গল্প তোমার আমার সংসারে | সংসার জীবনের গল্প

মেয়েদের সংসার জীবন

মেয়েদের সংসার জীবন

১ থেকে ৩ পর্বের গল্প সম্পূর্ণ এক সঙ্গে।

তৃণাকে আমি মেরেছি।আচ্ছামতো মেরেছি।এক চড়ে ওর সাদা গালে আমার হাতের আঙুলের দাগ বসিয়ে দিয়েছি একেবারে।মারবো না কেন?কী পেয়েছে ও! প্রতিরাতে তার চাচা তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যাবে এসে?এটা কী পুতুল খেলা! গতকাল বেচারার বাসর ছিল।ওর কান্না শুনে সে বাসর রেখে আমার ঘরে এসে তাকে তিন চার ঘন্টা গল্প বলে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে গেছে। গতকাল আল্লাহ জানে নতুন বউ কী না কী ভেবেছে!আজ আবার কান্না!চাচ্চুকে ডাকো মা চাচ্চুকে ডাকো!ফাজিল মেয়ে!ইচ্ছে করছে ওর গলা টিপে মেরে দেই! আমার দূর্ভাগ্য! নয়তো এমন দিন ঘটে কেন!

'

আমি নীলা। আমার একমাত্র মেয়ের নাম তৃণা।ওর বাবা মারা গিয়েছে তিন মাস ষোলো দিন হয়েছে।চার মাস পূর্ণ হয়নি বলে এখনও বাবার বাড়ি যেতে পারিনি। তৃণার বয়স তিন। ছোট মানুষ।একটু পর পর কাঁদে। গতরাতে এমন কান্না শুরু করলো!ওর কান্না শুনে মাঝরাতে আমার ঘরে উঠে এলো ওর ছোট চাচা মুহিব। এসে বললো,


--- 'ভাবী কী হয়েছে?'


আমি রাগের গলায় বললাম,


--- 'কী আর হবে? তুমি ঘুম না পারিয়ে দিলে ঘুমাবে না!এটা কী পুতুল খেলা বলো?'


--- মুহিব বললো,'ভুলটা আমারই হয়েছে ভাবী। বিয়ে করে সব ভুলে গেছি।তৃণাকে যে আমার ঘুম পাড়াতে হবে তা ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা আর সমস্যা নাই। এখন তো এসেই গেছি!'


--- 'কী বলছো তুমি এসব?বাসর রেখে তৃণাকে তুমি ঘুম পাড়াবে?'


--- 'পাড়াবো।এতে অবাক হওয়ার কী আছে?'


--- 'পাগল হয়ে গেছো? এখন যাও তো বলছি এখান থেকে।ঘরে যাও। এশা অপেক্ষা করছে।'

'করুক।'


বলে সে জোর করেই তৃণাকে নিয়ে শুয়ে পড়েছে বিছানায়। তারপর গল্প বলা শুরু করেছে। কাটায় কাটায় চার ঘণ্টা পর ঘুমিয়েছে তৃণা।ওর ঘুমানোর পর মুহিব উঠে গিয়েছে ঘরে।

-----------------------------

আর ওদিকে বাসর ঘরে বসে বসে ঝিমুচ্ছে এশা।মুহিব ঘরে যাচ্ছে না।বিষয়টা সে বুঝতে পারছে না।তার কেমন কান্না পাচ্ছে! ইচ্ছে করছে গলা ছেড়ে কাঁদতে। আবার রাগও হচ্ছে খুব ওর প্রতি!

মুহিব যখন গেলো তখন অনেক রাত হয়ে গেছে।প্রায় রাত তিনটা।মুহিব ঘরে ফিরে দরজার খিল দিতে দিতে বললো,


--- 'এশা আমি খুব সরি!অনেকটা দেরি হয়ে গেলো!'

--- এশা বললো,'এতোক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি?'

--- 'মেজো ভাবীর ঘরে ছিলাম।'

--- 'মানে?কী বলছো এসব?'


মুহিব বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করলো সবকিছু। কিন্তু এশা শুনতেই চায় না।সে উল্টো বললো,


--- 'তাহলে বড় ভাবীর কথাই সত্য হলো!'


মুহিব চমকে উঠে বললো,


--- 'বড় ভাবী আবার কী বলেছে?'


--- 'যা সত্যি তাই বলেছে।তৃণার মায়ের সাথে তোমার --'


মুহিব রেগে গিয়ে এশার গালে এক চড় দিলো। বিয়ের প্রথম রাতেই এমন ঘটনা!এশা কেঁদে উঠলো মুখ চেপে ধরে। তারপর কান্নামাখা গলায় বললো,


--- 'একটা খারাপ মেয়ের জন্য আমায় মেরেছো তুমি?

--- মুহিব বললো,'আরেকবার ভাবীর নামে এমন কথা বললে তোমায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এ বাড়ি থেকে বের করে দিবো!'


এশা কেন জানি হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। তারপর বললো,


--- 'আচ্ছা বাদ দেও তো এসব। পাঁচ বছরের প্রতীক্ষার পর আমাদের এই বিয়ে।আমরা এমন সুন্দর রাতটা নষ্ট করতে পারি না কিছুতেই।'


মুহিব রেগেমেগে আগুন হয়ে বললো,


--- 'রাখো তোমার সুন্দর রাত!'


বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।সে রাতে আর ঘরে ফিরলো না।এশা খাটের একপাশে বসে থেকেই ঘুমিয়ে পড়লো।

'

সকাল বেলা বড় ভাবীর সাথে লুকিয়ে দেখা করলো এশা। তারপর বড় ভাবীকে কেঁদে কেঁদে সব খুলে বললো সে।বড় ভাবী সবকিছু শুনে বললেন,


--- 'তুমি টেনশন করো না। নীলার (তৃণার মা) সাথে মুহিবের সম্পর্কটা মা বিশ্বাস করেন না। মাকে যেভাবেই হোক বিশ্বাস করাতে হবে। একবার যদি মাকে বিশ্বাস করানো যায় তবেই সম্ভব ওদের সম্পর্ক নষ্ট করা!


এশা চোখ মুছতে মুছতে বললো,


--- 'মার কাছে আমি সব বলবো।'


বড় ভাবী ওর মাথায় ঠুসি দিয়ে বললেন,


--- 'মাথামোটা মেয়ে। তুমি চুপচাপ থাকো।দেখো আমি কী করি!'

'

তৃণার কান্না শুনে আজও মুহিব এসেছে।সে এসে নীলাকে বললো,


--- 'ভাবী,তৃণাকে দেও আমার সাথে আমার ঘরে নিয়ে যাই! ওখানে ঘুমোবে।'


নীলা কিছু বললো না।কিন্তু তৃণা বললো,


--- 'চাচ্চু তুমি এখানে শুবে আমার সাথে।আমি আর কোথাও যাবো না!দরজাটা বন্ধ করে আসো।'


মুহিব উপায়হীন হয়ে তৃণাকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বরাবরের মতো তৃণার বিছানাতেই শুয়ে পড়লো।তৃণা এবার বললো,


--- 'চাচ্চু,আলোটা আমার চোখে খুব লাগছে।ব্যথা করছে চোখ।লাইটটা নিভিয়ে দাও!'


নীলা সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিয়ে বললো,


--- 'তৃণা কী সব বলছো তুমি?'


তৃণা সঙ্গে সঙ্গে ভে ভে করে কেঁদে উঠলো।মুহিব বললো,'আহা ভাবী, 


--- নিভিয়ে দাও না লাইট টা!'


নীলা রাগে দুঃখে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে সুইচ টিপে বাতি নিভিয়ে দিলো।আর তখনই দরজায় টোকা পড়লো টানা।তৃণার সাথে শুয়ে থেকেই মুহিব বললো,


--- 'কে?'


মুহিবের মা ময়মুনা বেগম দরজার ওপাশ থেকে কড়া গলায় বললেন,


--- 'দরজাটা খোল আগে!'


মুহিব স্বাভাবিক ভাবেই দরজা খুলতে গেলো। কিন্তু নীলার বুকটা তখন কেমন ধ্বক করে উঠলো।সে তার শাশুড়ির এমন কর্কশ গলা অতীতে কোনদিন শুনেনি!

'

'

তোমার আমার সংসারে

১ম_পর্ব

অনন্য শফিক


গল্প : তোমার আমার সংসারে

২য় পর্ব

অনন্য শফিক

'

মুহিব দরজা খুলে দিতেই তার মা ময়মুনা বেগম ঘরে ঢুকে বললেন,


--- 'ঘরে বউ থুইয়া এইখানে আইসা দরজা বাইন্ধা কী করস?এই ঘরের বাতি নিভানো কিসের লাইগা?'


মুহিব মার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল। নীলা বিছানা থেকে উঠতে উঠতে তার শাশুড়ির মুখে এমন কথা শুনে আবার ধড়াস করে বিছানার উপরই বসে পড়লো। শুধু তৃণা এলো দৌড়ে। এসে সে তার চাচ্চুর হাত ধরে বললো,


--- 'চাচ্চু এসো।দরজাটা বন্ধ করে দেও!'


ময়মুনা বেগম তৃণাকে এক ধমক দিলেন।তৃণা ভে ভে করে সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে উঠলো।মুহিব কিছু বলার আগেই ময়মুনা বেগম আবার বললেন,


--- 'তুই অতটা পঁইচা গেছস?'


মুহিব কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না।সে আহত আর বিক্ষিপ্ত মনে ভাবে, মা কী তবে তার নিজের সন্তানকেও ভালো করে চিনতে পারেন না!তারপর ময়মুনা বেগম নীলার কাছে গেলেন।

নীলা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো।তার মুখ একেবারে মলিন হয়ে গেছে।গলা শুকনো কাঠ।

ময়মুনা বেগম চোখ লাল লাল করে বললেন,


--- 'আমার ছেলে মারা গেছে তো এখনও ভরা চাইর মাসও হয় নাই,এর মাঝেই এইসব!

আমার তো এখন মনে হয়তাছে আমার ছেলের মৃত্যুতে তোমার নিজের হাত আছে!'


নীলা শাশুড়ির মুখ থেকে এই কথা শুনে থরথর করে কাঁপতে লাগলো।তার মুখ ভেঙে কান্না আসছে।চোখ ফেটে বেরুচ্ছে জলকণা। নীলা মুখে আঁচল চেপে ধরে কাঁদছে।ময়মুনা বেগম বললেন,


--- 'বড় বউ অনেক আগে থাইকাই আমারে স্বতর্ক করছিলো। কিন্তু আমি ওর কথা শুনি নাই। এখন দেখি ওর কথাই সত্য!'


মুহিব তখন বললো,

--- 'মা, তুমি ভুল বুঝছো।আমি তো---


মুহিব তার কথা শেষ করতে পারলো না।এর আগেই তার মা এক ধমকে তাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন,


--- 'চোর ধরা পড়ে গেলে বাঁচার জন্য অনেক কথা বানায়! কাঁটা বনের ভিতর দিয়াও পথ বাইর করে।এতে লাভ হয় না।ধরা পড়া চোর আর পড়ে যাওয়া তেল দুইটাই এক জিনিস। বাজেয়াপ্ত।তুই চোর।তৃণার মাও চোর। তোদের কাউর কথাই আমি শুনবো না।আমি তোদের শাস্তি দিবো!'


আর ঠিক তখন এ বাড়ির বড় বউ নাজমা এসে উপস্থিত হলো সেখানে।সে এসে তার শাশুড়িকে শান্ত গলায় বললো,


--- 'মা, আপনি অস্থির হচ্ছেন কেন?রাগের মাথায় কিছু করবেন না। ওরা হয়তোবা শয়তানের ধোকায় পড়ে এমনটা করেছে। তাছাড়া মুহিব নতুন বিয়ে করেছে।বউ জানলে সর্বনাশ হবে!আর নীলার এমনিতেই শোকের সময়।সে হয়তোবা তৃণার বাবাকে ভুলতে পারছে না বলেই মুহিবের সাথে সময় পাস্ করে!আর‌ একবার ভুল করলে স্বয়ং আল্লাহ নিজেও মাফ করে দেন।আর আপনি তো মা। আপনি না হয় একবার ওদের মাফ করুন!'


নীলা তখন জোর গলায় বলে উঠলো,


--- 'তবে আপনিই সবকিছুর মূল হোতা! মাকে আপনি ভুলিয়ে বালিয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন!'


ময়মুনা বেগম নীলার এমন উদাত্ত ভঙ্গীতে কথা বলা দেখে রেগে গেলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে এক চড় বসিয়ে দিলেন নীলার গালে।পরিস্থিতি কেমন ঘোলাটে হচ্ছে।তৃণা বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে কাঁদছে।তার কান্না কেউ শুনছে না।মুহিব বিষয়টা সবাইকে বুঝাতে চাচ্ছে কিন্তু কেউ তা কানেও তুলছে না। কিন্তু মুহিব এতোক্ষণে সবকিছু বুঝে গিয়েছে। গতকাল এশাও বলেছিল,বড় ভাবী তাকে এসব বলেছে। তবে এই সবকিছুর মূল হোতা বড় ভাবীই!তার খুব খারাপ লাগছে।বড় ভাবীর বিয়ে হয়েছে তো কম দিন হয়নি।এক যুগেরও উপর।প্রায় চৌদ্দ বছর। এখনও সন্তান সন্তুতি হলো না। কোথায় সে তৃণার প্রতি মায়া দেখাবে। ওদের খোঁজ খবর নিবে।এসব না করে যে ওদের খোঁজ খবর নিতে এলো। সাহায্য করতে চাইলো।তার বিরুদ্ধেই কুৎসা রটিয়ে দিলো!মুহিব মনে মনে ঠিক করলো,এই মহিলাকে সে ভয়ানক শাস্তি দিবে!সত্যি সত্যি শাস্তি দিবে।

'

আর ওদিকে এশা তার ঘরে একা বসে আছে। বসে থেকে রাগে থরথর করে কাঁপছে।সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে না।বড় ভাবী তাকে বলে দিয়েছে,যায় হোক না কেন তুমি ঘর থেকে বের হবে না কিন্তু।যা করার আমি করবো!এই কথা বলে সে এসেছে ময়মুনা বেগমের কাছে। ময়মুনা বেগমের কাছে এসে সে বলেছে,মা আমার কথা তো আপনি বিশ্বাস করেনই না। এখন গিয়ে নিজের চোখে দেখে আসুন আপনার আদরের ছেলে আর বিধবা বউ ঘরের লাইট নিভিয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে কী সব করছে!কথাটা শুনে ময়মুনা বেগমের রাগ উঠে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এলেন নীলার ঘরের সামনে।আর এসেই দেখলেন বড় বউ নাজমার কথাই ঠিক!ঘরের লাইট বন্ধ।ভেতর থেকে দরজা বন্ধ!

'

ময়মুনা বেগম বললেন,


--- 'মুহিব এখন ঘরে যা!'


তৃণা কেঁদে উঠে বললো,


--- 'চাচ্চু, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যাও। তুমি চলে গেলে আমি কিছুতেই ঘুমাবো না!'


মুহিবের গা এমনিতেই রাগে কাঁপছে।সে তৃণার কথা শুনলো না।সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একবার শুধু নাজমার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকালো!নাজমা সেই দৃষ্টি ধরতে পারলো না কিছুতেই!মুহিব চলে যাওয়ার পর ময়মুনা বেগম নীলাকে বললেন,


--- 'আগামীকাল সকালে সূর্য উঠার সাথে সাথেই তুমি ব্যাগ পুঁটলি নিয়া বাপের বাড়ি চইলা যাইবা।বুঝছো?'


নীলা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,


--- 'মা,আমি কী করেছি বলুন? আমার অপরাধ কী?'

ময়মুনা বেগম রাগত স্বরে বলেন,

--- 'নির্লজ্জ্বের মতো কথা বলবা না কইলাম! তোমার মতো আমি খারাপ মহিলা না। আমার মুখ দিয়া এইসব কথা বাইর হইবো না। তুমি কাল চইলা যাইবা এইটাই ফাইনাল কথা!'


--- 'মা, আমার তো এখনও ইদ্দত পূরণ হয়নি! তাছাড়া আরেকটা বিষয় আছে। এখনও নিশ্চিত নয় বলে আমি কাউকে জানাইনি কিছু!'


ময়মুনা বেগম কথাটা শুনলেন না। তিনি বললেন,

--- 'তোমার আবার ইদ্দত ফিদ্দত কী?স্বামী মরার শোক কী দেবরের সাথে শুইয়া শুইয়া মাইনষে পালন করে?'


নীলা কাঁদতে লাগলো আবার। কেঁদে কেঁদে সে বুঝাতে চাইলো বিষয়টা তিনি যা ভাবছেন তা না। কিন্তু ময়মুনা বেগম শুনছেন না।ইদ্দত পালন করা এখন মূখ্য না। কিন্তু আরেকটা বিষয় যাতে তার সন্দেহ।বিষয়টা যদি সত্যি হয় তবেই ভীষণ ভয়ের।তার শাশুড়ি কিছুতেই এই কথা বিশ্বাস করবেন না! নীলা সেই ভয়ে কঁকিয়ে উঠলো আরো একবার!

'

(৩)

নীলাকে আজ চলে যেতে হবে।তার কথা কেউ শুনছে না। উল্টো বকাঝকা করছে সবাই। নীলা মেয়েটা সরল। একেবারেই সরল।মুহিবকে সে ভাইয়ের মতো দেখতো। নিজের ছোট্ট ভাইয়ের মতো। এই জন্যই তো মেয়ের আবদার মিটাতে দরজা বন্ধ কিম্বা লাইট নিভিয়ে রাখতে সে তেমন একটা অস্বস্তি বোধ করেনি! তাছাড়া একটা বাড়িতে যখন অসহায় একজন মেয়ে কারোর অনুগ্রহ পায় তখন তাকেই আপন মনে করে।মুহিবকেও তার তেমন মনে হয়েছিল।এটাই ভুল।বিরাট ভুল! নীলা বুঝতে পারেনি সে ভুল কিছু করছে।

'

নীলা এখনও শিউ্যর না ওই বিষয়ে। তবে বেশিরভাগ লক্ষণ দেখা দিয়েছে। কিন্তু এখন তার আর আনন্দ কিংবা উৎসাহ নেই এই বিষয়ে। আগে পরীক্ষা করে দেখেনি এই জন্য যে তৃণার বাবার মৃত্যুর শোকটাই ভুলতে পারছিলো না। তখন এসব মাথায় অত খেলেনি!

আর এখন তো বিপদেই পড়ে গেছে।এ তো সাধারণ কোন বিপদ নয়।মস্ত বিপদ!তার মন বারবার বলছে, আল্লাহ, এমন কিছু না হোক।হলে সর্বনাশ হবে।ওরা কিছুতেই তাকে বিশ্বাস করবে না। এবং সে আপাতত বলতেও পারবে না কিছু!


তারপর নীলা ভাবলো বাড়ির কথা। এখানে তো তাকে থাকতে দিবেই না।আচ্ছা সে যদি আজ বাড়ি ফিরে যায় তখন কেমন হবে ব্যপারটা!বাবা মা বেঁচে থাকলে তাদের কাছে আশ্রয় নেয়া যেতো!মা তো সন্তানের বিষয়ে সবজান্তা। কিছু না বললেও মুখ দেখেই ঠিক বুঝে ফেলতো! কিন্তু এখন কে বুঝবে তাকে!ভাই আর ভাবীরা তাদের নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত, তটস্থ।তারা কী সহজে উটকো ঝামেলা ঘাড়ে বয়ে নিতে রাজি হবে!নিলেও যখন ওদের কানে এসব মিথ্যে রটানো খবর গিয়ে পৌঁছাবে তখন তারা বুঝতে পারবে তো তাকে?নাকি মুহিবের মা মুহিবকে যেভাবে ভুল বুঝেছে ঠিক সেভাবেই তার ভাই আর ভাবীরা তাকেও ভুল বুঝবে!

'

নীলার সাথে এশার দেখা হয়ে গেল হুট করে। নীলা রান্নাঘরে ঢুকেছিল তৃণার জন্য দুধ গরম করে আনতে।এশা ওখানেই ছিল। নীলাকে দেখেই সে রাগী রাগী গলায় বললো,


--- 'আপনাকে আমি খুব ভালো মানুষ ভাবতাম।তৃণার আব্বু মারা গেছেন এই জন্য আপনাকে দেখে আমার মায়া হতো! কিন্তু এখন আপনাকে দেখলে আমার ঘেন্না হয়।বমি পায়। ইচ্ছে করে আপনার গায়ে বমি করে ফেলি!'


কথাগুলো বলতে বলতে এশা কাঁপতে লাগলো রাগে।এটাই স্বাভাবিক। একটা মেয়ে কখনো তার প্রেমিক অথবা স্বামীর অন্য কোন প্রেমিকাকে সহ্য করবে না। নীলা তো তার চোখে এমনই। তাছাড়া ওরা দরজা জানালা বন্ধ এমনকি ঘরের লাইট নিভন্ত অবস্থায় একসাথে ধরা পড়েছে!সে আর যায় করুক নীলাকে ক্ষমা করতে পারে না। নীলার জন্যই মুহিব তার কাছে ঘেঁষছে না।কাল রাত থেকেই মুহিব ঘরে ফিরছে না। মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছে।


নীলা কিছু বলতে পারলো না। শুধু এশার দিকে জল ছলছল চোখে তাকালো একবার।তার বুকটা কেমন ছিঁড়ে যাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে খুব।এশার সাথে যেহেতু মুহিবের প্রেমের সম্পর্ক ছিল অনেক আগে থেকেই তাই নীলার পরিচয়ও ছিল আগে থেকেই।দেখাও হয়েছে ক'বার। নীলার কোন বোন নাই।ভাই আছে দুজন। দু'জনই বড়। এশাকে সে বোন মনে করতো। ছোট বোন।এশা এমন করে তাকে কথাগুলো বলতে পারলো!


নীলা তাড়াতাড়ি দুধ গরম করে ভুলে চুলো বন্ধ না করেই রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছিল। পেছন থেকে এশা বললো,


--- 'চুলোটা অফ করবে কে আপনার?মুহিব এসে অফ করে দিয়ে যাবে?না মানে আপনি তো আবার ওকে দিয়েই সব করান। মেয়েকে ঘুম পাড়ানো, নিজেকে ঘুম পাড়ানো-------


নীলা দাঁতে দাঁত চেপে এসে চুলোটা বন্ধ করেই জোরে জোরে পা চালিয়ে ঘরের দিকে চলে গেল।ঘরে গিয়ে রাগ মিটালো মেয়ের সাথে।তৃণা কী যেন একটা বলেছিল যাতে রাগ করার কোন কারণ নাই। কিন্তু সে ভীষণ রেগে গেলো।রেগে গিয়ে এমন জুড়ে ওর গালে দুটো চড় বসিয়ে দিলো যে তৃণা গগণবিদারী চিৎকার শুরু করলো।ওর কান্নার শব্দ শুনে জলদি পায়ে এগিয়ে এলেন ময়মুনা বেগম।যে মহিলা ছেলে মরার পর নাতিনের খোঁজ পর্যন্ত রাখেননি। তিনি এসে নাতিনকে কাছে টেনে নিতে নিতে বললেন,


--- 'এরে মারলা কেনো? আমাদের কিছু করতে না পাইরা মেয়ের উপর উসল তুলতাছো!'


নীলার আর সহ্য হচ্ছে না।সে মুখ ফসকে বলে ফেললো,


--- 'আমার মেয়েকে আমি একশো বার মারবো এতে আপনার কী?'


ময়মুনা বেগম নীলার এমন উদ্ধত গলার কথা শুনে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। রাগে হাঁসফাঁস করতে করতে তিনি নীলাকে বললেন,


--- 'তুই এক্ষণ আমার ঘর থাইকা বের হ।এক মিনিটের ভিতরে বের হইয়া যা!'


নীলা কী করবে না করবে কিছু বুঝতে পারছে না।তৃণার প্রতি তার দাদি সহানুভূতি দেখিয়েছে।এতে তৃণার উচিৎ দাদির পক্ষে যাওয়া।আর ছোট বাচ্চারা এমনই হয় অনেকটা। কিন্তু তৃণা তার দাদির কাছে গেল না। সে তার মায়ের আঁচল টেনে ধরে কাঁদতে লাগলো!

'

নাজমা এসেছে চুপিচুপি এশার সাথে দেখা করতে।এশা বললো,


--- 'ভাবী,আমি আজ তৃণার মাকে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছি।'


নাজমা চকচকে চোখে এশার দিকে তাকিয়ে বললো,


--- 'কেমনে কী করছো?'


এশা মৃদু হেসে বললো,


--- 'কাটা কাটা কথা বলছি।বলছি,মুহিব তো আপনার মেয়েরে ঘুম পাড়িয়ে দেয় সাথে আপনারেও।আর নানান সেবা যত্নও করে!'


নাজমা ঠোঁট টিপে টিপে হাসছে। এবার সে ফিসফিস করে বললো,


--- 'শুনো,মা যেমন চড়া মানুষ এমন পড়াও।যেমন আগুন তেমন ঠান্ডাও। এখন রাগের মুডে আছে তাই নীলাকে তাড়াতে চাইছে।রাগ মিটে গেলে সব শেষ। নীলাকে আর তিনি তাড়াবেন না।নিজেই একটু শাসিয়ে রেখে দিবেন।'


--- এশা বললো,'তাহলে এখন কী করা?'


--- নাজমা বললো,'টেনশন কইরো না। তুমি আমার ছোট বোন। তোমার শান্তির জন্য আমি সব করতে পারি। তুমি একটা কাজ করবা শুধু।মুহিব বাসায় ফিরলে মুহিবকে বলবা, তুমি তাকে ডিভোর্স দিবে।বুঝছো?'


--- এশা বললো,'বুঝেছি।'


নাজমা ঠোঁট টিপে হেসে এশার মাথায় একবার আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেল।

এশা আবার দুটানায় পড়ে গেছে।সে বড় ভাবীর হাবভাব কিছু বুঝতে পারছে না।তার ব্যাপারে তিনি এসে অত নাক গলাচ্ছেন কেন?তাছাড়া মুহিবকে ডিভোর্স দিবে এই কথা সে বলবে কেন?ডিভোর্স ছাড়া কী তাকে স্বতর্ক করার মতো অন্য কোন শব্দ বাক্য নাই!

'

তোমার আমারবসংসারে

৩য় এবং শেষ পর্ব

অনন্য শফিক

'

'

'

বিকেল বেলা নাজমা খানম তার স্বামীর হাতে পিটুনি খেলো।মুহিবের বড় ভাইয়ের নাম ফররুখ। ফররুখ অফিস থেকে এমনিতে লাঞ্চের সময় ফিরে না। কিন্তু আজ হুট করে নাজমাকে না জানিয়েই বাসায় ফিরেছে। বাসায় ফিরেই দেখে দরজার ও পাশে এশার সাথে ফিসফিস করে কথা বলছে নাজমা। নাজমা বলছে,


--- 'তুমি কী ডিভোর্সের কথা বলেছো মুহিবকে?'


এশা বিব্রত বোধ করে বললো,


--- 'মুহিব এখনও বাসায় ফিরেনি। আমার সাথে ওর দেখা হয়নি।আমি ভাবছি ওর সাথে যেভাবেই হোক দেখা করবো।ভাবী, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে মুহিব আর মেজো ভাবীকে নিয়ে আমরা যা ভাবছি বিষয়টা ঠিক তা না। তাছাড়া মুহিবকে তো আমি ভালো করে চিনি!'


নাজমা হাসলেন। হেসে বললেন,


--- 'অন্ধ প্রেম! স্বামীর প্রতি এমন অন্ধ প্রেম থাকা উচিৎ নয়। আচ্ছা তুমি যখন অতই বিশ্বাস করো মুহিবকে তবে বলো তোমার সাথে বাসর ঘরে না থেকে ও নীলার ঘরে রাত তিনটা পর্যন্ত কী করে?আর ওদের ঘরে দরজা জানালা লাইট সবকিছু বন্ধ থাকে কেন?'


এশা তখন বললো,


--- 'ভাবী আমার মন কেমন অন্য রকম সায় দিচ্ছে।আমি মুহিবের সাথে আলাদা ভাবে কথা বলবো! তারপর ভেবে দেখবো কী করা যায়!'


বলে এশা চলে যাবে তখন পেছন থেকে নাজমা বললো,


--- 'দাঁড়াও।একটা কথা শুনো।মুহিব যখন অতই ভালো তবে এখন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কেন? বাসায় আসছে না কেন?নাকি চোর ধরা পড়ে যাবে!'


এশা এই কথার কোন উত্তর দিলো না।সে ঝটপট বেরিয়ে চলে গেল।তখন ফররুখ খুব সাবধানে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে এমন ভাবে দাঁড়ায় যেন এশা তাকে একটুও দেখতে না পায়!এশা চলে যাওয়ার পর ফররুখ ঘরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করলো। নাজমা হাসি হাসি মুখ করে কিছু একটা বলতে চাইছিলো কিন্তু এর আগেই ফররুখ এক চড়ে নাজমাকে ফ্লোরের উপর ফেলে দেয়। তারপর আবার ওর একটা হাতের বাহু ধরে ওকে টেনে তুলে বললো,


--- 'ওদের নিয়ে খেলছিস কেন বল?তোর এতে লাভ কী?'


নাজমা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলছে না। শুধু রাগে কাঁপছে।তার চোখ অসম্ভব রকম লাল।যেন সে এক্ষুনি ফররুখের উপর ঝাপিয়ে পড়বে।ফররুখ নাজমার গালে আরেকটা শক্ত চড় বসিয়ে দিলো। নাজমা একেবারে কেঁপে উঠেছে। তারপর কাঁদতে শুরু করেছে।ওর কান্না শুনে দরজার সামনে দৌড়ে এলেন ময়মুনা বেগম। পেছন পেছন নীলা,এশা এবং ছোট্ট তৃণাও।মুহিব বাসায় নেই।কাল থেকেই বাসায় আসে না।ও থাকলে মনে হয় সেও এখন দরজার সামনে আসতো!ময়মুনা বেগম বাইরে থেকে দরজায় টোকা দিতে লাগলেন।আর অস্থির হয়ে বলতে লাগলেন,


--- 'কী হয়ছে বউ?কী হয়ছে?'


নাজমা কথা বলছে না।আরো শব্দ করে কান্না শুরু করেছে। ভেতর থেকে এবার কথা বললো ফররুখ।সে বললো,


--- 'মা এখন ডিস্টার্ব করো না তো। ওকে একটু শায়েস্তা করতে দাও!'


ময়মুনা বেগম রেগে গিয়ে বললেন,


--- 'দরজা খোল বলছি। কিসের শায়েস্তা করবি তুই?'


ফররুখ দরজা না খুলেই নাজমার গালে আরেকটা শক্ত চড় বসিয়ে দিলো। তারপর ওর হাতে শক্ত করে নাড়া দিয়ে বললো,


--- 'উত্তর দে।কেন এমন করেছিস তুই?'


নাজমা কেঁদে কেঁদে কী যেন বলছিলো।ঠিক এই সময় দরজাটা খুলে দিলো ফররুখ। দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকলো সবাই। ময়মুনা বেগম তাড়াতাড়ি করে নাজমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো।তখন মাকে বাঁধা দিলো ফররুখ।বললো,


--- 'এই পাপীকে ছুঁবে না খবরদার!'


ময়মুনা বেগম অবাক হয়ে বললেন,


--- 'এসব কী বলছিস তুই?'

--- 'যা বলছি তার একটুও ভুল নয়। এখন ওর নিজের মুখ থেকেই শুনো ও কী কী পাপ করেছে!'


নাজমা তখন কান্নাভেজা গলায় বললো,


--- 'মা আমি কিছু করতে জানি না। আমার কোন অপরাধ নাই। আপনার ছেলে শুধু শুধু আমায় মারছে!'


ফররুখ সঙ্গে সঙ্গে নাজমাকে একটানে বারান্দায় নিয়ে গেল। তারপর ধমক দিয়ে বললো,


--- 'আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা এক্ষুনি। তোকে অনেক সহ্য করেছি।আর না। তোকে আমি ডিভোর্স দিবো!'


ময়মুনা বেগম কিছুই বুঝতে পারছেন না।কী এমন ঘটলো যার জন্য ফররুখ অত রাগ দেখাচ্ছে!

নাজমা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।সে আবার কাঁদছে।ফররুখ বললো,


--- 'আগামীকাল ডিভোর্স পেপার পেয়ে যাবি।আজ মুখে বলে দিবো। তালাক---


নাজমা দৌড়ে এসে ফররুখের মুখ চেপে ধরে ফেলেছে। ফররুখ এক ধাক্কা দিয়ে নাজমাকে দূরে সরিয়ে ফেলে আবার বললো ,


--- 'তালাক।'


নাজমা গগণবিদারী চিৎকার করে উঠে বললো,


--- 'আমি সব বলছি। তুমি দয়া করে আরেকবার তালাক বলবে না। আল্লার দোহাই লাগে!'


ফররুখ নিজেকে শান্ত করলো। দুইবার তালাক বলে থেমে গেল।নাজমা এবার একে একে সব বলতে লাগলো।সে বললো,


--- 'আমিই সব দোষের দোষী।তৃণার বাবা মরার পর থেকেই মার চোখে সব সময় নীলাকে দোষী হিসেবে উপস্থাপন করতাম। এমনকি তৃণাকেও তার দাদির আদর থেকে বঞ্ছিত করেছি। তাছাড়া আমি এটা জানতাম যে তৃণা মুহিবকে ছাড়া ঘুমোয় না। জানার পরেও মার কাছে কথাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছি।আর এশার কাছেও আমি উল্টাপাল্টা কথা বলেছি।'


ফররুখ রেগে গিয়ে নাজমার ঘাড়ে শক্ত করে চেপে ধরে বললো,


--- 'কেন এইগুলো করেছিস বল?'

নাজমা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

--- 'ওদের সরাতে। আমার কোন সন্তান নাই এই জন্য আমার ভয় ছিল।আমি ভেবেছিলাম নীলার তো এক মেয়ে আছে।আর মুহিবের যদি সন্তান হয় তখন যদি ওরা সবকিছু ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে যায়।আমরা কিছু না পাই!'


ময়মুনা বেগম চোখ কপালে তুলে ফেললেন। বললেন,


--- 'বউমা তুমি এতো নীচ!'


ফররুখ তখন বললো,


--- 'শুধু সে একা না। আমরা প্রত্যেকেই ওর চেয়ে কম নীচ নয়। তুমি আমি আমরাও!'


ময়মুনা বেগম অবাক হওয়া গলায় বললেন,


--- 'আমরাও মানে?'


ফররুখ বললো,


--- 'হ্যাঁ আমরাও।আমরা প্রত্যেকেই। এই যে শিহাব (তৃণার বাবা)মারা গেলো। এরপর থেকে তুমি আমি ক'বার তৃণার খবর নিয়েছি!তৃণাকে কোলে টেনে নিয়ে আদর সোহাগ করেছি!শুনেছি ওর আহ্লাদ আবদার? কিংবা নীলার? নীলার সুবিধা অসুবিধা, প্রয়োজন কিছু জানতে চেয়েছি?'


ময়মুনা চুপ করে আছেন। তিনি নিজেও এখানে ধরা। তিনি হঠাৎ নিজেকেই চিনতে পারছেন না। কেন এমন দায়িত্ব জ্ঞানহীন হয়ে পড়লেন তিনি? নিজের মৃত ছেলের বউ, নিজের রক্তের একমাত্র নাতীন, এদের কেন শুধু শুধু এতো দিন তিনি দূরে দূরে সরিয়ে রেখেছেন?


ময়মুনা বেগমের কান্না পাচ্ছে। তিনি তৃণাকে কাছে টানতে চাইলেন। কিন্তু তৃণা কাছে আসছে না। ছোট বাচ্চারা এমনই হয়।এরা আদর না পেলে কারোর কাছে যেতে চায় না। বাবার কাছেও না।

ময়মুনা বেগম তবুও জোর করে তৃণাকে কোলে টেনে নিলেন।ওর গালে কপালে চুমু খেলেন। তারপর বললেন,


--- 'আর তোমারে দূরে রাখুম না বুবু। এখন থাইকা তোমারে আমি নিজে ঘুম পাড়াইয়া দিবো!'


তৃণা সঙ্গে সঙ্গে বললো,


--- 'আমি তোমার সাথে ঘুমাতে যাবো না।আমি ছোট চাচ্চুর সাথে ঘুমাবো।'


ময়মুনা বেগম বললেন,


--- 'আচ্ছা ঠিক আছে। ছোট চাচ্চুর সাথেই ঘুমাবে।'


তৃণা কী মনে করে যেন খিলখিল করে হেসে উঠলো।এইবার ফররুখ নীলার দিকে তাকালেন। তারপর মায়াময় গলায় বললেন,


--- 'বোন, তুমি আমাদের ক্ষমা করে দিও। তোমার সাথে অনেক অন্যায় হয়েছে।আমরা তোমার খবরাখবর নেইনি। প্রয়োজন মিটাইনি।এটা আমাদের বিরাট বড় অন্যায়!'


নীলা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,


--- 'ভাইয়া, এমন করে বলবেন না। আপনারাই তো আমার আপনজন। আমার গুরুজন। আপনাদের আদর সোহাগ শাসন বারণ নিয়েই আমি বেঁচে থাকতে চাই!'


ফররুখ এবার বললো,


--- 'নীলা তোমাদেরও ছোট্ট একটা ভুল আছে। তোমার আর মুহিবের।তোমরা তো বড়।বড়দের অত অসেচেতন হলে চলে না। তুমি জানো মুহিবকে তুমি ভাইয়ের মতো দেখো।মুহিব জানে সে তোমায় বোনের মতো দেখে। কিন্তু আমাদের সমাজ।সমাজ তো শুধু সুযোগ খুঁজে। আমাদের সমাজটা যে ভালো না বোন। আমাদের সমাজ কখনোই কাউকে নিয়ে ভালো কিছু ভাবতে পারে না। এদের কাজ হলো সব সময় মানুষকে নিয়ে কুৎসা রটানো। খারাপ কিছু আন্দাজ করা।'


নীলা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,


--- 'এমন কিছু আর হবে না ভাইয়া!'


ফররুখ বললো,


--- 'ঠিক আছে।আর তৃণা এখন থেকে এশা আর মুহিবের সাথে থাকবে।আর তোমার সাথে থাকবে মা। ইচ্ছে করলে তুমি একাও থাকতে পারো! মোটকথা, তোমার যেভাবে থাকতে ইচ্ছে করে সেভাবেই থাকো।'

--- নীলা বললো,'আচ্ছা ভাইয়া।'

'

নাজমাকে নিয়ে কিছুতেই সংসার করবে না ফররুখ।তালাক দেয়া হয়নি। দুইবার তালাক বললে তালাক হয় না। তিনবার বলতে হয়। তবে সে নাজমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।নাজমা বারান্দায় মন খারাপ করে বসে আছে।সে কাঁদছে। এবার তার জন্মের শিক্ষা হয়েছে।মনে মনে ঠিক করেছে এমন জঘন্য ভুল আর সে করবে না!


ময়মুনা বেগম নাজমাকে বসে থেকে কাঁদতে দেখে তার কাছে এলেন। এসে পাশে বসে বললেন,


--- 'বউমা, তুমি অতটা নীচু কাজ করবে তা আমি ভাবতেও পারিনি! তোমার নিজের কোন সন্তান নাই।এতো বছরের সংসার। কীভাবে এমন কিছু করলে তুমি? তোমার তো উচিৎ ছিল তৃণাকে কাছে টেনে নেয়া। নিজের সন্তানের মতো আদর করা!'


নাজমা কেঁদে কেঁদে বললো,


--- 'এখন থেকে ওকে নিজের মেয়ের মতোই দেখবো!'


ময়মুনা বেগম বললেন,


--- 'তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছো। এখন আর সম্ভব না। ফররুখ তোমারে রাখবো না বলছে!'


নাজমা তার শাশুড়ির পায়ে পড়ে গেছে।সে পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,


--- 'মা আমি ভালো হয়ে যাবো। আমার ভুল হয়ে গেছে।অন্যায় করেছি আমি।আর কখনোই এমন করবো না।আমায় শুধু একবার ক্ষমা করুন।অত বড় শাস্তি আমায় দিয়েন না মা!'


ময়মুনা বেগম খানিক সময় চুপ করে রইলেন। নাজমা কাঁদতে কাঁদতে বারবার একটা কথাই বলছে,


--- 'আমি আর কখনো এমন জঘন্য কাজ করবো না।আপনারা আমায় এ বাড়ি থেকে বের করে না দিয়ে যে শাস্তি দেন তাই মাথা পেতে নিবো!'


ময়মুনা বেগম এবার নাজমাকে বললেন,


--- 'বউমা, ছেলের মাথা এখন গরম। তোমার এখানে থাকা উচিৎ হবে না।তোমায় দেখলে রাগে ও আরেকবার তালাক বলে দিবে। তখন সর্বনাশ হবে!তালাক প্রাপ্তা হয়ে যাইবা তুমি। এরচেয়ে এটাই ভালো হবে যে তুমি দু তিন মাস বাবার বাড়ি গিয়ে থাকো।রাগ পড়লে ফররুখ নিজে গিয়েই তোমায় নিয়ে আসবে!'


নাজমা জানে তার এভাবে চলে যেতে কষ্ট হবে। কিন্তু এছাড়া তো তার আর কোন উপায়ও নাই!

'

মুহিব ফিরেছে রাতের বেলায়। তাকে কেমন উদভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে।মুখটা ফ্যাকাসে।চুল বিবর্ণ এবং এলোমেলো।এশা দ্রুত গিয়ে মুহিবের একটা হাত খপ করে ধরে ফেললো। তারপর ভেজা গলায় বললো,


--- 'মুহিব আমি সরি!আর কখনো এমন হবে না!'


মুহিব তখন গমগমে গলায় বললো,


--- 'আর কারোর কিছু মনে করায় আমার কষ্ট হয়নি। শুধু কষ্ট হয়েছে তোমার মনে করায়। তুমি তো আমায় আগে থেকে জানো চিনো এবং বিশ্বাস করো। তবে তুমিও কেন আমার সাথে এমন করলে?অবিশ্বাস করলে আমায়?'


এশা কেঁদেই ফেললো তখন। কাঁদতে কাঁদতে সে মুহিবের বুকের সাথে নিজেকে লেপ্টে নিলো। তারপর ওর বুকে মাথা গুঁজে দিতে দিতে বললো,


--- 'আর কখনো এমন হবে না। এই প্রথম এই শেষ।'


মুহিব ওকে শক্ত করে বুকের সাথে মিশিয়ে ধরলো। তারপর চুপিচুপি ওকে বললো,'


--- আর কখনো অবিশ্বাস করলে একেবারে মেরে ফেলবো!'


এশা কথা বললো না।সে মুহিবের পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে মুহিবের কপালে একটা চুমু খেলো।

'

                       ___সমাপ্ত___


তারা পর্বের গল্প পড়তে চান তাদের জন্য নিচে লিঙ্ক দেওয়া হয়েছে।


এমন আরও অনেক গল্প পড়ুন।