অনেক কষ্টের গল্প | রোমান্টিক কষ্টের স্ট্যাটাস

 রোমান্টিক কষ্টের গল্প

রোমান্টিক কষ্টের গল্প

রূপা তার অসুস্থ বাবার বুকে হাত রেখে আস্তে আস্তে বললো, 

- বাবা আমি যাকে ভালোবাসি সে আমার চেয়ে এগারো বছরের বড়। তার স্ত্রী আছে, তবুও কেন জানি সারাক্ষণ তার কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না। 


রূপার বাবা ফ্যালফ্যাল করে মেয়ের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল। মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? বাইশ বছরের মেয়ে যদি তার চেয়ে এগারো বছরের বড় কাউকে পছন্দ করে তাহলে তার বয়স তেত্রিশ। কিন্তু মারাত্মক কথা হচ্ছে সেই ছেলের নাকি বউ আছে, কি সর্বনাশ। 


রূপা বললো, 

- বাবা তুমি কি রাগ করেছো? 


- ছেলেটা কি তোর অফিসের সেই স্যার? 


- কীভাবে বুঝলে? 


- তুই প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে গোসল করার আগে আমার সঙ্গে আধা ঘণ্টা গল্প করিস। সেই কথাবার্তার মধ্যে সবকিছুই তোর স্যারকে নিয়ে। অফিসে যাওয়া থেকে শুরু করে ছুটির আগ পর্যন্ত তার সঙ্গে কি কি ঘটে সেগুলো বলিস। 


- বাবা তুমি চিন্তা করো না। তাকে আমার পছন্দ এটা ঠিক, কিন্তু সে আমাকে দুই চোখে দেখতে পারে না। 


- তাহলে কি দিয়ে দেখে? 


- জানি না বাবা। তবে সে আমার সঙ্গে সবসময় খারাপ ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে চাকরি ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে বাবা। কিন্তু একটু আবার ডাক দিয়ে ভালো করে কথা বলে। পাঁচ মিনিট কথা বলে যখন তার রুম থেকে বের হই তখন মনে মনে বলি " মানুষটা এতো ভালো কেন? " 


- তোর মাথা পুরোপুরি গেছে। 


রূপা হাসলো, অসুস্থ বাবার কাছে বিদায় নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। হাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রূপা, আজও তার অফিসে যেতে দেরি হবে। 


রূপার চাকরির বয়স এক বছর হতে আর সামান্য কিছুদিন বাকি আছে। এই এক বছরের মধ্যে সে সবসময়ই দেরি করে অফিসে যায়। আর প্রতিদিন তাকে ঝাড়ি খেতে হয়। অফিসে গিয়েই সে প্রথমে যায় তার স্যার সফিকের কাছে। সফিক তাকে দেখে বিরক্ত হয়ে বলে, 


- এরচেয়ে নিজে একটা অফিস খুলতে পারো না? লাঞ্চের পড়ে অফিসে তবুও কেউ কিছু বলবে না। 


সফিক আর কিছু বলেন। রূপা চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শোনে, কখনো জবাব দেয় না। বকা শুনতে শুনতে তার কান্না আসে। তারপর নিজের ডেস্কে এসে বসে বসে সফিকের পরবর্তী ডাকের অপেক্ষা করে। দশ মিনিট পরেই সফিক তাকে ডাকবে, হাসিমুখে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করবে। তারপর কিছু ফাইল হাতে দিয়ে বলবে " এগুলো চেক করে ম্যাডামের কাছে পাঠিয়ে দিও। " 


সফিক বাদে আর কেউ তাকে ঝাড়ি দিলে কিংবা উঁচু গলায় কথা বললেই সে প্রতিবাদ করে। কিন্তু সফিকের সঙ্গে পারে না। রূপার চাকরির ব্যবস্থা সফিক করে দিয়েছিল, হয়তো সেই কৃতজ্ঞতা হতেই সে প্রতিবাদ করতে পারে না। 


বছর খানিক আগে রূপা যখন চাকরির জন্য খুব চেষ্টা করছিল তখনকার কথা তার সবসময় মনে পড়ে। প্রায় মাস খানিক ঘোরাঘুরি করে কোনো চাকরি হয়নি। একদিন বিকেলে ক্লান্ত হয়ে সে একটা পার্কে বসেছিল। হঠাৎ করে দেখতে পেল তার সামনেই একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে। একপর্যায়ে মেয়েটা রাগ করে চলে গেলে, ছেলেটা কিছুক্ষন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সেখানে সবুজ ঘাসের উপর বসে যায়। 


রুপা দুর থেকে এসব দেখতে থাকে। একটা সময় সে নিজের মনের অজান্তেই ছেলেটার কাছে চলে যায়। ছেলেটা তাকে দেখে বিরক্ত হয়ে বলে, 


- কে আপনি? 


- আমার নাম রূপা। 


- নাম দিয়ে কি করবো? পার্কে এতো যায়গা আছে তবু আমার কাছে কেন এসেছেন? 


- আমার একটা চাকরির খুব দরকার, আমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিবেন? 


রূপা নিজের কথাতে নিজে বিরক্ত হয়ে গেল। এটা বলা হয়তো ঠিক হয়নি। আসলে যে মেয়েটি রাগ করে চলে গেছে সে ঝগড়ার সময় বলেছিল, 

" এতবড় চাকরি করে লাভ কি? আমাকে নিয়ে যদি সামান্য বাইরে আসতে না পারো তাহলে বড় চাকরি আর টাকা দিয়ে কি হবে? " 


এই কথা শুনে রূপার মনে হচ্ছিল লোকটা ভালো চাকরি করে। তার মানসিক চাপ আছে এখন, করুন হয়ে চাকরির কথা বলা যায়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়ে গেছে। এই লোকটার মুখে কোন রসকষ নেই, তিতা তিতা কথা বলে। 


লোকটা বললো,

- পার্কে এসে কেউ চাকরি খোঁজে? তোমার কি খারাপ কোনো উদ্দেশ্য আছে নাকি?


রূপার কান্না আসে, সে কোনকিছু না বলে পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে। রাত আটটার দিকে তার বাসায় একটা ছেলে আসে। ছেলেটা তাকে একটা ঠিকানা দিয়ে বলে আগামীকাল ঠিক সকাল দশটায় এই ঠিকানায় যোগাযোগ করতে হবে। তার একটা চাকরির ব্যবস্থা হতে পারে। 


রূপা ভাবেনি যে পার্কের সেই লোকটা এভাবে কাউকে দিয়ে খবর দেবে। তাছাড়া সেই লোকটার তো তার বাসা চেনার কথা নয়। 


পরদিন সে অফিসে গেল। দারোয়ানের কাছে সে কি বলবে বুঝতে পারছিল না। শুধু ঠিকানা দিয়ে ভিতরে ঢোকা যায় না, কার কাছে যাবে তার নাম বলা দরকার। সেই লোক অনুমতি দিলে তারপর প্রবেশ করতে দেওয়া হবে। 


সমস্যা হচ্ছে রূপা তার নাম জানে না। সে কার সঙ্গে দেখা করবে তার নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি। দারোয়ান তাকে ঢুকতে দিল না। রূপা সারাদিন অফিসের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাটাহাটি করে পার করলো। বিকাল তিনটার দিকে পিছন থেকে একটা লোক বললো, 


- তোমার নাম রূপা তাই না? 


রূপা পিছনে ফিরে দেখে গতকাল পার্কের সেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ হাসিহাসি ভাব, রূপা কিছু বললো না তার মনটা খারাপ হয়ে আছে অনেক। 


- তোমার না সকাল দশটার দিকে আসার কথা ছিল, তুমি এখান কি করো? 


রূপা তখন আনন্দে হাসতে ইচ্ছে করছিল। সে আনন্দে কিছু বলতে পারলো না। সফিক তার দিকে তাকিয়ে বললো, 


- চলো আমার সঙ্গে। 


সফিক গেইট দিয়ে ভিতরে যাচ্ছে। দারোয়ান তাকে সালাম দিল, তার সঙ্গে সঙ্গে রূপা প্রবেশ করলো ভিতরে। দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে রূপা মনে মনে বললো " এবার পারলে আটকে রাখ। " 


রূপার সেদিনই চাকরি হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেদিনের পর থেকে রূপার নাম সফিক মনে রাখতে পারে না। সফিক সবসময় তাকে স্বর্না বলে ডাকে। রূপা তাতেই সাড়া দেয়। মাঝে মাঝে সফিক কাগজপত্র দেখে বলে, 


- তোমার নাম তো স্বর্না তাহলে এখানে রূপা লেখা কেন? 


- স্যার আমার নাম রূপা। 


- তাহলে আমি স্বর্না বলে ডাক দিলে তুমি সাড়া দাও কেন? 


- আপনি আমার নাম মনে রাখতে পারেন না তাই আমি স্বর্না ডাকলেই বুঝতে পারি। তাছাড়া এ-ই অফিসে স্বর্না নামে কেউ নেই। 


- ঠিক আছে কাল থেকে রূপা মনে থাকবে। 


কিন্তু সফিকের মনে থাকে না। পরদিন আবার অফিসে এসে স্বর্না বলে ডাক দেন রূপা দৌড়ে চলে যায় তার কাছে। বছর খানিক আগে সফিক সেদিন পার্কে যার সঙ্গে ঝগড়া করেছিল সেই মেয়েটা সফিকের স্ত্রী। একদিন সে অফিসে এসে সফিকের রুমে বসে ছিল। সেদিন রূপা তাকে দেখেই চিনতে পারে। 


রিকশা থেকে নেমে রূপা গেইট দিয়ে ভিতরে যাচ্ছে। পনের মিনিট দেরি হয়ে গেছে। বাবার সঙ্গে সকাল বেলা বেশি কথা বলতে গিয়ে দেরি হয়েছে। সে জানে আজও তাকে বকা শুনতে হবে। 


কোম্পানির মালিক সফিককে খুব পছন্দ করেন। সফিকের কর্মদক্ষতা অসাধারণ, সেজন্যই তাকে আরো বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। ব্যস্ততার জন্য তার নিজের ব্যক্তিগত জীবনে অশান্তি চলছে। তবে সফিকের ধারণা তার স্ত্রী হয়তো তার সঙ্গে থাকতে চাইছে না। সেজন্য সে টুকটাক বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে বেশি। 


মালিকের নাম আমজাদ চৌধুরী। আমজাদ চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে। সাত বছর ধরে সে অস্ট্রেলিয়া তার মামার কাছে আছে। আমজাদ চৌধুরীর স্ত্রী আত্মহত্যা করে মারা গেছেন সাত বছর আগে। মেয়ে যখন জানতে পারে যে তার বাবার কারণেই তার মা আত্মহত্যা করেছে তখন থেকে বাবার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। মামার কাছে চলে গেছে অষ্ট্রেলিয়ায়। বিশাল কোম্পানি নিয়ে এই দেশে একা একা বাস করছেন আমজাদ চৌধুরী। 


পঁচিশ মিনিট লেইট করার পরেও সফিক আজ রূপাকে কিছু বললো না। রূপা তার কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে সফিক বললো, 


- রূপা কয়টা বাজে? 


- জ্বি স্যার? 


- সকালে নাস্তা করিনি, ওদেরকে বলো আমার জন্য নাস্তা দিতে। আর তুমি তোমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে এসো। 


রূপা দ্রুত বেরিয়ে গেল। নাস্তা ও চা নিজের হাতে নিয়ে সফিকের রুমে গেল। সফিক চায়ের কাপে ভিজিয়ে ভিজিয়ে রুটি খাচ্ছে। রূপার চা খেতে লজ্জা করছে, মনে মনে ভাবছে স্যার তাকে যখন বলবে তখনই খাওয়া শুরু করবে। কিন্তু সফিকের খাওয়া শেষ হয়ে গেল তবুও রূপাকে সে খেতে বললো না। রূপা মন খারাপ করলো না। 


সফিক বললো,

- আমি এখন বাইরে যাবো। আজকে আর হয়তো অফিসে আসবো না। তুমি জরুরি কোনো দরকার হলে আমাকে কল করবে। 


- অফিস থেকে বের হয়ে কোথায় যাবেন? 


প্রশ্নটা করে রূপা মনে মনে বললো, " আমি কি একটা গাধা? স্যার কোথায় যাবে সেটা জিজ্ঞেস করে লাভ কি? " 


- আমার স্ত্রীকে চেনো? 


- জ্বি স্যার, দুবার দেখেছি। 


- আজ আমাদের ডিভোর্স হবে। সেজন্য আজ আর আসবো না, ডিভোর্সের কাজ শেষ করে আমি এক বন্ধুর কাছে যাবো। 


রূপার চোখে পানি এসে গেল। সফিকের সামনে সে কখনো নিজের চোখে পানি আসতে দেখে নাই। আজ এসেছে। তার কি বলা উচিত? 


- তোমার চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, তুমি বরং আরেক কাপ চা নিয়ে নিজের ডেস্কে বসে খাও। আমি এখন বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে যাবো। তারপরই বেরিয়ে যাবো, আজ বিকেলে একটা মিটিং আছে। স্যারকে মনে করিয়ে দিও। 


রূপা চলে গেল, সফিক মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো তার স্ত্রী মেসেজ দিয়েছে। 


" তাড়াতাড়ি আসো, সবাই অপেক্ষা করছে। " 


★★


আমজাদ চৌধুরী মন খারাপ করে বসে আছেন। সফিক ইচ্ছে করে তার ব্যক্তিগত বিষয় এখানে বললেন না। মিটিংয়ে কি কি বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে সেগুলোর একটা ফাইল বুঝিয়ে দিল।


আমজাদ চৌধুরী বললো, 

- তুমি কি জানো আজ আমার মেয়ের জন্মদিন? 


সফিক জবাব দিল না, কারণ তার মনে নেই। সে এমনিতেই কিছু মনে রাখতে পারে না। অফিসের সব কাজ ঠিকমতো স্মরণ রাখার জন্য সে ব্যক্তিগত ভাবে রূপাকে নিয়েছিল। 


- আমি আমার মেয়েকে সকাল থেকে এ পর্যন্ত অনেকবার কল করেছি সফিক৷ সে কল রিসিভ করে না, নতুন নাম্বার দিয়ে কল দিলাম আমার কণ্ঠ শুনে কেটে দিয়েছে। 


সফিকের ভালো লাগছে না, মোবাইলে তার স্ত্রী কল দিচ্ছে। মেসেজ দিয়ে অপেক্ষা করে এখন কল দিচ্ছে। এখনই যাওয়া দরকার। 


- তুমি যাও সফিক, রাতে আমার বাসায় এসো। আমরা একসঙ্গে ডিনার করবো। 


সফিক উঠে গেল। আবারও নিজের ঘরে এসে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বের হয়ে গেল। অফিস থেকে বের হয়ে নিজের বাইকে করে রওনা দিল। কিছুদূর যেতেই মোবাইল বেজে উঠলো। মোবাইল বের করে দেখে রূপা কলে করেছে। সফিক কল রিসিভ করতেই রূপা বললো, 


- বড় সাহেবকে কে যে খু/ন করেছে। স্যারের রুমেই তার লা/শ পড়ে আছে। আপনি তাড়াতাড়ি অফিসে আসুন স্যার, সবাই হৈচৈ করছে। 


আমজাদ চৌধুরীর লা-শ এখনো সেভাবেই পড়ে আছে। সফিক নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সফিক এর কাছেই দাঁড়িয়ে আছে রূপা। সে থরথর করে কাঁপছে, অফিসের সবাই যেন আতঙ্কে দিশেহারা অবস্থা। 


ম্যানেজার বললেন, 

- স্যারের মেয়েকে ফোন করা হয়েছে, তিনি দেশে আসবেন আজ রাতের মধ্যে নাহয় কালকে। 


- একদিনের মধ্যে হুট করে আসবে কীভাবে? 


- ওনার মামা ব্যবস্থা করবেন। তিনি তো বললেন যে সমস্যা হবে না চলে আসতে পারবো। 


সফিক চুপ করে রইল। তার এখনো সম্পুর্ন ঘটনা বিশ্বাস হচ্ছে না। আজকে রাতে বাসায় একসঙ্গে ডিনার করার দাওয়াত দেওয়া লোকটা পরপারে চলে গেছে। পৃথিবীর সব ব্যস্ততা আজ থেকে তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। সারাজীবন নিজের ডে সম্পদ বৃদ্ধি করেছেন সবকিছু রেখে তিনি এখন একটা কবরের যাত্রী। 


- সফিক...! 


- বলেন ম্যানেজার সাহেব। 


- স্যারের মেয়ে কোনরকম দুঃখ পাননি। আমি ফোন করলাম, তিনি রিসিভ করে বললেন " লা-শ কি পুলিশ নিয়ে গেছে? "


- তারমানে তিনি আগেই জানতেন? 


- মনে হয় আমি কল করার আগে কেউ কল দিয়ে তাকে জানিয়েছে৷ নাহলে তিনি কীভাবে বলতে পারলেন তার বাবা মারা গেছে। তাছাড়া তার মধ্যে কোনো কষ্টের আঘাত দেখিনি। 


- অদ্ভুত তো ম্যানেজার সাহেব। 


- আরেকটা কথা। 


- কি? 


- তিনি পুলিশকে বলেছেন তার বাবার মৃত্যুর জন্য কোনো মামলা করা হবে না। পুলিশ এসে যেন অফিসের কাউকে গ্রেফতার না করে। জিজ্ঞেসা করতে পারে সমস্যা নেই কিন্তু কাউকে গ্রেফতার করে থানায় নিতে নিষেধ করেছে। 


পুলিশ এসে গেছে, সবাইকে দুরত্বে রেখে লাশের তদারকি করতে লাগলো। ম্যানেজার সাহেব বলা শুরু করেন, 


সফিক অফিস থেকে বের হবার পরে ম্যানেজার সাহেব ভিতরে ঢুকলো। কিন্তু চৌধুরী তখন বিরক্ত হয়ে ম্যানেজারকে পরে দেখা করতে বললেন। ম্যানেজার বেরিয়ে গেল, কিছুক্ষণ পর তিনি আবার অনুমতি চাইলেন। তার জরুরি কথা বলার ছিল তাই আবার নক করেন। কিন্তু তখনই তিনি আবিষ্কার করেন চৌধুরী সাহেবের কিছু একটা হয়ে গেছে। 


আমজাদ চৌধুরীর ঘরে কোনো ক্যামেরা ছিল না। রুমে ঢোকার স্থানে দেয়ালে একটা ক্যামেরা আছে সেই ক্যামেরার ফুটেজ চেক করা হলো। সেখানে ম্যানেজার ছাড়া আর কাউকে রুমে সামনে আসতে দেখা গেল না। পুলিশ ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গি করলেন। ম্যানেজার সাহেব ঘামতে লাগলো। 


অবশেষে আবারও আমজাদ চৌধুরী একমাত্র মেয়ে নিধির কাছে কল দেওয়া হলো। এবার কথা বললেন পুলিশ নিজে, কারণ তারা প্রাথমিকভাবে ম্যানেজারকে সন্দেহ করছেন। বেচারা ম্যানেজার অসহায় হয়ে চৌধুরীর মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। 


পুলিশের কাছেও নিধি বলেন যে কাউকে এরেস্ট করতে হবে না। যা করার সে দেশে এসে তারপর করবে। আর যদি পুরোপুরি প্রমাণিত হয় যে কে খু-ন করেছে, তাহলে পুলিশ তার কাজ করতে পারে। শুধু শুধু সন্দেহের কারণে কাউকে হয়রানি করার জন্য নিষেধ করেন নিধি চৌধুরী। 


সফিক কিছু বললো না। সত্যি সত্যি যদি তাদের ম্যানেজার নির্দোষ হয়ে থাকে তাহলে তাকে না নিয়ে যাওয়া ভালো। একবার থানায় গেলে একটা সম্মানিত ব্যক্তির মানহানীর সীমা থাকে না। পৃথিবীতে সবকিছু টাকা দিয়ে পাওয়া যায় কিন্তু সম্মান পাওয়া যায় না। 


নিধি চৌধুরী জোর গলায় বললেন " বাবা তার সারাজীবনে মানুষকে জ্বালাতন করেছেন। আজ মরে গিয়েও সবাইকে বিপদে ফেলে গেছে, যেটা আসলেই দুঃখজনক ব্যাপার। " 


সফিকের স্ত্রী বারবার কল দিচ্ছেন। সফিক কল রিসিভ করে বললো, 

- আমাদের অফিসার এমডি স্যার খু-ন হয়েছে আজ আসা সম্ভব না। 


সফিকের স্ত্রীর ভালো নাম ফারজানা। ফারজানা চেচিয়ে উঠে বললো, 

- সবসময় তোমার ঝামেলা কেন থাকে বুঝতে পারছি না। আমি পেপার পাঠিয়ে দিচ্ছি তুমি আমাকে মুক্তি দিয়ে দাও। 


সফিক কিছু বললো না। লাশ নিয়ে পুলিশ চলে গেছে। দুজন রেখে গেছে আমজাদ চৌধুরীর রুম পাহারা দেবার জন্য। গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আসবে তদন্ত করতে। বিশিষ্ট শিল্পপতি আমজাদ চৌধুরী অফিসে নিজের রুমে খুন হয়েছে। সুতরাং সুষ্ঠু তদন্তের দরকার আছে। 


সফিক নিজের রুমে এসে চোখ বন্ধ করে রইল। রূপা দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে, সে ভিতরে আসতে সাহস পাচ্ছে না। একটু পরে সফিক তাকে ডাক দিল। রূপা দরজা খুলে দাঁড়াতেই সফিক বললো " এক কাপ চা দিতে বলো। " 


সন্ধ্যা বেলা অফিস থেকে বের হয়ে সফিক সরাসরি তার বড়বোনের বাসায় গেল। অফিসে মোটামুটি ভালো অবস্থান তার ছিল কিন্তু সে কখনো গাড়ি চড়তে পারে না। মানে প্রাইভেট কারে চড়তে সে অভ্যস্ত নয়। নিজের বাইক নিয়ে সারা শহরের মধ্যে তার চলাচল। তাছাড়া গাড়ি ব্যবহার করার আরেকটা বিরক্তিকর কারণ হচ্ছে যানজট। সেই দিক দিয়ে বাইক অনেক ভালো। 


সফিকের বাবাও মেয়ের বাসায় থাকে। সফিকের কাছে ছিলেন কিন্তু সফিকের বোনের অনুরোধে তিনি মেয়ের বাসায় থাকতে বাধ্য হয়েছেন। যখন জানতে পারেন সফিকের স্ত্রী বাসা থেকে চলে গেছে তখনই নিজের কাছে বাবাকে নিয়ে আসে। শফিককে সবসময় আসতে বললেও সে এখানে আসতে চায় না। 


ড্রইং রুমে বসেই আকলিমা বললো, 


- তোদের অফিসের মালিক খুন হয়ে গেছে তাই না? কীভাবে কি হলো? 


- জানি না আপা। আমি অফিস থেকে বের হয়ে উকিলের কাছে যাচ্ছিলাম তখন খবর শুনে ছুটে যাই আবার। 


- ফারজানা শেষ পর্যন্ত তোকে ডিভোর্স দিবেই তাই না? 


- হ্যাঁ। 


- সেদিন শপিং মলে দেখা হয়েছিল আমার সঙ্গে। হাসিখুশি মুখে জিজ্ঞেস করলো কেমন আছি। তারপর অনেক কথা হলো, আমি একসময় তাকে বললাম সবকিছু ঠিক করে নাও। সে কিছু বলে নাই, কথা এড়িয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে গেছে। 


- বাবা কোথায়? 


- বাইরে গেছে। সন্ধ্যার পরে সে হাঁটতে বের হয়। রাত নয়টার দিকে বাসায় আসে। 


- এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? 


- না না কি সমস্যা হবে? বরং আরো ভালো লাগে বেশি। ফাহিম তো সারাক্ষণ নানার সঙ্গে থাকে। 


ফাহিম আকলিমার একমাত্র ছেলে। আকলিমা বললো, 


- তুইও এখানে চলে আয়। ফারজানা যেহেতু ঘরে থাকবে না তখন একা একা খাবি কি? 


সফিক হাসলো। 

- আপা আমার খাবারের চিন্তা করতে হবে না। 

তুমি বাবার খেয়াল রেখো, টাকাপয়সার দরকার হলে আমাকে বলো। 


- তোর কি শরীর খারাপ? 


- আমি আজ উঠি আপা! 


- সে কি? রাতে খেয়ে তারপর যাবি। বাবা আসুক বাবার সঙ্গে দেখা করে যা। বাসায় তো কাজ নেই তাই না? 


সফিক চুপচাপ বসে রইল। রাতে তার দুলাভাই এসে তার সঙ্গে বসে আমজাদ চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলো। শফিকের বাবা এসে সেই আলোচনায় অংশ নিলেন। সকল আলোচনা শেষ করে খাবার খেয়ে সফিক যখন বাসা থেকে বের হয় তখন রাত একটা। 


★★★


আমজাদ চৌধুরীর মৃত্যুর পনের দিন পেরিয়েছে। অফিসের সামনে বিশাল ব্যানারে শোক প্রকাশ করার চিত্র ঝুলছে। 

" আমজাদ চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যুতে সবাই গভীরভাবে শোকাহত। " 


নিধি এখন তার বাবার অফিসে বসেন। সপ্তাহ খানিক ধরে তিনি সবকিছু দেখাশোনা করেন। বাবার মৃত্যুর অস্বাভাবিক ঘটনা সে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করেছে। পুলিশের তদন্তের দরকারে সে শুধু বলেছে "আমার কোনো অভিযোগ নেই।"


সফিকের চাকরি চলে গেছে। চারদিন আগে নিধি ম্যানেজারকে ডাকেন, তার সঙ্গে আরো দুজন ছিল। নিধি ম্যানেজারকে বলেন, 


- অফিসের সবার কাজকর্ম মোটামুটি দেখলাম। সফিক সাহেবের তো কোনো কাজ নেই, তাকে রেখে আমাদের লাভ কি? 


- আপনার বাবা তাকে খুব পছন্দ করতেন। 


- বাবা নেই, তাই সেখানে তার পছন্দের মানুষ রেখে কি করবো? বাবা যাকে পছন্দ করতেন তাকে আমার পছন্দ নাও হতে পারে। 


- আমাদের যতগুলো ব্যবসা আছে সবকিছুই সফিক সাহেব জানেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে সফিকের অনেক অবদান আছে। স্যার সবসময় সফিকের উপর ভরসা করতেন। 


- বাবা সবসময় মানসিক সমস্যার মধ্যে থাকতেন তাই কাজকর্ম সবটা সফিক সাহেব দেখতো। আমি মানসিক সমস্যার মধ্যে নেই সুতরাং আমার তাকে দরকার নেই, বুঝতে পেরেছেন? 


- জ্বি ম্যাডাম। 


- কোম্পানির নিয়মানুযায়ী তাকে দুই মাসের বেতন দিয়ে বিদায় করুন। বাকি সবাইকে একটু সতর্ক হতে বলবেন, আরো অনেকে ছাটাই হতে পারে। 


অফিসে এসেই সফিক ঘটনা জানতে পারে। সে তেমন কিছু বলে নাই, দুই মাসের বেতন নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। রূপা সেদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে না, তার সেদিন সারাক্ষণ মন খারাপ ছিল। বাসায় ফিরে নিজের বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে কেঁদেছিল। 


সপ্তাহ খানিক পরের ঘটনা। 

রূপা তার ডেস্কে কাজ করছে। আজকাল সে নিধি চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করে। সে সারাক্ষণ নিধির হুকুমের অপেক্ষা করে থাকে। চাকরিতে তার মন স্থির থাকে না, কিন্তু চাকরি না করে উপায় নেই। 


- কেমন আছো রূপা? 


রূপা তাকিয়ে দেখে সফিক তার দিকে তাকিয়ে আছে। রূপা হাসতে ইচ্ছে করছে, তার ইচ্ছে করছে সে বলে " স্যার আমি ভালো নেই, আপনি চলে গেছেন তারপর থেকে আমি আর শান্তিতে কাজ করতে পারি না। রাতে ঘুমাতে গেলে আপনার কথা ভাবতে থাকি৷ সকালে অফিসে এসে আপনার কাছে বকা শুনতে ইচ্ছে করে। " 


রূপা কিছু বললো না, আজ সফিক তাকে রূপা বলে ডেকেছে। তারমানে স্যার এতদিন কাজের চাপে তার নাম ভুলে যেত মনে হয়। 


- তোমার ম্যাডাম অফিসে আছে? 


- জ্বি স্যার। 


- তাকে গিয়ে আমার কথা বলো, বলো যে সফিক সাহেব এসেছে। 


রূপা দৌড়ে গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার বের হয়ে এসে বললো, 


- ম্যাডাম আপনাকে যেতে বলেছেন। 


সফিক সামান্য হাসলো, তারপর নিধি চৌধুরীর রুমের দিকে গেল। যে রুমে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার বাবা আমজাদ চৌধুরী থাকতেন। 


- কেমন আছেন সফিক সাহেব? 


- জ্বি ভালো। 


- আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আসবেন না। কিন্তু আপনি এসে আমাকে অবাক করেছেন, আমি সত্যি সত্যি অবাক হলাম। 


- আসবো না কেন? 


- বিনা নোটিশে আপনাকে বরখাস্ত করলাম। খানিকটা অপমানের মতো বটে, তাই রাগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আসার সম্ভাবনা কম। 


- প্রয়োজন অপ্রয়োজন সবার জীবনে থাকে। আপনার বাবার কাছে আমি প্রয়োজনীয় ছিলাম, আপনার কাছে অপ্রয়োজনীয়। সুতরাং এখানে রাগ অভিমানের কিছু নেই। তাছাড়া আমাকে তো বিনা নোটিশে বরখাস্ত করা হয়নি, নোটিশ দিয়ে দুমাসের বেতন দেওয়া হয়েছে। 


- মৃত্যুর তিনমাস আগে থেকে বাবা আমার নানা বাড়ির এলাকায় মায়ের নামে একটা হাসপাতাল করতে চেয়েছে তাই না? 


- জ্বি। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল, এ মাসে কাজ শুরু হবার কথা ছিল। 


- বাবা ভেবেছিলেন এরকম কিছু করলে আমি তাকে ক্ষমা করবো। খুশি হয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে তার কাছে চলে আসবো। 


- আচ্ছা। 


- আপনাকে আমি একটা কাজের জন্য ডেকেছি। 


- বলেন। 


- আমি হাসপাতালের কাজটা শুরু করতে চাই। সম্প্রতি আপনার ডিভোর্স হয়েছে, শুনলাম এখন একা একা থাকেন। তাই আমি চাই আপনি এই হাসপাতাল তৈরির সব দায়িত্ব গ্রহণ করুন। 


- নতুন করে চাকরি করতে বলছেন? 


- অনেকটা সেরকম, তবে আপনাকে সবসময় গ্রামের বাড়িতে থাকতে হবে। 


- ঠিক আছে আমার আপত্তি নেই। 


- একটা কথা বলি? 


- বলেন। 


- মৃত্যুর আগে আপনি বাবার রুম থেকে বের হবার পরই আমি বাবার কল রিসিভ করি। বাবা যখন মারা গেছে তখন আমি বাবার সঙ্গে কথা বলছিলাম। 


সফিক তাকিয়ে রইল। নিধি অপলক দৃষ্টিতে সফিকের দিকে তাকিয়ে বললো, 


- যে মানুষটা আপনাকে এতো পছন্দ করতেন তাকে এভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেন কেন? আপনার কি একটুও কষ্ট হয়নি তার জন্য? 


সফিক যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। নিধি এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে, তার মুখে হাসিহাসি ভাব। 


নিধির এমন ভয়ঙ্কর কথা শুনেও সফিক চুপচাপ স্বাভাবিক ভাবে বসে রইল। এরকম কথার প্রসঙ্গে কি বলতে হয় সেটা হয়তো জানা নেই। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে সফিক বললো, 


- প্রশ্নটা তো আমার করা উচিৎ তাই না? 


নিধি চোখমুখ কঠিন করার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। তার চেহারায় রাগান্বিত ভাব হলেও ঠোঁটের আগায় হাসি দেখা গেল। 


- সফিক সাহেব! 


- বলেন। 


- আপনার কি ধারণা যে আমি আমার বাবাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি? 


- অনেকটা তাই। তিনি সবসময় একটা মানসিক কষ্টের মধ্যে থাকতেন। 


- আপনার যুক্তি পুরোপুরি সত্যি না হলেও কিছুটা সত্যি। 


- আমরা কি কাজের কথায় আসতে পারি? 


- হ্যাঁ অবশ্যই। 


- তাহলে বলুন। 


- হাসপাতালের কাজ যেদিন থেকে শুরু হবার কথা সেদিনই শুরু হবে। মনে হয় ২৫ তারিখে শুরু হবার কথা ছিল তাই না? 


- হ্যাঁ। 


- আপনি সেখানকার সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করতে বলেন। দরকার হলে সবকিছু গুছিয়ে চলে যান। ২৪ তারিখ বিকাল তিনটায় আমি সেখানে থাকবো। 


- আপনাকে একদিন আগে যেতে হবে কারণ সকালে রওনা দিলে পৌঁছে তারপর ক্লান্ত হয়ে যাবেন। 


- হেলিকপ্টার প্রস্তুত করা যায় কিনা দেখেন। 


- ঠিক আছে। 


- সফিক সাহেব, আপনাকে আমি চাকরি থেকে বের করেছিলাম কেন জানেন? 


- না, আপনি অবশ্য সবাইকে ছোট্ট কিছু কারণ দেখিয়েছেন। কিন্তু সেটা যথাযথ নয়। আপনার অন্য কোনো কারণ ছিল বলে আমার ধারণা। 


- আমি ভেবেছিলাম আপনি আসবেন না। 


- বেশ কিছুদিন আগে আপনার বাবা আমাকে বলেছিলেন, " আমি যদি হঠাৎ করে মারা যাই তাহলে তুমি আমার মেয়েকে সাহায্য করো। কারণ আমার মেয়ে ছোট তাছাড়া কাজের প্রতি তার মনোযোগ খুব কম। সে একটু রাগী স্বভাবের তাই অনেক কিছু বলতে পারে। তাই বলে রাগ করে চলে যেও না। " 


- আমি দেশ ছেড়ে চলে যাবার পরে বাবার সঙ্গে কথা বলতাম না। বাবা আমাকে প্রায়ই তখন চিঠি পাঠাতেন। ৩/৪ পৃষ্ঠার বড়বড় চিঠি লিখে তিনি পাঠিয়ে দিতেন অস্ট্রেলিয়া। বাবাকে আমি বছর খানিক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি কিন্তু তার থেকে চিঠি পাবার জন্য আমি সেটা প্রকাশ করিনি। 


সফিক চুপ করে রইল। তার কথা বলার কোনো পজিশন নেই, যখন পজিশন পাবে তখন কথা বলতে পারবে। এমনিতেই সে কম কথা বলে। 


- বাবার চিঠির মধ্যে প্রায় সময় আপনার কথা লেখা থাকতো। বাবার সবগুলো চিঠিতে আপনার স্থান আছে, কিছু না কিছু থাকবেই। 


- এগুলো কি কাজের কথা? 


- হ্যাঁ কাজের কথা। দু বছর আগে আমি বাবার চিঠি পড়ে বুঝতে পারি যে তিনি আপনার সঙ্গে আমাকে বিয়ে দিতে চায় সরাসরি বলে নাই কিন্তু তার ইঙ্গিতের অর্থ পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম। তিনি আপনাকে তার মেয়ের জামাই বানানোর স্বপ্ন দেখতেন। 


- আমি এসব জানতাম না। তাছাড়া আমার স্ত্রী ছিল সুতরাং এসব কথা স্যার বলতে পারে না। 


- আপনার স্যার বলেছেন, আমার কাছে চিঠি আছে। আপনাকে একদিন পড়তে দেবো। 


সফিক জবাব দিল না। 


- আমি অফিসে আসার পর থেকে আপনার কথা মনে হলেই আমার বাবার কথা মনে পড়ে। বাবার স্বপ্ন ছিল আপনি তার মেয়ের জামাই হবেন, এসব ভাবতে গেলে আমার খারাপ লাগে। অস্বস্তি বোধ শুরু হয়ে যায় তাই আপনাকে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। 


- ওহ্। 


- হাসপাতালের কাজের জন্য গ্রামের বাড়িতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত দুটো কারণে নিলাম। প্রথমত আপনি এখন একা আছেন তাই ঢাকার বাইরে গেলে সমস্যা নেই। দ্বিতীয়ত আপনার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা কম তাই সমস্যা হবে না। 


- আমি এবার উঠতে পারি? 


- জ্বি পারেন, আপনি ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে আরেকবার দেখা করে তারপর যাবেন। 


- আচ্ছা যাবো। 


সফিক উঠে দাঁড়াল। নিধি পিছন থেকে বললো, 


- বাবার মৃত্যুর জন্য কে দায়ী সেটা আমি জানি। তবে তাকে খুঁজে বের করার জন্য আমি একজন বুদ্ধিমান লোককে অফিসে নিয়োগ দেবো। সে সবার মতো স্বাভাবিক ভাবে ডিউটি করবে কিন্তু তার প্রধান উদ্দেশ্য থাকবে বাবার খুনিকে খুঁজে বের করা। সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে সে খুঁজে বের করবে। 


সফিক ঘাড় ফিরিয়ে বললো, 


- আপনি খুব অদ্ভুত মানুষ। 


|

|


নিধির রুম থেকে বের হয়ে রূপার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল সফিকের। মেয়েটা কি এতক্ষণ এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল নাকি? কি সর্বনাশ! 


রূপা বললো, 

- স্যার আপনি কি আবার চাকরি করবেন? 


- হ্যাঁ করবো, চাকরি করার জন্য আবার আমাকে ডেকে আনা হয়েছে। 


- সত্যি বলছেন? তাহলে তো খুবই ভালো হয়, ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতেই আমার ভয় লাগে। যদিও কখনো কিছু বলে না কিন্তু কেন জানি তাকে দেখলে আমার রাগ ওঠে। 


- রাগ কেন হবে? 


- তিনি আপনাকে চাকরি থেকে বের করে দিল। এতবড় অফিস আপনি নিজেই সবকিছু দেখে রাখতেন অথচ আপনাকেই বাদ দিল। 


- তার বাবার অবর্তমানে তিনি অফিসের মালিক রূপা। সুতরাং যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তার ছিল এবং আছে। 


- আপনি কবে থেকে অফিসে আসবেন? আজ থেকে ডিউটি করবেন নাকি কাল সকাল থেকে। 


- আমি অফিসে আর ডিউটি করবো না রূপা। স্যারের শশুর বাড়ির এলাকায় তার স্ত্রীর নামে যে হাসপাতাল হচ্ছে সেখানে যাবো। হাসপাতালের যাবতীয় লেনদেন কাজকর্ম সবকিছু আমি দেখাশোনা করবো। 


- বলেন কি...! 


- হ্যাঁ। 


- তাহলে তো আমাকে সেখানে রুম ভাড়া করে থাকতে হবে। বাবাকে নিয়ে যেতে হবে, স্যার সেই গ্রামের মধ্যে কি বাসা ভাড়া পাওয়া যায়? 


- তুমি কেন যাবে সেখানে? 


রূপা তাকিয়ে রইল। যেন অবিশ্বাস করার মতো একটা প্রশ্ন তাকে করা হয়েছে। সে কণ্ঠ খানিকটা নরম করে বললো, 


- আপনার সঙ্গে আমি যাবো না স্যার? আপনি তো আপনার সকল কাগজপত্র রেডি করা খেয়াল করার জন্য আমাকে রাখতেন। 


- হুম কিন্তু সেটা এই হেড অফিসে। 


- সেখানে কি অন্য কেউ থাকবে? 


- জানি না, সেই বিষয় এখনো কোনো সিদ্ধান্ত করিনি। আগে যাই তারপর যদি দরকার হয় তাহলে একজন রেখে দেবো। 


রূপা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সফিক তাকে কিছু না বলে হাঁটতে শুরু করলো। সে এখন ম্যানেজার এর সঙ্গে দেখা করতে যাবে। 


রূপা বসে আছে নিধির সামনে। নিধির চোখের দিকে রূপা কখনো তাকায় না। নিধি বললো, 


- আমি একটু পরে গাজীপুরে আমাদের একটা ফ্যাক্টরিতে যাবো। তুমি আমার সঙ্গে যাবে। 


- আচ্ছা। 


- তুমি কি কিছু বলতে চাও? 


- ম্যাডাম গ্রামের বাড়িতে যে হাসপাতালের কাজ শুরু হবে সেখানে কি কি কাজ থাকে? মানে এই অফিসে যেমন কাজ আছে সেরকম? 


- কেন বলো তো? 


- এমনি। 


- ওখানে ইঞ্জিনিয়ার, মিস্তিরি ডিজাইনার আরো অনেকে কাজ করবে। তাদের সবার কাজ তো আলাদা, আমাদের অফিসের কাজের সঙ্গে তো কোনো মিল নেই। 


- সফিক স্যার বললেন তিনি নাকি সেখানের দায়িত্বে যাচ্ছেন। তাই ভেবেছিলাম এখানকার মতো কাজ আছে মনে হয়। 


নিধি হেসে উঠলো, তারপর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললো, 


- তুমি আমার সঙ্গে যাবার জন্য তৈরি হয়ে নাও। হাতে কাজ থাকলে অন্য কাউকে সেটা বুঝিয়ে দিয়ে তারপর চলো। আর একটা ফ্লাক্স করে চা নিয়ে যাবে, এখানের চা খুব ভালো লাগে। 


★★★


রূপার বাবার পাশে তার ভাবিও বসে আছে। রূপা ভাবির পাশে বসলো। ভাবি বললেন, 


- কি হয়েছে রূপা? 


- কিছু হয়নি ভাবি, বাবার শরীর কেমন? 


- ভালো আছে, তোমার অফিসের অবস্থা কি? মালিককে কারা খুন করেছে কিছু জানা গেল? 


- না এখনো জানি না। ভাবি তুমি কি আমাকে একটু লবন দিয়ে চা বানিয়ে দেবে? আমার খুব গলাব্যথা করছে। 


- ঠিক আছে, তুমি বসো আমি যাচ্ছি। 


রূপা চুপচাপ বসে আছে, তার বাবা রূপার দিকে তাকিয়ে বললো, 


- ছেলেটার সাথে আজও কথা হয়নি? 


- হয়েছে বাবা, কিন্তু এরকম কথা হবার চেয়ে না হওয়া অনেক ভালো। 


- কেন কি বলেছে? 


- অফিস থেকে স্যারকে গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হবে, সেখানে অনেক বড় হাসপাতাল হবে। স্যার দু একদিনের মধ্যে সেখানে চলে যাবে। 


- তো কি হয়েছে? 


- আমি বলেছিলাম স্যার আমি যাবো না? তখন তিনি বলেন আমার নাকি সেখানে কাজ নেই। নতুন কাউকে নিয়োগ দেবেন। 


- ঠিকই তো, গ্রামের বাড়িতে তুই কীভাবে যাবি? সেখানে কি শহরের মতো বাসা ভাড়া পাওয়া যায় নাকি? তাকবি কোই? 


- তাহলে স্যার কোথায় থাকবে? আমি জানি স্যার ইচ্ছে করে আমাকে নেবেন না বাবা। তিনি ভালো করে জানেন আমি তাকে পছন্দ করি, সে যতই বকাবকি করে আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। সে বুঝতে পারে বলেই ইচ্ছে করে আমাকে নিবে না। 


- পাগলামি করিস না, তুই এমন ভাবে কথা বলিস মনে হয় যেন তুই বাচ্চা। তোকে কমপক্ষে দশ বছরের কম মনে হচ্ছে। 


রূপা তার বাবার বুকে মাথা রেখে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। রূপার বাবা লক্ষ্য করে দেখলেন রূপার কান্না একদম তার মায়ের মতো হয়েছে। এভাবে রূপার মা কান্না করতেন। 


আগামীকাল ২৫ তারিখ। 

সফিক সিগারেট হাতে নিয়ে লঞ্চের ছাঁদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাতের মুগ্ধতা উপভোগ করছে। বাতাসে হাতের সিগারেট এক টান দিতেই অর্ধেক ফুরিয়ে গেছে। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার, চাঁদের পাশে অসংখ্য তারার মেলা। সফিক তার মালপত্র সব কেবিনে রেখে ছাদে এসেছে। কালকে সকালে পৌঁছে তেমন কাজ নেই। সবই সেখানে বলা আছে, কালকে থেকে কাজের শুরু হবে। নিধি নাকি কালকে যাবে। 


প্রায় ঘন্টা খানিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে সফিক। হঠাৎ করে মেয়েলি কণ্ঠ শুনে ফিরে তাকালো। 


- বাহহ চমৎকার পরিবেশ, সেজন্য বুঝি একা একা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন? 


নিধি দাঁড়িয়ে আছে। সফিক ভাবলো হয়তো তার চোখের ভুল হতে পারে। নিধির তো ঢাকায় থাকার কথা, সে আসবে কীভাবে? কিন্তু একটু পরে তার ভুল ভেঙ্গে গেল। সত্যি সত্যি নিধি চৌধুরী। 


- অবাক হচ্ছেন? 


- হ্যাঁ। 


- হঠাৎ করে কেন জানি ইচ্ছে করছিল রাতের এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে। মায়ের কাছে সবসময় শুধু গল্প শুনতাম, নীরব রাতের আধারে এভাবে ভ্রমণ করার আনন্দ নাকি অন্যরকম। 


- আপনি কি জাননি কখনো? 


- না, বাবা যেতে দিতেন না। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বাবা আমাকে নানা বাড়ির এলাকায় যেতে দিতেন না। মা নিজেও কোনদিন মুখ ফুটে বলেনি নিয়ে যাবার কথা। কারণ বাবাকে প্রচুর ভয় পেতেন তিনি। 


- তো আমাকে বললেই পারতেন।। 


- ভাবলাম একটু চমকে দেই আপনাকে। তাই ম্যানেজারকে বলেছিলাম আপনি যেভাবে যাবেন সেভাবে যেন ব্যবস্থা করা হয়। 


- জিন্সের প্যান্ট আর টিশার্ট পরে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না। উপভোগ করতে হলে শাড়ি পরে খোলা চুলে এসে দাঁড়াবেন তখন মৃদু বাতাসে আপনার চুল উড়বে। আপনি বেশ আনন্দ পাবেন। 


- ঠাট্টা করছেন? 


- আপনার কি মনে হয় আমি ঠাট্টা করতে পারি? 


- আপনি কি জানেন আমি একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসি। 


- না জানি না। আমার জানার কথা নয়। 


- ঠিকই বলেছেন। ওরা নাম লিমন, পড়াশোনা করতে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। সেখানেই পরিচয়। সে আমার বাবার পরিচয় জানতো। বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ সবকিছু আমি তাকে বলতাম। 


- লিমন সাহেব এখন কোথায়? 


- দেশেই আছে। 


- ওহ্। 


- লিমন আমাকে সবসময় বলতো বাবার সাথে এসব রাগারাগি বন্ধ করে দেশে আসতে। তারপর বিয়ে করে আমরা দুজন সংসার করতাম, কিন্তু আমি আসতে চাইনি। 


- কেন? 


- একদিন লিমনকে কথা বলতে বলতে আমি বলেছিলাম, বাবা যতদিন বেঁচে আছে ততদিন আমি বাংলাদেশে যাবো না। 


- কঠিন প্রতিজ্ঞা, অবশ্য আপনি আপনার সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছেন। 


- সফিক সাহেব..! 


- জ্বি। 


- লিমনকে আমি বলেছিলাম বাবার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি বাংলাদেশে আসবো না। তাই আমার ধারণা লিমনই দেশে এসে পরিকল্পনা করে এই কাজটা করেছে। সেজন্য আমি পুলিশকে খুব প্রেশার দেইনি। তবে ছদ্মবেশে একজনকে নিয়োগ দেবো যেন পুরোপুরি সত্যিটা জানতে পারি। 


- আপনি তো খুব সাংঘাতিক মেয়ে! 


- রূপা নামের মেয়েটা কেমন সফিক সাহেব? 


- ভালোই মনে হয়, শ্রদ্ধা করে খুব। 


- রূপার সঙ্গে আমার বয়ফ্রেন্ড লিমনের পরিচয় আছে। 

লিমন ও রূপা একে অপরকে চেনে, জানেন? 

.

সফিক বললো,

- আপনি কি নিশ্চিত যে স্যারকে লিমন সাহেব খু-ন করেছে? 


- খু-ন করেছে বলিনি, বলেছি পরিচিত কাউকে দিয়ে কিংবা ভিন্ন উপায়ে বাবাকে মেরেছে। কারণ আমি জানামতে বাবার কোনো শত্রু নেই, তবে... 


- তবে? 


- আমার মনে হচ্ছে আমরা যেখানে যাচ্ছি সেই গ্রামের বাড়িতে কিছু একটা আছে। বাবা কখনো গ্রামের বাড়িতে যেতে চাইতেন না। আমি যখন মায়ের কাছে বলতাম মা নিজেও বলতেন সেখানে দেখার কিছু নেই। তাছাড়া তোমার বাবা যেতে দিবেন না। 


সফিক চুপ করে রইল। তার প্রচুর মাথা ব্যথা শুরু করেছে। মাঝে মাঝে এরকম হয়, একবার শুরু হলে ঘন্টা খানিক খুব কষ্ট হয়। এখন তার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিৎ। নিধি চলে গেলে সফিক কিছুক্ষণ একা থাকতে পারবে কিন্তু এই মেয়ের চলে যাবার কোনো লক্ষন নেই। 


- সফিক সাহেব। 


- বলেন। 


- গ্রামের মধ্যে বাবা কারো সঙ্গে হয়তো বেঈমানী করেছে। কোনো এক মানসিক অজ্ঞাত কারণে বাবা তাকে ভয় পেতেন। 


- আমার তো মনে হয় না। কারণ সেরকম কিছু হলে তিনি আপনার নানা বাড়ির এলাকায় তো হাসপাতাল করতে চাইতেন না। 


- আপনি কি অসুস্থ? 


- মাথাটা ব্যথা করছে। 


- ঠিক আছে আপনি তাহলে একা একা থাকুন আমি বিরক্ত না করে চলে যাই। 


- আচ্ছা। 


নিধি ছাঁদ থেকে নেমে গেল। সফিক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নদীর দিকে। ছোটছোট নৌকায় আলো জ্বলছে, নদীর পাড়ে দুরে যেসব গ্রাম দেখা যায় সেখানে কিছু বাতি তারার মতো লাগছে। এরকম একটা পরিবেশ, ফারজানার সঙ্গে আজ কথা বলতে ইচ্ছে করছে৷ রাত বেশি হয়নি, ঢাকা শহরে এখন সবাই জেগেই আছে। তাছাড়া বিগত কদিন ধরে অনেক রাত পর্যন্ত ফারজানাকে অনলাইনে দেখা যায়। 


- স্যার আপনার নাকি মাথা ব্যথা করছে? ম্যাডাম আপনাকে চা দিতে বললো। 


সফিক ঘুরে তাকালো, রূপা চায়ের ফ্লাক্স আর কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সফিক তার দিকে ফিরে তাকাতেই সে বললো, 


- চা খাবেন? 


- তুমি এখানে? 


- ম্যাডামের সঙ্গে যাচ্ছি, তিনি আমাকে তার সঙ্গে যেতে বললেন। 


- আমি তো জানতাম না। 


- আমিও জানি যে আপনি জানেন না। ম্যাডাম দুদিন আগে আমাকে বলেছে তার সঙ্গে যেতে হবে। 


সফিক খানিকটা অবাক হয়ে গেল। তারমানে নিধি চৌধুরী আগে থেকেই যাবার পরিকল্পনা করেছে। শফিককে সে বুঝতে দেয়নি, এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। সফিক চিন্তিত হয়ে গেল, বড়লোকের অহংকারী মেয়ে কারণ ছাড়া কোনো কাজ করবে না। মেয়েটার সকল কাজ সন্দেহের সৃষ্টি করে তার মনে। 


- স্যার চা দেবো? 


- হ্যাঁ দাও। 


রূপা চা বানাতে লেগে গেল। সফিক বললো, 


- অফিস থেকে কে কে যাচ্ছে? 


- ম্যানেজার সাহেবও যাচ্ছেন। আমি আর ম্যাম সহ মোট সাতজন যাচ্ছি। 


- তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? 


- জ্বি স্যার! 


- লিমন নামের কাউকে তুমি চেনো? বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছে। 


- জ্বি লিমন ভাইয়া। 


- তোমার সঙ্গে তার পরিচয় কি? 


- আমার ভাবির পরিচিত, ভাবির নাকি ক্লাসমেট ছিল সে। ভাবির গ্রামের স্কুলে তিনি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। 


- তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে কতদিন আগে? 


- দেড় দুই বছর তো হবেই। একদিন রাস্তায় হঠাৎ করে ভাবির সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। ভাইয়ার বাবা সরকারি চাকরি করতেন, ক্লাস এইটে পড়ার সময় তার বাবার বদলি হয়ে যায়। তারপর থেকে ভাবির সঙ্গে আর পরিচয় ছিল না। কিন্তু সেদিন রাস্তায় দেখে নাকি তিনি চিনতে পারেন। তারপর আমাদের বাসায় এসেছিলেন। 


- তোমাদের বাসায় আসার পরে তোমার সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে তাই তো? 


- জ্বি স্যার, আর তার সম্পর্কে যা কিছু বলছি সব ভাবির কাছে শুনেছি আমি। ভাবি তো মাঝে মাঝে আফসোস করেন। তার ক্লাসমেট কতো ভালো, পড়াশোনা করে এসেছেন বিদেশ থেকে। এখন ভালো চাকরি করবেন, আর ভাবির জীবন গরীব ঘরে কেটে গেল। 


- তুমি কি জানো লিমন সাহেব নিধি ম্যাডামের পরিচিত। অস্ট্রেলিয়ায় তাদের পরিচয়, ম্যাডাম কি তোমাকে এসব বলেছে? 


- না স্যার বলেন নাই। 


- ঠিক আছে আমি যে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি এসব কাউকে বলার দরকার নেই। 


- স্যার লিমন ভাইয়ের সঙ্গে আমার তেমন বেশি পরিচয় নেই। আমাদের বাসায় মাঝে মাঝে গেলে আমি তেমন কথা বলতাম না। 


রূপা একটু টেনশনে পরে গেল। সে ভাবছে তার স্যার কি বিষয়টা অন্য কিছু ভাবছে নাকি? রূপা তো লিমনকে পছন্দ করে না, কিন্তু স্যার সেরকম কিছু যদি মনে করে। হায় আল্লাহ। 


- সফিক সাহেব, মাথা ব্যথা কমেছে? 


নিধি দাঁড়িয়ে আছে, তার পরনে কালো রঙের একটা শাড়ি। সুন্দরী এক মেয়ে গায়ে কালো শাড়ি জড়িয়ে আছে, বাহ সুন্দর তো। 

কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সে শাড়ি কোথায় পেল? 

এই রহস্যময় মেয়েটার উদ্দেশ্য কি? 

ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করা দরকার। আর কি কি প্ল্যান করেছে কে জানে? 


- ভাবলাম ছাঁদে দাঁড়িয়ে চা খেলে আপনার মাথা ব্যথা কমতে পারে। তাই রূপাকে দিয়ে আপনার কাছে চা পাঠালাম। সেই ফাঁকে পোশাক পরিবর্তন করে শাড়ি পরেছি, এবার নিশ্চয়ই আপনার রাতের প্রকৃতি দেখতে বাঁধা নেই। 


- হঠাৎ করে শাড়ি পেলেন কোথায়? 


- এটা রূপার শাড়ি। ভাগ্যিস সে তার কাপড়ের সঙ্গে নিয়ে এসেছে নাহলে তো আপনার প্রকৃতি দেখতে পারতাম না। 


রূপা লজ্জা পেয়ে গেল। সে চায়ের কাপ আর ফ্লাক্স নিয়ে উঠে গেল, তার হয়তো থাকতে লজ্জা করছে। একটু আগে নিধি যখন কেবিনে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো, 


- রূপা তোমার শাড়ি আছে? 


- জ্বি ম্যাডাম আছে। 


- কি কি কালার আছে? 


- ম্যাডাম আমার তো সব ধরনের শাড়ি আছে। 


- তাহলে কালো বাদে যেকোনো রঙের একটা শাড়ি দাও আমি এখনই পরবো। 


রূপার মুখ ছোট হয়ে গেল, কারণ সে তার সঙ্গে করে মাত্র একটা কালো শাড়ি নিয়ে এসেছে। ম্যাডাম জিজ্ঞেস করাতে সে তার বাসায় নিজের যে শাড়ি আছে সেগুলো বলেছে। কিন্তু ম্যাডাম যে এখন তার শাড়ি চাইবে সে বুঝতে পারেনি। 


রূপা তার ব্যাগ থেকে কালো শাড়িটা বের করে নিধির হাতে দিল। নিধি তার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে বললো, 


- তোমাকে কালো বাদে যেকোনো রঙের একটা শাড়ি দিতে বলেছি। কালো দিতে বলিনি। 


- ম্যাডাম কালো শাড়িই আছে। 


- একটু আগে যে বললে? 


- ওগুলো তো সব বাসায়। 


- বুঝতে পারছি। ঠিক আছে তাহলে এটাই পরবো সমস্যা নেই। তুমি এক কাজ করো, ছাদে সফিক সাহেব একা একা বসে আছে। তার মাথা ব্যথা করছে, তুমি গিয়ে তাকে একটু চা দিয়ে আসো। আমি ততক্ষণে কেবিনে বসে শাড়ি পরে ফেলি। 


রূপা আনন্দিত হয়ে চা আর ফ্লাক্স হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ম্যাডাম আসার সময়ই সঙ্গে করে চা নিতে বলেছে, সেখান থেকে সফিক এখন পাবে। 


★★★ 


রূপার সঙ্গে সঙ্গে নিধিও চলে গেল। শরীরে কিছু একটা কামড়াচ্ছে, পিপড়া নাকি ছাড়পোকা বোঝা যাচ্ছে না। এখনই শাড়ি বদলে ফেলতে হবে। সে ছাঁদ থেকে নামার পরে সফিক আবারও নিঃশ্বাস ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইল। মেয়ে দুটো , বিরক্তিকর! 

মনে মনে বললো, আর যেন কেউ ফিরে না আসে। আর যদি কেউ আসে তাহলে সে নিচে গিয়ে আর আসবেন না সিদ্ধান্ত নিলেন। দরকার হলে কেবিনে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকবে। 


- Excuse Me Brother, কেমন আছেন? 


টগবগে তরুণ এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। আবার কোন বিরক্তিকর ঝামেলা, সফিক মনে মনে বললো, ঠিক আছে ক্ষমা করলাম এবার তুমি বিদায় হও ভাই। কিন্তু মুখে শুধু বললো, 


- Hi, 


- আমার নাম লিমন তালুকদার, আপনি নিশ্চয়ই নিধির অফিসে চাকরি করেন। 


লিমন...! তারমানে লিমনও লঞ্চে আছে? নিধি কি এটা জানে? জানলে সফিকের কাছে বললো না কেন? বলেই বা কি হবে, মেয়েটা তো এমনিতে একটু রহস্যময়। 


- হ্যাঁ, আমার নাম সফিক আহমেদ। 


- আমি নিধির পরিচিত, বন্ধু বলতে পারেন। 


- আচ্ছা, তো আপনিও কি ম্যাডামের সঙ্গে সেই গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছেন? 


- আপনার ম্যাডাম এখনো জানেন না যে আমি যাচ্ছি। সারপ্রাইজ হিসেবে রেখে দিচ্ছি, কালকে সকালে তার সঙ্গে দেখা করবো। 


রূপার কাছে করা প্রশ্ন লিমনকেও করতে ইচ্ছে করছে সফিকের। কিন্তু সেক্ষেত্রে নিধির কথা তার মনে পরে গেল। নিধি চুপচাপ নিজের মতো করে সবকিছু বের করার চেষ্টা করছে। সফল যদি কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে বেচারা কিছু আন্দাজ করতে পারে। 


- নিধিকে দেখলাম আপনার সঙ্গে কথা বলতে। তাই ভাবলাম কিছুক্ষণ গল্প করবো। একা একা ভালো লাগে না ভাই। 


- আপনি চাইলে নিধি ম্যাডামের সঙ্গে আগেই দেখা করতে পারেন। সকালের চাইতে এখনই বেশি সারপ্রাইজ হবে মনে হয়। তাছাড়া দুজন মিলে গল্প করতে করতে চলে যেতে পারবেন। 


- হুম তা ঠিকই বলেছেন। 


- দুঃখিত লিমন সাহেব, আপনার সঙ্গে আর থাকতে পারছি না। আমার বেশ কিছুক্ষণ ধরে মাথার মধ্যে যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি এখন কেবিনে গিয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করবো। 


- ওহ্ শিওর, কোনো সমস্যা নেই। 


- ধন্যবাদ আপনাকে, শুভ রাত্রি। আগামীকাল সকালে দেখা হবে ইন শা আল্লাহ। 


সফিক নিচে এসে অযু করলো। লঞ্চের মধ্যে নির্দিষ্ট একটা স্থানে নামাজের স্থান আছে, সেখানে গিয়ে এশার নামাজ পড়লো। তারপর নিজের কেবিনে চলে গেল। নিধি রূপা ম্যানেজার সবাই কে কোথায় আছে জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মাথা অতিরিক্ত যন্ত্রণা দিচ্ছে তাই কেবিনে চলে গেল। 


★★★


রাত একটা। 

রুপা নিধি ঘুমাচ্ছে, রূপা আস্তে করে কেবিনের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। তারপর সাবধানে দরজা বন্ধ করে এদিক সেদিক তাকিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। খানিকটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে লিমন। রূপা তার কাছে যেতেই লিমন বললো, 


- নিধি কি ঘুমিয়ে গেছে? 


- হ্যাঁ। 


- তুমি ঠিকমতো কাজটা করতে পারবে তো? হাতের যেকোনো শিরায় ইঞ্জেকশন দিতে হবে, খুব সাবধানে। 


- আমার ভয় লাগছে লিমন ভাই। 


- কোনো ভয় নেই, তুমি কোনরকমে ইঞ্জেকশন দিতে পারলেই শেষ। ঘুমের মধ্যেই নিধি তার বাবার কাছে চলে যাবে। এই বিষ খুবই মারাত্মক। একবার রক্তে মিশে গেলে সেই মানুষ আর বাঁচে না। 

.

.

লিমনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রূপা কেবিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সফিক যেন কিছু বলতে গিয়েও গলায় আটকে যাচ্ছে কথা। রূপা দরজা খুলে ভিতরে চলে গেল, সফিক দ্রুত কেবিনের সামনে গিয়ে দরজা ধাক্কা দিতে লাগলো। 

দরজা ধাক্কার শব্দ হচ্ছে কিন্তু রূপা দরজা খুলছে না। 


আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল সফিকের। সত্যি সত্যি দরজা ধাক্কার শব্দ হচ্ছে কিন্তু সেটা তার নিজের কেবিনের দরজা। সদ্য ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্নটা মাথার মধ্যে জ্বলন্ত হয়ে আছে। বাতি জ্বলছে, সে একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। মাথা ব্যথাটা এখন আর নেই মনে হচ্ছে। 


দরজা ধাক্কা চলছে। সফিক উঠে গিয়ে কেবিনের দরজা খুলে দিল, তার সামনে ম্যানেজার সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। 


- ঘুমাচ্ছিলে সফিক? 


- জ্বি, আসুন। 


- আপনার মাথা ব্যথা কমেছে কিনা জিজ্ঞেস করতে এলাম। ম্যাডাম আর রূপা ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে, আপনি সুস্থ থাকলে যেতে বলেছে। 


- তারা দুজনেই একসঙ্গে আছে? 


- হ্যাঁ। ম্যাডামের এক বন্ধু ছিলেন এতক্ষণ, তার নাম লিমন। কতক্ষণ গল্প করলো, তারপর দেখি ম্যাডাম তার সঙ্গে রাগারাগি করলেন। 


- আপনি ম্যাডামের দিকে খেয়াল রাখবেন। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না, তাছাড়া শরীর বেশি ভালো না ম্যানেজার সাহেব। 


- ঠিক আছে তাহলে বিশ্রাম করেন। 


দরজা বন্ধ করে সফিক মোবাইল হাতে নিল। কথা বলতে ইচ্ছে করছে, ফারজানার কাছে কল দিয়ে কি স্বপ্নের বিষয় জিজ্ঞেস করা যায়? সফিক তার ভাবনা মতোই ফারজানার কাছে কল দিল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হলো। 


- ফারজু আমি সফিক বলছি। 


- তোমার নাম্বার আমার মুখস্থ। 


- তোমাকে একটা জরুরি কারণে কল দিলাম। 


- কি কারণ?


- একটু আগে একটা স্বপ্ন দেখলাম, আমাদের মালিকের মেয়েকে রূপা মারার চেষ্টা করছে। 


- তুমি কি সবসময় উদ্ভট জিনিস দেখো? 


- রেগে যাচ্ছ কেন? 


- তুমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করোনি এখনো? 


- পেপারটা হারিয়ে গেছে, আমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো। তারপর সিগনেচার করে দেবো। 


- তুমি কিন্তু খুব চালাকি করার চেষ্টা করছ। 


- আমি মোটেই চালাকি করছি না, সত্যি সত্যি সেটা হারিয়ে গেছে। বাসাতেই আছে মনে হয়। তুমি এক কাজ করো, তোমার কাছে তো বাসার চাবি আছে। বাসায় গিয়ে একটু খুঁজে দেখবে প্লিজ? আমি জানি তুমি খুঁজে পাবে, তুমি পারবে না এমন কোনো কাজ পৃথিবীতে নেই। 


- ঠাট্টা করছ? 


- না ঠাট্টা করছি না, তুমি কি এখনো তোমার সেই বান্ধবীর বাসায় আছো? 


- হ্যাঁ। 


- তুমি চাইলে কিন্তু আমাদের বাসায় গিয়ে থাকতে পারো। বাসাটা এখন থেকে খালি পরে থাকবে। আমি স্যারের শশুর বাড়ির এলাকায় হাসপাতাল তৈরির সব দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। এখন থেকে সেই গ্রামের মধ্যে থাকবো। 


- তোমার কেন মনে হচ্ছে যে আমি ওই বাসায় গিয়ে থাকতে পারি। 


- জানি না, তুমি তো জানো আমি ভেবেচিন্তে কিছু বলতে পারি না ফারজু। যা ভালো লাগে তাই বলে ফেলি, তুমি না থাকলেও বাসায় গিয়ে পেপারটা খুঁজে বের করো। তবে তুমি যদি আমাদের বাসায় থাকো তাহলে কিছুদিন তোমার কাছে ফাকাফাকা মনে হবে। তখন যদি তোমার মনে হয় আমার কাছে ফিরে আসা দরকার তাহলে ফিরে আসবে। আর নাহলে তুমি পেপারটা নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসবে। সেখানে একদিন তোমাকে আমি সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাবো, তারপর সন্ধ্যা বেলা পেপার সাইন করে তোমাকে ঢাকার লঞ্চে উঠিয়ে দেবো। 


- আমি কল রাখলাম। 


- আরেকটু কথা বলি? বেশি নয়, একটুখানি ...! 


- বলো। 


- নাহহ কিছু না। ভালো থেকো ফারজু। 


সফিক কল কেটে দিল। ফারজানা তাকে বারবার বলেছিল সে সফিকের সঙ্গে আর কোনদিন দুই মিনিটের বেশি কথা বলতে চায় না। কিন্তু আজ একটু বেশি হয়ে গেছে। সফিক আবার বেরিয়ে গেল বাইরে, একটু চা খেতে ইচ্ছে করছে তার। 


★★ 


নিধির দিকে তাকিয়ে আছে রূপা, তার কাছে এই মুহূর্তে নিধিকে রহস্যময় মনে হচ্ছে। অদ্ভুত ধরনের কথা বলে, রূপার ঘুম পাচ্ছে কিন্তু নিধির জন্য তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। রূপার মনে হচ্ছে সে এখনই ঘুমে ঢলে পড়বে লঞ্চের ছাঁদে। একটু আগে ম্যানেজার সাহেব বলে গেছে সফিক সাহেব এখনো অসুস্থ। রূপার ইচ্ছে করছে স্যারের কাছে গিয়ে কথা বলতে, তার কিছু দরকার হলে সেটা এগিয়ে দেবে। কিন্তু পারছে না। 


- রূপা। 


- জ্বি ম্যাম। 


- লিমন সাহেবকে দেখে চমকে গেলে নাকি? 


- জ্বি একটু অবাক হয়েছি। 


- তার কথাবার্তায় তোমার কি মনে হয় যে  আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়? 


- আমি জানি না ম্যাম। 


- তুমিও তো একটা মেয়ে তাই সামান্য ধারণা তো আছে বলে মনে হয়। নাকি বলতে ভয় পাও? 


- জি-না ভয় পাই না। 


- সফিক সাহেবকে আমি বলেছিলাম যে বাবার মৃত্যুর পিছনে লিমনের হাত থাকতে পারে। কারণ আমি বাবার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশে আসবো না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। 


- তিনি কি সত্যি সত্যি স্যারকে মেরেছেন? 


- না, বাবা আত্মহত্যা করেছে। 


রূপা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিধির দিকে। খুব স্বাভাবিক ভাবে নিধি কথা বলছে কিন্তু সত্যি নাকি মিথ্যা বোঝা যাচ্ছে না।


- রূপা...! 


- জ্বি। 


- বাবাকে আমাকে মানসিক কষ্ট দেবার জন্য আমার জন্মদিনের দিন আত্মহত্যা করেন। আমি যতদিন বাঁচবো ততদিন প্রতি বছর জন্মদিনে আমার মনে পড়বে তার কথা। আমি তখন হয়তো তার কথা ভেবে মন খারাপ করবো চোখের পানি ফেলবো। এসব করার জন্য বাবা আমাকে শিক্ষা দিয়ে গেল। 

মৃত্যুর দিন বাবা অনেকবার আমাকে কল করে কিন্তু আমি রিসিভ করিনি৷ তারপর বাবা আমাকে টেক্সট করে বলে যে, আমি কল রিসিভ না করলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। আমি তখন বাবার কাছে ভিডিও কল করি তাকে বললাম যে আমি তার আত্মহত্যার দৃশ্য দেখতে চাই। আমি তাকে বলেছিলাম রাগ করে কারণ ভেবেছিলাম বাবা আমাকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করতে চায়। 


- তারপর কি হলো ম্যাডাম? 


- বাবা তার ড্রয়ার থেকে ছুরিটা বের করেন। মোবাইল হাতে ধরেই তিনি এক মুহূর্ত দেরি না করে নিজের গলায় নিজেই কাটেন। দেরি করলে হয়তো পারতেন না কারণ সাহস ফুরিয়ে যেত। ভাবতেই পারিনি যে বাবা এরকম একটা কাজ করতে পারবেন। 


নিধি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রূপা কিছু বলবে কিনা ভেবে নিচ্ছে। তার কাছে মনে হচ্ছে এখন চুপ করে থাকাটা ভালো হবে। 


- রূপা। 


- জ্বি। 


- আমি লিমনকে বললাম যে, তুমি কি আমার বাবার কিছু করেছ? আমি জানি বাবা আত্মহত্যা করেছে তবুও তাকে বলেছি। কারণ আমি চাইতাম লিমন এসবের সঙ্গে জড়িত হবার ভয়ে যেন আমার সঙ্গ ত্যাগ করে। তাকে ভয়ে রাখার জন্যই আমি সত্যিটা কাউকে বলিনি। পুলিশের তদন্ত করার বিষয়টাও বাদ দিয়েছি আমি। তবে সফিক সাহেবকে নিজে ইচ্ছে করে একটু বিভ্রান্ত করছি। আমার কেন জানি না নিজেকে সবার সামনে বুদ্ধিমতী হিসেবে প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে। সফিক সাহেব একেক সময় একেক ধরনের দ্বন্দ্বে পড়ে যেতেন। আমার বেশ ভালো লাগতো। 


- আমাকে এসব বলছেন কেন? 


- লিমন তোমার পরিচিত তাছাড়া আমার বিশ্বাস তুমি এসব কাউকে বলবে না। ঢাকায় ফিরে আমি সবাইকে সত্যিটা বলবো৷ 


- ঠিক আছে ম্যাডাম। 


- বাবা আমার জন্য একটা গিফট রেখে গেছে আমাদের বাড়িতে। আমি যে ঘরে থাকতাম সেই ঘরের খাটের ওপর রাখা ছিল গিফট। বাবা মনে হয় ভেবেচিন্তে রেখেছিল তিনি মারা যাবেন। না ভাবলেও সমস্যা ছিল না কারণ বেঁচে থাকলে সেদিনই তিনি গিফট সরাতে পারতেন। কারণ আমি তো দেশের বাইরে ছিলাম। 


- কি ছিল সেই গিফটে? 


- পঁচিশটা মোমবাতি আর একটা চিঠি। 


- মোমবাতি কেন ম্যাডাম? 


- জানি না, চিঠির মধ্যে মোমবাতি নিয়ে তেমন কিছু লেখা নেই। তবে চিঠিটা চমৎকার ছিল। 


- ওহ্। 


- মা নিধি, আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে আমার জীবদ্দশায় তুমি দেশে ফিরবে না। তাই আমি চাই যেকোনো মূল্যে তুমি দেশে আসো। তোমাকে আমি সফিকের কথা সবসময় বলতাম। আমি শুনেছি সফিকের নাকি ডিভোর্স হয়ে যাবে। এরকম ভালো আর চমৎকার একটা ছেলের এরকম কিছু হবে ভাবিনি। আমার মৃত্যুর পরে যদি তোমার রাগ বিন্দু পরিমাণ কমে থাকে তাহলে তোমার প্রতি আমার অনুরোধ তুমি শফিককে বিয়ে করবে। আশা করি আমার শেষ মুহূর্তে বলা অনুরোধ তুমি না রাখলেও অন্তত বিবেচনা করে দেখবে৷ 


এটাই ছিল বাবার চিঠি। আমি দেশে এসে বাড়িতে এই গিফট পাইছি তারপর থেকে কতো চিন্তা কতো সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। 


- রূপার গলা শুকিয়ে গেল। নিধি চৌধুরী তার স্যারকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নাকি? তাহলে তার নিজের কি হবে? রূপা মনে মনে কতটা আগ্রহ নিয়ে ছিল সেই স্বপ্নের কি হবে? রূপার মনে হচ্ছে নিধি বুঝতে পেরেছে রূপার মনের কথা। তাই সে কৌশলে সবকিছু তাকে জানাচ্ছে। 


- রূপা। 


- জ্বি। 


- শুনেছি সফিক সাহেব এখনো তার স্ত্রীর দেয়া ডিভোর্স পেপারে সাইন করেনি। আমি সেজন্য চুপচাপ অপেক্ষা করছি। বাবার অনেক অনেক টাকা হলেও কেন জানি নিজেকে খুব নিঃশ্ব মনে হয় সবসময়। 


- ম্যাডাম আমার ঘুম পাচ্ছে, চলুন নিচে যাই। 


- সফিক সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে তার মনে হয় আবার সম্পর্কটা ঠিক হবে। সফিক সাহেব এখনো সেই পেপারে সাইন করেননি। কেন জানি মনে হচ্ছে তিনি ফিরে আসবেন। তিনি যদি ফিরে আসে তবে আমি খুশি হবো। বাবার মৃত্যুর আগে তার বলে যাওয়া ইচ্ছে পুরন করতে হবে না। চলো নিচে যাই। 


★★★ 


নিধি কেবিনে ঢুকে গেল। রূপা সফিককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে রেলিং হাতলে। নিধিকে রেখে সে চুপিচুপি সফিকের কাছে গেল। সফিক তাকে দেখে বললো, 


- ম্যাডাম কোথায়? 


- এইমাত্র কেবিনে গেলেন। আপনার শরীর কেমন আছে স্যার? 


- ভালো লাগছে এখন। 


রূপা চলে যাচ্ছিল, আবারও থমকে গেল। সে পিছনে ফিরে বললো, 


- স্যার একটা কথা বলতে পারি? 


- হ্যাঁ বলো। 


- আপনার সঙ্গে ভাবির এখনো পুরোপুরি ডিভোর্স হয়নি তাই না? মানে আপনি ডিভোর্স পেপারে সাইন করেননি। 


সফিকের রাগ উঠে গেল। সে ভাবলো রূপা মনে হয় তার আর ফারজানার মোবাইলে কথা বলতে শুনেছে। ম্যানেজার সাহেব চলে যাবার পরে রূপা হয়তো আবার এসেছিল। তখন হয়তো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড়ি পেতেছে। 


- তাতে তোর কোনো সমস্যা আছে? আমার বিষয় আমি বুঝবো তাতে তোর কি? দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা শোনার অভ্যাস হয়ে গেছে নাকি? খবরদার আর কখনো যেন আমার চোখের সামনে তোমাকে না দেখি৷ মনে রেখো কথাটা। 


রূপার চোখ দিয়ে গলগল করে পানি পড়তে লাগলো। স্যারের কাছে বকা শুনতে তার খারাপ লাগে না কিন্তু আজকে কেন জানি প্রচুর খারাপ লাগছে। রূপার ইচ্ছে করছে এখনই নদীতে ঝাপ দিয়ে মরে যাবে। রূপা টলতে টলতে কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল। 


পরদিন ভোরবেলা লঞ্চ থেকে নেমে রূপা সবার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে গেল না। নিধির কাছে বললো তার বাবার শরীর খুব খারাপ তাই তাকে ঢাকায় যেতে হবে। নিধি কোনকিছু চিন্তা না করে রূপাকে ঢাকা যাবার ব্যবস্থা করতে বললেন। দেড় ঘন্টা পরে সকালের লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। রূপা লঞ্চ টার্মিনালে ঢাকায় ফিরে যাবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। মনে মনে বললো, 


"স্যার আর কোনদিন আপনার সামনে যাবো না!" 


★★★ 


সময় কখনো অপেক্ষা করে না। আপনি ঘুমিয়ে থাকুন, জাগ্রত থাকুন, ব্যস্ত থাকুন, অবসর থাকুন, সুখে থাকুন বা কষ্টে থাকুন। সময় চলে যাবে তার নিজের গতিতে। 


হাসপাতালের কাজ শুরু হবার পরে নিধি চৌধুরী চলে গেছে ঢাকায়। সে আর গ্রামের বাড়িতে আসেনি তবে খোঁজ নিচ্ছেন সবসময়। 


রূপা সেদিন চলে যাবার পরে অফিসে গিয়েছে মাত্র একবার। চাকরি ছেড়ে দিয়েছে রূপা। নতুন চাকরি নিয়েছে অন্য একটা কোম্পানিতে। 


সফিক এসব নিয়ে চিন্তা করে না। সে সারাদিন কাজের মধ্যে থাকে, দিনশেষে গ্রামের শেষ প্রান্তে নদীর তীরে গিয়ে বসে থাকে। অনেক রাত পর্যন্ত সে নদীর তীরে অবস্থান করে, তারপর ক্যাম্পে ফিরে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে যায়। 


সাত মাস পরে নিধির সঙ্গে সফিকের দেখা হয় কিন্তু কথা হয় না। চারদিন আগে কাজের সাইডে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে। চারিদিকে লন্ডভন্ড অবস্থা ছিল, কোনকিছু তেমন ঠিক নেই। সিমেন্টের শক্ত ঢালাইয়ে মাথা পরে মারাত্মক ধরনের আঘাত লাগে। জেলা সদর হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেবার পরে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়।

 

আজ সকালে সফিক মারা গেছে হাসপাতালে। সফিকের সঙ্গে যে ছেলেটা ছিল সে গতকাল রাতে নিধির হাতে দুটো ডকুমেন্ট দিয়েছে। সুন্দরবন কুরিয়ার অফিসের মাধ্যমে সফিকের নামে ঢাকা থেকে পাঠানো হয়েছিল। সফিককে দেওয়া হয়নি কারণ সেই সুযোগ নেই। 


একটা রূপার এবং আরেকটা ফারজানার। 


রূপার বিয়ে ঠিক হয়েছে। সে তার বিয়ের কার্ড সুন্দর করে খামে ভরে পাঠিয়েছে সফিকের কাছে। 

ফারজানা পাঠিয়েছে সেই ডিভোর্স পেপার। সে পেপারে সাইন না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না। সফিক যেন দয়া করে এবার কোনো ঝামেলা না করেই সিগনেচার করে দেয়। 


দুটো ঠিকানার জন্য দুটো খাম যোগাড় করে নিধি। চাইলেই কল দিয়ে বলে দিতে পারে সফিক নেই। 


কিন্তু সে রূপার কাছে একটা চিঠি দিল, যে ঠিকানা থেকে সে পাঠিয়েছে সেই ঠিকানায় নিধি তাকে লিখে পাঠালো, 

" তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইল। দোয়া করি সামনের দিনগুলো হাসিখুশি আর আনন্দের সাথে কাটুক। সফিক গতকাল মারা গেছে। তার হাতে তোমার বিয়ের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া হলো না। ভালো থেকো। "


নিধি। 


ফারজানার পাঠানো ঠিকানায় সেই পেপারই পাঠিয়ে দিল নিধি। সেখানেও ছোট্ট একটা চিরকুট দিয়ে দিল। 


" সফিক সাহেব মারা গেছে, আমার মনে হয় আপনার আর কোনো অস্বস্তি থাকবে না। জীবন নতুন করে সাজিয়ে নিন। নিধি। " 


|

|


মৃত্যুর আগে বাবার রেখে যাওয়া পঁচিশ মোমবাতি একসঙ্গে জ্বালিয়ে ছাঁদে বসে আছে নিধি। তার হাতে মা-বাবা দুজনের একত্রিত একটা ছবি। নিধি সেই ছবি আঁকড়ে ধরে বসে আছে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে, কিছু জীবন শেষ হয়েছে আর কিছু জীবন নতুন করে শুরু হয়েছে। 


জীবনের সব পথ শেষ হয় না। কিছু পথের যাত্রী মাঝপথে হারিয়ে যায়। কেউ কেউ পথ বদলে ফেলতে বাধ্য হয় আবার কেউ কেউ সামনে বা পিছনে কোথাও যায় না। অপেক্ষা করে। 


----- সমাপ্ত -----


এমন আরও গল্প গুলো পড়ুন।