গল্পঃসতীনের_সংসার | সতিনের সংসার

 দুই সতিনের ঘর

দুই সতিনের ঘর

আজ আমার বরের বিয়ে।ভুল বললাম,আজকের পর সে শুধু আমার বর নয়,আমার সতীনের ও বর হবে। সুন্দর করে নিজের হাতে সাজিয়ে দিলাম তাকে। শ্যামলা রঙের,লম্বা মানুষটাকে সাদা পাঞ্জাবিতে বেশ লাগছে।বিয়ের পাগরী মাথায় পরিয়ে দিতে চাইলাম,সে একটু বিরক্তির সাথে বলে উঠলো 

- হইছে তো!আমি কি প্রথম বিয়ে করতে যাচ্ছি???

- প্রথম বিয়েতে তো পাগরী পড়ার সৌভাগ্য হয়নি তাই এখন যখন সুযোগ পেয়েছ

পরে নাও।

কথাটা বলতে গিয়ে গলাটা কেমন যেনো ভারী হয়ে আসলো আমার।নিজেকে কোনমতে সামলে নিলাম। 


শাশুড়ি মা পাশের ঘর থেকে বেশ তাড়া দিচ্ছে

- তাড়াতাড়ি কর বাবা,দুপুর হয়ে যাচ্ছে দূরের রাস্তা,বউ নিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে তো!রাত হয়ে গেলে আবার ঝামেলা। নিয়ম কানুনের ব্যাপার স্যাপার ও তো আছে তাইনা।প্রথমেই যদি আমার কথা মতো চলতি তাহলে এই অলক্ষির মুখ দেখা লাগতোনা।এতদিনে নাতি নাতনীদের মুখ দেখে ফেলতাম।কপাল খারাপ আমার।যাওয়ার সময় এই অলক্ষীর মুখ দেখে যেনো বের হইতে না হয়,খেয়াল রাখিস।


- হইছে তো মা,আজ ও এইসব নাই বা বললে,তোমার কথা মতই তো সব হচ্ছে।বেচারি কে এখন একটু শান্তি দাও।

একটু ধমকের শুরেই বলে উঠলো বিজয়।


আমি বিজয়ের মুখ আঙ্গুলের স্পর্শে চেপে ধরলাম

- থাকনা!শুভ কাজে যাচ্ছো,মায়ের সাথে এভাবে কথা বলোনা।উনি আবার কষ্ট পাবেন।আমার এইসব রোজ শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছে।এখন আর কষ্ট হয় না।

- সত্যি করে বলো তো,তোমার কি একটুও কষ্ট হচ্ছেনা??

- নাহ্

- সত্যি?

-আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে?আজকে তো তুমি শুধু আমার,কালকে থেকে তুমি তো ভাগ হয়ে যাবে,এইটা বলে আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না।কেদেই ফেললাম।

- দেখো তুমি এমন করলে কিন্তু আমি সত্যি বিয়ে করতে যাবো না।আমি কিন্তু এমন প্রস্তাবে কখনোই রাজি ছিলাম না।শুধু তোমার কথায় রাজি হয়েছি।তবে তুমি এটাও জেনে রাখো,বিয়ে হয়তো করছি বাট তাকে আমি কখনোই মেনে নিতে পারবোনা।আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।

বিজয় আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো।


বড়ো ননদ এসে আমাদের এই অবস্থায় দেখে মুখ বেঁকিয়ে বলতে লাগলো

- তোমাদের নাটক শেষ হলে এবার এগোতে পারি?বেলা সাড়ে বারোটা বাজে।নাটক দেখতে দেখতে এখন আর ভাল্লাগেনা।

বিজয় আমাকে ছেড়ে দিলো।

আমি চোখ মুছে বিজয় কে বিদায় জানালাম।


জানালা দিয়ে ওদের গাড়িতে উঠে যাওয়া দেখছিলাম।যতক্ষণ না গাড়িটা চোখের আড়াল হলো ঠাই দাড়িয়ে ছিলাম।

ওরা যাওয়ার সাথে সাথে,বিছানায় শুয়ে চিৎকার করে কাদতে লাগলাম। আহ্ কি কষ্ট,এত কেনো কষ্ট হচ্ছে আমার।বিজয় তো বলেছে সে বাধ্য হয়েই বিয়েটা করছে,ভালোবেসে তো নয়।আর বিয়ে করতে তো আমিই রাজি করিয়েছি।সে শুধু আমাকেই ভালোবাসে।নতুন বিয়েটা তো শুধু মাত্র একটা সন্তানের জন্য।একজন উত্তরাধিকারের জন্য।যদি আমি একজন সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রাখতাম তাহলে হয়তো এই দিনটা কোনোদিন আমার জিবনে আসতো না।


আজ পুরোনো দিনের কথা গুলো খুব মনে পড়ছে।যেদিন প্রথম বিজয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। ইস কি বাজে পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম সেদিন। ভার্সিটিতে ঢুকতেই উষ্ঠা খেয়ে পরে গিয়ে জুতা জোড়া গেলো ছিড়ে।সবার কি অট্রহাশি।আমি খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম।আসলে জুতা ছেরাতে যতটা না লজ্জা পাচ্ছিলাম তার চেয়ে বেশি লজ্জা পাচ্ছিলাম ওই ছেলে গুলার সামনে এমন ভাবে পরে যাওয়াতে।

ওরা অনেক গুলা ছেলে,একজন আরেকজনের সাথে বলাবলি করছে।


- এভাবে হাসার কি হলো?একজন মানুষ পরে গেছে কোথায় তোরা হেল্প করবি, সেটা না করে তোরা হাসছিস!

- আরেহ হাসছি কি সাধে নাকি! দেখ না মেয়েটার জুতা ছিড়ে গেছে,আর এই জুতা যে আরো কতবার ছিড়েছে হিসাব নেই,দেখ জুতা জোড়া তে খালি সেলাই আর সেলাই।দেড়শো টাকার জুতায় ,সেলাই দেড়শো টার কম হবেনা।

- আরেহ মনে হয় হার কিপটার জাত।

- মনে হয় ময়লার ডাস্টবিন থেকে উঠে এসেছে।

- এইডারে তো আমি প্রতিদিন দেখি এক জামা পইরা আসে,ধুইতে ধুইতে জামার রং নষ্ট হয়ে গেছে তাও নতুন জামা বানায়না।


চা ওয়্যালা চা দিতে দিতে বললো,মেয়েটা অনেক কষ্ট কইরা লেখা পড়া করে।মা নাই,বাপ ঘরে পরা।

এই মেয়েটা দর্জগীরি আর টিউশনি কইরা অনেক কষ্টে নিজের পরা লেখা আর সংসার চালায়।

- আমিতো ভেবে ছিলাম এইটা হার কিপটার বাচ্চা কিন্তু এখন তো শুনছি একদম ফকিরের বাচ্চা,হাহাহা।


কথাটা শুনে আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না,অনেক কষ্ট করে উঠে ছেলেগুলোর সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বললাম

- এইযে শুনুন,মানুষের দরিদ্রতা নিয়ে মজা করবেন না।আমি গরীব এটা কি আমার অপরাধ? হ্যাঁ আমি আপনাদের মত দামী জামা কিনতে পারিনা,প্রতিদিন নতুন নতুন জামা পড়ার সামর্থ্য আমার নাই,এটা কি আমার অন্যায়?এক জুতা যতদিন পারি সেলাই করে পরি,কারণ যেই দেড়শো টাকা দিয়ে আমি নতুন জুতা কিনবো,সেই দেড়শো টাকা দিয়ে আমার দুই দিনের বাজার চলে।তাই দশ টাকা দিয়ে সেলাই করে নিলে আমার খুব বেশি অসুবিধা হবেনা কিন্তু যদি সময় মত বাবার মুখে খাবার আর ওষুধ তুলে দিতে না পারি তাহলে আমার বাবা কে বাঁচাতে পারবোনা।আমার পৃথিবীতে শুধু বাবা ছাড়া আর কেউ নেই।এইযে এত কষ্ট করছি কেনো জানেন? মনে একটা বড়ো আশা নিয়ে,যদি কখনো লেখাপড়া করে একটা ভালো চাকরি করতে পারি,তাহলে বাবাকে নিয়ে একটু ভালো মন্দ খেয়ে বেঁচে থাকবো।আপনারা বড়োলোক ঠিক ই কিন্তুু আপনাদের মনটা অনেক ছোট।মানুষকে সাহায্য করতে না পারলে ,কষ্ট দেওয়ার অধিকার আপনাদের নাই,মনে রাখবেন কথাটা।


আমি যখন এই কথা গুলো বলছিলাম,ছেলে গুলো আমার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে ছিলো।কোনো কথা বলা বা তর্ক কিছুই করেনি।তবে একটা জিনিষ খেয়াল করেছিলাম,সব ছেলেদের মধ্যে একটা চশমা পরা ছেলে চুপ ছিলো।যখন সব গুলো ছেলে আমাকে নিয়ে মজা করছিলো,তখনও ঐ চশমা পরা ছেলেটা তেমন কিছু করেনি,সে ফোন টিপা নিয়ে ব্যাস্ত ছিল বলেই হয়তো তেমন কিছু করেনি অথবা হতে পারে খুব ভদ্র।যখন আমি কথা গুলো বলছিলাম সে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো।

খুব কেদেছিলাম সেদিন।ক্লাস না করেই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।


পরেরদিন যখন ভার্সিটিতে গেলাম,চশমা পড়া ছেলেটা আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো

- সরি

- কেনো?

- কালকের ব্যাপারটার জন্য।

- আপনি তো কিছু করেন নি,তাহলে ক্ষমা চাচ্ছেন যে?

- আমার ওদের কে থামানোর উচিত ছিলো,ওরা যখন হাসাহাসি করছিলো আমার বাধা দেওয়া দরকার ছিলো বাট আমি তা না করে চুপ ছিলাম।

- তাতে কি,ওরা তো আর মিথ্যে কিছু বলেনি,শুধু আমার কাছে শুনতে খারাপ লাগছিলো।

- যদি আমি আপনাকে কিছু দেই,নিবেন?

- আমাকে দেখে কি আপনার খারাপ মেয়ে মনে হয়?

- আমি কখন বললাম আপনি খারাপ মেয়ে?

- বলেননি তবে বিনা কারণে অপরিচিত কাওকে কিছু দেওয়া অবশ্যই কোনো ভালো লক্ষণ হতে পারেনা।

- আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।

- সেটা হলেই খুশি হবো। এই বলতে বলতে ক্লাসে ঢুকে গেলাম।


ইদানিং এই ছেলেটা আমার পেছনে লেগেই থাকে,আমি যখন টিউশনিতে যাই,তখন ঐ পথে দাড়িয়ে থাকে।ভার্সিটিতে গেলে জোর করেই কথা বলে।কি চায় আমার কাছে?আমার আশেপাশে ঘোরাফেরা, আমাকে আড় চোখে দেখা,আমি কোথায় যাই নজর রাখা, কেনো করে এইসব।যা খুশি করুক তাতে আমার কি।


এক সপ্তাহ পর 


দরজায় এসে কে যেনো নক করলো,আমি বললাম ভেতরে আসুন।আমার বাসায় সারাদিন অনেক মানুষ ই আসে,কাপড় বানাতে দিয়ে যায়, বানানো হলে নিয়ে যায়।

তাই কে এসেছে না দেখেই ভেতরে আসতে বললাম।মানুষটা ভেতরে আসতেই চমকে উঠলাম,আপনি?

- তুমি একসপ্তাহ ধরে ভার্সিটিতে যাওনা কেনো?

- আপনি বাসা চিনলেন কিভাবে?

 - সেই চা ওয়ালার কাছ থেকে।

- কি চান আপনি?

- তুমি ভার্সিটিতে যাওনা কেনো? আপাতত এই টুকুই জানতে চাই।

- আমার বাবা মারা গেছে,এক সপ্তাহ আগে।

- কিভাবে!?

- অসুস্থ তো অনেকদিনের,ওইদিন হঠাৎ করেই....

-এখন কি হবে?কিভাবে একা একা থাকবে?

- কি আর হবে...,কপালে যা আছে তাই হবে।আপনি এখন প্লিজ চলে যান,কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।

- তুমি যাবে আমার সাথে?

- কোথায়!

- আমার বাড়িতে?

- আপনার বাড়িতে গিয়ে কি করবো?

- আমার সাথে থাকবে।

- হাহাহা,ভালই মজা করেন।

- মজা না,সত্যি বলছি।

- কোনটা সত্যি?

- আমি তোমাকে ভালোবাসি,এটাই সত্যি।

- ভালোবাসা গরীবের জন্য না।

দরজায় আবার কে যেনো টোকা দিলো,ভয়ে আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছিলো,কেও দেখলে আবার কি ভাববে কে জানে।


যেমনটা ভয় পাচ্ছিলাম ঠিক তেমন টাই হলো,মানুষ বলেনা যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়।আমার বেলাতেও হলো তেমন।দরজা খুলে দেখি বাড়িওয়ালা।


-গল্পঃসতীনের_সংসার

প্রথম পর্ব ( পর্ব ০১ )



-গল্পঃসতীনের_সংসার ( পর্ব ০২ )


দরজা খুলে দেখি বাড়িওয়ালা চাচা,সাথে আরো দুই জন ছেলে তমাল আর সুজন।বাড়ির সামনে আরো অনেক মানুষ জড়ো হয়ে আছে।আমি কিছু বলার আগেই তমাল আর সুজন ঘরে ঢুকে বিজয় কে শার্টের কলার ধরে বাইরে বের করলো।আমি বললাম 

- কি হয়েছে,ওনার সাথে এমন ব্যাবহার করছেন কেনো,ওনার দোষ কি?

- কি দোষ জানিস না?দিন দুপুরে পুরুষ মানুষ ঘরে আইনা রাখিস আবার বলিস দোষ কি?

- কি বলছেন এইসব! উনি আর আমি একই ভার্সিটিতে পড়ি,কিছুদিন ধরে ভার্সিটিতে যাইনা বলে খোজ নিতে এসেছে,আর কিছুনা।

বাড়িওয়ালা চাচা বললো এই ছেলেরে আরো অনেকবার আমি এই এলাকাতে ঘুর ঘুর করতে দেখছি,আইজকা হাতে নাতে ধরলাম।

তমাল আর সুজন আজকে উঠে পরে লেগেছে আমাকে কলঙ্কিনী প্রমাণ করতে।এই দুইটা ছেলে আমাকে খুব উত্যক্ত করতো অবশেষে পাত্তা না পেয়ে‌ পিছু ছেড়ে দিয়েছিলো,আজ সুযোগ পেয়ে প্রতিশোধ ও নিয়ে নিচ্ছে।


যখন কোনো কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না,তখনই বাড়িওয়ালী চাচী সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো

- আপনারা কেমন মানুষ হ্যা?এতদিন ধরে এই মেয়েটা এই এলাকায় থাকে,কখনো কি খারাপ কিছু দেখছেন?আজ একজন ছেলে বাসার ভিতর ঢুকতে দেখে বাসায় এসে এমন হইচই শুরু করছেন।সদ্য মেয়েটার বাপ মারা গেছে,এই মেয়েটার মনের উপর দিয়ে কি যাচ্ছে একবার ভেবে দেখেছেন?

আর ছেলেটা এসেছে তো বেশিক্ষণ হয়নি।আজ এই মেয়েটার কেউ নেই বলে আপনারা বিনাদোষে তাকে দোষী করছেন অথচ যখন আপনাদের নিজের মেয়েরা‌ স্কুল বা কলেজ থেকে কোনো বন্ধু নিয়ে আসে,তখন তো আপনারা সেটা খুব সহজেই মেনে নেন।একজন মানুষ খোজ নিতে আসতেই পারে তার মানে এই না যে তার সাথে মেয়েটির কোনো বাজে সম্পর্ক আছে।মেয়েটির কেউ নেই বলে আপনারা এমন করছেন?ভেবে দেখেন কালকে আপনিও হয়তো‌ থাকবেন না আপনার মেয়ের পাশে,তখন কি হবে ভেবে দেখেছেন?


বাড়িওয়ালী চাচীর কথা শুনে সবাই যার যার মতো চলে গেলেন।এ যাত্রায় চাচীর জন্য বেচে গেলাম।আমি সবার সামনে বিজয়‌কে চলে যেতে বললাম,ও কি জানি বলতে চাইলো আমি না শুনেই ঘরের ভেতর চলে আসলাম।তারপর থেকে বাড়িওয়ালী চাচীর সাথে আমার একটা অন্যরকম ভালো সম্পর্ক তৈরি হলো।উনি আমার ভালো মন্দ খোজ রাখতেন।


প্রায় একমাস পর ভার্সিটিতে আসলাম।আমাকে নিয়ে মজা করা ছেলে গুলো এখন আমাকে দেখলে অন্যদিকে ফিরে থাকে,যেনো আমার দিকে তাকাতে তারা লজ্জা পায়।তাদের চোখে আমি অপরাধ বোধ দেখতে পাই।ক্লাস শেষে মাঠের এক কোণে একাই বসে ছিলাম। এত বড়ো দুনিয়াতে আমার কেউ নেই ভেবে মাঝে মাঝে আমার খুব হাশি পায়।একটা বান্ধবী আছে কুইন নামে,তাকেও আজ দেখছিনা মনে হয় আসেনি।আমার মোবাইল ও নেই যে ফোন করে খবর নিবো।আসলে আমি গরীব বলে আমার সাথে কেউ বন্ধুত্বও করেনা।হঠাৎ বিজয় পাশে এসে বসলো,আমি ওখান থেকে চলে আসতে চাইলে, ওরনা ধরে থামিয়ে দিল।আমি রেগে গিয়ে বললাম


- বাসায় কলঙ্কিনী বানিয়ে শান্তি হয়নি,এখন কি এখানেও কলঙ্কিনী বানাতে চান?

- সরি

- সরি বললেই কি সব কিছুর সমাধান হয়ে যায়?কি ভাবেন নিজেকে?কেনো আমাকে খারাপ প্রমাণ করতে উঠে পরে লেগেছেন?কি ক্ষতি করেছি আমি আপনার?আপনার জন্য এখন আমি এলাকাতে মুখ দেখাতে লজ্জা পাই,আমার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি লেগে গেছে।গরীব বলে কি আমার কোনো প্রেস্টিজ নেই?আমিও মানুষ প্লিজ আমাকে দয়া করে ছেরে দিন।আমি এমনেই মনের ভিতর অনেক কষ্টের বোঝা নিয়ে আছি প্লিজ আপনি আমার সেই কষ্টের পরিমাণ আর বাড়িয়ে দিবেন না, দয়া করুন আমার উপর, দয়া করুন।


বিজয় আমার ওরনা ছেরে শক্ত করে আমার হাতটা ধরলো,নরম কণ্ঠে বলতে লাগলো

- ভালোবাসি তোমাকে তাই এমন পাগলামি করি।তোমার কষ্টের বোঝা বাড়াতে না,তোমার মনকে হালকা করতে চাই।তোমার সব রাগ,অভিমান,কষ্ট,ভালোবাসা সব নিজের করতে চাই।আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো,শুধু বলো না।ভয় পাও যদি আবার নতুন করে কষ্ট পাও এই ভেবে।আমি তোমাকে কথা দিলাম আমি কোনোদিন তোমাকে কষ্ট দিবনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি তুমিও আমাকে ভালোবাসো তবে কিসের এত লুকোচুরি! কি চুপ করে আছো কেনো?ভালোবাসোনা আমায়?আমার কাছে স্বীকার না করলেও নিজের কাছে কি অস্বীকার করতে পারবে?আমি দেখেছি তোমার চোখে আমার জন্য ভালোবাসা।

- আপনি আমাকে সত্যিই ভালোবাসেন?

- অনেক ভালোবাসি

- কি লাভ ভালোবেসে যদি বিয়েই না হয়?

- তুমি চাইলে সবই হবে

আপনার পরিবার কি আমাকে মেনে নিবে?

- আমি আমার পরিবারের এক মাত্র ছেলে,আমার পরিবার আমাকে অনেক ভালোবাসে তাই আমার কথা তারা ফেলতে পারবেনা।

- তাহলে তাদের কে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান।

- কার কাছে পাঠাবো,তোমার তো কেউ নেই।

- আমি যাদের বাড়িতে থাকি তাদের কাছেই পাঠাবেন।এখন তো ওনারাই আমার গার্জেন।

- আচ্ছা তাহলে রেডি থেকো কালকে।

আমি মুচকি হাশি দিয়ে সায় জানালাম।

সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত দুইজন একসাথে ছিলাম।জীবনের অনেক কথাই একে অপরের সাথে শেয়ার করলাম।


পরের দিন বিকেলে কয়েকজন‌ মহিলা আসলো আমাকে দেখতে।আমার হাত দেখছিলো,পা দেখছিলো,চুল দেখছিলো।আমার পরিবারের কথা জানতে চাইলে,সবটা খুলে বললাম।আমি তাদের ভাবশাপ দেখে বুঝলাম আমাকে তাদের পছন্দ হয়নি।বাড়িওয়ালী চাচী তাদের আপ্যায়ন করলেও তারা কিছু মুখে দেননি।

যাওয়ার সময় একজন মহিলা বলে গেলো

- শুনো মেয়ে বামন হয়ে চাঁদ ধরতে যেওনা।আমি বিজয়ের সব আবদার মেনে নিলেও এটা মানতে পারবোনা।তুমি আমাদের বাসার বউ তো দূরের কথা, কাজের মেয়ে হওয়ার ও যোগ্য না।আমার ছেলের আসে পাশে তোমায় যেনো কখনো না দেখি।কথাটা মনে রেখো।

কথা শুনে মনে হলো উনি সম্ভবত বিজয়ের মা হবেন।আমি জানতাম আমাকে তাদের পছন্দ হবেনা।তাই তাদের কথায় বেশি কষ্টও হচ্ছেনা,আগের থেকেই প্রস্তুত ছিলাম তো ব্যাপারটার জন্য তাই হয়তো।


অন্যদিকে বিজয়ের মা,বোন বিজয় কে বকাবকি করছিলো

- কি দেখে পছন্দ করলি এই মেয়েকে?না ভালো দেখতে ,না কোনো ভালো পরিবারের।থাকে একটা নোংরা বস্তিতে।গায়ের রং ও তো ময়লা।তুই শেমলা আমার ইচ্ছা ছেলের বউ ফর্সা হবে।আমার ছেলের রুচি যে এতটা খারাপ এটা আমার ধারণার বাইরে ছিলো। ছিঃ মানুষকে মুখ দেখাবো কিভাবে।

- মা আমি তো তার রূপকে ভালোবাসিনি,আমিতো তার দারিদ্রতাকে ভালোবেসেছি।আমিতো ভালোবেসেছি তার হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা কষ্টকে।একজন মানুষের কতটা ধর্যো থাকলে সব অপমান মুখ বুঝে সইতে পারে,আমিতো তাকে দেখেই বুঝেছি।কতটা সাহসী হলে একটা সংসারের দায়িত্ব নেওয়া যায়,এটা ওকে দেখে শেখা উচিৎ।

- বাবারে আবেগ দিয়ে গল্পঃ কবিতা চলে,জিবন চলেনা।ওই মেয়ে কে আমি কোনোদিন ও আমার ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে পারবোনা।

- কিন্তু মা আমিও যে তাকে ছাড়া আর কাউকে আমার স্ত্রী বলে মানতে পারবোনা।

- তাহলে শুনে রাখ,ওই মেয়েকে বিয়ে‌ করলে তোকে এই বাড়ি ছাড়তে হবে।

- তুমি যদি চাও তবে তাই হোক।তবুও আমি সুফিয়াকে ছাড়তে পারবোনা।


রাত বাজে এগারোটা,কে যেনো দরজায় টোকা দিচ্ছে।এত রাতে কে আসতে পারে।এখন তো কারও আসার কথা না,তাহলে?ভয়ে‌ ভয়ে দরজা খুললাম। একি বিজয়!এত রাতে?আপনি এখানে কেনো? কেউ দেখলে কি হবে জানেন?

- যা হবার তাই হবে।আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জড়িয়ে ধরলো।আমিও কেনো জানি নিজেকে সামলাতে পারলাম না,জড়িয়ে ধরলাম তাকে।দুইজনের কষ্ট যে আজ একটাই।পাওয়ার আগেই না হারিয়ে ফেলি ।কতক্ষন এভাবে ছিলাম জানিনা তবে চোখ খুলতেই বাড়িওয়ালী আর বাড়িওয়ালা কে দেখতে পেলাম।চাচা তো খুব রেগে গেছেন।কিন্তু বিজয়ের কথায় তিনি মাথা ঠান্ডা করলেন।

- চাচা আজ রাতেই আমরা বিয়ে করতে চাই,আপনারা কি আমাদের বাবা মা হয়ে পাশে থাকবেন?আমি আমার বন্ধুবান্ধব কে কাজী নিয়ে আসতে বলেছি।কিছুক্ষনের মধ্যেই এসে পড়বে।


সেদিন রাতেই আমাদের বিয়ে হল।তারপর প্রায় বছর খানেক শ্বশুর বাড়ির সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিলোনা।একদিন শাশুড়ি এসে খুব কান্নাকাটি করে নিয়ে গেলেন আমাদের কে বাড়িতে।বাড়িতে তুললেও মন থেকে কখনো মেনে নেননি আমাকে।অনেক কষ্ট সহ্য করেছি,তবুও দিন শেষে ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেয়ে সব কষ্ট ভুলেছি।বিয়ের দশ বছর হলেও একটা বাচ্চার মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি।ডাক্তার বলেছে আমি কখনো মা হতে পারবোনা।তবুও হাল ছাড়িনি।যতটুকু সম্ভব ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েছি কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।ভেবেছিলাম শাশুড়িকে একজন নাতি বা নাতনি উপহার দিয়ে তার মনে জায়গা করে নিবো,ভাগ্যের কি পরিহাস তা আর হলোনা।অবশেষে বাধ্য হয়েই নিজের স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে রাজি করিয়েছি।সে রাজি ছিলোনা,অনেক কসম দিয়ে,কান্নাকাটি করে রাজি করিয়েছি।এছাড়া আমার কি বা করার ছিলো!আমার সুখের জন্য আমিতো বিজয়ে কে বাবা হওয়া থেকে বঞ্চিত করতে পরিনা।তবে বিয়েতে রাজি করানোর পর শাশুরির রাগ আমার উপর অনেক টা কমে গেছে সেটা আমি খেয়াল করে দেখেছি।যাইহোক শাশুরির মনে একটু জায়গা পেয়েছি এটাই বা কম কিসের!


এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলতে পারবো না।গাড়ির শব্দে ঘুম ভাঙলো ।তাহলে কি বউ নিয়ে চলে এসেছে?


-গল্পঃসতীনের_সংসার ( পর্ব ০৩ )


গেটের সামনে গিয়ে দেখি শাশুড়ি মা বৌকে বরণ করার জন্য দাড়িয়ে আছেন।আমি বৌ এর মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু দেখতে পাচ্ছিনা,লম্বা ঘোমটা তার উপর এত মানুষের ভিড় এড়িয়ে দেখার কোনো সুযোগ পাচ্ছিনা।এই সব হুড়োহুড়ি থেকে একটু দূরে এসে দাড়িয়ে রইলাম।কি দরকার অযথা ভিড় বাড়ানোর।কিছুক্ষন পর বৌ কে বরণ করে গাড়ি থেকে নামানো হলো।কে যেনো ঘোমটা টা তুললো,আমি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।বাহ্ কি সুন্দর দেখতে,লম্বা ফর্সা একদম আমার শাশুরির মনের মত।এতদিনে আমার শাশুরির ইচ্ছা পূরণ হলো তাহলে।তার খুব ইচ্ছা ছিলো তার ছেলের বউ ফর্সা হবে,আমার গায়ের রং ময়লা বলে কত কথাই না শুনেছি।

সবাই যখন বলছিলো, বৌ দেখতে অনেক সুন্দর একদম চাঁদের মত,তখন পাশে দাড়িয়ে থাকা আমার বরের ঠোঁটের কোণে হাসির ঝলক দেখতে পেলাম।নাহ্ এ হাসি তো কোনো মিথ্যে হাসি নয়,এত মনের আনন্দে ফুটে ওঠা প্রাপ্তির হাসি।তবে কি সেও মুগ্ধ হয়ে গেলো তার রূপে!


রাতে নতুন বৌ আর বিজয় কে একসাথে খেতে দেওয়া হলো।বিজয়ের বন্ধুবান্ধব,ছোট বোন, বড় বোন,বাবা মা সবাই ছিলো সেখানে শুধু আমিই ছিলাম না।সবাই যার যার মতো খাওয়া শেষ করে উঠলো,অথচ কেউ একবার আমার খাওয়ার কথা‌ মনেও করলো না!বিজয় তো একবার জিজ্ঞেস করতে পারতো আমার কথা,ও কি জানেনা আমিযে ও কে ছাড়া খাইনা।যখন নতুন এসেছিলাম এই বাড়িতে,খাবারের অভাব না থাকলেও,আমাকে খাবারে অনেক কষ্ট দেওয়া হতো।একদিন বিজয়ের চোখে ব্যাপারটা ধরা পরলো,সেদিনের পর থেকে সে আমাকে রেখে কখনো খায়নি।অথচ এতদিনের অভ্যাস সে আজ কিভাবে ভুলে গেলো।যে মানুষটা বিয়েতে রাজি ছিলোনা,সে মানুষটা বিয়ে না করতেই এতোটা পাল্টে গেলো কিভাবে?


আজ আমার বিছানায় নতুন বৌ কে থাকতে দেওয়া হলো।খুব কষ্ট হচ্ছে ঘরটা ছাড়তে।ঘরের প্রতিটা জিনিষ খুব যত্ন সহকারে নিজের হাতে সাজিয়েছিলাম,আজ সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেলো।আমি বিজয়ের মুখের দিকে একবুক আশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম,ভেবে ছিলাম ও বলবে,সুফিয়া তুমি কোথাও যাবেনা,এই ঘর তো একমাত্র তোমার।এই ঘরে একমাত্র তোমার থাকার অধিকার আছে,আর কারো না।কিন্তু আশাহত হয়ে‌ চলে আসলাম অন্য ঘরে।মনে হলো সেও চাচ্ছে আমি এ ঘর থেকে চলে যাই। 

স্বামী হারালাম,ঘর হারালাম,কবে জানি এই বাড়ি থেকেও হারিয়ে যাবো নিঃশব্দে।

আজ আমি একদম নিঃস্ব, বাবা হারিয়ে যেই মানুষ টাকে বেচে থাকার জন্যে আকরে ধরে ছিলাম সেই মানুষটাই আজ খুব যত্ন করে হৃদয়টা ভেঙে দিলো। আসলে প্রিয় মানুষরাই তো পারে,এত যত্ন নিয়ে কষ্ট দিতে...


না,কিছুতেই ঘুম আসছেনা।এই একটা সমস্যা আমার,নিজের বিছানা ছেড়ে অন্য বিছানায় ঘুমোতে পারিনা।

আচ্ছা সত্যিই বিছানা নাকি ঘুম না আসার কারনটা নিজের থেকেই লুকাতে চাইছি আমি?

দীর্ঘ দশ বছরে কখনো বিজয়কে‌ ছাড়া ঘুমাইনি। বাপের বাড়ী নেই,যাওয়ার মতো ও কোনো জায়গা ছিলোনা,তাই কখনো আলাদা থাকা হয়নি। অথচ আজ একই বাড়িতে দুজন আলাদা।এতদিনের অভ্যাস কি আর একদিনে ভোলা যায়।যার বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাতাম,তার বুকে আজ অন্য কেউ মাথা রেখে ঘুমাবে।বিজয় কি জানেনা একা থাকা কতটা কষ্টের,আমি যে তাকে ছাড়া ঘুমোতে পারিনা সে কি বুঝেনা?

আর বুঝবেই বা কি করে,এখানে আমি একা থাকলেও,ওর পাশে তো আজ সুন্দরী নতুন বৌ।

বুকের ভিতর চিন চিন করে ব্যাথা করছে,গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে।মনে হচ্ছে এখনই বুঝি মারা যাবো।এমন ভাবে বেচে থাকার চেয়ে মৃত্যুতেই শান্তি মনে হচ্ছে।


রাতটা কোনো মতে কাটিয়ে সকালে উঠেই সংসারের কাজে হাত লাগলাম।কিছুক্ষন পর বিজয় এসে নাস্তার টেবিলে বসলো,ওর বৌ এখনও নিচে নামেনি হয়তো গোসল নিয়ে ব্যাস্ত।আমি বিজয়কে ‌নাস্তা দিলাম।সুযোগ পেয়ে একটা প্রশ্ন করে বসলাম

- বাসর রাত কেমন কাটলো?

-কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,নাস্তা করেছো?

- আমি এই দশ বছরে কখনো তোমাকে ছাড়া খেয়েছি?

- রাতে খাওনি তুমি???

- আমার খাওয়ার খোজ কে রাখে?

- এখনই খেয়ে নাও,পরে কাজ করো।

- আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছো?

বিজয় আর কথা না বাড়িয়ে টেবিল থেকে নাস্তা না খেয়েই‌ উঠে পরলো।ও আমার চোখে চোখ রাখার সাহস পেলোনা।

কিছুক্ষন পর নতুন বৌ নিচে নেমে এলো।শাশুড়ি মা, বৌ এর সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো।আমাকে দেখিয়ে বললো,এইটা তোমার সতীন।এতক্ষন সবাইকে সালাম দিলেও আমাকে সে সালাম দেইনি।আমি বললাম তুমি আমাকে কি বলে ডাকবে জানিনা,আমি তোমাকে ছোট এবং তুই করেই ডাকবো।


এভাবেই চলছিলো দিনকাল।বিজয়ের থেকে দুরত্ব দিন দিন বেড়েই চললো।মাসে দুই একদিন সে আমার ঘরে এসে থাকতো,দায়িত্ব হিসেবে। আমিও সেটাকে ভালোবাসা ভেবে খুশি থাকতাম।যাইহোক ভালোবাসার মানুষের কাছাকাছি আছি,মাসে এক দুই বার হলেও তো তার দেখা পাই এটাই যথেষ্ট।

এখন তো আমার তাকে ছাড়া খাওয়া,থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে।আগে যখন ছোট ছিলোনা,রাত এগারোটা পর্যন্ত বিজয়ের জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতাম,ছোট এসে সেই কষ্ট থেকে আমাকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছে।একদিন আমাকে রাতের খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখে ছোট বললো,

- বুবু তুমিতো সারাদিন অনেক কাজ করো,এত রাত পর্যন্ত তোমার খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতে হবেনা।তুমি ঘুমাও গিয়ে,আমি ওনাকে খাবার দিয়ে দিবো।

একদিন যার মুখ দেখে সারাদিনের কষ্টের কথা ভুলে যেতাম,আজ তার জন্য অপেক্ষা করা ও বারণ।আমি মুখ ফুটে কিছু না বললেও আমার বুঝতে বাকি নেই,কৌশলে আমাকে বিজয়ের থেকে আরো এক ধাপ দূরে সরানো হলো।তবুও আমি ছোট কে কোনো দোষ দেইনা।ছোট তো আমার সতীন, কিন্তুু বিজয় তো আমার স্বামী।সে যখন আমার খোজ নেয়না,সতীন কে দোষ দিয়ে কি হবে।


এর মাঝে শ্বশুর মারা গেলো হঠাৎ,বাড়িতে কান্নাকাটির ধুম পড়ে গেলো।শ্বশুরের মৃত মুখটা দেখে বাবার কথা খুব মনে পড়ছিলো।বিজয় সেদিন সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাদছিলো আর বলছিলো,আমিও তোমার মত বাবা হারা হয়ে গেলাম।

ইদানিং শাশুড়ি অসুস্থ থাকে বেশি,রাতে ঘুমায় না ঠিক মত।খাওয়া দাওয়া না করে শুধু কান্নাকাটি করে।তিনিও একা আমিও একা,তাই মাঝে মাঝে রাতে আমি তার সাথেই থাকি।শাশুরির সাথে সম্পর্ক টা এখন মধুময় হয়ে‌ উঠেছে।অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করি দুজনে,এক সময় গল্প করতে করতে সে ঘুমিয়ে যায়,আমার রাত টা মাঝে মাঝে ঘুমহীন কেটে যায়।মাঝরাতের আকাশের সাথে যে আমার একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।কত ঘুমহীন রাতের সাক্ষী এই রাতের আকাশ।বারান্ধায় দাড়িয়ে আকাশ দেখে দেখেই অনেক রাত কাটিয়ে দেই।


ছোট ও ইদানিং খুব অসুস্থ থাকে,খায়না।শাশুড়ি বললো ডাক্তার দেখাতে।সন্ধ্যায় বিজয় ছোট কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলো,রাতে ফিরে আসলো সুখবর নিয়ে। বিজয় ‌ মা কে খুশিতে চিৎকার করে জানালো,উনি দাদী হতে চলেছেন।এতদিনে এই ঘরে নতুন মেহমান আসছে।মিষ্টি নিয়ে মায়ের মুখে তুলে দিলো,আমিও সেখানে দাড়িয়ে ছিলাম আমার মুখেও মিষ্টি তুলে দিয়ে বললো

-সুফিয়া অবশেষে আমি বাবা হবো ,এতদিনের স্বপ্ন পূরণ হবে আমার।

- আর আমি হবো তোমার বাচ্চার সৎ মা।

- এভাবে বলছো কেনো,তুমি খুশি হউনি?

- কেনো খুশি হবো না,এই দিনটা দেখার জন্যই তো তোমাকে বিয়ে করিয়ে ছিলাম।

বিজয় আজও এড়িয়ে গেলো আমাকে,কথা বাড়ালো না।কেনো জানি আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেনা ও।মুখে খুশির কথা বললেও,মন থেকে খুশি হতে পারিনি,সতীন বলেই হয়তো।


এখন বিজয় ছোট কে খুব যত্ন করে।নিজের হাতে খাইয়ে দেয়,উপর থেকে নিচে নামতে দেয়না।আমিও যতটুকু পারি করি,না হলে যে সবাই বলবে সতীন বলে হিংসা করি।তবে মনে মনে সহ্য করতে পারতাম না ওদের এত ভালোবাসা। হিংসা, না পাওয়ার ব্যাথা,হারানোর শোক সবকিছু আষ্টেপিষ্টে জাপটে ধরেছে আমায়।

মাঝে মাঝে শাশুড়ি মা বিজয় কে‌ দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিতো,বলতো

- বাবা সুফিয়াও কিন্তুু তোর স্ত্রী,ওকেও একটু সময় দিস।তাই মাঝে মাঝে দায়িত্ব পালন করার জন্য আমার কাছে আসতো, তাও আবার শাশুড়ি মনে করিয়ে দেবার পর। কিন্তুু এখন আর আমার এইটা ভালো লাগেনা।যেখানে ভালোবাসা নেই , সেখানে এই শারীরিক সম্পর্কটা শুধুই নোংরামি।আস্তে আস্তে ওর কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে আনলাম।কখনো ওর সামনে পরতাম না। ও সারাদিন বাসায় থাকতোনা,সকালে যেতো আসতো অনেক রাতে।শুক্রবার বাসায় থাকলে দেখা হলেও কথা বলতাম না।আগে মাঝে মাঝে শাশুড়ি রুমে থাকতাম এখন পার্মানেন্ট থাকতে শুরু করেছি।যেনো কোনো ভাবেই দায়িত্ব নামের নোংরামি টা আমার সাথে না হয়। কবে যে কতটা দূরে চলে এসেছি সেই খোজ ও সে রাখেনি।


দেখতে দেখতে চলে আসলো কাঙ্খিত সেই দিন।আজ ছোটর ‌ডেলিভারি ডেট।বেলা বারোটায় সিজার হওয়ার কথা।আমার স্বামী বাবা হবে,শাশুড়ি দাদী হবে আর আমি হবো সৎ মা....


-গল্পঃসতীনের_সংসার ( পর্ব ০৪ )


ছোটো কে নিয়ে হসপিটালে উপস্থিত হলাম।সিজারের সব ব্যাবস্থা হয়ে গেছে,ডাক্তার বললো রক্তের ব্যাবস্থা করে রাখতে,রক্তের প্রয়োজন পরতে পারে।আমি ডাক্তার কে বললাম সমস্যা নাই,আমার আর রোগীর ব্লাড গ্রুপ একটাই,ব্লাড লাগলে আমি দিবো। বিজয় কি যেনো ভেবে বললো

- তোমার ব্লাড দিতে হবেনা,আমি দেখি ব্লাড ব্যাংকে ব্লাড পাওয়া যায় কি না।

- কেনো ভয়‌ পাও?

- কিসের‌ ভয়?

- যদি আমার রক্তে তোমার স্ত্রীর শরীরে বিষক্রিয়া শুরু হয়ে যায়!

- এভাবে কথার মারপ্যাচে আমাকে আঘাত না করলেও পারো।তোমার এমন ভাবে বলা 

কথা গুলো ছুরির মত আঘাত করে বুকে।

- তোমার অবহেলা গুলোও আমাকে এভাবেই আঘাত করে।

-আমিতো তোমার শরীর খারাপ হবে ভেবে বলেছি কথাটা।

- আমার কথা তুমি নাইবা ভাবলে..


এমন সময় নার্স এসে বিজয় কে বললো,আপনি মেয়ের বাবা হয়েছেন,আর রক্তের প্রয়োজন পরেনি,মা ও বাচ্চা দুজনেই সুস্থ।আমি আর বিজয় ছোটোর‌‌ কাছে গেলাম।নার্স বাচ্চাটাকে এগিয়ে দিলো আমাদের দিকে,আমি হাত বাড়ালাম কোলে নেওয়ার জন্য কিন্তুু ছোটো নার্স কে বললো, বাচ্চাকে আগে ওর বাবার কোলে দিন পরে অন্যকেউ নিবে।আমি হাত নামিয়ে নিলাম।নার্স বাচ্চাটাকে বিজয়ের কোলে দিলো, বিজয় মেয়ে কে কোলে নিয়ে কপালে একটা চুমু দিলো।তার চোখের কোণ বেয়ে একফোটা পানি ঝরে পড়লো।আমি তার চোখে মুখে বাবা হওয়ার আনন্দ দেখতে পেলাম।তার অনুভূতিটা আমিও মন থেকে অনুভব করছিলাম।বাবা হওয়ার সুখ যে কত টুকু তাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।

ইস কত কষ্টইনা করেছি একটা বাচ্চার জন্য ডাক্তার, কবিরাজ আরো কত জায়গায় গিয়েছি।কবিরাজের কথায় শীতের দিন মাঝরাতে গোসল করে ওষুধ খেয়েছি,তারপর ঠান্ডা জ্বরে বিছানায় পড়েছিলাম কতদিন তবুও কোনো কিছুতেই কোনো লাভ হয়নি অথচ ছোটো কত সহজেই মা হয়ে গেলো।তার কোনো কবিরাজের দরকার পড়লোনা,তার জন্য স্বামীর ভালোবাসাটাই যথেষ্ট ছিলো।


তিনদিন পর ছোটো কে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো।শাশুড়ি মা নাতনি কে কোলে নিয়ে তার গলার চেইন খুলে পরিয়ে দিলেন আর নাতনির নাম রাখলেন পরী।দেখতেও পরীর মত।মায়ের মতই সুন্দরী হয়েছে।

পরী রাতে খুব জ্বালায় তাই ছোট ঠিক মত ঘুমাতে পারেনা।দিনের বেলায় আমি ছোটো কে বলি,তুই একটু ঘুমা রাতে তো ঘুমাতে পারিস না আমি পরী কে দেখবো।ছোটো তাই করে রাতে ও পরী কে নিয়ে থাকে আর আমি দিনের বেলায়।

এখন আমার অনেক টা সময় পরীর সাথে কেটে যায়।ওর হাত পা নাড়াচাড়া,ওর হাসি খেলাধুলা এগুলো আমাকে কিছুক্ষনের জন্য হলেও সব কষ্ট ভুলিয়ে রাখে।সতীনের মেয়ে‌ ভেবে যেখানে হিংসা হওয়ার কথা,সেখানে আমি পরী কে খুব বেশীই ভালোবাসি। ওর নিস্পাপ মুখটা আমাকে বার বার ওর কাছে টানে।আমিযে ওর মধ্যে আমার বিজয়ের আনন্দ কে খুজে পাই।

তবে ইদানিং ছোটো পরী কে আমার কাছে বেশি আসতে দেয়না।আমি পরী কে আদর করি এটা ওর পছন্দ না।আমার থেকে পরী কে দূরে সরিয়ে রাখে।নানান সময় নানান কথার মাঝে অপমান করে আমাকে,তবুও আমি পরীর থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারিনা।পরী ও আমাকে দেখলেই কোলে আসার জন্য অস্থির হয়ে যায়।


একদিন পরী খেলতে খেলতে পরে গিয়ে ব্যাথা পেলো,যদিও আমি সামনেই ছিলাম। ঠোট কেটে রক্ত পড়ছিলো,আমি রক্ত বন্ধ করানোর চেষ্টা করছিলাম।ছোটো দৌড়ে এসে পরী কে আমার কোল থেকে কেরে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো

- তুমি সামনে থাকতে পরী ব্যাথা পেলো কিভাবে?

- খেলতে খেলতে কিভাবে যেনো পরে গেলো জানিনা।

- জানো‌‌ না নাকি ইচ্ছা করেই ব্যাথা দিয়েছো?

- কি বলছিস এসব,এটা তুই বলতে পারলি?

- কেনো পারবোনা,তুমি যে আমাকে হিংসা করো আমি জানিনা নাকি!

- আজ পর্যন্ত তোর ক্ষতি হয় এমন কোনো কিছু করেছি আমি?

- করো নাই তবে,করতে কতক্ষন।নিজে তো মা হতে পারোনি,তাই আমাকেও সন্তান ছাড়া করতে চাও?তুমি পরীর আশেপাশে না আসলেই খুশি হবো।

বিজয় এসে জিজ্ঞেস করলো

-কি হইছে,এত চিল্লাচিল্লি কিসের?

- আমি বললাম,তোমার বৌ আমাকে পরীর কাছে যেতে মানা করলো।আমি নাকি পরী কে ইচ্ছা করে ব্যাথা দিয়েছি।বিজয় ছোটো কে কিছু বললো না, উল্টা আমাকেই বললো,তুমি পরীর কাছে এসো না তাহলেই তো হয়।


 রাত বাজে তিনটা,কিছুতেই ঘুম আসছে না।বার বার ছোটর‌ বলা কথা গুলো মনে পরছে,আর কান্না পাচ্ছে।

আমি মা হতে পারিনি বলে,পরীর ক্ষতি করবো এইটা ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠে অথচ ছোটো কত সহজেই কথাটা বলে ফেললো। 

না বিছানায় শুয়ে থাকতে পারছিনা।আস্তে করে উঠে বারান্দায় চলে গেলাম,যেনো শাশুড়ি জেগে না যায়।খুব চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছা করছে,মুখে কাপড় চাপা দিয়ে চিৎকার করে কাদতে লাগলাম।এই কান্নাই তো আমার একমাত্র সঙ্গী,কান্না করেই মনের কষ্ট গুলোকে হালকা করতে পারি।কাদতে পারি বলেই এখনও বেচে আছি।আকাশে কত সুন্দর চাঁদ ঝলমল করছে।আমার মনে এত মেঘ কেনো।মেঘ জমতে জমতে মনের ভেতরে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে,তবুও এক টুকরো আশা নিয়ে বেঁচে আছি যদি কখনো এই মেঘ ভেঙ্গে সূর্য উঠে।


পেছন থেকে কে যেনো ঘাড়ে হাত রাখলো,আমি চমকে গিয়ে

- কে???

- আমি।

- মা আপনি এখানে?

- তুই ঘুমাসনি‌ কেনো?

- এমনি ঘুম আসছেনা

- আমি তোর থেকে সব কিছু কেরে নিয়েছি তাই না?বিজয় কে‌ কেরে নিয়েছি,তোর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছি।

- না মা,সবই আমার ভাগ্য।

- নারে‌‌ মা ভাগ্য না,সব কিছু আমার কারনেই হয়েছে। আমার কারনেই তোর মত একটা দুখি‌‌ মেয়ে আজ ছন্নছাড়া।সব ই আমার দোষ।

- দোষ না মা,এটা আপনার অধিকার।ছেলের ঘরে সন্তান দেখার ইচ্ছাটা কোনো দোষের নয়,।আমি কাওকে দোষারোপ করিনা,আমার কপালে যা ছিল তাই হইছে। কিন্তূ মা আমিতো নিজের থেকেই সব অধিকার ছেরে দিয়েছি স্বামী,ঘর,সুখ সবই তো ছোট কে দিয়ে দিয়েছি।ওর মেয়েটা কে‌ নিয়ে একটু খেলি বলে,ওর সহ্য হয় না।আমি নাকি পরী কে ওর কাছ থেকে কেরে নিতে চাই,ও এই কথাটা বলতে পারলো।কিভাবে পরলো মা ও এই কথাটা বলতে?তার উপর বিজয় ও আমাকে পরীর কাছে যেতে মানা করলো,কেনো করলো মা এমন টা বলতে পারেন?

শাশুড়ি মা আর কোনো কথা বললেন না,আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলেন।আমিও ছোট বাচ্চাদের মত তাকে আগলে ধরে কাদতে লাগলাম।এই মাঝরাতে যখন সবাই ঘুম,আমি আর আমার শাশুড়ি কান্নায় ব্যাস্ত।


সকালে রান্না করছিলাম এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো দরজা খুলতেই অবাক হয়ে গেলাম

- কিরে কুইন তুই এখানে?

- কেনো এসে কি খুব অপরাধ করে ফেলেছি।

- আরেহ না,কি বলছিস এইসব?আয় ভেতরে আয়।

শাশুড়ির সাথে কুইনের পরিচয় করিয়ে দিলাম।শাশুড়ি বললো ,তোমরা ঘরে গিয়ে গল্প করো,আমি চা নাস্তা পাঠাচ্ছি।আমরা 

ঘরে এসে বসলাম।আমি বললাম

- এতদিন পর কিভাবে আসলি?

- তোর কথা মনে পড়লো তাই চলে আসলাম।

- বাসা চিনলি কিভাবে?

- ইচ্ছা থাকলে সবই হয়,ইচ্ছা ছিলো তাই খুজে নিয়েছি।

- আচ্ছা কেমন আছিস বল?

- তুই কেমন আছিস সেটা বল?

- একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে,আছি ভালই।

- এটাকে কি ভালো থাকা বলে?

-দামী শাড়ি,ভালো খাবার, বড়ো ঘর আর কি লাগে ভালো থাকার জন্য?

- আর স্বামী?তাকে কি পাশে লাগেনা ভালো থাকার জন্য

- পাশেই তো আছে।

- সেটা তো শুধু নামে,সত্যিটা তুইও জানিস আমিও জানি।এভাবে কি বেচে থাকা যায়?

-‌ বেচেই‌ তো আছি,মরিনি তো!

-দয়া করে চুপ করবি তুই?নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছিস কি হাল হয়েছে তোর?কেনো এভাবে নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী করে রেখেছিস!এসব করে কি প্রমাণ করতে চাস,তুই দুনিয়ার সব চেয়ে ভালো মেয়ে ,মুখ বুঝে সব সহ্য করতে পারিস!

- এছাড়া কিই বা করার আছে আমার?

- অনেক কিছু করার আছে।তুই ভুলে যাস কেনো,তুই একজন মাস্টার্স কমপ্লিট করা মেয়ে,তুই চাইলেই একটা ভালো জব করতে পারিস।

- বিজয় রাজি হবেনা।

- বিজয় কি আধও তোর কথা ভাবে?

একজন শিক্ষিত মেয়ে হয়ে, ঘরের ভেতর নিজেকে বন্দী করে রেখে,এমন দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে বেচে থাকার কোনো মানে হয় না।কেনো মিছেমিছি পরে আছিস এই সংসারে,এত অপমানের পরেও,কিসের আশায়?তোর বেঈমান স্বামী তো খুব সুন্দর করেই সংসার করে যাচ্ছে,আর তুই কেদে কেদে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছিস।

- বিজয় কে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারবোনা।

- আমি বলছিনা তুই তোর স্বামীর সংসার ছেড়ে দে,শুধু বলছি এই মিথ্যে মায়া থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে আয়।তুই না সব সময় বলতি লেখাপড়া শেষ করে একটা ভালো চাকরি করবি,তাহলে এখন কোথায় গেলো তোর সেই স্বপ্ন?

- স্বপ্ন দেখতে যে ভুলে গেছি।

- ভুলে গেলে চলবেনা, বাচতে হলে সপ্ন দেখতে হবে,ভালো থাকতে হলে সে গুলো পূরণ করার চেষ্টা করতে হবে।তোকে নিজের ভালো থাকার পথ খুজে নিতে হবে। একবার বাইরে বেরিয়ে দেখ,তুই কত স্বাধীন।একটা জব কর,নিজেকে কাজে ব্যাস্ত করে দেখ কতটা ভালো লাগে।সবার জীবনেই কিছু না কিছু কষ্ট আছে,তাই বলে সেই কষ্টের কথা ভেবে মূল্যবান সময় টাকে নষ্ট করা যাবেনা।কষ্টের মাঝেই সুখ খুজে নিতে হবে। বেচে থাকা ই সব না,ভালো থাকাও জরুরি।নিজের ভালো থাকার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে।

- আচ্ছা আমিতো কখনো তোকে এইসব ব্যাপারে কিছু বলিনি,তাহলে তুই জানলি কিভাবে?

- ঐযে বললাম না ইচ্ছে থাকলে অনেক কিছু হয়,ইচ্ছে ছিলো তাই জেনে গেছি।আর সতীনের সংসারে একটা মানুষ কেমন থাকতে পারে,সেটা তুই বলার পর আমি জানবো?তোর কষ্টটা যদি না জানি,না বুঝি তাহলে কেমন বন্ধু আমি!

- আচ্ছা বাদ দে,এখন নাস্তা কর।


সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে ছিলাম,শাশুড়ি এসে পাশে বসলেন,জিজ্ঞেস করলেন

- কিরে মন খারাপ?

- নাহ্ ভাবছি।

- কি ভাবছিস?

- আমি একটা জব করতে চাই।

- কেনো তোর কি কোনো কিছুর জন্য টাকা লাগবে?

- না মা,আসলে ব্যাপারটা তেমন না।আমি চাইছি নিজেকে কোনো কাজে ব্যাস্ত রাখতে।বাড়িতে থাকলে পরীর থেকে দূরে থাকতে পারিনা,পরীর কাছে যাওয়া ও ছোটোর‌ পছন্দ না।এভাবে দিনকে দিন আমি ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছি,আর মাসের শেষে হাত খরচের টাকাটাও বিজয়ের কাছ থেকে নিতে হবেনা।সব ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি,এখন আপনি কি বলেন?

- আমি আর কি বলবো,আমিতো জিবনে তোকে কম কষ্ট দেইনি।তোর যেটা ভালো লাগে কর তবে একটা শর্ত আছে।

- কি শর্ত?

- যাই করিস এই বাড়ি ছেড়ে তুই যেতে পারবিনা,তোর সাথে গল্প না করে যে আমার ঘুম হয় না।

- আচ্ছা মা তাই হবে।তবে ভাবছি বিজয় কি রাজি হবে?

- কথা বলে দেখ কি বলে।


আমি রাতে ওদের ঘরে গেলাম,ওদের বলতে যেই ঘরটা এক সময় আমার ছিলো।প্রায় দুই বছর পর এই ঘরটায় আসলাম।অনেক কিছু চেঞ্জ করা হয়েছে এই ঘরে,আলমারির জায়গায় টেবিলে রাখা হয়েছে,খাট যেখানে ছিলো সেখানে নাই,অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।আগের মত কিছু নেই, ছোটো নতুন করে সাজিয়ে নিয়েছে।যাইহোক আমি ঘরে ঢুকার আগে একটু কাশি দিয়ে নিলাম।ছোটো বললো কে ,আমি ভেতরে যেতেই 

বিজয় বললো

- তুমি?

- একটা কথা বলার ছিলো।

- কি বলো?

ছোটো বললো এখন কথা বলা যাবেনা,পরী ঘুমিয়েছে উঠে পরবে। বিজয় বললো,

- সুফিয়া তাহলে চলো ছাদে গিয়ে কথা বলি।

- এত রাতে ছাদে কেনো,থাক তাহলে কালকে সকালে বলবো।

- নাহ্ এখনই চলো,সকালে আমার সময় নেই।

ছোটো রাগে জলছে,ও ভেবেছিলো পরীর ঘুম ভাঙ্গার কথা বললে হয়তো বিজয় আমার সাথে কথা বলবেনা।কিন্তু এতে হিতের বিপরীত হয়ে গেলো।আমি ছোটোর কান্ড দেখে না হেসে পারলাম না।যেখানে আমি নিজের থেকেই সব ছেড়ে দিয়েছি,তবুও যে এত কিসের ভয় ওর বুঝিনা।

আমি আর বিজয় ছাদে গেলাম...


চলবে...


(নেক্সট বললেও দেবো, না বললেও দেবো।তাই এগুলো না লিখে গল্পটা কেমন লাগছে সেটা বলো)


-গল্পঃসতীনের_সংসার ( পর্ব ০৫ ) 


অনেকদিন পর বিজয়ের সাথে ছাদে আসা।রাতের আকাশে চাঁদটা কেমন ঝলমল করে জ্বলছে। বিজয় ছাদের এক পাশে দাড়িয়ে,আমি অন্য পাশে।খুব কাছাকাছি না,আবার বেশি দূরেও না। বিজয় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমাকে বললো

- কি বলতে চাও,বলো।

- আমি জব করতে চাই।(ভয়ে ভয়ে‌ বললাম)

- কোথায়?

- এখনো ঠিক করিনি তবে কুইন বলেছে যদি জব করি তাহলে খুজে দিবে।

- আচ্ছা।

- কি আচ্ছা?

- কুইন কে বলো জব খুজতে।

- তুমি না এক সময় আমার জব করা পছন্দ করতে না,এখন এত সহজে রাজি হয়ে গেলে?

- কেনো রাজি না হলে কি খুশি হতে?

- নাহ্,তবে এত সহজেই রাজি হবে ভাবিনি।

- পৃথিবীতে অনেক কিছুই মানুষের ভাবনার বাইরে থাকে।

- হুম,যেমন তোমার আমার সম্পর্কটা সব ভাবনার বাইরে ।

- আচ্ছা বলতে পারো,আমাদের জিবন টা এমন কেনো হলো?অন্যরকম ও তো হতে পারতো।

- আমিযে মা হতে অক্ষম তাই হয়তো!

- আমরা চাইলেই একটা বাচ্চা দত্তক নিতে পারতাম।

- তাতে তুমি খুশি হলেও,তোমার পরিবার খুশি হতো না।


বিজয় আমার আরেকটু কাছে এসে বললো

- একটা সত্যি কথা বলবে?

- কি কথা?

- এখনও কি ভালোবাসো আমায়?

- অনেক রাত হয়েছে‌ ঘুমাতে গেলাম।

- এড়িয়ে যাচ্ছো?

- হুম,যেমন তুমিও এড়িয়ে যাও আমার প্রশ্ন গুলো।

- আকাশের চাঁদ টা কত সুন্দর দেখাচ্ছে,তাইনা?

- হ্যা,তবে সেটা আমাদের জন্য না,একসাথে চাঁদ দেখার অধিকার আমরা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি।

- ভুলে যেওনা,তুমি এখনও আমার স্ত্রী।

- সেটাতো শুধু কাগজে।

- এভাবে কেনো নিজেকে আড়াল করে রাখো?

- তুমি নিজেকেই প্রশ্ন করো,উত্তর পেলেও পেতে পারো।

- তোমার সাথে তর্ক করে পারবোনা,তাই তর্কে যেতে চাইনা।

- তাহলে ঘুমাতে যাও।

- আর তুমি?

- আর কিছুক্ষন না হয় থাকি,চাঁদ দেখি।

- আমি তোমার পাশে থাকলে কি খুব ক্ষতি হবে?

- ক্ষতি হবে কিনা জানিনা তবে তোমার বউ জলবে।

- তুমিও তো আমার বৌ।

- তাতে কি!

- তোমার জলে না?

- জল্লেও,মলম লাগেনা।

- এভাবে কেনো সব অধিকার ছেরে দিলে?

- তুমিতো তাই চেয়েছিলে।

- সত্যিই কি বুঝো আমি কি চাই?

- বুঝিনা বলেই তো,আর বুঝতে চাইনা।

- তোমার হাত টা একটু ধরতে দিবে,অনেক দিন এই হাতের স্পর্শ পাইনা।

- এই হাতের স্পর্শ হয়তো তোমার আর প্রয়োজন হয় না।

- আজ প্রয়োজন।

- এটা তোমার ক্ষণিকের আবেগ।

- এটা আবেগ না,ভালোবাসা।


বিজয় ক্রমে ক্রমেই আমার আরো কাছে আসতে লাগলো।আমি চলে আসতে চাইলাম ও আমার হাত ধরে থামিয়ে দিলো।

কাছে এসে কপালে, গালে চুমু খেতে লাগলো।আমি নিজেকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না,ওর শক্তির কাছে,ওর স্পর্শের কাছে হেরে যাচ্ছিলাম।ও আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো,যেনো পালাতে না পারি।আমিও যেনো কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি,নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিনা।

অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললাম,অনেক রাত হয়েছে ঘুমাবো।

বিজয় বললো আচ্ছা চলো একসাথেই যাই।আমি শাশুরির ঘরে থাকার জন্য গেলাম কিন্তুু দরজাটা ভেতর থেকে লাগানো ছিলো।উনি তো দরজা লাগান না,তাহলে কি উনি কোনো ভাবে বুঝে গেছেন আমি আর বিজয় এক সাথে আছি।আজ তাহলে ঐ খালি ঘরটায় থাকতে হবে।

ওই রুম পর্যন্ত বিজয় আমাকে এগিয়ে দিয়ে ঠায় দাড়িয়েই আছে।আমি বললাম

- কি হলো ঘুমাতে যাও।

- তোমার পাশে একটু জায়গা দিবে?

- কিন্তু...

- কোনো কিন্তু না,প্লিজ ফিরিয়ে দিয়োনা আমাকে।

- কি লাভ মিথ্যে মায়া বাড়িয়ে?

- লাভ ক্ষতির হিসাব তো অনেক আগেই ভুলে গেছি।প্লিজ আজকে একটু সময় দাওনা আমাকে।কথা দিলাম তুমি না চাইলে আর কখনো এমন দাবি করবো না।

ওর এমন ভাবে অনুরোধ করাতে,মানা করতে পারলাম না।সেই রাত টা দুজনে একসাথেই কাটালাম।এতদিনের রাগ,অভিমান সব যেনো কোথায় হারিয়ে গেছে।সব অভিমান গুড়িয়ে,নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুজনে মিশে একাকার হয়ে গেছি।


সকালে ছোটোর চিল্লাচিল্লিতে ঘুম ভাঙ্গলো।

কাজের মেয়ের সাথে কি নিয়ে যেনো রাগারাগি করছে।ঠিক কি নিয়ে এমন করছে জানিনা তবে বেশ বুঝতে পারছি ও রেগে আছে।রাতে স্বামী ঘরে যাইনি বলে কথা।

আমারও রাতে বিজয় কে জায়গা দেওয়া টা ঠিক হয় নি।আমি কি করে ভুলে যেতে পারি ওর স্বার্থপরতার কথা!ওতো আমাকে কম কষ্ট দেয়নি বরং কষ্ট দিতে কোনো ফাঁকফোকর বাকি রাখেনি।মেয়েদের এই একটা সমস্যা,প্রিয় মানুষ যতই কষ্ট দিকনা কেনো,একটু ভালোবেসে কাছে টানলে সব ভুলে যায়। কিন্তুু আমার তো ভুলে গেলে চলবেনা,নিজেকে শক্ত হতে হবে,এগিয়ে যেতে হবে।আমি আর বিজয়ের কাছাকাছি যাবো না,আমি যে ওর কাছে গেলে দুর্বল হয়ে পরি,আর এই দুর্বলতাই আমার কষ্টের কারন।যদি ভালো থাকতে হয় নিজেকে ওর কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে।

 

কুইনের সাথে কথা বলে একটা জবের ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। অফিসের ম্যানেজার সাজ্জাত কুইনের খুব ভালো ফ্রেন্ড।তবে আমার চাকরিটা কোনো সুপারিশে হয়নি,নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেই পেয়েছি।

শুরু হলো আমার নতুন জিবন।সকালে অফিসে চলে যাই, বাসায় আসি সন্ধ্যায়।মাঝে মাঝে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হয়ে গেলে ,কুইন আমি একসাথে আড্ডা দেই।

বাইরে কিছু খাই,শাশুড়ি চটপটি খুব পছন্দ করেন,ওনার জন্যও নিয়ে নেই।

মার্কেটে যাই নিজের জন্য কিছু কিনি,পরীর জন্যও কিনি। কিন্তুু আমি কিছু দিলে ছোটো সেটা পরী কে নিতে দেয়না,পরী তো ওর কথা শুনেনা,নিতে না দিলেও জোর করেই কান্নাকাটি করে নেয়।পরী এখন অনেক টাই বড়ো হয়ে গেছে,ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথা বলে।আমাকে মামনি বলে ডাকে।ছোটো আগের মতোই প্রায় আমায় কথার মারপ্যাঁচে অপমান করে,অফিস থেকে বাসায় আসলেই আমাকে দেখে মুখ গোমড়া করে রাখে,আমি ওর এই মুখ গোমড়া করে রাখার কারনটা ঠিক খুজে পাইনা। খুজার প্রয়োজন ও মনে করিনা। ও অপমান করলেও,এখন আর ওইসব বিষয় গায়ে মাখিনা।

বিজয়ের সাথেও যথেষ্ট দুরত্ব বজায় রাখি।

ওর সাথে শুক্রবার ছাড়া দেখা হয় না,দেখা হলেও তেমন কথা হয়না।

কুইন ঠিক ই বলেছিলো,কাজে ব্যাস্ত থাকলে অনেক কিছু ভুলে থাকা যায়।এখন আর আমার আগের মত একা অনুভব হয় না,আগের মত রাত ও জাগি না।সারাদিন কাজ শেষে ক্লান্ত শরীর যখন বিছানা পায়,নিজের অজান্তেই ঘুমের দেশে হারিয়ে যাই।অফিস,কাজ,ঘুম,বান্ধবীর সাথে আড্ডা,সব মিলিয়ে ভালই আছি।


এভাবেই কেটে গেলো দুই বছর।

আমি এখন অফিসে মোটামুটি সুনাম অর্জন করেছি।আমার কাজে বস অনেক খুশি।সাজ্জাত কুইনের বন্ধু,এখন আমারও ভালো বন্ধু হয়ে গেছে।সাজ্জাত আমাকে অফিসের কাজে অনেক হেল্প করে,ওর জন্যই এতটা এগোতে পেরেছি।

একদিন সাজ্জাত বললো,অফিস থেকে নাকি দেশের বাইরে বিজনেস করার পরিকল্পনা চলছে,কয়েকজন‌ কর্মী নেওয়া হবে। যারা দেশের বাইরে কোম্পানির প্রোডাক্ট গুলো তুলে ধরবে,এতে কোম্পানির বিজনেস অনেক টা এগিয়ে যাবে।এইটা করতে গেলে কয়েকজন দায়িত্ববান কর্মী লাগবে,আর বস নাকি সেখানে আমাকেও নির্বাচন করেছে বাট প্রবলেম একটাই যেই যাবে জুটি নিয়ে যেতে হবে, যারা যাবে তারা স্বামী স্ত্রী এক সাথেই এই কোম্পানিতে জব করতে পারবে,আপাতত দশ বছরের জন্য নেওয়া হবে,পরে চাইলে তারা আরো মেয়াদ বাড়িয়ে সেখানে একবারে সেটেল ও হয়ে যেতে পারবে।আমার জুটি নেই বলে তেমন একটা মাথা ঘামাইনি ব্যাপারটা নিয়ে, অফিসের কেউ তো আর জানেনা আমার ব্যাপারটা,যেহেতু আমার বায়ো তে বিবাহিত দেওয়া তাই তারা আমাকে নির্বাচন করেছে,জানলে হয়তো‌ করতো না।


এর মাঝে ছোট আবার মা হতে চলেছে।‌বিজয়ের‌ ছোটোর প্রতি অন্য সময়ের তুলনায় যত্ন,ভালোবাসা একটু বেড়েই গেলো,এটাই স্বাভাবিক।প্রতিটি দায়িত্ববান স্বামীর উচিৎ,এই সময়টায় স্ত্রীর পাশে থাকা।বিজয় ও দায়িত্ব পালনে অটুট।কিন্তু আমাকে আবারো একবুক হতাশা ঘিরে ধরলো,মা না হতে পারার কষ্টটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।ওদের এই প্রেম প্রেম ভাবটা আমার ঠিক সহ্য হয় না।কেনো জানি বুকের ভিতরটা জলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।আমি নিজের মনকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেও পারিনা।আমি চাইনা আমার মনে এমন ভাবনা গুলো আসুক,তবুও এমন ভাবনা এসেই যায়, না চাইতেও। সতীন বলেই হয়তো এমনটা হয়,স্বামীর ভাগ দেওয়া যে কতটা কষ্টের যে দেয় একমাত্র সেই জানে।


অফিসে কাজ করছিলাম এমন সময় ফোন আসলো, বিজয় ফোন দিয়েছে।মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটু চমকে গেলাম কি হলো, বিজয় তো আমাকে ফোন দেয়না‌, হটাৎ ফোন!বেশি না ভেবে কল টা ধরলাম

- হ্যালো

- তুমি কি একটু অ্যাপোলো হসপিটালে আসতে পারবে?

- কেনো কি হয়েছে???

- আগে এসো,পরে বলছি।

- এখন তো অফিসে কাজ করছি।

- ছুটি নিয়ে এসো।

- আচ্ছা দেখছি।

হসপিটালে এসে দেখি,ছোটো চিৎকার করছে,আমি বিজয়ের কাছে জানতে চাইলে বললো

- বাথরুমে পরে গিয়ে ব্লাড যাওয়া শুরু হইছে,ডাক্তার বলছে এখনই সিজার করতে হবে,না হলে বাচ্চা বা মা কাউকেই বাচানো যাবেনা।আর অপারেশনের জন্য রক্তের প্রয়োজন,তুমি কি দিতে পারবে?

- হ্যা পারবো।তারপর রক্ত দিলাম,ডাক্তার অপারেশন করলো,২টা যমজ ছেলের জন্ম দিলো ছোটো। কিন্তুু বাচ্চা গুলো সময়ের আগেই ডেলিভারি হওয়াতে একটু অপুষ্ট।তবে ডাক্তার বলেছে ঠিক মত যত্ন নিলে,মায়ের দুধ ঠিক মত পেলে ওরা তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

আমি শুধু পাশে বসে ভাবছিলাম,বিধাতা যাকে দেয় কোল ভরে দেয় আর যাকে না দেয় একেবারেই দেয় না।আমাকে এমন একটা বাচ্চা দিলে কি এমন ক্ষতি হতো!


যমজ বাচ্চাদের সামলাতে গিয়ে ছোটো পরীর ঠিক মত যত্ন নিতে পারেনা।তাই পরী এখন রাতে আমার সাথেই থাকে।দিনের বেলা শাশুড়ি ওর খেয়াল রাখে।এভাবেই দিন গুলো যাচ্ছিলো। ছেলে বাচ্চা গুলোও আস্তে আস্তে বড়ো হতে লাগলো, কিন্তূ বাচ্চা গুলো প্রায় অসুস্থ থাকে।আমি সময় পেলে ওদের কে কোলে নেই।সময় ই তো নেই হাতে,কাজের চাপ এখন অনেক বেশি।রাতে ফিরতে ফিরতে বারোটা বেজে যায়।বেশি রাত হয়ে গেলে বিজয় আমাকে গাড়ি নিয়ে অফিস থেকে নিয়ে আসে।আমি নিষেধ করলেও শুনেনা,বলে এত রাতে মেয়ে মানুষ একা একা যাওয়া ঠিক না,রাস্তা ঘাটের পরিস্থিতি তো ভালোনা।আমার ও এত রাতে একা একা রাস্তা দিয়ে আসতে ভয় লাগে, বাসে উঠলে মনে হয়,যদি বাস অন্য রাস্তা দিয়ে নিয়ে চলে যায়,আজকাল তো কত কিছুই হয়, ক্রাইম পেট্রোলে এমন অনেক কিছুই দেখি।তবে এই ভয়ের কথা আমি ও কে বলিনি,বিজয় নিজের থেকেই আমাকে নিতে আসে। বিজয় নিতে আসলে একটু স্বস্তি অনুভব করি,ওর সাথে নিশ্চিন্তে বাসায় চলে আসি।বাসায় এসে ছোটোর রাগে লাল হওয়া মুখটা দেখে আমি না হেসে পারিনা।

একদিন বিজয় আর ছোটোর খুব ঝগড়া হলো....

  

-গল্পঃসতীনের_সংসার ( পর্ব ০৬ )


ছোট আর বিজয়ের চিল্লাচিল্লি শুনে রুম থেকে বের হয়ে ওদের কাছে গেলাম।জিজ্ঞেস করলাম

- কি হয়েছে বিজয়,এভাবে চিৎকার করছো কেনো?

- ছোটো বললো তুমি আমাদের মধ্যে নাক গলাতে আসবেনা।

- আমি নাক গলাতে আসিনি,তোদের এভাবে ঝগড়া করতে শুনে না এসে পারলাম না। মা অসুস্থ,তাছাড়া বাচ্চারাও বড় হচ্ছে ওদের সামনে এমন করে ঝগড়া করা কি ঠিক হচ্ছে?

- ঠিক ভুল কি তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে?তুমি নিজের চরকায় তেল দাও।আমার আর আমাদের সন্তানের কথা তোমার না ভাবলেও চলবে।

এই বলে ছোট ওর ঘরে চলে গেলো।বিজয় ওখানেই দাড়িয়ে ছিলো।আমি বললাম

- দেখেছো বিজয় তোমার বউ কি বলে গেলো?

- যা বলেছে ঠিকই বলেছে,তুমি এসবের প্রাপ্য ছিলে।

- আমি কি করেছি?

- কি করেছো জানো না?তুমি আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছো।এইযে যা কিছু হচ্ছে এইসব কিছু তোমার কারণেই হচ্ছে।সব নষ্টের গোড়া হলে তুমি।

- বিজয় তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছো কেনো?

- আমি তোমার সাথে এভাবে কেনো,কোনো ভাবেই কথা বলতে চাইনা।প্লিজ আমার চোখের সামনে থেকে যাও এখন।

- আমি তোমার চোখের সামনে থেকে চলে গেলে কি তুমি খুশি?

- নেকামি না করে যেতে বলছি যাও।অসহ্য লাগে তোমাকে।

বিজয়ের এমন কথা শুনে কান্নায় বুক ভিজে যাচ্ছিলো।ও এভাবে অপমান করতে পারলো!


বিজয় কেনো আমাকে এইসব বললো জানিনা।আমি কি এমন করেছি, বিজয় এমন ভাবে আমার সাথে কথা না বললেও পারতো।নাহ আর সহ্য করতে পারছিনা।আমাকে কিছু একটা করতে হবে,আমাকে অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে হবে। এতোটা দূরে যেতে হবে যে ,কেও আমাকে আর কখনো খুজে না পায়।বিজয় চায় আমি ওর সামনে না থাকি,তবে তাই হোক।

আচ্ছা আত্মহত্যা করলে কেমন হয়?

নাহ আত্মহত্যা করবো কেনো,আমি মরে গেলেই বিজয়ের কি আসে যায়!জিবনে কত পাপ করেছি তার কোনো হিসাব নেই,আর পাপ বাড়াতে পারবোনা।তাছাড়া মৃত্যু তো কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারেনা।আমাকে অন্য কোনো একটা সলিউশন বের করতে হবে।নিজেকে আর নিচে নামাতে পারবোনা,এত লাঞ্ছনা,অপমান সহ্য করে এখানে আর থাকবো না। হ্যা আমি চলে যাবো এখান থেকে,অনেক দূরে চলে যাবো।


সাজ্জাত কে ফোন দিলাম,একটা রিং বাজতেই ও ফোন ধরলো

- হ্যালো সাজ্জাত?

- হুমমম, হঠাৎ ফোন কিছু বলবে?

- তুমি না বলেছিলে কোম্পানি থেকে দেশের বাইরে কিছু কর্মী নিবে তার মধ্যে আমিও আছি,ওইটার খবর কি?

- সামনের মাস থেকে শুরু হবে,কেনো তুমি যাবে নাকি?

- হুমম যাবো,আমাকে কি নিবে?

- কেনো নিবেনা,তুমি তো একজন দায়িত্ববান স্টাফ,আর তুমি যাবে শুনলে বস আরো খুশি হবেন।তবে সমস্যা হলো তোমাকে কি তোমার হাসব্যান্ড যেতে দিবে?

- আমি চলে গেলে তো তার আরও ভালো হয়,তুমিতো সবটাই জানো।আসলে আমি আর এখানে থাকতে চাচ্ছি না।দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।প্লিজ সাজ্জাত একটু হেল্প করো আমাকে।

- আচ্ছা অফিসের তুলি মেডাম আছে না,তার সহকারী হিসেবে তোমাকে দেই?তার সাথে কাজ করতে পারবে তো?

- সব পারবো,যদি বলো সেখানে ঘর মুছতে হবে,কাপড় ধুতে হবে তাতেও রাজি আমি।

- হাহাহা কিযে বলো।আচ্ছা আগে অফিসে এসো,বাকি কথা অফিসেই হবে।

- আচ্ছা ভালো থেকো।


অফিসে লাঞ্চের সময়ে কুইন আর আমি একসাথে খেতে বসলাম।খেতে ইচ্ছে করছেনা,খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম।কুইন জিজ্ঞেস করলো

- কিরে খাচ্ছিস না কেনো,কি ভাবছিস?

- ভাবছি মানুষ কিভাবে পাল্টে যায়।

- কেনো নতুন করে আবার কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি?

- যতদিন আমি ওই বাসায় থাকবো,ঝামেলা আমার পিছু ছারবে না।কুইন তোর বাসায় আমাকে কয়েকদিন থাকতে দিবি?

- এভাবে বলছিস কেনো,থাকবি সমস্যা নেই, কিন্তূ কি হয়েছে বলবি তো?

- কি আর হবে,আমার কপাল খারাপ।যাকে ভালোবেসে বাচতে চেয়ে ছিলাম সেই মানুষটাই আমাকে ভেতর থেকে মেরে ফেলছে।মাঝপথে দিক হারিয়ে যেই মানুষটার হাত আক্রে ধরেছিলাম,সেই মানুষটাই আজ হাত ছেড়ে দিয়েছে।যেই চোখে একসময় ভালোবাসা খুজে পেতাম,সেই চোখেই এখন ঘৃণা দেখতে পাই।তার বউ আমাকে অপমান করে সে প্রতিবাদ না করে উল্টো আমাকেই বলে আমি নাকি এসবের প্রাপ্য। আমাকে দেখলে নাকি তার অসহ্য লাগে।আমি নাকি তার জীবন শেষ করে দিয়েছি।

- বাদ দে,রাগে বলেছে হয়তো।

- কেনো,আমার উপর তার এতো কিসের রাগ?কি করেছি আমি?বলতে পারিস আমার ভুলটা কোথায়?আমি বিজয় কে ভালোবাসি এটাই কি আমার ভুল?আমি তো কখনো ওদের কোনো ক্ষতি করিনি,তবুও আমার এতো দোষ কেনো হয়?ছোটোর কথা আমি ধরিনা, কিন্তূ বিজয়....

আসলে মানুষ চেনা অনেক কঠিন, এতোটাই কঠিন যে একসাথে দশ বছর সংসার করেও চেনা যায়না।আমিও বিজয় কে চিনতে পারিনি, আমিতো ভাবতাম যাইহোক ও আমাকে মন থেকে একটু হলেও ভালোবাসে, কিন্তূ আমি ভুল ছিলাম। ও আমার মনকে নিয়ে খেলেছে শুধু,আর কিছুনা।


কুইন একটু আমতা আমতা করে বললো,সুফিয়া একটা কথা বলবো,যদিও বিজয় নিষেধ করেছে তোকে বলতে।

- কি কথা?

- মনে আছে আমি যখন প্রথম তোর বাসায় গেলাম,তুই জানতে চেয়েছিলি না আমি তোর কষ্টের কথা কিভাবে জানলাম,তোর বাসা চিনলাম কিভাবে,আমি সেদিন সত্যিটা বলিনি কিছু একটা বলে কাটিয়ে দিয়েছিলাম কথাটা কিন্তু সত্যিটা হলো...

- কি সত্যিটা?

- তোর কষ্টের কথা আমাকে বিজয় বলেছে।

- বিজয়!

- হ্যা বিজয়।ও একদিন আমাকে ফোন দিলো,বললো দেখা করবে।পরে আমি অফিসের ঠিকানা দিয়ে দিলাম।তখন ও আমার অফিসে এসে সব বলেছে।আর তোর কাছেও আমাকে বিজয় ই পাঠিয়েছে।

- কিন্তূ বিজয় এমনটা কেনো করলো?

- ও চাইছিলো তুই নিজের পায়ে দারা,বাসায় তোর রোজ রোজ অপমান নাকি তার সহ্য হয়না।তোর সতীন নাকি তোকে কথায় কথায় অপমান করে,ওর বাচ্চাকে কোলে নিতে দেয়না।এসব থেকে দূরে রাখার জন্যই বিজয় চাইছিলো তুই একটা জব কর,নিজের মতো বাচতে শিখ।তোর এই সফলতার পেছনে বিজয়ের অবদান অনেক। আমিতো শুধু ওর কথা মতো তোকে বুঝিয়েছি।

- বিজয় তো আমাকে নিজেই জবের কথাটা বলতে পারতো।

- আমিও বিজয়কে সেটাই বলেছিলাম যে,আপনি নিজেই সুফিয়াকে বলুন কিন্তু বিজয় বললো,আমি বললে সুফিয়া ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে নাও নিতে পারে,এমন ও হতে পারে ও ভাবলো আমি ওর খরচ বহন করতে চাইছিনা।তাই তুমি তো ওর খুব কাছের বান্ধবী তোমার কথায় ও কিছু মনে করবেনা।বরং ভালো করে ভেবে দেখবে।আমি বিজয়ের মুখে এমনটা শুনে পরে তোকে গিয়ে বললাম জবের কথা।


অফিসের কাজ শেষ,বসে আছি।মাথা কেমন যেনো করছে,একটা হিসেব কিছুতেই মিলাতে পারছিনা।আমার অপমান সহ্য হয় না বলে যে মানুষটা আমাকে চাকরি করার সুযোগ করে দিলো,সেই মানুষটাই আমাকে খুব যত্ন সহকারে বাসায় অপমান করে।এই জন্যই হয়তো ওইদিন জবের কথা বলায়,ও সহজেই রাজি হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তূ একটা কথা মাথায় কিছুতেই ঢুকছেনা, সে যদি আমার কথা এতোটাই ভাবে,তাহলে এভাবে আমাকে কষ্ট দেয় কেনো।

দারোয়ানের ডাকে ঘোর কাটলো।

- মেডাম বাসায় যাবেন না?

হুমম যাবো।

- কয়টা বাজে?

- একটা বাজে মেডাম

- একটা বেজে গেছে!oh my god।

- স্যার ডাকছে আপনাকে,মেডাম।

- আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম,বিজয় গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছে।আমি নিচে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।যদিও বাসায় যেতে ইচ্ছে করছেনা।কুইন ওর সাথে যাওয়ার জন্য অনেক জোরাজুরি করলো,তাও গেলাম না।মন আজ সত্যিই উতলা হয়ে আছে,সব কিছু কেমন যেনো এলোমেলো লাগছে।একটা সমীকরণ যে কিছুতেই মিলছেনা।গাড়িতে উঠে জানালা লাগিয়ে দিলাম।

বিজয় আমাকে জিজ্ঞেস করলো

- খেয়েছো?

- হুমমম।

- বিজয় একটা নুডুলস এর বাটি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,তুমিযে খাওনি সেটা আমি ভালো করেই জানি।নাও এটা খেয়ে নাও।

- খাবোনা,খিদে নেই।

- খাও,তোমার ফেভারিট রেস্টুরেন্ট থেকে এনেছি।

- কেনো করছো এইসব?জুতো মেরে গরু দান না করলেও চলবে।

- ওমাঃ এতো রাতে আমি গরু পাবো কই,যে তোমাকে দান করবো।

- বিজয় তুমি মজার মুডে থাকলেও আমার কিন্তু এসব ভালো লাগছেনা।

- তাহলে খেয়ে নাও।

- বলছি তো খাবোনা।

 বিজয় বাটিটা খুলে,চামচ বের করে আমাকে খাইয়ে দিতে নিলো,আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।বিজয় বললো

- প্লিজ খেয়ে নাও,আমিও কিন্তূ সারাদিন কিছু খাইনি,তুমি খেলে আমিও খাবো।

- কেনো খাওনি?

- সেটা তুমি বুঝবেনা।

- আমিও আর কথা না বাড়িয়ে খেতে লাগলাম।বিজয় আমাকেও খাওয়াচ্ছে,নিজেও খাচ্ছে।আমার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পরে যাচ্ছিলো।

- এইযে মেডাম,আপনাকে কাদতে বলিনি,খেতে বলছি।

- তুমিও তো কাদছো।

- কই নাতো,চোখে কিছু পড়েছে মনে হয় তাই জলছে।

- কেনো মিথ্যে বলছো?

- জানিনা...

কারো মুখে কোনো কথা নেই,দুজনের চোখেই আজ পানি।মনের কষ্ট গুলো চোখের পানি হয়ে ঝরছে।এক অজানা কষ্ট বাসা বেধেছে মনে,জানিনা এই কষ্টের শেষ কোথায়।


বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে একটু বারান্দায় বসলাম।আজ আকাশে চাঁদ নেই,অমাবস্যা চলছে মনে হয়।পেছন থেকে শাশুড়ি মা এসে জিজ্ঞেস করলো

- আজ এতো দেরি হলো যে ফিরতে?

- আপনি এখনো ঘুমান নি?

- তুই বাসায় না আসা পর্যন্ত কি আমার ঘুম হয়।

- আচ্ছা মা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?

- কি কথা?

- শুনেছি একজন মা নাকি তার সন্তানের গতিবিধি জানতে পারে,তার মনে কি চলছে না বললেও বুঝতে পারে,কিছু লুকাতে চাইলে নাকি টের পেয়ে যায়।আচ্ছা মা,আপনি কি বুঝেন না আপনার ছেলের মনে কি চলছে?

- কেনো কি হয়েছে?

- আমি না তাকে ঠিক বুঝতে পারিনা কিন্তূ আপনি তো ওর মা,আপনিও কি বুঝেন না?

- বিজয় কি তোকে কিছু বলেছে?

- একটা মানুষ কিভাবে এত বহুরূপী হতে পারে?যে মানুষ টা আমাকে কষ্ট দেয়,আবার দিন শেষে সেই কাদে।যে আমাকে চোখের সামনে থেকে দূরে যেতে বলে,গভীর রাতে সেই গাড়ি নিয়ে আমার সামনে দাড়িয়ে থাকে।যে আমাকে অপমানের হাত থেকে বাচানোর জন্য আড়াল থেকে সাহায্য করে ,অথচ বাসায় সেই আমাকে বেশি অপমান করে।আমি আসলে অনেক কিছুর হিসেব মিলাতে পারছিনা।আপনি কি বলতে পারবেন মা,এর মানে কি?


- শুন মা,আমি যত টুকু জানি,আমার বিজয় খুব অভিমানী।ও ওর মনের কথা মুখে প্রকাশ করতে পারেনা।ওর মনে এখন অনেক অভিমান জমেছে।আসলে ও যেটা দেখায় তুই সেটাই দেখিস,যেটা ওর মনে লুকানো সেটা বুঝতে পারিস না।

- কিভাবে বুঝবো তাকে,যে মানুষটা বিয়ের আগ‌ মুহূর্তেও বিয়ের জন্য রাজি ছিলোনা,সেই মানুষটা বিয়ের পর মুহূর্তেই কিভাবে পাল্টে গেলো।যেই মানুষটা আমাকে ছাড়া রাতে খাবার খেতো না, সে তো এখন সুন্দর ভাবে খেয়ে ঘুমিয়ে পরে,একবারও আমার কথা জিজ্ঞেস করে না।

- সবটাই আমার জন্য হয়েছে,এর জন্য আমিই দায়ী।

- না মা,আপনি শুধু শুধু নিজেকে দোষারোপ করবেন না।

- শুধু শুধু না,আমার কসমের জন্যই বিজয় তোর থেকে দূরে চলে গেছে।

- কিসের কসম।

যেদিন বিজয় বিয়ে করে ফিরে এলো,আমি বিজয় কে আমার কসম দিয়ে বলেছি,

ও যেনো আমার নাতি বা নাতনি না হওয়া পর্যন্ত তোর থেকে দূরে থাকে।বিনিময়ে বিজয় আমার কাছে,এই বাড়িটা আর ব্যাংকে দশ লাখ টাকা তোর নামে লিখে দিতে বলেছে,যাতে শেষ বয়সে তোর কারো উপরে ভরসা করতে না হয়,আমি তাই করেছি।বিজয় কে বলেছি, যদি আমার কসম না মানে তাহলে আমার মরা মুখ দেখবে।ছেলে হয়ে মায়ের মরা মুখ দেখবেনা বলে,তোর থেকেই দূরে সরে গেলো।কিন্তু যখন দেখতাম তুই অনেক কষ্টে আছিস,রাতে না ঘুমিয়ে শুধু কান্না করিস,তখন বিজয়ের থেকে সব কসম তুলে নিয়েছি।তাই আমি বলার পর ই বিজয় তোর কাছে যেতো।আমি হয়তো‌ শাশুড়ি হিসেবে খারাপ কিন্তূ আমিও তো মানুষ,আমার ও কষ্ট হয়।আমি তোর কষ্ট সহ্য করতে পারিনা।আমাকে ক্ষমা করে দিস মা,ক্ষমা করে দিস।আমি তোর মত এতিমের সাথে‌ অনেক বড়ো অন্যায় করে ফেলেছি।

- মা আমিতো বাড়ি বা টাকা চাইনি,বিজয় এসব না করে যদি আমার সাথে একটু স্বাভাবিক ব্যাবহার করতো তাতেই আমি খুশি হতাম।ও তো আমার ভালো করতে গিয়ে,আমার খারাপ টাই করে।মুখে বলে একটা,করে আরেকটা।জানিনা ও কি চায়।

আবারও শাশুড়ি আমাকে ধরে কান্না শুরু করলো,আমিও নিজের কান্না ধরে রাখতে পারলাম না।


এতদিনে বুঝতে পারলাম বিজয়ের আমার থেকে দূরে যাওয়ার কারনটা, কিন্তূ বিজয়ের বার বার আমাকে অপমানে কারণটা ঠিক খুজে পাচ্ছিনা।বিজয় কি আমাকে এখনও ভালোবাসে?

মা তো তার কসম তুলে নিয়েছে,তাও তো বিজয় আমার থেকে দূরে থেকেছে।অবশ্য এটা তো বিয়ের সময়ের কথা, এতদিনে তার ছোট স্ত্রীর ভালোবাসা পেয়ে আমাকে তো ভুলেই গেছে।তার প্রমাণ তো সেদিনের কথা গুলোই।যেদিন আমাকে তার সামনে থেকে চলে যেতে বলেছিলো।


কিছুদিন পর.....


সাজ্জাতের ফোনে ঘুম ভাঙলো,অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত দিনটি এসেই গেলো...


-গল্পঃসতীনের_সংসার

( পর্ব ৭+ শেষ পর্ব )


ঘুম ভাঙলো সাজ্জাতের ফোনে।আজ বেশ ফুরফুরে লাগছে।এতদিন পর তাহলে সেই প্রতীক্ষিত সময়টা এসেই গেলো।খবরটা পেয়েই বিজয়ের কাছে গেলাম,গিয়ে দেখি ও অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে।আমি বললাম

- বিজয় আজ তোমার একটু সময় হবে?

- কেনো কোনো কাজ আছে কি?

- কাজ না,এক জায়গায় যাবো।

- বিজয় কিছুক্ষন ভেবে,মাথা নাড়িয়ে শায় জানালো বললো আচ্ছা।

আসলে সুফিয়া বিজয়ের কাছে অনেক দিন যাবৎ কিছু চায়না।আজ এভাবে একটু সময় চাওয়াতে নিষেধ করতে পারলোনা,যদিও অফিসে ম্যানেজ করতে একটু প্রবলেম হবে,তাও রাজি হলো।


আজ একটা শাড়ি পরলাম,এই শাড়িটা বিজয় আমাকে প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে দিয়েছিলো।খুব সাজতে ইচ্ছে হচ্ছে আজ তাই একটু সাজলাম, মুখে হালকা মেকআপ আর ঠোঁটে হালকা কালারের একটা লিপস্টিক দিলাম।

রুম থেকে বের হতেই বিজয় আমার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলো।আমি চোখের ইশারাতে প্রশ্ন করলাম,ও কানের কাছে এসে বললো আজ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।আমি একটা মুচকি হাসি দিলাম।

বিজয় গাড়ি নিয়ে বের হতে চাইলো,আমি বললাম গাড়িতে না রিক্সায় যাই?

ও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

একটা রিক্সা ডাকলো,আমি রিক্সা ওয়ালা কে বললাম, মামা কবর স্থানে যাবেন?

উনি বললেন উঠেন।বিজয় আমাকে জিজ্ঞেস করলো

- হটাৎ কবর স্থানে কেনো?

- ঐখানে গিয়ে তুমি আর আমি একসাথে মরবো তাই।

- মরার জন্য বুঝি এতো সুন্দর করে সেজেছো?

- হুমমম।কেনো তোমার আফসোস হচ্ছে নাকি?

- আফসোস হবে কেন?

- এইযে মরার আগে সাজতে পারলেনা বলে।

- আমার তো খুশি লাগছে,একসাথে বাচতে না পারি,মরতে তো পারবো, হাহাহা।

- চুপ করো,এভাবে রাক্ষসের মতো হেসো না তো।

- আমি রাক্ষস?

- তার চেয়েও বড় কিছু।

গল্প করতে করতে কবর স্থানে এসে গেলো।

রিক্সা ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম থাকবেন নাকি চলে যাবেন?

আপনারা কইলে থাকমু।

- আচ্ছা থাকেন তাহলে।

বাবার কবরের সামনে এসে খুব কান্না পাচ্ছিলো,কিছুক্ষন কান্না করে হালকা হলাম।মায়ের কবরটা গ্রামের বাড়িতে,তার কবরটা আর দেখা হলোনা।আজ খুব মনে পরছে বাবা মায়ের কথা।যদি আজ তারা বেচে থাকতো,আমার জীবনটা অন্যরকম হলেও হতে পারতো।


পুনরায় রিক্সায় এসে বসলাম,বললাম মামা উত্তরা আজমপুর চলেন।বিজয় জিজ্ঞেস করলো

- আবার আজমপুর কেনো?

- দরকার আছে।

- কি দরকার?

- গেলেই বুঝতে পারবে।

- আমার কিন্তূ এখন ভয় হচ্ছে।

- কিসের ভয়?

- আমাকে এভাবে একা কোথাও নিয়ে গিয়ে যদি আবার পুরুষ নির্যাতন করো।আজকালের মেয়েদের তো বিশ্বাস নেই।

- পাগলের মত বক বক করা বন্ধ করবে?

- আমি পাগল?

- তাতে কি কোনো সন্দেহ আছে?।

- আচ্ছা তাহলে এই পাগলের একটা পাগলামি রাখবে?আজকে একটু আমাকে নির্যাতন করবে?অনেক দিন হলো....

- বিজয়! চুপ করবে নাকি ধাক্কা মেরে ফেলে দিবো রিক্সা থেকে?

- ফেলে দাও,আমি নায়কের মত পড়ে যাবো,তুমি নায়িকাদের মত আমার উপড়ে পরে যাবে।তারপর সুযোগ পেয়ে আমি তোমাকে চুমু দিবো,আর তুমি চোখ বন্ধ করে....

- বিজয় আসলেই মনে হয় তোমার মাথার তার ছিড়ে গেছে,কখন থেকে শুধু উল্টা পাল্টা বক বক করে যাচ্ছো,সত্যিই তুমি পাগল হয়ে গেছো, হাহাহা।

- বিজয় অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

- কি হলো,এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?আমাকে কি এর আগে কখনো দেখোনি?

- দেখেছি তবে,অনেকদিন পর এভাবে তোমাকে হাসতে দেখলাম।

রিক্সা থেমে গেলো,তাকিয়ে দেখি সেই পুরোনো বাসার সামনে এসে পরেছি।

কলিংবেল দিলাম,বাড়িওয়ালী চাচী এসে দরজা খুললেন।এতদিন পর আমাকে দেখে একটু অবাক হলেন।

অনেকদিন পর এই বাসায় আসলাম,এই বাসাতেই বাবা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন,এই বাসাতেই আমার আর বিজয়ের বিয়ে হয়েছিলো।কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বাসায়।তবে আমরা যেই ঘরটায় ভাড়া থাকতাম সেটাতে এখন অন্যকেও থাকে।আমি চলে যাওয়ার পর নতুন ভাড়াটিয়া এসেছেন।

চাচীর সাথে অনেক সময় বসে গল্প করলাম।চাচী না খাইয়ে ছারছিলোই না,তারপর দুপুরে খেয়ে ওখান থেকে বের হলাম।


রাস্তা দিয়ে হাটছি,বিজয় বললো

- আর কোথাও যাওয়ার আছে,মেডাম?

- একটু ভার্সিটিতে যাবে?

- ওখানে গিয়ে কি করবে?

- কিছুনা,এমনি যেতে ইচ্ছে করছে।

- ইচ্ছে যখন করছে তাহলে তো যেতেই হয়।

ভার্সিটিতে কিছুক্ষন ঘুরলাম,পরিচিত স্যারদের সাথে দেখা করলাম।তারপর অফিস হয়ে,সাজ্জাতের সাথে দেখা করে,একটা পার্কে এসে বসলাম।

বিয়ের আগে বিজয় আর আমি এই পার্কে অনেকবার দেখা করেছি।আজ শেষ বারের মত....

বিজয় জিজ্ঞেস করলো

- মেডাম আজকে আপনার কি হয়েছে শুনি? এতো জায়গায় ঘুরলেন,আপনাকে আজ বেশ খুশি খুশি ও দেখাচ্ছে কারনটা কি জানতে পারি?

- আজ তোমার অফিস মিস হয়ে গেলো তাইনা?

- আরেহ ধুরর..অফিস তো সারাবছর ই করি।আজ অফিসে গেলে এতো সুন্দর মুহূর্ত গুলো কি পেতাম?কতকিছু মিস করে যেতাম।

-তাই নাকি?

- জী মেডাম।

- আসলে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

- বুঝেছি,আজকে আমাদের বাসর রাত হবে তাইনা?

- তোমার মাথায় এইসব ছাড়া আর কিছু নেই?

- কি করবো বলো,সুন্দরী বৌকে পাশে রেখে নিজেকে নিয়ত্রণ করা যে কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

- হাহাহা,আমিও আবার সুন্দরী!

- হুম,তুমি আমার চোখে সব চেয়ে সুন্দরী একজন নারী।

- ভালই বলেছো।আসলে আজকে আমার প্রমোশন হয়েছে।

- ওহ,তার জন্যই বুঝি এতো আয়োজন?

- এটার জন্যই বলতে পারো,তবে আরেকটা সারপ্রাইজ আছে।

- কি সারপ্রাইজ?

- বাসায় গেলে জানতে পারবে।

- এখনি বলো।

- বললাম তো বাসায় গিয়ে বলবো।

- তাহলে বাসায় চলো।

- আচ্ছা চলো।


পার্কের অনেক টা ভেতরে এসে বসেছি আমরা। হেটে হেটে পার্কের গেটের মুখে যাচ্ছিলাম। হাটতে হাটতে বিজয় বললো

 - আজকের দিনটা অনেক ভালো কেটেছে।অনেকদিন পর দুজনে এভাবে ঘুরলাম।অনেকদিন পর তোমার মুখে এত সুন্দর হাসিটা দেখতে পেলাম।আজ আবারো অতীতে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।আবারও প্রাণ খুলে বলতে ইচ্ছে করছে,ভালোবাসি সুফিয়া তোমায়, অনেক ভালোবাসি।

- ভালোবাসো বলেই তো ব্যাংকের দশ লাখ টাকা, আর বাড়ি আমার নামে লিখে দিয়েছো। ভালোবাসো বলেই তো, আড়ালে থেকে আমার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ করে দিয়েছো, তাইনা?

- বিজয় হাটা বন্ধ করে বললো, তুমি এসব জানো?

- কিছুদিন আগেই জানতে পেরেছি।

- বিজয় আমাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে পার্কের একটা দোলনায় বসলো।

- আমি আসলে চেয়ে ছিলাম...

আচ্ছা বিজয় আমি কি কখনো তোমার কাছে এসব চেয়েছি?বাড়ি,টাকা পয়সা এসব দিয়ে আমি কি করবো।আমার তো এসবের কোনো দরকার ছিলোনা,এখনও নেই। আমিতো শুধু এক ছাদের নিচে তোমাকে নিয়ে বাচতে চেয়েছিলাম।সুখী হতে চেয়েছিলাম তোমাকে নিয়ে।সুখী হতে বেশি টাকা পয়সার প্রয়োজন হয়না, প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে অল্পতেও সুখী হওয়া যায়।বিজয় টাকা পয়সাই কি জীবনের সব?তুমি আমার জন্য এতো কিছু না করে যদি আমাকে একটু ভালোবাসতে তাহলেই আমি খুশি ছিলাম।

- সুফিয়া আমি তোমাকে এখনও অনেক ভালোবাসি।

- এ কেমন ভালোবাসা তোমার?এমন ভালোবাসা তো আমি চাইনি।যে ভালোবাসা দুজনের মধ্যে দুরত্ব তৈরি করে,যে ভালোবাসা তিলে তিলে মানুষকে মন থেকে শেষ করে দেয়।

- সুফিয়া চলো আমরা দূরে কোথাও চলে যাই,যেখানে কোনো পিছুটান থাকবেনা,শুধু তুমি আর আমি থাকবো।নতুন করে বাচার চেষ্টা করবো।

- সত্যিই কি সেটা আর সম্ভব?

- তুমি চাইলেই সম্ভব।

- না বিজয়,আমি চাইলেই যদি সব হতো,তাহলে আমি তোমাকে নিজের করে রাখতে চেয়েছিলাম কই রাখতে পারিনি তো।তুমি আমি এক সাথে থাকা এটা এখন শুধুই একটা মিথ্যে সপ্ন,মিথ্যে সপ্ন দেখে আনন্দ পাওয়া গেলেও ভালো থাকা হয়না।

এসব বলে আর কি লাভ,চলো বাসায় যাই রাত হয়ে আসছে। 

বিজয় আর কিছুই বললোনা,চুপ করে শুধু বার বার দেখছিলো আমায়।


বিজয় আর আমি দুজন এক সাথেই বাসায় ঢুকলাম।অফিস হয়ে আসার সময় সাজ্জাত দরকারি সব কাগজপত্র দিয়ে দিয়েছিলো সাথে।আমি সাজ্জাত কে বলেছিলাম,কাগজ গুলোর ফটোকপি করে দিতে,যাতে বিজয় কে একটা দেখার জন্য দিতে পারি।যদি আসলটা দেই পরে যদি যেতে কোনো বাধা দেয়।আমি কোনো রিস্ক নিতে চাইনা এই ব্যাপারে।

বাসায় ঢুকেই আমি বিজয়ের হাতে একটা খাম তুলে দিয়ে বললাম

- এটাই তোমার সারপ্রাইজ।

- কি এইটা?

- খুলে দেখলেই বুঝবে।

- বিজয় তখনই খুলতে চাইলো।

- আমি বললাম,এখন না ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে পরে দেখো। ছোটোকেও দেখিও,ও দেখলে খুশি হবে।

আমি ফ্রেশ হয়ে মায়ের কাছে গেলাম।মা কে বললাম

- মা আমি কালকে চলে যাচ্ছি।

- কোথায় যাচ্ছিস?

- দুবাই তে।

- দুবাই তে মানে?ওখানে কেনো?

- এখন থেকে ওখানেই থাকবো।

- হটাৎ এমন সিদ্বান্ত কেনো নিলি মা?তুই জানিস না তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারিনা।তাছাড়া তুই তো আমাকে কথা দিয়েছিলি‌ এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবিনা কিন্তু এখন দেশ ছেরেই চলে যাচ্ছিস?

- পৃথিবীতে কারো জন্য জীবন থেমে থাকেনা মা।আপনি বাবাকে কত ভালোবাসতেন, সে ছিলো‌ আপনার অনেক কাছের মানুষ,তাকে ছাড়া যখন বাচতে পারছেন, আমাকে ছাড়াও আপনি থাকতে পারবেন।আর মা কথা দেওয়ার কথা বলছেন? কতো মানুষ,অনেক বড়ো বড়ো কথা দিয়ে নিমিষেই ভুলে যায়,প্রয়োজনে ভালোবাসার মানুষকে ও ছেড়ে দেয় আর আমিতো সামান্য দেশ ছাড়ছি মাত্র।আর আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে কারো কোনো ক্ষতি হবেনা বরং ভালই হবে।

- অভিমান করেছিস মা?রাগ করেছিস?

- না মা রাগ বা অভিমান কোনোটাই না,শুধু এই হাপিয়ে যাওয়া জীবন থেকে বেরিয়ে একটু বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই।অন্য কারো সংসার এ আর তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে থাকতে চাইনা।এসব থেকে দূরে গিয়ে,একটু নিজের মতো বাচতে চাই।

মা দয়া করে আপনি আমাকে বাধা দিবেন না,আপনি বাধা দিলেও,আমি সেটা মানতে পারবোনা।শুধু একটু দোয়া করবেন আমার জন্য তাহলেই হবে।

শাশুড়িকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই চলে এসেছি। কারন আমি জানি,আমি ওখানে থাকলে সে আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিবে।


ঘরে এসে ব্যাগ পত্র গুচ্ছাচ্ছিলাম,বিজয় এসে আমাকে সজোরে একটা চর মারলো।

- কি নাটক শুরু করেছো তুমি?চাকরি করো বলে যা খুশি তাই করবে?তোমার দুবাই যাওয়া কেন্সেল।আমি তোমাকে যেতে দিবো না।তুমি এক পা ও বাসা থেকে বেরোতে পারবেনা।আজ থেকে তোমার চাকরি করাও বন্ধ।মনে থাকে যেনো‌ কথাটা।ভুলে যেওনা আমি এখনও তোমার স্বামী।

- ভুলে যাইনি তুমি আমার স্বামী,খুব ভালো করেই মনে আছে।তুমিতো আমার ঐ স্বামী যে নতুন বৌ পেয়ে,বাসর রাতে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলে।তুমি তো আমার ঐ স্বামী যে আমার সতীনের দুই বাচ্চার বাবা।তুমিতো আমার ঐ স্বামী যে মায়ের কথা রাখতে গিয়ে,আমাকে ময়লার মত ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলেছিলে। এতো ভালোবাসার স্বামীকে আমি কিভাবে ভুলতে পারি।

বিজয় একটু কাছে এসে বললো,

- আমি পুরোটাই বাধ্য হয়ে করেছি সুফিয়া,সেটা তুমিও জানো।আর তুমিই আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলে।

- বাধ্য হয়ে হোক আর মন থেকেই হোক করেছো তো?আমি তোমাকে বিয়ে করতে বলেছিলাম, কিন্তূ আমার থেকে দূরে যেতে তো বলিনি।কখনো কি ভেবে দেখেছো আমি এসব কিভাবে সহ্য করেছি?

কতরাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি,কতবার মৃত্যু আহ্বান করেছি।তোমাকে একটু পাশে পাবার জন্য ছট্ফট করেছি,কেদেছি,চিৎকার করেছি,মাঝে মাঝে বেহুষ ও হয়ে পড়েছিলাম,কই তুমিতো তখন আমার একবারও খোজ নাওনি।

তুমি তোমার মায়ের মন রাখতে,গিয়ে আমাকে দূরে ঠেলেছো।তুমি তোমার সন্তানের মুখ দেখবে বলে,আমাকে দূরে ঠেলে ছোটোকে আপন করে নিয়েছো।এসবের মধ্যে কি কখনো আমার কথা ভেবেছো?ভাবনি।দায়িত্ব হিসেবে বললে ভুল হবে,হয়তো গরীবের মেয়ে হিসেবে আমার জন্য কিছু টাকা আর এই বাড়িটা বরাদ্দ করেছো।আসলে তুমি আমাকে নিয়ে শুধু খেলেছো। আমি কি তোমার কাছে এসব চেয়ে ছিলাম?আমি এখন হাপিয়ে গেছি,ক্লান্ত হয়ে গেছি এমন জীবন নিয়ে।রোজ রোজ তোমার অপমান,তোমার বৌ এর অপমান আমি এসব আর মেনে নিতে পারছিনা।ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড,আমাকে যেতে দাও,না হলে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো।

- প্লিজ সুফিয়া তুমি এমনটা করোনা।আমি তোমাকে ছাড়া বাচতে পারবোনা।এই বলে বিজয় আমাকে জড়িয়ে ধরলো,কিন্তু আজ তার এই জড়িয়ে ধরার কোনো রিএকশন আমার মধ্যে হচ্ছেনা।আমিযে মন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।আমাকে যেতেই হবে এখান থেকে দূরে,বহু দূরে।

আমি বিজয়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,

- তুমি যদি আমাকে যেতে না দাও তাহলে আমি তোমাকে ডিবর্স দিতে বাধ্য হবো।

- সুফিয়া তুমি এমনটা বলতে পারলে?

- তুমিই বলতে বাধ্য করলে।

আচ্ছা তোমার যা খুশী করো,আমি আর তোমাকে বাধা দিবো না।

বিজয় ঘর থেকে চলে গেলো,আমি বিছানায় শুয়ে চিৎকার করে কাদতে লাগলাম।আজ জীবনের প্রথম ভালোবাসার মানুষটার সাথে এভাবে কথা বলেছি,হয়তো‌এটাই জীবনের শেষ।আর কখনো তার সাথে কথাই হবেনা।


সারারাত ঘুম হয়নি, বড্ডো খারাপ লাগছে সব কিছু ছেড়ে যেতে।কত স্বপ্ন নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিলাম আজ একবুক হতাশা নিয়ে চলে যাচ্ছি। পরী টার জন্য খুব মন খারাপ হচ্ছে,খুব মিস করবো মেয়েটাকে।মায়ের জন্যও খারাপ লাগছে, বয়স্ক মানুষ প্রায় অসুস্থ থাকে, ছোটো তো ওর বাচ্চাদের কে সামলাতেই হিমশিম খায়,উনাকে কিভাবে দেখবেন।বিজয়ের জন্যও খারাপ লাগছে,এখনও যে ভালোবাসি তাকে।সে যে আমার জীবনের প্রথম ও শেষ ভালোবাসা।আশা করি ছোটোও ওর বাচ্চাদের নিয়ে ভালো থাকবে।অবশ্য আমি চলে গেলে ওরা এমনিতেই ভালো থাকবে।ওদের সংসার টা ভালোবাসায় পুর্ণ হবে।এসব ভাবছিলাম আর খুব কাদছিলাম।কেনো এতটা কষ্ট হচ্ছে আমার।ভাবতে ভাবতে কখন যেনো চোখটা লেগে গেলো।


ফজরের আযানের শব্দে ঘুম ভাঙলো।উঠে ফ্রেশ হয়ে পুরো বাড়িটা একবার ঘুরে দেখলাম।তারপর ব্যাগ পত্র নিয়ে নিচে নামলাম।নাহ কাওকে আর বলার দরকার নেই।শুধু শুধু সিনক্রিয়েট করবে। কালকে তো বলেছি, এখন কাওকে না বলেই চলে যাবো। যত সকাল সকাল সম্ভব বাসা থেকে বের হতে হবে,বেলা হয়ে গেলে আবার বিজয় ঘুম থেকে উঠে পরবে,আমি চাইনা যাওয়ার সময় আর কোনো ঝামেলা হোক।দরজা খুলে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালাম,পেছন থেকে একজন বলে উঠলো

- পালাচ্ছো????

- আমি পেছন ফিরে দেখি, ছোটো।

- কি ভাবো তুমি নিজেকে?এসব করে কি প্রমাণ করতে চাও?

- কিছু প্রমাণ করতে চাইনা তো,শুধু চাই তোরা ভালো থাক।

- তুমি এখান থেকে চলে গেলেই কি আমরা ভালো থাকতে পারবো?

- আমিতো তাই মনে করি,আর কেও ভালো না থাকলেও তোর বর ঠিকই ভালো থাকবে কারন সে এটাই চেয়েছিলো।

- তুমি তার মুখের কথাটাই শুনলে,তার মনের ভেতরটা একবারও বুঝলেনা?

- তার মনের ভেতর তো আমি নেই,সেখানে এখন শুধু তোরই বসবাস।

- নাহ বুবু তুমি ভুল।তার ঘরে আমার বসবাস হলেও তার মনে শুধু তোমার জায়গাই আছে।আমি তার স্ত্রী হলেও তার মনের মানুষ না।

- তাতে কি আসে যায়,তুই ওর সন্তানের মা।

- সন্তানের মা হলেই কি সব হয়?হয়না বুবু, আমিতো ওর সন্তান দেওয়ার একটা মেশিন মাত্র,ওর সাথে তো আমার মনের কোনো সম্পর্ক নাই।তুমি না বলো আমি দেখতে সুন্দর আর তুমি শেমা।কিন্তু দেখো তোমার কি ভাগ্য শেমা হয়েও তুমি তোমার স্বামীর মন জুড়ে আছো আর আমি সুন্দর হয়েও তার মনে জায়গা পেলাম না।এই সুন্দর্যের কি দাম,যদি স্বামির মনে জায়গায় না পেলো।মেশিনের যেমন কোনো মন থাকেনা,তবুও কাজ করে যায় নিরলস ভাবে, আমরাও বলতে পারো একটা মেশিনের মত শুধু নিজেদের চাহিদা পূরণ করছি,আমাদের বাচ্চার দরকার এটাই বড় কথা,বাকি সব কিছুতো শুধুই ...। 

বুবু আমি কখনোই চাইনি তুমি এখান থেকে চলে যাও,এ বাড়িটা তো তোমার,গেলে আমি যাবো,তোমার তো যাওয়ার কথা না।এখনও বলছি থেকে যাও আমার সতীন হয়ে না,আমার পরীর মামনি হয়ে। সে যে তোমাকে ছাড়া খেতে চায়না,ঘুমাতে চায়না,তুমি না থাকলে পরী কে সামলাবে কে?

- আমিতো ওর সৎ মা কিন্তূ তুই তো ওর আসল মা, তোর কাছে পরী অনেক ভালো থাকবে।

- আর তোমার বর,তার কি হবে?

- তুইতো আছিস,দেখে রাখিস।

- বুবু,চলো একসাথেই থাকি,কথা দিলাম তোমাকে আর কষ্ট দিবো না।

- না রে ছোটো তুই আমাকে কখনোই কষ্ট দিসনি,তুই তোর জায়গা থেকে ঠিকই ছিলি।আমার তোর উপর কোনো রাগ নেই। আমিতো শুধু নিজের মতো বাঁচতে চাইছি।


বিজয় আর পরী কে নিচে নামতে দেখে,আমি তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাইলাম কিন্তূ পেছন থেকে পরী এসে আমাকে মামনি বলে জড়িয়ে ধরলো।

- মামনি তুমি কোথায় যাচ্ছো? আমাকে ও তোমার সাথে নিয়ে যাবে?

- না মা,তুমি চলে গেলে তোমার ভাইদের কে কে দেখবে?তোমার দাদুকেও তো তোমার দেখতে হবে তাইনা?শুনো বাবু লক্ষ্মী মেয়ের মত থাকবে,মা কে একদম জ্বালাবে না।ভাইদের দেখে রাখবে,আর বাবা কেও।

- মামনি বাবা সারারাত ঘুমায় নি,শুধু কেদেছে,আর বলেছে তুমি নাকি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো।বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসে মামনি,আমার থেকেও বেশি।

আমি পরী কে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলাম।


বিজয় পাশে এসে বললো

- আমি কালকে তোমার গায়ে হাত তুলেছি,আমাকে ক্ষমা করে দিও।

- না বিজয় এভাবে বলো না।তুমিতো আমার স্বামী,আমাকে যেমন ভালোবাসার অধিকার আছে, আমাকে মারার ও অধিকার তোমার আছে।বরং আমিই কালকে তোমার সাথে‌ খুব খারাপ ব্যাবহার করেছি,তুমিই আমাকে মাফ করে দিও।

- সুফিয়া কোনো ভাবে কি থেকে যাওয়া যায়না?

- না বিজয়,তুমিই না চেয়ে ছিলে আমি মাথা উচু করে বাচি,এখন সময় এসেছে বাচার।

- তাহলে কোনোভাবেই আর তোমাকে আটকাতে পারলাম না!

- তুমি কি আমাকে পাখির মত খাচায় আটকে রাখতে চাও?

- না,আমি চাই তুমি স্বাধীন ভাবে আকাশে ওড়ো।

- তাহলে পাগলামি করছো কেনো?

- অনেক ভালোবাসি তোমায় তাই।

- তুমি সেদিন জানতে চেয়েছিলে না,আমি তোমাকে এখনও ভালোবাসি কি না,সত্যি বলবো?

- হুম।

- ভালোবাসি তোমায় অনেক ভালবাসি।ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি।

- তাহলে থেকে যাওনা আমার কাছে।

- সেটা এখন আর সম্ভব না।

- চলেই যখন যাবে,কোনো ভাবেই যখন আর আটকাতে পারবোনা,তাহলে আমাকে ও তোমার সাথে নিয়ে চলো না।

- তোমার তো চলে গেলে চলবেনা।তোমার তো পরিবারের পাশে থাকতে হবে।মা, ছোটো আর বাচ্চাদের যে তোমাকে প্রয়োজন।

- আর তোমার?তোমার কি আমাকে কোনো প্রয়োজন নেই?

- আমি তো চিরো জীবনেরই একা,আমার একা থাকতে কষ্ট হবেনা।আর কে বলেছে তোমাকে আমার দরকার নেই,তুমি তো আমার স্বামী,এটাই আমার সব চেয়ে বড় পরিচয়,আমি না হয় তোমার পরিচয় টুকু নিয়েই বাঁচবো।


আমি কাদছি, পরী,মা বিজয় সবাই কাদছে।আশ্চর্যের বিষয় ছোটোর চোখেও আজ পানি।আমি বিজয় কে বললাম শেষ বারের মত একটু জড়িয়ে ধরবে আমায়?

বিজয় আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বাচ্চাদের মত কাদতে লাগলো। আমিও বিজয় কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি।আমি ওর কাছ থেকে ছুটতে চাইলাম কিন্তূ ও ছাড়ছেনা,আরো শক্ত করে ধরছে।যেনো পালাতে না পারি।আমি জোর করেই ওর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম।চোখের পানি মুছে সামনের দিকে পা বাড়ালাম।


পা বাড়ালাম অজানা এক দেশের উদ্দেশ্যে।জানিনা ওই জিবনটা আমার জন্য কেমন হবে,জানিনা আগামী দিন গুলোতে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে।তবুও একবুক ভালো থাকার প্রয়াস নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি।জানিনা এদের সাথে আর কখনো দেখা হবে কি না,জানিনা মনের স্বপ্ন গুলো পূরণ হবে কিনা তবুও পা বাড়িয়েছে অনেক আশা নিয়ে,যদি এই কালো মেঘ ভেঙে কখনো নতুন সূর্যের আগমন ঘটে।

শেষ বারের মত একবার পিছু ফিরে চাইলাম, পরী আর তার বাবা এখনো কাদছে।যতক্ষণ চোখের আড়াল হইনি, ঠায় দাড়িয়েই ছিলো....


আজ অনুপম রায়ের একটা গান খুব মনে পড়ছে


আমাকে আমার মত থাকতে দাও,আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি,

যেটা ছিলোনা,ছিলোনা সেটা না পাওয়াই থাক।সব পেলে নষ্ট জীবন.....


সমাপ্ত।


এমন আরও অনেক গল্প পড়ুন।