স্বামীর সংসার | এই ঘর এই সংসার

 সংসার এর সন্ধি বিচ্ছেদ

সংসার এর সন্ধি বিচ্ছেদ

শ্বশুরবাড়ির সকল লোকজন যখন আমার গুণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখনি আমি সেই বাড়ি ছেড়ে চিরদিনের জন্য বাবার বাড়ি চলে আসলাম।  

এসে নিজের চলার জন্য একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিম্ন বেতনের চাকরি নিলাম। নিজের ভাইদেরই একটা ঘর ভাড়ায় নিয়েছি, যেন অধীনস্থ হয়ে অন্য ভাইদের মতো নিজের ভাইকেও স্বার্থপরের তালিকায় দেখতে না হয়। অবশ্য তারা মানা করছিলো খুব, আবার ওরা অভিযোগও করছিলো বিনা কারণে কেন স্বামীর সংসার ছেড়ে দিলাম!?

মা নেই আমার, মাকে ছাড়া আমার বাবা নিজেই এই বাড়িতে অসহায়ের মতো জীবন কাটায়। সেখানে আমি কি করে বাড়তি বোঝা হই? এমনিতেও আর কারো অধিন হতে চাইনা আমি,ঢের হয়েছে!


স্বামীর সংসারে দীর্ঘ ৫ বছরের অবদান ছিলো আমার। বিয়েটাও আমার নিজের পছন্দে ছিলো। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি বিয়ের পরে আমার অতি চেনা মানুষটার রূপ বদলে যেতে দেখবো, যখন কিনা তার কাছে আমার মূল্য হয়ে উঠবে চাকরের মতো। 


বিয়ের পরদিন থেকে আমার স্বামীকে দেখেছি একপাক্ষিকভাবে পরিবারের সবাইকে সাপোর্ট করতে, শুধু আমাকে ছাড়া। ওর কাছে আমার কোনো মূল্য ছিলোনা। ওর দুটো বোন ছিলো, যাদেরকে আমি যথাসাধ্য সম্মান করতাম, সব প্রয়োজনেই তাদের অন্যতম হাতিয়ার হতাম।


কিন্তু তবুও নাকি তারা তাদের ভাইয়ের কাছে আমাকে নিয়ে নানান অভিযোগ করতো, বোধহয় আমার স্বামী তাদের এসবকে অনেক প্রশ্রয় দিতো আর তাই সত্য মিথ্যা মিলিয়ে বলার সুযোগ পেতো। 

যার প্রভাব বিয়ের তিনমাসেই পড়েছিলো, আর সে তখনি আমার গায়ে প্রথম হাত তুলেছিলো। 

বেশি কিছু না, সামান্য একটা পোশাক নিয়ে ছোট্ট তর্কের সূত্র আমাকে একটা চেনা মানুষের বজ্জাৎ রূপ দেখিয়েছিলো। যেখানে আমি সম্পূর্ণই নির্দোষ ছিলাম, কিন্তু আমার স্বামী একবারও আমার কথা শুনেনি। কিন্তু আমি শুনেছিলাম বিশ্রীরকম তুইতোকারি সম্বোধন আর গালি! 


এরপর সামান্য কিছু হলেই সে গায়ে হাত তুলতো, পুরো ঘটনা বলতে চাইলে মুখে মুখে তর্কের অপরাধে আরো বেশি ক্ষিপ্ত হতো, আর তার খারাপভাবে গালিগালাজ করতো। 


তারপরও আমি সব সহ্য করে শ্বশুরবাড়ির সবার মনমতো হতে উঠে পড়ে লাগলাম। কেউ ভুল করলেও এড়িয়ে যেতাম, আমাকে অন্যায়ভাবে বকলেও না শোনার ভাব করে থাকতাম। আমার শাশুড়ী কয়েক বছর পর্যন্ত আমার সাথে কারণে অকারণে লেগে লাগতো৷ কিন্তু আমার বিয়ের তিন বছরের মাথায় আমার শাশুড়ী গোসলখানায় পা পিছলে পড়ে কোমড় ভেঙে ফেলেন, তারপর শয্যাশায়ী হয়ে যান, সাথে আরো বিভিন্ন রোগের মিশ্রণও দেখা দিচ্ছিলো। তখন আমি ছাড়া উনার আর গতি ছিলোনা, ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সর্বদা উনার সেবায় প্রস্তুত থাকতাম। 


ততদিনে আমার দুজন ননদের মধ্যে একজনের বিয়ে হয়ে গেলো, আরেকজন বাকি রইলো। একজন চলে যাওয়া আবার মায়ের করুণ অবস্থার পর সেও আমার ত্রুটি খোঁজা বন্ধ করে দিলো। 

 অতঃপর আমার উপর সকলের নির্ভরতা এসে জড়ো হলো, কমে গেলো যাবতীয় অভিযোগ। এখন যা হয় তা শুধুই প্রশংসা! 


শুধু একজন আগের মতোই, আমার স্বামী। বোধহয় বিয়ের পর থেকে আমার উপর যাচ্ছেতাই ব্যবহার করতে করতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, এখন ভালো ব্যবহার করতে তার গায়ে লাগে,কিংবা আত্মসম্মানে । তার উপর আমার এখনো কোনো সন্তান হয়নি। এ নিয়ে তো দোষারূপ আছেই। 

 

চার বছরের মাথায় আমার ছোট ননদেরও বিয়ে হলো আর আমার শাশুড়ী পঞ্চম বছরে পরলোক গমন করেন, তবে এলাকার সবার কাছে বুক হাত চাপড়ে বলে গেছেন, আমার বিরাট কপাল,আমি একটা বউ পাইছিলাম যে আমার দেখা সাক্ষাৎ মহয়সী । 


মানুষটা চলে গেলো, যত যাই হোক সবশেষ যেন আমি পুরো অসহায় গেলাম। কেন জানি স্বামীর উপরেও এতদিনে আমার একটা বিতৃষ্ণা চলে আসছে। মায়া মহব্বত, একসাথে থাকার লোভ আর আমাকে তাড়া করেনা, আমার মনে হয় এভাবে অন্তত সংসার করা যায়না। এতো ধৈর্য্যের মধ্যে থেকে এতো মানুষ সামলে একটা মানুষের সামনে কেমন যেন অধৈর্যশীল হয়ে গেলাম! শুধু মনে হচ্ছিলো ওকে ছাড়াই আমি ভালো থাকবো। 


ছেড়ে দিলাম আমি, সব ছেড়ে চলে আসলাম। আসার সময় অবশ্য সে জানতোনা আমার এই আসাটাই শেষ আসা। আমি যখন বলছিলাম বাড়ি আসবো, সে তখন মাথা নাড়িয়ে বলছিলো, অওও যাও। 


আমি একদম কান্না করিনি, কোনো কান্না পায়নি আমার। আমি হাসতে হাসতে ঘর ছেড়ে চলে আসছি। ঘর থেকে বের হয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়েছি। মনে হয়েছিল আমি এবার জীবন্ত!

আসলে আমরা কিছু মানুষ দুনিয়ার সবার অবহেলা, ঘৃণা, দুঃখ যন্ত্রণাকে সয়ে যেতে পারলেও প্রিয় মানুষটার অবহেলাকে একদম কলিজায় গেঁথে রাখি। আর একদিন, একমাস,এক বছর এভাবে যখন আরো কয়েকবছর চলে যায় তখন কীভাবে যে সে প্রিয় থেকে আমাদের অপ্রিয় হয়ে যায় আমরা নিজেরাও জানিনা৷ 


আমার ডিভোর্স পেপার পেয়ে নাকি আমার স্বামী আমার বাবার মোবাইলে ফোন দিয়ে জানতে চেয়েছিলো এতো সুন্দর সানন্দে সংসার করার মধ্যে হঠাৎ কি এমন হলো যে তাকে কিছু না বলে একদম জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলাম!? সংসার ছেড়ে আসার মতো এমন কি হয়েছিলো? 


শুনে আমি মুচকি হাসছিলাম আর বিরবির করে বলছিলাম, কিছু হয়নি বুঝি? তাহলে গত ৫ টা বছর আমার এই কোমল হৃদয়টা কীভাবে এমন পাথরে রূপান্তর হয়েছে? 

তুমি ছেড়ে আসার কারণ পাচ্ছোনা?

কারণ বউয়ের বাহ্যিকটা সুন্দর দেখছো বলে ভেবে নিয়েছো সে দিব্যি আছে, আর এভাবেই থেকে যাবে?

আরে সে তো একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে গেছি কবেই, সে এতদিন ধরে সব মেনেও প্রস্তুতি নিচ্ছে এই দমবন্ধ জীবন থেকে মুক্তির জন্য। প্রথম যখন অত্যাচারিত হয়েছিলো তখন সে চাইলেই পারতোনা তোমাকে ছেড়ে দিতে, কারণ তখন তার বুকে তোমার জন্য অগাধ মায়া ছিলো, যে মায়া এতটাই কঠিন, যা ছেড়ে দিলে সে তখনি প্রাণ হারাতো। 


কিন্তু তারপর! তারপর কি হলো? আস্তে আস্তে সে তোমার সব সহ্য করে করে সব কাটিয়ে নিলো! এখন তোমার নাম শুনলে তার ভেতরে মন্দ নেহাৎ কোনো ভালো অনূভুতি আসেনা। তাহলে এই তিক্ত সম্পর্ক ছেড়ে মুক্তিলাভটাই উত্তম নয় কি?


গল্পঃ মুক্তি 

লেখাঃ তাজরীন খন্দকার


বাস্তব জীবনের ঘটনা ও গল্প পড়ুন এখানে ক্লিক করে।


ছন্দ পিকচার ডাউনলোড করুন।