কষ্টের ভালোবাসার গল্প | অবহেলার কষ্টের গল্প

 বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

☞তেরো_বছরের_সংসার

☞বারো_বছরের_পরকীয়া 

বিয়ের ১৩ বছর পর জানতে পারলাম, আমার স্বামী পরনারীতে আসক্ত। 


সে রাতটা ছিল ঈদের রাত। সে বাইরে থেকে এসে ফ্রেশ হবার জন্য ওয়াশরুমে ছিল, আর আমি খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে, তাকে সালাম করার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কারন প্রতি ঈদে তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি, সেই ১৩ টা বছর ধরে। রাত আনুমানিক ১২.৩০, আমি বসে আছি, এসময় হঠাৎ তার ফোনে রিং বেজে উঠল, দেখলাম, আননোন নাম্বার, পিক করলাম না আননোন নাম্বার দেখে। রেখে দিতে যাবো, এমন সময়ে মেসেঞ্জারে টুং করে শব্দ হলো।


সচরাচর আমি তার মেসেঞ্জার চেক করি না, কিন্তু সেইসময় ফোনটা যেহেতু হাতেই ধরা ছিল, মেসেজটা দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। 

যা দেখলাম, তাতে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আমার স্বামী ১২ বছর ধরে একটা মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িত। 

সেখানে সব লেখা আছে, তারা কবে কোথায় দেখা করেছে, তার দেয়া গেন্জি পরে, আজ তার সাথে দেখা করে এসছে।

সব, সবটাই লেখা আছে।


আরেকটা কথা বলা হয়নি, আমরা ৪ বছর প্রেম করে পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে করি, আমাদের সংসারে দুটো সন্তান রয়েছে। 


আমি ও আমার স্বামী দুজনেই শিক্ষিত, আমি চাকুরীজীবি, আমার স্বামী তেমন কিছু করে না, ফ্যামিলি বিজনেস দেখাশোনা করে, তার বাবার অঢেল সম্পত্তি ছিল, সে নেশাগ্রস্ত, নেশা করতে গিয়ে প্রায় ২ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করে।


যাই হোক সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তার সবটাই মেনে নিয়েছিলাম, তাছাড়া প্রচন্ড ভালবাসতাম তাকে, ভাবতাম, একসময় সে নেশার জগত থেকে ফিরে আসবেই।


কিন্তু, এখন দেখছি, একটা মেয়ের সাথেও জড়িত, মেয়েটি একজন মাদক ব্যবসায়ী, সেই সাথে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকের আয়া। অনেকে অনেক সময় এসে বলতো আমাকে এই মেয়ের কথা, কিন্তু স্বামীর প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর ভালবাসা ছিল বলে, কোনদিন বিশ্বাস করিনি।


যায় হোক, বাস্তব নির্মম সত্যিটা আজ আমার সামনে, যেটা ভয় পেতাম সেটাই হলো!!


তারপর আমি কি করলাম? আমি........


তারপর আমি কি করলাম? আমি তার ফোনটা যথাস্থানে রেখে দিলাম। সে ওয়াশরুম থেকে বের হলে, তাকে খেতে দিলাম, আমি তেমন কিছু খেলাম না।তার খাওয়া শেষ হলে, তাকে রুমে ডাকলাম, বললাম, তোমাকে কিছু বলতে চাই, সত্যি সত্যি উত্তর দেবে, কোনকিছু অস্বীকার করবে না, কারন আমি সবকিছু জানি।


সে বলল, বলো!

আমি বললাম, কোন মেয়ের সাথে কি তোমার সম্পর্ক আছে?

আমি তখন কেবল আল্লাহ্কে ডাকছিলাম, যেন বলে সব মিথ্যা, কারন তার মুখ থেকে এটা আমি সহ্য করতে পারব না।

সে বলে, হ্যাঁ, আছে। তবে আজকের পর থেকে আর থাকবে না।

আশ্চর্য হয়ে গেলাম, কি রকম অবলীলায় সে স্বীকার করে নিল! আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল, কোনমতে জিজ্ঞেস করলাম, আজ থেকে ঠিক বারো বছর আগে তোমার ফোনে একটা মেয়ের ম্যাসেজ দেখেছিলাম, সেই মেয়েটাই কিনা!

সে বলল, হ্যাঁ, সে মেয়েটাই।

আমার চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। নিজেকে কোনমতেই সামলাতে পারলাম না।

তবুও যতোটা সম্ভব ঠান্ডা হয়ে, তার ফোনটা নিয়ে, তার সামনেই মেয়েটাকে ফোন দিলাম, তখন রাত প্রায় ২ টা বাজে।

রিং হতেই ওপাশ থেকে একটা ছেলে ফোন ধরলো, বললাম, এটা কি নাদিরার নাম্বার! 

লোকটা বলল, হ্যাঁ।

বললাম, আপনি কে?

বলল, আমি তার স্বামী। 

বললাম, আপনি কি জানেন, আপনার বউ একজনের সাথে প্রেম করে, নাকি নিজের বউকে বিক্রি করে দিয়েছেন?

লোকটা বলল, কি যা তা বলছেন!!

এটা বলতেই আমার হাজবেন্ড, আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে আছাড় মেরে ভেঙে চুরমার করে ফেললো, আর আমাকে দুইটা লাত্থি মেরে বিছানা থেকে নিচে ফেলে দিল।


আমি কিছু না বলে,আস্তে করে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম।

চলে গেলাম রান্নাঘরের দিকে, সেসময় মনে হয় কাঁদতে ভুলে গিয়েছিলাম, বুকটা পাথর, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম।

মনে পড়তে লাগলো সেই সব পুরনো দিনের কথা। সেসময় কলেজে পড়তাম। আমি শহরে কলেজের হোস্টেলে থাকতাম। খালাতো ভাইয়ের ফ্রেন্ড ছিল সে। সেখান থেকেই পরিচয়। চার বছর প্রেম। একটা দিনও আমাকে না দেখে থাকতে পারতো না। প্রতিদিন দেখা হতো আমাদের। কলেজ ছুটি হলে, আমি গ্রামের বাড়ি গেলে, আমাকে বাসা পর্যন্ত রেখে আসতো। মাঝে মাঝে আমাকে এক নজর দেখার জন্য আমাদের গ্রামের বাড়িতে ছুটে যেতো ৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে। 

একসময় দেখলাম, দুজন দুজনকে ছেড়ে থাকতে পারছি না।পারিবারিক সম্মতিতে হঠাৎ করেই বিয়ে হয়ে গেল।

দুজনের মতো সুখী কেউ ছিল না সেদিন।

এই তেরোটা বছরে, আমি একটা দিনও তাকে ছাড়া ঘুমাইনি।

আমি বাবার বাসায় যেতাম না, গেলে দুদিন থেকেই চলে আসতাম। 

কারন, তার হাতটা ছিল আমার বালিশ। তার বুকে মাথা না রাখলে, কিছুতেই ঘুমটা আসতো না।

সে রাত করে বাসায় ফিরতো, আমি তার জন্য বসে থাকতাম।সে আসলে একসাথে খেতাম।


আমার দুটো বাচ্চায় সিজারিয়ান। ওটিতে ঢোকার আগ মূহুর্তে তার সে কি কান্না।

এই তেরোটা বছরে আমাকে কোনদিন অবহেলা করেনি।

আমি যা চেয়েছি, তাই এনে দিয়েছে, আমি যা করতে বলেছি, তাই করেছে।

খারাপ অভ্যাস ওই একটাই ছিল। মাদকাসক্তি। বোঝাতাম তাকে, ভেবেছিলাম, সেটাও আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।


আমি সারাক্ষণ আমার বাচ্চা আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। সংসারের প্রতি তার কোনদিনই মনোযোগ ছিল না, বাজার করা থেকে, রান্না করা, সংসার সামলানো, বাচ্চাদের স্কুল সবটাই আমাকে একাই সামলাতে হতো। তবুও ভাল ছিলাম, সুখী ছিলাম।

বাসার প্রত্যেকটা কোনা আমার নিজ হাতে সাজানো।


আমার সেই ভালবাসার মানুষটা কি করে আমার সাথে প্রতারণা করতে পারলো, যাকে ছাড়া আমি আমার জীবনের একটা দিনও কল্পনা করতে পারি না, সে শুধুই ঠকিয়ে এসছে আমাকে।


আমি আর কিছুই ভাবতে পারলাম না। মৃত্যুর পথ বেছে নিলাম।

অন্য রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে, ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে পড়লাম।


তারপর, দরজা ভেঙে আমার হাজবেন্ড আমার গলা থেকে পেঁচানো ওড়না খুলেই আমার গালে ঠাস ঠাস করে ২টা থাপ্পড় বসিয়ে দিল। আমি ২ সপ্তাহ কানে শুনতে পাইনি। সেদিন সে আমাকে স্যরি বা জড়িয়ে না ধরে থাপ্পড় কেন মারল, তা আমার আজও বোধগম্য নয়। কান্নাটা ছিটকে বের হতে চাইল কিন্তু, আঁটকে যাচ্ছিল হয়তোবা অপমান আর অভিমানের চাপে, শুধু দুচোখ দিয়ে অশ্রু আর বুক থেকে হেঁচকি উঠে আসছিল।


যায় হোক, দরজা ভাঙার শব্দে আমার শ্বাশুড়ি আর আমার পাঁচ বছরের ছোট বাচ্চাটা জেগে গেল। আমার বাচ্চাটা জেগেই কান্না শুরু করে দিলো। বাচ্চার কান্না দেখে, বুকে জড়িয়ে নিলাম। শ্বাশুড়ি সব শুনে কিছুক্ষণ থ হয়ে বসে থাকল, তারপর আমাকে ছেলের পক্ষ হয়ে বুঝাতে শুরু করলো। 

বলল, বাচ্চা কাঁদছে, তাকে নিয়ে শুয়ে পড়ো।

প্রায় ভোর হয়ে আসলো, শুয়ে পড়লাম। 


সেদিন থেকে আমার খাওয়া, ঘুম সব কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

আমি সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, আর সেই মেয়ে একজন অশিক্ষিত আয়া। আমি কি করে এতোবড় অপমান সহ্য করবো।


তাকে সারাক্ষণ জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, সেই মেয়ের সাথে তোমার কতোদূর সম্পর্ক। কি করেছো তার সাথে, কতোবার তার হাত ধরেছো, কতোবার তাকে জড়িয়ে ধরেছো, কতোবার তাকে ফোন করতে, তাকে কি কি গিফট করেছো, কোথায় কোথায় দেখা করেছো, কোন কোন রেস্টুরেন্টে দেখা করেছো, কোন পার্কে বসেছো, তাকে কতোবার ভালবাসি বলেছো ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন করতাম সারাক্ষণ। 


সে আমার প্রতি বিরক্ত হতে লাগলো আস্তে আস্তে। আর আমি ধীরে ধীরে মানসিক রুগী হতে লাগলাম।একদিন আমার এক আত্মীয় মারা যাওয়ায়, আমার আব্বু আম্মু ভাই বোন বাসায় আসলো।


সেদিন রাতে সে বাহির থেকে আসলে, আমি তাকে বললাম, আমি ঐ মেয়ের সাথে কথা বলতে চাই। আমি ঐ মেয়ের কাছে যেতে চাই। 

সে বলল, ঐ মেয়ের কাছে গেলে তোমাকে সতীনের সংসার করতে হবে।

তা শুনে, আমার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেল।

আবারও দরজা বন্ধ করে, আমার নিজের গায়ে আমি আগুন ধরিয়ে দিলাম।

আবারও আমাকে দরজা ভেঙে বের করলো, গায়ে পানি ঢেলে আগুন নেভালো।

কিন্তু আমাকে ঐ অবস্থায় রেখে, সে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।

আমার শ্বাশুড়ি আমাকে বলল, তোমার প্রতিদিনের নাটক আর ভাল লাগে না, তোমার জন্য আমার ছেলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল, যাও যেখান থেকে পারো আমার ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। রাত তখন ১ টা বাজে।


আমার ছোট ননদ, তার জামাই, চাচা শ্বশুর, চাচী শ্বাশুড়ি আরও অনেকে বাসায় চলে আসলো।


আমার ছোট ননদ সবার সামনে আমাকে বলল, ছেলেরা দশজনের সাথে প্রেম করলে কিছু হয় না, কিন্তু মেয়েমানুষ স্বামীর সাথে ঝগড়া করলে, তাকে বলে বেশ্যা।

 আমি রীতিমতো হিজাবী, অথচ আমার ননদ আমাকে বানিয়ে দিল বেশ্যা।


যায় হোক, সেই রাতেই শ্বাশুড়ির কথা মতো ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম তাকে খুঁজতে। 


তার কিছু ফ্রেন্ডের কাছে ফোন করে, তার খোঁজ পেলাম, সে কিছুতেই বাসায় আসবে না, তাকে স্যরি বলে, বললাম, আর ঐ মেয়েকে নিয়ে কোন কথা বলব না, বাসায় চলো।

অনেক বুঝিয়ে রাত প্রায় ২ টায় বাসায় নিয়ে আসলাম।

সব আত্মীয় স্বজন বুঝাতে লাগলো, কি করবা, দুটো সন্তান আছে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে, সব মেনে নাও, বাচ্চা দুটোকে মানুষ করো।


আমি কোন কথা না বলে, শুয়ে পড়লাম। সবকিছু আগের মতো, সংসার বাচ্চা, তাদের স্কুল।


কিন্তু, ভেতরের আগুনটা কিছুতেই নেভে না। একদিন ডিসিশন নিলাম, তার সাথে আর থাকবো না, শুধু নিজের সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে এই বাসা থেকে চলে যাবো। তাঁর বাচ্চাদের সে, একা মানুষ করুক, এটাই তার শাস্তি।


কিন্তু আমি মা, বাচ্চাদের ছেড়ে যাবো ভাবতেই দুচোখ জলে ভরে আসে। সিদ্ধান্ত নিলাম, ছোট বাচ্চাটাকে সাথে নিবো, ঢাকায় আমার এক ফ্রেন্ড থাকে, আপাতত তার বাসায় কয়েকটা দিন থেকে, একটা চাকরি যোগাড় করে নেবো।

একটা ছোট ব্যাগ, আমার সার্টিফিকেট আর আমার ছোট বাচ্চা এসব নিয়েই রওনা হলাম, অজানা পথের উদ্দেশ্যে। 

☞সত্য ঘটনা অবলম্বনে...

আমি কাউকে কিছু না বলে, আমার পাঁচ বছরের বাচ্চাকে নিয়ে ঢাকার বাসে উঠে পড়লাম।


বাসে ওঠার কিছুক্ষণ পরেই, সবার কল আসতে লাগলো। ফোনটা কিছুসময় অফ করে রাখলাম, শুধু ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলাম, আজ থেকে আমি কারও নই, কেউ আমাকে খুঁজবে না।

কিন্তু, আমার বাচ্চাটা গাড়িতে ওঠার পর থেকেই কাঁদতে লাগলো, বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো,আমাকে তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছো! বললাম, আমরা বেড়াতে যাচ্ছি। 

সে বলতে লাগল, আমি যাবো না, আমি বাসায় যাবো, আমার আব্বুর কাছে যাবো, আমার দাদীর কাছে যাবে, আমি আমার ভাইয়ার সাথে খেলবো।

ওর কান্না দেখে আমিও চোখের পানি আটকাতে পারলাম না।

কাঁদতে কাঁদতে একসময় আমার ছেলে ঘুমিয়ে পড়ল।

ফোনটা খুললাম, সবাই কল করছে, আব্বু, আম্মু, ভাই, বোন, শ্বাশুড়ি, হাজবেন্ড। 

কারও ফোন পিক করলাম না। বারবার কল দিয়েই যাচ্ছে। শুধু ছোট বোনের ফোনটা রিসিভ করে বলে দিলাম, আমি ভাল আছি, আব্বু আম্মুকে টেনশান করতে নিষেধ করিস। তার এতো বড় অন্যায় মেনে নিয়ে তার সাথে, তার বাসায় থাকা সম্ভব না। বলেই, লাইনটা কেটে দিলাম। 

সারাটা রাস্তা চোখের পানিটা আটকাতে পারলাম না, বাসের লোকজন বারবার ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে আড়চোখে। 

তবুও নিজেকে সামলাতে পারছি না। মনের ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে, নিজের তিলতিল করে সাজানো সংসার, ভালবাসার মানুষ যাকে ছাড়া আমার ঘুম আসেনা, তাকে ছেড়ে, আমার আরেকটা সন্তান তাকে ছেড়ে, আমি থাকবো কেমন করে!

তবুও, আর কোন কম্প্রোমাইজ নয়, কিছুতেই তার বাসায় ফিরবো না আমি।

ঢাকায় পৌঁছে ফ্রেন্ডকে বললাম, কিছুদিন থাকবো, একটা চাকরী যোগাড় করে দিতে হবে। 

সে হেসে বলল, তা তোমার যতোদিন মন চায় থাকো, অভিমান কমলে, চলে যেও।

কিন্তু সমস্যায় পড়লাম আমার বাচ্চাকে নিয়ে। সে কেঁদেই চলেছে একইভাবে, কিছুতেই থাকবে না এখানে। সারাটাদিন কাঁদলো, কিছুই খাওয়াতে পারলাম না। একটানা কেঁদে যাচ্ছে। কি করবো, কিছুই বুঝতে পারছি না। বিকেলের দিকে আমার বাচ্চার মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে পড়ল।

আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হতে লাগলো, আমি কি নিজের জেদ বজায় রাখতে, আমার ছোট্ট বাচ্চার কচি মনে খুব বেশি আঘাত দিয়ে ফেলছি!


নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে লাগলো। এদিকে সবাই অনবরত কল করেই চলেছে। আমার হাজবেন্ড ম্যাসেজ দিয়েছে, তুমি ফিরে এসো, তুমি ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় গিয়েছো, তুমি যা বলবা তাই হবে, তুমি ফিরে এসো, আর না হয় বলো, কোথায় আছো, আমি নিতে আসছি।


এদিকে সন্ধ্যে হতেই আমার বাচ্চা নিস্তেজ হতে থাকল, আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম, ডাক্তারের কাছে নিতেই, ডাক্তার বলল, বাচ্চা যা চায়, তাই করুন, তা না হলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।


মা হয়তো দুনিয়ার সবচেয়ে বেহায়া প্রানী। বাচ্চাকে বললাম, চলো, বাবা, আমরা এখনই বাসায় ফিরে যাবো। সেদিনই রাতে বাসে উঠে পরদিন ভোরে বাসায় ফিরে আসলাম।


আবার সবকিছু আগের মতোই চলতে লাগলো, বাচ্চা, সংসার, বাচ্চাদের স্কল সবকিছু আগের মতোই।


এর মাঝে পেরিয়ে গেল কয়েক সপ্তাহ। কিন্তু আমি কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারলাম না। 

একদিন রাতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা তুমি কি ঐ মেয়েটাকে ভালবাসো!

সে বলল, ভালবাসতাম হয়তো।

বললাম, তাকে চিঠি লিখতে।

বলল, লিখেছি কয়েকটা!

বললাম, কি লিখতে? ভালবাসি?

বলল, হ্যাঁ, এমনটাই লিখতাম।

বললাম, তাকে জড়িয়ে ধরেছো?

বলল, ধরেছি, কয়েকবার।


তার এসব শুনে, আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল, একসময় অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

সকালে জ্ঞান ফিরলে সিদ্ধান্ত নিলাম, মেয়েটার সাথে দেখা করবো।

সেদিনই দুপুরে আমার এক দেবরকে সাথে নিয়ে মেয়েটা যে ক্লিনিকে চাকরী করে সেখানে গেলাম।

প্রথমে মেয়েটি আমার সাথে দেখা করতে চাইনি, পরে রাজী হলো।

মেয়েটিকে দেখে আরও অবাক হলাম, আমার হাজবেন্ড যে কিনা মাশাল্লাহ লম্বা, স্মার্ট, হ্যান্ডসাম, এক কথায় সুন্দর, সুপুরুষ, সে কিনা এরকম কুচকুচে কালো, খাটো একটা মেয়ের সাথে প্রেম করছে ১২ টা বছর ধরে। ছি!


শুনেছি, মেয়েটার পেছনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করসে, মেয়েটাকে বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে, ছেলের পড়ার খরচ সে দেয়, এমনকি মেয়েটার স্বামীকে হাতে রাখতে, একটা অটো রিকশাও কিনে দিয়েছে।


যায় হোক, মেয়েটাকে ডেকে বললাম, দেখো, আমার হাজবেন্ডের মতো লোকেরা তোমাদের মতো মেয়েদের কখনও বিয়ে করে ঘরে তুলবে না, শুধু তোমাদের ইউজ করবে। আর তুমি কেন আমার হাজবেন্ডের সাথে সম্পর্ক রাখছো তা আমি খুব ভালভাবে বুঝি।

তোমার যতো টাকা লাগে আমি দেবো, তোমার সংসারের সব খরচ আমি দেবো, তোমার ছেলের পড়ার খরচও আমি দেবো, তোমার যখন যা লাগবে আমি দেবো, আমি হাতজোড় করে মিনতি করছি, তুমি আমার স্বামীর জীবন থেকে, আমার জীবন থেকে সরে যাও, কারন আমি আমার স্বামীকে প্রচন্ড ভালবাসি, তাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না।


মেয়েটি হেসে বলল, আপনার টাকা আমার লাগবে না, পারলে নিজের স্বামীকে বেঁধে রাখেন। আর একটা কথা, আমি ইচ্ছে করলে, আজই আপনার স্বামীকে বিয়ে করতে পারি, আপনার স্বামী আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য, কিন্তু, আমি তা করবো না, কারন আমি আমার ছেলেকে খুব ভালবাসি, আর আমি তাকে নিয়েই থাকতে চাই। 


শুনে, আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল। হে আল্লাহ্, তুমি তোমার জমিনের মাটি একটু ফাঁক করে দাও, আমি তোমার জমিনে ঢুকে যায়।


ঘোরের মাঝে বাসায় চলে আসলাম। ভাবলাম, এ জীবনের কোন মূল্য নেই, এতোটা সহ্য ক্ষমতা আমার নেই। আমার কাছে পৃথিবীটা অর্থহীন মনে হলো।

আবারও সুইসাইড করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেদিন রাতে ৩০ টা ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিলাম। 


আস্তে আস্তে আমার শরীরটা নিস্তেজ হতে থাকল। দুচোখ বন্ধ হয়ে আসলো, শুধু আমার দুটো সন্তানের মুখ চোখের সামনে ভাসতে লাগলো।

হঠাৎ মনে হলো, আমি যদি আজ মরে যায়, কে দেখবে আমার সন্তানদের।


আমার ভাই তখন বাসায় ছিল, কোনরকমে তাকে ইশারায় ডেকে বললাম, আমি অনেকগুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিয়েছি, কি করবো এখন।


তারপর কি হলো জানি না। দুদিন পর চোখ মেলে দেখলাম, আমি হাসপাতালে, হাসলাম, মনে মনে, বেঁচে আছি এখনও। আমার দুই সন্তানকে দেখতে চাইলাম। তারা সামনে আসলে, বুকে জড়ালাম।


আবার সেই বাসায় ফিরে আসলাম। আব্বু আম্মু অনেকবার তাদের বাসায় নিয়ে যেতে চাইল। আমি যেতে চাইতাম না, কারন তাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না।


কিন্তু আস্তুে আস্তে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। কোন খাবার গলা দিয়ে নামতো না, আর দুচোখের ঘুম হারিয়ে গেল। সংসারের প্রতি, বাচ্চাদের প্রতি সব আকর্ষণ হারিয়ে গেল। কিছুই ভাল লাগে না, রান্না করি না, বাচ্চাদের দেখি না।

বেশিরভাগ সময় ওরা হোটেল থেকে খাবার কিনে খায়, বাচ্চার পড়া দেখিনা, পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ করতে লাগলো বাচ্চারা।


ধীরে ধীরে আমি মানসিক ভারসাম্য হারাতে লাগলাম। 

মেডিসিনের ডাক্তার, মানসিক ডাক্তার কোনটাই বাদ থাকলো না। এই ডাক্তার, ওই ডাক্তার কোন ডাক্তারই বাদ থাকলো না।

কিন্তু হায়! কোন ডাক্তার আমাকে সুস্থ করতে পারলো না, কোন ডাক্তারই কড়া কড়া ঘুমের ঔষধ দিয়েও আমার চোখে ঘুম এনে দিতে পারলো না, আমাকে খাওয়াতে পারলো না।


আমি আরও অসুস্থ হয়ে পড়লাম, বিছানা থেকে নামতে পারতাম না। আরও বড় বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো!

শুধু এটুকু খুুব ভালমতো মনে পড়ছে, ডাক্তার জিজ্ঞেস করতো, তোমার কি হয়েছে, মা, বলতো।

আমি বলতে বলতে কেঁদে ফেলতাম, আর আমার সাথে সাথে ডাক্তারও চোখের পানি আটকাতে পারতো না।


এভাবে কেটে গেল, কয়েক মাস......

.

আস্তে আস্তে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম,

মানসিক ভারসাম্য হারাতে বসলাম, কিছুই

ভাল লাগে না, সন্তানরা কাছে আসলেও

বিরক্ত লাগে।

আমার হাজবেন্ড আমাকে নানাভাবে সুস্থ

করতে চেষ্টা করতো, বাইরে নিয়ে যেতো,

যেসব আমি পছন্দ করতাম, যেমন, গভীর

রাতে নদীর ধারে যাওয়া, ফুটপাতের

দোকানে বসে চা খাওয়া, রাস্তায়

দাঁড়িয়ে থেকে ফুচকা খাওয়ানো।

কিন্তু কোন কিছুতেই আমার মন ফেরাতে

পারলো না।তাকে আজও প্রচন্ড ভালবাসি,

কিন্তু তার কাছে যেতে গা ঘিনঘিন

করতো। তার মুখের দিকে তাকালে ঐ

মেয়েটার মুখটা ভেসে উঠতো।

ঠিক এমন একটা অবস্থায়, আমার সমবয়সী

একজন দেবর ছিল, সে মাঝে মাঝে আসতো।

খুব মজার মানুষ ছিল। আমার বাচ্চাদের খুব

ভালবাসতো।

ও খুব সহজেই মানুষকে হাসাতে পারতো।

তাই একদিন আমার হাজবেন্ড ওকে বলল,

তোর ভাবী তো কারও সাথে তেমন কথা

বলে না, দেখতো, তুই গিয়ে হাসাতে

পারিস কিনা।

ও আমার রুমে গেল, আমার সাথে অনেক

কথা বলল। কেন যেন ওর সাথে কথা বলে

মনটা অনেক হালকা হয়ে গেল। আমাকে

অনেক বুঝালো, বলল, ভাবী, ভাইয়া শুধু

আপনাকেই ভালবাসে, ঐ মেয়ের বাসায়

আমরাও যেতাম, আপনি সব ভুলে যান তো,

শুধু শুধু ভাইয়াকে ভুল বুঝছেন।

ছেলেটার কথায় মনে একটু জোর আসলো।

আমি মাঝে মাঝে ছেলেটার সাথে ফোনে

কথা বলতাম, আমাকে হাসাতে পারতো, ওর

কথায় আমি হাসতাম, ও এসে আমাকে

খাইয়ে যেতো।

ফোন করেই বলতো, ভাবী, আজ কি রান্না

করেছেন, আমি খেতে আসছি।

বাধ্য হয়ে আমাকে রান্না করতে হতো,

আমাকে ছাড়া খাবার টেবিলে বসতো না,

আমার হাজবেন্ড, সে, আমি, আমার

বাচ্চারা একসাথে খেতাম।

তাকে সাথে নিয়ে মাঝে মাঝে বেড়াতে

যেতাম।

ছেলেটার খুব ভাল একটা গুন ছিলো, কথায়

কথায় যে কোন মানুষকে হাসাতে পারতো।

ও আস্তে আস্তে আমাদের পরিবারের একজন

হয়ে উঠল।

মাঝে মাঝে এমন হতো, রাত একটা বাজে,

আমি খাচ্ছি না, আমার হাজবেন্ড তাকে

তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে আসতো, সে

আমাকে খাইয়ে তার বাসায় ফিরতো।

আমার হাজবেন্ড তাকে মাঝে মাঝে

বাসায় পাঠাতো, বলতো, তোর ভাবিকে

বাজার থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আয়।

যখন দেখতো আমি চুপচাপ বসে আছি, তখনই

ওর ফোনটা ধরিয়ে দিতো আমার কানে।

সে যেন ডাক্তারের মতো আমার চিকিৎসা

শুরু করলো।

আমি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে

ফিরে আসতে লাগলাম।

বড় বড় ডাক্তাররা যেটা পারলো না, সেই

ছেলে আমার জীবনে ফেরেশতা হয়ে এসে,

আমাকে একটু একটু করে, আমার স্বাভাবিক

জীবন ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে

লাগলো।

আমি তার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।

এর মাঝে ৫/৬ মাস কেটে গেল। কিন্তু,

আমার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল।

সেটাই হয়তো আমার জীবনের সবচেয়ে ভুল

সিদ্ধান্ত ছিল। সেসময় আমার মাঝে চরম

প্রতিশোধ নেবার প্রবনতা জেগে উঠলো।

সিদ্ধান্ত নিলাম যে আগুনটা আমার বুকে

দাউদাউ করে জ্বলছে, সেই আগুন আমিও তার

বুকে জ্বালিয়ে দিবো।

আমি সেই ছেলেটার সাথে আলোচনা

করলাম, বললাম, আমার সাথে তোমাকে

একটা নাটক করতে হবে, প্রেমের নাটক।

আমি সেইদিন শান্তি পাবো, যেদিন

আমার হাজবেন্ডকে কেউ বলবে, তোমার বউ

পরকীয়া করছে। ছেলেটি প্রথমে কিছুতেই

রাজী হলো না, পরে আমার অনেক

রিকোয়েস্টে রাজী হলো। ও বলে রাখা

ভাল, ছেলেটা বিবাহিত।

শুধু একটা মাস, আমি ওর সাথে বিভিন্ন

রেস্টুরেন্টে বসতাম, একসাথে সময়

কাটাতাম, ফোনে কথা বলতাম আমার

হাজবেন্ডকে দেখিয়ে দেখিয়ে, ইমোতে

কথা বলতাম ভিডিও কলে। কিন্তু সবটাই

ছিলো সাজানো নাটক। তার সাথে কিছু

সেলফি তুললাম, আর সেগুলো আমার

হাজবেন্ডের মেসেঞ্জার পাঠাতে বলতাম।

আমার হাজবেন্ডকে তার ফ্রেন্ডরা এসে

বলতে লাগলো, তোর বউ পরকীয়া করছে।

প্রথম প্রথম সে তাদের কথা বিশ্বাস করতো

না, কিন্তু আস্তে আস্তে বিশ্বাস করতে

লাগলো।

আমি যখন দেখলাম, আমি আমার

পরিকল্পনায় সাকসেস, তখন সবটা আমার

হাজবেন্ডকে খুলে বললাম। বললাম, বুঝতে

পারছো তো কতোটা কষ্ট, কতোটা যন্ত্রণা

হয়, বুকের ভেতর কতোটা আগুন জ্বলে।

কিন্তু, আমার হাজবেন্ডকে আর কিছুতেই

আমাকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না।

আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলতে লাগলো,

এই মেয়েকে নিয়ে আর সংসার করতে

পারবি না, সে এখন খারাপ মেয়ে, তাকে

ডিভোর্স দিয়ে দে, তোকে আরও সুন্দরী

মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবো, আর

অনেক টাকাও পাবো।

তাদের কথায় আমার হাজবেন্ড, আমাকে

বাসা থেকে বের করে দিলো। আমার ছোট

ছোট বাচ্চাদূটোকেও দিলো না আমাকে।

আমি একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে

চাকরী নিলাম, খুবই সামান্য বেতনে।

আব্বু আম্মু বলল, বাসায় চলে আয়। আমি

রাজী হলাম না, বললাম, এখানে থাকলে

আমি আমার সন্তানদের কাছাকাছি

থাকতে পারবো। আমি তাদের স্কুলে গিয়ে,

কোচিং এ গিয়ে দেখে আসতাম। মাঝে

মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার হাজবেন্ডকেও

দেখতে যেতাম। তাকে দুদিন না দেখে

থাকতে পারতাম না।

আমার বাচ্চারা দেখা হলে বলতো, আম্মু,

তোমার জন্য ওরা (আব্বু আর দাদী)

আমাদের কাঁদতেও দেয়না, আমরা লুকিয়ে

লুকিয়ে কাঁদি।

কথাটা শুনে বুক ফেটে যেতো, বেহায়ার

মতো ফোন করে বলতাম, আমি কিছু করিনি,

প্লিজ আমাকে বাসায় আসতে দাও, আমি

কাজের মেয়ের মতো থাকবো, তবুও আমার

সন্তানদের কাছে থাকতে দাও।

সে বলল, এক শর্তে বাসায় ঢুকতে দেবো। ঐ

ছেলেকে সবার সামনে তার গালে চড়

মারতে হবে, আর তার নামে থানায় কেস

করতে হবে, মামলা দিতে হবে, সে

তোমাকে ডিসটার্ব করে, আর দুইলাখ টাকা

হাতিয়ে নিয়েছে, এটাও বলতে হবে।

আমি মা, আমি বেহায় মা, সবচেয়ে

বেহায়া প্রানী হলো মা।সন্তানের মুখের

দিকে তাকিয়ে, বললাম, তোমার সব শর্ত

মানবো, আমাকে আমার সন্তানদের কাছে

যেতে দাও, প্লিজ।যদিও নিজের মাঝে

অপরাধবোধ কাজ করছিল, কারন সেই ছেলের

তো কোন দোষ ছিল না, সে যা করেছে,

আমার কথায় করেছে, বড় কথা সে আমাকে

নতুন জীবন দান করেছে, আমি কি করে তার

এতো বড় ক্ষতি করবো।

এখানে আরেকটা কথা বলা হয়নি, আমার

হাজবেন্ড বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের

রাজনৈতিক নেতা। তার একটা কথায় সব

হয়।

সে রাত ২ টায় আমাকে নিকটবর্তী থানায়

নিয়ে গেল, আর যেতে যেতে বলল, তুমি কিছু

বলবে না, শুধু একটা সাদা কাগজে সই করবে।

থানায় গিয়ে আমাকে সাদা কাগজে সই

করতে বলা হলে, আমি বললাম, না, আমি

কোন সাদা কাগজে সই করবো না। কি

লিখা আছে আমি পড়বো তবেই সই করবো।

এটা শুনে, থানার ওসি আমার সাথে একা

কথা বলতে চাইলো। আমার হাজবেন্ডকে রুম

থেকে বের করে দিলো।

ওসি বলল, আপনি কি ওই ছেলের নামে

মামলা করতে চান?

বললাম, না।

বলল, ওই ছেলেকি আপনাকে ডিসটার্ব করে?

আপনার কাছে টাকা চাই?

বললাম, না।

বলল, তাহলে এতো রাতে থানায় কেন

এসছেন?

বললাম, আমার হাজবেন্ড আমাকে জোর

করে নিয়ে এসছে। তাছাড়া ওই ছেলের কোন

দোষ নেই, ও যা করেছে আমি করতে

বলেছিলাম বলে করেছে, আমি কেন তার

বিরুদ্ধে মামলা করবো!

ওসি বলল, ওকে, আপনি যেতে পারেন।

কোন মামলা না করেই বাসায় চলে

আসলাম। আমার শ্বাশুড়ি বলল, এই বাজে

মেয়েকে কেন এখানে নিয়ে এলি।

টাকাকড়ি দিয়ে এখনই বিদায় করে দে।

আমার হাজবেন্ড বলল, মা, আমি ওকে

মারলে দোষ হবে, তুমি ওকে মারো। কালই

ওর বাপ মাকে ডেকে বিদায় করে দেবো।

সব অপমান নিরবে সহ্য করে শুয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে আমার আব্বু আম্মু আসলো,

তারা অকথ্য বাসায়, আমার আব্বু আম্মুকে

অপমান করলো।

আব্বু বলল, আর কতো অপমান সইবি, বাসায়

চল।

বললাম, যতোই অপমান করুক, আমার

সন্তানদের ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।

আমার হাজবেন্ড বলল, নিয়ে যান

আপনাদের মেয়েকে, এরকম চরিত্রহীনার

কোন জায়গা নেই আমার বাসায়।

আবার আমাকে বাসা থেকে বের করে

দিলো। আমি আমার এক আত্মীয়ার বাসায়

থাকতে লাগলাম। চুপ করে ফোন নিয়ে

আমার বাচ্চারা ফোন দিতো, আর কেঁদে

কেঁদে বলতো, আম্মু তুমি বাসায় এসো,

সামনে আমার পরীক্ষা, কে পড়াবে

আমাকে।

কষ্টে বুকটা ফেটে যেতো। আবার বেহায়া

হয়ে ফোন দিয়ে বললাম, আমাকে একটা

মাস তোমার বাসায় থাকতে দাও, আমার

ছেলের পিইসি পরীক্ষা, আমাকে ওর

দরকার। আমি তোমার আর তোমার মায়ের

পায়ের তলায় পড়ে থাকবো, তবু্ও এসময়

আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করো না।

সে কিছুতেই রাজী হলো না, তবুও আমি

জোর করে, শুধু আমার ছেলের জন্য বাসায়

ঢুকে পড়লাম।

তারা মা ছেলে আমার সাথে চরম

দূর্ব্যবহার শুরু করল।

একদিন বাসায় বিরিয়ানি রান্না করলো

আমার শ্বাশুড়ি, তার দুই মেয়ে জামাই, আর

ছেলেকে একা ডেকে খাওয়ালো।

শ্বাশুড়ি থাকতো অন্য ফ্লোরে, আমরা

নিচতলায় থাকতাম।

কিন্তু, আমার সাথে কোন কথা বলল না বা

খেতেও বলল না, বা কোন খাবারও পাঠালো

না।

আমি সেদিন কিছু খেলাম না।

রাতে আমার আম্মু ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস

করলো, কি খেয়েছিস, শুনেই কান্নাটা

আটকাতে পারলাম না, বলে ফেললাম সব।

কথাটা মনে করে, আমার মা আজও কাঁদে।

বলে, বাসায় কুকুর, বেড়াল থাকলেও তো

মানুষ না খাইয়ে রাখে না, আর তারা

তোকে না খাইয়ে রাখলো।

মুখ বুঁজে পড়ে থাকলাম, শুধু ছেলের জন্য।

ছেলের পরীক্ষা শেষ হলো।

আবার মা ছেলে আমাকে বাসা থেকে বের

করার পথ খুঁজতে লাগলো।

একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ বলে উঠল, আমার

নাকি মোবাইল বিল ৬০০০ টাকা।

এটা কি করে সম্ভব, বলতেই আমার

হাজবেন্ড আমার মুখে নাকে ঘুঁষি মারতে

লাগলো, আমার নাক মুখ ফেটে রক্ত বের

হতে লাগলো।

আমি চিৎকার করে কাঁদতেই, পাড়ার মানুষ

অনেকেই এসে গেল, আমার শ্বাশুড়ি বলতে

লাগলো, কি এমন মেরেছে আমার ছেলে,

তোমার হাত পা তো ভাঙেনি।

তারপর আমার আর কোন জ্ঞান ছিল না,

পরদিন দেখলাম, আমি হাসপাতালে।

চোখ মেলতেই দেখলাম আম্মুরা এসছে।

হাসপাতাল থেকেই আম্মুূদের বাসায় নিয়ে

চলে গেল।

বাসায় গিয়ে সবাই ডিভোর্সের জন্য

প্রস্তুুতি নিতে লাগলো।

কিন্তু, আমি তাদের কোন কথা না শুনেই

আমার হাজবেন্ডের বাসায় চলে আসলাম।

সে শর্ত আরোপ করলো, আমাকে বাসায়

বন্দী থাকতে হবে, মোবাইল ব্যবহার করা

যাবে না, স্কুলের চাকরী ছাড়তে হবে,

আমার কোন আত্মীয় স্বজনের সাথে কোন

প্রকার যোগাযোগ রাখা যাবে না।

আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে, আর তাকে

ছেড়ে থাকতে পারবো না, এটার জন্য তার

সব শর্ত মেনে নিয়ে, সবটুকু আত্মসম্মান

জলাঞ্জলি দিয়ে তার বাসায়, শুধু আমার

সন্তানদের জন্য পড়ে আছি, তার বাসায়,

যেখানে আমার কোন স্বাধীনতা নেই,

আমি তার আর তার মায়ের হুকুমের গোলাম

মাত্র।

তার মাঝে সুখ এটুকুই আমি আমার

সন্তানদের কাছে আছি।

শুধু ভাবি, এই এতোটা বছরে তার কতো শতো

অপরাধ আমি ক্ষমা করেছি, আর সে আমার

এক মাসের একটা নাটক মেনে নিতে

পারেনা।

এটাই হয়তো একজন পুরুষ ও নারীর পার্থক্য।

(অনেক ধন্যবাদ, সবাইকে, ধৈর্য্য নিয়ে

গল্পটি পড়ার জন্য।

ভাল থাকবেন সবাই!!)