না পাওয়া ভালোবাসার কষ্টের গল্প
ঢাকা শহরে জন্ম হলেও আমি একটা গ্রামের সহজ সরল ছেলের প্রেমে পড়েছিলাম। একদম অন্ধ প্রেমের মতো সেই মায়া, ছেলেটার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে ফেসবুকে।
বেশ ভালো ছোটগল্প লিখতে পারতো জাবেদ নামের সেই ছেলেটা। গল্প ভালো লাগা থেকে একদিন তার ইনবক্সে মেসেজ করা, আর তারপর আস্তে আস্তে কথা বলে মায়ায় জড়িয়ে যাওয়া।
একটা সময় আমি অবাক হলাম, বাস্তবের দিকে চেয়ে আমি বিষয়টা নিয়ে খুব ভাবতে লাগলাম। জাবেদ ছিল গ্রামের ছেলে, পড়াশোনার গন্ডি শেষ হবার আগেই সে কর্মজীবন শুরু করে।
ছোটবেলায় ওর বাবা মারা গেছে, ওর মাকে নিয়ে বহু কষ্টে ওর জীবন। অথচ আমার বাবা একজন ব্যবসায়ী, ভালোবাসা ধনী গরীব দেখে হয়না ঠিকই কিন্তু বিয়েটা ধনী গরীব দেখে হয়।
আমার মা-বাবা এরকম সম্পর্ক কোনদিনই মেনে নেবে না সেই ধারণা আমার শতভাগ ছিল। তাকে ভালোবাসি এই কথাটা কোনদিন বলা হয়নি, তবে তার আচরণে আমার মনে হতো সে আমাকে ভালোবাসে। আমার আচরণ দেখে সে কি ভেবেছে আমি জানি না।
ক্লাস নাইনে উঠে জাবেদ ওর গ্রামের এক ইলেকট্রিক মিস্ত্রির সঙ্গে বৈদ্যুতিক অনেক কাজ শিখেছে। তারপর থেকে আস্তে আস্তে এটাই নিজের মূল পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। গ্রামের স্থানীয় বাজারে ওর নিজের নামে একটা দোকানও করেছে বছর তিনেক পরে। সবকিছুই জাবেদের কাছে শুনেছি, কারণ এসব তার জীবনের অনেক আগের কথা। সেই ১৫ বছর বয়স থেকে শুরু করে আজ তার বয়স ২৬ বছর।
ওর পছন্দের কোনো মানুষ ছিল না, তবে ও আমাকে সবসময় নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে নদীর তীরে হাঁটার স্বপ্ন বলতো।
আমি ভাবলাম এবার একটা কিছু করতে হবে, এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় আর পিছনে ফিরে আসতে পারবো না। মা-বাবার মনে আঘাত করে কোনকিছু করাও আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই যোগাযোগ বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমাদের সিনিয়র বড়আপুর সঙ্গে সবটা খুলে বললাম। তিনি সবকিছু শুনে বললেন,
- রিলেশন তো হয়নি তাই না অবন্তী?
- না আপু, এমনিতেই অনেকদিন ধরে কথা হয়।
- তাহলে তুমি তাকে বলো যে তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তাই তুমি আর ফেসবুকে আসবে না।
তারপর মাস খানিকের জন্য নতুন একটা আইডি ব্যবহার করো। পারবে না?
- জ্বি আপু পারবো।
এর পরদিন কথা বলার সময় আমি তাকে বলি যে, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। হয়তো ব্যস্ততার জন্য ফেসবুকে আসা হবে না। তোমার গল্পগুলো খুব মিস করবো, তবে যখন আসবো তখন সবটা একসঙ্গে পড়ে ফেলবো।
- জাবেদ বললো, হঠাৎ করে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল নাকি আগে থেকে ঠিক করা ছিল?
- হঠাৎ করেই হয়ে গেল।
- ঠিক আছে নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা।
- ভালো থেকো সবসময়।
আমি সেদিনই আমার আইডি বন্ধ করে দিলাম। আপুর কথা অনুযায়ী নতুন আইডি আর ব্যবহার করতে ইচ্ছে করলো না। ফেসবুক ব্যবহার না করে থাকার অভ্যাস আছে তাই বেশি সমস্যা হবে না।
জাবেদের কাছে আমার নাম্বার ছিল, তার নাম্বারও ছিল আমার কাছে। অনেকদিন পেরিয়ে গেলেও সে আমাকে কোনদিন ও কল করলো না। আমার ধারণা ছিল সে অন্তত কল দিয়ে টুকটাক খোঁজ খবর নিতে চাইবে।
একুশ দিন পর জাবেদ কল দিল।
- কেমন আছো অবন্তী?
- আলহামদুলিল্লাহ, আপনি কেমন আছেন?
- ভালো, কিন্তু হঠাৎ করে আপনি বলছো কেন?
- না মানে, অনেকদিন কথা হয় না তাই।
- তাই অনেকটা পর পর মনে হয় তাই তো?
- না তেমন কিছু না।
- তোমার শশুর শাশুড়ী কেমন আছে, স্বামীর কি অবস্থা?
- সবাই ভালো আছে। আচ্ছা আজকে হঠাৎ করে এতদিন পরে কি ভেবে মনে পড়লো?
- তোমাকে কল দিতে কারণ লাগবে?
- যেহেতু আমার বিয়ে হয়ে গেছে তাই কারণ তো লাগবেই।
- তোমার কোনো স্মৃতি নেই, তাই ভাবলাম তোমার কাছ থেকে একটা বই উপহার হিসেবে নেবো।
- মানে?
- " স্মৃতিগন্ধা " নামের একটা উপন্যাস আছে, আমি সেই উপন্যাসটা তোমার কাছ থেকে চাই।
- ঠিক আছে পেয়ে যাবে। এতদিন ধরে কখনো কল দাওনি কেন বললে না তো!
- সত্যি বলবো?
- হ্যাঁ সত্যি বলো।
- আমার সঙ্গে মিথ্যা বিয়ের নাটকটা করার জন্য বেশ মন খারাপ করেছিলাম। তুমি আমাকে সত্যি বলতে পারতে আমি যোগাযোগ বন্ধ করতাম। কিন্তু একটা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কেন এমন করে বিয়ের কথা বললে?
- তোমার সঙ্গে মিথ্যা বলবো কেন?
- আমিও সেই কথা চিন্তা করছি, আমার সঙ্গে কেন মিথ্যা কথা বলতে হবে।
- তোমার কাছে কেন মনে হচ্ছে আমি তোমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছি।
- তুমি কি ভুলে গেছ তোমার আরেকটা বান্ধবী আমার গল্প পড়তো। তার সঙ্গেও আমার মাঝে মাঝে কথা হতো, তুমিও সেটা জানতে। একদিন আমি তাকে হঠাৎ করে তোমার বিয়ের কথা বলাতে সে আকাশ থেকে পড়ে। তারপর তার কাছে জানতে পারি তুমি মিথ্যা বলছো। আমি অবশ্য তাকে বলেছিলাম তোমার কাছে যেন না বলে যে আমি সত্যিটা জেনে গেছি।
- ওহ্।
- তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল, তাকে কিছু বলবে না। সে কিছুই জানতো না তাই তাকে বলার দরকার নেই, আমি ভুলে গেছি।
মনে মনে বান্ধবীর প্রতি ঠিকই রাগ উঠেছিল, আর জাবেদ তাকে সাপাই গাইছে দেখে রাগটা আরও বেড়ে গেল। আমি বললাম,
- তাহলে ওর সঙ্গে কথা বললেই তো পারতেন, আবার আমাকে কল করেছেন কেন?
- আশ্চর্য তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?
- রাগবো না? আর উপন্যাস লাগবে তো তার কাছে চাইতে পারেন না? আমাকে কল দিয়ে কেন বলছেন?
- সরি অবন্তী, বইয়ের কথা এমনিতেই বললাম। আসলে কদিন ধরে তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। তোমার মিথ্যা বলার রাগটা এখন কমে গেছে তাই কল দিলাম।
- এটাই যেন শেষ হয়, আর কোনদিন আমার কাছে কল দিবেন না।
- ঠিক আছে তাই হবে।
আমি কল কেটে দিলাম। এমন ব্যবহার করা ছাড়া উপায় ছিল না, নাহলে আবার কথা বাড়বে। যে মায়া আমি কাটিয়ে উঠতে চাই সেটা আবার মনের মধ্যে নতুন করে প্রবেশ করতে দেবো না।
কিছুক্ষণ পর একটা মেসেজ দিল জাবেদ।
" মনের অজান্তেই তোমাকে ভালোবেসে ভুল করে ফেলেছিলাম। তাই সেদিন যখন বুঝতে পারছি তুমি আমার থেকে মিথ্যে বলে মুক্তি চাও। তোমার চাওয়া অনুযায়ী মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার বারবার মনে হতো আমার মতো তুমিও হয়তো আমাকে মিস করো। আমি ভুল ছিলাম অবন্তী, পারলে ক্ষমা করে দিও। প্রতিদিন মানুষ কতো ভুল ই তো করে, কিন্তু সবগুলো ভুলের তো অর্থ থাকে না। যেটা ভুল সেটা তো ভুলই। "
★★
সপ্তাহ খানিক পরে একটা পেইজে " স্মৃতিগন্ধা " বইটা দেখে জাবেদের কথা মনে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে বইটা অর্ডার করে দিলাম। দুদিন পরে যখন বইটা আমার হাতে পেলাম তখন তার জন্য ছোট্ট একটা চিরকুট লিখলাম।
জাবেদের বাসা কুষ্টিয়া জেলার মধ্যে কোনো এক গ্রামের মধ্যে। সঠিক ঠিকানা জানি না তাই নাম্বার বের করে কল দিলাম। কল রিসিভ হবার পরে বুঝতে পারলাম কণ্ঠটা জাবেদের নয়।
- বললাম, এটা জাবেদের মোবাইল না?
- জ্বি, আমি তার মামাতো ভাই। জাবেদ ভাই মারা যাবার পরে আমিই দোকানে বসেছি আজকে।
আমি অস্ফুটে বললাম,
- জাবেদের কি হয়েছে?
- পাঁচদিন আগে পাশের গ্রামে একটা বাড়িতে কারেন্টের কাজ করতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করেছে। আসলে মেইন লাইন থেকে সরাসরি শকট্ করেছে তাদের ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। ভাইয়ার ফোনটা আমার কাছেই আছে, আমিও একই কাজ করি।
এরপর আর কিছু শোনার মতো ধৈর্য আমার ছিল না, না চাইতেই মোবাইলটা নামিয়ে রাখলাম। আমার সামনে তখন চিরকুট দিয়ে সজ্জিত তার চাওয়া উপন্যাস স্মৃতি হয়ে, " স্মৃতিগন্ধা "।
----- সমাপ্ত -----