মেয়েদের সংসার জীবন | সংসার ভাঙ্গার কারণ

 সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা

সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা

আমার হাসবেন্ড আশরাফ ঢাকাতে চাকরি করে।বিয়ের পর পর শুনেছি আশরাফ নাকি বাহিরের খাবার খেতে পারে না। বাহিরের খাবার খেয়ে দুইবার হাসপাতালে ভর্তি ছিলো।তাই বিয়ের একমাস পরে অনেকটা জোর করে শ্বাশুড়ি মা আমাকে আশরাফের কাছে পাঠিয়ে দেন। সংসারের স ও বুঝতাম না।তারপরও একটা সংসার গুছিয়েছি।কেউ একটু সাহায্য করে নাই। আশরাফ খুব ছুটি পেতো না যার কারণে দুই ঈদ বাদে আমাদের বাড়ি যাওয়া হতো না।


তিন দিন হউক চার দিন হউক যখন বাড়ি যেতাম আমার শ্বাশুড়িকে রান্না করতে দিতাম না। আমি রান্না করতে গেলে ওনি বার বার রান্নাঘরে যেতো। আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। আমি এসব স্বাভাবিক ভাবেই নিতাম। আমি মা হারা ছিলাম। আমার নয় বছর বয়সে একটা এক্সিডেন্টে আমার মা স্পট ডেথ আর বাবা তার এক পা হারিয়ে ফেলে। আমার বাবা আমাকে বড় করেছে। সেজন্য শ্বাশুড়ি কে বার বার মা বলে ডাকতাম। কিন্তু ওনি সহজে সারা দিতো না।পাঁচ ছয়বার ডাকার পর সারা দিতো। কপাল কুঁচকে তাকাতো। এমন মুখভঙ্গি করতো যেন আমার ডাকে ওনি বিরক্ত। 


আমি বাড়ি গেলে ওনি এখানে সেখানে যাওয়া কমিয়ে দিতো। সারাক্ষণ ঘরেই থাকতো। আমি ভাবতাম হয়তো অনেকদিন পর পর বাড়ি যাই বলে আমাকে সঙ্গ দেয়। কিন্তু আমার ভুল ভাঙ্গে শ্বাশুড়ি আর ননদের ফোনালাপ শুনে। শ্বাশুড়ি মা ননদকে বলছে, "


--- তোর ছোট ভাবি বাড়ি আসলে আমার ভয় হয়। যদি এটা সেটা সরিয়ে নেয়?সেজন্য আমি বাড়ি থেকে বের হই না।" 


ফোনের ওপাশ থেকে ননদ কি বলেছে জানি না কিন্তু আমার আর কিছু শুনার সাহস ছিলো না। তখন বুঝেছি কেন ওনি আমাকে বিয়ের একমাস পরে আশরাফের কাছে পাঠিয়েছেন।ওনি নিজের মেয়েকে এক নজরে দেখতেন আর ছেলের বউকে অন্য নজরে।ওনার এই বৈষম্যপূর্ণ আচরণ খুব পীড়া দিতো। কি হয় একটু ছেলের বউকে মেয়ের নজরে দেখলে?


আমার বড় মেয়েটা যখন পেটে আসে তখন এতোটাই অসুস্থ ছিলাম যে প্রতি সপ্তাহে একটা স্যালাইন দেওয়া লাগতো। কোনো খাবার খেতে পারবো থাক দূরের কথা গন্ধই সহ্য করতে পারতাম না। আশরাফ আমাকে গ্রামে পাঠাতে চেয়েছিলো।কিন্তু শ্বাশুড়ি মা একেবারে নিষেধ করে দেয়। সে কোনো পোয়াতি মেয়ের সেবা করতে পারবে না। অথচ আমার ননদের দুটো বাচ্চা এখানেই হয়েছে। আশরাফ সারাদিন অফিস করে এসে আবার রাতে নিজের রান্না করতো।আমার সেবা করতো।ওর ক্লান্ত মুখের দিকে তাকালে খুব কষ্ট হতো। আমি যখন নিরবে কান্না করতাম তখন আশরাফ আমার চোখের পানি মুছে কপালে চুমু দিয়ে বলতো,


--- "কেউ থাকুক আর না থাকুক আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।" 


এটা শুনলেই নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হতো। আমার প্রেগ্ন্যাসি জার্নিতে স্বামী ব্যতীত কাউকে পাশে পাইনি। হয়তো মা থাকলে আমার সেবা করতো।আর বাবা তো অসুস্থই। যখন লেবার পেইন হয় তখনও হাসপাতালে আমি কল করি।সিজারের সময়ও ওনারা কেউ আসেনি। 


একজন নতুন মা হিসেবে মেয়ের সব কাজ করা আমার জন্য খুব কষ্টকর ছিলো।তার ওপর আবার সিজার।খুব প্রেশার পড়তো।আশরাফ অফিস থেকে এসে আবার মেয়েকে সামলাতো। 


দেশে করোনা আসলো আশরাফের চাকরী চলে গেলো। চলে এলাম গ্রামে। শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে একঘরে থাকতাম।একসাথে খাবার খেতাম। আশ্চর্যজনক ব্যপার হলো রান্নার সময় আমার শ্বাশুড়ি মাছ থেকে শুরু করে মাংসের টুকরো গুনে গুনে দিতেন। যদি রান্নার করতে করতে খেয়ে ফেলি তাই। এসব দেখলে শুধু কান্না পেতো। মেয়েদের জীবনটা এমন কেন? আশরাফ আর শ্বশুর কিছুই বলতো না। কারন ওনার কথার বাইরে কেউ কথা বললে চিল্লাচিল্লি করে বাড়ি মাথায় তুলতো। ওনার ব্যবহারে সবাই অতিষ্ঠ ছিলো। কয়েকমাস যাওয়ার পর দেশের অবস্থা শিথিল হলো।বাবা কিছু টাকা দিলো আশরাফকে দেশের বাহিরে যাওয়ার জন্য।কাগজপত্র রেডি সেই মুহূর্তে জানতে পারলাম আমি আবারও প্রেগন্যান্ট। একমাসের মাথায় আশরাফ চলে গেলো।


 এবারও আমার অবস্থা খারাপ। গতবার তো আশরাফ ছিলো কিন্তু এইবার পুরাই একা হয়ে গেছি। বমি করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে যেতাম আবার আমিই সেই বমি পরিষ্কার করতাম। শ্বাশুড়ি মা নাক সিটকাতেন। ভেবেছিলাম বিয়ের পর মা পাবো কিন্তু আমি তা পাইনি। ওনার কথার অবাধ্য কখনো হইনি তবুও ওনার মন পাইনি। ওনার ধ্যানজ্ঞান সব মেয়ে ছিলো। 


ডেলিভারির চারদিনের মাথায় ওনি আমাদের আলাদা করে দিলেন। আমাদের নাকি রান্না করে খাওয়াতে পারবেন না। তখন আমার শরীর পুরোপুরি দূর্বল উঠে বসতেও পারতাম না। তার ওপর দুইটা বাচ্চা। আমার মাও নেই। অথচ আমার ননদ যদি বলতো আমি মাছ দিয়ে ভাত খাবো ওনি তৎক্ষনাৎ অন্য তরকারি রান্না করে দিতো। রান্না মজা না বলে রাগারাগি করতো।সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনো কান্না পায়। ঠিকমতো যত্ন আর পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে আমার ছেলেটা অসুস্থ হয়ে জন্ম নিলো। দুইদিন পর পর ডাক্তারের কাছে দৌড়াতাম। বিনিময়ে শুনতে হতো আমি নাকি বিদেশি টাকা নিয়ে দৌড়াই শপিং করার জন্য। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করি করতাম কারণ আমার পক্ষে কথা বলার কেউ নাই। আশরাফ কে বললে ও বলতো সহ্য করো আমি নিরুপায়। 


আমার এখনো মনে আছে একবার আমি আর আমার দুই সন্তান ঘরে জ্বরে কাতরেছি। কেউ একটু উঁকিও দেয় নাই। সারাদিন রান্না হয় নাই কেউ এসে জিজ্ঞেস করে নাই কি খাইছি। পরে আশরাফ তার এক বন্ধুকে বলে তার ওয়াইফকে আমার এখানে পাঠায়। আমি না হয় পরের মেয়ে কিন্তু ছেলেমেয়ে দুটো তো ওনার বংশধর। ওদের একটু খবর নিলে খুব ক্ষতি হতো?   


গাছের ফলমূলের সিংহভাগই ওনার মেয়ের ঘরের নাতিকে দিতো।আমার মেয়ের একটা কি দুইটা দিয়ে বলতো আর নাই। তাহলে গাছে যে এতো ফল আসতো সেগুলো কই? মেয়ে বউয়ের মাঝে বৈষম্য মেনে নেওয়া যায় তাই বলে নাতিনাতনিদের মাঝেও? সবই তো ওনার র'ক্ত। ওনার উষ্কানিতে দুই দিন পর পর আমার ননদ ঝগড়া করে এবাড়িতে চলে আসে। ওনার এই ব্যবহার গুলো আমার ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। এখন বুঝি আমার বড় জা কেন একেবারে এখান থেকে চলে গেছে আর কেন আসে না।ওনার বৈষম্যপূর্ন ব্যবহার যে কারোরই মন ভেঙে যাবে। দিনশেষে সব দোষ হয় বউদের। বউরা নাকি শ্বশুর শ্বাশুড়ির সেবা করে না। এমন ব্যবহার করেও বউয়ের কাছে সেবা আশা করা যায়? শ্বাশুড়ি তো আমাকে মেয়ে মনে করলো না। আমি তো ভরা পরিবার চেয়েছিলাম। একজন মা চেয়েছিলাম। পেলাম না তো। ওনি মাঝে মাঝে আকারে ইঙ্গিতে খুব খুব বাজে বাজে কথা বলে। বুঝেও না বুঝার ভান করি। কারণ আমি মানিয়ে নিয়েছি। আমি জানি ওনি যতোদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এমন করবেন। 


------সমাপ্ত------


গল্প : বৈষম্য

রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)


এমন আরও অনেক গল্প পড়ুন আমাদের ওয়েব সাইটে।