অবহেলার কষ্টের গল্প | বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

 কঠিন কষ্টের গল্প

কঠিন কষ্টের গল্প

বাসর রাতের শেষ ভাগে এসে জামাই আমার ফুপিয়ে কান্না করতেছে। তার চোখ ভর্তি পানি দেখে আমার কেবলি হাসি পাচ্ছে। 


আমি রাত্রি। আজ আমার জীবনের প্রথম মধুময় রাত। গায়ের রঙ চাপা হলেও; ভালবাসার দাবী নিয়ে অবিবাহিত জীবন পথে কয়েক জন পুরুষ এসেছিলো। শুদ্ধতম বন্ধনের মানুষটির জন্য, তাদেরকে হাসি মুখে ফিরিয়ে দিয়েছি। আজ পারিবারিক ভাবে জুনাইদের সাথে আমার বিয়ে হলো। জুনাইদ যেদিন আমায় প্রথম দেখে গেলো, সেদিন থেকে ছেলেটি আস্ত প্রেমিক হয়ে গেলো। বলা নেই কওয়া নেই পরেদিন শেষ বিকেলে বাইকে ছড়ে চলে এলো! লজ্জায় শ্যামা মেয়ে আমি রক্ত জবা হয়ে উঠি। আড় চোখে একবার তাকিয়ে, ঠোঁটে হাসি লেগে থাকা ছেলেটির মাঝে নিজকে সপে দেই। জুনাইদের আগ্রহ উত্তেজনার দুইদিনের মাঝে ঘটা করে আমাদের আংটি বদল হয়। আংটি বদলের এক সপ্তাহ পর বিয়ে হয়। এই গোটা একটি সাপ্তাহ রাতে দু'জন চোখের পাতা এক করিনি। কথা বলে কাটিয়ে দিয়েছি সাত সাতটি রাত। 


ওর প্রিয় রঙ লাল, আমার কালো। খুব ইচ্ছে ছিলো, গতানুগতিক ধারা উলটে দিয়ে; বিয়ের দিন কালো শাড়ি পরবো। কিন্তু আমার সাহেবের পছন্দের কাছে হেরে গেলাম। ও আমায় জোর করেনি, শুধু বলেছে ' বিয়ের দিন লাল শাড়িতে তোমারে যা লাগবে না'! উত্তরে বললাম কি লাগবে শুনি? সদ্য ফোঁটা লাল গোলাপ দেখেছো? দুষ্টু হেসে উত্তরে বললাম না তো। সেও হেসে বললো, আচ্ছা, আচ্ছা; আয়নায় দেখাবো তোমারে। কখন দেখাবে? প্রথম রাতে।


তার প্রিয় রঙে'র লাল শাড়ি পরে, তার'ই অপেক্ষায় বসে আছি। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি, অবসান ঘটিয়ে চলে এলো তার নববধূর কাছে। রুমে ঢুকে দরজার ছিটকেনি লাগিয়ে পর্দার ফাঁকফোকর ভালো করে দেখে, হাতের পাগড়ি রেখে; নত মস্তকে বসে থাকা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঘোমটার অল্প আস্তরণের ভেতর থেকে দেখলাম তার মুগ্ধ চাহনি। সেই চিরচেনা হাসি হেসে পাশে বসে বললো অবশেষে তুমি শুধুই আমার হলে। তার এ কথা শুনে ইচ্ছে করছিলো, সব লাজুকলতা'র গলা চেপে দিয়ে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি! কিন্তু পারিনি, আড়ষ্ট আমি আরো কুঁকড়িয়ে গেলাম। আমাকে সহজ করার জন্য প্রেমিক পুরুষের ন্যায় ফোন কলের কথোপকথন সরাসরি নিয়ে এলো। মুখে হাসি রেখে গম্ভীর কণ্ঠের ভাব ধরে বলে 'রাত্রি তোমার হাত ধরতে অনুমতি লাগবে'? হু বলে মাথা হ্যা সূচক নাড়িয়ে তার ডান হাত ধরে বললাম, জরিমানা হিসেবে এবার একশত একবার ভালোবাসি বলো। সুখকর এ শাস্তি কেনো? এই যে অনুমতি নিলে। হাত শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করে; উফফ শব্দ করে মেকি বিরক্তির ভাব ধরে বলে, এই মেয়ে আমার সাধের রাত খেয়ে দিলো রে। তুমি গুনতে থাকো। বেশি হলে শোধ করে নেবো। কম হলে আগামী কাল পুষিয়ে দেবো।


কিন্তু আমাদের একসাথে আগামী কাল এলো না। শেষ রাতে তার ফুপিয়ে কান্না করা'কে মজার চলে নিয়েছে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলেছি ভার্জিনিটি ক্ষয়ে যাওয়ায় দুঃখ পেয়ে কষ্টের জলে ভাসছো? অহেতুক বকবক করেও ওকে আমি স্বাভাবিক করতে পারিনি। চারপাশে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। হাত ধরে টেনে বললাম, জুনাইদ চিন্তা হচ্ছে তো। হঠাৎ কি হলো তোমার? 

হাত ঝেড়ে ফেলে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। বিস্ময়ে দু'চোখ দরজায় কাটকে যায়। চোখ দু'টো জ্বালা করতে থাকে। পানি জমতে থাকে। ঝাপসা চোখ নিয়ে অজু করে ফজর আদায় করলাম। সিজদায় পড়ে এক জীবনের জন্য তাকে'ই চাইলাম। ওর ক্ষানিক অবহেলায় ভেতর পুড়ে যাচ্ছে। 'ঠিক হয়ে যাবে' বলে নিজেক সান্ত্বনা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। 

সকাল হলো সবাই মিলে নাস্তা করলাম। চারপাশের লোকেরা নতুন বউ দেখতে আসছে। ভাবিরা হাসি তামাশা করছেন। সকাল দশটা পেরিয়ে গেলো তার দেখা নেই। বাধ্য হয়ো শ্বাশুড়ি মা'কে জিজ্ঞেস করলাম, মা আপনার ছেলে নাস্তা করেছে? উত্তর এলো 'না'। আরো বললো ওকে সকাল থেকে উনি দেখেননি। তাকে কল করার জন্য রুমে গেলাম। রুমে গিয়ে দেখি ফোন বিছানায় পড়ে আছে। 

দুপুরের খাবারের সময় বাসায় এসেছে। ওকে দেখে বন্ধ হয়ে যাওয়া দমে পানি এলো। সবাই সহ একসাথে বসে ভাত খাচ্ছিলাম। ইচ্ছে করছিলো তার সামনে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়াই। 


ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে জুনাইদ বললো, মা আমরা একটু পর ও বাড়ি যাবো। বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা শুনেও মনে উচ্ছাস জমলো না। কেনো যেনো যেতে ইচ্ছে করছিলা। রুমে এসে থম ধরে বসে রইলাম। খেয়ে এসে তৈরি হওয়ার জন্য আমাকে তাড়া দিতে লাগলো। স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলো। সঙ্গে সঙ্গে ও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো দ্রুত করো। কিন্তু তার মুখে সেই চিরচেনা হাসি নেই, কেমন যেনো ফেকাসে দেখাচ্ছে। উত্তরে বললাম, বিয়ের পরের দিন যাওয়ার নিয়ম নেই, তিনদিন হলে যেতে হয়। ধুরো, তুমি আছো মুরব্বিদের যুগে। বোরকা পরে নাও তো।

আমার কেনো যেনো বুকের ভেতর ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কান্না করি। কান্নার জলে তার শার্ট ভিজিয়ে দেই। কিন্তু তার সরে সরে থাকা'তে নিজেকে এগিয়ে নিতে পারলাম না।  


শেষ বিকেলে রক্ত রাঙা সূর্যকে সাক্ষী রেখে জুনাইদ আমাকে চিরদিনের জন্য বাবার বাড়ি রেখে গেলো। যা আমার কল্পনায়ও ছিলো না। আমাকে রেখে বাজার যাওয়ার অযুহাতে সে আমার জীবন থেকে চলে গেলো। 

রাতে এলো না, ফোনে কল যাচ্ছে না। শ্বাশুড়ি'কে ফোন দিয়েও কোন খাবর ফেলাম না। পরের দিন সে নিজ থেকে বড় দুলাভাই'কে ফোন দেয়। তার না কি আমাকে পছন্দ হচ্ছে না। আমি কালো। দুলাভাই বললো, বিয়ের আগে তিনদিন এসে দেখে গেলেন; সেই তিনদিন কালো দেখেননি?

দেখিনি তখন, তখন তো তাকে বিশ্ব সেরা রূপবতী মনে হয়েছে। এখন সোজা কথা তার সাথে আমি সারাজীবন সংসার করতে পারবো না। দুলাভাই রেগে খুব গালাগালি করলেন। 

তাকে ছাড়া এক সপ্তাহ কেটে গেলো। তার একটাই কথা সে আমাকে নিবে না, নিবেই না। আমার একটাই দোষ, আমি কালো। তার পরিবারের লোকেরাও অনেক বুঝিয়েছে, কিন্তু সে তার কথায় অটল। এবার তাকে জেল ফাঁসি যা-ই দেওয়া হোক, সে তাই মেনে নিবে; শুধু আমাকে ছাড়া।


আমার পরিবারের লোকেরা অপমানিত হয়ে ক্ষেপে গেলো। হয়ে গেলো আমাদের বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদের দিন শুধু একটি কথা-ই বলেছি 'জীবনে যখন থাকবেই না, তাহলে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলে কেনো'? তাকে আরো অনেক কথা বলার ছিলো। কিন্তু এই একটা প্রশ্নের উত্তর'ই তো সে দিতে পারলো না। সেদিন নিজেকে শক্ত রেখেছি। চোখের জল লোকচক্ষু'তে পড়তে দেইনি। কিন্তু তারপর থেকে আর পারিনি নিজেকে শক্ত রাখতে। এক রুমের বাসিন্দা হয়ে গেলাম। রুমের বাহিরে শব্দ না যাওয়ার মতো করে হাউমাউ করে কেঁদেছি। পরিবারের লোকেরা আমার ভালোথাকার জন্য এখানে সেখানে ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে ভেতর থেকে নড়ছেনা। ঠায় বসে আছে হৃদয়ের মাঝ বরাবর। বসে বসে ছুরি দিয়ে খোঁচাচ্ছে আর হাসছে!


ছয় মাস সুস্থ মানুষ ছিলাম৷ এর পর আমার নাম হয়েছে 'মেয়েটি পা*গল'।  

রোকসানা আক্তার আলো


এমন আরও অনেক গল্প পড়ুন।