জীবনে সফল হওয়ার গল্প | সফল হওয়ার গল্প

কষ্টের জীবনে সফলতার গল্প

কষ্টের জীবনে সফলতার গল্প

মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে বিবেক, খুব শান্ত আর ভদ্র। বুক ভরা স্বপ্ন তার একদিন সফল হবে। বাবা স্বপনের পেশা বলতে ওই অটো চালানো। আটোটা স্বপনের নিজের নয়। মালিক প্রতিদিন অটো চালানোর জন্য মজুরি দেয়‌। একদিন যেতে না পারলে কাটা যায় টাকা। বাড়ির পাশের ছোট ক্ষেতে চাষ হয় ধান আর সব্জি, সেসব দেখাশোনা করে স্বপনের স্ত্রী রমা। মাঝে মাঝে লেখাপড়ার ফাঁকে সাহায্য করে বিবেক মাকে। স্বপনের দুই ছেলে মেয়েই লেখাপড়া করে। বিবেক কলেজে পড়ে, আর বোন অনু স্কুলে। দুজনেই বেশ মেধাবী। তাই সারাদিন কাজের শেষে স্বপন যখন ক্লান্ত হয়ে ফিরে দেখে ছেলেমেয়েরা পড়ছে, মনে তৃপ্তি পায় সে।


বিবেকের স্বপ্ন একজন আই এ এস অফিসার হওয়ার‌‌।তাই মন দিয়ে পড়াশোনা করে,আর সময় পেলে ক্ষেতের কাজও করে। পড়তে বসে নিজে পড়ে বোন অনুকেও পড়ায়। এইভাবে দিনগুলো বেশ কেটে যাচ্ছিল। পাড়ার লোক মাঝে মাঝে স্বপনকে বলে-"আর কতোদিন অটো চালাবি রে স্বপন? এবার ছেলেকে বল সংসারের হাল ধরতে।"

স্বপন হাসি মুখে বলে-"ছেলে তো আমার পড়ছে।"

প্রতিবেশীরা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে-" বিবেকের বয়সী ছেলেরা বেশী লেখাপড়া শেখেনি তো কি হয়েছে? দ্যাখ বাপের পাশে দাঁড়িয়ে খেটে ইনকাম করছে কেমন। আর তোর ছেলে তো খালি পড়েই যাচ্ছে রে!"

স্বপন এসব কথা মনে নেয় না। ও বোঝে বিবেককে নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য অনেক লেখাপড়া করতে হবে, তার জন্য ওকে সময় দিতে হবে। বিবেককেও এরকম কথা প্রায়ই শুনতে হয়।


মা রমাকেও অনেক সময় মেয়েরা খোটা মেরে বলে-"এবার ঘরে বৌ আনো দিদি। কতোদিন আর একা একা খাটবে?"

রমা হেসে বলে-"আমার একমাত্র বৌমা খাটতে যাবে কেনো? আর সময় হলে বৌমা ঠিক আনবো।"

এক সময় বিবেকের কলেজের পড়া শেষ হল। কিন্ত হঠাৎ ঘটে গেলো দুর্ঘটনা। লড়ির সাথে অটোর ধাক্কায় চিরদিনের মতো হাঁটার ক্ষমতা হারালো স্বপন। সংসারে নেমে এলো ঘোর দুর্দিন। সংসারটা বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো বিবেক। বাবার অটোর মালিকের সাথে কথা বলে অন্য একটা অটো চালিয়ে রোজগার করার সিদ্ধান্ত নিলো সে।


এখন রোজ সকাল সকাল উঠে অটো নিয়ে লাইনে দাঁড়ায় বিবেক। সন্ধ্যে বেলা বাড়ি ফিরে মুড়ি খেয়েই বইখাতা নিয়ে পড়তে বসে সে, তারপর পড়তে থাকে।কখনো কখনো সারারাত বিবেকের ঘরে জ্বলে আলো। ভোরের দিকে ছেলেটা একটু ঘুমোয় সারারাত পড়ে, তাই সাতসকালে ছেলেটাকে ডাকতে ইচ্ছে করে না রমার কিন্ত উপায়ও যে নেই। বেরোতে হবে তাড়াতাড়ি, মালিকের হুকুম। কখনো কখনো দেখা যায় রাতের বেলা চাঁদের আলোয় ক্ষেত থেকে মাথায় করে ধান বয়ে বাড়িতে আনছে বিবেক। দিনের বেলা সময় পায় না যে সে। গ্ৰামের লোক বলে-"কি হল এতো লেখাপড়া করে? সেই বাপের মতো দিনমজুর হলি তো শেষমেশ!"

বিবেক উত্তর দেয় না।


বিবেক কিন্তু ওর স্বপ্নকে ভুলে যায়নি। যখন অটো লাইনে থাকে, বই খুলে মন দিয়ে পড়ে সে। বাকি অটো চালকরা আড্ডা মারে আর তাস খেলে যখন, বিবেক তখন মন দিয়ে পড়ে, কেউ বিবেককে বিরক্ত করে না। নম্র ভদ্র স্বভাবের জন্য সবাই তাকে ভালোবাসে। তারা যথাসম্ভব সাহায্য করে বিবেককে। মাঝে মাঝে ওরা বলে বিবেকের মতো ছেলে যেনো ঘরে ঘরে জন্মায়।


অটোর মালিকের সাথে কথা বলেছে বিবেক, যে ও সপ্তাহে একদিন একবেলা অটো চালাতে পারবে না। কারণ জিজ্ঞেস করলে বিবেক জানিয়েছে ওই সময়ে সে তার চাকরীর প্রস্তুতির জন্য পড়তে যাবে। মালিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছে বিবেকের দিকে। তার জেদ আর লেখাপড়ার ইচ্ছা দেখে রাজী হয়েছে সে। মনে মনে ভেবেছে এতো টিউশন দিয়ে,টাকা খরচ করেও যে সে নিজের ছেলেটাকে শিক্ষিত করতে পারেননি।


মাঝে মাঝে খুব দুঃখ প্রকাশ করে স্বপন বলে-"বাবা আমার এরকম অবস্থা না হলে তুই ঠিক তোর স্বপ্ন পূরণ করতে পারতিস।"

 বিবেক বলে আমি হাল ছাড়িনি বাবা। আমি এখনো লেখাপড়া করছি। টিউশনে গিয়ে বিবেক শুধু মন দিয়ে বোঝে স্যারের পড়ানো, কারো সাথেই তেমন কথা বলে না। একদিন অটোর প্যাসেঞ্জার হয়ে এলো বিবেকের দুই সহপাঠী। তারা তো অবাক তাদের সাথে পড়া ছেলেটা কিনা অটো চালায়! পরের দিন পড়তে গিয়ে দেখলো পুরো ব্যাচে খবরটা ছড়িয়ে গেছে। পুরো ব্যাচে বিবেকের পরিচিতি হল বন্ধু নয়, অটো ড্রাইভার হিসাবে। আস্তে আস্তে মজার খোরাকে পরিণত হল বিবেক। সবাই বলতো অটো ড্রাইভারের আবার আই এ এস হবার শখ! আরো নানান খারাপ মন্তব্য। বিবেক কষ্ট পেলেও মুখে প্রকাশ করতো না কখনো, এইভাবে একটা বছর কেটে গেলো


আজ বিবেকের স্বপ্নের পরীক্ষা। মালিককে বলে ছুটি নিয়েছে সে। আগের দিন সব অটো ড্রাইভার শুভ কামনা জানিয়েছে তাকে। পরীক্ষা বেশ ভালোই হয়েছে বিবেকের। একটার পর একটা ধাপ অতিক্রম করে এখন সে ফাইনাল রেজাল্টের অপেক্ষায়। আজকাল আনমনা লাগে তাকে খুব। সে কি তাহলে পারবে বাবা মা আর নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে? ঠিক তাই। সমস্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিবেক আই এ এস অফিসারের চাকরিটা পেয়ে গেলো। বিবেকের বাবা মায়ের চোখে জল। ওর একাগ্ৰতা আর স্বপ্নপূরণের দৃঢ় ইচ্ছা সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করেছে। জীবনে হার মেনে পিছিয়ে আসেনি ও। লক্ষ্য ঠিক রেখে গেছে নিজের। চরম দারিদ্রতাও রুখতে পারেনি তাকে, আসলে ইচ্ছাশক্তিটাই আসল জীবনের।


খুশির খবরে মেতে উঠেছে অটো স্ট্যান্ডের সমস্ত লোকজন। চাঁদা তুলে আজ তারা সবাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। তাদের সকলের প্রিয় বিবেক আজ সফল হয়েছে যে। তারা আজ ভীষণ ভাবে গর্বিত, খুশি। প্রত্যেকে চাইছে বিবেকের মতো একজন সন্তান। গ্ৰামের লোকজন বিবেকের বাড়ি এসে বলে যাচ্ছে ধন্য তুমি বিবেকের মা, রত্ন জন্ম দিয়েছ তুমি। একদিন এই মানুষ গুলোই বিরুদ্ধাচরণ করেছিল বিবেকের লেখাপড়া শেখার। আজ তাদের মুখে প্রশংসা কারণ আজ বিবেক সফল। ব্যর্থ হলে হয়তো শুনতে হতো অন্য কিছু।


-শ্রাবন্তী_মিস্ত্রী


সমাপ্ত