স্বামী স্ত্রীর শিক্ষামূলক গল্প | স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা

 স্বামী স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক

স্বামী স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক

একটা মেয়ে যতো উচ্চ শিক্ষিতই হোক তার মধ্যে কুসংস্কার থাকবেই। এর উত্তম উদাহরণ হলো আমার স্ত্রী।

  

  স্ত্রীর কথা বলার আগে নিজের কথা একটু বলি।


  পেশায় আমি একজন ডাক্তার। আর আমার স্ত্রী একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমেরিকা থেকে পড়াশোনা করেছে সে। অথচ ওর মধ্যে অদ্ভুত সব কুসংস্কার রয়েছে। 


  একটা ঘটনা বলি। একদিন আমি আর আমার স্ত্রী প্রাইভেট কারে করে বাড়ি ফিরছিলাম। আমাদের বাড়ির পাশে বস্তির মতো একটা জায়গা রয়েছে। সেই বস্তির মুখে একজন বৃদ্ধ মানুষ বোতলে করে পানি বা তেল জাতীয় কিছু জিনিস বিক্রি করে। লোকটি দাবি করে তরল জিনিসগুলো সাধারণ জিনিস নয়। ওগুলো স্বপ্নে পাওয়া মহৌষধ।


  আমাদের গাড়ি যখন লোকটির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো, স্ত্রী তখন ড্রাইভারকে বললো গাড়ি থামাতে। 

  গাড়ি থামলে সে নামলো। তারপর বৃদ্ধটির কাছে গেলো। 


  বৃদ্ধটি আমার স্ত্রীকে দেখে উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগলো,"মা, এগুলো স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ। সাধারণ জিনিস না। যে কোনো ব্যথা বেদনার উপর মালিশ করলে নিমিষে ব্যথা ভালো হয়ে যাবে। আমি মিথ্যা বলতেছি না।..."


  লোকটি আরো হাবিজাবি কথা বলতে লাগলো। আর আমার স্ত্রী আগ্রহ নিয়ে লোকটির কথা শুনতে লাগলো। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে সে কয়েক বোতল ঐ তরল জিনিসগুলো কিনে ফেললো। 


  ড্রাইভার পর্যন্ত অবাক হয়ে গেলো আমার স্ত্রীর কাণ্ড দেখে। ড্রাইভারের সামনে স্ত্রীকে কিছু বললাম না। নিজেকে কোনো রকমে সামলালাম। 


  কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই বললাম,"এসবের মানে কী?"

  সে বললো,"কোনটার মানে?"

  ওর হাতে ধরা বোতলগুলো দেখিয়ে বললাম,"এগুলো কেনো কিনেছো?"

  উত্তরে বললো,"চিন্তিত হতে হবে না। এগুলো তোমার জন্য কিনি নি।"

  "তোমার ব্যবহারের জন্য কিনেছো? এখন থেকে কি স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ ব্যবহার করবে? এতো পড়াশোনা করে এই শিখেছো! তোমার স্টুডেন্টদেরকেও কি স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ ব্যবহার করতে শেখাবে? ডাক্তার হিসেবে সমাজে আমার একটা সম্মান আছে। লোকে যদি জানে আমার স্ত্রী স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ ব্যবহার করে, তাহলে আমি কি পরিমাণ হাসির পাত্রে পরিণত হবো, তুমি কি বুঝতে পারছো?"


  সে আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। কিন্তু আর কিছু না বলে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো। 


  যে ভয়টা পেয়েছিলাম ঠিক তাই হলো।

  দুদিন পর হাসপাতালের এক সহকর্মী ডাক্তার হাসতে হাসতে আমাকে বললো,"ডাক্তার সাহেব, গতকাল আপনার উচ্চ শিক্ষিত স্ত্রীকে দেখলাম, সাপুড়েদের কাছ থেকে গাছের শেকড় কিনছে। আপনাদের বাসায় সাপের উপদ্রব আছে নাকি? ভাই, কাল ডিউটিতে আসার সময় আপনার স্ত্রীর কাছ থেকে দু একটা শেকড় বাকড় আমার জন্য নিয়ে আসবেন। শুনেছি ওগুলো সাথে থাকলে সাপ কাছে আসে না।" 


  বলে হাসতে হাসতে ভেঙে পড়লো। 


  সেদিন বাসায় এসে স্ত্রীর সাথে তুমুল বাজে আচরণ করলাম। সবার সামনে সে আমাকে ছোটো করছে এসব বললাম। সে জবাবে কিছু বললো না। শুধু ব্যাগ গুছিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেলো। 


  পরে বাবা জানতে চাইলেন কী নিয়ে আমাদের সমস্যা হচ্ছে। 

  বললাম,"ও আমার মান সম্মান সব শেষ করে দিচ্ছে। ও স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ এবং সাপ থেকে বাঁচার জন্য গাছের শেকড় বাকড় ব্যবহার শুরু করেছে। সবাই হাসাহাসি করছে এসব নিয়ে। এমন মেয়েকে নিয়ে কী করে সংসার করা যায়?"


  বাবা খানিক চুপ থেকে বললেন,"এই ব্যাপারটা তোর মায়ের মধ্যেও ছিলো।"

  সঙ্গে সঙ্গে বললাম,"মা অল্প পড়াশোনা করা গ্রামের মেয়ে ছিলেন। তিনি এসব কুসংস্কার মানবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে কী করে এসব ফালতু জিনিস মানতে পারে? আসলে মেয়ে মাত্রই কুসংস্কারাচ্ছন্ন। শিক্ষিত অশিক্ষিত কিছু যায় আসে না।"


  বাবা ধমকে বললেন,"বেশি বুঝিস তুই। আগে আমার কথা শোন। তারপর কথা বলবি।"

  আমি চুপ হয়ে গেলাম। 

  এরপর বাবা বললেন,"প্রথম দিকে তোর মতো আমিও তোর মায়ের ওপর ক্ষেপে গিয়েছিলাম এসব কারণে। পরে বুঝলাম, তোর মা ঐ জিনিসগুলো ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কিনতো না। কিনতো দরিদ্র মানুষগুলোকে আর্থিক সাহায্য করার জন্য। আমি নিশ্চিত তোর বউও সেজন্যই এসব কেনে।"


  বাবার কথা শুনে ধাক্কার মতো খেলাম। এই ব্যাপারটা মাথায় আসে নি। 

  না বুঝে স্ত্রীর সাথে বাজে আচরণ করেছি। ওর কাছে এখনই ক্ষমা চাওয়া উচিত। ওকে ফিরিয়ে আনার জন্য দ্রুত ঘর থেকে বেরুনোর সময় সিঁড়িতে পা হড়কে পড়ে গেলাম। এতে টাকনুতে প্রচণ্ড আঘাত পেলাম। মুহূর্তে পা ফুলে গেলো। এবং হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। কোনো রকমে লেংচে লেংচে রুমে এলাম। ব্যথা বেড়ে জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা হলো। চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। এই আচ্ছন্ন দশায় চোখে পড়লো টেবিলের কোণে রাখা স্ত্রীর কেনা স্বপ্নে পাওয়া মহৌষধগুলো। ওগুলো যে ভুয়া তা আমি জানি। তবু প্রচণ্ড ব্যথায় এক অদ্ভুত ঘোরের কারণে চিন্তাভাবনাহীন ভাবে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। এবং কোনো রকমে একটা বোতল খুলে কিছু তরল হাতে নিয়ে পায়ে দিতে লাগলাম। এর পরই জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।


  পরদিন ভোরে জ্ঞান ফিরলে আশ্চর্য হয়ে দেখলাম পায়ে কোনো ব্যথা নেই। কোনো ফোলা নেই। কীভাবে এই ঘটনার ব্যাখ্যা করবো জানি না। তবে কি স্বপ্নে পাওয়া ওষুধগুলো সত্যি ছিলো? 


  বাবা তখন ফজরের নামাজ পড়ে বাসায় ঢুকলেন। ছুটে গিয়ে বাবাকে আশ্চর্য ঘটনাটির কথা বললাম।

 

  শুনে বাবা শান্ত গলায় বললেন,"স্বপ্নে পাওয়া ওষুধের কারণে এই আশ্চর্য হয় নি। এটা হয়েছে তোর স্ত্রী বৃদ্ধ লোকটির প্রতি যে মায়া অনুভব করেছিলো, এবং কেনার অজুহাতে তাকে যে সাহায্য করেছিলো তার জন্য। ভালো কাজের পুরষ্কার আল্লাহ দিয়েছেন।"


  তৎক্ষণাৎ সব পরিষ্কার হয়ে গেলো।

  এরপর করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে এলাম।

  এবং বললাম,"তুমি আমাকে গভীর ভাবে ভাবতে শেখালে। মা যেমন বাবাকে গভীর ভাবে ভাবতে শিখিয়েছিলেন।"


  এরপর এক ছুটির বিকেলে স্ত্রীকে নিয়ে পার্কে হাঁটছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়লো পার্কের এক জায়গায় এক রুগ্ন বয়স্ক মানুষ ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আংটি বিক্রি করছিলো। লোকটির চেহারায় রয়েছে ক্লান্তি এবং বিষণ্ণতা। কারণ কেউ তার আংটি কিনছিলো না। না কেনারই কথা। কেননা, যে নিজের ভাগ্য বদলাতে পারে নি, সে কী করে অন্যের ভাগ্য বদলাবে? 


  আমি লোকটির কাছে গিয়ে বেশ কয়েকটা আংটি কিনে ফেললাম। সাথে সাথে রুগ্ন মানুষটির মুখে প্রাণ ফিরে এলো। হয়তো পরিবারের সবার রাতের খাওয়ার খরচটা উঠে এলো।

  

  দৃশ্যটি দেখে স্ত্রী খুশি হলো। 

  বললো,"সুন্দর একটা কাজ করেছো।"


  তবে এরপর সে যা করলো তা ছিলো আরো সুন্দর। 

  সে আমার হাত থেকে ভাগ্য পরিবর্তনের আংটিগুলো নিয়ে পার্কে এলোমেলো ঘুরতে থাকা পথশিশুদের হাতে পরিয়ে দিলো। রঙ্গিন আংটিগুলো পেয়ে তারা বেশ আনন্দিত হয়ে উঠলো। এবং খিলখিল করে হাসতে লাগলো।


  তাদের আনন্দের দিকে তাকিয়ে স্ত্রী উচ্চারণ করলো,"হে আল্লাহ, এদের ভাগ্য বদলে দাও।"


  উত্তরে বললাম,"আমিন।"