বাসর রাতের গল্প | বাসর রাতে কি করে ২০২৪

 বাসর রাতের মিলন

বাসর রাতের মিলন

(গল্প টা পড়ুন) 

আমার বিয়ে হয়েছিল ১৬ মার্চ রাতে। সেদিনই গায়ে হলুদ হয়। গায়ে হলুদ দিতে এসে আমার মেজো ননদ আমার কপাল ছুঁয়ে বললেন – আহা, মেয়েটার তো জ্বর।

ওকে আলতো করে হলুদ দাও সবাই। হলুদ মাখানোর সময় আর সেটা কারো মনে থাকলো না। এরপরে সাত বৌ মিলে পিতলের কলসির মুখে আমপাতা রেখে আমার মাথায় পানি ঢাললো । আমি কেঁপে কেঁপে শেষ হলাম।

সন্ধ্যার পরে আমাকে বৌ সাজানো হলো।


বয়স কম। মাত্র ক্লাস টেনে পড়ি। এতো সাজার জিনিস কেমন করে কোথায় ব্যবহার করে তাও জানি না। যে সাজাচ্ছে সেও খুব অভিজ্ঞ না। গালে পাউডার দিয়ে চমৎকার করে আমায় কাজল টেনে দেয়া হলো। আই লাইনার দেয়ার ব্যাপারটা ঠিক বোঝা গেল না বলে দেয়া হলো না। কপালে টিপ দিয়ে তার চারপাশে চমৎকার নকশা এঁকে দিল আমার বোনের এক বান্ধবী। সমস্যা শুরু হল শাড়ি পরা নিয়ে। ব্লাউজ পিস কাটতে হবে। বিয়ে বাড়িতে কেঁচি খুঁজে পাওয়া গেল না।


তাই ব্লাউজ পিস সহই শাড়ি পরানোর সিদ্ধান্ত হল। আমি পেটের কাছে বেঢপ ভাবে কুঁচি গুজে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

সবাই নিচের কুঁচি ঠিক করছে। কেউ আমার পেটের টুপলির দিকে খেয়ালই করলো না। 

এদিকে চুলে সেফটিপিন লাগিয়ে ওড়না পরিয়ে দিলো একজন। আমার শাশুড়ি এসে গহনা পরিয়ে দিলেন। ঝুমকা, হার, বালা, সাথে লালের উপরে আঁকাবাঁকা সোনালি কাজ করা চুড়ি।


আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। বারবার চুলে টান পড়ছে সেফটিপিনের। বিরক্ত লাগছে। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। হাজার হোক আজ আমি নতুন বৌ।

বিয়ে পড়ানোর সময় আম্মা আর মামা চিৎকার করে কাঁদলেন। আমি জ্বর আর রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে চুপচাপ আছি। হঠাৎ দেখি আমার ছোট ভাইটা ঝিলিমিলি কাগজ নিয়ে দৌঁড়াচ্ছে আর বলছে ‘ আপার বিয়ে, আপার বিয়ে।

অবুঝ ভাইয়ের আনন্দ দেখে কেন জানি আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি কেঁদে কেঁদে চোখের কাজল লেপ্টে ফেললাম। বাইরে ক্যাসেটে জোড়ে গান বাজছে ‘একদিন ঘুম ভেঙ্গে দেখি, সুখের সমুদ্র শুকিয়ে গেছে। ‘


আমার চোখের পানি এবার প্রবল তোড়ে বের হতে লাগল।

রাত দশটার মাঝেই বিয়ে, খাওয়া দাওয়া সব শেষ। আগে থেকেই কথা হয়ে আছে।

আমার এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত আমি আমাদের বাড়িতেই থাকবো । তারপর বিয়ের অনুষ্ঠান হলে আমি সংসার শুরু করবো। এর মাঝে আমার বর হঠাৎ কোন উপলক্ষে বাসায় আসতে পারবেন। কিন্তু থাকবেন না।

রাত সারে দশটার মাঝে পুরো বাড়ি ফাঁকা। আমি আর নানু রঙিন কাগজ আর ফুল দিয়ে সাজানো রুমে শুয়ে পড়লাম। প্রায় মাঝরাতে শুনি কলিংবেল বাজছে। কী ব্যাপার এতো রাতে কে এলো?


মামা ভয় পাচ্ছেন। বিয়ে বাড়ি গহনা, টাকা পয়সা থাকাই স্বাভাবিক। সুতরাং ডাকাত পড়েছে হয়তো। কেউ দরজা খুলছে না। এমন সময়ে মোটর সাইকেলের দুইবার হর্ণ শোনা গেল। আম্মা যা বোঝার বুঝে গেলেন। মামাকে বললেন – দরজা খোল জামাই এসেছে।

নানু আমাকে তড়িঘড়ি করে আবার শাড়ির প্যাকেট বানালেন। পেটের কাছে টুপলি আর মাথায় ঘোমটা। শাড়ির নিচে পরনে সালোয়ার কামিজ।


ব্যাপার আর কিছুই না। আমার বর তার দুলাভাইকে গিয়ে রাতে ধরেছেন। ‘দুলাভাই আমি বিয়ে করেছি। বৌকে তো ঠিকমত দেখিইনি। আমাকে ওই বাসায় রেখে আসো।

উনি যত না বলেন, আমার বর তত জোড়ে চিৎকার করেন। আমার বর ভাশুর রেগে বললেন – মান সম্মান আর রাখলি না। যা শ্বশুর বাড়ি। তাড়িয়ে দিলে খুব ভালো হয়।

আমার বর গান গাইতে গাইতে মোটরবাইক স্টার্ট দিলেন। ননদ জামাই বাধ্য হয়ে সাথে এসেছেন।


দুলাভাই চুপচাপ সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছেন। আমার বর তাকে শিখিয়ে দিচ্ছেন – বলো, আজকেই শেষ। আগামীতে অনুষ্ঠান হবার আগ পর্যন্ত আর আসতে চাইবো না। এই প্রমিজ করছি। আমার মোটর বাইকের কসম। ( পরবর্তী জীবনে উনি এমন প্রমিজ আরো কয়েক হাজার বার করেছেন ) 


দুলাভাই তাকে হালকা বকতে বকতে চলে গেলেন। রুমে উনি , আমি আর নানু। নানু ‘আমি একটু শরবত নিয়ে আসি। ‘ বলে দরজায় হ্যাজবল লাগিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।

আমি চুপচাপ বসে আছি। কতক্ষণ কাটল ? এক মুহূর্ত নাকি এক বৎসর?


আমার বর আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

আমি চোখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে সোফায় বসে আছি। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। উনি হঠাৎ বললেন ‘ আমি আসলে একটা জিনিস পরীক্ষা করতে এসেছি। তোমার চোখ তো খুব সুন্দর তার মাঝে তোমার ভ্রু যেন পাখির ডানা । এতো কালো কারো ভ্রু হয়? 

তুমি কি ভ্রুতে আই ব্রো পেন্সিল লাগাও?

আমি অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম – না, আমার ভ্রু এমনিতেই কালো।


উনি বললেন – ঠিক আছে দেখা যাক। পাশে ছিল পানির গ্লাস উনি গ্লাসে দুই হাতের বুড়ো আঙুল ডুবিয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন, ভ্রুতে ঘসা দিয়ে দেখবেন আমি কালো রঙ লাগিয়েছি কি না ! বাসর ঘরে একজন অপরিচিত লোক। যদিও লোকটা বর। আমার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে একদম মুখের সামনে যখন নিয়ে আসলো। আমি প্রাণ ফাটিয়ে এক চিৎকার দিলাম।

নানু নানু এই লোকটা আমার গলা টিপে ধরতে চাইছে। বাঁচাও নানু নানু। দরজা খুলে নানু দৌঁড়ে এলেন। আমার আম্মা তখন আমার মামাকে বকা শুরু করলেন। আমি বলেছিলাম এতো অল্প বয়সে বিয়ের দরকার নেই। এখন হলো তো ! 


এদিকে আমার বর বিস্ময়ে স্তব্ধ। আর নানু ! সেতো হেসেই কুটপাট। আমার বরকে শুনলাম একবার বিড়বিড় করে বলছে – বাচ্চাকাচ্চা বিয়ে করে কী বিপদেই না পড়লাম।

সারারাত আমি নানুকে জড়িয়ে ধরে খাটে ঘুমালাম। আমার বর বাধ্য ছেলের মতো সোফায় শুয়ে গান গেয়ে গেয়ে সময় কাটালো। তারপর ভোর না হতেই মোটরবাইক নিয়ে চলে গেল। আমি তখন ঘুমের রাজ্যে কে গেল আর কে থাকলো কী বা যায় আসে । 


ঘটনা ২ – বিয়ের চারদিন পরে আমার বর আবার আসলো আমাদের বাসায়। আমি তার মোটরবাইকের আওয়াজ শুনেই বাসা থেকে পালালাম। বান্ধবীর বাসায় গিয়ে বসে থাকলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। আমার দুই ভাই বোন চার দফায় এসে ধমক খেয়ে ফিরে গেছে। এদিকে আমার বান্ধবীর স্যার এসে গেছে পড়াতে । এখন কী করি ! বাধ্য হয়ে গুটিগুটি পায়ে ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরছি। আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।


দৌঁড়ে গিয়ে আম্মার রুমে ঢুকে পড়তে বসবো। আমাকে ঢুকতে হবে ড্রয়িংরুম দিয়ে। আমার বরও ভেবে রেখেছে । আমি রুমে ঢোকামাত্র সে দরজা লক করে দেবে।

( বরদের মাথায় এমন হাজারো কুবুদ্ধি গিজগিজ করে )

আমি বেল বাজানো মাত্র সে দরজা খুলেছে। আমি দিয়েছি দৌঁড় আর সে চেয়েছে দ্রুত দরজা বন্ধ করতে। ফলাফল - 

দরজা এসে ঠাশ করে আমার কপালে লাগলো বাড়ি। সাথেসাথে কপাল ফেঁটে দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগলো। রক্তে আমার কপাল বুক ভেসে যাচ্ছে। আমি মাথা ঘুরে পরে গেলাম। সে সিনেমার নায়কের মতো আমায় কোলে নিয়ে দৌঁড়ে হাসপাতালের দিকে ছুটলো।


এদিকে রাস্তার লোকজন ভিড় করে আমাদের দেখছে। কেউ কেউ বলছে – আহারে বিয়ে হয়েছে মাত্র তিন/চার দিন। এর মাঝেই মেরে মেয়েটার মাথা ফাটিয়ে দিলো? জালিম একটা ! 

বিয়ের চারদিন পরে আমার বর আবারো হতভম্ব হলেন। আমার কপালে যখন ডা. ব্যান্ডেজ করছে। উনি দেখি তখন বিড়বিড় করে বলছে। আরে ধুর – বিয়ে করা যে এতো ঝামেলার কে জানতো?

মানুষ নাকি তিন চারটি বিয়ে করে আর আমি একটাই সামলাতে পারি না।


আমার কেটে গিয়েছিল ঠিক কপালের বা পাশে। সিনেমায় যেমন নায়িকাদের কাটে।

ফেরার পথে রিক্সায় দুজন পাশাপাশি বসে ফিরছি। উনি রিক্সায় আমার হাত ধরতে চাইলে আমি এক ঝটকায় আরো সরে বসলাম। বাসার সামনে সবাই দাঁড়িয়ে ছিল। রিক্সা থামা মাত্র আমি লাফ দিয়ে নেমে বাসায় ঢুকে গেলাম। আমার রুমের লাগোয়া বাথরুমে দেখি একটু পরে উনি শার্টের যেখানে যেখানে রক্ত লেগেছে। নিজেই ধুচ্ছে আর গান গাইছে। ‘ একি হলো, কেন হলো, কবে হলো জানি না। শুরু হলে হলো, শেষ হলো কী যে হলো জানি না তো । ‘


 অণুগল্পঃ বাসর

লেখনীতেঃ নিতু ইসলাম


এমন আরও অনেক গল্প পড়ুন এখানে ক্লিক করুন।