মায়ের কষ্টের গল্প | মায়ের কষ্ট | সন্তান হারা মায়ের কষ্ট

 মায়ের কষ্টের স্ট্যাটাস

মায়ের কষ্টের স্ট্যাটাস

ওকি আম্মা এতো আস্তে ভাত খাচ্ছ কেন? আর একটু মাংস নিবা?

খাবার টেবিলে বড় ছেলে সাদিক তার পঁচাশি বছর বয়সি মা রোখসানা আহমেদকে প্রশ্ন করলো। টেবিলে বসা সাদিকের ছেলে, মেয়ে এবং স্ত্রী সবাই ঘুরে তাকালো রোকসানার দিকে। রোকসানা অত্যন্ত সংকুচিত ভাবে বললেন, 'শক্ত ভাত খেতে পারি না বাবা।'

সাদিক তার স্ত্রী জুলিকে বলল, 'ভাতটা একটু নরম করলেও তো পারো!'

জুলি ঝাঁঝিয়ে উঠলো, 'আমি নরম ভাত খেতে পারি না।'

- রুকুকে বললেই তো পারো একটু ভাত আলাদা করে নিয়ে পানি দিয়ে পাঁচ মিনিট আবার রান্না করলেই তো হয়ে যায়।

- না পারি না। রুকুর আরো অনেক কাজ আছে। আম্মা আসলেই ওকে সারাক্ষণ দৌড়ের উপরে রাখেন। এটা কর, ওটা কর। নানান রকম হুকুম চলতেই থাকে। ওনাকে যা কিছু খেতে দেয়া হয়, তাতেই কোন না কোন দোষ খুঁজে পান। লবণ হয়নি, ঝাল হয়নি, চিনি হয়নি, মাছ ভালো করে ধোয়া হয়নি, তরকারির সাইজ ঠিক হয়নি।

সবাই চুপচাপ খেয়ে যার যার রুমে চলে গেল।

বেডরুমে এসে জুলি বলল, 'তোমার মাকে অন্য কারো বাসায় পাঠিয়ে দাও। আমি আর রাখতে পারব না।'

- আশ্চর্য, আম্মা মাত্র সাত দিন হয় এসেছেন। এখন কোথায় পাঠাবো?

- সেটা তোমার ব্যাপার। আমার বাসায় আর উনি থাকতে পারবেন না এটাই হচ্ছে আমার ফাইনাল কথা।

সাদিক বিপন্ন বোধ করে।

সাদিক প্রথমেই ফোন করে বোন সোহেলীকে, সে দুই বোনের মধ্যে বড়। কুশল বিনিময়ের পরে সে আসল কথা বলে, 'আম্মাকে তোর বাসায় কিছুদিন রাখতে পারবি?'

- কেন তোমার বউ সাত দিনেই ক্লান্ত হয়ে গেছে?

- আম্মা অনেক ঝামেলা করে, পরের মেয়ে কত সহ্য করবে?

- শোন ভাইয়া আমি আগেই বলেছি আম্মাকে রাখতে পারব না। আব্বা মারা যাওয়ার পরে যখন তোমরা সম্পত্তি ভাগাভাগি করো, তখন আমাদের দুই বোনকে আর আম্মাকে কিছুই দাও নাই। তখন বলেছিলে যে আব্বা আমাদের দুই বোনকে টাকা পয়সা খরচ করে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিয়েছেন, তাই আমরা আর বাবার সম্পত্তির অংশ পাবো না। আর আম্মার অংশও তোমরা তিন ভাই ভাগ করে নিয়েছো। তখন বলেছিলে, "আম্মার সম্পত্তির দরকার কি? তাকে তো আমরা তিন ভাই দেখে রাখবো।" আব্বা মারা যাওয়ার এক বছর পরেই তোমরা তিন ভাই আম্মাকে নিয়ে ঠেলাঠেলিি শুরু করলে। সে সব দেখে সোহানা আম্মাকে নিয়ে ওর কাছে সাত/আট বছর তো রাখল। এখন তোমরা তিন ভাই পালা করে আম্মাকে রাখ।

- সোহানা অতদিন রাখতে পারলো আর তুই কয়েকটা মাস রাখতে পারবি না?

- না পারব না। সোহানা অনেক ভালো মানুষ তাই আম্মাকে রেখেছে নিজের ক্ষতি করেও। আম্মাকে রাখতে গিয়ে ওর সংসারে কত অশান্তি হয়েছে তার হিসাব কি তোমরা রাখো? আমি কিছু কিছু জানি। ওর স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি কেউই আম্মাকে দেখতে পারে না। ওদের কথা হচ্ছে, "তোমার কোন ভাই না থাকলে মাকে রাখলে আমরা আপত্তি করতাম না। তুমি তো অনেকদিন রাখলা, এবার তোমার ভাইরা রাখুক।"

- হ্যাঁ, ওর সংসারে অশান্তি হচ্ছিল বলেই তো আমরা আম্মাকে নিয়ে এসে তিন ভাই পালা করে রাখলাম এই বছরখানেক। তুই না হয় ছয়টা মাস রাখ।

- না ভাইয়া, আমার সংসারে অশান্তি হবে। আমাকে মাফ করো।

সাদিক সোহানাকে ফোন করতে ভরসা পায় না, কারণ ওর স্বামী আবার মাকে নিয়ে ওর কাছে রাখলে নিজেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে।

মেজো ভাই সোহেল মাত্র এক সপ্তাহ আগে মাকে দিয়ে গেছে নানা রকম কথা বলে। তার কথা হলো, 'আমার বউ আম্মাকে নিয়ে অনেক কমপ্লেইন করে। আমার ভালো লাগে না। এখন বুঝতে পারছি সোহানা কী ঝামেলা সহ্য করেছে। যতদিন পারো আম্মাকে তোমার কাছে রেখে দাও।'

গভীর করে শ্বাস টেনে বুকে সাহস সঞ্চয় করে সাদিক ফোন করে ছোট ভাই সাব্বিরকে। সাব্বিরের বউও শাশুড়িকে রাখতে চায় না নিজের কাছে নানান বাহানায়। অনেক বুঝিয়ে সাব্বিরকে রাজি করল সাদিক ওদের মাকে নিয়ে যেতে। কথা ঠিক হলো যে পরদিন সকালে সাব্বির এসে নিয়ে যাবে রোখসানাকে।

সাদিক এই খবর দিতে মায়ের রুমে গেল। খুব দরকার না পড়লে সাদিক বেশি একটা মায়ের রুমে আসে না। এসে দেখে মা শুয়ে আছে, শরীরটা যেন বিছানার সাথে মিশে গেছে। ধবধবে সাদা চুল, মুখের চামড়ায় শত ভাঁজ। মায়ের পাশে বসে শীর্ণ হাতখানা কোলে তুলে নিলো সাদিক। এই সেই মা যে কি না যৌবনে কতো সুন্দর আর স্মার্ট ছিল। সুন্দর করে হেসে কথা বলত। পরিষ্কার সুন্দর পোশাক পরতো, সুন্দর করে ঘর সাজাত। প্রথম সন্তান সাদিককে অনেক ভালবাসত। আজ সেই ভালবাসা ফেরত দেয়ার সময়। অথচ সে কিছুই করতে পারছে না মায়ের জন্য। নিজের অজান্তেই দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে সাদিকের চোখ থেকে।

রোখসানা বুদ্ধিমতী এবং তীব্র সংবেদনশীল একজন মানুষ। খাওয়ার টেবিলেই উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এ বাসা থেকে দ্রুতই তাকে অন্য কোন বাসায় যেতে হবে। তিনি মুখে হাসি টেনে এনে বললেন, 'কাল কি সাব্বির আমাকে নিতে আসবে?'

- তুমি কেমন করে জানলে মা?

- তুই কাঁদতেছিস কেন পাগল? একদিন তো মরেই যাবো, তখন কি করবি?

একথা শুনে সাদিক ডুকরে কেঁদে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরল। সাদিকের খুব ইচ্ছা করছিল মাকে বলতে, 'আম্মা, তোমাকে আর কোথাও যেতে হবে না। তুমি আমার বাসায়ই থাকো।'

জুলি এসে দেখে মা-বেটা কাঁদছে। সে বলল, 'এতো নাটক করতে পারো তোমরা মা-বেটা!'

এই কথা শোনার পরে সাদিক তার মনের ইচ্ছাটাকে মাটি চাপা দিল। এমন নিষ্ঠুর যে কি করে হয় মায়ের জাত!

রোখসানা রাতে ভাত খেলেন না। সারারাত শুয়ে শুয়ে কাঁদলেন। মনে পড়ে বাচ্চারা ছোট থাকতে স্কুল বা খেলা থেকে ফিরে এসেই মাকে খুঁজত। সারাদিনের সব গল্প দিনশেষে এসে মাকে বলা চাই-ই-চাই। বাচ্চাগুলো সারাদিন হাঁসের বাচ্চার মতো মায়ের পিছু পিছু ঘুরত। কেন যে এরা এতো বড় হয়ে গেলো!

পরদিন সকালে সাব্বির এসে রোখসানাকে নিয়ে গেল।

এর দুইদিন পরে সাব্বির কাঁদতে কাঁদতে সাদিককে ফোন করলো, 'ভাইয়া আম্মা নেই। কাল রাতে ঘুমের মধ্যে মারা গেছে, কখন আমরা জানতেও পারিনি। সকালে কাজের মেয়ে নাস্তা খেতে ডাকতে গিয়ে দেখে আম্মা মারা গেছে।'

সাদিক আম্মা বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠল।

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত।)

মা