না পাওয়া ভালোবাসার কষ্টের গল্প ২০২৩

 না পাওয়ার গল্প

না পাওয়ার গল্প

নিষিদ্ধ ভালোবাসা

পর্ব-(১)

নওরীন খান।

৯ বছরের সম্পর্কের পর আমার প্রেমিক আদিব আমায় আজ জানালো:

"সুপ্তি তুই আমার পরিবারের সাথে ঠিক যাবি না আর খাপ খাওয়াতেও পারবি না"


থুম ধরে বসে ছিলাম ক্যাফের চেয়ারে।মুখ দিয়ে যেন কথায় বের হতে চাইছিলো না,যেখানে আমার কথার যন্ত্রণায় আদিবের কান ঝালা-ফালা হয়ে যেতো!কি বলবো আমি!আকাশটা মনে হচ্ছিলো আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে আর পৃথিবীটাও শূন্য মনে হচ্ছিলো,কোথাও কেউ নেই!একদম শূন্য - নিস্তব্ধ চারিদিক।


আমার ঘোর কেটে গেলো আবার আদিবের ডাকে:

~"কিরে কিছু বলছিস না যে?"

~"কি বলবো?"

~"আসলে দেখ তুই রান্না করতে পারিস?আর মাছ কাটতে"

~"না"

~"ঘর গুছাতে?"

~"না"

~"আমাদের পরিবারে বউদের বাইরে বের হওয়া কিন্তু নিষেধ।"

~"৯ বছর ধরে জেনে আসছিস যে আমি ঘুড়তে ভালোবাসি"

~"আমাদের পরিবারে বউদের চাকরি করাও নিষেধ "

~"আমি ছোট থেকেই নিজের পায়ে দাড়াতে চাইতাম তুই এটাও জানিস"

~"হুম সেই জন্যই তো হবে নারে"


সেই ছোট থেকে আমার আর আদিবের সম্পর্ক।আদিবই আমায় প্রথম প্রেমের প্রস্তাব দেয়... আর আমি না করে দেই, সবার কাছে এমনকি আদিবের বাসায়ও বিচার দিয়ে কি যে লঙ্কা কান্ড করেছিলাম!!শুনেছিলাম আদিব অনেক মারও খেয়েছিলো আর এরপরেও বলে গিয়েছিলো আমায় ভালোবাসে।বাসা থেকে বেরও নাকি করে দিয়েছিলো।বাবা-মা,মামা সকলের কথার অবাধ্য হয়েছিলো,আমাকে এক দেখায় ভালোবেসে ফেলেছিলো বলে।ঘটনার ফলশ্রুতি এতটাই ভয়ংকর হয়েছিলো যে আদিব সুইসাইডও করতে গিয়েছিলো।আমি অবশ্য এসব শুনেই গলে গিয়েছিলাম।


তারপর,কথা,কথার পৃষ্ঠে কথা।বহুদিন পর দেখা,আবারও দেখা আর প্রেম।সবকিছুই যেন না চাইতেই হয়ে গিয়েছিলো আর এভাবেই কেটে গিয়েছিলো বহুদিন, তারপর বছর আর তারওপর কিছু বছর।


এখন আদিবের মা-ও আমাদের ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে।আদিবও অনেকটা বড় হয়েছে।মায়ের সাথে আরও ফ্রী হয়েছে.. আমার সাথে তার মায়ের কথাও বলিয়ে দিল।প্রথমে আন্টি তারপর মা ডাকা শুরু করলাম।


ছোট ছোট বিষয়-ঝগড়া আর আদিবের এসে বলা সরি আর আমার সর্বকালের ঝাড়া ডায়লগ সরি বললেই সব ঠিক হয়ে যায় না এসব মিলিয়ে কেটে গেলো আরোও কিছু বছর।


আর এখন,বর্তমান কালের কিছু বছরগুলো এমন হয়েছে যে সরিটা আমিই বলি সে হয়তো হুম বলে।রাগ করে ব্লক করে সে-ই রাখে আমি হয়তো নিজে থেকেই দেখা করতে গিয়ে সব ঠিক করি।

এভাবে ঠিক থাকেও কিছুদিন কিন্তু আবার.......

আসলে আদিব খুব চরিত্রবান আর বুদ্ধিমান ছেলে।অনেক বাস্তবিকও।কিন্তু আমি যে সেই আবেগের প্রেমে পরেছিলাম তাই বিয়ের বয়সে এসে আদিবের এমন অতি বাস্তবিক কথা প্রমিকা হিসেবে মেনে নিয়ে নিজেকে যখন আদিবের বউ হিসেবে কল্পনা করছি বড্ড বেমানান লাগছে।


নাহ!!ক্যাফেতে আর বসে থাকা যাবে না কেমন অসহ্য লাগছে।

আমি কাঁদতে কাঁদতে বাসায় চলে এলাম।বাসায় ঢুকতেই আম্মু জিজ্ঞাসা করলো:

"কিরে আদিবের সাথে দেখা হলো?কবে দেখতে আসছে ওরা তাহলে?"


আম্মু-বাবা কেউই আদিবকে শুরুতে মেনে নেয়নি।নিজের কতো বিয়ের ঘর যে ভেঙেছি আদিবের জন্য তার হিসাব নেই। অনেক কষ্টে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে,রাগ দেখিয়ে দরজা বন্ধ রেখে তবেই বাবা-মাকে রাজি করেছিলাম।আদিবের বেতন ১০ হাজার,পরিবারের অবস্থাও তেমন ভালো না এসব নিয়ে আমার কখনও কোনো মাথা ব্যাথা না থাকলেও বাবা-মার এতে ছিল ঘোর আপত্তি।কিন্ত আমার জেদের কাছে এই আপত্তি বশ্যতা শিকার করলো।


আম্মুকে কিছু না বলে আমার রুমে চলে এসেছি।দরজা বন্ধ করে বেসিংএ গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিয়ে এবার আয়নায় নিজেই নিজেকে বেশ কিছুক্ষণ দেখে আমার আমিকে আয়নার প্রতিবিম্বে আবিষ্কার করে নিজেই নিজের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম:


"তুই কতো বোকা রে সুপ্তি!যখন ছেলেটা প্রেম করতে এসেছিলো কেন তুই স্টেম্পে তার লিখিত দলিল নিলি না?কেন তখন সেই দলিলে তাকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে এটা লিখে রাখলি না যে, তুই তার এবং তার পরিবারের যোগ্য কিনা!কেন তুই বুঝলি না,কোনো মানুষের যখন তার খুব ভালো লাগার মানুষটির ব্যাপারে জানা শেষ হয়ে যায় তখন তার প্রতি আগ্রহ কমে যায়।মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল আর গিরগিটির মতো রঙ বদলায়।যার জন্য আদিব তার পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েছিলো,পরিবারের কথা অমান্য করেছিল আর আজ সে-ই পরিবারের দোহায় দিয়ে তোকে ছেড়ে যাচ্ছে।"


আম্মুর ডাকে আবারোও ঘোর কাটলো আর তার হাজারো প্রশ্নের ভিড়ে আর এটা লুকাতে পারলাম না যে আদিব আমায় বিয়ে করতে চায়না।কথাটা শুনা মাত্রই আম্মুর অপমানজনক কথায় যেন আমার বুকের ভেতরের ক্ষততে লবণ আর মরিচ ঢালার স্বাদ পাচ্ছিলাম।

বাবাও আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল।অপরদিকে,আমি ভাবছিলাম আদিবের মাকে সব বলবো বা আদিবের হাত-পা ধরে ওকে বিয়ে করতে রাজী করাবো। কিন্তু মন তা করতে চাইলেও বিবেকের কাছে বাঁধা পরছিলাম বারবার।

আসলে,অনেক বছরের সম্পর্ক তো তাই সম্পর্কের চেয়ে সময়ের বাঁধনে বাঁধা পরে গিয়েছিলাম বেশি।কথা বলাটা যেন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো।অভ্যাসের ফলশ্রুতিতে আদিব আর আমি একে অপরের খোঁজ নিতাম... কেমন আছি এই অবদিই কিন্তু আদিব তখনও বিয়ে করতে নারাজ। আমিও জোড়াজুড়ি বা তাকে প্রতারক বলে আখ্যাও দেয়নি।কারণ,আমি জানতাম আদিবের যা মন চায় তাই করে, আর আদিব ভুল কিছু কখনও করতেই পারে না।আসলে, বিশ্বাস করাটা সময়ের সাথে কখন যে রক্তে মিশে গিয়েছে বুঝিনি।আর আমরা মেয়েরাও বড্ড অদ্ভুত কাউকে ভালোবেসে ফেললে তার প্রতি আসক্ত হয়ে যায়।


এভাবে চলতে চলতে সত্যি সত্যিই বিয়েটা ঠিক হয়ে গেলো বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে। আর এবার না করারোও মুখ নেয়! আমার আত্মহত্যা করার মতোও সাহস নেয় ।দেখতে এসেই আংটি পরিয়ে চলে গেলো।ঠিক করেছি বিয়ের কার্ডটা আগে আদিবকেই দিব...

আজ মনটা শক্ত করে আবার আদিবকে ক্যাফেতে আসতে বললাম......


 সম্পর্কের নতুনত্বে আদিব নিজ থেকেই আগে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করতো,তার নাকি আমার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে ভালো লাগতো।আর এতে নাকি আমাকে অনুভবও করে বেশি আর ভালোবাসাও বাড়ে।গত ১ বছর যাবত অবশ্য আমিই তার জন্য অপেক্ষা করি ঘন্টার পর ঘন্টা আর সে ব্যস্ততায় দেরি করে ফেলে।

অথচ,আমিই নাকি ছিলাম তার পৃথিবী।আম্মুর ফোন চুরি করে সারারাত কথা বলার দিনগুলো কবে যে হারিয়ে গেলো চোখের পলকে টেরই পেলাম না।কত শখ ছিলো ওর, আমার নিজের ফোন হবে...আর ওকে আমার সাথে আম্মুর ফোন দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলতে হবে না।আজ দামি ফোন তো হলো ঠিকই কিন্তু কথা বলার মানুষটি কই...

এসব ভাবতে ভাবতেই আর ভাবনার ঘোর কাটিয়ে আদিব এসে আমার সামনের চেয়ারে ধপাস করে বসে পরলো......


নিষিদ্ধ_ভালোবাসা 

পর্ব_ (০২)

নওরীন খান।

 ৯ বছরের সম্পর্কের পর আমার প্রেমিক আদিবকে আজ কিভাবে আমার বিয়ের কার্ডটা দিবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

ক্যাফেতে সামনের চেয়ারটায় আদিব বেশ ফুরফুরে মেজাজে বসে আছে আর গুণগুণ করে গানও গাইছে।কাউকে বিয়ে করতে চেয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম মন থেকে আর সেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল।আজ সময়ের ব্যাবধানে তার আবেগ হয়েছে শূন্য,কমেছে আমার প্রতি মায়া আর টান আর আমারও থেমে নেয় কিছু।সময়ের স্রোতে চলছে সব....আসলে কারোর জন্য জীবনের কিছুই থেমে থাকে না!ঠিক চলে যায়...হয়তো যেভাবে চালানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল সেভাবে চলে না আর ভালো-মন্দেরও হিসাবের মাঝে পরে না।


~আদিব এই নে আমার বিয়ের কার্ড..তোকেই প্রথম দিলাম।

~কিছুটা ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে!বিয়ে মানে?কার বিয়ে?

~বললাম তো আমার বিয়ে।

~আমাকে তো জানালি না।কার সাথে আর কবে?

~কার্ডেই সব দেওয়া আছে।এইতো জানালাম।

~হুম।(কিছুটা উদাস আর দুঃখী মনে)


আদিবটাও না এমন অদ্ভুত।যখন আমি তার সাথে সারাজীবন পার করার আশায় তার প্রতীক্ষায় ছিলাম তখন আমায় ঠিক অগ্রাহ্য করেছিলো।ঠিক যখনই আমি ওকে ওর কাঙ্ক্ষিত মুক্তি দিতে চাইলাম তখনই ওর চোখে মুখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। হয়তো, এখন আমায় প্রতারক বলে বন্ধুমহলে এই দুঃখীমুখটা নিয়ে ঘুড়ে বেড়াবে আর আমি আখ্যায়িত হবো প্রতারিকা প্রেমিকা নামে।


~আদিব শোন যাওয়ার আগে শেষ একটা কথা বলে যাচ্ছি..

~হুম্ম বল।

~পরবর্তীতে যখন বিয়ে বা প্রেম করবি একটু কষ্ট করে বাসা থেকে জেনে নিস তারা কেমন মেয়ে চায়,আর নিজের মনের সাথেও কথা বলে নিস সে কি ৯ বা ১০ বছর পর বদলে যাবে কিনা!আসি....(কান্নাজড়িত কন্ঠে)


বাসায় আসার সাথে সাথেই আদিবটা কল দিলো।নাহ ধরবো না...অনেকটা দেরী হয়ে গিয়েছে।তাছাড়া,একমাত্র মেয়ে হিসেবে আমারও বাবা-মার প্রতি কিছু দায়িত্ব তো রয়েই যায়।

২বার কলটা বেজে কেটে গেলো...

ঠিক ৫টা মিনিট পরেই নিজের জেদের কাছে অন্তরে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা জিতে গেলো আর কেন ফোন করছে জানার আগ্রহও দমাতে না পেরে কল দিয়ে বসলাম।

~হ্যালো ফোন দিলি যে?আমি তো সব বলেই এসেছি।তাহলে আবার এখন কেন।

~নাহ এমনিই দিলাম।সত্যিই তোর বিয়ে?

~হ্যাঁ 

~আচ্ছা।ভালো থাকিস।আর মনে পরছে তোকে খু.....

এতটুকু বলতেই কলটা কেটে দিলাম।নাহ!আমি আবার মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছি...

মেয়েদের এই মন নিয়েই যত্তসব ঝামেলা।একবার মায়ায় জড়িয়ে গেলে আর ছাড়তে চায় না।এখন আদিব যদি আমায় ফোন না দিতো মনকে ঠিক বুঝ দিয়ে নিতাম যে,বিয়ের কার্ডটা পেয়ে আদিব খুশি হয়েছে আর মুক্তিও পেয়েছে।কিন্তু এখন?

এই আদিবটা আমায় জ্বালিয়ে মারলো!অবহেলা করে ছেড়েও যেতে চাইছে,আবার যখন মুক্তি পাচ্ছে আমায় তখন মায়ায় জড়িয়েও ফেলছে।

এক প্রবল দ্বিধায় ভুগছি আমি!এমন সময়ই বাবা এলো হাতে গয়নার ৩টি বাক্স নিয়ে:

"মা রে জানি তোর জীবনে একটা খুব খারাপ সময় গিয়েছে।তুই-ই আমাদের একমাত্র মেয়ে।তাই আমাদের বাবা-মা হিসেবে সব শখ-আহ্লাদ তোকেই ঘিরে।এই গয়না গুলো তোর মা আর আমি টাকা জমিয়ে জমিয়ে খুব শখ করে বানিয়েছিলাম।আমাদের মেয়েকে গয়নায় মুড়ে দিবো বলে।এই যে নিজ হাতে তোর বিয়ের এতো সব আয়োজন করছি,তোর ভবিষ্যৎটা নিজ হাতে গুছিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছি এই জীবনে এইতো ঢের!আর কি প্রয়োজন!তাছাড়া দুলাল আমার বন্ধু,একই শহরে থাকা হতো না বলে তোদের সাথে দেখাও করানো হয়নি তাই চিনিস না,শুনেছি তার ছেলেও খুব ভালো..তুই ভালো থাকবি মা।"


বাবা চলে গেলো কিন্তু আমায় আবার আরেকটা মায়া আর কর্তব্যবোধে জড়িয়ে দিয়ে গেলো।বাবা-মার প্রতি মায়া আর পরিবারের প্রতি কর্তব্যবোধ।এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে কেন জানিনা জীবনে আর বিয়েই করতে ইচ্ছা হচ্ছে না।মনে হচ্ছে,বিয়েই কি সব!যদিও আমার ভাবনাগুলো অবাস্তব,ভিত্তিহীন।তবুও মন বলছে ভালো হতো!


এমন সময় মা এলো হাতে ফোন নিয়ে।আমাকে পাশে বসিয়ে খুব আনন্দিত নয়নে বললো:

" এই নে নীলয়ের নাম্বার। কথা বল..বিয়ের আগে একটু একে অপরকে চিনে নে।"

প্রথমে,নীলয় নামটা শুনেই কেমন ধুপ করে ওঠেছিলো বুকটা।এক মূহুর্তের জন্য আদিব শুনেছিলাম।


মাকে হতাশ করে দিয়ে বললাম: "নাম্বার লাগবে না, যা কথা বলার তোমরাই বলে নাও।"

জোড় কদমে আগাতে লাগলো বিয়ের আয়োজন।বাসায় সব আত্মীয় স্বজনরাও চলে এসেছে।এরই মাঝে আদিবের মায়ের ফোন:

~হ্যালো সুপ্তি?

~জ্বি।আসসালামু আলাইকুম।

~ওয়ালাইকুম আসসালাম।শুনলাম বিয়ে করছিস?

~হুম।তবে বিয়েটা করছি না,বাবা-আম্মুই ঠিক করে দিয়ে দিচ্ছে।তুমি কেমন আছো?প্রেসারটা নরমালে আছে তো?

~রাখ তো তোর প্রেসার।তা আমার ছেলেকে যখন বিয়েটা করবিই না প্রেমটা করতে এসেছিলি কেন?

~তুমি সবটা জানো না তাই এমন বলছো।

~জানি জানি।সব জানি।শুনলাম তোর বরটাও খুব বড়লোক।হয়তো সেটাই কারণ... ভালো থাকিস।


আদিবের মা হয়তো অভিমান করেছে।আসলে, সব মায়েরাই নিজ সন্তানের সুখ-দুঃখের কথা সবার আগে ভাবে।নিজের মায়ের কাছেই হয়তো সন্তানের বড় অপরাধও বড় নয়।সে যায় করুক সবার আগে নিজের সন্তানের সুখ-চাহিদা।


তবে,কেন জানিনা নিজেকেও অপরাধী লাগছে।আদিবটা অবহেলার পর আমাকেই আবার অপরাধী করে ছাড়লো।


ফেসবুকে ঢুকে দেখলাম অনেকেই ম্যাসেজও করেছে।বেশিরভাগ ম্যাসেজই আমাকে আর আদিবকে নিয়ে করা।বেশির ভাগ ম্যাসেজগুলো এমন যে:

~"এতো বছরের সম্পর্কের পর তুই কিভাবে পারছিস বিয়ে করতে?"

~"আপু আদিবদা কে এভাবে কষ্ট দিতে পারছো তুমি?"

~"শুনলাম বর নাকি খুব ধনী তা আদিবকে কি এই কারণেই ছেড়েছেন নাকি ম্যাডাম?"

এই হলো আমার ইনবক্সের অবস্থা।হয়তো গ্রুপে গ্রুপে আমায় নিয়ে সমালোচনার ঝড়ও বয়ছে।আসলে,আদিবের আমার প্রতি করা অন্যায় আর অবহেলাগুলো ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে।তাই তা কারোর চোখে পরেনি বলে কেউ সেইদিক থেকে বিচার করছে না।সেইসব শুধু আমার মনেই কষ্টের ছাপ ফেলে গিয়েছে সকলের অগোচরে।কিন্তু আমার বিয়েটা স্পষ্ট তাই সবাই এইদিক থেকে অর্থাৎ বলা যেতে পারে একদিক থেকে বিচারে মত্ত।

আমরা মানুষেরা বড্ড অদ্ভুত।যা দেখি তাই বলি,ঘটনার পৃষ্ঠের ঘটনা দেখার চেষ্টা করিনা।


আজ রাত পার হলেই আমার গায়ে হলুদ।কাল বিয়ে...

আদিবের দেওয়া সমস্ত উপহার গুলো বের করেছি।এগুলো আমি সারাজীবন বয়ে নিয়ে বেড়াতে পারবো না।আমার বুকের উপর বোঝা হয়ে থাকবে আর কাঁটার মতো বিঁধবে।অশ্রুসিক্ত নয়নে উপহারগুলো শেষবার দেখছি.....

কতো মায়া,আবেগ,অনুভুতি, স্মৃতি জড়িয়ে আছে এগুলোয়।আমি কখনোও আদিবের দেওয়া উপহার গুলো ব্যবহার করতাম না।স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রেখে দিতাম।এসব কাল এক বান্ধবীর কাছে দিয়ে যাবো।আদিবকে ফেরত দিতে।


যতই জিনিসগুলো দেখছি ততই মায়া বাড়ছে।আচ্ছা আমি পালিয়ে যাই আদিবের সাথে?ছিঃ ছিঃ কি ভাবছি এসব!মা-বাবার সমাজে মুখ থাকবে না তাহলে।মন সকল বোঝার উর্ধ্বে তাই হয়তো মানতে চাইছে না আর মানাতেও পারছি না।তাছাড়া,আদিবও মানবে না।এমনটা ভাবতে ভাবতেই বিয়ের দিন চলে এলো....আমার পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা, পরিকল্পনা মাটি করে দিয়ে আজ আমার বিয়ে।হঠাৎ আমার পাশে বসা বান্ধবীর ফোনে আদিবের নাম্বার থেকে কল।ফোনটা ধরার সময় পাওয়ার আগেই কাজী সাহেব এসে হাজির।


আমি আর আমার মাঝে ছিলাম না,মন বলেও কিছু অনুভব করছিলাম না,অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছিলাম আর এরই মাঝে বিয়ে হয়ে গেল।


আমার চেনা শহর আর মানুষগুলোকে ছেড়ে চলে এলাম ভিন্ন এক শহরে।


ফুলসজ্জার খাটে বউ সেজে বসে আছি।আদিবকে নিয়ে কল্পনা করা এই দিনে আজ দিনটা ঠিক থাকলেও বদলে গিয়েছে মানুষ।

তবে,আমার কাউকে ঠকানোর অধিকারও নেয়।তাছাড়া যে আমায় বিয়ে করেছে তারও অধিকার আছে আমার অতীত সম্পর্কে জানার।আজই সব বলে দিতে হবে....

ঘড়িতে বাজে রাত ১২ টা।এসময় নীলয় ঘরে প্রবেশ করলো।আমি ঘরেই পায়চারি করছিলাম আর ভাবছিলাম নীলয়কে সব কিভাবে বলবো আর শুরুটাইবা কিভাবে করবো!কিভাবে বুঝাবো যে,আমার ওকে এই মুহুর্তে স্বামী হিসাবে মেনে নেওয়া সম্ভব না।আমারও তো মন আছে, আমি তো আর নিজের মনের উপর জোর খাটাতে পারি না।


নতুন বউয়ের এমন চিন্তিত মুখে পায়চারি দেখে নীলয় খুব অবাক হলো মনে হলো।তাকে আরোও অবাক করে দিয়ে বললাম,

"আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে"


নিষিদ্ধ ভালোবাসা

পর্ব-(০৩)

নওরীন খান।


ফুলসজ্জার রাতেই আমার নতুন বরকে আমার প্রেমিকের কথা বলে দিয়েছিলাম।সাথে এটাও বললাম, এই মুহুর্তে আমাকে তার স্ত্রীর ভূমিকা পালন করা সম্ভব না।

কয়েক মাসের প্রেমিক হলে তাও একটা কথা ছিল,৯ বছরের সম্পর্ক ছিল আমাদের!


নীলয় মানে আমার বর আমাকে ছেড়ে দিবে নাকি আমার অতীত মেনে নিবে এসব কিছুই কথাগুলো বলার আগে মাথায় কাজ করছিলো না বা আসেও নি।মাথায় তখন শুধু একটাই কথা ছিল যে,কিভাবে তাকে সব গুছিয়ে বলবো,কিভাবে শুরু করবো।তবে,কথাগুলো বলার পর নীলয়ের নিস্তব্ধতার এই মুহুর্তে আমার ভবিষ্যত নিয়ে ভাবছি আর মনে মনে দৃঢ়তা আনছি যাতে বের করে দিলেও অনুনয়-বিনয় করতে না হয়, আবার বাবা-মায়ের উপরেও বোঝা না হতে হয়!

আমার ভাবনা আর নীলয়ের নিস্তব্ধতার পাঠ শেষ করে নীলয় শুধু একটা কথাই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো:

"ঘুমিয়ে পরো"

আমার মনে হাজারো প্রশ্নের ভিড় এসে জড়ো হলো।নীলয় কেন আমার ৯ বছরের সম্পর্কের কথা আর সেটা ভাঙ্গনেরও কারণ জেনে কিছুই বললো না!নীলয় কি কাল আমায় বের করে দিবে!

এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম বুঝেই ওঠতে পারলাম না আর সকালে ঘুম ভাঙলো ননদের ডাকে।ওঠার সাথে সাথেই ননদের প্রশ্নের মুখে পরলাম:

"একি ভাবি ভাইয়া অন্য ঘরে ঘুমাচ্ছে যে?"

কিছুই বললাম না কিছুটা এড়িয়েই ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই খেলাম আরেকটা ধাক্কা!

বিয়ে বাড়িতে মানে বরের বাড়িতে যতোজন আত্মীয় এসেছিল সকলেই আমার ঘরে এসে জড়ো হয়েছে আর নীলয় কেন ঘরে ছিল না তার গুঞ্জন।

এতো মহা বিপদ!আজ আবার বউভাতে বাবা-মাও আসবে তারা এসে এসব শুনলে বড্ড কষ্ট পাবে।হঠাৎ নীলয় ঘরে ঢুকে পরিস্থিতি তার পেট খারাপের কথা বলে ভালো ভাবেই ঠান্ডা করে দিলো।আসলে নীলয়ের পরিবারেরও তো মান-সম্মানের ব্যাপার আছে!

এই যাত্রাই রক্ষা!

এরই মাঝে নীলয় আমার সাথে খুব দরকার ছাড়া একটা কথাও বলে না আর পরিস্থিতি এড়াতে ওর ঘরেই খাটে আমাকে থাকতে দিয়ে সে থাকে নিচে।যদিও ওইদিকে আমার কোন মাথা ব্যাথাই নেই।


বউভাত,নীলয়ের বাড়ির আত্মীয়দের আপ্যায়ন,নতুন বউয়ের কর্তব্য,শ্বাশুড়ির থেকে রান্না শিখা,ননদের চাহিদা মিটানো আর তার সাথে আড্ডায় ব্যস্ত আমি আমার ৯ বছরের অভ্যাস কাটিয়ে ওঠতে চলেছি।অভ্যাসটা ছিল আদিবের সাথে কথা বলা।যার সাথে কথা বলা ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারতাম না,যার সাথে ৫ ঘন্টা কথা না হলেই গাল ফুলিয়ে দিতাম আর মাঝে মাঝে আমায় ভুলে গিয়েছে,সে বদলে গিয়েছে ভেবে ফুপিয়ে কাঁদতাম।এই মূহুর্তে এসে এটা আবিষ্কার করলাম যে,

"ব্যস্ততা মানুষকে সব ভুলিয়ে রাখতে পারে"

তবে হ্যাঁ, যখন সংসারের এসব ঝামেলা থেকে কিছুটা একা থাকি,যখন সন্ধ্যার পর ছাদে কিছুটা সময় কাটাই বা নির্ঘুম কোন রাত কাটে,হঠাৎ যখন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায় খুব মনে পরে তখন আদিবের আমাকে আর আমার আদিবকে দেওয়া কথাগুলো।কতো বিকাল একসাথে হাতে-হাত রেখে ভবিষ্যত সংসারের পরিকল্পনা করে কাটিয়েছি!আমাদের সন্তানের নাম ঠিক করেছি!এসব ভাবলেই গাল বেয়ে ২ ফোটা জল পরে যায়।ঠিক তখনই মনটা আবার আদিবের সাথে কথা বলতে উথাল-পাতাল করে,ফোনটা হাতেও নেই কিন্তু ফোন আর দেওয়া হয় না।নাম্বারটা এখনও চোখ বন্ধ করে ডায়াল করতে পারি!


এখন সময়টা কাটছে মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে আত্মীয়দের বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে।নিজেদের মাঝে মিল থাকুক বা না থাকুক প্রকৃতির রীতি এড়ানোর সাহস আমাদের নেই,পরিবার আর সমাজ নামক শিকলে আমরা বাঁধা।

এখন আদিবকে আরেকটু ভুলে গিয়েছি,দেখা যাচ্ছে আগে প্রতিদিন একবার করে কথা বলার শখ জাগলেও এই আত্মীয়দের ভীড়ে আর ঘুরতে ঘুরতে নিজের ক্লান্ত শরীরে নিজেকে নিয়েই ভাবার সময় পাইনা।

আত্মীয়দের বাড়িতে ঘুরার পাঠ চুকিয়ে এখন নাকি নীলয়ের বন্ধুরা আসবে তার বউকে দেখতে।নীলয়ের পরিবারের সবাই গিয়েছে গ্রামে তাই সব রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সব দায়িত্ব এলো আমার ঘাড়ে।নীলয় টুকটাক যা-ই কথা বলে বা অর্ডার করে কিছুই ঠিক মানুষের সাথে কথা বলার মতো না।অনেকটা রাগী আর ধমকের সুরে,দায় সারা কথা-বার্তা।শুরুতে এসব আমার গায়ে না লাগলেও আর এটাই চেয়েছিলাম ভাবলেও কয়েকদিন ধরে আমার বেশ রাগ আর খারাপও লাগছে।মনের একদিক বলছে এমনই তো কথা ছিল আবার অন্যদিক বলছে একসাথে এতোদিন থাকছি একটু ভালো করে কথা বললেও তো পারে,বাড়ির বুয়ার সাথেও তো আমার থেকে ভালো আচরণ করে!

নীলয়ের কথা যখন আমার মনে আঘাত করে ঠিক তখনই আদিবটার কথা মনে পরে:

"ইসস আদিব কখনই পারতো না এভাবে কথা বলতে,নীলয়ের জায়গায় আদিব থাকলে খুব ভালোও থাকতাম!"

মনে রয় আফসোস আর চোখে জল।


আসলে,মানুষের সন্তুষ্টির বরই অভাব।আর,কোনো মানুষ কাছে না থাকলেই তার শুধু ভালো দিকই মনে পরে।মন থেকে মুছে যায়,আদিবের করা আচরণ।এখন যদি আদিব এই আচরণ গুলো করতো বা আদিবের সাথে বিয়ে হতো আমার আফসোস তখনও থাকতো।মনকে সন্তুষ্ট করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার।


যাইহোক,বুয়াকে সাথে নিয়ে নীলয়ের বন্ধুদের জন্য নানাধরণের খাবার রান্না করলাম।রান্নার ব্যস্ততায় আদিবের জন্য আফসোস আর নীলয়ের জন্য রাগ কিছুই অনুভবে আর আসলো না।আগেই বলেছিলাম:

"ব্যস্ততা মানুষকে সব ভুলিয়ে রাখতে পারে"

খাওয়া শেষে নীলয়ের বান্ধবীদের সাথে ছাদে বসে আড্ডা মারছিলাম।কথায় কথায় নীলয়ের ২ জনের সাথে সম্পর্কের কথা ওঠে এলো।একজনের সাথে ব্রেক-আপের পর তাকে ভুলতে আরেকটি মেয়ের সাথে কথা বলতে বলতে বন্ধুত্ব থেকে সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলো নীলয়।কিন্তু মেয়েটির নাকি বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো!তখন নীলয়ের চাকরীও ছিলো না!মেয়েটি নাকি বাবা-মায়ের আর পরিবারের দোহায় দিয়ে নীলয়ের থেকে বিদায় নিয়েছিলো।নীলয়ের সেই বান্ধবীটি হাসতে হাসতে বললো:

~"জানো পরে কি হয়েছিলো?আমি ওই মেয়েকে ম্যাসেজ দিয়েছিলাম তার বিয়ের দিন"

~"কি ম্যাসেজ?"

~"বাবা-মায়ের কথার বিরুদ্ধে যাবি না তাইলে করলা ভাজি করলে খাছ না কে ছেরি?”

আপুর কথা শুনে খুব হাসি না পেলেও আপু যে ময়মনসিংহের সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলাম।

রাতে নিজে নিজেই ভাবছি:

"নীলয় নিজে ২টা সম্পর্কে ছিল তাহলে আমার সম্পর্কের কথা শুনে সে এমন রাগ কেন দেখাচ্ছে।সে কিছু বললেও সরাসরি বলা হয়ে যেত কিন্তু একই বাসায় থেকেও শত্রুর মতো আচরণ কেন করছে?"


এই ছেলেগুলোও না অদ্ভুত।নিজের সব ভুল বা দোষ দোষ না কিন্তু প্রেমিকা বা বউয়ের দোষ আর দোষ থাকে না মহা-অন্যায় হয়ে যায়।তারা শুধু অন্যদেরই বিচার করবে নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে কিন্তু নিজেদের গুলো নিয়ে ভাববে না।


এরই মাঝে নীলয়ের বাড়ির সকলেই ফিরে এলো এক মহা প্রস্তাব নিয়ে।আমাকে আর নীলয়কে হানিমুনে পাঠাবে!কক্সবাজারের সব আয়োজনও করে ফেলেছে।না করারো মুখ নেয় আর না করলেই সন্দেহ করে হাজারো প্রশ্ন করবে।বাধ্য হয়েই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম:

"ইসস বান্ধবীদের সাথে গেলে কত্তো মজা হতো!সারাজীবন তাদের সাথে এই জায়গায় ট্যুর দেওয়ার প্ল্যানই করে গিয়েছি,বাস্তবায়ন আর হয়নি"

হঠাৎ করে মনে পরলো, বেশ কয়েকদিন পরেই মনে পরলো আদিবের কথা!আমাদের অনেক শখ ছিলো ১ মাসই হানিমুনে খুব ঘুরে-বেড়াবো!

হঠাৎ করেই এসব ভাবতে মানে আদিবের কথা ভাবতেই এমন অপরাধ-বোধ জাগছে কেনো!তবে কি আমার মন নিজেকে এই বাড়ির মানে নীলয়ের বউ ভাবতে শুরু করেছে!

ভাবনার ঘোর কাটিয়ে ব্যাগ গুছানোয় মন দিলাম আর ঠিক করে নিলাম হানিমুন-টানিমুন কিচ্ছু না নিজে নিজেই ঘুরতে তো পারবো!

বিয়ের ঝামেলায় আর আদিবের বিরোহে মনটা কেমন দুমড়ে গিয়েছে!সমুদ্রের কাছে গিয়ে সব ভুলে হালকা হয়ে আসি!

পরেরদিন,রাতে বেরিয়ে পরলাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে আর সকালে হোটেলে উঠলাম।


আমার বর রিসিপশনে গিয়ে সব ফরমালিটিস সারছে আর আমি ওয়েট করছি।হুট করে আমার সামনে দিয়ে আদিব রিসিপশনের এদিকে হেঁটে গেলো! না চাইতেও ওঠে তার পিছু পিছু যাচ্ছি।সে রুম বুকিং দিচ্ছে আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে......

চলবে.....


(আগের পর্বের লিংক কমেন্ট বক্সে দেওয়া থাকবে)


-গল্প:নিষিদ্ধ_ভালোবাসা

-পর্ব_ (০৪)

Nowrin_Khan


প্রাক্তন প্রেমিক আদিবের সাথে অন্য মেয়ে দেখে বুকটা কেমন ধরাস করে উঠলো।তাও আবার হোটেলের রুম বুক দেওয়ার সময়.....

এমন দিন দেখতে হবে আগে থেকে জানলে আমি কখনই হয়তোবা আমার বরের সাথে কক্সবাজার আসতাম না।

"আচ্ছা আমিও তো বিয়ে করে ফেলেছি,তাহলে আদিবই বা কেন আমার জন্য অপেক্ষা করবে?"মনকে এই কঠিন সত্যি কথাটি বুঝাতে গিয়েও ব্যর্থ হচ্ছি বারবার।আর ব্যর্থ এই আমার আমিকে নিয়ে এখনও হতবাক হয়ে আদিবের দিকে তাকিয়েই আছি,তবে আদিবের আমার প্রতি নেই কোন ভ্রুক্ষেপ।হয়তো দেখেনি বা দেখতে চায়নি।মন শুধু বলে যাচ্ছে একটি কথায়, আর কিছুদিন তো অপেক্ষা করতে পারতো!আমার চলে যাওয়া কি তার মনে একটুও দাগ ফেলেনি,কষ্ট কি হয়নি একটুও!প্রতারকের থেকে প্রতারিত হওয়ার পরেও আমার তো ঠিকই তার বিরীহে প্রায়ই হাহাকার করে ওঠে মনটা,ইচ্ছে হয় চিৎকার দিয়ে উঠি!

" ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের মন যে সত্যিই খুব নরম তা আবারও প্রমাণিত"


নীলয়ের সাথে হোটেলের ঘরে চলে এলাম।নিথর আমি আমাকে কিছুতেই আর ধরে রাখতে পারছি না,এক বুক দমবন্ধ অনুভূতি আমাকে গ্রাস করে রাখছে।নীলয় মানে আমার বর জানতে চাইলো বাইরে যাবো নাকি,না করে দিয়ে শুয়ে পরলাম।আর পারছি না আমি এখানে থাকতে পারবোই না!যত তাড়াতাড়ি না এই স্থান ত্যাগ করছি আমার মুক্তি নেই।নিজেকে জেল খানার কয়েদি মনে হচ্ছিলো।


নীলয় ঘরে আসতেই কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললাম ফিরে চলো।নীলয় অনেকটা চমকে ওঠলেও যেহেতু সে আমার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না আর আমাদের সম্পর্কের কোন নাম নেই তাই অজুহাতও চাইলো না।শুধু বললো ব্যবস্থা করছি।


মনে ভয় নিয়ে একরাত রয়ে গেলাম সেই হোটেলেই।ভয়টা ছিল এই যে,যদি বের হলে আদিবকে আবার ওই মেয়ের সাথে দেখে ফেলি!


পরেরদিন,চলে এলাম আর বাড়ি আসতেই আবার সেই প্রশ্নের মুখে।কেন এতো তাড়াতাড়ি আর তাড়াতাড়ি বললেও ভুল হবে একদিন থেকেই কেন কক্সবাজার থেকে চলে এলাম!আমার শরীর খারাপ আর নীলয়ের অফিসের জরুরি মিটিং এর কথা বলে নীলয় আবারও আমায় বাঁচিয়ে নিলো একগাদা প্রশ্নের মুখ থেকে।


কিন্তু সন্দেহ যেন যায় না শ্বশুরবাড়ির লোকের।তার উপর নতুন বউ!সবাই যেন,ভুল ধরায় মত্ত।


বিএসসি টা শেষ করে ওই ফাঁকে বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল।এমএসসি টা করতে চাইছি এখন।আসলে,এসব থেকে দূরে থাকারও এটা একটা পন্থা।আর ইচ্ছা তো আছেই!কিন্তু,আবার পড়াশুনা শুরুর নাম শুনার সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেলো শ্বশুর বাড়ি থেকে নানাধরণের কথাবার্তা যা আমার দেহে কাঁটার মতো বিঁধছে।আমার দাদি শ্বাশুড়ির ভাস্য মতেঃ

"আমরা বউ ঘরে তুলছি,কোন ইস্কুল-কলেজের ছাত্রী না।আর নতুন বউ অনেক তো পড়াশুনা করছে এখন কই বাচ্চা-কাচ্চা,সংসারের কথা ভাব্বো....তানা আবার কলেজে ভর্তি হইবো!কতদিন আর হয়ছে বিয়ার"

আমার শ্বাশুড়িও সম্মতির সুরে মাথা নাড়লেন।

কিন্তু আমি আমার ইচ্ছায় অনড়।তাই শ্বশুড়বাড়িতে খুব অল্প দিনেই জেদি,বেয়াদব বউয়ের উপাধিও পেয়ে গেলাম।বদলে গেলো সকলের আচরণ। আর পেরে উঠতে না পেরে সিদ্ধান্ত নিলাম কিছুদিন বাবার বাড়িতে থেকে আসি।


"কিছুদিনের জন্য আমার বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকতে চাই"

সকলেরই নতুন বউকে বাবা বাড়িতে এখনি কিছুদিনের জন্য পাঠানো নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই কিন্তু নীলয় বলে ওঠলো:

"আমি কাল দিয়ে আসবো আপনাকে"

নীলয় কি আমায় সাপোর্ট করলো নাকি আমায় অসহ্য লাগছে বলে আমার থেকে মুক্তি পেতে রাজি হয়ে গেলো!দ্বিধায় পরে গেলাম.....


আসলে অনেকদিন যাবত আদিবের আমার থেকে মুক্তি চাওয়ার আকাঙ্খা দেখে আমার মনে এটাই গেঁথে গিয়েছে যে,আমাকে কারোরই হয়তো সহ্য হয়না!আমার থেকে সকলেই মুক্তিই কামনা করে!এখন সেটা সাপোর্টই হোক!


আসলে,মানুষ যা দেখে অভ্যস্ত হয়ে যায় বাকি সব তার কাছে তেমনি লাগে।


তবে,বাবার বাড়ি এসেছি বলে বাবা-মা যে খুব খুশি হয়েছে তাদের মেয়েকে দেখে এমনও নয় কিন্তু।আমার আসাটা তাদের কাম্য ছিলো না,আমার মায়ের বড় বড় চোখ করে বলা কথাগুলো শুনেই সেটা স্পষ্ট বুঝলামঃ

"সুপ্তি তুই?এখন?আর হাতে ব্যাগ কেন?"

অনেকদিন পর আমি যাচ্ছি তাই বাবা-মা খুশিই হবে হয়তো-আসলে আমার এই ভাবনাটাই ছিলো ভুল!

এবার বাবার দিকে তাকালায়,তার কপালেও ভাঁজ আর বিন্দু বিন্দু ঘামও জমেছে।আমাদের দেশে, প্রায় পরিবার গুলোতেই বিয়ে দিলেই দায়মুক্ত আর বিয়ে হয়ে গেলে মেয়ে শত অশান্তি নিয়েই শ্বশুরবাড়িতেই থাকবে এই রীতি চলে এসেছে বহুদিন ধরেই।কিন্তু বিয়ে হলেই যে,মেয়ের প্রতি দায়িত্ব আরোও দ্বিগুন বেড়ে যায় তা মানতে প্রতি পরিবারই নারাজ।তাদের কথা হলো যাই-ই হোক না কেন,শ্বশুর বাড়ির মাটি কামড়েই থাকতে হবে।

প্রতি পরিবারই যদি বিয়ের দিনই তাদের মেয়েকে বলে দিতঃ

("আমরা ছেলে আর তার পরিবারের আর্থিক আর সামাজিক অবস্থা দেখেছি মনের অবস্থা নই তাই যাই-ই হয়ে যাক আমাদের দরজা তোমার জন্য চিরদিন খোলা থাকবে")

তাহলে হয়তো মেয়েদের স্বামীর বাড়িতে নির্যাতন আর নিজের ডিপ্রেশন দুই-ই কমে যেতো।কিন্তু, আফসোস!

মা-কে জানালাম নীলয়ই আমায় দিয়ে অফিসে চলে গিয়েছে।কিন্তু নীলয় আমার সাথে বাড়ির ভিতরে কেন এলো না এর দায় আসলো আমার উপর।

"তুই নিশ্চয় জামাইয়ের সাথে ঝগড়া করে চলে এসেছিস তাই জামাই ভিতরে আসেনি।আচ্ছা তুই কি আমাদের একটুও শান্তি দিবি না?"

মায়ের কথায় এবার কিছুটা না ঠিক অনেকটাই রাগ হচ্ছে।কারণ ঝগড়া তো আমি করিনি,শুধু মনের বিরুদ্ধে যাইনি।

"নীলয়ের অফিসে কাজ আছে তাই চলে গিয়েছে"

এটা বলেই চলে এলাম আমার ঘরে আর পেছন থেকে শুনতে পারছিলাম মা জিজ্ঞাসা করছে রাতে নীলয় আসবে কিনা।কিন্তু আমি উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না।দড়জাটা বন্ধ করে নাম্বার খুঁজছি.....আদিবের এক বন্ধুর নাম্বার।আদিবের বিয়ের বিষয়টা খোলাশা না হওয়া পর্যন্ত মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না।খুব খোঁজে অবশেষে এক ডাইরির পাতায় নাম্বারটা পেলাম......

~হ্যালো আকাশ ভাইয়া?আমি সুপ্তি।

~হ্যাঁ আকাশ বলছি।সরি আপু ঠিক চিনতে পারলাম না।কোন সুপ্তি?

~আমি এখন আদিবের প্রাক্তন। 

~ও হ্যাঁ চিনতে পেরেছি।

~ভাইয়া আদিব কি বিয়ে করেছে?

~হ্যাঁ প্রায় ১.৫ বছর সম্পর্কের পর বিয়ে করেছে।

~কয় বছর ভাইয়া?

~দেড় বছর।

~আচ্ছা ভাইয়া রাখছি।

কিন্তু আমার সাথে আদিবের সম্পর্ক শেষ করে আমার বিয়ে হয়েছে মাত্র কয়েক মাস।তার মানে আমাকে অবহেলার এই ছিলো কারণ।এখন পুরোটা স্পষ্ট আমার কাছে।সব দিক থেকেই নিঃসঙ্গ লাগছে।আচ্ছা আমাকে দেখতে দেখতে আদিবের কি বিতৃষ্ণা চলে এসেছিলো?কই আমার তো আসেনি!তবে,এখন অনেক বিতৃষ্ণা অনুভব করছি!হয়তো আদিবের থেকেও বেশি.....

নীলয়কে ফোন দিলাম।এক্ষুনি এসে আমাকে নিয়ে যেতে বললাম।নীলয় শুধু আচ্ছা বললো।


নীলয় চলে আসবে কিছুক্ষণের মাঝেই।ব্যাগ নিয়ে আবার আমার রুম থেকে বেরিয়ে পরলাম।বের হতেই মায়ের প্রশ্ন।কি ঝামেলা বাঁধিয়ে এসেছি।মা'কে জানালাম কিচ্ছু হয়নি।আর কিছু হলেও তোমাদের আর আমার দায় নিতে হবে না,আমি আমার নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে পারি।আর এ বাসায় আমি আর আসবোও না।কথা শুনেই মা চড় মেরে বসলেন আর এরই মাঝে নীলয় চলে এলো।

গালে হাত দিয়েই নীলয়কে বললামঃ

"চলো"

নীলয় কিছুটা বিভ্রান্তিতে পরে গেলো।কিন্তু,আমি এসব কিছু অগ্রাহ্য করে গাড়িতে গিয়ে বসলাম।নীলয় গাড়িতে ওঠে বললোঃ

~"কোথায় যাবো?"

~"জানি না।"

নীলয় গাড়ি চালাতে থাকলো হঠাৎ করে অনুভব করছিলাম এই একজনই হয়তো আছে যে রেগে থাকলেও আমি কিছু বলার সাথে সাথেই কখনই না করেনি।

~"নীলয় আমি এমএসসি করতে চাই"

নীলয় সেইবারও শুধুই বললোঃ

"আচ্ছা"

শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে নীলয় জানালো আমাকে ভর্তি করিয়ে দিবে আবার....

আবার সকলেই আপত্তির সুর তুললো কিন্তু নীলয়ের এক কথা সবাইকে চুপ করিয়ে দিলোঃ

"আমি চাই আমার বউ উচ্চশিক্ষিত হোক।".......

আসলে,শ্বশুড় বাড়িতে সবাই এক হবে না এটাই বাস্তবিক।কিন্তু, যদি স্বামী পাশে থাকে তাহলে যে যেমনই হোক না কেন সবার সাথেই মানিয়ে থাকা যায় আর প্রাপ্য সম্মানও পাওয়া যায়, তা প্রমাণিত করতে পেরে নীলয়ের প্রতি সত্যিই আজ খুব কৃতজ্ঞতা বোধ হচ্ছে।


আজ সকালে আমি নীলয়ের সাথে এমএসসি তে ভর্তি হতে যাচ্ছি।এরই মাঝে কয়েকমাস পর আবার আদিবের কল........


-গল্প:নিষিদ্ধ_ভালোবাসা

-পর্ব_ (০৫) (সমাপ্ত) 

Nowrin_Khan


বিয়ের এতো মাস পর প্রাক্তন প্রেমিকের ফোন দেখে শুধু অবাকই নয় মনে মনে তার জন্য রাগ,ঘৃণাও হচ্ছিলো...

হয়তো রাগ আর ঘৃণাটা এতো তীব্র হতো না,যদি না জানতাম সে অতীতে আমার সাথে প্রতারণা করেছে।

আসলে মানুষ সব মাফ করতে পারলেও প্রতারণা ক্ষমা করতে পারে না....প্রতারণা যেন এক গরম লোহার হাতল যা একবার মনে ছুঁয়ে গেলে দাগ থেকে যায় আজীবন।

ফোনটা ধরবো নাকি ধরবো না ভাবতে ভাবতেই ধরে ফেললাম....

মনে জমা সকল তিক্ততা আজ কথার মাধ্যমে তাকে শুনিয়ে দিয়ে এই দায় থেকে আমায় আজ মুক্ত হতে হবে।

ফোনটা ধরতেই-

~কি পাইছো কি তুমি?এখনও আমাকে জ্বালিয়ে যাবা?একটুও শান্তি দিবা না?এখন তো তোমারও বিয়ে হয়ে গিয়েছে..এখন একটু রেহায় দাও আমায়।এতো অন্যায় আমার আর সহ্য হচ্ছে না।

~অথচ এই কথাগুলো আমার তোমাকে বলা উচিত ছিল তোমার করা অন্যায়ের জন্য।

"মানুষ নিজের দোষ অপরের উপর চাপিয়ে নিজে মহৎ সাজতে খুব ভালো পারে"

~তুমি আকাশকে ফোন দিয়েছো কেন?

~তোমার আমাকে ঠকানোর নমুনা জানতে...

এতটুকু বলেই ফোনটা কেঁটে দিলাম।অনেককিছু বলার পরিকল্পনা শুরুতে করে থাকলেও কথা বলার সময় পরে আর মুখ দিয়ে কিছু বের হলো না।

অথচ,যে দোষী সে-ই আমার থেকে বেশি কথা শুনিয়ে গেলো।

"দোষীদেরই তাদের দোষ আর ভুল ঢাকতে বেশি কথার প্রয়োজন পরে"

"বের হবেন কখন?আপনার ভর্তির কাজ শেষ করে আমাকে অফিসে যেতে হবে।আমারও তো অফিসে কাজ আছে,সারাদিন তো আর অপেক্ষা করতে পারিনা"-নীলয়..

হ্যাঁ চলুন..

গাড়িতে যেতে যেতে নিজেকে একবার স্বার্থপরের কাতারে চিন্তা করলাম।যেই নীলয়কে আমি স্বামী হিসেবে মেনে নিতে চাইনি এখন তার থেকেই কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য সাহায্য কামনা করছি!অবশ্য, এখনও তাকে স্বামীর মতো ভাবছি না।একজন উপকারী বন্ধুর তালিকায় তাকে ফেলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করছি।

~" আমি কি খুব বেশি স্বার্থপরের মতো আপনার থেকে সুবিধা নিচ্ছি? "

~আপনি আমাকে স্বামী হিসাবে না মানলেও সামাজিক রীতিতে আমার স্বামী হিসাবে কিছু কর্তব্য আছে।আমি শুধু আমার কর্তব্যই করছি আর আপনিও কর্তব্যের খাতিরে আমার থেকেই সাহায্য চেয়েছেন।এখন যদি আপনার প্রাক্তন আপনার স্বামী হতো তাহলে আপনি তাকেই বলতেন....এটাই প্রকৃতির রীতি।আর এখন চুপ থাকেন।গাড়ি চালানোর সময় এতো কথা ভালো লাগে না।

নীলয় আমাকে প্রাক্তন নিয়ে কিছুটা খোঁচা দিলেও আমাকে সাপোর্ট করায় কৃতজ্ঞবোধও হচ্ছে।


ভর্তির কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরেই সবার মাঝে থমথমে ভাব উপলব্ধি করলাম।হয়তো,আমার ভর্তি নিয়েই বাড়ির এই হাল!

তবে,যেহেতু সামাজিক রীতিতে এই বাড়ির বউ আমি তাই তাদের থমথমে ভাব দূর করে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করা আমারই কর্তব্যের মাঝে পরে।

তারা আমার ভর্তি হওয়াতে নারাজ ছিল বলে আমিও অভিমান করে থাকলে তাদের সাথে দূরত্ব আরোও বাড়বে।

আসলে,আমার মনটাও আজ ভালো আর মন ভালো থাকলে সব কর্তব্যই পালন করতে মন থেকে আগ্রহ পাই আর ভালো লাগে।


রান্না ঘরে ঢুকেই সবার পছন্দের খাবার বানালাম।সবাই খেয়ে যে অনেকটাই খুশি হলো মুখে না বললেও তা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।আর শ্বাশুড়ি মায়ের বাতের ব্যাথার জন্য আসার সময় একটা মালিশের তেলও নিয়ে এসেছিলাম।খাবারের পরে ওটা দিয়ে মালিশ করে দিচ্ছি...মা হয়তো আরাম পাচ্ছে..আমার পানে সন্তুষ্টির দৃষ্টিতে তাকালো...

এবার ননদের ঘরে গিয়ে আমার থেকে একটা থ্রিপিস দিয়ে আসলাম।বিয়ের পরেরদিনই সে ওইটা খুব পছন্দ করেছিলো।খুশিতে তো আমায় জড়িয়ে ধরলো....

তবে,দাদি শ্বাশুড়ি এখনও আমার উপর অসন্তুষ্ট।কথা শুনিয়েই যাচ্ছে.....

উনাকে পান সাজিয়ে দিলাম কিন্তু খেলো না...কিছুটা মন খারাপ হলো বটে!

আসলে,আমি একা সবার মন জয় করতে পারবো এমন তো না।কেউ কেউ থাকবে এমন যাদের আমাকে ভালো লাগবে না।সবাইকে নিয়েই তো সংসার।


সংসার!আমি কি সংসার করছি!তাহলে আমি কি নীলয়ের বউ হয়ে গিয়েছি!ভাবতেই অনেকবেশি লজ্জা পেয়ে লজ্জা-মিশ্রিত চোখে নীলয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে আছি...এই প্রথম নীলয়কে ভালো করে দেখছি।নাহ খুব খারাপ না কিন্তু দেখতে!

তবে,মনে এখন আর কোন নীলয়ের ব্যাপারে দ্বিধা আর অনীহা আসছে না।


হয়তো কারো সাথে থাকতে থাকতে তার প্রতি মায়া চলে আসে।মন না চাইলেও আসে....আর মনের উপর কারো তো হাত নেই!


চা বানাচ্ছি..নীলয়ের অফিস থেকে আসার সময় হয়ে গিয়েছে।আসতেই চা-টা দিতে হবে।কলিং বেলটা বাজতেই দরজাটা খুলে মুচকি হাসি দিলাম....

কি করে ফেললাম!হাসতে তো চাইনি!নীলয় কি ভাবলো কে জানে!

তবে এই প্রথম নীলয়কে চা বানিয়ে দিচ্ছি দেখে সে বেশ অবাকই হলো।যদিও কিছুই বললো না ধন্যবাদ ছাড়া।


~আমার কিছু বই লাগবে।

~আমি কাল অফিস থেকে আসার সময় নিয়ে আসবো।কিন্তু আমার যদি মনে না থাকে..কাজের চাপে আমাকে কিছু আনতে বললে ভুলে যাই আমি।

~আপনার নাম্বারটা দিন আমি মনে করিয়ে দিব।


প্রথমে নাম্বার নেওয়া।এরপর বই আনা,এটা-সেটা আনার অজুহাতে ফোন দেওয়া,কথা বলা,কথার পৃষ্ঠে আবারও কথা বলা,চা বানিয়ে দেওয়া,একসাথে খেতে বসা এসব করতে করতে আমাদের মাঝে জড়তা অনেকটাই কমে গিয়েছে।সম্পর্কটা ভালোবাসার সম্পর্ক পর্যন্ত না গেলেও একে ভালো সম্পর্ক বলাই যায়!


নীলয়ের সাথে তার অফিস থেকে সাজেকে ঘুরতে এসে সম্পর্কটা আরও ভালোর দিকে আগাচ্ছে....

এরপর আমরা প্রায়ই ঘুরতে যেতাম...

আর এভাবেই একপা-দুপা করে আমাদের মাঝে এখন আর জড়তা নেই বললেই চলে।


আসলে,সময় মানুষকে সব কিছুর সাথেই খাপ খাওয়াতে বাধ্য করে জিতেও যায়!


৩ বছর হয়ে গিয়েছে...

সম্পর্কটা এখন ভালো সম্পর্ক থেকে ভালোবাসার সম্পর্কে রূপ নিতে শুরু করেছে।


এমএসসিটাও শেষ করে বসে আছি তবে এখন চাকরি করার ইচ্ছাপোষণ করছি।

সেই আবার শ্বশুরবাড়ির চাকরি করা নিয়ে অশান্তি!তাদের বাড়ির বউয়েরা চাকরি করে না আরও কতো কি!

এবার তো আমার বাবা-মাকেও ডেকে এনেছে মিটিং করতে যাতে আমি চাকরি করতে না চাই আর তারা আমকে বোঝায়। 

এতো হাঙ্গামা দেখে আমারও চাকরী করার ইচ্ছা চলে গেলো।

কাউকে আর কিছু বললাম না.....


কিছুদিন পরেই দেখছি এক সফটওয়্যার কম্পানি থেকে চাকরীর ইন্টারভিউ এর ইমেইল এসেছে।কিন্তু আমি তো কোন সিভি জমা দেইনি!

বুঝতে আর বাকিই রইলো না এটা নিশ্চয় নীলয়ের কাজ।

এরপর,আমি আর নীলয় মিলে আমার পরিবার আর নীলয়ের পরিবারকে বুঝিয়ে অনেক কষ্টে রাজী করালাম।

আমারও ইচ্ছাটা আবারও ফিরে এলো!

আসলে,পাশে কেউ সাহস জুগানোর মতো থাকলে সকল বাঁধাই অতিক্রম করা সম্ভব হয়।

সফটওয়্যার কম্পানিতে একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে আর ভালো কোডিং পারার সুবাদে চাকরিটা আমার হয়েও গেলো।

আজ আমার অফিসের প্রথমদিন......

নীলয়ই আমায় নিয়ে যাবে..সবাইকে বলে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছি।সবার মুখেই সন্ধ্যার আধাঁর নেমে এসেছে।ভাবলাম, প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে সবার জন্য উপহার কিনে এই আধাঁর মূহুর্তের মাঝেই একদিন কাটিয়ে দিবো।এই আশায় অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম....

আমার ডেস্ক,আমার কম্পিউটার সব কিছু দেখেই একজন মেয়ে হিসাবে এতো বেশি খুশি আর গর্ব হচ্ছিলো যা হয়তো ভাষায় বুঝানো সম্ভব না।

কিন্তু পাশের ডেস্কের দিকে চোখ যেতেই আমার উজ্জ্বল হয়ে জলজল করা চোখ দুটিতে যেন মেঘের আধাঁর নেমে এলো!

পাশের ডেস্কেই আদিব বসে কাজ করছে!


সেই বেঈমান চেহারাটা চিনতে আমার খুব বেশি কষ্ট হয়নি।

মনে মনে ঠিক করেই নিলাম এখানে আর কাজ করবো না।আজকেই আমার প্রথম আর শেষদিন।এমন কারো সাথেই বসে সারাদিন কাজ করা আমার পক্ষে শুধু অসম্ভই না বরং আরও অসহ্যেরও বটে!

মনে মনে খুব শক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আজই না করে দিব,আজকের মতো শুধু কাজ করে যাবো।

হঠাৎ করে দেখলাম আদিব আমার দিকে তাকিয়ে আছে।অনেক্ষণ ধরেই তাকিয়ে আছে...

এখন আমার বেশ অস্বস্তি লাগছে।এরই মাঝে লাঞ্চ টাইম হয়ে গেলো বলে মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিয়ে উঠে অফিসের ক্যান্টিনে চলে গেলাম।


প্রথমদিন,তাই সকলের সাথে ব্রেক টাইমে পরিচিত হচ্ছিলাম এমন সময় আমার পরিচিত কন্ঠে ডাকঃ

"সুপ্তি"

পেছন ফিরে দেখলাম আদিব।মুখ ঘুরিয়েই সেখান থেকে চলে আসবো তখন আবারঃ

~"সুপ্তি দাঁড়া তোর সাথে আমার কথা আছে।প্লিজ দাঁড়া ১ মিনিট"

বেঈমানটার অনুনয় শুনে মানুষ হিসাবে ভদ্রতার খাতিরে দাড়াঁলাম।

~"জ্বি বলুন কি বলবেন?"

~"তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে আর তোকে আমি অনেকদিন যাবতই খুঁজে বেড়াচ্ছি আর কি ভাগ্য দেখ আজ এই অফিসে আমার শেষ দিন,অন্য জায়গায় ট্রান্সফার হয়েছি আর আজই তোর সাথে আমার দেখা!"

~"নাটক বন্ধ করেন,আমার আপনার সাথে কথা নেই।আর আপনি এই অফিসেই চাকরি করেন জানলে আমি কখনই জয়েন করতাম না"

~সুপ্তি তোর সাথে অন্যায়ের ফল আমি পেয়েছি।জেরিনের মানে আমার বউয়ের আমার সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় সে অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে আমার মান-সম্মান সব শেষ করে আর আমার পরিবার আর সমাজে মুখ দেখানোর পথ বন্ধ করে অন্য ছেলের সাথে স্কটল্যান্ড চলে যায়।ও যেদিন একটি চিঠি ফেলে চলে গেলো সেদিন খুব কেঁদেছিলাম আর তর সাথে যে একই অন্যায় করেছিলাম সেটাও উপলব্ধি করেছিলাম।মানুষ যখন এখন আমায় দেখিয়ে বলে ওই-যে ওর বউ ভেগে গিয়েছে তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগে।পারলে আমাকে মাফ করে দিস!"

বলেই আদিবটা চলে গেলো।আমি মনে মনে ভাবছিলাম আল্লাহ পাপের শাস্তি পৃথিবীতেই কিছুটা ভোগ করায় তবে সেই শাস্তি থেকে সবাই ভুলটা বুঝতে পারে না।আদিব যে বুঝতে পেরেছে এই তো অনেক.....


বাড়ি ফিরে গেলাম চাকরিটা করবো বলে ভাবতে ভাবতে।কিন্তু বাড়ি ফিরেই আবার সেই অফিসে যাওয়া নিয়ে আশান্তি।আমি চলে গেলে ঘরের কাজ করার লোক থাকে না।গিয়ে দেখি ঘরের সমস্ত কাজ পরে আছে আমার জন্য আর সকলেরই মুখে অসন্তুষ্টির ছাপ...

অফিস থেকে গিয়ে ঘরের সমস্ত কাজ করছি এরই মাঝে নীলয় এসে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চা চাইছে।অথচ,আমরা দুইজনই সারাদিন অফিসের কাজ সামলে এসেছি।

আজ ছেলে-মেয়ের তফাৎটা খুব করে উপলব্ধি করছি।

এভাবেই কাটতে লাগলো দিন আর শ্বাশুড়ির নাতি বা নাতনীর মুখ দেখার জন্য আগ্রহও বাড়ছে...অফিসে যাওয়ার অপরাধে অফিস থেকে ফিরিতেই ঘরের কাজ বাড়তি করে রেখে দেওয়া হয়...

হয়তো সব আমার চাকরী ছাড়ার জন্যই ফন্দি!


কিন্তু শক্ত মনে সব করে দেই।চাকরীটা আমি করবই।আমার পরিচিতি এটা,আমি কেন ছাড় দিব!নিজেকে এখন শুধু এই বাড়ির বউ হিসাবে পরিচয় দেইনা।একজন চাকরিজীবী হিসাবেও পরিচয় দেই।

এভাবে কেটে গেলো আরও ১মাস...


হঠাৎ করে অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন ধরতেই বললোঃ

"নীলয় এক্সিডেন্ট করেছে"

আকাশটা মনে হলো মাথার উপর ভেঙ্গে পড়ল দৌড়ে গেলাম হাসপাতালে।আঘাত গুরুতরভাবেই লেগেছে....

এক্ষুনি অপারেশন করতে হবে...

অপারেশন ভালোভাবেই করা হলো আর কিছুদিন পর নীলয়টা এখন কিছুটা ভালো আছে।

দীর্ঘ দেড়মাস হাসপাতালে থাকার পর নীলয়কে নিয়ে আজ বাসায় ফেরার পালা কিন্তু অপারেশন, ইঞ্জেকশন,ঔষধ খরচের পেছনে ক্যাশ যা ছিল সবই শেষ...হাসপাতাল থেকে ছাড়াতে বেশ কিছু টাকার প্রয়োজন আর এই টাকাটা জোগাড় হলো আমার বেতনের টাকা থেকে।

বাসায় আসার পর বিপদের সময় আমার চাকরীটা যে কতোটা ভূমিকা পালন করলো তা বুঝতে পেরে শ্বশুর বাড়ির লোকের এতোদিন পর আমার চাকরিটার জন্য তাদেরও গর্ববোধ হলো আর তারা সেটা মেনেও নিলেন....

নীলয়ের সেবা করে নীলয়কে অনেকটা সুস্থ তো করে দিলামই সেই সাথে নীলয়ের মনে ভালোবাসায় জায়গাটাও পরিপূর্ণভাবে পেয়েও গেলাম।.....


বহুবছর পর আজ আমার মেয়ে রাজকন্যা আর নীলয়কে আমার জন্মদিনের ট্রিটটা আমার টাকাতে দিতে এক বড় রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছি।রেস্টুরেন্টে ঢুকার সময় এক দম্পতি তাদের ছেলেকে নিয়ে বের হওয়ার সময় আমাদের দেখেই দাঁড়িয়ে গেলো।অনেক সম্মান আর শ্রদ্ধাবোধ মিশ্রিত আদিবের মুচকি হাসি আর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে আমাকে তার পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।হয়তো, আবার বিয়ে করেছিল।আর করবেই তো কারোর জন্যই তো কারোর জীবন থেমে থাকে না।আমার যেমন,আদিবের জন্য থেমে থাকেনি কিছু আদিবেরও তেমন জেরিনের জন্য থেমে নেই কিছু।

আমিও শ্রাদ্ধবোধ ধরে রেখে ধন্যবাদ জানালাম আদিবকে।

আর রাজকন্যা আদিবের ছোট্ট ছেলেকে তার হাতের চকলেটটা এগিয়ে দিলো....একে অপরকে সালাম দিয়ে যে যার পথে আবার হাটঁতে শুরু করলাম......


আমার আদিবের জন্য আজ নেই কোন আর ঘৃণা।এসব ঘৃণা,রাগ থেকে নিজের মনকে বহুদিন আগেই সরিয়ে এনেছিলাম।


শেষ হয়ে যাক শেষ হওয়ার আকাঙ্খা নিয়ে মরার মতো বেঁচে থাকা সম্পর্কগুলো..রয়ে যাক মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মান।এখানেই একসময় ছিলো নামের সম্পর্কগুলোর নয় নিজের মানসিকতার সার্থকতা....


              [সমাপ্তি]


আমাদের ওয়েব সাইটে এমন গল্প গুলো আপনার ভালো লাগলে অবশ্যই আপনার বন্ধুদের সাথে সাইটি শেয়ার করুন। এমন নতুন নতুন সব গল্প পেতে আমাদের সাথেই থাকুন ধন্যবাদ।


এমন আরও অনেক গল্প পড়ুন।