বাস্তব জীবনের কিছু গল্প | বাস্তব জীবনের গল্প

বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

 আমার পাশের ফ্ল্যাটের রোখসানা ভাবি যখন তখন টাকা উড়ায়। আমি শুধু অবাক হয়ে দেখি আর শুনি। বিগত তিন বছর ধরে আমরা ভাড়াটিয়া হিসাবে পাশাপাশি বাস করছি। সেই শুরু থেকেই দেখে আসছি ওনার এমন স্বভাব। আরে টাকা ইনকাম করে ভালো কথা, তাই বলে এভাবে বেহিসাবি খরচ করতে হবে!


উনি একটা প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ফ্যামিলি বলতে হাজব্যান্ড আর ওনার দুই ছেলে। দুজনই হাই স্কুলে পড়ে। বড়টা ক্লাস টেনে আর ছোটটা ক্লাস সেভেনে। সেদিন অনলাইনে একটা শাড়ি দেখলাম। শাড়ির ডিজাইনে আমার চোখ আটকে গেল। ভাবিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, সামনেই তো ১লা বৈশাখ, কিনবেন নাকি ভাবি? চলেন দুজনে দুইটা অর্ডার করি। শাড়ি দেখে উনিও স্বীকার করলেন শাড়িটা আসলেই অনেক সুন্দর। কিন্তু কিনতে রাজি হলেন না। বললেন টাকার সমস্যা। 


কথাটা মানতে কষ্ট হলেও বিশ্বাস করলাম। কেননা ওনার মুখে মিথ্যা কথা শুনিনি কখনো। রোখসানা ভাবি খুব বড় ঘরের মেয়ে শুনেছি। মানে উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে। পরিবারের অমতে ভালোবেসে রাসেল ভাইকে বিয়ে করেছে। রাসেল ভাই একটা বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। খুব হিসাব নিকাশ করে চলে দুজন। কিন্তু মাঝে মাঝে দেখি হিসাবের বাইরেও টাকা খরচ করে।


এইতো কিছুদিন আগেও দেখলাম চার বছরের মেয়ের জন্য একটা ফ্রক কিনে এনেছে। আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো কেমন হয়েছে। আমি জামাটার গেটআপ দেখে বুঝলাম দাম বেশ ভালোই হবে। ভালোমন্দ কিছু না বলেই জিজ্ঞেস করলাম, ভাবি কার জন্য কিনেছেন? আপনার ছেলেরা তো আর ফ্রক পরে না। উনি মুচকি হেসে ভেতরে চলে গেলেন।


পরদিন ছাদে দেখি রোখসানা ভাবির কাজের বুয়ার মেয়েটা সেই ফ্রক পরে খেলছে। কিছুটা অবাক হলাম। বুঝতে পারলাম নিজের জন্য শাড়ি কিনতে কেন টাকার সংকট পরেছে। প্রতি মাসে বেতন পেয়ে ওনার মায়ের জন্য টাকা পাঠায়। একমাত্র মায়ের সাথেই তার যোগাযোগ আছে। ভাই-বোনদের সাথে কোন সম্পর্কই নেই। অথচ ওনার মায়ের তেমন টাকার প্রয়োজন হয়না। তবুও মাকে টাকা দিতে ওনার নাকি ভালো লাগে। গত মাসেও শ্বাশুড়ির চিকিৎসা বাবদ টাকা পাঠিয়েছে। রাসেল ভাইও দেয়, কিন্তু উপযাচক হয়ে উনিও দেয়।  


এ পর্যন্ত হলেও মানা যায়। এই শুক্রবারে দেখি আরেক কান্ড। সকাল সকাল ভাবির বাসা থেকে রান্নাবান্নার বেশ ঘ্রাণ পাচ্ছি। প্রতি শুক্রবারই অবশ্য এমনটা হয়। সপ্তাহের এই একটা দিনেই মূলত ওনার বাসায় একটু ভালোমন্দ রান্না হয়। তাছাড়া তো আর সময় নেই তার। দরজার বাইরে বেশ হৈ চৈ শুনতে পাচ্ছি। দরজাটা একটু ফাঁকা করতেই দেখি ফকির, মিসকিনের মেলা। দশ বারো জন হবে। তাদের আপ্যায়নের জন্য রাসেল ভাই রাস্তা থেকে ধরে এনেছে। স্ত্রীর এসব পাগলামিতে স্বামীও বেশ সায় দেয় দেখছি। 


এসব আদিখ্যেতা দেখতে আমার আর ভালো লাগে না। অতিষ্ঠ হয়ে গেছি আমি। খাওয়াদাওয়া শেষে ফকির মিসকিনগুলো দু'হাত তুলে মোনাজাত করে চলে গেল। আমি তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে। দুপুরের খাওয়ার আগে আমার বাসাতেও খাবার পাঠিয়েছে রোখসানা ভাবি। দেখলাম চার পাঁচটা আইটেম। জাস্ট খিচুড়ি বা বিরিয়ানি করলেও পারতো। অযথা ঝামেলা বাড়িয়েছে। আমি আর কিছু না ভেবে খেতে শুরু করলাম।


রাতে শুতে যাবো এমন সময় কান্নার শব্দ ভেসে আসলো কানে। একটু গভীরভাবে কান পেতে শুনলাম ওটা রোখসানা ভাবির কণ্ঠ। এতো রাতে ভাবির কান্না শুনে আমরা ছুটে গেলাম ওনার বাসায়। গিয়ে দেখি ভাবি পাগলের মত কাঁদছে। কারণ জানতে চাইলাম বললো, ছোট ছেলেটার শরীরটা বেশি ভালো যাচ্ছিলো না বেশ কয়েক মাস যাবৎ৷ এতোদিন শুনেছি শুধু মাথাব্যাথা। কিছুদিন ধরে মাথাব্যথার সাথে বমিও হয়। সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট দেখে আজকে জানতে পেরেছে ওর মস্তিষ্কে ব্রেন টিউমার ধরা পরেছে। কথাটা শুনে আকস্মিকভাবে আহত হলাম। আমি ভাবির পাশে বসে একটু সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম।


ভাবিদের এখন একটাই সমস্যা সেটা টাকার। অপারেশনে যে পরিমাণ টাকা লাগবে তার পুরোটা ম্যানেজ করা তাদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য হবে। ওনাদের সাথে মিশে এতোদিনে যা বুঝেছি ওনারা ধার দেনা করে চলতে পছন্দ করেনা। কারো কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতা তো দূরের কথা। 


ভাই ভাবি দুজনই বেশ দিশেহারা হয়ে পরেছে। কোথায় যাবে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এমতাবস্থায় আমরাও চাইলাম কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করতে। ভাবি রাজি হলেন না। 


কিছুদিনের মধ্যেই ভাবির চেহারা বদলে গেছে। একেবারে বিষন্ন আর মরা মরা লাগে। চেহারায় কোন লাবন্যতা নেই। চোখ দেখলেই বোঝা যায় দিন রাত চোখের পানি ফেলে।


পরদিনই ভাবিরা ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করালেন। বাসাটা কেমন নিরব আর নিস্তেজ লাগছে। সন্ধার পর হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ পেলাম। দরজা খুলতেই দেখলাম বেশ লম্বা আর কালোমতো দেখতে একটা লোক দাঁড়িয়ে। কাকে চাই জিজ্ঞেস করতেই বললো রোখসানা ভাবিদের সাথে দেখা করতে এসেছে। একজন আগন্তুককে ঘরে আসতে বলতেও দ্বিধা বোধ হচ্ছে। তবুও ডেকে ড্রয়িং রুমে বসালাম, কারন আমার হাজব্যান্ড আবিদ বাসায় ছিল। 


ভাবির সাথে তার সম্পর্ক কি তা জানতে চাইলে উনি বললেন রোখসানা ভাবি ওনার বোন হন। কিন্তু আমি যতটুকু জানি রোখসানা ভাবির ভাই বোনদের সাথে কোন যোগাযোগ নেই দীর্ঘদিন। সুতরাং উনি যে মিথ্যা বলছেন এটা আমি বুঝে ফেললাম। ওনার মতলব জানতে আরো কিছু প্রশ্ন করলাম৷ উনি ঠিকঠাক বলতে চাচ্ছিলেন না। এক পর্যায়ে বলা শুরু করলেন। বছর পাঁচেক আগে রোখসানা ভাবির সাথে তার পরিচয় হয়। ভাবির স্কুলের সামনে ওনার একটা দোকান ছিল। দূর্ঘটনাবশত হঠাৎ একদিন আগুন লেগে দোকানটা পুরে ছাই হয়ে যায়। লোকটার অবস্থা তখন বেগতিক। এরপর এই রোখসানা ভাবি তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার বেতন থেকে হাজার দশেক টাকা লোকটার হাতে গুজে দিয়ে বলেছিলেন, এটা দিয়ে আবার শুরু করেন ভাই।


লোকটা ভাবির সেই উপকারের কথা ভুলে যায়নি। আজ তাই তার ছেলের অসুখের কথা শুনে ছুটে এসেছে। শুধু তাই না তার এক টুকরো জমি বন্ধক রেখে কিছু টাকাও নিয়ে এসেছে। কথাগুলো শুনে ক্ষণিকের জন্য আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমার চোখের কোণে পানি জমে গেছে। 


আমি লোকটাকে হাসপাতালের ঠিকানা লিখে দিলাম। উনি চলে গেলেন। ভাবিকে ফোন করে জানতে পারলাম রাসেল ভাই গত দুই মাস যাবৎ যে লোনের জন্য ব্যাংকে ঘোরাঘুরি করছিল শেষমেশ ব্যাংক সেটা একসেপ্ট করেছে। সাথে সাথে দুই রাকাত নফল নামাজ পরে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালাম। 


আগামীকাল রাত আটটায় ভাবির ছেলের মাথায় অস্ত্রোপচার হবে। আমি আগের রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি। শুধু ভেবেছি যদি তারপরও ছেলেটা সুস্থ না হয়! এতো চিন্তার ভীড়েও আমার অস্থির মনে উদয় হলো ভালো মানুষদের কাজের প্রতিদান কখনো খারাপ কিছু হতে পারেনা। এটা সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব লীলা। 


সাতদিন পর আজ রোখসানা ভাবির হাসিখুশি ছেলেটিকে দেখে আবারও আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো।


---------(সমাপ্ত) ----------


অণুগল্প - প্রতিদান

লেখনীতে - সায়মা আক্তার 


পড়কিয়া কতটা ভয়ংকর পরিণতি হয় পড়ুন।