বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প
বয়স টা তখন খুব বেশি নয়। সবে মাত্র ১২।
আবদার করেছিলাম, আমার ভাই চাই। চাই তো চাই।
আবদার পূর্ণ করতে গিয়ে জীবন থেকে হারিয়ে গেছে মা নামক মানুষ টা।
আজ ও মনে পড়ে শীতের সকালে মায়ের নীথর শরীর টা যখন বারান্দায় ছিলো, মুখ টা নীল হয়ে গিয়েছিলো,তখন আমার কোলে আসে আমার ভাই।
ছোট্ট ছোট্ট হাত পা, চোখ দুটো।
লাল তোয়ালে প্যাচানো ছিলো।
মা সব সময় বলতো আমি কি? মরে গেলে বুঝবি।
সেদিন ও মায়ের কমতি বুঝিনি।
বাড়ি ভর্তি কত মানুষ ছিলো।
এক সময় কাফন পড়িয়ে কালেমা শাহাদাত বলতে বলতে নিয়ে গেলো।
তখন বুঝলাম মা আর আসবে না। খালি পায়ে দৌড়ে কবরস্থান অবধি গিয়েছিলাম।
মেয়ে মানুষ তো তাই আর ভিতরে যেতে দিলো না। খুব ইচ্ছে করছিলো মা কে আরেকটা বার দেখবো.. । ।।
.
.
বাবা মা কে খুব ভালোবাসতো। প্রেমের বিয়ে ছিলো তাদের।
বাবা এক সময় পুরোপুরি ভেংগে পড়ে। সবাই স্বান্তনা দিচ্ছিলো।সেদিন মনে করেছিলাম বাবা হয়তো কাছে টেনে নিবে, কিন্তু তার শোক হয়তো আমাদের থেকেও বেশি ছিলো।
.
,
ছোট্টুনি একটা বাবু। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখছে সব।
কিছুক্ষণ পর সে কি কান্না? কোন কিছুতেই যেনো থামে না। পরে মনে হলো হয়তো ক্ষুধা লেগেছে।
ফুপু ছিলো উনি ভাই কে কিছু খাওয়ালেন।
হয়তো চিনির পানি।
চিনির পানি খেলে কি পুষ্টি হবে??
তিন দিন পর ধীরে ধীরে সবাই চলে যায়।
চাচা-চাচী, দাদী আর আমরা দুই ভাই বোন।
রাতের বেলা দাদী আমাদের সাথে থাকতো। চাচীর তখন ৭ মাস।
ভাই রাতে খুব কান্না করতো, দাদী প্রথম প্রথম সাথে থাকলেও পরে আর থাকতো না।
বয়স্ক মানুষ হয়তো ঘুমানো বেশি দরকার ছিলো।
বাবা খুব একটা আর আমাদের খেয়াল নেয় না।
প্রয়োজন ছাড়া কেউ কথাও বলে না।
দেখতে দেখতে ২১ দিন হয়ে এলো। পাশের বাড়ির নিমু ফুফু বললো ভাই রে না কি টিকা দিতে হবে।
সেইদিন ভাই রে তিন টা টিকা দিলো। রাতে খুব জ্বর ছিলো, দাদীও ছিলো না, পুরো শীতের রাত ভাই কে কোলে নিয়ে হাটতে হয়েছিলো।
ভাইয়ের বয়স যে দিন ৩৫ দিন সেদিন স্কুলে রেজাল্ট দিলো। জানতে যাই নি। পরে টুকি এসে বললো প্রথম হয়েছি। বরাবর ছাত্রী ভালোই ছিলাম।
স্পষ্টভাবে মনে আছে,
যেদিন বই আনতে যাই কাকি কে বলে গেছিলাম ভাই কে দেখতে।
নিশ্চিত ছিলাম যে তারা তো দেখবেই কিন্তু ভয় ভয় লাগছিলো।
বাড়ি থেকে অনেক টা দূরে কান্নার শব্দ আসছিলো। দৌড়ে গিয়ে দেখি ভাই খুব কাদছে কাকি কোলে নেয় নি কারণ সে পায়খানা করেছিলো বলে।
.
মা মারা যাওয়ার পর ভাইকে পেয়ে দায়িত্ব হয়তো বেড়েছিলো কিন্তু সেদিন সত্যি সত্যি বড় হয়ে গেলাম।
.
.
কয়েক দিন যাবত দাদী কে বলতে শুনতেছি
বউ মরবো মাসের মাস পোলা বিয়া করামু চান্দের চান।
তুই বেডা মানুষ না?
তোর ভবিষ্যৎ বলতে কিছু নাই? যা কই তাই কর। তোর খারাপ তো চাই না?
.
বুঝলাম দাদীর বোনের মেয়ে নীলু আন্টির সাথে বাবার বিয়ে।
বাড়িতে উৎসবের আমেজ পড়ে গেলো। শুধু ঘরকুনো হয়ে রইলাম আমরা অভাগী দুই ভাই-বোন।
.
.
-স্ত্রী_
-পর্ব....(০২)
.
.
দুই মাস হলো আমার ভাইয়ের।
ঠিক দুই মাস আগে এই দিনে আমাদের মা চলে গেছে।
সেই যে তিন দিনের দিন কবর দেখেছিলাম আর যাওয়া হয়নি।
শীত কিছুটা কমেছে। তাইতো ভাইকে বুকে নিয়ে শাল জড়িয়ে মায়ের কবর টা দেখতে চলে গেছিলাম।
মানুষ তো মারা যাওয়ার পর সব দেখতে পায়! আচ্ছা আম্মো? তুমি কি আমাদের দেখতে পাও?
আম্মো দেখো না, আমার হাত টা না? পুড়ে গেছে।
জানো আম্মো, এখন না আর কেউ আমাকে খাওয়ায় ক্যান ঠিক মতো খেতেই দেয় না৷
তুমি তো জানো আমি মাছ খেতে পারি না। আম্মো তুমি ক্যান চইলা গেলা? দেখো আম্মো ভাই আজ দু মাসের। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি ওর খেয়াল রাখবো। আমি ওকে একটুও কষ্ট দেই না, ও কিন্তু খুব ভালো। তুমি জিজ্ঞেস করো ওকে যে আমি ওকে কষ্ট দেই কি না?
আম্মো, একবার আসো না। একবার কথা বলো। আমার না ভালো লাগতেছে না।
জানো? আজ না বাবার বিয়ে।
নীলু আন্টির সাথে।
.
মায়ের কবরের পাশে অনেক ক্ষণ বসে ছিলাম।
যখন ফিরে এলাম বাবা রেডি হচ্ছিলো নতুন মা আনতে যাবে বলে।
আমি জানি নীলু আন্টি খুব ভালো। সে আমাদের খুব আদর করবে। আর আমার ভাই কেও।
ভাই তো সব সময় মায়ের কোল খুজে, সে এখন মায়ের কোল পাবে।
.
সারাদিন খুব আশায় আশায় ছিলাম। বাবা কখন আসবে।
বাবা ফিরে এলো কিন্তু আমাদের সাথে কথাও বললো না।
নীলু আন্টিও আমাদের কে সন্তান বলে কাছে টেনে নিলো না।
মায়ের পুরো ঘর ফুলে ফুলে সেজে আছে। এত দিন আমরা দুই ভাইবোন থাকতাম কিন্তু আজ বড়ফুপ্পি আমাদের সব ঘর থেকে বের করে দাদীর পাশের ঘরে দিয়ে দিয়েছে।
আচ্ছা? সৎ মা কি আগলে নিতে পারে না?
সব কাজ দেখে তো বুঝেছিলাম আমরা বড্ড বোঝা এই বাড়িতে।
নীলু আন্টি বাড়িতে এসেছে বাবার স্ত্রী হয়ে।
মা মারা যাবার পর বাবা আমাদের খেয়াল রাখতো কিন্তু খুব একটা না। তবুও রাখতো কিন্তু ইদানিং বাবার মধ্যে অনেক পরিবর্তন ।
ভাই দিন দিন বড় হচ্ছিলো। চাহিদাও বাড়ছিলো।
ধীরে ধীরে আমিও বড় হতেছিলাম।
শারীরিক পরিবর্তন গুলো ছিলো স্পষ্টত।
.
তখন ভাই আর আমি দাদীর পাশে রুমেই থাকি। রাতে হঠাৎ করে পেট ব্যথা শুরু হয়। মনে হচ্ছে তল পেট টা ছিড়ে যাচ্ছে।
ভাই কে বিছানায় রেখেই টয়লেটে গেলাম মনে করেছিলাম হয়তো পেট খারাপ হয়েছে কিন্তু তা নয়।
ফিরে এসে পেটে চাপ দিয়ে শুয়ে ছিলাম কখন ঘুমিয়েছি জানিনা।
সকালবেলা দেখি বিছানার চাদর, নিজের কাপড়ে রক্ত।
খুব ভয় পেয়েছিলাম। মা যখন মারা যায় তখন চাদরে, মায়ের কাপড়ে রক্ত লেগেছিলো।
আমিও মরে যাবো? ভাইয়ের কি হবে?
পেট মনে হচ্ছে ছিড়ে যাচ্ছে। ভাই ঘুমিয়ে আছে। ফ্লোরে বসে চুপচাপ আছি ঠিক সেসময় নীলু আন্টি মানে বাবার স্ত্রী ঘরে আসে।
কিছু বলতে না দিয়েই বলে
- শুনো অরী তোমার মায়ের তুমি খুব আদরের ছিলা, আমারো তুমি খুব আদরের তাই বলে তো আর মেয়ে মানুষ এভাবে ঘরে বসে বসে খাওয়ালে চলবে না। তোমার নানীর বাড়িও তোমাদের জায়গা হবে না।আর দুজন মানুষের খরচ ও কম না। তাই কাজের লোক ছাড়িয়ে দিয়েছি। হাতে হাতে কাজ করলে তুমিও সংসারী হয়ে উঠবে।
.
তার সাথে দাদীও সায় দিলো।
আমার মা কখনো দাদীর কাছে ভালো ছিলো না। কারণ প্রেমের বিয়ে ছিলো যে।
নানীর বাড়ি কি আমি জানিই না। নিজের খাওয়া চললেও ভাইয়ের জন্য বাসার সব কাজ করতে হবে।
.
বিকেলবেলা টুকি এসেছিলো ওর মা কে নিয়ে।
কাকীমা কে টুকি সব বলছে কারণ আমি বলেছিলাম আমি মরে গেলে আমার ভাইকে যেনো একটু দেখে। ওতো অনেক ছোট। কিছু খেতে পারে না। না হলে অনাথালয়ে দিয়ে দিতে।
টুকির মা এসে বলে গেলো এখন থেকে প্রতী মাসেই এমন হবে।
খুব ব্যথা করলে গরম পানির ছ্যাক নিতে।
বুঝলাম ধীরে ধীরে সত্যি বড় হচ্ছি।
বয়সের সাথে বাড়ছিলো ধৈর্য্য শক্তি। কিন্তু অপর দিকে আমাদের প্রতি বাবার খেয়াল, দেখাশুনা যেনো দ্বিগুণ ভাব্র কম ছিলো দিন দিন।
.
ভাইয়ের দুধ শেষ হওয়ার দুই দিন আগে থেকেই বলি যে আনতে হবে। এবারো বলেছি, বাবা বলে এনে দিবে কিন্তু আর দেয় না। যাই হোক, সেদিন দুধ ছিলো না, বাবার স্ত্রী কে বলছিলাম ভাইয়ের দুধ আনতে হবে।
সাফ সাফ বলে দিলো আজকে আনতে পারবে না। আর থুতনী ধরে চাপ দিয়ে বলে কয় ডিব্বা লাগে? টাকা কি গাছে ধরে? ৪০০ টাকা ডিব্বা। দুই এক বেলা না খাইলে মরবো না। আর মরলেও আমার হাড় মাংস জুড়ায়। খানকি মইরা গেছে নষ্টামি করার জন্য আরেক খানকি জন্ম দিয়া গেছে।
.
চিল্লাচিল্লি শুইনা দাদী আসে। বাপরে কইবার পারোস না মুখপুরী? মায়ে খালি খাওয়াইছেই। দামড়া ছেরি গায়ে গতরে খাইটা খা।
তোর বাপেরে আইজকা আবার দে। বাড়িত এত অশান্তি আর কুলায় না।
.
.
খুব কষ্ট লাগলো। আমারে বলে বলুক আমার মরা মায়েরে ক্যান বলে? ভাই টা ঘুমাইছে। উঠলেই খাইতে চাইবো।
কি খাইতে দিমু? ও তো বাচ্চা একটা ছেলে, এত কিছু তো বুঝেও না।
ও আল্লাহ,আল্লাহ্ গো কিছু তো একটা করো।
হয়তো এতিম দের কান্না উঁচু সমাজ অবধি যায় না।
রান্না করার সময় খেয়াল করলাম ভাতের ফেন প্রতিদিন ফালাইয়া দেই, আজ আর দিলাম না।
ভাই ঘুম থেকে উঠলে একটু ভাতের ফেন খাওয়াইলাম, প্রথমে মুখে দিতে চাইলো না, পরে কি বুঝে জানি খাইলো।
.
মায়ের কবরের সামনে বসে আছি। কবর দিয়ে ঘাস জ্বালিয়ে গেছে।
আচ্ছা? ভাইকে নিয়ে যদি আমি মরে যাই তবে কি ঝামেলা শেষ হবে?
.
.
-স্ত্রী_
-পর্ব....(৩+৪)
.
.
মায়ের কবরের পাশে বসে থাকতে থাকতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে বুঝিনি। বৃষ্টির সাঝ করছিলো। ভাইকে নিয়ে বাসায় ফিরবো তখন রূপম কাকার সাথে দেখা হয়।
জিজ্ঞেস করে কোথায় গিয়েছিলাম, কি হয়েছে?
অজান্তেই সব বলি।
পাশের দোকান থেকে সে ২০ টাকার এক প্যাকেট গুড়া দুধ কিনে দেয় বলে বাড়ি গিয়ে ভাইকে খাওয়াতে। আর রাত ১১ টায় আমাদের বাড়ির পিছনে আসতে। সে ভাইয়ের জন্য দুধ নিয়ে আসবে।
- কিন্তু কাকা? এত রাতে? আপনি আইসাদিয়ে যান।
- তোর সৎ মা দেখলে তোরে বকবো, তুই আসিস তাই হবো।
.
ভাই কে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়িয়ে দেই । অপেক্ষা করছিলাম যে কখন ১১ টা বাজবে। আর আমার ভাইয়ের না খেয়ে থাকতে হবে না।
.
.
বাড়ির পিছন থেকে দৌড়ে ঘরে এসেছিলাম। ঘেন্না করছিলো নিজেকে।
বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছিলো। সেদিন রাতে বুঝেছিলাম শুধু ভাইকে বাচিয়ে রাখা না, এই সমাজের নরপিশাচরদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
.
সে রাতে রূপম কাকার নষ্টামির হাত থেকে কোন রকমে বেঁচে ফিরা অরী যেনো পরদিন সকাল থেকে এক নতুন করে পথ চলতে শুরু করে।
যার অস্তিত্ব নিজেকেই ধরে রাখতে হয়।
.
বাবার সামনে গতকালের কাহিনী পেয়াজ,কাচামরিচ, মসলা দিয়ে পরিবেশন করে।
সেদিকে কোন খেয়াল নেই।
ভাইকে খাইয়ে নিজে না খেয়েই চলে গেলো স্কুলে। আজ জেএসসি পরীক্ষার প্রবেশ পত্র দিবে।
.
.
আচ্ছা? আমি যতদূর জানি, মা-বাবার প্রেমের বিয়ে ছিলো। দাদী কখনো মা কে মেনে নেয় নি কিন্তু দাদা মা কে খুব আদর করতো। হয়তো দাদার কারণেই মা এত দিন এ বাড়িতে টিকেছিলো।
বছর দেড়েক আগে দাদা মারা গেলো। সেদিন মা খুব কেদেছিলো। বিয়ের আগে সেই যে মা বাবার হাত ধরে নানু বাসা থেকে বেড়িয়ে এসেছিলো আর কোন দিন সে বাড়িতে মায়ের জায়গা হলো না।
দাদী সব সময় চাইতো নীলু আন্টির সাথে বাবার বিয়ে হোক। কিন্তু হয়নি।
নীলু আন্টিও না কি বাবাকে পছন্দ করতো। সে না কি ২য় বউ হয়েই থাকতে চেয়েছিলো। মাঝে মধ্যে দেখতাম মা-বাবার মধ্যে.......
আচ্ছা মা কি সত্যি ভাইকে জন্ম দিতে গিয়েই মারা গেছে?
.
মাসের শুরুর একদিন আমাদের বাবার স্ত্রীর আমাদের জন্য ভালোবাসা আসে।
সেদিন সে আমাদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করে।
আজ সেই দিন। মনে হয় সে যেনো আমাদের কে চোখে হারায়।
কারণ সেদিন মায়ের কলিগ রাফসান স্যার,মরিয়ম ম্যাম আসে। মা ছিলেন সরকারি হাইস্কুলের ইংলিশ টিচার। সাধারণ মানুষকে বাবার নামে চিনে সবাই কিন্তু আমাদের সবাই চিনতো মায়ের নামে। মায়ের কলিগরা আমাদের খোঁজ খবর নিতে আসে
হয়তো তাদের জন্যই আমার লেখাপড়া টা এখনো হচ্ছে না হলে.........
.
.
যথারীতি এক্সাম শুরু হয়। কেন্দ্রে সবাই সবার বাবা মায়ের সাথে যায়। সবাইকে মায়েরা কত আদর করে দোয়া পড়ে কপালে চুমু দিয়ে দেয়। পরীক্ষা শেষ হলে মায়েরা কত আগ্রহ নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে এক্সাম কেমন হইছে, ক্ষুধা লেগেছে কি না? ফাইল টা হাতে নেয়। ঈশ! কত ভাগ্যবান ওরা।
কিন্তু আমার কেউ নেই। বাবাও এলো না। মায়ের কবর টা ইদানীং বড্ড ডাকে। মা! আম্মো! একবার আসো না। দেখো আমি এক্সাম দিতে যাইতেছি। প্রবেশ পত্র নিছি কি না তুমি ক্যান জিজ্ঞেস করো না?
কই টুকির মায়ের মতো আমাকে আর চুল বেধে দেও না।
জানো মা! আমার না রাত জেগে পড়তে খুব খারাপ লাগে। আমি না একটু ঘুমাতে পারি না। আর জানো মা? আমি না সব রান্না শিখে গেছি। হাত আর আগের মতো কাটে না,পুড়ে না।
মা! ভাইয়ের না পিচ্চি পিচ্চি দাত উঠছে। খালি কামড়াইতে আসে। বড্ড পাজি হইছে।
ভাইকে টুকির দাদীর কাছে রেখে এসেছি। মা এখন আমি যাই? ভাইকে নিয়ে আমি পরে আসবো।
.
টুকির দাদীর কাছে ভাই কে রেখেই যাই। সে খুব আদর করে আমাদের। ভাইও থাকে।
ভাই দূর থেকে আমাকে দেখে যেনো পাখির মতো উড়াল দিলো কোলে আসার জন্য।
মেধাবৃত্তি হিসেবে কিছু টাকা পেয়েছি।আজকে হেড স্যার দিলো।৩৬৮০ টাকা।
ভাইকে দোকান থেকে চিপ্স আর জুস কিনে দিয়েছি। আহারে ভাই! ভাইরে তোর বোন এসব খায় নি, কত ফালাইয়া দিছে! আর তুই? তুই তো এসব চিনিস না.....
.
.
২৪ ডিসেম্বর। মায়ের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। ভাইয়ের প্রথম জন্মদিন।
ভাইটাও হয়তো বুঝে গেছে নতুন মা হয়ে আসা মানুষ টা কখনো আমাদের মা হয়ে উঠবে না। সে শুধুই বাবার স্ত্রী।
দেখতে দেখতে এক বছর। এই দিন টাতে মা হারা হয়েছি। হয়েছি অনাথ।মা তুমি বলতে না? তুমি না থাকলে মানুষের অবহেলা সহ্য করতে হবে?
নিত্য নতুন কাপড়, খাওয়া, বায়না থাকবে না। সত্যি মা দেখো আমাদের ভাই বোনের কোন বায়না নেই।
কোরবানী ঈদের সময়
বাড়িতে অনেক মানুষ।মাংসের গন্ধ চারিদিকে। বাড়িতে মেহমান আসায় কাজ করছিলো অরী। ঈদের ছুটি সবাই এসেছে।
রান্না করতে দেখে বড়ফুপু বললো
- এই মেয়েরে মায়ে খাইয়ে না দিলে খায় নাই আর এখন!
এত শুকিয়েছিস কেনো? উঠ তুই আমি রান্না করছি। তুই হাত মুখ ধুয়ে আয় সবাই মিলে খাবো।
.
কোথায় থেকে যেনো দাদী এসে ফুপুকে না করে আর অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করে।
আমাদের ফুপু, কাকা কেউই দাদীর মুখের উপর কথা বলতো না।
তাই ফুপুও কিছু বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। দুচোখ ছলছল করে অনেক কিছুই বলছিলো। কারো কোন কথায় কান না দিয়ে কাজ করছিলাম। কাজ প্রায় শেষের দিকে। ঠিক সেসময় ভাইয়ের চিৎকার। শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখি ভাই গাল ধরে কান্না করতেছে আর আমাদের সো কল্ড মা, ওহ সরি আমাদের বাবার স্ত্রী সে আমার ভাইকে হাত ধরে টেনে হিচড়ে বের করতেছে।
ভয়ে আমার মোনা পাখি টা চুপসে গেছে। গাল টা লাল হয়ে গেছে।
.
- এই বয়সেই! হ্যাঁ! এই বয়সেই লুচ্চামি? আর তো দিন আছেই। আর তোরে না কইছি তুই ঘরে আসবি না?
.
বলতে বলতেই দিলো আরো এক থাপ্পড়।
ভাইকে কোলে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম।
দোষ বলতে ছিলো ছোট চাচার তিন মাস বয়সী মেয়ের গালে ধরেছিলো। আর ও ঘরে যেতো কেবল মাত্র একটু টিভি দেখতে।
.
সেদিন ভাইকে শান্তু করতে অনেক সময় লাগে। তবুও কাজ বাদ দিতে পারিনি। সব শেষে ভাইকে ঘুম পারিয়ে এসে দেখি খাওয়ার জন্য কিছু নেই।
কি করবো? খুব ক্ষুধা পেয়েছিলো। বালিশে মুখ চেপে কান্না করে জীবনে তৃতীয় বারের মত বুঝলাম আমরা অনাথ।
.
.
রাত দেড় টায় সেদিন বাবা ঘরে দরজা নেড়ে এসে বলে গিয়েছিল যদি এই বাড়িতে থাকতে চাই তাহলে যেনো ভালো হয়ে যাই।
সত্যি আজো বুঝলাম না কি খারাপ ছিলাম।
.
সকাল সকাল মায়ের কবর টা দেখে মা কেই এসব বলতাম। এই কয়েকদিন আসতে পারিনি কি না।
মায়ের কবর টা ভেংগে গেছে। তাহলে কি মা মাটির সাথে মিশে গেছো?
হুজুর কে বলে লোক দিয়ে কবরে মাটি দিয়েছি। বৃত্তির টাকা দিয়ে ভাইকে ঈদে কাপড় আর মায়ের জন্য ছোট্ট একটা মিলাদ এর ব্যবস্থা করিয়েছি টুকির বাবা কে দিয়ে।
.
.
আজ রেজাল্ট। জানি না কি হবে?
ভাই ঘুমিয়ে আছে।
কোলে নিয়েই যাবো স্কুলে। ইদানিং কোলে নিয়ে হাটতে সমস্যা হয়। তাই বলে কি ফেলে রাখা যায়?
ছোট্ট ছোট্ট পা। কতক্ষণ হাটবে?
.
.
এই মুখপুরী, এই। ঘুমের পোলাডারে তুলস ক্যালো?
- দাদী রেজাল্ট দিবো তো তাই স্কুলে যাবো।
- তুই যাস যা। ঘুমের পোলাডারে তুলে? ওই মারানী অন্য হানে যাইয়্যা মারাও।
- ওরে কে দেখবো? ঘুম থেকে উঠলে যে কাদবো?
- আমি আছিনা? দেহুমনি যা তুই।
দাদীর কথায় ভরসা কইরা রেখে গেছিলাম।
স্কুলে গিয়ে বড্ড একা লাগছিলো।
আমার বলতে কেউ নাই।
সবার বাবা মা আসছে।
কত টেনশন? আর আমি তো অনাথ।
টুকি আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে।
আচ্ছা? এই মেয়ের আমাকে ধরতে ঘেন্না করেনা?
আমি তো আর আগের মতো নেই।
কিন্তু তবুও যেনো ওরাই আমার শেষ সহায়।
.
রেজাল্ট দিলো। এ প্লাস পেয়েছি।
সবাই অবাক না হলেও আমি অবাক।
আমি তো পড়িইনি।
মরিয়ম ম্যাম এসে জড়িয়ে ধরেছিলো।
কেনো যেনো খুব আপন বলে মনে হচ্ছে। কান্না ধরে রাখতে না পেরে খুব কেদেছিলাম।
সেদিন পুরো তিন গ্রামের মানুষ হয়তো দেখেছিলো ইংলিশ ম্যামের মেয়ে অরীর কান্না।
হেড স্যার কে টুকি সব বলে দেয়।
তখন ছিলো আমার আরো এক দফা অবাক হওয়ার পালা।
.
মায়ের পেনশন বাবদ পনেরো লাখ টাকা আমাদের নামে।
যেহেতু ভাই ছিলো না তখন তাই আমার আর বাবার নামে। যেখানে পোষ্ট অফিস থেকে প্র তি মাসে ১৫ হাজার টাকা রাফসান স্যার মরিয়ম ম্যাম বাড়ি গিয়ে আমাদের দেখাশুনার জন্য দিয়ে আসে।
অথচ আমার ভাই? তার দুধের জন্য আমাকে..৷৷।
.
সব কিছু শোনার পর বাড়ি এসে দেখি আমার দাদী বাড়িতে নেই।
ভাই টা কে ঘরেও নেয়নি আমাদের সৎ মা। ভাই বাহিরে দাঁড়িয়ে শীতের মধ্যে গাছের পাতা খুটছে।
ভাইটা আমার হাটাও শিখে গেছে। গুটি গুটি পায়ে হাটছে সারা উঠোন।
কাছে যাওয়ার পর দেখি ভাইয়ের হাতে লাল লাল কিছু।
হাত দিতেই দেখি রক্ত...
.
.
-স্ত্রী
পর্ব(৫)
শেষ পর্ব
.
.
হায় হায় গো! ওহ আল্লাহ্ গো, কে কনে আছোস রে আমাগো বাঁচাও।
এই মাইয়্যা আমাগো মাইরা ফালাইলো গো........
.
.
ভাই এক কেজি কালোজাম দেন তো!
- কি গো টুকির বাবা? আইজ যে কালা মিষ্টি নেও? মাইয়্যা না সন্দেশ পছন্দ করে?
- এইগুলা অরী মায়ের জন্য। মা আমার পুরো জেলায় প্রথম হইছে।
- আহারে? মাইয়্যাডার কথা মনে হইলে কইলজ্জা টা পুড়ে রে ভাই। খুব কষ্ট করে।
- যার মা না, বাবা থাকতেও নাই তার আর কে আছে?
ভাইরে আকড়ে ধইরা, পইড়া আছে বাপের ঘরে। যাওয়ার তো জায়গা নাই। যেটুক পারি তাই করি।
- হু ভাই! এতিমের মাথায় হাত রাইখো আল্লাহ্ তোমারে দেখবো.....
.
.
গুটি গুটি পায়ে হাটছে সারা উঠোন। অরী কে দেখে ভাই যেনো পাখির মতো উড়াল দিলো।
আধো আধো কন্ঠে বলে
- মনু, মনু ওক্কু। দেখো ওক্কু।
.
ভাইয়ের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে রক্ত।
ভালো ভাবেই কেটেছে।
মনে হয় অনেক ক্ষণ কাদছে। চোখ ভেজা।
- মি পছা,কই গেছিলা? আমালে মাররছে। দেখো উক্কু।
.
ভিতর থেকে শক্ত হলেও কোন দিন ভাইয়ের রক্ত দেখিনি।
মনে হচ্ছিলো কেউ আমার গলা চাপ দিয়ে ধরেছে।
চিৎকার করতে পারি না, না পারি শ্বাস নিতে।
.
বাড়ির পাশেই ফার্মেসী।
ভাইকে নিয়ে যাই।
কাকা বলে এন্টিসেপ্টিক ইনজেকশন দিতে হবে।
ভাই এমন ভাবে মুখ লুকিয়েছিলো বুকে যেনো সব বিপদ থেকে মুক্ত করতে পারবো।
কিন্তু সেই আমি কি না? দাদীর কথায় ভাই কে রেখে গিয়েছিলাম? ছি!
.
রেজাল্ট এর পর টুকি আমার সাথেই ছিলো।
বাড়ি আসতে আসতে ভাই ঘুমিয়ে যায়।
. দাদু আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়ালাইকুম সালাম। মা খুব খুশি হইছি তোমার রেজাল্ট শুইনা।
- দাদু! ভাইরে একটা ঝারা দেন না! মনে হয় ভয় পাইছে।
- তাইতো তোমার দিম্মা কইলো বইনে?
ভাইরে রাইখা কোথাও যাইয়ো না। ওরে বুকে বুকেই রাইখো। তোমার মায়ে আইজক্যা না কি ঘুমের পোলা রে উঠছে তারে গাছের লগে বাইন্ধ্যা রাখছে যাতে কোনহানে না যায়! ডরাবোই তো মা।
দেও আমার কোলে দেও।
.
- টুকি? এইখানে বসবি। আর কোথাও যাবি না। ভাইকে কোলে নিয়ে এখানেই থাক ।
- অরী? কি করবি?
- হয় মারবো, না হয় মরবো।
.
.
আজ অনেকদিন পর মায়ের ঘরে। এই ঘর টা মা কতই না শখ করে সাজিয়েছিলো!
মায়ের ছবি টা সুকেশ এর এক পাশে রাখা।
ধুলো জমে গেছে । কতই না চেয়েছি। দেয় নি।
মা! তোমার খুব কষ্ট হয়েছে না? মা জানো আমি......
.
বাবার স্ত্রী আমাদের সোকল্ড মা ঘুমিয়ে ছিলো । জেগেছে।
কোন সুযোগ না দিয়েই চুলের মুঠিতে ধরে ঘর থেকে টেনে হিচড়ে বের করেছি। ঠিক তেমন ভাবে যেভাবে আমার মোনা, আমার ভাইকে বের করেছে।
ঘুম থেকে উঠেই সে এতটা প্রকট ছিল না যে বাধা দিবে।
ঘর থেকে বের করে দিয়ে টুকি কে বলি ঘরে আয়। গ্রিল লাগিয়ে দেই।
এরপর শুরু হয় তার চিৎকার,দাদীর চিৎকার।
তাদের ভাষ্যমতে আমি তাদের কে মেরেছি ।
বাবার স্ত্রী বলে তার পেটের বাচ্চাকে মারতে চাইতেছি আরো কতকি!!!
.
আশেপাশে বাড়ির মানুষ সব জড়ো হয়। সবাইকে গিয়ে গিয়ে আমার দাদী বলে আমি না কি মেরেছি।
সেই সময় টুকির বাবা আসে।
সব বুঝতে পেরে টুকির মা কে খবর দেয়।
সাথে সাথেই ছোট কাকা আসে।
কাকা এসে মাথায় রাখে আর বলে...
.
- মা তোর এইটা আরো আগে করা উচিৎ ছিলো। অনেক সহ্য করছিস আর না।
দাদী বাধা দিতে আসলে বলে
- মা! আজ আর না। খুব কষ্ট দিছেন আর না। খালি ছোট চাচী ওদের কে বোঝা মনে করে তাই আমি ওদের নিতে পারি না। নইলে কবেই নিয়া নিতাম।
.
.
ঘর থেকে সৎ মায়ের সব, বাবার সব বের করে দিয়েছি। সে ব্যবসার কাজে বাহিরে। টুকি,টুকির মা রাতে গেলো না। রাতে কাকা খাবার কিনে দিয়ে গেলো।
ভাইকে বুকে জড়িয়ে কম্বল প্যাচিয়ে সারা রাত বসে ছিলাম। শুধু মাত্র রাত পোহানোর অপেক্ষায়।
.
সারা রাত ভাই জ্বরে খুব কষ্ট করেছে। সকালে খাইয়ে দিয়ে ছোট কাকার সাথে বেরিয়েছি। দাদী ওরা বাড়ি নেই।
বাইক এসে দোতালা এক বাড়ির সামনে দাড়ালো।
কাকার ঈশারায় বাড়ির ভিতরে গেলাম।
মোটামুটি সবাই বাড়ির উঠোনেই।
বেশ ধনী মুসলিম সংস্কৃতির বাড়ি।
আমাকে দেখে সামনের লোকজন মনে হয় কিছুটা ভয় পেয়েছি!
বয়স্ক দাড়িওয়ালা লোক হাতের থেকে চায়ের কাপ নামিয়ে চশমা চোখে তাকিয়ে আছে অরী আর ভাইয়ের দিকে.......
.
.
বাবার স্ত্রী (৬)
.
.
মা মারা গেছে আজ এক বছর আট দিন। ভাইয়ের বয়স টাও তাই। আমরা যে শুধু মা কে হারিয়েছি তা নয়, আমাদের বাবাও আমাদের নেই। দু মাস পর বাবা বিয়ে করে। মনে হয়েছিলো হয়তো ভাই,আমার কষ্ট কমবে।
কিন্তু মা, মা হয়। আমাদের কেউ কাছে টেনে নেয় নি। নিবেই বা কেনো? আমরা তো শুধুই বোঝা। মা মারা যাওয়ার আগের দিন দুপুরবেলা ভাত খাইয়ে দিয়েছিলো।কত বায়না ছিলো আমার কিন্তু রাত পোহাতেই মা কে হারিয়েছি, ভাই পেয়েছি।
যখন ভাই মায়ের বুকের দুধের জন্য কান্না করতো ওর মুখে চিনি পানি দিছি। বৃত্তির সামান্য টাকা দিয়ে মায়ের মৃত্যু বার্ষিকী তে মিলাদ পড়িয়েছি ।
বৃষ্টির রাতে যখন কারেন্ট থাকতো না, ভাইকে আগলে ধরে থেকেছি, দুধ না থাকলে ভাইকে ভাতের ফেন খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছি।
.
সবাই যখন ছুটিতে নানুবাড়ি বেড়াতে যেতো মায়ের কাছে বায়না করতাম মা আমিও যাবো।
কখনো ধমক দিতো, কখনো দীর্ঘ শ্বাস।
মাঝে মাঝে দেখতাম রাতে কাদছে।
জিজ্ঞেস করলে বলতো - জানিস অরী! আজ আমার বাবার জন্মদিন।
মা বাবাকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলো। আপনারা যান নি, মা আসেনি। মা আর কখনো আসবে না।
.
চশমা চোখে তাকিয়ে আছে বয়স্ক লোক টি।
অরীর খুব কান্না পাচ্ছে।
ভাইকে শক্ত করে ধরে আছে।
.
মা কে না কি অভিশাপ দিয়েছিলেন, মা কখনো সুখী হতে পারবে না।
অপঘাতে মারা যাবে।
কেনো? কেনো আপনারা অভিশাপ দিয়েছিলেন?
আপনারা কি জানেন না, মা- বাবার দোয়া, অভিশাপ আল্লাহ্ খুব দ্রুত কবুল করে?
কেনো আমাদের ক্ষতি করলেন?
মা ছাড়া বেঁচে থাকা কত কঠিন আপনারা জানেন?
সৎ মা কখনো মা হয় না, তারা শুধু বাবার স্ত্রী। স্বামী কে গ্রহন করে, স্বামীর সন্তান কে না।
মানুষের তাচ্ছিল্য সহ্য করতে করতে আমরা আজ নিরুপায়। সৎ মা এক বছরের বাচ্চা কে কষ্ট দিতেও ভাবে না কারণ আমরা তার সতীনের সন্তান।
কিন্তু আমাদের তো মা দরকার ছিলো! আমি জানি না, আপনারা কে আমার কি লাগেন। শুধু বলবো আমার মা কে ক্ষমা করে দিয়েন। আমাদের কেও। যার মা নাই, বাবা থেকেও নাই তারা তো অনাথ।
আমরা সত্যি এতিম। আমরা এখানে থাকতে আসিনি, কারণ জানি আমরা বোঝা। বাবার কাছেই বোঝা। মরে যেতাম, যদি ভাই না থাকতো।
.
.
কারো হাতের স্পর্শ মাথায় অনুভব করে অরী।
জানে না সে কে।
- আমি তোমার নানু হই।
বলেই সে জড়িয়ে ধরে। খুব কান্না করতে থাকে ভদ্র মহিলা।
.
ভাই তখন ঘুম থেকে উঠে গেছে। বোনের ওড়নার একপাশ মুখে দিয়ে আছে। ঈশারায় বোন কে বুঝাচ্ছে ক্ষুধা লাগছে।
ব্যাগের থেকে জুস দিলো অরী।
বাড়ির আর কেউ ওদের সাথে কথা অবধিও গেলো না।
সবাই যার যার মতো চলে গেলো।
অরী আশা করে এসেছিলো এরা হয়তো এদের কে কাছে টেনে নিবে কিন্তু!!
কথায় আছে না? অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়।
.
.
বাড়ি ফেরার পথে হেড স্যারের সাথে দেখা। সব কিছু বলার পর উনি বললেন কাল থাকবেন উনি শালিসে। ভয় নেই উনারা আছেন তো। এত ভালো রেজাল্ট করেছিস মা! তুই তো আমাদের সবার দায়িত্ব।
.
প্রয়োজনে পুলিশকে খবর দেবো, কিন্তু আর তোকে সহ্য করতে হবে না।
.
.
- ভাই! ও ভাই!
- উহু!
- ভাই, ওওওওও মোনা ভাই।
- দিস্তাব কলো না, তালে চাপায়, চাপায়
- মানে!!!!!
- চাপায়! চাপায়!
- তুমি আমার চাপায়, চাপায় মারবা?
-গায় য়ায় (গাল লাল) হবে।
.
.
ভাইয়ের কথা শুনে অরী হাসতে হাসতে বাড়িতে যায়।
ভাই জানে, এরা একে অপরের বেঁচে থাকার শেষ সম্বল।
আজ সে একা একা কবরস্থানের ভিতরে গিয়ে মায়ের কবর স্পর্শ করেছে।
আজ সে প্রথম মা কে স্পর্শ করেছে।
অরী যে অনেক দিন যাবত অপেক্ষা করছিলো এ দিনের। আজ সেই দিন।
.
.
বাড়িতে অনেক মানুষ। সবাই তার বাবার শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
অরীর সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।
তালা খুলে ঘরের ভিতরে গিয়ে গ্রিল লাগিয়ে দিলো।
.
.
পর দিন সকালে....
আল্লাহ গো তাই তো বলি এ মেয়ে এত সাহস কই থেকে পায়?
ছি ছি ছি! আল্লাহ বাচাইছে! কে কোথায় আছো গো?
দেইখা যাও, দেইখা যাও......
.
.
.
বাবার স্ত্রী (৭)
.
.
কে জানতো রাত পোহালেই অরীর জন্য অপেক্ষা করছে সব থেকে বড় অভিশপ্ত সকাল!
সকাল সকাল বাহিরে চিল্লাচিল্লি তে ঘুম ভাংগে অরীর।
শাল জড়িয়ে বাইরে বের হয়ে দেখে মসজিদের ইমাম সাহেব সহ আরো অনেকে।
আজ তাদের শালিস বসার কথা কিন্তু এত সকালে?
- এই মাইয়্যার নচ্ছমগচ্ছম আগে থাইক্যাই ভালা না।
এই কারণে হগলসময় কামে রাখি। আর আন্নেরা কন আমি না কি আমার নাতী নাতনি রে কষ্ট দেই।
মা মরা মাইয়্যারে দিয়া কাম করাই! আপ্নেগো যা কও তাই বিশ্বাস করেন! এহন দেহেন নিজের চোখেই দেহেন। আগেও কয় দিন দেখছি কিন্তু ঠাউর করবার পারি নাই। আইজক্যা হাতে নাতে ধরছি।
আবিয়াত্তা মাইয়্যার ঘর থেইক্যা ভোর সকালে বেডা ছাওয়াল বাইর হওয়ার মানে বুঝেন তো আপনারা?
বাকী টা এহন কি করবেন দেহেন!
যৌবনে এত কুড়কুড়ায় রে তোর মুখপুড়ী? কইলেই পারতি বিয়া দিয়া দিতাম। খারাপ মাইয়্যা গো নাগাল ঘরে পোলা মানুষ আনোস ক্যা? মায়েরে তো খাইছোস বাপরে তো বাইচ্যা থাকতেই মাইরা দিলি রে!
.
.
অরীর সাথে কি হচ্ছে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারলো তার উপর অনেক বড় বদনাম লেগে গেলো।
মুচকি হাসলে নীলুফার বেগম। অরীর সৎ মা। শেষ অবধি তার চাল টা কাজে লেগে গেছে। তিন দিনের মেয়ে সে না কি আমার উপর দিয়ে যাবে? এখন সারা জীবন রিক্সাওয়ালার বউ হয়েই থাকবি। এমন চাল দিয়েছি না? উঠতে পারবি না। পাঁচ হাজার টাকা গেছে তাতে কি? আপদ তো বিদায় হবে।
.
কাজ তেমন কিছুই ছিলো না, শুধু অভিনয় করতে হবে যে অরীর ঘর থেকে ভোরে বেরিয়েছে। আর অরীর সাথে সারা রাত ছিলো।
এর জন্য পাঁচ হাজার টাকা আর এত সুন্দরী বউ পাবে। এ আর কম কিসের?
ঘরের ভিতর ভাই কাদছে। অরীর মনে হচ্ছে ঘরে গিয়ে গলায় দড়ি দিতে।
ছি! এত খারাপ মানুষ কিভাবে হয়? কি দোষ ছিলো তার?
ভাইকে সে মেরে ফেলবে আর নিজেও মরে যাবে।
হয়তো দাফন কাফন হবে না তাদের তবে কি মুক্তি তো পাবে!
এই অনেক বড়। এ সমাজে মা ছাড়া সন্তানের যে কি সুখ সে খুব অনুভব করছে।
ঘরের ভিতরে যাইতে চাওয়াতে নীলুফার বেগম হাত ধরে টেনে এনে দুয়ারে ধাক্কা দিয়ে ফেলে।
অরীর বাবা এসেছে। অরী উঠে দাড়াতে দাড়াতেই সে অনেক জোড়ে একটা থাপ্পর মারে।
কান দিয়ে রক্ত এসে গেছে।
অরীর হঠাৎ করেই ৫ বছর আগের কথা মনে হলো।
সেদিন অরীর কানে ফুটো করার কথা। তার বাবা সারা সকাল কিছু খায় নি। যখন সময় এলো এলাকায় ছিলো না সে কারণ মেয়ে কান্না করবে আর আজ.............
সবাই কে অবাক করে দিয়ে অরীর ভাইকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো টুকির দাদী আর ইমাম সাহেবের স্ত্রী।
তাদের দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো নীলুফার বেগম আর অরীর দাদী।
- ও কলির মা! আল্লাহ রে ডরাইস, বুঝছোস! এক পাও তো কব্বরে যাইয়া রইছে, ক্যান ছেরিডারে এত বড় মিথ্যা বদনাম দিলি?
কাইল রাতে একবার আইবার চাইলাম না। কইলাম থাকবোনি দরজা দিয়া কিন্তু টুকির বাপে কইলো যে এতিম পোলাপান, কেউ নাই। কোন বিপদ আপদ হইলে কেউ দেখার নাই। তাই ইমামের বউ নিয়া রাইতে আমি আইছি।
কে জানতো যদি না আইতাম তাইলে আইজ ছেড়ির কপাল ডা পুড়তো।
.
অরী ভাইকে কোলে নেয়। ভাই রক্ত দেখে ফু দিতে দিতে বলে সাইরা যাবে। কান্না করো না।
.
সকাল নয়টার সময় বিচার বসে।
আজকের কাহিনি কারো অজানা না। তবুও যেনো অন্যরা পিছুপা হয় না।
অরীর সৎ মা আজ যে ভাবেই হোক এই রিক্সাওয়ালার সাথে বিয়ে দিবেই।
ভাইকে কোলে নিয়ে বাড়ির কাঠাল গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অরী।
কি বলবে সে? কে আছে তার? ভাই বার বার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে।
ঠিক সে সময় বাড়িতে এলো কয়েক জন মানুষ। এরা কেউ না অরীর নানুবাড়ির মানুষ। তারা আসার পর বিচারের ধারা পাল্টে গেলো।
অরীর মামা এসে যখন ছেলে টা কে শক্ত করে জিজ্ঞাসা করলো তখন সে সব সত্যি বলে দেয়।
এক সময় বিচারে অরী বলে তার কিছু চাই না। শুধু মায়ের ঘর, মায়ের জিনিস চাই।
সৎ মা বলে - আমার স্বামীর স্ত্রীর জিনিসে আমাদের অধিকার নেই কি?
কিন্তু বিচারের শেষ টা অরীর হয়।
নানা চায় অরী কে নিয়ে যেতে কিন্তু অরী যায় না। কারণ সে চায় না বোঝা হয়ে থাকতে ।
.
সেদিনের সূর্য নিয়ে ডুবেছিলো অরীর সব কষ্ট ।
দেখতে দেখতে কাটতে থাকে সময়। ভাই কে নিয়ে,লেখা পড়া দুই একজন স্টুডেন্ট পড়িয়ে, মায়ের টাকা তে ভালোই চলছিলো।।
সেদিন ছিলো ভাই কে স্কুলে ভর্তির দিন। স্কুলে গিয়ে নাম লিখানোর সময় মনে হইলো ভাইয়ের নাম কি?
ভাইয়ের নাম তো রাখিনি। সবাই তো ভাই বলেই ডাকে ।
তখন মায়ের নামেই নাম রাখলাম আয়াত।
আমার বেচে থাকার শেষ সম্বল। এক দিন সবাই জানতো অরীর ভাই বলে আজ জানে আয়াতের বোন।
.
.
বাসর রাতে কনে বেশে বসে থাকা মেয়েটি খুব সহজে বলে দিলো। কে বলবে এই মেয়ে এত সহ্য করেছে?
- তবে আমাকে কেনো বিয়ে করলেন অরী?
- কারণ আমি চাইনি আমার মতো কোন মেয়েকে যুদ্ধ করতে হোক। আমি চাই না বেলা আমার মতো এই নিষ্ঠুর সমাজের স্বীকার হোক।
১২ বছরের অরী যদি আয়াত কে বুকে জড়িয়ে বাঁচতে পারে তবে ২৪ বছরের অরী কেনো ৬ মাসের বেলা কে বুকে নিতে পারবে না?
.
শাওন মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। সে হয়তো মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নিচ্ছে যে তার মেয়ে সত্যি মা পেলো।
অরী নিজেকে বেলার মা হিসেবেই গড়ে নিবে।
বেলা অরী কে নিজের মা বলবে বাবার স্ত্রীর নয়।
.
.
সমাপ্ত___