গল্প: আত্মার চিৎকার | পৃথিবীর রহস্যময় মৃত্যু

 রহস্যময়

রহস্যময়

গল্প: আত্মার চিৎকার...👹👽

পর্ব: ০১

-তেরো বছর ধরে একটা লাশ নিয়ে ঘুরে লোকটা, যেখানে যায় সাথে কাঁধের উপর লাশটাও দেখা যায়।'

অরিনের কথা শুনে চমকে তাকায় প্রহর। মনে হচ্ছে যেন কোনো রূপকথার কাহিনি শুনছে সে। রাস্তার ধারে একটা ফুচকার দোকানে বসে দুজন ফুচকা খাচ্ছিল, হঠাৎ অরিন এ কাহিনী শুরু করে। অরিন আবার জোর গলায় বলে উঠে,

-বিশ্বাস কর তুই, নিজ চোখে না দেখলে আমিও বিশ্বাস করতাম না।' 

-কোথায় থাকে লোকটা?' জিজ্ঞেস করে প্রহর।

-কখন কোথায় থাকে সেটা বলা সম্ভব না, তবে শুনেছি একটা জায়গায় লোকটাকে প্রায় দেখা যায়। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার কী জানিস? লোকটাকে যেদিন দেখা যায়, সেদিনই কোনো না কোনো মেয়ের লাশ পাওয়া যায় নির্দিষ্ট একটা বিল্ডিংয়ে। লাশগুলোও নাকি সব সুন্দরী মেয়েদের লাশ। 

-ধুর! এসব গাঁজাখুরি গল্প রাখতো তুই। কী বলছি শোন না, একটা কথা বলার ছিল তোকে...

-আরে গাঁজাখুরি না রে আমার বাপ, সত্যি এটা। আমাদের হোস্টেলের কাছেই এই ঘটনা ঘটেছে। আর আমাদের হোস্টেলের একটা মেয়ের লাশও পাওয়া যায় একটা বিল্ডিংয়ে। প্রায়ই নাকি এরকম ঘটনা ঘটে ওখানে, আমি তো নতুন তাই আগেরগুলো দেখিনি, কিন্তু কাল...?' বলার সময় অরিনের চোখেমুখে ভীতি ফুটে উঠলো।

-কাল কী?' নির্লিপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে প্রহর।

-কাল যখন মেয়েটার লাশ পাওয়া যায় বিল্ডিংটাতে, তখন সবাই দেখে ঐ লোকটাকে, তার কাঁধে সেই লাশ, যেটা সে তেরো বছর ধরে বহন করছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আমিও দেখেছি লোকটাকে। কী ভয়ংকর চেহারা! এমা!' বর্ণনা করতে গিয়ে শিরশির করে উঠলো অরিনের শরীর।  

-তো লোকটাকে আটকায়নি কেন?

-তা আবার চেষ্টা চালায়নি ভাবছিস? পুলিশ এসেছিল, তাকে ধরার জন্য গুলিও চালিয়েছিল। কিন্তু লোকটা কাঁধের লাশসহ এক লাফে মিলিয়ে গেল ল্যাম্পপোস্টের আলো পেরিয়ে অন্ধকারে। 

-অদ্ভুত ব্যাপার। গুলি লাগেনি গায়ে?

-না। তবে লাগলেও কিছু হতো না।

-মানে?

-লোকটাকে নাকি আগেও অনেকবার গুলি করা হয়েছে। গায়েও লেগেছে নাকি। লোকটার কিছুই হয়নি। ভয়ংকরভাবে হেসেই মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। বারো বছর ধরেই নাকি এরকম ঘটনা ঘটে আসছে। 

-ধুর! তোর এসব আজগুবি গল্প রাখ তো, কী বলতে চাচ্ছি শোন...'

-উহু, আর সময় নেই, বাসায় যেতে হবে। মা বারবার ফোন করছে বাসা থেকে।' বলেই ভ্যানিটি ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো অরিন। যাওয়ার সময় হেসে বললো,

-বিল দিয়ে দিস, আমি যায়...'

প্রহরও মৃদু হেসে বললো,

-তুইও তো সুন্দরী, সাবধানে থাকিস।' 

অরিন চলে গেল হাসির রেখাটা আরেকটু প্রসারিত করে। প্রহর দুহাত জোড় করে মুঠো পাকিয়ে চেয়ে থাকে অরিনের প্রস্থানপথে। অরিনের সাথে তার পরিচয় দীর্ঘ আট বছর হতে চললো। দুজন ভালো বন্ধু। কিন্তু প্রহর তাদের সম্পর্কটাকে আরেকটু ঘনিষ্ঠ করতে চায়। যতোবারই প্রহর তার মনের কথাটা অরিনকে বলতে যায়, অরিন ততোবারই কৌশলে এড়িয়ে যায় ব্যাপারটা। আজকেও হয়তো আজগুবি কথা বলে এড়িয়ে গেছে অরিন। 

অরিন একটা ভালো কোম্পানিতে জব করে। তার অফিসটা বাড়ি থেকে অনেক দূরে হওয়ায়, অফিসের কাছাকাছি মেয়েদের একটা হোস্টেলে উঠেছে সে। অফিস থেকে দুদিন ছুটি নিয়ে আজ গ্রামে এসেছে সে। এসেই প্রহরকে ফোন করে দেখা করতে বলে। প্রহর একটা হাই স্কুলের শিক্ষক। অরিন যখন ফোন করে তখন সে ক্লাস নিচ্ছিল। অরিনের সাথে দেখা করার কথা শুনেই সে ক্লাস রেখেই বেরিয়ে পড়ে স্কুল থেকে। জানে সে অরিনকে কোথায় পাওয়া যাবে। প্রচুর ফুচকা খেতে ভালোবাসে অরিন। ফুচকার দোকানেই তাকে পাওয়া যাবে। তাই প্রহর সোজা চলে আসে ফুচকার দোকানে। তারপর থেকে সে কতোবার বলতে চাইলো মনের কথাটা, প্রতিবারই অরিন এড়িয়ে গেছে।

.

.

রাতে প্রহর ফোন দেয় অরিনকে। ঘুমানোর আগে কেন জানি খুব কথা বলতে ইচ্ছে হলো তার সাথে। মনকে সে কতো করে শাসায়, তবুও খালি অরিনের কথা ভাবে বেহায়া মনটা। এখনও খুব ইচ্ছে করছে ঘুমানোর আগে একবার অরিনের কণ্ঠ শুনতে।

-হ্যালো...' ওপাশ থেকে অরিনের মিষ্টি কণ্ঠ শোনা গেল।

-কী করছিস?' জিজ্ঞেস করলো প্রহর।

-কিছু না, শুইলাম মাত্র। তুই কী করছিস?

-ভাবছি তোর কথা...

-কেন? ঐ লোকটা এসে আমাকেও মেরে ফেলবে তাই ভয় পাচ্ছিস?

-ধুর! আবার শুরু করেছিস ওসব?

'হিহিহি' করে হেসে উঠে অরিন। 

-চুপ! একদম হাসবি না।' ধমক দেয় প্রহর।

-আমি জানি তুই ভয় পাচ্ছিস।' হাসিয়ে থামিয়ে বলে অরিন। একটু থেমে আবার বলে,

-একটা ব্যাপার ভেবে খুব অবাক লাগছে, জানিস?

-কোন ব্যাপার?

-যে মেয়েগুলোর লাশ পাওয়া যায়, তাদের গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন থাকে না। 

-তো কীভাবে মারে ওদের?  

-সেটাই ভাবছি। 

-ধর্ষণ?

-আরে না। সেটাও না, পোস্টমর্টেমে নাকি কোনো মেয়ের ধর্ষণের রিপোর্টও আসেনি।

-তাহলে?

-ব্যাপারটা আসলে রহস্যজনক...

-আর নয়তো তোর মনগড়া কাহিনী হতে পারে। বাদ দে ওসব। একটা কথা বলতো...

-কী কথা?

-তোর মনটা ভালো তো?'

-হুমম...

-নতুন পরিবেশে দিনকাল কেমন কাটে?

-সবকিছু ভালো, কিন্তু ভয় হচ্ছে শুধু ব্যাপারটা নিয়ে।

-ভয় হলে হোস্টেল ছেড়ে দিস।

-অনেক কষ্টে একটা জায়গা পেয়েছি, সেটাও ছেড়ে দেবো?

-তাহলে কী করবি?

-দেখি কী করা যায়, অফিস থেকে একটা কোয়ার্টার চাইবো।' ঘুমের ভান করে বললো অরিন।

-আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?

-হুমম...

-তোর কি কাউকে ভালো লাগে?

-হুমম...

-কাকে?

-হুমম?

-কাকে ভালো লাগে তোর?'

কোনো উত্তর দিলো না অরিন। 

-বল, কাকে ভালো লাগে?' রিপিড করলো প্রহর। অরিনের কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে সে কয়েকবার নাম ধরে ডাকলো,

-অরিন... অরিন... অরিন...' 

ওপাশ থেকে নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেল কেবল। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে অরিন। এতো ঘুমাতে পারে মেয়েটা। বাচ্চাদের মতো শুয়ে পড়লেই ঘুম চলে আসে ওর চোখে।

.

.

দু'দিন ছুটি কাটিয়ে চলে যায় অরিন। প্রহর নিজে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে এসেছে ওকে। ট্রেন ধীরে ধীরে চলে যাওয়ার মুহূর্তে প্রহর ডাক দিয়ে বলে,

-পৌঁছেই ফোন দিস আমাকে।'

-আচ্ছা।' হাত নেড়ে বিদায় জানায় অরিন। পেছনে সরতে থাকে প্রহর। কিছুটা হতাশ সে। এবারও বলা হলো না মনের কথাটা। ভেবেছিল সামনাসামনি কথাটা বলবে সে, কিন্তু অরিন সুযোগই দিলো না।

সেদিন সারাক্ষণ অপেক্ষা করলো প্রহর অরিনের ফোন পাওয়ার জন্য। কিন্তু অরিন ফোনই করলো না। ভেবেছিল অরিন পৌঁছেই ফোন করবে, কিন্তু করলো না। প্রচণ্ড অভিমান করে বসে প্রহর। নিজেকে কী ভাবে মেয়েটা? সেও আর ফোন দেবে না নিজ থেকে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছটফট করতে থাকে প্রহর।

.

.

পরদিন স্কুলে যাওয়ার পথে ফোন আসে অরিনের নাম্বার থেকে। প্রহর প্রথমে রিসিভই করলো না। অভিমানটা এখনও কাটেনি। দ্বিতীয় বার রিং বেজে উঠলে প্রহর ফোন রিসিভ করে চুপ করে থাকে। আগে আগে কিছু বলবে না সে। ওপাশ থেকে অরিনের বদলে একটা পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেল,

-হ্যালো, প্রহর বলছেন?'

-জ্বী, আপনি কে?' চমকে উঠে প্রহর। কিছুটা ভয়ও পাচ্ছে সে। 

-আমি রসুলপুর থানা থেকে ওসি আকমল বলছি। 

-জ্বী বলুন? অরিনের কিছু হয়নি তো? ওর ফোন আপনার কাছে কেন?' প্রহরের ভয় বাড়তে থাকে।

-আজ সকালেই আমরা ওর লাশ উদ্ধার করেছি একটা বিল্ডিং থেকে। 

-হোয়াট?' নিজেকে সামলাতে পারলো না প্রহর। হাঁটুগেড়ে বসে পড়লো।

.

.

পোস্টমর্টেম শেষে অরিনের লাশটা তার বাবা মার হাতে তুলে দেয়া হয়। অরিন ছিল বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। মেয়েকে হারিয়ে ওরা যেন একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়েছে হঠাৎ। প্রহর নিজের কষ্টটাকে লুকিয়ে দুই অসহায় বাবা মাকে সান্ত্বনা দিতে থাকে। অভিযোগও করতে পারে না তারা। কার কাছে অভিযোগ করবে? প্রশাসন নিজেও আজ ভীত ব্যাপারটা নিয়ে। লোকটাও বড় বেশি রহস্যময়। সন্ধ্যার আগেই অরিনের লাশটা কবর দেয়া হয় গ্রামে নিয়ে এসে। তবে প্রহর বসে থাকেনি। রাতেই ট্রেন ধরে আবার। যেখানে প্রশাসনের হাত গুটিয়ে গেছে, সেখানে সে নিজে কী করতে পারবে কিছুই জানে না সে। তবে এতটুকুই জানে, যতোই বিপদ আসুক এর শেষ দেখেই ছাড়বে সে। 

.

.

অরিন যে হোস্টেলে থাকতো তার কাছাকাছি একটা হোটেলে উঠেছে প্রহর। হোটেলে উঠার আগে সে ঐ বিল্ডিংয়ের অবস্থানটাও দেখে এসেছে, যেখানে মেয়েগুলোর লাশ পাওয়া যায়। কাছেই বিল্ডিংটা। পুরনো দুতলা শ্যাওলা ধরা একটা বিল্ডিং। সামনেই একটা সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা আছে, "বিপদজনক সীমানা।" প্রহর ভেতরের দিকে যায়নি। আগে থাকার জন্য একটা রুম দরকার। তাই হোটেলে উঠেছে সে। 

রাত তখন তিনটে বাজে। প্রহর বের হয় হোটেল থেকে। হাঁটতে থাকে পরিত্যক্ত বিল্ডিংটার দিকে। আশেপাশে কেউ নেই, জনমানবহীন রাস্তায় সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। মাঝেমাঝে দূর থেকে নেকড়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। সাবধানে পা ফেলছে প্রহর। বারবার মনে হচ্ছে সে একা নয়, কেউ যেন তার পাশাপাশি হাঁটছে। কাউকে দেখা যাচ্ছে না, শুধু নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।  

-কে কে?' বলে কয়েকবার ডাক দেয় প্রহর। কারও সাড়া পাওয়া যায়নি। তখন সে নির্ভয়ে এসে দাঁড়ায় পরিত্যক্ত বিল্ডিংটার সামনে। গা ঘেঁষে আর কোনো বিল্ডিং নেই। সবচেয়ে কাছের বিল্ডিংটা এখান থেকে দুশো মিটার দূরে। ওটা মেয়েদের হোস্টেল। আশ্চর্যের বিষয়, ওখান থেকে মেয়েগুলো কীভাবে আসে এই বিল্ডিংয়ে? কে নিয়ে আসে তাদের?  

হঠাৎ একটা মেয়ের কান্নার আওয়াজ আসে। সতর্ক হয়ে উঠে প্রহর। কান্নার আওয়াজটা বিল্ডিংয়ের ভেতর থেকেই আসছে। মেয়েটা চেপে চেপে কান্না করছে। 

-কে? কে ওখানে কান্না করছেন?' চিৎকার করে উঠে প্রহর। ভেতর থেকে কোনো উত্তর এলো না। এবার আরও কয়েকটা মেয়ের কান্নার শব্দ শোনা গেল। এরাও কান্না করছে চেপে চেপে। উপরের তলা থেকে আসছে কান্নার শব্দগুলো। প্রহর আবার চিৎকার করে উঠে,

-কারা আপনারা? কাঁদছেন কেন?' 

এবারও কোনো প্রত্যুত্তর এলো না। প্রহরের চিৎকার যেন ওদের কান পর্যন্ত পৌঁছেনি। প্রহর ভেতরে ঢুকতে চাইলে দেখে গেইটে বড় একটা তালা ঝুলানো। হয়তো বিপদজনক জায়গা তাই প্রশাসনের নির্দেশে লাগানো হয়েছে তালাটা। যদি তাই হয়, এতোগুলো মেয়ে ভেতরে গেল কী করে তালা না খুলেই। উপরের তলার দিকে তাকায় প্রহর। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে কেবল দালানটায় দেখা গেল। জানালার পাশ থেকেই হয়তো আসছে কান্নার আওয়াজগুলো। হঠাৎ জানালার গ্লাসে ভেসে উঠলো দুটো হাত আর একটা মাথা। মনে হচ্ছে কোনো মেয়ের অবয়ব। জানালটা একবার খুলেই বন্ধ হয়ে গেল। একটু করে দেখার সুযোগ হলো প্রহরের। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে যে মেয়েটা কাঁদছে ওটা অরিন। চমকে উঠে প্রহর! 

.

.

একটা মৃত মেয়ে আবার কী করে জীবিত হয়ে আসতে পারে? যাকে সন্ধ্যায় কবর দিয়ে এসেছে, তাকে আবার গভীর রাতে দেখা যায় কী করে? ভাবনাগুলো কয়েকমুহূর্ত ঘুরপাক খায় প্রহরের চিন্তায়। কিন্তু শত যুক্তিকে পায়ে ঠেলে সে ছুটে যেতে চাই অরিনের কাছে। তালা ভাঙার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তখন দেয়াল টপকে উপরে যেতে চায় সে। দেয়াল টপকাতে গিয়েই তার হাতে কাঁচের ভাঙা টুকরো ঢুকে যায়। ব্যথায় ককিয়ে উঠে সে, আর দেয়াল টপকাতে পারেনি। পড়ে যায় নিচে। হাত থেকে রক্ত ঝরতে থাকে তার। তখন ভেতর থেকে আসা মেয়েদের কান্নাগুলো মুহুর্তেই মিলিয়ে যায়। প্রহর গেইটের সামনেই বসে পড়ে মাথায় হাত দিয়ে। সারারাত ওভাবেই বসে থাকে সে।

.

.

ভোর হতেই এক বৃদ্ধের ডাকে সম্বিত ফিরে পায় প্রহর।

-কে বাবা তুমি?' জিজ্ঞেস করে বৃদ্ধ।

-জ্বী, আমি প্রহর।' চেয়ে থাকে প্রহর বৃদ্ধের দিকে।

-সারারাত এখানে বসেছিলে? জানো না জায়গাটা ভালো না। এ কী? তোমার হাতে দেখি রক্ত! কী করে হলো এটা?'

প্রহর এবার দেয়ালের দিকে তাকায়। বৃদ্ধ লোকটা বুঝে নেয় ব্যাপারটা। তারপর বলে,

-ভেতরে যেতে চেয়েছিলে? জীবনের মায়া কি নেই?

-ওখানে আমার অরিন ছিল। কান্না করছিল ও।

-ওটা তোমার ভুল ধারণা বাবাজি। ওখানে কেউ নেই।  

-আমি স্পষ্ট দেখেছি, বিশ্বাস করুন। কান্না করছিল সে।

-মেয়েটা কি মারা গেছে? মানে এই বিল্ডিংয়ে? 

-জ্বী, আজ সকালে মেয়েটার লাশ পাওয়া যায় এখানে।

-ওহ! আজকে যে মেয়েটার লাশ পাওয়া যায় ওটাই অরিন?' স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো বৃদ্ধ।

-জ্বী। ওকে আমি ভালোবাসতাম।'

বৃদ্ধ এবার প্রহরকে দাঁড় করায়। তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলে,

-তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি বাবাজি। কিন্তু তুমি যাকে দেখেছো সে অরিন ছিল না।

-অরিনই ছিল। আপনি আমাকে ভেতরে নিয়ে চলুন। ও এখনও আছে ওখানে।'

বৃদ্ধ নিশ্বব্দে একটা চাবি বের করে গেইটের তালাটা খুললো। তারপর প্রহরকে নিয়ে ভেতরে গেল। কাউকে দেখতে পেল না সে। কেউ নেই সেখানে। মাকড়শা জাল বিছিয়েছে পুরো বিল্ডিংয়ে। 

-অনেকদিনের অব্যবহৃত তো, কেউ থাকে না এখানে।' নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠে বৃদ্ধ।

-কিন্তু কাল যে আমি কিছু মেয়ের কান্না শুনলাম এখানে। অরিনও কাঁদছিল ওদের সাথে।

-ওরা সবাই মৃত। এই বিল্ডিংয়েই মারা গেছে। আর ওদের আত্মাগুলোই থেকে গেছে এখানে। ওরা গভীর রাতে কাঁদে, চিৎকার করে। 

-তাদের সাথে কথা বলা যায় না?

-কী করে কথা বলবে? সবাই তো ভয়ে থাকে। সবচেয়ে বড় ভয় ঐ লোকটার প্রতি। যে মরা মানুষ কাঁধে নিয়ে ঘুরে। 

-কে ঐ লোক? ঐ লোককে আমি ছাড়বো না। আমার অরিন আজ আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে, শুধু ঐ লোকটার কারণে।

-দুঃসাহস দেখাতে যেও না বাবাজি, লোকটা যেমন ভয়ংকর, তেমনি অদ্ভুত। পুলিশের গুলিতেও মরে না। আজ তেরোটা বছর ধরে আমরা আতংকে আছি ওর ভয়ে। যাদের ঘরে সুন্দরী মেয়ে থাকে, তাকেই তুলে নিয়ে যায় সে। আর মেরে ফেলে।

-সুন্দরী মেয়েদের সাথে লোকটার কী সম্পর্ক?  

-সেটা কেউ বলতে পারে না। কীভাবে ঘর থেকে মেয়েদের তুলে নিয়ে যায়, কীভাবে মারে তা এখনও অজানা। কারণ কারও গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন থাকে না। 

-লোকটার পরিচয় কী? আর তাঁর কাঁধে লাশের রহস্যটাই বা কী? কার লাশ ওটা?

-লোকটার পরিচয় কেউ জানে না। তবে তার কাঁধের লাশটা নিয়ে কেউ কেউ বলছে ওটা কোনো তান্ত্রিকের লাশ। তেরো বছর আগে ঐ তান্ত্রিককে মেরেই তার লাশ কাঁধে নিয়ে ঘুরে লোকটা। তান্ত্রিককে মারতে নাকি অনেকেই দেখেছে। তবে তান্ত্রিকের আগমন কোথা হতে সেটা কেউ বলতে পারে না। দুজনের কাউকেই কেউ কোনোদিন এর আগে এখানে দেখেনি।' 

বৃদ্ধের কথা শুনে মনে হলো রহস্য যেন আরও বেড়ে গেছে। দূর থেকে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। আর এই সমস্যা সমাধান না হলে চলে যেতে পারে অরিনের মতো আরও অনেক তাজা প্রাণ।  

প্রহরের বুকে প্রচুর সাহস। তাই সে নিজের জীবনের পরোয়া না করে বৃদ্ধের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ে রাত কাটানোর। ব্যাপারটা শুধু দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে আপাতত। আর কেউ জানতে পারবে না। 

.

.

রাতে যখন পুরো নগরী নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে, প্রহর তখন আবার আসে পরিত্যক্ত সেই বিল্ডিংয়ে। আগের রাতে অরিনসহ যেসব আত্মাগুলোর কান্না শোনা গিয়েছিল, তাদের কারও দেখা নেই আজ। তবে চারপাশের দেয়াল থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল। প্রহর বারবার চমকে উঠছে শব্দ গুলো শুনে। আকাশে মেঘ নেই, তবুও বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আর ঘরের আলো নিভে নিভে যাচ্ছে। হঠাৎ বাহিরের গেইট খোলার শব্দ শোনা গেল। প্রহর সরে আসে জানালার পাশে, আগের রাতে ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে অরিন কান্না করেছিল। জানালার আড়াল থেকে প্রহরের নজর যায় বাইরে। দেখে লম্বা একটা লোক, কাঁধের উপর তার লাশের মতো কিছু একটা। হয়তো এই সেই লোক। লোকটা কাঁধের লাশটাকে নিচে রাখে। তারপর আশেপাশে তাকায়। হেঁটে আসতে থাকে ভেতরের দিকে। আর লাশটা পড়ে থাকে গেইটের পাশে। 

সিঁড়িতে লোকটার পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। ধীরে ধীরে কাছে চলে আসছে আওয়াজটা। প্রহরের হার্টবিট দ্রুত বাড়তে থাকে। দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে সে। লোকটা সেই রুমে আসে। কিন্তু তাকে দেখতে পায়নি। দুজনের মাঝে দুরত্বও বেশি না। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। এতো বিশাল সাইজের লোকটার সাথে শক্তিতে পেরে উঠবে না প্রহর। যা করার কৌশলে করতে হবে। প্রহর নিজের নাক-মুখ চেপে ধরে, যাতে তার নিশ্বাসের শব্দ লোকটার কান পর্যন্ত না যায়। কিন্তু তবুও নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। প্রহর নিশ্চিত এই নিশ্বাসের শব্দটা তার বা এই বিশালদেহীর না। তাহলে কার নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে? ডানদিকে ঘাড় ফেরায় প্রহর। দেখে, দেহবিহীন শুধুমাত্র একটা মাথা দেয়ালের সাথে লেগে আছে তার মাথা বরাবর। চমকে উঠে প্রহর। এই মাথাটায় নিশ্বাস নিচ্ছে। প্রহর তাকাতেই মাথাটাও ঘুরে তাকায় তার দিকে। নিজেকে সামলানোর জন্য নিজের মুখ আরও শক্ত করে চেপে ধরে প্রহর। তখন ঐ বিশালদেহীর পায়ের শব্দ শোনা যায় আবার। লোকটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে আবার। প্রহর পিছু নেয় তার। লোকটা আবার এসে দাঁড়ায় মাটিতে রাখা লাশটার পাশে। দুহাতে কাঁধে তুলে নেয় সে লাশটাকে। এবার প্রহর স্পষ্ট দেখতে পায় লাশটার চেহারা। মেয়েদের মতো লম্বা চুল আর দাঁড়িতে লাশের চেহারাটা আদিমযুগের কোনো মানবের মতো লাগলো। কিন্তু লোকটা এই লাশ নিয়ে কেন ঘুরে তেরো বছর ধরে? লাশের সাথে তার সম্পর্ক কী? আর লাশটাও বা তেরো বছর ধরে এমন তাজা থাকে কী করে? তখন গেইট দিয়ে আসতে দেখা যায় আরও একটা মেয়েকে। মেয়েটা এমনভাবে হাঁটছে যেন নিজের মাঝে নেই সে। অন্যমনস্ক! ধীর পায়ে হেঁটে ভেতরের দিকেই আসছে সে। দেখতে অপূর্ব সুন্দরী। প্রহরকে পাশ কাটিয়েই সিঁড়ি বেয়ে উপরে যেতে লাগলো। প্রহরকে যেন দেখেও দেখলো না....


আত্মার চিৎকার...👹👽

পর্ব: ০২ ও শেষ 


পেছনে আবার পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। এগিয়ে আসছে বিশালদেহী। লাশটা তার কাঁধে নেই। আবার মাটিতে রেখেছে। বিশালদেহীকে এগিয়ে আসতে দেখে প্রহর আবার দুতলায় উঠে এলো সাবধানে। সুন্দরী মেয়েটা এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। এখনও যেন নিজের হুশে নেই সে। বিশালদেহীর দৃষ্টি থেকে বাঁচতে আবারও দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়লো প্রহর। বিশালদেহী ভেতরে এলো। মুহূর্তেই কোথা থেকে যেন আরও অনেকগুলো মেয়ে এসে হাজির। সবাই সুন্দরী। অরিনকেও দেখা গেল এদের সাথে। তারমানে এদের সবার পরিণতি একই। সবাইকে এখানে এসে জীবন দিতে হয়েছে। সবাই আজ আত্মা। আত্মাগুলো মেয়েটাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। বিশালদেহী তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তার শয়তানি হাসি। সে ইশারা করতেই আত্মাগুলো ভয়ংকরভাবে হেসে উঠলো। তখন হুশ ফিরলো মেয়েটার। 

-কারা আপনারা? আমি এখানে কেন?' চিৎকার করে উঠে মেয়েটা। তখন আত্মাগুলো ভয়ংকর রূপ নেয়। দেখে যে কারও ভেতরটা কেঁপে উঠবে। অরিনের ভয়ংকর চেহারাটা নজরে পড়লো প্রহরের। ছিঃ! কী বিশ্রী ভয়ংকর চেহরা। নিজেকে ঠিক রাখতে কষ্ট হলো প্রহরের। অরিনের এমন পরিণতি সে মেনে নিতে পারছে না। 

-প্লিজ ছেড়ে দাও, আমাকে মেরো না।' আবারও চিৎকার করে উঠে মেয়েটা। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে সে। আত্মাগুলো ভয়ংকরভাবে হাসতে হাসতে মেয়েটাকে ভয় দেখাচ্ছে। এবার বুঝতে পারে প্রহর কীভাবে এখানে মেয়েগুলোর মৃত্যু হয়েছে। ভয়ে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে ওরা। তাই শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি ওদের। এই মেয়েটার পরিণতিও তাদের মতো হতে যাচ্ছে। হয়তো একসময় এই মেয়েটাও আত্মা হয়ে যোগ দেবে এই আত্মাগুলোর সাথে, আর ভয় দেখাবে অন্য কোনো নতুন মেয়েকে। না, না, তা হতে দেয়া যাবে না। যেকোনোভাবে বাঁচাতে হবে এই মেয়েটাকে। প্রহর দরজার আড়াল থেকে মাথাটা আরেকটু বের করে মেয়েটার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়েটা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখায় কিছুতেই তা সম্ভব হচ্ছে না। আত্মাগুলো হাসতে হাসতে তার চারপাশে ঘুরতে থাকে, আর মাঝেমাঝে খামচে দেয়ার চেষ্টা করে। তখন জোরে চিৎকার করে উঠে মেয়েটা। অনেকক্ষণ পর মেয়েটার দৃষ্টি নিজের দিকে ফেরাতে পারলো প্রহর। মেয়েটা ফিরতেই সে নিজের ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে মেয়েটাকে স্বাভাবিক থাকার ইশারা করে। মেয়েটার অস্থিরতা কিছুটা কমে তখন। হয়তো কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছে সে তাকে বাঁচানোর মতো কোনো পুরুষকে দেখতে পেয়ে। প্রহর এবার সম্পূর্ণ নিজেকে প্রস্তুত করে মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য। ইশারায় সে মেয়েটাকে বুঝিয়ে দেয় একসাথে পালাবে তারা। মেয়েটাও স্বাভাবিকভাবে চোখ টিপে সাড়া দেয়। প্রহর আর দেরি করে না। এক লাফে এসে পৌঁছায় মেয়েটার পাশে। আশ্চর্য! আত্মাগুলোর গায়েও লাগলো না সে। এখন এতোকিছু ভাবার সময় নেই। মেয়েটার হাত ধরে চিৎকার করে উঠে সে,

-পালাও...'

আর দেরি করেনি, দুজন একসাথে লাফ দিলো রুমের বাইরে। সিঁড়ি বেয়ে লাফ দিয়ে দিয়ে পালাতো লাগলো দুজন। পেছন পেছন আসতে লাগলো বিশালদেহী। প্রহর মেয়েটার হাত ধরে বিল্ডিংয়ের সদর দরজা থেকে লাফ দেয় বাইরে। বাইরে তখন লাশটা পড়েছিল। লাশের উপর লাফ দেয় ওরা, সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে উঠে বসে লাশ। থমকে দাঁড়িয়ে যায় প্রহর আর মেয়েটা। লাশকে চিৎকার করে উঠতে দেখে অবাক হয় প্রচুর। কয়েকমুহূর্ত দুজন তাকিয়ে তাকে ওর দিকে। পেটে হাত চেপে ধরে কাতরাচ্ছে সে। কয়েকমুহূর্ত ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার দৌড়াতে শুরু করে ওরা বিশালদেহীকে আসতে দেখে। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে দুজন। বিশালদেহীও থেমে নেই। যেন দুজনকে ধরেই ছাড়বে আজ সে। 

.

.

একটা ঝোপের আড়ালে লুকোয় দুজন। লাইটপোস্টের আলো নেই এদিকে। চারপাশে অন্ধকার। তবুও হালকা দেখা যায় কাছের জিনিসগুলো। বিশালদেহীকেও দেখা যায় ঝোপের পাশে এসে থামতে। দুজনের হার্টবিট তখন দ্রুত বাড়তে থাকে। ঝোপে কয়েকবার নাড়া দেয় বিশালদেহী। প্রহর নিজের নিশ্বাসটা আটকিয়ে মেয়েটার মুখ চেপে ধরে যাতে নিশ্বাসের শব্দ লোকটার কানে না পৌঁছে। তখন পাশ থেকে আরেকটা নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। তবে সেটা দুজনের কারও নিশ্বাসের শব্দ না। তবে কার নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। আশে পাশে তাকায় দুজন। কিন্তু ঝোপের ভেতর পুরোটাই অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। মেয়েটার হাত তখন কিছু একটা স্পর্শ করে। মনে হচ্ছে কোনো মানুষের মুণ্ডু এটা। কান, মুখ, নাক সব আছে। নাকটা দিয়ে শ্বাস ফেলছে মুণ্ডুটা। ভয়ে চিৎকার করে উঠলো সে। প্রহর তার মুখ চেপে ধরেও চিৎকার আটকাতে পারলো না। সাথে সাথে ঝোপের দিকে তাকায় বিশালদেহী। প্রহর আবার শক্ত করে ধরে মেয়েটার হাত। এক লাফে বের হয়ে আসে ঝোপ থেকে। আবার পালাতে শুরু করে। দৌড়াতে দৌড়াতে একটা বড় গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। হাঁপাতে থাকে দুজন। বিশালদেহীর আসার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। আবছা আলোয় যতদূর দেখা যায় বিশালদেহীকে দেখা গেল না। তার পায়ের আওয়াজও শোনা গেল না। দুজন গাছে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিতে লাগলো। হাঁপাতে হাঁপাতে এবার প্রহর প্রশ্ন করে মেয়েটাকে,

-কে আপনি? 

-আমার নাম মোহনা। গার্লস হোস্টেলেই থাকি। 

-বিল্ডিংটাতে গেলেন কী করে?'

-আমি জানি না। আমি তো হোস্টেলে ছিলাম। হঠাৎ ওখানে কী করে গেলাম, কিছুই জানি না আমি, কিছুই না।

-যেভাবে আপনি হেঁটে ভেতরে গেলেন, মনে হলো কেউ আপনাকে সম্মোহন করেছে। সেই সম্মোহনী শক্তি আপনাকে নিয়ে গেছে ওখানে।'

-আমাকে প্লিজ একটু হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আসুন।' কাঁপছে মোহনা। কাঁপতে কাঁপতে আবার বললো,

-আমি কালকেই হোস্টেল ছেড়ে চলে যাবো। আর আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে বাঁচানোর জন্য, আপনি না থাকলে যে কী হতো...

-ইটস ওকে। এটা আমার কর্তব্য। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে তো বাঁচাতে পারলাম না। সেও জীবন দিয়েছে ঐ বিল্ডিংয়ে। কাল যার লাশ পাওয়া গিয়েছিল, সে আমার ভালোবাসা ছিল। খুব ভালোবাসতাম ওকে। কিন্তু মনের কথা কখনও বলতে পারিনি। বাই দ্যা ওয়ে, চলুন আপনাকে পৌঁছে দিই...

-হুমম...' মুখের ভেতর শব্দ করলো মোহনা। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়ালো দুজন। যখনই হাঁটার জন্য পা ফেলতে যাবে তখনই খেয়াল হয় সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী। '

-আ...আ...আ....' দুকানে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠে মোহনা। ভয়ে ভয়ে প্রহরের পেছনে এসে লুকোয় সে। এবার বিশালদেহীর কণ্ঠ শোনা গেল,

-ভয় পেও না, আমি তোমাদের ধন্যবাদ দিতে এসেছি আর তোমাদের সাহায্য করতে এসেছি। 

-মানে?' আশ্চর্য হলো প্রহর।


-মানে আমি কোনো মানুষ না, আমি একটা আত্মা। আমার মৃত্যু হয়েছে আজ থেকে ৭০০ বছর আগে। 

-হোয়াট? তাহলে আপনি এসব করছেন কেন? কেন অসহায় মেয়েগুলোকে বিল্ডিংয়ে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলছেন?

-ওসব আমি মারিনি। আমাকে দিয়ে করানো হয়েছে।

-কে করিয়েছে?

-যাকে কাঁধে নিয়ে আমি চলাফেরা করি, যাকে সবাই মৃত ভাবে। সে আসলে মৃত না। সেই করেছে সবকিছু।  

-হোয়াট?' নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারলো না প্রহর। মোহনার ভয়টাও ধীরে ধীরে কাটতে থাকে। রোমাঞ্চকর অনুভূতি হতে শুরু করে দুজনের সারা শরীরে। গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠে তখন।

-লোকটা কেন মেয়েগুলোকে ঐ বিল্ডিংয়ে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে? তাও আবার সুন্দরী মেয়েগুলো। কী উদ্দেশ্য তার?' জিজ্ঞেস করে প্রহর। আত্মাটা তখন যে জবাবটা দেয়, তা শুনে আরও বেশি চমকে উঠে প্রহর। সে বলে,

-সুন্দরী মেয়েদের প্রতি লোকটার আকর্ষণ বেশি। মেয়েগুলোকে ভোগ করার জন্য নিয়ে যায়।

-হোয়াট? কিন্তু পোস্টমর্টেমে তো কোনো মেয়ের লাশে ধর্ষণের কিছু পাওয়া যায়নি।

-সে মেয়েগুলোর শরীরের সাথে সঙ্গম করে না। তাদের আত্মার সাথে সঙ্গম করে।'

যতো শুনছে ততো বিস্ময় বেড়ে যাচ্ছে প্রহরের।  

-মানে?' অবাক হয়ে প্রশ্ন করে সে। এবার আত্মাটা বর্ণনা করে তান্ত্রিকের ব্যাপারে,

-লোকটা একজন তান্ত্রিক। তন্ত্র বিদ্যার পাশাপাশি সে আত্মাদের নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা করে। অনেক কিছু শিখে সে, অনেক শক্তি অর্জন করে। আত্মাদের বশ করতে পারে। তেমনি একদিন সে আমাকে বশ করে। আর আমাকে দিয়ে সে বিভিন্ন অন্যায় কাজ করায়। 

-কিন্তু একটা কথা...' প্রহর থামায় তাকে। আত্মাটা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়। প্রহর বলে,

-কিন্তু অনেকে নাকি দেখেছে তেরো বছর আগে আপনি লোকটাকে মেরে কাঁধে কাঁধে নিয়ে ঘুরছেন। 

-ওটা ছিল একটা নাটক। সে নিজের অস্তিত্ব সব পৃথিবী থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল। 

-তারপর? 

-ও নিজের আত্মাকেও দেহ থেকে আলাদা করতে পারতো। আমার কাঁধে সে মরার মতো থাকতো, কিন্তু পাশাপাশি চলতো তার আত্মা। আমাকে দিয়ে সে মেয়েগুলোকে বিল্ডিংয়ে নিয়ে আসতো। আমি মেয়েগুলোকে সম্মোহন করে নিয়ে আসতাম, তারপর কীভাবে তাদের মারা হয় দেখলে তো। 

-হুমম... আর ওদের আত্মাগুলোকে কীভাবে অত্যাচার করতো?

-মৃত্যুর পর ওদের আত্মাগুলো ওখানেই আটকে থাকে। আর তান্ত্রিক নিজের আত্মাকে পাঠায় ওদের কাছে। তারপর শুরু হয় অত্যাচার। তাই রাতের গভীরে মেয়েদের আত্মাগুলোকে কাঁদতে শোনা যায়।'

-হুহ...' দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো প্রহর। পাশে শিউরে উঠছে মোহনা। তারও একই পরিণতি হতে পারতো। ভাগ্যিস হয়নি। 

-আসলে আত্মাগুলোর মুক্তির জন্যই আমি তোমাদের কাছে এসেছি।' বললো আত্মাটা।

-আপনি তো চাইলে আরও আগে আসতে পারতেন, চাইলে মানুষের সাহায্যে তান্ত্রিককে বধ করতে পারতেন।

-পারতাম না। কারণ আমি বশ ছিলাম ওর। এখন বশমুক্ত হয়েছি কারণ তোমরা তার সাধনা ভেঙে দিয়েছো তাকে আঘাত করে। 

-এখন আমাদের কাজ কী?

-এখন আমাদের কাজ মেয়েদের আত্মাগুলো মুক্তি দেয়া। তান্ত্রিক যেকোনো মুহূর্তে আবার শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। আবার অন্য কোনো আমার মতো আত্মাকে বশ করতে পারে। এখনই সুযোগ ওকে মারার।'

প্রহরের চোখে মুখে প্রতিশোধের নেশা ফুটে উঠলো। অরিনের চেহারাটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। মোহনাকে বললো,

-আপনি হোস্টেলে চলে যান, ঐতো আপনার হোস্টেল দেখা যাচ্ছে। 

-কিন্তু আপনি?' মোহনার কণ্ঠে ভীতি।

-আমি যাচ্ছি তান্ত্রিককে শায়েস্তা করতে।

-আপনার যদি কিছু হয়ে যায়...?

-হবে না। আপনি যান, ভয় পাবেন না তো?'

-নাহ্।' চলে যেতে লাগলো মোহনা। 

প্রহর দ্রুত পা চালায় পরিত্যক্ত বিল্ডিংটার দিকে। বিল্ডিংয়ের গেইট দিয়ে ঢুকতেই দেখা গেল তান্ত্রিক ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে কী যেন সাধনা করছে। হয়তো অন্য কোনো আত্মাকে বশ করতে ব্যস্ত সে। ভেতরে মেয়েদের আত্মাগুলোর চিৎকার শোনা গেল। ওরা কাঁদছে। মুক্তি চাই ওরা। জানালার পাশে অরিনকে দেখা গেল। চেয়ে আছে সে প্রহরের দিকে। জানালা দিয়ে হাতটা বাড়িয়ে কাঁদছে সে। কয়েকমুহূর্ত চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবলো প্রহর। তারপর এগিয়ে গেল তান্ত্রিকের দিকে। তান্ত্রিক কী যেন ছুড়ে মারলো প্রহরের দিকে। ওটা প্রহরের সামনে পড়ে আগুন সৃষ্টি করলো চারপাশে। তান্ত্রিকের মুখে শয়তানি হাসি শোনা গেল। কিছুটা দূর থেকে ঐ আত্মাটা চিৎকার করে প্রহরকে বললো,

-যাও, দেরি করো না। আটকাও ওকে। আর সময় নেই।'

প্রহর দেরি করে না। আগুনের ভেতর থেকে লাফ দেয়। তান্ত্রিক আবার কী যেন ছুঁড়ে মারে তার দিকে। প্রহর এবার লাফ দিয়ে একটা লাঠি তুলে নেয়, আর ওটা ছুঁড়ে মারে তান্ত্রিকের কপাল লক্ষ্য করে। অব্যর্থ লক্ষ্য। সোজা গিয়ে পড়লো ওটা তান্ত্রিকের কপালে। তান্ত্রিক নিজের জায়গা থেকে ছিটকে গিয়ে পড়লো কয়েক ইঞ্চি দূরে। এবার সে উঠে দাঁড়ালো ক্রোধান্বিত হয়ে। রাগে চিৎকার করছে সে। এগিয়ে এলো প্রহরের দিকে। দুজন কিছুক্ষণ হাতাহাতি করলো। তারপর তান্ত্রিক প্রহরকে দুহাতে তুলে নিয়ে আছাড় মারলো। একটা ইঁটের সাথে লেগে তার ঠোঁট কেটে গেল। ইঁটটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে ইটসহ স্কাইডাইভ দিলো সে, আর ইঁট দিয়ে জোরে আঘাত করলো তান্ত্রিকের মাথায়। এক হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে আরেক হাতে প্রহরের গলা টিপে ধরে তান্ত্রিক, যেন হার মানার পাত্র সে নয়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে তার মাথা থেকে। প্রহর নিজের গলা ছাড়াতে চেষ্টা করলো, কিন্তু প্রচুর শক্তি তান্ত্রিকের গায়ে। প্রহর এবার জোরে পা চালালো তার তলপেটে। কয়েক পা পেছনে গিয়ে থামলো সে, কিন্তু প্রহরের গলা ছাড়লো না। যেন নিশ্বাস থেমে না যাওয়া পর্যন্ত ছাড়বে না সে গলা। এদিকে প্রহরের নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। একটু পর জোরে আর্তনাদ করে উঠে প্রহরের গলা ছেড়ে দিলো তান্ত্রিক। নিজের মাথাটা চেপে ধরে মাটিতে পড়ে গেল সে। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ঐ বৃদ্ধ, যিনি প্রহরকে ভেতরে ঢুকতে সাহায্য করেছিল। সেই বৃদ্ধ ইঁটটা তুলে নিয়ে তান্ত্রিককে আঘাত করে আগের ক্ষত জায়গায়। পুনরায় আঘাতটা সহ্য করতে না পেরে পড়ে যায় সে। বৃদ্ধের হাত থেকে ইটঁটা নিয়ে প্রহর আঘাত করতে থাকে তান্ত্রিকের মুখে উপর্যুপরি। তান্ত্রিকের মুখ থেকে শুধু আর্তনাদ বের হলো। প্রাণ চলে যাওয়ার পরও বেশ কিছুক্ষণ আঘাত করতে থাকে প্রহর। তারপর ছেড়ে দেয়। তখন থেমে যায় ভেতরের আত্মাগুলোর চিৎকার। হাসি শোনা যায় তাদের। আবারও জানালার দিকে চোখ যায় প্রহরের। অরিন হাসছে। হাত নেড়ে বিদায় দিচ্ছে সে। প্রহরও হাত নাড়লো।

.

.

পরিশিষ্ট: আত্মাদের মুক্তি দিয়ে ফিরে আসে প্রহর। কিন্তু ভুলতে পারে না সে অরিনকে। যতো দিন যায়, আরও বেশি করে যেন মনে পড়ে তাকে। অরিনের মোবাইলটা এখন সে ইউজ করে। ঐ মোবাইলে সে একটা রেকর্ডিং পায় অরিনের। ওটা মৃত্যুর আগে অরিন রেকর্ড করে গিয়েছিল প্রহরের উদ্দেশ্যে। ওটাতে সে বলে,

-প্রহর, আমার খুব ভয় করছে। আমাকে ওরা পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ে নিয়ে এসেছে। আমাকে ওরা মেরে ফেলতে চায় প্রহর। আমি মরতে চায় না প্রহর। বাঁচতে চাই অনেকদিন, তোকে নিয়ে বাঁচতে চাই। তা হয়তো আর সম্ভব হবে না। মৃত্যুর আগে তোর কণ্ঠটা শুনতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু তোর ফোন বন্ধ। তোর জন্যও কষ্ট হচ্ছে খুব। আমাকে তুই খুব ভালোবাসিস জানি। কী করে থাকবি তুই আমাকে ছাড়া? আমিও তোকে খুব ভালোবাসি রে। কিন্তু ওরা আমাদের দুজনের মিলন হতে দিলো না।' 

অরিনের কথা শেষ হতেই কয়েকটা ভয়ংকর হাসি শোনা গেল। এরপর জোরে চিৎকার করে উঠে অরিন।'

রেকর্ডিং বারবার শুনে প্রহর, আর চোখের জল ফেলে। এই রেকর্ডিংটাই অরিনের শেষ স্মৃতি। এটা কখনও মুছতে দেবে না সে....


......সমাপ্ত......


লেখক: Shohel Rana


রহস্যময় আরও গল্প পড়ুন।