খুব কষ্টের ভালোবাসার গল্প | কষ্টের ভালোবাসার গল্প 2023

 অনেক কষ্টের ভালোবাসার গল্প

অনেক কষ্টের ভালোবাসার গল্প

আমার দুই বছরের মেয়ে নাযাহার হুট করে জ্বর আসার কারণে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসলাম। ডাক্তারের চেম্বারের বাহিরে বসে আছি। নাযাহা আমার কোলের উপর ঘুমাচ্ছে আর আমার স্ত্রী অর্পিতা আমার কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। মেয়ের চিন্তায় অর্পিতার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। এমন সময় আমার সামনে একটা ছেলে এসে বললো,

  ~পিয়াস ভাই, ভালো আছেন আপনি?

আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,

   -- ভালো আছি কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না। 

ছেলেটা মুচকি হেসে বললো,

   ~আমি শ্রাবণীর কাজিন খালিদ। শ্রাবণী আপুকে যখন পড়াতে আসতেন তখন বিনা কারণে আমার মাথায় টোকা দিতেন। আবার পড়ানো শেষ করে যাবার সময়ও আমার মাথায় টোকা দিতেন 


  খালিদের কথা শুনে আমি ওর মাথায় টোকা দিয়ে বললাম, 

 -- আরে তুমি! অনেক বড় হয়ে গেছো। তা এইখানে কেন?

খালিদ মুখটা মলিন করে বললো,

   ~আন্টিকে নিয়ে এসেছি 


হুইলচেয়ারে শ্রাবণীর মা বসে আছে। আমি আন্টির পাশে বসে বললাম,

  -- আন্টি, আপনার এই অবস্থা হলো কিভাবে?

আন্টি মলিন হাসি দিয়ে বললো,

  ~স্ট্রো"ক করার পর এমন হয়ে গেছি

আমি তখন বললাম,

-- শ্রাবণী কেমন আছে?

উনি হেসে বললো,

  ~ভালো আছে এখন। তোমার ঠিকানা দিয়ে যাও। একদিন সময় সুযোগ হলে শ্রাবণীকে তোমার কাছে পাঠাবো


আমি আন্টিকে বাসার ঠিকানাটা দিয়ে নাযাহাকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে ভিতর ঢুকলাম...

|

|


১০-১২ দিন পর শ্রাবণীর বাসা থেকে আমার জন্য একটা পার্সেল আসে। আমি অবাক হয়ে পার্সেলটা যখন খুলি তখন দেখি একটা নীল রঙের ডায়েরী। ডায়েরীটা খুলে হাতের লেখা দেখে বুঝতে পারলাম এটা শ্রাবণীর। নিশ্চয় এটা ওর আবার নতুন কোন পাগলামি। এত বড় হলো এখনো পাগলামিটা যায় নি। আমি ডায়রীটা টেবিলের উপর রেখে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম আর মানে মনে ভাবলাম কোনো একদিন সময় পেলে ডায়েরীটা পড়ে দেখবো...

---

----

দুইদিন হয়েছে পিয়াস অসিফের কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিলো। আজ ওর আসার কথা। পিয়াসের অপেক্ষায় অর্পিতার সময়টা কোনভাবেই পার হচ্ছে না। পিয়াসের টেবিলের উপর কতগুলো বই রাখা। অর্পিতা বইগুলো হাতে নিয়ে দেখছে আর রেখে দিচ্ছে। এত কঠিন কঠিন বইয়ের নাম। হঠাৎ অর্পিতার চোখ একটা নীল রঙের ডায়েরীতে আটকে গেলো। ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা খুলে দেখে শ্রাবণীর নাম লেখা। তারমানে ডায়েরীটা শ্রাবণীর। অন্য জনের ডায়েরী পড়া উচিত না জেনেও অর্পিতা ডায়েরীটা কৌতূহল বসতো পড়তে শুরু করলো,


    আমার জন্য আমার মা একজন আবুল মার্কা স্যার ঠিক করেছেন। স্যারের নামটাও অদ্ভুত; আবুল বাশার পিয়াস। আমার আগে যে সব টিচার ছিলো ওরা আমাকে পড়ানোর সময় আমার চোখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতো কিন্তু এই আবুল স্যার কখনো আমার চোখের দিকে তাকায়নি। মনে মনে ভাবলাম স্যারের গার্লফ্রেন্ড হয়তো আমার চেয়েও সুন্দর তাই আমার সৌন্দর্য্য উনার চোখে পড়ে না। কিন্তু পরে জানতে পারলাম উনার কোন গার্লফ্রেন্ড নেই।

    প্রথম দিন স্যারকে যখন নাস্তা দেওয়া হয় তখন উনি অল্প একটু খেয়ে পকেট থেকে একটা পলিথিন বের করে বাকি খাবারটা পলিথিন ব্যাগের ভিতর ভরে পকেটে রেখে দেয়। বিষয়টা আমার কাছে খুব খারাপ লেগেছিলো। মানুষের অভ্যাস এত বাজে হয় কি করে।

 পরের দিনও সেইম একই কাজ করলো। যখন দেখলাম উনি প্রতিদিন একই রকম কাজ করে একদিন আমি রেগে গিয়ে বললাম, 

   -আপনি এমন ছোটলোকদের মত কাজ করেন কেন? যতটুকু পারেন খান সেটা না করে অল্প খেয়ে বাকিটা ব্যাগে করে নিয়ে যাবার কি আছে? 

আমার এত কড়া কথা শুনার পর উনি কিছু না বলে শুধু বেহায়ার মত হেসেছিলেন।

পরের দিন আবারও কয়েকটা বিস্কিট নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। আমার রাগে হাত পা কাঁপছিলো। স্যার বাসা থেকে বের হতেই আমি ছাদে চলে গেলাম।ছাদে হাটাহাটি করলে নিজের রাগটা একটু কমবে। হঠাৎ খেয়াল করলাম স্যার আমাদের বাসার সামনের রাস্তাতে বসে আছে আর স্যারকে ঘিরে কয়েকটা কুকুর বসে আছে। স্যার পকেট থেকে বিস্কিট গুলো বের করে কুকুর গুলোকে দিচ্ছে আর বিড়বিড় করে কি সব বলছে। এটা দেখার পর নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মেয়ে মনে হচ্ছিলো। স্যারের প্রতি সেদিনের পর থেকেই কেন জানি একটা অন্য রকম ভালো লাগা শুরু হলো...


অর্পিতা একটু দম দিয়ে আবার পড়তে শুরু করলো,


     আজ বিকাল থেকে এখন পর্যন্ত তিনবার গোসল করেছি কিন্ত তবুও রাগ কমছে না। মা অনেক বার জিজ্ঞেস করেছে আমি কেন বারবার গোসল করছি। আমি মাকে কিছু বলি নি উল্টো রাগ দেখিয়েছি। পুরোটা দুপুর নিজের হাতে মেহেদী দিয়েছি। স্যার পড়ানোর সময় বারবার হাতগুলো নাড়ছিলাম যেন স্যারের চোখে আমার মেহেদীর ডিজাইনটা চোখে পড়ে কিন্তু স্যার একবারও আমার হাতের দিকে খেয়াল করে নি। তাই বাধ্য হয়ে আমিই বললাম, 

      -স্যার, দেখেন আমি হাতের তালুতে P+S লিখেছি। আচ্ছা বলেন তো P+S এর মানে কি?

  স্যার আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন,

  "P তে প্রিয়াংকা চোপড়া আর S তে শাহরুখ খান"

কথাটা শুনার পর আমি আশ্চর্য্য হয়ে বললাম,

 -আজব তো! আমি প্রিয়াংকা আর শাহরুখ খানের নাম আমার নিজের হাতের তালুতে লিখে কি করবো?  


লেখটা পড়ে অর্পিতা জোরে জোরে হাসতে লাগলো। হাসির শব্দ শুনে নাযাহার ঘুম ভে'ঙে গেলো। অর্পিতা কোন রকম নাযাহাকে ঘুম পাড়িয়ে আবার পড়তে লাগলো,


  আজ প্রথম বারের মত হিমুর রূপার মত করে সেজেছিলাম। নীল শাড়ি নীল কাচের চুড়ি খোলা চুল আর নীল টিপ পরেছিলাম। এই প্রথমবার স্যার আমার চোখে চোখ রেখে বললেন,

   "শ্রাবণী, তোমাকে তো আজ খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু কাপালের টিপটা একটু সরে গেছে "

   স্যার নিজ হাতে আমার টিপটা ঠিক করে দিয়েছিলো। স্যারের আঙুলের স্পর্শ যখন আমার কপালে লাগলো তখন আমি আমার মাঝে ছিলাম না। সেই অনুভূতিটা হয়তো লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না...


  অর্পিতা ডায়েরীটা পড়া বন্ধ করে দিলো। ভিতরে হয়তো আরো অনেক কিছু লেখা থাকতে পারে যেটা অর্পিতা সহ্য করতে পারবে না কারণ অর্পিতা পিয়াসকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসে। ডায়রিটা রেখে অর্পিতা ছটফট করতে লাগলো। কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে অর্পিতা আবার ডায়রীটা খুলে ডায়রীর একদম শেষের দিকে চলে গেলো


   আজ ১২ নভেম্বর স্যারের জন্মদিন ছিলো। আমি নিজ হাতে কেক বানিয়ে স্যারের মেসে এসেছিলাম স্যার কে দিতে। কিন্তু স্যার আমার কেকটা রাখে নি। উল্টো আমায় বলেছে,

    " শ্রাবণী, আমি বুঝতে পারছি তোমার মাঝে কিছু সমস্যা হচ্ছে। এই বয়সে এমনটা সবারি হয়। কয়েকদিন পর এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যখন ভালো একটা ভার্সিটিতে চান্স পাবে তখন এমনিতেই সব ভুলে যাবে। তুমি আমার স্টুডেন্ট আর আমি তোমার স্যার আমি তোমায় কখনোই এতটা প্রশ্রয় দিতে পারি না"


  সেদিনের পর স্যার আমাকে আর কখনো পড়াতে আসে নি। উনার নাম্বারটাও বন্ধ ছিলো। ফেইসবুকেও উনাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি মেসে খবর নিয়েছি কিন্তু উনি আর সেখানে থাকেন না। আমি কেন জানি পাগলের মত হয়ে যাচ্ছিলাম। সারাক্ষণ বাসার সামনে রাস্তায় বসে কুকুরগুলোকে খাবার খাওয়াতাম। বারবার নিজের মনকে বুঝাচ্ছিলাম আমি যেটা করছি সেটা ঠিক না কিন্তু তবুও বারবার নিজে নিজের কাছে হেরে যাচ্ছিলাম...


অর্পিতার হাত কাঁপছে। ডায়েরীর পৃষ্ঠাটা উল্টাতেও ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। পৃষ্ঠা উল্টিয়ে অর্পিতা আবারও পড়তে লাগলো,


    আজ মা আমাকে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। সবাই ধারণা করছে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমারও এখন সেটা মনে হয়। সারাক্ষণ শুধু মাথার উপরে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি আর পারছি না। আমি এই ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি চাই। মার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। বাবা মারা যাবার পর মা আমায় খুব যত্ন করে বড় করেছে। আমি চলে গেলে মা খুব একা হয়ে যাবে। সিলিং ফ্যানের সাথে আমি আমার নীল শাড়িটা বেঁধেছি। রূপা হিমুকে ছাড়া ঠিকিই বেঁচে ছিলো কিন্তু আমি যে পারবো না


 অর্পিতা ডায়েরীটা রেখে চিৎকার করে কাঁদছে। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে অর্পিতা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো। পিয়াসকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

  -শ্রাবণী সু'ই'সা'ই'ড করেছে পিয়াস। তুমি শ্রাবণীকে মে'রে ফেলেছো। তুমি কেন ওর নিরব চোখের ভাষা বুঝতে পারো নি? কেন একটা বার এই অবুঝ মেয়েটার সাথে যোগাযোগ করো নি। শ্রাবণী ম'রে গেছে পিয়াস, শ্রাবণী আর বেঁচে নেই...


সমাপ্ত