গল্প লিলাবতী | রহস্যময় গল্প ২০২৩

 রহস্যময়ী নারী

রহস্যময়ী নারী

গল্প: লিলাবতী

আমার বড় মেয়েটা ১ মাস আগে আত্নহত্যা করেছে।আমার সোনা মা টা কেন এমন করল এটার কারন বুঝতে পারলাম না এখনও।কয়েকদিন যাবৎ শুধু বলত 


--- "মা আমার কেন জানি না খুব কষ্ট হয় আমার কেন জানি না ভিতরটা খুব একা একা লাগে।"


মেয়েকে তখন বলতাম,


--- 'মা তোমার কি হয়েছে? আমাকে বলো।আমি তো তোমার বন্ধুর মতো।


আমার মেয়েটা আমাকে সব বলত কেন জানি না সেদিন আমার মেয়েটা খুব চুপ ছিল।আমার মেয়েটা কেন জানি না সেদিন ভয়ে আৎকে উঠেছিল।হাজার বার প্রশ্ন করার পরও কোন উত্তর দেয় নি।আমার মেয়েটার মনের কথা আমি সেদিন জানতে পারে নি।জানতে পারলে হয়ত আমার মেয়েকে শান্ত্বণা দিতে পারতাম। এ ঘটনা টা আর ঘটত না।আমার ভিতরের যন্ত্রণা কিভাবে বুঝাব সবাইকে?আমি কতটা অসহায় আজকে সেটা বলার অপেক্ষা থাকে না।।আমার যন্ত্রণার পাহাড় টা বুকের উপর এমন ভাবে পড়েছে আমি সেটার ভার নিতে পারছি না।আমার মেয়ের বন্ধুমহলে অনেক খুঁজ নিয়েছি আমার মেয়েটার কি হয়েছিল জানার জন্য।তার বন্ধুরা সবাই শুধু এটাই বলেছে


--- 'আন্টি রিতু দু মাস যাবৎ কেমন জানি হয়ে গিয়েছিল।কেমন জানি ভয়ে ভয়ে থাকত।ক্লাসে স্যার রা অনেক বার কারন জানতে চেয়েছে আমরাও কারন জানতে চেয়েছি কিন্তু রিতু মুখ খুলে নি কখনও।সবসময় মনে হত ওকে কেউ প্রেসার দিচ্ছে ওকে কেউ দমিয়ে রাখছে।কিন্তু হাজার বার জিজ্ঞেস করার পরও কারন টা বলে নি।'


রিতুর বন্ধুদের কথা শুনে শুধু মনে হল আমার মেয়েটার মনে হয়ত কোন চাপা কষ্ট ছিল।মেয়ের বয়স সবে মাত্র ১৩। ক্লাস এইটে পড়ত।এ তরুনী বয়সে কি এমন কষ্ট সে পেল যে আমার বুকটা খালি করে চলে গেল।আমার আকাশের মেঘগুলা আজকে বৃষ্টি হয়ে জড়ছে না।বৃষ্টি হয়ে জড়লে হয়ত হালকা হতে পারতাম।কিন্তু সেটা মেঘ হয়ে হাহাকারের গর্জন দিচ্ছে।কষ্টে আমার বুকের ছাতিটা ফেটে যাচ্ছে।যেদিকে যায় শুধু রিতুর ছোঁয়া পাই।ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকালে হুহু করে কেঁদে উঠি কারন আমার মেয়েটা আমাকে আর বলবে না 


--- " মা আমাকে একটু পুডিং করে দাও।"আমার মেয়েটা খাব না বলে আর বায়না ধরবে না।


রিতুর মনের ভিতরে কি চলতেছিল জানি না।তবে ও কেন এমন করল বুঝতে পারে নি আজও।সেদিন সকালে রিতুকে ডাকতে ঘরে ঢুকতে যাব দেখি রিতুর ঘরের দরজা বন্ধ।মায়ের মন তো কেন জানি না তখনেই ভিতর টা হুহু করে বলে উঠল আমার মেয়েটার কিছু হয় নি তো?দরজা নক করতে লাগলাম আর চেঁচাতে লাগলাম কোন সাড়া পেলাম না।রিতুর আব্বু এসেও অনেক নক করল।কোন সাড়া শব্দ পাচ্ছিলাম না।কোন দিশা পাচ্ছিলাম না কি করব?দিশা না পেয়ে রিতুর বাবাকে বললাম,


--- 'রিতুর বাবা দরজা ভাঙ্গ আমার মনটা ভালো ঠেঁকছে না।'


রিতুর বাবাও কেঁদে কেঁদে সান্ত্বনা দিয়ে বলতেছিল,


--- 'কিছু হবে না আমাদের রিতুর।তুমি এত চিন্তা কর না।পড়তে পড়তে হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে।গভীর ঘুমে আছে তো তাই আমাদের ডাক শুনতে পারছে না।'


এ বলে দরজা জোড়ে ধাক্কা দিল।দরজা খুলার পর রিতুর বেডে তাকিয়ে দেখলাম রিতু নেই।কেন জানি না হুট করে ফ্যানের দিকে চোখ গেল।ফ্যানের দিকে চোখ যাওয়ার পর যা দেখলাম মনে হচ্ছে আমার কলিজাটায় কেউ গিট দিয়ে ধরে রেখেছে আর আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।এক চিৎকার দিলাম কারন রিতু ফ্যানের মধ্যে ঝুলছে।রিতুর বাবাকে বললাম,


--- 'রিতুর বাবা তাড়াতাড়ি রিতুকে নামাও।'


রিতুর বাবাও চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল।সারা ঘর খুঁজে কোন চেয়ার পেলাম না।ডাইনিং টেবিল থেকে চেয়ার এনে রিতুকে নামালাম।আমার মেয়েটার হাত, পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল।আমি আমার মেয়েটার হাত পায়ে তেল মালিশ করতে লাগলাম।আমার মেয়েটার জিহ্বাটা বের হয়ে গিয়েছিল।আমার তো তখন মাথায় এটাই আসছিল না কি করতে হবে?শুধু ভাবছিলাম আমার মেয়েটার কিছু হবে না তে।খেয়াল করলাম ওর হার্টবিট আর কাজ করছে না।আমি আমার মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম।পাশে রাখা চিঠিটা হাতে নিল রিতুর বাবা।চিঠিতে লিখা ছিল


"প্রিয় বাবা,মা 


আমি স্ব ইচ্ছায় স্বজ্ঞানে আমার জীবন দিলাম।আমার লাশটা যেন ময়না তদন্ত না করা হয় এটাই তোমাদের কাছে রিকুয়েষ্ট। "


চিঠিটা পড়ে আরও চিৎকার দিলাম।মুহুর্তের মধ্যেই আমার চিৎকার শুনে আশে পাশের লোক চলে আসল।ক্রমশেই বাড়িটা ভরে গেল।পুলিশকে খবর দেওয়া হল।তারা এসে লাশটা নিয়ে গেল ময়না তদন্ত করার জন্য।হাজার বার বলেছি আমার মেয়ে না করেছে ময়না তদন্ত করতে আমার মেয়েটাকে কাটা ছিড়া করে কষ্ট দিবেন না।আমার আর্তনাদ সেদিন কেউ শুনল না।বুকের ভিতরটা কাঁদতে লাগল শুধু।ঘরটা খেয়াল করে দেখলাম শূন্যতা বিরাজ করছে।হুট করে আমার চোখ পড়ল খাটের উপরে।খাটের থেকে ফ্যান টা অনেক উপরে তাহলে আমার মেয়ে সে ফ্যানে কিভাবে গলায় দঁড়ি দিল?আমার মেয়ে তো খাটের উপরে কোন টুল বা চেয়ার রাখে নি।আর রিতুকে নামানোর সময় ও তো কোন চেয়ার রুমে ছিলনা।রিতুর বাবা তো ডাইনিং রুম থেকে চেয়ার এনে রিতুকে নামিয়েছে।তাহলে এরকম কিভাবে সম্ভব?রিতু কিভাবে এত উপরে নাগাল পেল চেয়ার ছাড়া।প্রশ্নটা মনে আসতেই, মনে হল আমার মেয়েটাকে কেউ মেরে দেয় নি তো?কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব ঘরের দরজাটা লক করা ছল।আর ঘরে প্রবেশের ও কোন আলাদা দরজা ছিল না।তাহলে এমন কিভাবে হল?এলোমেলো প্রশ্ন মাথা ঘুরিয়ে দিল মনে হচ্ছে।মাথার ভিতরটা ঝিম ধরে গেল।


২ দিন পর রিতুর লাশ দেওয়া হল।কিন্তু রিতুর লাশ তারা ময়না তদন্ত না করেই দিয়ে দিল।পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম 


--- 'ময়না তদন্ত করেন নি কেন?'


পুলিশ অফিসারের চোখে একটা ভয় দেখতে পেলাম।খেয়াল করলাম ভয়ে নীরব হয়ে আছে।আমাকে কিছু না বলে চুপ করেই বাইরে চলে গেল।আমি আমার মেয়েকে দৌঁড়ে দেখতে গেলাম।আমার মেয়ের নিথর দেহটা পড়ে আছে।সেদিনেই আমার মেয়েকে শেষ দেখা দেখেছিলাম।বুকে পাথর চেপে মেয়েকে রেখে এসেছিলাম কবরে।মেয়ের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর জানতে পারি পুলিশ অফিসারটা মারা গিয়েছে।শুনেছি অপঘাতে মারা গিয়েছে।শুনেছি রিতুকে যে ডাক্তাররা ময়না তদন্ত করতে চেয়েছিল তারাও অপঘাতে মারা গিয়েছে।এই মৃত্যুর অজানা কারন গুলো এখনও রহস্যে ঢাকা।


দেখতে দেখতে ১ টা বছর কেটে গেল।আমার মেয়ের মৃত্যু শোক টা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারি নি।সারাক্ষণ শুধু রিতুর কথায় মাথায় ঘুরতে থাকে।অনেক এলোমেলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়।কিভাবে রিতু এত উপরে উঠে গলায় দঁড়ি দিল।গলায় দঁড়ি দিল ঠিক আছে কিন্তু কেন তার গলায় কোন দাগ পড়ল না।ময়না তদন্ত করতে নিয়েও কেন ময়না তদন্ত করা হল না?পুলিশ অফিসারটায় বা হুট করে কেন অপঘাতে মারা গেল।ডাক্তারগুলোরেই বা কি হল?এসব প্রশ্ন বারবার মনে আসতে থাকত।কোন উত্তর খুঁজে পেতাম না।আমার মেয়েটার সেদিন কি হয়েছিল?এটা ভাবতে ভাবতে যেন আমি পাগল হয়ে যাব।আমাদের একটা মাত্রই মেয়ে ছিল আর কোন সন্তান ছিল না।তাই রিতুকে হারিয়ে রিতুর বাবা আর আমি দুজনেই বেশ হতাশ হয়ে যাই।আমাদের সারাদিন কাটে রিতুকে কল্পনা করতে করতেই।বাড়িটার পাশ দিয়ে অনেকে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।একেক জন একেক কথা বলে।কেউ বলে তারা রিতুকে দেখেছে।কেউ বলে অনেক কান্নার শব্দ আসে।কেউ বলে বাসার সামনে নাকি ছায়ামূর্তি দেখে মাঝে মাঝে।


কিন্তু আমি কতবার রিতুকে দেখার চেষ্টা করতাম একটা বারও রিতু আমার সামনে আসত না।এত অভিমান আমার উপর যে আমাকে দেখা দেয় না।রিতুর মরার পর বাসাটার কাছে দিয়ে নাকি ছোট বাচ্চারা গেলে জ্বর আসত।খারাপ বাতাস বইত সবাই বলত।কিন্তু আমি এ বাসায় থেকেও এমন আভাস পাই নি।রিতুর শূন্যতা নিয়েই ধুকরে ধুকরে বেঁচে থেকে ও যেন মরে আছি।চারদিকে শুধু রহস্য আর রহস্যের বাসা বাঁধছে।রিতুর মৃত্যুটা এখনও একটা রহস্যে ঢেকে আছে।


সময় কাটে কিন্তু বুকের ভিতরের পাহাড়টা এখনও নামে নি।ডাইনিং টেবিলে বসে প্রতিদিনের মতই খেতে বসে রিতুর জন্য কাঁদতেছিলাম।হুট করে কে জানি কলিং বেল এ চাপ দিল।এ এক বছরে নানা কারনে কেউ আসে নি এ বাড়িতে।এক বছর পর কে আসল এটা ভাবতে ভাবতেই দরজাটা খুললাম।দরজাটা খুলে দেখলাম.....


গল্পঃ লিলাবতী 

পর্ব : ০১

শারমিন আঁচল


গল্পঃ লিলাবতী 

পর্ব : ০২

শারমিন আঁচল

পর্ব : ০২ (সমাপ্ত) 

লেখিকা-শারমিন আঁচল


দরজা খুলে দেখলাম একটা অল্প বয়সী মেয়ে দাঁড়ানো।বয়স হবে ২১ কি ২২।মেয়েটার মুখটায় বেশ মায়া মাখা ছিল।মেয়েটার মুখে রিতুর একটা ছাপ পেতে লাগলাম।রিতুর মতই খানিকটা দেখতে মেয়েটা।মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ ক্লান্ত,অসহায়,নিরুপায়।মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম


--- কে গো মা তুমি?নাম কি তোমার?


মেয়েটা মিষ্টি গলায় উত্তর দিল


--- আমার নাম লিলাবতী।

--- বাহ অনেক সুন্দর নাম।

--- কি চাও মা?


মেয়েটা অসহায়ত্ব মাখা মুখ আর কান্না জড়িত কন্ঠে বলল


--- আমার একটা কাজ চাই মা।সেই সোনাপুর গ্রাম থেকে আসছি।বাবা, মা বন্যায় মারা গিয়েছে।তিন কূলে আমার যে আর কেউ নেই মা।অনেক কাজ খুঁজেছি কেউ কাজ দেয় নি।আপনি আমাকে কাজ দিলে খুব খুশি হব মা।আমি পেটের ক্ষুদায় ক্লান্ত আমাকে কাজের বিনিময়ে খেতে পড়তে দিলেই হবে।বাড়তি কোন টাকা দিতে হবে না।বিনিময়ে আমি আপনার সব কাজ করে দিব। মা আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না।


মেয়েটার কথা শুনে বেশ মায়া হল।মেয়েটার মুখে মা ডাক শুনে আমার কলিজাটা যেন শান্ত হল।বুকের ভিতরের হাহাকারটা এতদিনে নিস্তব হল।বুকের যন্ত্রণাগুলো নিভতে লাগল।ভারী পাহাড়টা যেন নামতে লাগল।মেয়েটাকে বললাম,


--- মা বলে ডেকেছিস তোকে ফিরিয়ে দেবার সাধ্য তো আমার নেই।আয় মা ঘরে আয়।তোর তো খুব ক্ষুদা পেয়েছে তাই না।আই তোকে খেতে দেই।


লিলাবতীর চোখ যেন ছলছল করতে লাগল সিক্ত অশ্রুজলে।চেহারার মায়াবী লাবন্যটা যেন আরও ফুটে উঠল।মনে হতে লাগল এক বিভোর অন্ধকারে একটা জোনাকি পোকা জ্বলছে।চোখের কোণে জল দেখে জিজ্ঞেস করলাম


--- কি হয়েছে এভাবে কাঁদছিস যে?

--- এভাবে অনেক দিন পর আমাকে কেউ ভালোবেসে খেতে বলল।মা,বাবা,মারা যাওয়ার পর তো কাউকে আপন করে পাই নি।আজকে পেলাম।এ অশ্রু যে আনন্দ অশ্রু।


লিলাবতীর চোখ দুটো মুছে।জড়িয়ে ধরে রুমে আনলাম।ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে দিলাম।লিলাবতী খাবারগুলো পেয়ে গপ গপ করে খেতে লাগল।তার খাওয়া দেখে মনে এক অজানা তৃপ্তি আসল।ইশ বেচারী না জানি কতদিন খাই নি।


--- কি রে লিলাবতী পুডিং খাবি?


লিলাবতী পুডিং নামটা শুনে বেশ অবাক হল।অবাক হয়ে বলল,

--- পুডিং কি?

আমি ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে জবাব দিলাম

--- আজকে বিকেলে তোকে খেতে দিব নে।


লিলাবতীকে পেয়ে মনটা যেন শান্ত হয়ে গেল।রিতুর শোকটাও বেশ কাটিয়ে উঠতে পারতেছিলাম।লিলাবতীকে দেখেই মনে হত বেশ বিচক্ষণ আর বুদ্ধমতি মেয়ে।কাজে কর্মে অনেক পটু।মনে হয় না ও কোন গ্রামের মেয়ে।মনে হয় শহরে থেকেই বড় হয়েছে।


কিন্তু লিলাবতীর হাব ভাব মাঝে মাঝে আমার কাছে কেন জানি না বেশ সন্দেহজনক মনে হয়।কেন জানি না মনে হয় ও কোন উদ্দেশ্যে নিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকেছে।কারন সেদিন হুট করে সে বলল

--- আচ্ছা মা এ বাড়িটার বাজার মূল্য কত?


আমি জাবাব না দিয়েই কথাটা এড়িয়ে চললাম।খেয়াল করলাম ওর এ বাড়ি, এবাড়ির সব কিছুর প্রতি একটা কৌতুহল কাজ করে।সারা বাড়িতে রিতুর ছবি দেখে সে রিতুর ব্যাপারে ও বেশ তথ্য কৌশলে আমার কাছ থেকে জোগার করে ফেলেছে।


এক তো আমার মেয়ের মৃত্যু রহস্য আর এখন লিলাবতীর এরকম আচরণ সবকিছুই যেন আমার কাছে বেশ রহস্যময় লাগল।এ রহস্যের জাল থেকে বের হওয়া বেশ দায়।মাঝে মাঝে খেয়াল করতাম লিলাবতী নানা বাহানায় বাইরে যেত।প্রথম প্রথম বিষয়গুলো বেশ নজরে নিতাম না কিন্তু ইদানিং বেশ নজরে নিচ্ছি।একদিন কৌশলে আমি তার পিছু নিলাম।বেশ অবাক হলাম।কারন লিলাবতী এক ছেলের সাথে দেখা করে কি যেন দিয়ে চলে আসল।লিলাবতী আমাকে বলেছিল তার এ শহরে কেউ নেই।তাহলে ঐ ছেলেটা কে ছিল।আমার মনে একের পর এক প্রশ্ন বাসা বাঁধতে লাগল।তবুও নিজেকে শাত্বণা দিলাম।এ রহস্য আমাকে বের করতেই হবে।লিলাবতীকে কিছুই বুঝতে দেওয়া যাবে না।তাই লিলাবতী বুঝে উঠার আগেই চলে আাসলাম বাসায়।


সেদিন রিতুর রুমে গিয়ে খেয়াল করলাম লিলাবতী রিতুর রুমের সব অগোছালো করে কি যেন খুঁজছে।আমি লিলাবতীকে বললাম


--- সব এমন অগোছালো করলি কেন? আর কি খুঁজছিস?


লিলাবতী হয়ত আমার এমন প্রশ্ন শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না।তবুও অপ্রস্তুত গলায় জবাব দিল

--- আমি সব গোছাচ্ছিলাম।


আমি কিছু না বলেই বের হয়ে চলে আসলাম।সন্দেহের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্র হতে লাগল।সেদিন মাঝরাতে খেয়াল করলাম লিলাবতীর রুম থেকে রিতুর বাবা বের হচ্ছে।তার মানে কি রিতুর বাবার সাথে লিলাবতীর কিছু আছে।নাহ এ আমি কি ভাবছি?লিলাবতী মেয়ের বয়সী তাকে নিয়ে না জেনে এমন বাজে মন্তব্য আনাও পাপ।কিন্তু কোনভাবেই সন্দেহ মন থেকে যাচ্ছে না।সবকিছুই বলে দিচ্ছে লিলাবতী কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এ বাড়িতে এসেছে।কিন্তু কি সে উদ্দেশ্য?এক তো মেয়ের মৃত্যু রহস্য আর এখন একটার পর একটা প্রশ্ন সবকিছু যেন মাথা এলোমেলো করে দিচ্ছে।


সেদিন রিতুর বাবা বাসায় ছিল না।তাই লিলাবতীকে বললাম আমার সাথে থাকার জন্য।লিলাবতীও বেশ খুশি মনে রাজি হয়ে গেল।রাতে লিলাবতীর সাথে কথা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে গেলাম।হুট করে মাঝরাতে উঠে খেয়াল করলাম লিলাবতী...


(৩) অন্তিম অংশ


মাঝরাতে উঠে খেয়াল করে দেখলাম লিলাবতী ঘরের আলমিরা খুলে কাগজ পত্র অগোছালো করছে।আমি বেশ আশ্চর্য হলাম এরকম অবস্থানে লিলাবতীকে দেখে।আমি কিছু না বলে চুপটি মেরে শুয়ে রইলাম।কারন আমার উদ্দেশ্য লিলাবতীকে হাতে নাতে ধরা।আমি যেহেতু তার উদ্দেশ্য এখনও টের পাই নি তাই তাকে বুঝতে দেয় নি যে আমি জেগে আছি।খেয়াল করলাম ও ঘরের সব চেক করে বাহিরের দিকে যাচ্ছে।আমিও খানিকক্ষণ পর লিলাবতীর পিছু নিলাম।খেয়াল করলাম লিলাবতি বাড়ির পিছনের দিকে যাচ্ছে।যে জায়গায় কেউ এক বছরের মধ্যে যায় নি কারন এ জায়গায় নাকি অনেকে রিতুকে দেখেছে।আর রিতুর কবরটাও এদিকে।লিলাবতী জোরে পা চালাতে লাগল।আমি পিছু নিতে লাগলাম।হঠাৎ করে খেয়াল করলাম রিতুর মত পোশাক পড়ে কেউ একজন লিলাবতীর ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে।তার মানে এলাকাবাসী ঠিক বলেছে।লিলাবতীকে লক্ষ্য করলাম ঐ মেয়েটার পিছু নিচ্ছে।ঐ মেয়েটাও লিলাবতী দেখে দৌঁড়াচ্ছে।বুঝতে পারলাম না এটা যদি রিতুর আত্না হয় তাহলে লিলাবতীকে কেন ভয় পাচ্ছে।লিলাবতী ত মানুষ।উল্টা লিলাবতীক ভয় পাবার কথা তাহলে লিলাবতী কেন ভয় পাচ্ছে না।


আমি সামনে এগুতে থাকলাম।হুট করে মনে হল কেউ আমার মাথায় আঘাত করেছে আমি মুখ থুবরে পড়ে গেলাম।তারপর কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারলাম না।যখন আমার জ্ঞান ফিরেছে তখন খেয়াল করলাম সকাল হয়ে গিয়েছে আর আমি বিছানায় শুয়ে আছি।মাথার পিছনে হালকা ব্যাথা পাচ্ছিলাম।মাথাটা বেশ ব্যাথা করছে।রাতে কি হয়েছিল খানিকক্ষণের জন্য বেমালুম ভুলে গেলাম।তাই মাথায় কি হল বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম।আস্তে আস্তে রাতের সব মনে পড়তে লাগল।তাহলে এখানের লোক যা বলত তা ঠিক এ বাড়ির আশে পাশে রিতুর আত্না ঘুরে।কিন্তু লিলাবতী কে?সে কি চায়?আমি লিলাবতীকে ডাক দিলাম।


--- লিলাবতী লিলাবতী

--- আসছি মা।

--- আমাকে বল রাতে তুই ঐ বাড়ির পিছনের দিকে কেন গিয়েছিলি।

--- মা ধৈর্য হারাবেন না।একটু স্থির হয়ে বসুন একটু পড়েই আপনার কাছে সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।


আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না লিলাবতী কি বুঝাতে চাচ্ছে।বেশ অস্থিরতার সাথেই জিজ্ঞেস করলাম,


--- তুই আমাকে এখনেই বল।

--- মা আমি আপনাকে এখন বললে আপনার বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে।আপনি একটু স্থির হয়ে বসুন।আর অনাকাক্ষিত কিছু শুনার জন্য প্রস্তুত থাকুন।


আমি লিলাবতীর কথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।আমার মাথাটা আরও ব্যাথা করতে লাগল।বেশ রেগেমেগেই বললাম


--- আমি আর এসব নিতে পারছি না।কি হয়েছে বলবি কি না বল।আমার আর ভালো লাগছে না।


--- মা বলে যেহেতু ডেকেছি আপনার কোন ক্ষতি করব না।রিতুর মৃত্যু রহস্য সব কিছু আজকে জানতে পারবেন।এক ঘন্টা অপেক্ষা করুন।১০ টা বাজতে দিন।


আমি লিলাবতীর এ কথাটা শুনে বেশ ভরসা পেলাম।স্থির হয়ে এক ঘন্টা বসে থাকার চেষ্টা করলাম।কিন্তু যতই নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছি ততই অস্থির হয়ে যাচ্ছি।মনে হচ্ছে একটা সেকেন্ড একটা বছরের মত পার হচ্ছে।এতটা অস্থির এর আগে লাগে নি।আস্তে আস্তে সময় পেরিয়ে ঘড়ির কাটা ১০টার ঘরে গেল।দরজায় তখন টুংটাং করে কলিং বেল বাজতে লাগল।লিলাবতী দৌঁড়ে দরজা খুলতে গেল আমাকেও ড্রইং রুমে নিয়ে গেল।ড্রইং রুমে গিয়ে আমি যা দেখলাম তা দেখে আমার মাথার ব্যাথাটা আরও বেড়ে গেল।একি রিতুর বাবাকে পুলিশ ধরে রেখেছে কেন?আর রিতুর পোশাক পড়া পাশের এ মেয়েটা কে?এটাই কি তাহলে রিতু সেজে ভয় দেখাত।কিন্তু রিতুর বাবাকে কেন ধরে রেখেছে।আমি অবাক হয়ে লিলাবতীর দিকে তাকালাম।আমি কিছু বলার আগেই লিলাবতী আমাকে বলল


--- মা আমি যা বলব তা শুনতে হয়ত আপনার কষ্ট হবে তবুও আপনি একটু মন দিয়ে শুনুন।ভুল হলে আমাকে ক্ষমা করবেন।আমি পুলিশ অফিসার সাইদুর সাহেবের মেয়ে।সাইদুর সাহেব কে চিনতে পেরেছেন তো।সাইদুর সাহেব হল সেই পুলিশ অফিসার যে আপনার মেয়ের বিষয়টা তদন্ত করেছিল।আর আপনার মেয়ের মৃত্যুর সাতদিন পর এক্সিডেন্টে মারা যায়। হয়ত এখন ভাবছেন আমি কেন আপনার বাড়িতে এভাবে ঢুকেছি।আমার বাবার হঠাৎ মৃত্যু আমি মানতে পারি নি।সবকিছুতে আমি একটা রহস্যের গন্ধ পেতাম।খুঁজ নিয়ে জানতে পারি আপনার মেয়ের কেস চলাকালীন সময় আমার বাবার মত্যুর ঘটে।আর এদিকে আপনার বাড়ি নিয়ে বিভিন্ন ভূতের প্রলাপ শুনতে পাড়ি।তখন সন্দেহটা বাড়ে।আর সন্দেহটা আরও তীব্র হয় তখন যখন জানতে পারি দুজন ডাক্তারও মারা গিয়েছে।এক সাথে এতগুলো মৃত্যু বিষয়টা বেশ রহস্যজন মনে হতে লাগল।তারপর বাড়িটা সম্পর্কে খুঁজ নেওয়া শুরু করলাম।খু্ঁজ নিয়ে জানতে পারি বাড়িটা আপনার বাবার ছিল আর আপনার বাবা আপনার মেয়েকে লিখে দিয়েছে আর বাড়িটার বাজার মূল্য ২ কোটি টাকা।তখনেই আমার মনে একটা সন্দেহ ঢুকে যায়।তাই আমি ছদ্মবেশে এ বাড়িতে ঢুকি।


এ বাড়িতে ঢুকার আগে আমি জানতে পারি আমার বাবা যখন আপনার মেয়েকে ময়না তদন্ত করতে নিয়ে গিয়েছল তখন উপর মহল থেকে আমার বাবাকে চাপ দেওয়া হয় যেন ময়না তদন্ত না করা হয়।আমার বাবা নিজের চাকুরী বাঁচাতে ময়না তদন্ত করে নি।কিন্তু আমার বাবা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল রিতুর মৃত্যুটা আত্নহত্যা ছিল না।আমার বাবা আপনার মেয়ের একটা ডায়রি পেয়েছিল। আর সে ডায়রিতে কি লিখা ছিল জানেন?


আমি একটু অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলাম


--- কি লিখা ছিল?

--- লিখা ছিল


"মা তুমি তো বারবার আমাকে জিজ্ঞেস কর আমার কি হয়েছে,কেন আমি এত চুপচাপ।আমি কি করে বলব মা আমার বাবা আমার সাথে নোংরামু করছে।আমার বাবা আমার সাথে খারাপ করছে।আমার বাবা আমাকে ধর্ষণ করছে।আমি আমার বাবাকে যখন বলেছি তোমাকে সব বলে দিব তখন আমার বাবা আমাকে বলেছে তোমাকে মেরে ফেলবে।আমার জীবনে তুমি ছাড়া তো আর কেউ নেই।"


লিলাবতীর কথাটা শুনে যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে গেল।রিতুর বাবা রিতুকে ধর্ষন করেছে।নাহ এ হতে পারে না।এটা নিশ্চয় লিলাবতীর চাল।আর লিলাবতী ইচ্ছা করেই আমাকে ভুল বুঝাচ্ছে।


--- লিলাবতী এটা আমি বিশ্বাস করি না।


--- মা আমিও প্রথম আপনার মত এটা বিশ্বাস করি নি।পরে যখন রিতুর বাবা আমার রুমে এসে আমার সাথে অসভ্যতা করতে এসেছিল তখন বিশ্বাস হয়েছে।আর মা এটা রিতুর ডায়রি পরে নিবেন।আর এটা সিসি টিভি ফুটেজ যেদিন রিতুর বাবা আমার সাথে অসভ্যতা করেছিল তার ভিডিও আছে।আমি সব প্রমাণ নিয়েই বলেছি।আর এ কাগজগুলো আপনার আলমিরা থেকে নেওয়া।যেখানে স্পষ্ট লিখা আছে।রিতুর ১৮ বছর হওয়ার আগে সব সম্পত্তির মালিক হবে রিতুর বাবা ।স্বাভাবিক বিষয় এটাই যে রিতু মারা গেলে পুরো সম্পত্তির মালিক উনি হবেন।এক তো উনার বিকৃত যৌন চাহিদা তার উপর বিশাল সম্পত্তি তাই রিতুকে বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফ্যানে ঝুলিয়ে দিয়েছে এবং চাবি দিয়ে বাইরে থেকে অটো লক করে দিয়েছে যাতে করে সবাই ভাবে রিতু একা এ কাজটি করেছে।এর পর আমার বাবা যখন প্রমাণ পেয়ে ফেলেছে।তখন উনি উপর মহলে টাকা দিয়ে ময়না তদন্ত বন্ধ করে দেয়।আমার বাবা এ নিয়ে আবার মামলা দাঁড় করাতে চাইলে বাবাকে এক্সিডেন্ট করিয়ে মেরে ফেলে।ডাক্তারদেরও মেরে ফেলে।এ মেয়েটিকে টাকা দিয়ে রিতু সাজিয়ে ভয় দেখায় যাতে করে সবাই ভাবে এটা ভূতের কাহিনী।যাতে করে সবাই ভেবে নেয় যেন রিতুর মৃত্যুটা হয়ত ভূতে করেছে।একটা মিথ্যা ডাকতে গিয়ে এত সব খুন করল।আর আমিও একা হাতে কিছু করে নি।কারন আমি জানতাম প্রমাণ ছাড়া কথা বললে আমারও প্রাণ যাবে।তাই কৌশলে এ বাড়িতে ঢুকি সব প্রমাণ জোগাড় করি।রাতে যখন বাড়ির পিছনের দিকে যায় তখন এমেয়েটাকে হাতেনাতে ধরি।আপনার মাথায় আঘাতটা রিতুর বাবায় করেছে আর আমাকে মারতে চেয়েছিল।কিন্তু এটা যে উনাকে ধরার ফাদ ছিল উনি বুঝতে পারে নি।নিজের ফাঁদে নিজে পড়েছে।আর উনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর উনিও সব স্বীকার করেন।এবার সব প্রমাণ পেয়ে আপনি কি করবেন আপনি চিন্তা করুন।


কথা আর প্রমাণগুলো পেয়ে ভিতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল।আমার মেয়েটা কত কষ্ট করে মরল।আমার মেয়েটার এত কষ্ট হচ্ছিল আমি টের পাই নি।আর আমার স্বামী সম্পত্তি আর নিজের বিকৃত চাহিদা মিটাতে নিজের মেয়েকেও ছাড়ল না।আল্লাহ আমায় এসব শুনার আগে মরণ কেন দিল না।মনে হচ্ছে মাটি টা ফাঁকা হোক আমি ঢুকে পড়ি।মাথাটার ব্যাথা তীব্র হতে লাগল।আমি রিতুর বাবার কাছে গিয়ে গালে কষিয়ে চড় দিয়ে বললাম


--- লজ্জা লাগল না এত নিকৃষ্ট কাজ করতে।কু*ত্তার বাচ্চা নিজের মেয়েকেও ছাড়লি না।তোরে আমি এখনেই মেরে ফেলব।এই বলে গলায় চেপে ধরলাম।আর ছাড়ি নি।একদম মরার পরেই ছেড়েছি।


এবার বেশ শান্তি পাচ্ছি।আদালত আমাকে আইন তুলে নেওয়ার জন্য ১ বছর কারাদন্ড দিয়েছে।আমার তাতে কোন আফসোস নেই।


লিলাবতী মাঝে মাঝে আমাকে জেলে দেখতে আসে।এখন আমার মেয়েই হল -লিলাবতী।


(এখানে ধর্ষণ টা মূলত হয়েছে বিকৃত মানসিকতার কারনে।এরকম হাজার ও ধর্ষণ হয় বিকৃত যৌন চাহিদার জন্য।আমাদের উচিত ধর্ষণের দোষ হিসেবে শুধুমাত্র মেয়েদের পোশাক কে দায়ী না করে এসব বিকৃত মানুষকে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেওয়া।ইসলাম টানলে বলব পর্দা মেয়েদের ও ফরজ আর ছেলেদের ও ফরজ।পর্দার আয়াত মেয়েদের আগে ছেলেদের জন্য নাযিল হয়েছে।সব মিলিয়ে আমাদের ও সচেতন হতে হবে।শালীন পোশাক পড়াটাও জরুরি।নিজেদের সচেতনতা, দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশেই পারে ধর্ষনমুক্ত বাংলাদেশ উপহার দিতে।কোন ভুল হলে ক্ষমার চোখে দেখবেন)


সমাপ্ত ----------------


এমন আরও গল্প পড়ুন।