কোন মেয়ে বিয়ে করা উচিত ও বউ পিটানোর শাস্তি

 শিক্ষামূলক বাণী

শিক্ষামূলক বাণী

আমরা তিন বন্ধু ভালো চাকরি করি। আমাদের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে। আমাদের পছন্দ ভিন্ন। 


  এক বন্ধু চায় এমন পরিবারের মেয়ে বিয়ে করতে যাদের আর্থিক অবস্থা তার পরিবার থেকে উঁচু। আরেক বন্ধু চায় ভালো চাকরি করা অর্থাৎ স্বনির্ভর মেয়ে বিয়ে করতে। আর আমি চাই এমন পরিবারে বিয়ে করতে যাদের আর্থিক অবস্থা আমার পরিবার থেকে নিচু, এবং মেয়ে চাকরি করতে পারবে না। 


  দুই বন্ধুসহ সবাই আমাকে বললো, সচ্ছল ঘরের মেয়ে বিয়ে করার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দুর্বল ঘরের মেয়েকে কেনো বিয়ে করতে চাচ্ছি? 

  উত্তরে বললাম,"সময় হলে জানাবো।"


  আমাদের বন্ধুদের পছন্দ ভিন্ন হলেও একটা জায়গায় আমাদের মিল ছিলো। সেটা হলো, আমরা এ ব্যাপারে একমত যে, সংসারের শান্তির জন্য স্ত্রীদের শাসনে রাখতে হবে। মুখের কথায় যদি স্ত্রীরা সোজা না হয়, তাহলে মার দিতে হবে। স্ত্রীদের মারা অন্যায় নয়। আমাদের বাবারাও তাদের স্ত্রীদের প্রয়োজনে মেরেছেন।


  এই মনোভাব নিয়ে পছন্দ অনুযায়ী আমরা বিয়ে করলাম।


  প্রথম দিকে আমাদের তিন বন্ধুর সংসার ঝামেলাহীন ভাবে গেলো। পরে নানা বিষয় নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে টুকটাক ঝামেলা হতে লাগলো। 

 

  লক্ষ্য করে দেখলাম তিন পরিবারের ঝামেলাগুলোর মূল কারণ একটাই। তা হলো, আমরা স্বামীরা যা বলি স্ত্রীরা যদি তা না করে তাহলে আমাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যেতো। 


  স্ত্রীকে হয়তো একটা কাজের কথা বললাম। এবং কীভাবে করতে হবে সেটাও বললাম। 

  স্ত্রী যদি তখন বলতো,"কাজটা তুমি যেভাবে করতে বলছো, সেভাবে না করে অন্য ভাবে করলে বেশি ভালো হবে।"

  রেগে গিয়ে তখন বলতাম,"আমার থেকে বেশি বোঝো? আমি যেভাবে বললাম ঠিক সেভাবেই করবে। অন্য ভাবে না।"


  স্ত্রীরা আমাদের আদেশ, হুকুম, মেজাজ বেশ কিছুদিন সহ্য করার পর একদিন তারা রেগে গেলো। তাদের রাগ হলো, আমাদের কাছে বেয়াদবি। আর স্ত্রীদের বেয়াদবি কী করে দূর করতে হয়, তা আমাদের বাবারা শিখিয়ে গেছেন। অর্থাৎ মার।


  তিন বন্ধুও স্ত্রীর গায়ে হাত তুললাম। হাত তোলার পর তিন স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া তিন রকম হলো।


  ধনী ঘরের মেয়েটি বাবার বাড়ি চলে গেলো। বন্ধু মেয়েটিকে যেতে দিতে চায় নি। কিন্তু মেয়ের পরিবার ক্ষমতাবান হওয়াতে সে আটকাতে পারে নি। 


  মেয়ের বাবা বললেন, নারী নির্যাতনের মামলা করবেন। এবং তালাকের ব্যবস্থাও করছেন।


  বন্ধু মাথায় হাত দিয়ে বললো,"ধনী পরিবারে বিয়ে করে বিরাট ভুল করলাম।"


  আর যে বন্ধুর স্ত্রী ভালো চাকরি করে অর্থাৎ স্বনির্ভর, তার গায়ে হাত তোলার পর স্ত্রী বললো,"তোর মতো অসভ্যের সাথে না থাকলে আমার কী ক্ষতি হবে? আমি কি খেতে পারবো না? পরতে পারবো না? থাকতে পারবো না? আমার গায়ে হাত তোলার ফল তুই পাবি। একটু অপেক্ষা কর।"


  সেদিনই বন্ধুর স্ত্রী চলে গেলো। এবং বন্ধুর নামে নির্যাতনের মামলা এবং তালাকের আয়োজন করতে লাগলো।


  এই বন্ধুও মাথায় হাত দিয়ে বললো,"স্বনির্ভর মেয়ে বিয়ে করে বিরাট ভুল করলাম।"


  দুই বন্ধুর দু:খ দেখে খারাপ লাগলেও মনে মনে বিজয়ীর হাসি হাসলাম। কারণ, আমার স্ত্রী মার খেয়ে কোনো প্রতিবাদ করলো না। বাপের বাড়িও চলে গেলো না। শুধু নীরবে কাঁদলো।


  দুই বন্ধু তখন আমাকে বললো,"দুর্বল ঘরের এবং স্বামীর উপর নির্ভরশীল মেয়ে বিয়ে করে তুই বুদ্ধিমানের কাজ করেছিস। তুই বউকে মারিস, কাটিস, যা ইচ্ছে করিস, কিন্তু মেয়েটা কিছু বলতে পারবে না। তোকে ছেড়েও যেতে পারবে না। তুই কেনো এমন মেয়ে বিয়ে করেছিস এবার বুঝতে পারলাম।"


  বন্ধুদের কথা ঠিক। বন্ধুরা তাদের স্ত্রীদের গায়ে একবার হাত তুলে এখন নাকানিচুবানি খাচ্ছে। আর আমি একাধিকবার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেও দিব্যি সংসার করে যাচ্ছি। মেয়েটা প্রতিবাদহীন চুপচাপ সব মেনে নেয়। 


  অবশ্য স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার সময় মা আমাকে আটকানোর চেষ্টা করতেন। এবং বকাঝকা করতেন। কিন্তু মা'র কথা শুনতাম না।


  যাই হোক, আমার সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলো না। 

  স্ত্রীর এক ভাইয়ের পুলিশে চাকরি হয়ে গেলো। যেদিন চাকরি হলো, ঠিক সেদিন আমার চুপচাপ থাকা স্ত্রী ব্যাগ গুছিয়ে প্রবল ক্রোধের সাথে আমাকে বললো,"নিরুপায় হয়ে দিনের পর দিন তোর নোংরামি সহ্য করেছি। কিন্তু আর না। এবার তোকে এমন শিক্ষা দেবো, সারাজীবন মনে রাখবি।"


  এমন তীব্র আক্রমণ করার পরও স্ত্রীকে কিছু বলার সাহস হলো না। কারণ শ্যালক এখন পুলিশ। আমাকে হাজতে ঢোকানো তার জন্য কোনো ব্যাপার না।


  দুই বন্ধুর বিপদের চেয়ে আমার বিপদ আরো ভয়াবহ হয়ে দেখা দিলো। ভেবেছিলাম, দুই বন্ধুর মতো আমিও নারী নির্যাতনের মামলা এবং তালাকের সম্মুখীন হবো। কিন্তু আমারটা হলো আরো সাংঘাতিক! 


  স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার পর পুলিশ শ্যালক ফোন করে শীতল গলায় বললো,"দুলাভাই, আমার বোনকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়ে আপনি পুরষ্কার হিসেবে ক্রস ফায়ার পেয়েছেন। অভিনন্দন আপনাকে।"


  তারপর থেকে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেলো।


  তিন বিধ্বস্ত বন্ধু আমার বাসায় বসে আলোচনা করছিলাম, আমাদের বাবারা স্ত্রীদের সাথে যে আচরণ করে পার পেয়ে গেলেন, একই আচরণ আমাদের স্ত্রীদের সাথে করে আমরা কেনো পার পেলাম না?


  কথার এক পর্যায়ে মা এসে বললেন,"পুরুষেরা সবচেয়ে বড়ো যে ভুলটা করে তা হলো, তারা স্ত্রীদের ভাবে তাদের অধীনস্থ, আশ্রিত এবং শারীরিক সুখ পাওয়ার বস্তু মাত্র। এই মনোভাবের কারণে স্ত্রীদের কোনো কিছু স্বামীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। স্ত্রীদের কথা, পরামর্শ, সিদ্ধান্ত সব তুচ্ছ মনে হয়। আর তুচ্ছদের বকলে, মারলে কিছু যায় আসে না। আমরা এসব অত্যাচার মুখ বুজে মেনে নিলেও এখনকার মেয়েরা এসব মানতে রাজি নয়। কারণ এখনকার মেয়েরা শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর হচ্ছে।"


  তারপর বললেন,"পুরুষেরা নিজেদের বড়ো ভেবে স্ত্রীদের সাথে মিশলে, কোনোদিন স্ত্রীদের ভালোবাসা পাবে না। বড়ো ভাবা স্বামীর সাথে কোনো মেয়ে ঘর করতে চাইবে না। সুযোগ পেলে মেয়ে চলে যাবে। স্ত্রীদের ভালোবাসা পেতে হলে এবং চিরটাকাল তাদের ধরে রাখতে হলে, তাদের অধীনস্থ, আশ্রিত, এবং শারীরিক সুখ পাওয়ার বস্তু মাত্র না ভেবে বন্ধু ভাবতে হবে। অর্থাৎ তাদের সমান ভাবতে হবে। তোমরা যেটা করতে পারো নি।"


  মা'র কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করার কারণ নেই। কেননা, আমরা কখনো স্ত্রীদের বন্ধু অর্থাৎ আমাদের সমান ভাবি নি। ভেবেছি আমাদের অধীনস্থ, আশ্রিত এবং শারীরিক সুখ পাওয়ার বস্তু মাত্র। 


  এরপর মা বললেন,"আর পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ হলো, স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা। যারা স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে, তেমন পুরুষদের স্ত্রীরা আজীবন ঘৃণা করে।"


  এই নিকৃষ্ট কাজটাও আমরা করেছি। স্ত্রীরা আমাদের ঘৃণা করবে এটাই স্বাভাবিক। 


  এখন তো আমরা ভুল বুঝতে পারলাম। এবং এখন যদি স্ত্রীদের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাই, এবং তাদের ফিরিয়ে আনতে চাই, তারা কি আসবে? যে অপরাধ আমরা করেছি, তাতে ফিরে না আসার কথা। অবশ্য লেখক যদি চান তাহলে ভিন্ন কথা। শুনেছি রুদ্র আজাদ হ্যাপি এন্ডিং পছন্দ করেন। এই গল্পটাতেও যদি হ্যাপি এন্ডিং দেন, তাহলে ভীষণ খুশি হবো।


  ( লেখক হিসেবে আমি খুবই নরম মনের। ভাঙা পরিবার দেখলে খারাপ লাগে। তাই আমার প্রায় গল্পে ভাঙা পরিবার জোড়া লাগিয়ে দিই। কিন্তু এই গল্পে জোড়া লাগাবো না। কারণ, স্ত্রীর গায়ে হাত তোলাকে আমি মেনে নিতে পারি না। তাই এই তিন স্বামীকে শাস্তি অবশ্যই দেবো। ) 


  দু:খের বিষয় লেখক হ্যাপি এন্ডিং এ রাজি হন নি। তাই আমরা তিন বন্ধু অনেক চেষ্টা করেও স্ত্রীদের ফিরিয়ে আনতে পারি নি। আমাদের তালাক হয়ে গেলো। স্ত্রীদের দেনমোহরের পুরো টাকা দিতে হলো। সেই সাথে তিন মাসের ভরণপোষণের টাকাও দিতে হলো। ভালো চাকরিটাও চলে গেলো। শুধু তাই নয়, স্ত্রী নির্যাতনের অপরাধে এখন জেলে পড়ে আছি। 


  অবরুদ্ধ জেলখানায় শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, স্ত্রীকে অধীনস্থ, আশ্রিত এবং শারীরিক সুখ পাওয়ার বস্তু না ভেবে যদি বন্ধু ভাবতাম, তাহলে জীবনটা শূন্য না হয়ে আলোয় পূর্ণ হয়ে উঠতো! অপূর্ব সুন্দর আলোয়। 


"অপূর্ব সুন্দর আলো"

- রুদ্র আজাদ