একটু_সুখে_থাকতে_চেয়েছিলাম | রহস্যময় গল্প

 রহস্যময় গল্প ও ঘটনা

রহস্যময় গল্প ও ঘটনা

মাঝ রাতে আমার ছাত্রী ফোন করে বলল,


- স্যার আপনি খুব খারাপ!আমার আম্মু একটু আগে আত্মহত্যা করেছে।আপনি আমার আম্মুকে ব্লাকমেইল করতেন..।সুইসাইড নোটে কারণ হিসেবে শুধু আপনার নামটাই আম্মু উল্লেখ করেছে।


এতো রাতে আমার ছাত্রী রিহানার গলার কন্ঠ স্বর থেকে এমন কথা আমাকে খুব দ্রুতই অবাকের শেষ দিকে নিয়ে গেল।কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকার পর হতভম্ব হয়ে আমি বললাম,


- মাঝ রাতে ফোন করে কি বলছো এসব?তোমার কি মাথা ঠিক আছে? 


- স্যার!আমার মাথা ঠিকই আছে।হয়তো বা আপনার মাথা ঠিক নেই।আপনার স্ত্রী তো প্রেগনেন্ট!শারীরিক চাহিদা আপনাকে এতোটাই নিম্ন স্তরে পৌঁছে দিয়েছে,যে আমার মায়ের উপর আপনার লোভাতুর খারাপ দৃষ্টি ফেলতেও দ্বিধা বোধ করেন নি!


- রিহানা তুমি কি আমার সাথে মজা করছো?কি-সব আজেবাজে কথা বলে চলেছো?


- আপনার কি মনে হয় আমি মজা করার মতো মেয়ে?চোখের ঠিক সামনেই আমার মায়ের লাশ জুলে আছে সিলিংফ্যানের সঙ্গে।বাবা তো সেই কবেই দুনিয়ার মূর্ছা ত্যাগ করেছে।এই পৃথিবীর ভূখন্ডে আমার অতি আপন বলতে আর কেউই রইলো না।আপনি আমার টিউশনির প্রিয় একজন স্যার ছিলেন।আপনার প্রতি আমার যথেষ্ট সম্মান,শ্রদ্ধাভক্তি ছিল।কিন্তু আজ সব শেষ হয়ে গেল।আপনি আমার দেখা একজন জঘন্য মানুষে রুপান্তরিত হলেন।আপনি টিউশনির স্যার নামের এক কলঙ্ক মাত্র তাছাড়া আর কিছুই নয়।আপনাকে আমি কখনোই ক্ষমা করবো না স্যার! "কখনোই না।"

 


কথাগুলো বলার পরপরই ফোন কেটে দিলো রিহানা।সব কিছুই যেন আমার মাথার উর্ধে দিয়ে গেলো।এসব কি বলল রিহানা?কিছুই জানিনা কেনো আমার মাথার গহীনে ঢুকলো না।এই মুহূর্তে ভাবাতে বিভোর আমি।বেশ কয়েক-বারই রিহানার নাম্বারে কল করেছিলাম।কিন্তু রিং বাজলেও ফোন উঠায় নি।ঘন্টার কাটা প্রায়ই চারটার কাছাকাছি।শোয়া অবস্থায় আচমকা ঘুমঘুম চোখে পেছন থেকে হাত টেনে ধরে আমার স্ত্রী রুহি বলল,


- কি ব্যাপার!এতো রাতে তুমি এভাবে বসে আছো কেনো?


হকচকিয়ে আমি বললাম,


- হঠাৎ ঘুম ভাঙাতে এখন আর ঘুম আসছে না।তাই বসে রয়েছি।তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।অন্যথায় শরীর খারাপ করবে।


অতএব আর কিছু বলল না রুহি।হাত টেনেই,কিছুটা জোর করে, আমাকে নিজের কাছে টেনে নিলো।তার ঠোঁট আমার ঠোঁটের নিকটে এনে গলা জড়িয়ে ধরলো এবং ভ্রু-কুচকে "ঠোঁট বেঁকিয়ে একটু মুচকি হেঁসে রুহি বলল,


- নিশ্চই কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছো তাই হয়তো ঘুম আসছিল না।কিন্তু এখন দেখবো তোমার ঘুম কেনো আসবে না!


প্রতিউত্তরে কিছুই বললাম না আমি।রুহির খুব কাছে থাকলে,কেনো যেন আমার সব ধরনের চিন্তাদুশ্চিন্তা নিমিষেই দূর হয়ে যায়।মনের ভেতরটায় প্রশান্তিতে ভরে ওঠে।কিন্তু আজ এসব কিছুই হচ্ছে না।ঘুম আসছে না আমার চক্ষু জোড়ায়।ভেতরে ভেতরে অনেক আতংক ও বিভ্রাটের মধ্যে বসবাস করছি আমি।হঠাৎ আমাদের ফ্লাটের কলিংবেল টং করে বেজে উঠলো।রুহি প্রায় ঘুমিয়েই পরেছিল।কিন্তু কলিংবেলের শব্দে ঘুমের আভাটা ওর কেটে যায়।


রুহি বলল,


- এই শুনছো?এতো রাতে কে আমাদের ফ্লাটের কলিংবেল বাজাতে পারে?


- আমারও তো একই কথা!দরজা খুলে দেখছি।


- "না"। "দাঁড়াও?


- কেনো?


- চোর ডাকাত অথবা দুষ্কৃতকারীও তো হতে পারে?


- বর্তমানে বাড়িতে চুরি ডাকাতি বা দুষ্কৃতকারীদের আগমন অতোটাও সহজতর নয় রুহি।

 


অতঃপর শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি এবং ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুললাম।সাথে সাথে পুলিশের আগমন ঘটলো ফ্লাটে।অবশ্য যেটার পূর্বাভাস আমি অনেক আগে থেকেই পাচ্ছিলাম।"কলার চেপে ধরে একজন পুলিশ অফিসার বলল,


- তুই শাহরিয়ার?


- হ্যাঁ।


- থানায় চল!ব্লাকমেইল করা জন্মের মতো শিখিয়ে দিবো।


- দেখুন আমার কথাটা একটু শুনুন!আপনাদের ভুল ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না।আমি ওনার সাথে ওসব কিছুই করিনি।


- আমাদের সাথে চুপচাপ থানায় যাবি নাকি মারধর করে নিয়ে যেতে হবে?


জবাবে আমি কিছু বলতে যাবো ঠিক তার পূর্ব মুহূর্তেই রুহি এসে বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল,


- পুলিশ!আমাদের ফ্লাটে পুলিশ কেনো এসেছে?আর আপনি আমার স্বামীর শার্টের কলার কেনো চেপে ধরেছেন? "হাও ডেয়ার ইউ"! ওকে ছাড়ুন বলছি!


- এখন তো শুধু মাত্র কলারটাই ধরলাম।থানায় গেলেই বুঝবে পুলিশের লাঠির আঘাত কতটা না যন্ত্রণা-দায়ক হয়।


- এসব কি বলছেন!আমার স্বামী থানায় কেনো যাবে?কোন অপরাধে ভূষিত করে,ওকে আপনারা থানায় নিয়ে যাবেন?


জবাবে পুলিশ অফিসারটি আমার কলার ছেড়ে দিয়ে অনেকটা গম্ভীর গলায় বলল,


- আপনার স্বামী বাসায় গিয়ে,যেই মেয়েটাকে টিউশনি করাতো,ওর মা'কে ব্লাকমেইল করতেন।ফলস্বরূপ এই তো প্রায়ই অনেক্ষণ পূর্বে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।সুইসাইড নোটে স্পষ্ট ও সাবলীল ভাষায় একমাত্র আপনার স্বামীর নামটাই তিনি উল্লেখ করেছেন।


- কি বলছেন এসব!আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না।আর তাছাড়া একটা সাধারণ সুইসাইড নোটের ওপর নির্ভর করে আমার স্বামীকে আপনারা একদমই গ্রেফতার করতে পারেন না।আপনারা সুনিশ্চিত তো সুইসাইড নোট স্বয়ং ওনার নিজের হাতেরই লেখা?এটাও তো হতে পারে অন্য কেউ ওনাকে খুন করে দোষটা সম্পূর্ণই আমার স্বামীর উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।পরিশেষে স্পষ্ট ভাষায় একটাই কথা আমি বলবো,আমার স্বামী অর্থাৎ শাহরিয়ারকে কেউ মিথ্যাচারে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। তাছাড়া আর কিছুই নয়।


- চুপ করুন!আপনার স্বামী কি কোনো বড় কিছু,যে তাকে কেউ ফাঁসানোর চেষ্টা করবে!সুইসাইড নোট স্বয়ং ওনার নিজের হাতেরই লেখা ছিল।এখন শুধুই অপেক্ষারত পোস্ট মর্টেম রিপোর্টের জন্য।সেটাও খুব শীঘ্রই বেরিয়ে আসবে।এখন আর কথা বাড়াতে চাই না। আপনার স্বামীকে আমাদের সাথে থানায় তো বাধ্যতামূলক যেতেই হবে।প্লিজ বাঁধা দেওয়ার কোনো প্রকার বৃথা প্রচেষ্টা করবেন না।যা কথা সব থানাতেই হবে। 

 


অতঃপর আমাকে হাতকড়া পড়ানো হলো।রুহির চক্ষু জোড়া তখন জলে ভিজে গিয়েছিল।মোটেও তখন রুহির দিকে তাকাতে পারিনি, আমি।ওর চোখে চোখ রাখতে পারিনি।অতএব আমাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো।পরেরদিন সকাল দশ ঘটিকায় রুহি থানায় এলো।ওর চোখ মুখ আমাকে ইঙ্গিত করছিল প্রচুর কেঁদেছে -ও- "প্রচুর!ধীরে ধীরে চোখের বাঁধ আমারও নরম হয়ে ভেঙে পরার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।তবুও বাঁধ জোড়া শক্ত করে রুহির ফর্সা দুটো গাল স্পর্শ করে আমি একটা কথাই বললাম,


- আমি নির্দোষ নিরপরাধ।আমাকে অবিশ্বাস করোনা রুহি!


কথার উত্তরে রুহি বেশ একটা ভেজা গলায় বলেছিল,


- পরিস্থিতি যেমনই হোক শাহরিয়ার।তোমার উপর আমার দীর্ঘ বিশ্বাস কখনো উঠে যাবে না।আমি জানি তুমি নির্দোষ।বিশ্বাস রাখো সৃষ্টিকর্তার উপর।নিশ্চই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

 


কথা-গুলো বলার পরপরই সেদিন রুহি চলে গিয়েছিল।যার দু-দিন পর থানায় নতুন এক ওসির আগমন ঘটলো।যাকে মূলত ট্রান্সফার করে এখানে নিয়ে আসা হয়।'কিন্তু ওনাকে দেখা মাত্র আমার এবং রুহির দুজনেরই চক্ষু জোড়া কপালে উঠে যায়।রুহির চোখে তখন জল টল-মল করছিল কারণ এই ওসি আর কেউ নয় স্বয়ং আমার স্ত্রী রুহির আপন বড় ভাই।নিজের হাতে খাবার তৈরী করে এনেছিল রুহি।কিন্তু পারলোনা মুখে তুলে দিতে আর না পারলো এড়িয়ে যেতে।রুহির বড় ভাইও হয়তো বা আমাদের দেখে এই মুহূর্তে অবাকের সর্বোচ্চ সীমায় গিয়ে পৌঁছেছেন।একটা ফাইল ও কিছু রিপোর্ট হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে আসে রুহির বড় ভাই জাহিদ এবং খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথেই রুহিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন,


- যেমনটা আমরা সবাই আশা করেছিলাম।ঠিক আজ তার বেতিক্রম হলো না।আমরা পূর্বেই তোকে বহুবারন করেছিলাম।এই ছেলেকে বিয়ে করিস না।কিন্তু জেদি মেয়ে আমাদের কোনো কথাই তুই শুনিস নি।সবার পছন্দ করা পাত্রকে ঠুকরে কোথাকার এই অনাথ ছেলেটার প্রেমে মজলি।কি পেলি ওকে বিয়ে করে?ত্যাজ্য সন্তান হলি,সমস্ত ধন-সম্পদ থেকে বহিষ্কার হলি।সব কিছুই হারালি পরিশেষে কি পেলি?বল আমায়?তোর স্বামীর চরিত্রই তো খারাপ!পড়ানোর নাম করে ছাত্রীর মাকে ব্লাকমেইল করতো।কু-প্রস্তাব দিতো।


- শাহরিয়ার এমন কিছু করেনি ভাইয়া।ও এমন নয়।ওকে ফাঁসানো হচ্ছে।


- চুপ!এখানে আমার একটা সম্মান আছে।অন্তত ভাই ডেকে সেটা নষ্ট করে দিস না প্লিজ।পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বেরিয়েছে,সেখানে স্পষ্টই উল্লেখিত রয়েছে,ওটা আত্মহত্যাই ছিল।তাছাড়া আরও বিভিন্ন প্রমানও আমাদের নিকট রয়েছে, তোর চরিত্রহীন স্বামীর বিরুদ্ধে। ও দোষী।সাঁজা পাবেই।এছাড়াও আমি ভাবতেও পারছি না তুই এখনো ওকে কি করে সাপোর্ট করতে পারিস?


জবাবে শত দুঃখের ভীড়ে একটু মুচকি হাঁসলো রুহি এবং বলল,


- ভালোবাসা।

 


কথাটা বলেই রুহি এক-পলক তাকালো আমার দিকে।তারপর থানা থেকে বের হয়ে গেল।জানিনা কি আমার দোষ!কেনো এমন হলো?আমি তো কোনো অপরাধ করিনি তাহলে কেনো আজ আমি এই অন্ধকার জেলে?ছোট্ট একটা চাকরি করতাম।যা দিয়ে সংসার চালানো বেশ কষ্টের ছিল।তাই তো পাশাপাশি একটা টিউশনিও করাতাম আমি।রিহানার মা তো খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন।তাহলে কেনো তিনি মৃত্যুর পথটা বেছে নিলেন?এবং তার দ্বায়ী হিসেবে আমায় কোনোইবা উল্লেখ করলেন?যেখানে আমি নির্দোষ,এমন কিছুই করিনি।জানিনা কি হচ্ছে এসব!মনে তো হচ্ছে গভীর থেকেও গভীর কোনো ষড়যন্ত্র।কেনো আল্লাহ সর্বদা নির্দোষকেই ফাঁসানো হয়?দোষীরা তো ঘুরেবেড়ায় মুক্ত আকাশে,খোলামেলা,রাস্তা-ঘাটে!


"পরের দিন সকাল সকাল একজন কনস্টেবল এসে যখন কিছুটা দুঃখ প্রকাশ করেই বলল, 


- থানায় আসার পথে,কোনো একটা গাড়ির চাপায় আপনার গর্ভবতী স্ত্রী প্রাণ হারিয়েছেন।


"যা শোনা মাত্রই আমার অন্তরমহলে তিল তিল করে গড়ে ওঠা সাম্রাজ্য ভাঙতে আরম্ভ করে...............


গল্প : একটু_সুখে_থাকতে_চেয়েছিলাম 

পর্ব : ০১

লেখাঃ মোঃ_শাহরিয়ার 


গল্পঃ একটু_সুখেই_থাকতে_চেয়েছিলাম (পর্বঃ ০২)

লেখাঃ মোঃ_শাহরিয়ার 

 

(২)

- থানায় আসার পথে কোনো একটা গাড়ির চাপায় আপনার গর্ভবতী স্ত্রী প্রাণ হারিয়েছেন।


"যা শোনা মাত্রই আমার অন্তর-মহলে তিল তিল করে গড়ে ওঠা সাম্রাজ্য ভাঙতে আরম্ভ করে।আমাকে স্তব্ধ করে তুললো।সব কিছু যেন আমার মাথার উপরে ঘুরছে।হচ্ছে কি এসব?শরীর জিমজিম করছে,হাত-পা অবশ হয়ে আসছে।বলার মতো কোনো ভাষাই,যে খুঁজে পাচ্ছিনা।বুকের ভেতরের ধুকধুকানি ক্রমশ বেড়েই চলেছে।আর পারছি না,যন্ত্রণার নদী সাঁতরাতে,পারছি না আর তীব্র স্রোতের সম্মুখীন হতে।মন ভেঙে চুরমার তবুও খানিক শক্ত করলাম নিজেকে এবং কনস্টেবলটির উদ্দেশ্যে কাঁপা গলায় বললাম,


- আপনি কি সত্যি কথা বলছেন?ওটা কি আমার স্ত্রীই ছিল!না অন্য কেউ? আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না। মজা-টজা করছেন না তো?


- গাড়ির চাপায় মুখের অর্ধাংশ থেঁতলে গিয়েছে।স্বয়ং আপনার স্ত্রীর বড় ভাই অর্থাৎ আমাদের থানার নতুন ওসি লাশটা চিহ্নিত করেছেন।আপনি একটু নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করুন।সত্যিটা মেনে নিতেই হবে।শেষ দেখা এবং স্ত্রীকে দাফন কাফনের জন্য জেল থেকে বেশ সম্ভবত আপনাকে কিছু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মুক্ত করে দেওয়া হতে পারে।


কথাগুলো বলার পর একপ্রকার হনহনিয়ে চলে গেল কনস্টেবলটি।বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল আমার।কি এমন পাপ করেছিলাম, যার জন্য আজ এই পরিস্থিতি আমায় খুব যন্ত্রণার মধ্যে ফেলছে।অতএব প্রায় অনেক্ষণ পর অবশেষে চোখের দৃষ্টির সন্নিকটে একজন পুলিশ অফিসারের দেখা পেলাম।যিনি এসেই জেলের তালা খুলে বললেন,


- তাড়াতাড়ি চলুন।জানাজা পেতে হলে ঢাকার উদ্দেশ্যে শিগগিরীই যেতে হবে।


"বেশ খানিকটা আশ্চর্য হয়ে বললাম,


- ঢাকায় কেনো?"


- আপনার স্ত্রীর লাশ ঢাকায় তার পৈতৃক বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।সেখানেই সম্ভবত জানাজা এবং কোনো একটা করব স্থানে লাশ দাফন হবে।

 


মন শতবার চাইলেও আর কথা বাড়ালাম না আমি।আমাকে সঠিক সময়ে জানাজা নামাজে দাঁড়াতে হবে।শেষ বারের জন্যে,রুহির পবিত্র মায়াভরা "ওই মুখটা দেখতেই হবে।কিন্তু কিছুই পারলাম না।আহহ আফসোস!থানার বাহিরে আসতেই সেই পুলিশ অফিসার সিফাত উল্লার ফোন বেজে ওঠে। কল রিসিভ করার পর পনেরো মিনিট তিনি কথা বলেছিলেন।তারপর আমাকে ইঙ্গিত করে কয়েক জন কনস্টেবলকে ডেকে বললেন,


- ওকে দ্রুতই আবার জেলের ভেতরে নিয়ে যাও।


এতে মাত্রাধিক হতভম্ব হয়ে আমি বললাম,


- এসব আপনি কি বলছেন?


উত্তরে কিছুটা নরম কন্ঠ স্বর ব্যবহার করে বললেন,


- কিছুই করার নাই।স্যার ফোন করেছিল।তিনি স্পষ্ট ভাবে আপনাকে সেখানে যেতে,এখন আবার বারন করছেন।


- আপনার স্যার মানে এই থানার ওসির কথা বলছেন তাই তো?


- হ্যাঁ।


- সে তো এমনটা বলবেনই।প্লিজ আমাকে নিয়ে চলুন।নতুবা আমায় নিজে থেকে যেতে দিন। আমি শেষ বার,একটুখানির জন্য আমার ভালোবাসার মানুষটাকে দেখতে চাই।ওকে আমি বলতে চাই, কেনো ছেঁড়ে গেলে, হারালে অতলে,গভীরে।এটা তো হওয়ার কথা ছিল না।তাহলে কেনো আমার সাথে এমনটা হলো? আমি তো কোনো অন্যায় করিনি বা অপরাধের সাথে যুক্ত হইনি তাহলে কেনো আমায় বিনা দোষে সাঁজা ভোগ করতে হবে? দয়াকরে আমায় যেতে দিন।শুধু চোখের পলকে একটাবার দেখেই আমি চলে আসবো।বিশ্বাস করুন!

 


জবাবে বেশ একটা তীক্ষ্ণ গলায় পুলিশ অফিসার সিফাত উল্লাহ বলল,


- সরি!আমার কাছে অবশিষ্ট করার মতো কিছুই নেই।আপনাকে যেতে দিলে আমার চাকরি টানা হেঁচড়ার সম্মুখে পরবে এটা'তো কনফার্ম।স্যার কড়া কন্ঠেই বারন করে দিয়েছেন।আপনি কোনো ক্রমেই সেখানে যেতে পারবেন না।

 

অতঃপর দুজন কনস্টেবল জোর-জবরদস্তির ভিত্তিতে আমাকে আবার জেলের ভেতরে নিয়ে আসে।জীবনে কখনো এতো কষ্ট,যন্ত্রণা অনুভব করিনি আমি।যতটা আজ অনুভব করছি।যা আমাকে তিল তিল করে ক্ষণে-ক্ষণে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিচ্ছে। কেনো যেন আজ মনে হচ্ছে, দুনিয়ার সমস্ত যন্ত্রণা বেদানা সব দিক থেকে শুধু আমাকেই ঘিরে ধরেছে।ছায়ার মতো সর্বদা আমার পাশে একমাত্র রুহিই ছিল কিন্তু তাকেও শেষ পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তা কেঁড়েই নিলো,আমার নিকট থেকে।কিছু মানুষ খানিক্ষণের জন্য জীবনে থাকে।হয়তো রুহিও তাদের মধ্যে একজন ছিল।দুদিন পর রুহির বড় ভাই জাহিদ থানায় এসেই সর্বপ্রথম আমার মুখ-দর্শন করেন এবং নিজের সর্বোচ্চ শক্তি এক হাতে সঞ্চারিত করে, কোষে কয়েকটা থাপ্পর বসিয়ে দেওয়ার পর শক্ত করে কলার চেপে ধরে রাগান্বিত গলায় বললেন,


- তোর জন্যে আমার ফুলের মতো বোনটা আজ "ওই অন্ধকার কবরে শুয়ে আছে!সব কিছুর জন্য একমাত্র তুই'ই দ্বায়ী।তোকে আমি কোনো ক্রমেই ছাড়বো না।প্রয়োজন বোধ হলে,তোর বিরুদ্ধে আরও কিছু মিথ্যে অভিযোগ আমি তুলবো।তারপর ফাঁসির দড়ি পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে তবেই আমি শান্ত হবো।মনে ভিষণ তৃপ্তি পাবো।


কথাগুলো বলার পর খানিকটা ধাক্কা দিলেন আমায়।যার ফল সরূপ দেয়ালের সাথে মাথা লেগে কিঞ্চিৎ পরিমাণ কেটে যায় আমার।এতে তার কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপ নেই।আর থাকবেই বা কেনো?অতএব কিছুক্ষণ আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকার পর চলে গেলেন তিনি।যার মাত্রই দেড় ঘন্টা পর অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি আমার জামিন হয়ে যায়।অপরিচিত একলোক এসে মূলত আমার জামিন করান।জানিনা কে এই লোক!আর কেনো,কিভাবেই বা অতি সহজে আমার জামিন করালো?রাগে গজগজ করে রহির বড় ভাই জাহিদ সেই অপরিচিত লোকটির উদ্দেশ্যে বলল,


- এটা কি করে সম্ভব!ওর জামিন কি করে হতে পারে? "হাও পসিবল!আর "কে আপনি?ওর মতো একটা অপরাধীকে কেনোই বা জামিন করালেন? মনে তো হচ্ছে আপনি কোনো সন্ত্রাসবাদের লোক!


রুহির বড় ভাই জাহিদের কথা গুলো শুনে একটু হাসলো অপরিচিত সেই লোকটি।মুখের মাস্ক এবং চোখের সানগ্লাসটা খুলে জবাবে তিনি বললেন,


- আমি এহসানুল সরকার।গোয়েন্দা ডিপার্টমেন্টের একজন অফিসার।চোখে না দেখলেও নাম হয়তো শুনেছেন। মৃত্যুর ছত্রিশ মিনিট আগে আপনার বোন অর্থাৎ রুহি আমার সাথে কনট্যাক্ট করেছিল।বলতে গেলে সেই সুবাদেই আমার এখানে আসা।কথা বাড়াতে চাইনা তাই মেইন পয়েন্টে আসছি,শাহরিয়ারের ছাত্রী রিহানার মায়ের ওই পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট-টি আসল ছিল না।যা,থানার একজন ওসি হয়েও আপনি সেটা ধরতে পারলেন না।ওনাকে খুন করার পর সেটা সম্পূর্ণই আত্মহত্যায় রুপ দেওয়া হয়েছে।আর এটা সত্য সুইসাইড নোট রিহানার মায়ের নিজের হাতেই লেখা।তবে আমার আশংকা সুইসাইড নোট-টি কেউ রিহানার মা'কে জোর করে লিখতে বাধ্য করেছে।সঠিক ভাবে তদন্ত করলে কোনো কিছুই অজনা থেকে যায় না,জাহিদ সাহেব।


কথাগুলো বলার পরপরই তিনি আমার একটা হাত ধরে থানার বাহিরে নিয়ে এসে একটা গাড়িতে উঠতে বললেন।


"জবাবে আমি বললাম,

- আমরা কোথায় যাচ্ছি এখন?


- তোমার ছাত্রীর বাসায়।


- কিহ!ওর বাসায় কেনো?


- তদন্ত।

 


অতঃপর আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।নির্দ্বিধায় গাড়িতে উঠে বসলাম।ছাপ্পান্ন মিনিট পঞ্চাশ সেকেন্ড পর রিহানাদের বাড়ির সামনে এসে পৌঁছিলাম।কিন্তু এটা কখনো কল্পনাও করিনি,বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই সোফার পাশে আমার ছাত্রী রিহানার রক্তাক্ত তাজা লাশ পরে থাকতে, আমি দেখবো।যার একটু পাশেই কালো রঙের একটা খামও পরেছিল।যেটা দেখে এহসানুল ভাই অনেকটা আঁতকে উঠেছিলেন।অতএব কাঁপা কাঁপা হাতে প্রথমে খামটা উঠালেন তিনি।তারপর কপালের ঘাম মুছে কালো রঙের খামটা খুলে একটা চিঠি বের করলেন।জানি না এটা কিসের চিঠি।কিই বা লেখা আছে,এই চিঠিতে।একটু জোরেশোরেই এহসানুল ভাই চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন।

"চিঠিতে লেখা ছিল :-


অপরাধ করেছিল বিধায় প্রান হারিয়েছে।আমি কখন,কোথায়,কিভাবে কার সাথে জড়িয়ে পরি সেটা নিজেও জানি না।রুহি নামের মেয়েটা এখনো বেঁচে আছে।তবে আর কতক্ষণ বাঁচবে সেটা আপনাদের উপর নির্ভর করছে।চাঁদপুর লঞ্চ টার্মিনালের বাম পাশে "এইট স্টার" নামক একটা পরিত্যাক্ত জাহাজে,সে রয়েছে।অবস্থা বেশ খারাপ।কাছের লোকেরাই খুন করবে ওকে।যত দেরি করবেন, ওর বাঁচার আশংকা ততই কমে যাবে।

--------------

সেরু ভাই 


(৩)

চিঠিটা আমার কথা বলার ভাষা কেঁড়ে নিলো।উত্তাপ্ত দেহকে শীতলে পরিণত করলো।প্রতিটি শব্দ আমাকে অবাক,আশ্চর্যের শেষ সীমানায় দাঁড় করালো।বাকরুদ্ধ হয়ে আমি বললাম,

- সেরু ভাই কে?আমার ছাত্রী রিহানার খুনটা কি সেরু ভাই করেছে?কেনো খুন করলো?কি দোষ ছিল রিহানার?আর রুহি বেঁচে আছে,এটা কি করে পসিবল!সেরু ভাই জানলো কিভাবে,আমার স্ত্রী রুহি এখনো বেঁচে রয়েছে!তাছাড়া রুহিকে কেনো,কি কারণে কে বা কারা খুন করতে চায়?এছাড়াও গাড়ীর চাপায় তাহলে কার মৃত্যু হয়েছিল?কার লাশকে জানাজা পড়ানোর পর সেদিন দাফন দেওয়া হয়েছিল।হচ্ছে কি এসব!


 

জবাবে নরম কন্ঠ স্বর ব্যবহার করে এহসানুল ভাই বললেন,

- সেরু ভাই হলো এমন একজন ব্যক্তি,যে সব সময় নিজেকে রহস্যের অন্ধকারে ঢেকে রাখতে বেশি সাচ্ছন্দ্য'বোধ করে। মূলত সে একজন ফাঁসির আসামী ছিল।আজ থেকে প্রায়ই দু-বছর আগে ওর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। কিন্তু সেদিন তার ফাঁসি হয়নি।পূর্বপরিকল্পিত ভাবেই পালিয়ে গিয়েছিল।তবে 'ও' এখন পর্যন্ত যাদেরকেই খুন করেছে কিংবা করবে,তারা প্রত্যেকেই বড় কোনো না কোনো অন্যায়,অপরাধ করেছিল অথবা সেই সবের অংশীদার অর্থাৎ যুক্তছিল।ওর চোখের দৃষ্টিকোণে যারাই একবার দোষী হিসেবে সিলেক্টেড হয়ে যায়, তাদের মৃত্যুটা হয় খুবই নৃশংসতার সাথে।ওর লেখা সুশীল ভাষার চিঠি আজ পর্যন্ত কখনো মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি।ও কখন,কোথায়,কিভাবে কার সাথে জড়িয়ে পরবে সেটা হয়তো ওর নিজেরও সঠিক জানা নেই।এখন আর কথা বাড়ালে চলবে না।তোমার স্ত্রীকে বাঁচাতে হলে,দ্রুত আমাদের এখন চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে গমন আরম্ভ করতে হবে।আর একটুখানির জন্যেও সময় ব্যয় বা অপচয় করা যাবে না।সময়ের মূল্য বুঝতে হবে।তুমি এখনি গাড়িতে গিয়ে বসো।আমি থানায় কল করে লাশটা'কে বাড়ি থেকে পোস্ট মর্টেমের জন্য নিয়ে যেতে বলেই আসছি।

 


এখনো মনে অসংখ্য প্রশ্ন জমা হয়ে থেকে গেলেও আর কিছুই বলিনি, আমি। রুহির জন্য আমার মন প্রাণ সব উতলা হয়ে পরছে।জানি না সত্যিই রুহি আদৌও কি বেঁচে আছে! যদি বেঁচে থাকে, তাহলে না জানি কিরূপ করুণ পরিস্থিতিতেই না,এই মুহূর্তে সে রয়েছে।অতঃপর রিহানাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।যার একটু-বাদেই দ্রুত বেগে এহসানুল ভাই এসে আমার পাশা-পাশি বসলেন এবং তাড়া-হুড়োর কন্ঠেই গাড়ির ড্রাইবারকে নির্দিষ্ট গন্তব্য'স্থলে যত'দ্রুত সম্ভব নিয়ে যেতে বললেন।চোখ দুটো বন্ধ করে সম্ভবত ভাবাতে বিভোর আমি।কিছুই বুঝতে পারছি না।চোখের পলকেই কি সব হয়ে গেল।অভাবের সংসার হলেও আমরা অল্পতেই ভিষণ হাসি'খুশি আনন্দে ছিলাম।কিন্তু সুখ রইলো না কপালে!দুজনে একটু সুখেই তো থাকতে চেয়েছিলাম।তবে আমাদের সাথে কেনোই'বা এমন হলো?দুনিয়াতে আর কোনো মানুষ 'কি ছিল না?কেনো এমন হয়,প্রতিবার হৃদয় পোড়ানোর যন্ত্রণায় আমাকেই ছাই হতে হয়।

 


আচমকা এহসানুল ভাই বলে উঠলেন,

- আমাদের যেতে যেতে হয়তো অনেকটাই দেরি হয়ে যাবে।তাৎক্ষণিক তোমার স্ত্রীর ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আশংকা অনেক বেশি।তাই সেখান'কার নিকটবর্তী থানায় একটু আগেই ফোন করে আমি সব জানিয়ে দিয়েছি।তারা হয়তো এতক্ষণে মূল স্থান অর্থাৎ পরিত্যাক্ত সেই জাহাজের কাছাকাছি চলেও গিয়েছে।তাড়াহুড়োয় মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি সব অতি সহজেই লোপ পেয়ে যায়।বিপদ কালীন মুহূর্তে এই সব হ্রাস পেলে চলবে না। কিছুতেই না।


 

একটু অবাক হয়েই আমি বললাম,

- আপনি ফোনে কখন কথা বললেন?আমি তো পাশেই ছিলাম। কই শুনলাম না তো?


- ভাবনার ঘোরে নিজেকে হারিয়ে বসলে শুনবে কি করে? 

 


কথাটা তিনি আমায় গম্ভীর ভাবে বললেন।এর কোনো জবাব আমি দিলাম না।আবার ভাবাতে বিভোর হয়ে পরলাম।কিন্তু হঠাৎ বেজে ওঠা এহসানুল ভাইয়ের ফোনের রিংটোন আমার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালো।তিনি ফোন রিসিভ করে ছয় মিনিটের মতো কথা বলার পর খানিক্ষণ চুপ করে থেকে,পরক্ষণেই বিস্মিত কন্ঠ স্বরে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,

- চিঠিতে উল্লেখিত থাকা চাঁদপুর লঞ্চ টার্মিনালের বাম পাশে এইট স্টার নামক সেই পরিত্যাক্ত জাহাজেই তোমার স্ত্রীকে পাওয়া গেছে। 

 


এতক্ষণ যাবত চোখের জল-গুলোকে,আমি বহু বাধার সম্মুখীন হয়েই আঁটকে রেখেছিলাম।কিন্তু আর পারলাম না।অনেকটা কান্না জড়ানো কন্ঠেই বললাম,

- কিহ!রুহি এখন কোথায়?ঠিক আছে তো?


- রুহিকে ইমিডিয়েটলিই সেখান'কার একটা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অবস্থা মোটেও ভালো না।


 

ডান হাত দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল-গুলো মুছে নিয়ে আমি বললাম,

- এ-সব কিছুর পেছনে কে ছিল এহসানুল ভাই?ওখানকার পুলিশ কি "আপনাকে আর কিছু জানিয়েছেন?


- পুলিশ আসার পূর্বাভাস ওরা আগেই পেয়ে গিয়েছিল।পালিয়ে বেঁচেছে কোনো মতে।তবে খুব শীঘ্রই সব রহস্যের উন্মচোন হবে।এখন নিজেকে সামলাও তুমি।আর নেগেটিভ চিন্তাধারা মাথার গহীনে একদমই নিয়ে আসবে না।নেগেটিভকে বের করে দেও। পজিটিভের প্রবেশ ধার খুলে দাও।তোমার স্ত্রীর কিছুই হবে না।


 

অতএব এহসানুল ভাই আর কিছু বললেন না।চুপ হয়ে গেলেন।আমিও আর কিছু না বলে চুপ করে নিস্তব্ধ হয়ে রইলাম।নিজেকে সামলে নেওয়ার যতই চেষ্টা করছি ততই সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।বাম হাত আমার কাঁধে রেখে,এহসানুল ভাই বৃথাই আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।অবশেষে দীর্ঘ ঘন্টার জার্নির পর হাসপাতালে এসে পৌঁছালাম।যে হাসপাতালে রুহিকে এডমিট করা হয়েছে। রুহির কেবিনে এখন প্রবেশ করা নিষিদ্ধ।ডাক্তার বারন করেছেন।গুরুতর অবস্থা। তাছাড়া ডাক্তার এটাও স্পষ্ট বলেছেন, রুহিকে প্রচন্ড ভাবে ট'র্চার করা হয়েছে।আরও কিছুক্ষণ টর্চার করা হলে,গর্ভের সন্তান'সহ উভয়ই হয়তো মারা যেতো।


 

দূর থেকে দাঁড়িয়ে প্রিয় মানুষটার পবিত্র মুখ'খানির দিকে তাকাতেই অন্তরমহলে আরও তীব্র আকারে কম্পিত অনুভব করলাম।আ'হ! ভালোবাসার মানুষ'টার কিরূপ করুণ অবস্থা!ওর মুখের দিকে কেনো জানিনা,আমি তাকাতেই পারছি না।খবর পাওয়ার দু-দুদিন পর রুহির মা-বাবা,আত্মীয়স্বজন সবাই হাসপাতালে ছুটে এসেছিল।কান্নায় ভেঙে পরেছেন তারা।অতঃপর এক প্রকার সবার সম্মুখেই রুহির বড় ভাই জাহিদকে এহসানুল ভাই প্রশ্ন করলেন,

- লাশটা'তো আপনিই শনাক্ত করেছিলেন,তাই না জাহিদ সাহেব?তা ঠিক কোন কারনে মনে হলো,ওটা আপনার ছোট বোন রুহিরই লাশ ছিল?


থতমত খেয়ে রুহির বড় ভাই জাহিদ বলল, 


গল্পঃ একটু_সুখেই_থাকতে_চেয়েছিলাম (পর্বঃ-৩)

লেখাঃ মোঃ_শাহরিয়ার 


 - লাশটা'তো আপনিই শনাক্ত করেছিলেন,তাই না জাহিদ সাহেব?তা ঠিক কোন কারনে মনে হলো,ওটা আপনার ছোট বোন রুহিরই লাশ ছিল?


থতমত খেয়ে রুহির বড় ভাই জাহিদ বলল,

- রুহির বাইশতম জন্মদিনে আমি ওকে একটা সোনার দামী চেইন উপহার সরূপ গড়িয়ে দিয়ে ছিলাম।যেটার ডিজাইন আমার নিজের তৈরী ছিল।স্বর্নকাররা শুধু সেই অনুযায়ী চেইনটি ডিজাইন করে বানিয়ে ছিলেন।মূলত সেই চেইনটাকেই কেন্দ্র করে নিজের বোন রুহি ভেবে লাশ শনাক্ত করেছিলাম।তাছাড়া ওই মেয়েটাও প্রায়ই রুহির সমবয়সী এবং অন্তঃসত্ত্বাও ছিল। 


একটু ভ্রু-কুচকে এহসানুল ভাই বললেন,

- লাশটার মুখ-খানি তো থেঁতলে গিয়েছিল। তা আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য কি ডিএনএ পরিক্ষা করান নি?


প্রত্যুত্তরে রুহির বড় ভাই জাহিদ সরু গলায় বলল,

- করেছিলাম তো।


- ফলাফল কি?পজিটিভ না নেগেটিভ ছিল?


- পজিটিভই ছিল।তাই তো আরও কনফার্ম হয়েছিলাম।


- বুঝেছি। অবশ্যই ডিএনএ রিপোর্টেই কোনো গোলমাল ছিল। তবে প্রশ্ন এখনো রয়েই গেল,তাহলে ওই মেয়েটা কে ছিল?মেয়েটার গলায় রুহির চেইন কি করে এলো?তাছাড়া আপনাকে আমি একটা কথা বলছি,একটু শুনুন জাহিদ সাহেব!আপনি চাইলে অলংকারের ব্যবসা শুরু করে দিতে পারেন কারণ এই পুলিশের চাকরির যোগ্য কিন্তু আপনি এখনো মোটেও হয়ে উঠেন নি। জানি না এই চাকরিটা আপনাকে কেইবা দিয়ে ছিল।

 


শেষে এহসানুল ভাইয়ের এরুপ কথায়,খানিকটা রাগ উঠলো রুহির বড় ভাই জাহিদের।যেটা স্পষ্টই তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল।কিন্তু জবাবে তিনি তেমন কিছু বলার সাহস পাননি।অতঃপর এহসানুল ভাই আমার কিছুটা কাছে এসে দাঁড়ালেন।ডান হাত আমার বাম কাঁধে রেখে বললেন,

- আই হোপ ইউর ওয়াইফ উইল নট বি হারমড।এখন নিজেকে খানিকটা সামলানোর চেষ্টা করো। সর্বদা তোমার রবের উপর ভরসা,আস্থা রাখো।দেখবে চোখের পলক ফেলার পূর্বেই সব ঠিক হয়ে যাবে।আচ্ছা তাহলে আমি এখন একটু বের হচ্ছি।ঘন্টা-খানিকের মধ্যেই ফিরে আসবো।          


 

অবাক হয়ে আমি বললাম,

- এখন আপনি কোথায় যাচ্ছেন এহসানুল ভাই?


- দরকারী কাজ আছে।রুহিকে যেই থানার পুলিশ ওই পরিত্যক্ত জাহাজ থেকে উদ্ধার করেছে,সেই থানাতেই যাচ্ছি।শীঘ্রই চলে আসবো।তাছাড়া সব কিছুর ইতি না টেনে তোমাদের ছেড়ে আবার দূরে কোথাও যাচ্ছি না, আমি।আর একটা কথা শোনো,যতই হোক রুহির মা-বাবা উভয় সম্পর্কে কিন্তু তোমার শশুর এবং শাশুড়ী হন।নিজেকে শক্তপোক্ত করো।তাদের পাশেও দাঁড়ানোর চেষ্টা করো।নিজের মেয়ের প্রতি যতই তাদের রাগ,অভিমান থাকুক না কেনো, তারা কখনোই নিজ মেয়ের এরূপ দুঃখজনক অবস্থা কাম্য করবেন না। কখনোই না।ওনারাও তোমার মতোই অনেকটা ভেঙে পরেছেন।


 

অতএব এহসানুল ভাই আর তেমন কিছুই বললেন না।সোঁজা-সাপ্টা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেলেন।যার একটু পরই ডাক্তার এসে বলল, রুহির অবস্থা এখন বেশ ভালো।মাঝ-রাত অথবা শেষ রাতের দিকে,ওর সেন্স ফিরতে পারে বলে ডাক্তার আশংকা করছেন।যা শুনে একটু হলেও অন্তত সুস্থির শ্বাস নিলাম।


প্রায়ই দু-ঘন্টা পর এহসানুল ভাই আবার হাসপাতালে ফিরে এসেছিলেন।ওনাকে দেখা মাত্রই আমি প্রশ্ন করলাম, 

- কিছু জানতে পেরেছেন?

 

 উত্তরে হতাশাযুক্ত গলায় বললেন,

- না।এখন মনে-মনে শুধুই রুহির সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছি।একমাত্র রুহিই বলতে পারবে,তারা কে ছিল।আচ্ছা রুহির কন্ডিশন এখন কেমন।আগের চেয়ে ভালো তো?আমি যাওয়ার পর কি ডাক্তার কিছু বলেছেন? 


- হ্যাঁ।রুহির অবস্থা এখন বেশ উন্নত।মাঝ-রাত বা শেষ রাতের দিকে ওর জ্ঞান ফিরতে পারে বলে,আশংকা করছেন ডাক্তার।


- তাই যেন হয়।


 

অতএব এহসানুল ভাই আর কিছু না বলে একটা জায়গায় গিয়ে চুপ করে বসলেন।আমিও তেমন কোনো আর প্রশ্ন করলাম না।ওনার একটু পাশে গিয়েই বসে পড়লাম।আমাদের দুজনের চেহারাতেই গম্ভীরতা বিরাজমান।রাত ন'টা বাজে এখন।মাথা খানিকটা নিচু করে শুধুই রুহির কথা ভাবছি আমি,অনাবরত।পাশেই নিজের মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছিলেন,এহসানুল ভাই। আচমকা একজন নার্স এসে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,

- আজ রাতে পেশেন্টের সাথে কেউ একজন থাকাটা অত্যন্তই জরুরী।পেশেন্টের মা-বাবা অথবা তার হাসবেন্ড থাকতে পারবেন।


কথাগুলো বলার পর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না নার্সটি। হন-হনিয়ে চলে গেল।পেছন থেকে আলতো স্পর্শ করে এহসানুল ভাই বললেন,

- কি বলল নার্সটি? 


- আজ রুহির কেবিনে একজনকে থাকতে বলেছেন।আমি বরং রুহির মা-বাবাকে গিয়ে বলছি,তাদের মাঝে কেউ একজন থাকুক।


- না। দাঁড়াও!


- কেনো?


- আমার মনে হয় আজ রুহির সাথে তোমার থাকাটা বেশি আবশ্যক। কারণ এরূপ পরিস্থিতিতে একজন স্ত্রী সব-সময় নিজের স্বামীকেই পাশে চাইবে।রাত তো কম হলো না।তুমি বরং-চো এখনই রুহির কেবিনে চলে যাও। আর আমি গিয়ে রুহির মা-বাবাকে বলছি,সবটা। 


- কিন্তু এহসানুল ভাই?


- নো বাট! "গেট 'ইনসাইড 'দ্যা কেবিন"।


কিছুটা ধমকানোর সুরেই কথাটা তিনি আমায় বলেছিলেন।আমিও আর কোনো রূপ কথা বাড়ালাম না।সোঁজা-সাপটা রুহির কেবিনের ভেতরে চলে আসলাম।রুহির ক্ষতবিক্ষত মুখচ্ছবিটার দিকে তাকাতে,কোনো মতেই পারছিলাম না আমি।একজন গর্ভবতী নারীকে কেউ এতটা টর্চার, প্রহার,আঘাত করতে পারে?মানুষ যে এতটাই পাষাণ হয় তা জানা ছিল না আগে।সঠিক জানিনা আমি, কখন অশ্রু জড়াতে,জড়াতে নিদ্রায় অটল হয়ে পরেছিলাম।তবে মাঝ-রাতে আমার নিদ্রা ভেঙে যায়,কারো যন্ত্রণার আর্তনাদে।চোখ মেলে তাকাতেই ঘুমের ঘোর মুহূর্তেই কেটে যায় আমার।

|

অশ্রুতে নয়ন ভিজিয়ে আমি বললাম,যাক!অবশেষে তাহলে রুহির জ্ঞান ফিরলো।নিজের দৃষ্টি গোচরের সীমানায়,আমাকে দেখা মাত্রই যেন থেমে যায়,রুহির সমস্ত ছটফটানি।এক মনে,দৃষ্টিতে রুহি শুধু আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।চোখের পলক একবারও ফেলছে না।হয়তো আজ মন প্রাণ ভরে দেখছে আমায়। নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না আমি।রুহির খুবই নিকটে গিয়ে বসলাম।ওর একটা কোমল হাত আমার গালে আলতো করে চেপে ধরলাম এবং বললাম,

- জানো রুহি আজ অনেকটা দিন হলো,তুমি এমন করে আমায় আর আদর করোনি।


প্রত্যুত্তরে কিছু বলার চেষ্টা করেছিল রুহি। কিন্তু বলতে পারলো না। কথা বলতে হয়তো কোনো প্রকার সমস্যা হচ্ছিল, রুহির।চোখের কোণ থেকে অশ্রু জড়ছে রুহির।হাত দিয়ে হাল্কা স্পর্শ করে জল গুলো মুছে দিলাম।কপালে একটা চুমু দিয়ে বললাম, খুব ভালোবাসি তোমায়। 


পরের দিন সকালে রুহির মা-বাবা,পরিবার,আত্মীয়-স্বজন সবাই'ই সমস্ত রাগ,অভিযোগ,অভিমান ভুলে গিয়ে রুহিকে ঘিরে কান্নায় ভেঙে পরে।সে দিন রুহি, চোখের অশ্রু গড়ানো ছাড়া আর তেমন কিছুই বলতে পারেনি।আজ দুই-সপ্তাহের মতো কেটে গেল। আগের চেয়ে রুহির অবস্থা এখন অনেকটাই উন্নত। আগে কথা বলার চেষ্টা করলে রুহির ভিষণ কষ্ট হতো কিন্তু এখন আর সেটা হয়না।


বেশ খানিক্ষণ গম্ভীর ভাবে চুপচাপ বসে থাকার পর উঠে দাঁড়িয়ে এহসানুল ভাই, রুহির উদ্দেশ্যে কিছু বলার পূর্বেই রুহি বলে ফেললো,

- আমি ভাবতেও পারিনি আমার একটা ফোনেই আপনি সত্যি চলে আসবেন।আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো,এহসানুল ভাই।


- এটা আমার কর্তব্য ও দায়িত্বের মধ্যে ছিল।এখন তুমি আমায় বলো, তোমাকে কে বা কারা,কেনো চাঁদপুর টার্মিনালের বাম পাশে অবস্থানরত ওই পরিত্যাক্ত জাহাজে নিয়ে গিয়ে খুন করতে চেয়েছিল?তাদের উদ্দেশ্য কি ছিল? 


বিস্মিত কন্ঠ স্বরে জবাবে ধীরে ধীরে রুহি বলতে লাগলো,

- এই সব কিছুর পেছনেই আমার কিছু আপন লোকজন জড়িত ছিল।যারা আর কেউ নয় স্বয়ং আমার নিজেরই আপন মামা-মামী এবং তাদের একমাত্র ছেলে,আসিফ।মূলত আমাকে বাবা শুধু তার সমস্ত ধনসম্পদ থেকে বঞ্চিত করার পর ত্যাজ্য সন্তান ঘোষণা করেছিল।তবে নানা বাড়িতে আমার নামে থাকা বেশ খানিকটা ধন-দৌলত, জমি-জমা থেকে কেউই আমায় বহিষ্কার করতে পারেনি।যেগুলো মৃত্যুর পূর্বে নানা-নানি আমার নামে লিখে দিয়ে গেছিলেন।অনেক আগে থেকেই মামা-মামী উভয়েরই এসবের প্রতি প্রচুর লোভ ছিল,বড় কোনো ধরনের স্বার্থ ছিল।তবে কি সেটা, জানিনা। তারা খুব করে চাইতেন এসব ধন-দৌলত,জমি-জমা নিজেদের তত্বাবধানে করে নিতে।কিন্তু প্রতিবারই ওনারা ব্যর্থ হতেন।তাই বোধ হয় বিভিন্ন কায়দা অবলম্বন করে, আসিফের সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল।অবশ্য বিয়ের প্রস্তাব সর্ব-প্রথম মামাই আগে,বাবাকে দিয়ে ছিল।যাতে আমার বাবা প্রথমে সহমত না হলেও পরবর্তীতে নির্দ্বিধায়,হ্যাঁ সম্মতি প্রকাশ করে।বাবাকে আমি অনেকবার বিভিন্ন ভাবেই বুঝিয়ে ছিলাম। এবং এটাও বলেছিলাম, আমি একজনকে ভালোবাসি কিন্তু শোনেনি।আমি শাহরিয়ারকে ভালোবাসতাম খুব।তাই সবার দ্বিমতে সেদিন শাহরিয়ারকেই বিয়ে করার পর দূরে কোথাও চলে এসেছিলাম।একটু সুখে থাকার আশায়।কিন্তু বেশি দিন সুখে থাকতে পারিনি।আমার স্বামীকে মিথ্যা একটা অভিযোগে ফাঁসানো হলো। প্রিয় ভালোবাসার মানুষটি প্রথমবারের মতো জেলে গেল।তখন বুক-খানি আমার,যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছিল।সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কেউ ছিলনা।তবুও মনে ছিল দীর্ঘ বিশ্বাস।একই থানায় ভাইয়া ট্রান্সফার হয়ে এলো। যা আমার কল্পনারও শত গুন দূরে ছিল।অবশ্য ভাইয়ার মাধ্যমেই আমাদের ব্যাপারটা আত্মীয়-স্বজন প্রায়ই সবার নিকটে গিয়ে পৌঁছে।এতদিন যাবত আমরা, কোথায় বসবাস করে আসছিলাম সেটা মামা-মামি অথবা তাদের ছেলে আসিফও জানতো না।তাই চাইলেও তারা আমার তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি।

|

যখন জানলো তখন আর খামতি মেরে বসে থাকেনি।ষড়-যন্ত্রের কৌশ আটলো।পূর্ব-পরিকল্পনা মোতাবেক "একটা মেয়ের সাহায্যে আমাকে জনবহুল স্থান থেকে ভুল-বাল বুঝিয়ে নির্জনের দিকে নিয়ে আসা হলো।অতঃপর আমাকে জোর-জবরদস্তি করে গাড়িতে তোলা হয়। সাহায্যের জন্য আশে-পাশে কোনো মানবের ছিটে-ফোঁটাও ছিল না।যে গাড়িতে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেই গাড়ির নিচেই ব্যবহৃত সেই মেয়েটাকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলা হয়।তারপর আমার গলার সোনার চেইনটা ওই মেয়েটির লাশের গলায় পড়ানো হয়েছিল।  

|

এমনকি পোস্ট মর্টেম রিপোর্টেও ভেজাল বাঁধানো হয়।যে রিপোর্টের ভুল-ত্রুটি একজন দক্ষ,বুদ্ধিমান এবং মেধাবী অফিসার ছাড়া কারো ধরার সাধ্যে ছিলনা।পরিশেষে মামা-মামী যেটা আশা করেছিল, সেটাই হয়।ওই মেয়েটির লাশটিকে ভাইয়া আমায় ধরে নিয়ে বড় ভুল করেছিল।মামা-মামি সম্পত্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধতায় থাকলেও তাদের মনে খুন করার কোনো চিন্তাধারা প্রথমে ছিলনা।ওপর দিকে আসিফের সীমাবদ্ধতা ছিল অনেকটা দূর পর্যন্ত।আমাকে খুন করার নেশায় ''ও'' নেশাকর হয়ে ওঠে।কারণ আসিফও আমাকে বেশ একটা বোধ হয় ভালোবাসতো।আমায় নিজের করে না পাওয়ার যন্ত্রণা রাগ,ক্ষোভ ছিল ওর নোংরা দূষিত ময়লাযুক্ত মনে।অবশ্য পরবর্তীতে আসিফের উস্কানি মূলক কথাতেই মামা-মামী আমায় খুন করার ব্যপারে আরও গভীরতায় চলে যান।

 


এতক্ষণ চুপ-চাপ রুহির বলা কথা-গুলো শুনছিলাম।স্তম্ভিত হয়ে সবাই যারযার অবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে।এহসানুল ভাই বলল,

- সব বুঝলাম।জড়তা কমলো।তবে একটা কথা ওরা প্রোপার্টি গুলো, তোমার কাছ থেকে লিখে নিতে কি সক্ষম হয়েছে? 


- হ্যাঁ।ওরা খুব টর্চার করে ছিল, আমায়।সহ্য হচ্ছিল না।কিন্তু সই করে দেওয়ার পরেও টর্চার কমায়নি।তিল-তিল করে মেরে ফেলতে চেয়ে ছিল।আপনি দ্রততার সাথেই এখন কিছু করেন।ওদের প্রত্যেক কেই গ্রেফতার করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করুন।


- চিন্তা করো না।পুলিশকে আমি অনেক আগেই ইনফর্ম করে দিয়েছি।

 

বেশ আশ্চর্য হয়ে রুহি বলল,

- পুলিশকে কখন জানালেন?


জবাবে এহসানুল ভাই বললেন,

- প্রথমেই যখন তোমার মামা-মামি এবং তাদের ছেলে আসিফের নাম বলেছিলে,তখনই মেসেজে পুলিশকে আমি সব জানিয়ে দিয়েছি।যা তুমি সহ কেবিনে উপস্থিত থাকা কেউই লক্ষ করোনি।এতক্ষণ হয়তো তারা পৌঁছেও গিয়েছে।ফোন আসার অপেক্ষায় আছি।


কথাটা সময় নিয়ে বললেও এহসানুল ভাইয়ের ফোন বেজে উঠতে বেশি সময় লাগেনি।কথা শেষ করার পরপরই আচমকা এহসানুল ভাইয়ের ফোন বেজে উঠলো।অবস্থানরত সবার এখন মূল কেন্দ্র মুখ হচ্ছে এহসানুল ভাই।অতএব ফোন রিসিভ করে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফোন কেটে দিলেন, তিনি।


রুহি বলল,

- কে ফোন করেছিল আর কি বলল এহসানুল ভাই?


গম্ভীর গলায় এহসানুল ভাই বলল,

- পুলিশ ফোন করেছিল।আসিফের লাশ তার নিজের বাড়িতে পাওয়া গেছে।কিন্তু আসিফের মা-বাবা অর্থাৎ তোমার মামা-মামী নিখোঁজ।দ্রুতই তাদের খুঁজে বের করে গ্রেফতার করতে হবে।আইনের আওতায় আনতে হবে।নতুবা -ও" নিশ্চিত বাঁচতে দিবে না।


হতবাক হয়ে রুহি বলল,

- মানে বুঝলাম না। কে বাঁচতে দিবে না? আর আসিফ কি করে মারা গেল? 


- দুটোর উত্তর কিন্তু একটাই সেটা হলোঃ- সেরু ভাই।


কথাটা বলতে একটু দেরি করলেও কেবিন থেকে চলে যেতে এহসানুল ভাই একটুও দেরি করেন নি।কাউকে কোনো কিছু বলার সুযোগ দেননি, তিনি।যাওয়ার আগে অনেক তাড়াহুড়োয় বলে গেলেন, দ্রুতই আবার ফিরে আসবেন।এহসানুল ভাই চলে যাওয়ার পর-পরই রুহিকে ওর মা জড়িয়ে ধরলো।জলে দু-নয়ন জোড়া ভিজিয়ে বললেন,

- আমাদের ক্ষমা করে দিস মা।আমরা বেঠিক ছিলাম।তুই ঠিক ছিলি।সঠিক মানুষকে বেছে নিয়ে ছিলি।ভুল আমরা করেছিলাম।ভুল মানুষকে তোর জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে।


অতঃপর বেশ কিছুক্ষণ রুহির সাথে ভালো মন্দ কথা বলার পর, আস্তে ধীরে সবাই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।এই মুহূর্তে আমি ও রুহি ছাড়া আর কেউই কেবিনে নেই।চোখের ইশারায় আমায় কাছে ডাকলো রুহি।নরম হাত দিয়ে আমার গাল দুটো হাল্কা স্পর্শ করলো এবং নিজের সাথে আকরে ধরে বলল,

- কত দিন তোমায় এভাবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরিনি,শাহরিয়ার।


জবাবে কিছু বললাম না আমি।একটু মুচকি হাসলাম৷সময়ের তীব্র গতি সীমায় আজ বেশ কয়েক মাস পার হলো।রুহির মামা-মামিকে কয়েক মাস পূর্বেই গ্রেফতার করা হয়েছে।কিন্তু এখনও আমার ছাত্রী বা তার মায়ের ব্যপারটা ঠিক মতো ক্লিয়ার হয়নি।তদন্ত জারি রয়েছে।বর্তমান ঢাকা হাসপাতালে রয়েছি।কারণ রুহির ডেলিভারির সময় অতিই নিকটে।সবেই মাত্র রুহিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।রুহির বড় ভাই এবং তার স্ত্রী বাদে সবাই হাসপাতালে উপস্থিত আছে।তাদের না আসার কারণ আমার অজানাই বটে।এহসানুল ভাই আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। অল্প কিছুক্ষণ হলো তিনি নিজের বাড়ি থেকে অনেকটা দূর ঢাকায় এসেছেন।টায়ার্ড দেখাচ্ছে ওনাকে।হঠাৎই হুটহাট কোথা থেকে যেন আচমকা একটা পিচ্চি ছেলে এসে,এহসানুল ভাইয়ের দিকে একটা খাম এগিয়ে বলল,

- আঙ্কেল একটা লোক আপনাকে হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিয়ে এই খামটা দিতে বলল।

 


খামটার দিকে ভালো করে তাকাতেই এহসানুল ভাই সহ আমিও অনেকটাই অবাক হলাম।মনের ভেতরে ভয় হতে লাগলো, এটা সেরু ভাইয়ের খাম নয় তো?দ্রুতই পিচ্চি ছেলেটার হাত থেকে খামটা নিজের তত্ত্বাবধানে আনলো এহসানুল ভাই।এরপর আমার দিকে কয়েকবার তাকানোর পর খামটা খুললেন এবং ভেতরে থাকা চিঠিটির প্রতিটি বাজ খুলে আমার শোনার মতো করে এহসানুল ভাই পড়তে শুরু করলেন।

"চিঠিতে লেখা ছিলঃ-


দু-মিনিট পর ডাক্তারটি মারা যাবেন।রুহি নামক মেয়েটার ডেলিভারী করতে হলে,শিগগিরীই নতুন কোনো ডাক্তারের ব্যবস্থা করুন।বরিশালের বিষখালি নদীতে জাহিদের রক্তাক্ত বস্তাবন্দী লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে, কিছুক্ষণ আগেই।এটা মোটেও ভেবে বসবেন না,আমি খুনটা করেছি।ওকে স্বয়ং ওর নিজের প্রাণ-প্রিয় স্ত্রীই খুন করিয়েছেন।কেনো খুন করিয়েছে সেটা আপনি বরংচো নিজেই খুঁজে বের করুন।তবে খানিক্ষণ পরই আমি ওর স্ত্রী রাহিলাকে খুন করবো।

----------------

সেরু_ভাই 

 

গল্পঃ-একটু_সুখে_থাকতে_চেয়েছিলাম

পর্বঃ- ৪ এবং শেষ)

লেখাঃ মোঃ_শাহরিয়ার 

 

রুহিকে নিয়ে নানা টেনশনের ভিড়ে চিঠিতে থাকা, এই লেখা গুলো আমার ভয় ভীতি যেন আরও দ্বিগুন আকারে সমৃদ্ধ করলো।একের পর এক হচ্ছে কি এসব?অবাক করা চাহনিতে এহসানুল ভাইয়ের দিকে তাকালে, তিনি আমাকে কিছু বলার আগেই আচমকা অপারেশন থিয়েটার থেকে একজন নার্স বেরিয়ে আসলো।নার্সটির মুখচ্ছবি দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি বেশ আতংকে রয়েছেন।

মুহূর্তেই নার্সটি হৈচৈয়ের সুত্রপাত ঘটিয়ে কাঁপাকাঁপা কন্ঠ স্বরে বললেন,

- ভেতরে, ডা. সবুজ চৌধুরী স্যার লুটিয়ে পরেছেন।ওনার শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রমে।নাক ও কান দিয়ে প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে।জানিনা হঠাৎ করেই কি হয়ে গেল, স্যারের।আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।তাছাড়া পেশেন্টের অবস্থাও অনেকটাই সিরিয়াস কন্ডিশন!দ্রুতই ডেলিভারি করতে হবে।নতুবা যেকোনো মুহূর্তে, যা কিছু হয়ে যেতে পারে। এটা সুনিশ্চিত।

 


নার্সটির এরূপ কথা প্রায় সবাইকে নিমিষেই বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিলো।নার্সটির কথা শুনে তাড়াহুড়ো করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বেশ ক'জন লোক ভেতরে ঢুকলো।তৎক্ষনাৎ ডা. সবুজ চৌধুরীকে তারা মৃত হিসেবে দেখতে পায়।অতঃপর খুব একটা দ্রুততার সাথেই অপারেশন থিয়েটার থেকে ওনার তাজা লাশটা বের করে অনত্রে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়।যার পরপরই অন্য একজন দক্ষ ও পারদর্শী ডাক্তার অপারেশন কন্টিনিউ করার জন্য থিয়েটারের ভেতরে প্রবেশ করে।ঘটনাটা সারা হাসপাতাল জুড়েই দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পরে; হৈচৈ, কোলাহল ও আতংকের সৃষ্টি করে।আগের চেয়েও এখন দ্বিগুন আকারে রুহির পরিবারের প্রত্যেকেই বেশ ঘাবড়ে রয়েছে।চিন্তা-দুশ্চিন্তা আমার মনকে ভেতর থেকে ক্ষয় করেই যাচ্ছে।মাথা কাজ করছে না।সব কিছুই আমার ঘোলাটে ঘোলাটে লাগছে। 


হঠাৎই এহসানুল ভাই সবার থেকে আমাকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বললেন,

- একটা রহস্য বেদ হতে না হতেই, জানিনা এটা আবার কোন রহস্যের সুত্রপাত হলো।আমার মাথাতেও কিছু ঢুকছে না।আচমকা এমন কিছু হবে, আমি ভাবতে বলতে কল্পনাও করিনি।ডা. সবুজ চৌধুরীর মৃত্যুর পিছনে যে সেরু ভাই আছে তা আমি কনফার্ম।জানিনা ডা. সবুজ চৌধুরীর কি দোষ বা অপরাধ ছিল।যার ফল সরূপ এভাবে প্রাণ হারাতে হলো।যে করেই হোক আমাকে সব জানতে হবে।তাছাড়া এখুনিই হাসপাতাল থেকে আমায় বের হতে হবে।জাহিদের স্ত্রীর প্রাণ সংশয়ে রয়েছে।দেরি হওয়ার আগেই আমাকে রুহিদের বাড়িতে পৌঁছুতে হবে।যে কোনো মূল্যে যেমনই হোক জাহিদের স্ত্রীকে সেরু ভাইয়ের রোষানল থেকে সর্বপ্রথম বাঁচানোটা নিতান্তই প্রয়োজন।নতুবা এই সব রহস্য উন্মোচন করা অনেকটা কঠিন হয়ে উঠবে।আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস।তোমার ভালোবাসার মানুষটির কোনো ক্ষতি হবে না এবং তোমার সন্তানও আশা করছি সহিসালামাতেই ভূপৃষ্ঠের আলো দেখতে পারবে।আর হ্যাঁ, জাহিদের স্ত্রীর ফোন নাম্বার এখন অতিই প্রয়োজন।তোমার কাছে তো থাকার কথা?


- হ্যাঁ আছে। এই যে নিন, নাম্বার।


- সুইচটপ বলছে।আচ্ছা শোনো, তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি বা কাউকেই এই বিষয়ে এখন কোনো কিছু জানাবে না।এই মুহূর্তে ওনারা রুহিকে নিয়ে অনেকটাই দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন।তার মাঝে এতোকিছু আমার মনে হয়না তারা সহ্য করে নিতে পারবে।তুমি এদিকটা সামলানোর চেষ্টা করো।আমি ওদিকটায় দেখছি।


 

জবাবে কিছু বললাম না আমি।এহসানুল ভাইও আর কিছু বললেন না।তাড়াহুড়ো করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেলেন।যার ঘন্টাখানিক পর, ঘড়িতে তখন রাত নয়-টা আট বাজছিল।অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এলো।

সঙ্গে সঙ্গে আমার শ্বশুর শাশুড়িসহ, আমি বেশ উত্তেজিত হয়েই ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম,

- রুহি ঠিক আছে? ওর কোনো ক্ষতি হয়নি তো?


জবাবে ডাক্তারটি একটু মুচকি হেঁসে বলল,

- Yes both the patient and her child are healthy

    (হ্যাঁ রোগী এবং তার সন্তান দু'জনেই সুস্থ আছেন।)

উনি একটি পুত্র সন্তানের জননী হয়েছেন।আপনারা একটু ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করুন।খানিকটা সময় পর তাদের একটা কেবিনে নিয়ে যাওয়া হলেই দেখতে পারবেন।আর হ্যাঁ, পেশেন্টের জ্ঞান ফিরতে একটু দেরি হবে।


ডাক্তারের কথা গুলো শোনা মাত্রই চিন্তা দুশ্চিন্তায় মনের ভেতরে ক্ষয় হয়ে যাওয়া স্থানে যেন, প্রশান্তির বাতাস বইতে লাগলো।অতএব ডাক্তারটি চলে গেল।পরিশেষে রুহি ও আমার নবজাতক সন্তানকে একটা কেবিনে নিয়ে আসা হলে, সর্বপ্রথম আমিই আমার সন্তানকে কোলে তুলে নিয়ে ছিলাম।কি সুন্দর ফুটফুটে চেহারা।দেখতে একদম রুহির মতোই।কোনো ব্যাশকম দেখছি না।তবে রুহির এখনো জ্ঞান ফিরেনি।


আমার নবজাতক সন্তানকে কোলে নিয়ে রুহির মা অর্থাৎ শাশুড়ি আম্মা আনন্দে যেন দিশে হারা হয়ে উঠেছেন। কিন্তু রুহির বাবা বেশ অনেকটাই চিন্তিত।তিনি খানিকটা সময় পরপরই ওনার বড় ছেলে জাহিদ ও পুত্রবধু রাহিলাকে কল করেই যাচ্ছেন৷হয়তো সংবাদটা দেওয়ার জন্য।কিন্তু তাদের উভয়েরই ফোন বন্ধ।যা অবশ্য স্বাভাবিক।শাশুড়ি মায়ের কোল থেকে আমার নবজাতক সন্তানকে নিজের কোলে নিতেই চিন্তার সব হাবভাব কেটে গেল, রুহির বাবার।মুখে এক ঝলক হাঁসি ফুটে উঠলো।জানিনা, এই হাঁসি আনন্দ আর কতক্ষণই বা ওনাদের মুখে থাকবে।একটু আগেই এহসানুল ভাই ফোন করে আমায় জানালো, জাহিদের স্ত্রীকে তিনি বাঁচাতে পারেন নি।পৌঁছানোর ছিয়াশি সেকেন্ড পূর্বেই ওনার মৃত্যু ঘটেছে।যেভাবে ডা. সবুজ চৌধুরীর মৃত্যু হয়েছিল।তাছাড়া এটাও এহসানুল ভাই বলেছিল,

বরিশালের বরগুনা জেলার ছোট্ট একটা লঞ্চঘাটের কিণারায় কোনো একজন পুরুষের বস্তাবন্দী নৃশংস লাশ পাওয়া গেছে।যে লাশ'টা আর কারোই নয়, স্বয়ং রুহির বড় ভাই জাহিদের।যদিও এসব রুহির পরিবারকে এখন সবটাই আমায় জানিয়ে দিতে বলেছিলেন এহসানুল ভাই।কিন্তু আমি বেশ সংকোচ বোধ করছি।কিছুতেই কিছু বলতে পারছি না।ওনাদের সামনে গেলেই আমি বোবাতে রুপান্তর হচ্ছি। এমন একটা খুশীর মুহূর্তে তাদের কি করেই'বা এই সব জানাবো, আমি?

ত্রিশ মিনিট পর হঠাৎ কেবিনের বাহিরের দিকটায় এহসানুল ভাইয়ের কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম।হয়তো তিনি এসে পরেছেন।অতঃপর এহসানুল ভাই ভেতর আসলো।বেশখানিক্ষণ চুপ করে থাকার পর চোখের ইশারায় আমায় তিনি কেবিনের বাহিরে নিয়ে গেলেন এবং গম্ভীর গলায় বললেন,

- তুমি এখনো জানাও নি, সবটা?


আমি বললাম,

- আমার এই শূন্য মস্তিষ্কের গহীন ঘরে কিছুই ঢুকছে না, এহসানুল ভাই!আমি কিভাবেই এমন একটা মুহূর্তে ওনাদের এসব কথা বলবো?


- কিচ্ছুই করার নেই।ওনাদের সব জানাতেই হবে।ভেতরে চলো।তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি উভয়কেই সামলাতে হবে।কারণ আমার কথা গুলো ওনাদের ভেঙে পরতে সাহায্য করবে।


অতএব এহসানুল ভাই আর কোনো কথা বাড়ালেন না।সোঁজাসাপটা কেবিনের ভেতরে চলে গেলেন।পরিশেষে কিছুটা ধীর কন্ঠেই ওই দিন সবাইকে সবটা পরিষ্কার করে বলে দিয়েছিলেন তিনি।সেদিন রুহির বাবাকে সামলানোটা আমার নিকট সবচেয়ে বেশি কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে উঠেছিল।

 

আজ আট দিন অতিক্রম হলো।বর্তমান হাসপাতালেই রয়েছি।আগামীকাল রুহিকে রিলিজ করা হবে।সবার মন মেজাজই এখনো বেশ খারাপ। বিশেষ করে রুহির বাবার।তিনি একটু পরপরই নিজের বড় ছেলে জাহিদের নৃশংস লাশের কথা মনে করে ডুকরে কেঁদে উঠছেন।আমার একটু পাশেই গম্ভীর, গম্ভীর মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এহসানুল ভাই।অবশ্য তিনি সব সময় গম্ভীর ভাব নিয়েই থাকেন।আচমকাই তিনি বলতে শুরু করলেন,

- জানি না, আমার বলা কথা গুলো আপনারা কিভাবেই বা নিবেন! "


কথাটা রুহির মা-বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এহসানুল ভাই।সল্প কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি আবার তাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

- নিজেদের সহন সীমা শক্ত করুন।লোভ মানুষকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে দেয়।এই সত্য কথাটির প্রচলন যুগযুগ ধরেই চলে আসছে।জাহিদ রাহিলাকে মোটেও পছন্দ করতো না।শুধু মাত্র আপনাদের পছন্দ-অপছন্দ জোরাজুরির জন্যই নিজের দু'বছর বারো মাস,উনত্রিশ দিনের ভালোবাসাকে কোরবান,বিসর্জন দিয়ে রাহিলাকে বিয়ে করেছিল।যদিও জাহিদের সাথে রাহিলাও তেমন সুখী ছিলনা।সবার অজান্তেই ঝগড়া হতো, তাদের।রুহিকে ত্যাজ্য সন্তান করার পর সমস্ত ধনসম্পত্তির উত্তরাধিকার ও মালিক একমাত্র জাহিদই ছিল।বলতে গেলে এসবের লোভে পড়েই জাহিদকে বিয়ে করা রাহিলার।পরবর্তীতে রুহির প্রতি আপনাদের সমস্ত রাগ অভিমান মিটে গেলে, যখন আপনারা রুহি ও তার অনাগত সন্তানের কথা ভেবে; সম্পত্তির তিন ভাগের দু-ভাগই রুহি ও তার সন্তানের নামে করার আলাপ-আলোচনা জাহিদের সাথে করছিলেন, তখন আড়াল থেকে রাহিলাও আপনাদের সব কথাই শুনছিল।যতই হোক নিজের ছোট বোন রুহিকে জাহিদ খুবই ভালোবাসতো।আদর,স্নেহ করতো।এতে জাহিদের কোনো আপত্তিই ছিলনা।বরংচো সব কিছুই লিখে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল, সে।ঠিক বলছি তো?কিন্তু এসব রাহিলার একদমই পছন্দ হয়নি।কারণ সে চেয়েছিল জাহিদের মাধ্যমে সমস্ত ধনসম্পত্তির উপরই নিজের বিস্তার ফেলতে।সব কিছু হাতিয়ে নেওয়ার চিন্তা-ধারা মনে পোষণ করেছিল, অনেক দিন যাবৎ থেকে।তবে সব কিছুই যেন রাহিলার হাত থেকে বেড়িয়েই যাচ্ছিল।

পরিশেষে জাহিদকে খুন করার জন্য বড়সড় প্লান সাঁজালো।সাবেক প্রেমিক ডা. সবুজ চৌধুরীর সহায়তায় রুহি এবং তার অনাগত সন্তানকে অপারেশন থিয়েটারেই মারার পরিকল্পনা করলো।একসঙ্গে দু'টো পথের কাঁটাকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য সরিয়ে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল, রাহিলা।জাহিদকে নিজের বাড়িতেই ধনসম্পত্তির সব রকমের কাগজ পত্রে সাইন করানোর পর ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়।তারপর খুবই সাবধানতা অবলম্বন করে বস্তাবন্দী লাশ ফেলে দেওয়া হয়, বিষখালী নদীতে।যদিও সেদিন দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় সেরু ভাই জাহিদকে একটা এসএমএস পাঠিয়ে সতর্কও করেছিল।বলেছিল, পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে।একটু পর রাহিলা তাকে খুন করবে।কিন্তু এসএমএস'টা অতটাও সিরিয়াস ভাবে নেয়নি, জাহিদ।যতটা না যার ঠিক তেরো মিনিট পর সিরিয়াস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।জাহিদের ওপর শুরু হয়ে গেছিল, নির্মম অমানবিক অত্যাচার।এর পেছনে আরও একজনের বিশেষ কিছু ভূমিকা এবং বেশ খানিকটা প্ররোচনাও রয়েছে।সে হলো রুহির মায়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী শায়লা অর্থাৎ রাহিলার মা।যে কথা তিনি নিজের মুখেই শিকার করেছেন।ধাপে ধাপে বিভিন্ন পরিকল্পনা, প্লানিং করে রেখেছিল তারা।কিন্তু শেষমেশ সব কিছুই বৃথা গেল, তাদের।তাছাড়া রাহিলার করা সমস্ত প্লানিং ভুলবসত যদিও'বা সাকসেস হয়েও যেতো, আমার মনে হয়না সে বেশিদিন এসব ভোগবিলাস করতে পারতো।কারণ তার শরীরে মরণব্যাধি ক্যান্সার ছিল।যা আমি রাহিলার পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট থেকেই জেনেছি।

লোভ-লালসা বড়ই মারাত্মক একটা জিনিস।একবার নিজের ভেতর জন্ম নিলে, তা শেষ করা বেশ কঠিন হয়ে ওঠে।খুব অল্প সংখ্যক মানুষ তা সংযত রাখতে সক্ষম হয়।বেশিসংখ্যক মানুষই নিজেদের লোভ-লালসা'কে সংযত রাখতে না পেরে ভুল পথে পরিচালিত হয়।


এতোক্ষণ যাবৎ এহসানুল ভাইয়ের কথা সবাই অনেকটা মনযোগ সহকারেই শুনছিলাম।রুহির বাবা-মা কোনো কথাই বলছে না।স্তব্ধ হয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছেন।রুহির চোখ থেকেও টপটপ করে গাল বেয়ে জল পড়ছে।পরিবেশটা এখন নিরবতার।খানিকটা সময় চললো, এমন।অতএব রুহি থমথমে নিরব পরিবেশটা ভেঙে দিলো। বলে উঠলো,

- ধনসম্পদ, ধনসম্পদ!সব কিছুরই শেষে বারবার এই ধনসম্পদের কথাই উঠে আসছে, কেনো? মা,বাবা, আমি কি কখনো তোমাদের একবারও ধনসম্পত্তি নিয়ে কোনো কথা বলেছিলাম?তাহলে কেনো ভাইয়ার সাথে আলাপ-আলোচনা করতে গেলে? আমিতো এসব কিছুই চাইনি, মা।শুধু একটা জিনিসই সর্বদা চেয়ে এসেছিলাম বাবা, একটু সুখে থাকতে। হ্যাঁ, একটু সুখে থাকতে চেয়েছিলাম।এর বেশি কিছু নয়।কিন্তু বিপদ যেন আমার পিছু লেগেই রয়েছে।কিছুতেই ছাড়ছে না।


জবাবে কিছুই বলতে পারলেন না, রুহির মা-বাবা।সেই পূর্বের ন্যায়েই নিরবে কাঁদছিলেন তারা। অতএব কেবিন থেকে বেড়িয়ে যেতে রইলে, আমি এহসানুল ভাইকে জিজ্ঞেসা করলাম,

- আমার ছাত্রী রিহানা এবং তার মায়ের ব্যাপারে'তো কিছুই বললেন না, এহসানুল ভাই?


জবাবে তিনি বললেন,

- ধৈর্য ধরো। শীঘ্রই এটার রহস্যও সব বেড়িয়ে আসবে। উপযুক্ত দোষীরা শাস্তি পাবে। 


কথা গুলো বলেই তিনি কেবিন থেকে বেড়িয়ে যান।

পরের দিন রুহিকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেওয়া হয়।

অতঃপর তীব্র গতিতে আজ চার মাসের মতো দিন কেঁটে গেল।স্ত্রী-সন্তান নিয়ে, বর্তমান আমি শ্বশুর বাড়িতেই অবস্থান করছি।তবে এখনো আমার ছাত্রী রিহানা এবং তার মায়ের ব্যাপারটা ঠিক মতো ক্লিয়ার করতে পারেননি, এহসানুল ভাই।

পনেরো দিন পূর্বেও নওগাঁ জেলার একটা বিখ্যাত জায়গায়, দ্বিতীয় বারের মতো সেরু ভাইকে ধরার অপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, এহসানুল ভাই।কিন্তু তিনি সেরু ভাই নামক ব্যক্তিটির তুখোড়, বুদ্ধি, বিচক্ষণতার সম্মুখে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি বিধায় অসফল হয়েছিলেন।


গভীর রাত।গল্প গুজবের একপর্যায় রুহি আমার গলা জড়িয়ে ধরে এবং নাকের ডগায় হাল্কা কামর দিয়ে বলল,

- তা কি সিদ্ধান্ত নিলে? 


- কিসের সিদ্ধান্ত?


- কেনো, গতকাল বাবার বলা কথাগুলো 'কি' তুমি ভুলে গেছো?


- ওহ! না ভুলিনি।এখনো ভাবছি।


- ঘর-জামাই থাকতে কি তোমার কোনো অসুবিধা রয়েছে? 


- না।


- তাহলে কেনো এতো ভাবছো?যদিও তুমি যাই ভাবোনা কেনো, আমি যা বলবো তাই হবে।আমি চাই সব কিছু সলভ হওয়ার পরও আমরা এখানেই থাকি।যেটা বেটারই হবে।ভাইয়া মারা যাবার পর বাবা-মা কিন্তু সম্পূর্ণ একা হয়ে গিয়েছে।তার মধ্যে আমরা যদি এখান থেকে চলে যাই, তাহলে তাদের দেখাশোনা করার মতোও তেমন কেউ আর থাকবে না।তাছাড়া মা ও বাবা উভয়ই'তো এটাই চায় আমরা এখানে থাকি, তাদের সাথে থাকি।তাছাড়াও আমিও চাইনা মা-বাবার কাছ থেকে দূরে কোথাও যেতে।


প্রত্যুত্তরে কিছু বললাম না।একটু মুচকি হাসি দিলাম।যা দেখে রুহি ঠিক বুঝে নিতে পারবে আমার মনের সমস্ত কথা।গলা ছেঁড়ে দিয়ে এবার আমার বুকে মাথা রাখলো রুহি।চোখ দুটো বন্ধ করে বলল,

- তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি শাহরিয়ার।আমার চেয়ে বেশি তোমাকে আর কেউই বুঝবে না, ভালোবাসবে না।

 

অতঃপর আর কিছু বলল না রুহি।হয়তো ঘুম সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে।ডান হাতটা রুহির মাথার পেছনে নিয়ে গিয়ে রাখলাম।হাল্কা ভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।পাশেই আমার চার-মাসের ছেলে ঘুমিয়ে রয়েছে।হাল্কা আলোতে দু'জনকেই অনেক সুন্দর লাগছিল।


পরের দিন সকালে রুহির চিৎকার, চেঁচামেচিতে আমার ঘুম ভেঙে গেল।অনেক দিন যাবৎ রুহির এরূপ চিৎকার, চেঁচামিচি শুনিনি, আমি।ভিষণ মিস করছিলাম, এই চেঁচামেচি ওয়ালী রুহিকে।ঘুম ঘুম চোখে রুহির একটা হাত টেনে ধরে বললাম, 

- কি হয়েছে আমার চেঁচামেচি ওয়ালী?ঘুমাতে দাও'তো!এভাবে ডাকছো কেনো, আমায়?


- এমনি এমনি ডাকছি না।এভাবে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সকাল থেকে দুপুর পার করলে হবে?ছেলেকে নিয়ে আজ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে'তো নাকি?

জলদিই ফ্রেশ হয়ে রেডি হও।তারপর ড্রয়িং রুমে এসো।আমি অপেক্ষা করছি।


কথাগুলো বলেই রুহি চলে গেল।আমিও আর কোনো রূপ দেরি করলাম না।দ্রুতই ফ্রেশ ও রেডি হয়ে ড্রয়িং রুমে চলে আসলাম।অতঃপর ডাক্তারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায়ই দুপুর হয়ে গিয়েছিল।বিকেলে আমার ছেলে ইফতিকে কোলে নিয়ে ছাঁদের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলাম।যার একটু দূরে দোলনায় বসে ছিল রুহি।এক পানে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।চোখের পাতার কোনো নড়াচড়া নেই।দমকা হওয়ায় চুলগুলো এলোমেলো ভাবে উড়ছিল ওর।দারুণ লাগছিল, রুহিকে তখন।এভাবেই ক'দিন অতিবাহিত হলো।হঠাৎ একদিন এহসানুল ভাই ফোন করে বললেন, তাদের বাড়িতে কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে আসতে।অনেকটা জোরাজুরিই করেছিলেন।না'ও করতে পারিনি।


অতএব রুহিকে নিয়ে আজ এহসানুল ভাইদের বাড়িতে আসলাম।আগামীকাল দুপুরের পরেই আবার চলে যাবো।খুব সুন্দর ভাবেই অতিথি আপ্যায়ন করে আমাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়।অনেক বড়সড়ই বাড়ি ওনাদের।এহসানুল ভাই এবং তার মা দুজনেই থাকেন।আমরা আসার একটু বাদেই ঢাকা থেকে আবার এহসানুল ভাইয়ের চাচাতো ভাই ও তার স্ত্রী আসে।জানতে পারলাম, তারা নাকি কিছুদিন পরপরই আসেন।কয়েকদিন থেকে আবার চলে যান।তাদের সাথেও পরিচয় হলো, অনেক কথাও হলো।দারুণ মুহূর্ত কাটলো।পরিশেষে আমাদের থাকার জন্য যেই রুমের ব্যবস্থা করা হয়, সেই রুমে চলে আসলাম।ক্লান্ত শরীরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলাম।যার একটু পরই আমার শ্বশুর শাশুড়ি আবার ভিডিও কল করেছিলেন।সঙ্গে সঙ্গেই রুহি কল রিসিভ করে ইফতির সামনে নিয়ে গিয়ে ধরলো।বলাই বাহুল্য, রুহির মা-বাবা তাদের নাতিকে না দেখা ছাড়া যেন, এক দন্ডও থাকতে পারেন না।নাতির প্রতি তাদের ভালোবাসা সত্যিই অসীম,সীমাহীন।রাতে ডিনারের পরে, এহসানুল ভাইয়ের মায়ের সাথে নানা গল্প-গুজবে মজে ছিল রুহি।সাথে যোগ হলো, এহসানুল ভাইয়ের চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রীও।তখন আমি আর এহসানুল ভাই ছাঁদের এক সাইডে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

হঠাৎ এহসানুল ভাই বলল,

- তোমার ছাত্রীকে সেরু ভাই কেনো খুন করেছিল, জানো?


- কেনো খুন করেছিল?নিশ্চই কিছু জানতে পেরেছেন?


- কিছু না, সবটাই জানতে পেরেছি।

তুমি যাকে রিহানার মা হিসেবে চিনো,জানো, তিনি আসলেই কী রিহানার মা? না..। তিনি রিহানার মা নন।


- কিহ!


- হ্যাঁ। আনোয়ারা বেগম রিহানার মা নয়। তিনি নিঃসন্তান।তার কোনো সন্তানসন্ততিই নেই।রিহানা ওনার সৎমেয়ে।রিহানার মা মারা যাবার পর, আনোয়ারা বেগমকে বিয়ে করেন রিহানার বাবা, বজলু হোসেন।


তবে তিনি কখনো রিহানার ওপর জলুম অত্যাচার করে অনান্য সৎ মায়ের মতো নিজের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেন নি।বরংচো তিনি আসাতে আগের চেয়ে আরও ভালো থাকতে শুরু করেছিল, রিহানা।


স্ট্রোকে রিহানার বাবা মারা যাওয়ার পর রিহানাকে অনেক আদর, স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে তিনি বড় করেছিলেন।কিন্তু সব পর-ই আপন হয়না, কিছু পর পর-ই থেকে যায়।রিহানা একটা ছেলেকে ভালোবাসতো।যেটা আনোয়ারা বেগমের অপছন্দ ছিল। এই নিয়ে তাদের মধ্যে অনেক কথা কাটাকাটি সহ ঝগড়ার সৃষ্টি হতো।আনোয়ারা বেগম সবসময়ই রিহানার ভালো চেয়ে আসছিলেন।তিনি চাননি রিহানা এমন একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখুক যার চরিত্র খারাপ।


মূলত দু'দিন আগে বাজার থেকে ফেরার পথে মেয়ের বয়সী একটা ছেলে ওনাকে খুবই বিশ্রী বিশ্রী কটুকথা বলেছিল। আর তিনি কল্পনাও করেননি রিহানার সেই ছেলেটির সাথেই সম্পর্ক আছে। যদিওবা রিহানার ওঠাবসা ছিল সব বাজে মেয়ে-ছেলেদের সাথে।এমনকি রিহানা একটা বড় প্রতারণা চক্রের সাথেও যুক্ত ছিল।যে চক্র দিনের পর দিন মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছে।যেদিন আনোয়ারা বেগম এসব জানতে পেরেছিলেন, ওই দিনই রিহানার গায়ে প্রথম তিনি হাত তুলেছিলেন।এমনকি ঠান্ডা মাথায় অনেক বুঝানোর পর সেদিন তিনি পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ধমকি পর্যন্ত দিয়ে বলেছিলেন, এসব থেকে বেরিয়ে আসতে।কিন্তু তারপরও কোনো কাজ হয়নি।রিহানা এসব থেকে বেরিয়ে আসেনি।বরং এতে হিতে বিপরীত হয়।


পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, গলার কাঁটা হয়ে বেঁধে ছিলেন আনোয়ারা বেগম।মুহূর্তেই আনোয়ারা বেগমের সমস্ত আত্বত্যাগ ভুলে গিয়ে রিহানা অনেক ভেবে চিন্তে প্লান সাজিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, সে তার সৎমাকে খুন করবে।প্রথমে নিজের অপহরণের নাটক করে আনোয়ারা বেগমকে ওই সুইসাইড নোটটি লিখতে বাধ্য করে।তারপর খুন করার পর ওনার তাজা লাশটাকে সিলিংফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়।এতে রিহানার বয়ফ্রেন্ডও জড়িত ছিল।বলে রাখাই ভালো, রিহানার বয়ফ্রেন্ড আজ থেকে তেরোদিন আগে মারা গেছে।থানায় এসে নিজে থেকেই সব কিছু স্বীকার করেছে।মূলত জেলেই ওর মৃত্যু হয়েছে।পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট থেকে জানতে পারি, ও এমন একটা ঔষধ খেয়েছিল, যেটা শুধু আমাদের দেশে নয়, আশেপাশের অনেক দেশেতেই পাওয়া যায়না।ঔষধটা যে যখন যে সময়ে খাবে, ঠিক তার পরের দিন ওই সময়ই তার মৃত্যু ঘটবেই ঘটবে।এই মৃত্যুর পিছনেও যে সেরু ভাই আছে তা আমি নিশ্চিতই। 


- আমি কল্পনা করতেও পারছি না, এহসানুল ভাই; রিহানা মেয়েটা আসলে এতোটা খারাপ!আমার ভাবতেও ঘৃণা লাগছে, আমি এই মেয়েকে টিউশন করাতাম। 


অতএব বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম আমরা দু'জনই।হঠাৎ আকাশের দিকে চেয়ে এহসানুল ভাই আবার বলে উঠলেন, 

- আজ আসলে কালই কি চলে যাবে? কিছুদিন থাকলে হয়না?


- না ভাইয়া, কালই যেতে হবে।আবার অন্য কোনো সময় আসবো, অনেক দিন থাকার জন্য। 


- জানো, কেনো যেন তোমাকে আমার খুব আপন মনে হয়।তোমার মতো আমার যদি একটা ছোট ভাই থাকতো তাহলে খুব ভালো হতো।


মুচকি হেঁসে প্রত্যুত্তরে আমি বললাম, 

- সেরু ভাই তো আপনার নিজেরই রক্তের আপন ছোট ভাই, তাই না এহসানুল ভাই?


আমার এমন কথা হয়তো কস্মিনকালেও আশা করেননি এহসানুল ভাই। ভ্রুকুচকে পরক্ষণেই তিনি বললেন,

- কি বলছো এসব?


- কেনো, ভুল কিছু কী বলেছি আমি?


চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে এহসানুল ভাই বললেন,

- এই কথাটা আমি ছাড়া কেউই জানে না।কারো জানারই তো কথা না! সেখানে তুমি কি করে জানলে?


- আপনি যেমন হুটহাট রহস্যজনক ভাবে অনেক কিছু জেনে জান, আমিও ঠিক তেমনই জেনেছি।


- মশকরা করো না শাহরিয়ার! সত্যি করে বলো? নিশ্চয়ই আমার কোথাও ভুল হয়েছে, আমার কোনো গোপন কথা তুমি শুনে ফেলেছো।নাহলে তোমার তো এটা কল্পনায়ও আসার কথা না? জানিনা এই কথাটা তুমি কি করে জানলে, কিন্তু তোমার যদি মনে হয় আমি তোমার কোনো উপকার করেছি; তাহলে অনুরোধ করেই বলছি, এই কথাটা তুমি নিজের মধ্যেই রেখো।


মুচকি হেঁসে বললাম,

- ভয় পাবেন না। এ কথাটা আর কেউই জানতে পারবে না।তবে একটা বিষয় কি খেয়াল করে দেখেছেন?


- কী?


- আপনি যেসব বিষয়ে বা যেসব কেসে ইন্টারফেস করেন, সেরু ভাইও কিন্তু সেইসবেই ইন্টারফেস করে।আপনি দোষীকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেন আর সেরু ভাই দেয় অন্য ভাবে।আপনারা দু'জনেই একে অপরের বিপরীত ধর্মী।


অনেকটা সময় চলে গেলেও প্রত্যুত্তরে এহসানুল ভাই এবার আর কিছুই বললেন না, আকাশের পানে গম্ভীর ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছেন।জানি না, মনে মনে এখন কি ভাবছেন তিনি বা মাথায় কি চিন্তা করছেন।আমি আর বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকিনি, নিচে চলে এসেছিলাম।পরের দিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে সেদিন আমরা চলে এসেছিলাম।


অতঃপর চোখের পলকেই যেন সাতটি মাস কেটে গেল।জানতে পারলাম, সেরু ভাই গ্রেফতার হয়েছে।দিনাজপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাকে। যার মাত্রই দেড় মাস পর আজ এইমাত্র এহসানুল ভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম, সেরু ভাই গতকাল রাতে জেল থেকে আবার পালিয়ে গিয়েছে। কড়া পাহারার মধ্যেও কেউ কি করে জেল থেকে পালাতে পারে এটাই তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না।সেরু ভাইকে পালাতে সাহায্য করা কাউকেই কোনো রূপ ছাড় দেওয়া হবে না।গভীর তদন্ত চলছে।


কিছু না বলে তখন ফোন কেটে দিয়েছিলাম আমি।এখন নির্জন একটা মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। হাতে আছে কালো রঙের একটা খাম।এটা সেই ব্যক্তিরই খাম, যাকে নিয়ে এতো হট্টগোল!খামের ভেতর থাকা চিঠিতে লেখা আছে:-

" দ্বিতীয় বার ধন্যবাদ তোমাকে। "

 

মুচকি হেঁসে খামসহ চিঠিটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়তে ছিঁড়তে শ্বশুর বাড়ির দিকে অগ্রসর হলাম।কাউকে জানতে দেওয়া যাবেনা।ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেওয়া যাবেনা।কারো ভাবনাতেও আনতে দেওয়া যাবেনা।কাউকে কল্পনাও করতে দেওয়া যাবেনা;

আজ থেকে দু'বছর আগে, সেরু ভাইয়ের ফাঁসি না হওয়া ও পালিয়ে যাওয়ার মহাচক্রান্তের পিছনে সবচেয়ে বড় হাতটা যে আমারই ছিল।যা কেউ জানে না।কেউ জানবেও না। আর আজ দু'বছর পরও সেরু ভাইয়ের জেল থেকে পালিয়ে যাওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকাও সেই আমারই রয়েছে।

কিছু রহস্য, রহস্যতেই মানায়।

কিছু সত্য অপ্রকাশ্যেই শ্রেয়।

কিছু গল্প অজানাই ভালো। 

আর কিছু অতীত, কারো না জানাটাই বেটার।

 

(সমাপ্ত।)_____


পর্বের সমস্ত গল্প গুলো পড়ুন।