পৃথিবীর সব বাবা এক নয় | বাবার মৃত্যু নিয়ে স্ট্যাটাস

বাবাকে নিয়ে স্ট্যাটাস

বাবাকে নিয়ে স্ট্যাটাস

আমার বাবার শরীরবোধের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিলো, যা বাবার লজ্জাবোধকে খেয়ে ফেলেছিলো। আমরা বাবার তিনটি সন্তান, আমাদের অত্যন্ত বাধ্যগত মা থাকার পরও বাবা এমনসব কাজ করতো যা আমাদের বেঁচে থাকাকে নরক করে তুলেছিলো।


কিছুদিন পরপর খবর আসতো বাবাকে অমুক এলাকার একটা ঘরে আটকে রাখা হয়েছে।

মারধর করা হচ্ছে। যে মহিলার সাথে ধরা হয়েছে বাবাকে, তার সাথে নাকি বিয়ে দিয়ে দেয়া হবে।

মা কাঁদতো আর বলতো, ও মোতালেব তোর বাবাকে ছাড়িয়ে আন।


আমি আর ময়না মায়ের কান্নাকে গুরুত্ব দিতাম না। আমাদের ছোটোভাই হারুন বাবাকে আনতে যেতো। গিয়ে কিছু বলতো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে বাবার মার খাওয়া দেখতো। শেষে চোখ-মুখ ফুলে যাওয়া বাবাকে ধরে ধরে বাড়ি নিয়ে আসতো হারুন।


বাবার রক্তাক্ত ফোলা মুখ দেখে মা সারা দিনের ক্ষোভ ভুলে বাবাকে গরম পানি দিয়ে গোসল করাতো। একবার আমি প্রচণ্ড রাগে কেরোসিন তেলের বোতলটি 'শুয়ো*রের বাচ্চা' বলে বাবার দিকে ছুঁড়ে মেরেছিলাম। 

বাবার সারা গা কেরোসিনে মাখামাখি হয়ে গেলে আমার ইচ্ছা করলো একটা দেশলাইয়ের কাঠি ছুঁড়ে মারি এই নরকীটের দিকে। পারিনি। কেন পারিনি এই উত্তর আমার জানা নেই।


ময়না কলেজে যাওয়া বাদ দিয়ে দিলো।

ওর নাকি লজ্জা লাগে কলেজে যেতে। অনেকে সরাসরি ওকে জিজ্ঞেস করে, 'তোর বাবা এমন কেন? তোদের এই বয়সে এমন করা কি ঠিক?'

ময়না উত্তর দেয়, 'আমাদের বাবা খুব খারাপ লোক। লুচ্চা।'


আমি জানি, ময়না প্রচণ্ড লজ্জায় কালো হয়ে যায়। ওর চোখ ফুঁড়ে সমুদ্রের মত জল গড়ায়। আমারও কি লজ্জা কম লাগে? লজ্জার কারণে ইচ্ছা করে রাস্তাঘাটে যেখানেই পাই বাবার কলার ধরে চড় থাপ্পড় মারি।


আড়তের কাঁচা তরকারি বেচে যা টাকা বাবা কামায়, তা লুঙ্গির গিঁটে বেঁধে বাবা কালো শরীরে নোংরামি করতে বেরিয়ে পড়ে।


একবার খুব কমবয়সী এক মেয়েকে নিয়ে বাবা মাঝরাতে বাড়ি ফিরলো।

মেয়েটির বয়স বাইশ-তেইশ হবে। ফর্সা। সুতি শাড়ি পরা। বাবা মেয়েটিকে বিয়ে করে এনেছে। লজ্জা আর ঘৃণায় আমার গা কাঁপছে। আমি রাগ সামলাতে পারলাম না। দৌড়ে গিয়ে মেয়েটির হাত টেনে রাস্তায় বের করে দিলাম।

বাবা 'খা***র পোলা' বলে আমার সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করলো। কয়েকটি ঘুষি খেলাম আমি। ময়না, হারুন, মা মিলে আমাকে ঘরে নিয়ে এলো। এমন কুৎসিত বাবার সন্তান হয়ে আমি সারারাত তড়পাতে লাগলাম রাগে, ক্ষোভে, লজ্জায়।


সকালে বাবা মেয়েটিকে কোথায় রেখে এলো জানি না।


মা আর ময়না নানিবাড়ি চলে গেলো। 

ওখানে গিয়ে ওরা কী করবে জানি না। আমি আর হারুন দুজন কোথায় কোথায় থাকলাম। কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি বাবা মা আর ময়নাকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছে।


এতকিছুর পরও বাবার শরীরবৃত্তীয় এইসব কাজকে আমরা আটকাতে পারলাম না। মানুষের পৃথিবীতে জন্ম কি শুধু শরীরের চাহিদার জন্য?

শরীরের এত ক্ষমতা একটা সংসারকে, কয়েকটি অসম্ভব নম্র মনকে তছনছ করে দেয়া? মানুষের কি এমন ক্ষমতা নেই শরীরকে থামানোর?


মাঝরাতে খুব ভাবছি।

এইতো রাত দশটায় বাবাকে কবর দিয়ে এলাম। তরতাজা একটি শরীরকে পিষে দিয়েছিলো একটি মালবাহী ট্রাক।

থ্যাতলানো শরীরকে রেখে এলাম মাটির ঘরে।


বাবার শরীর এতদিন খেয়েছে আমাদের সংসার। আমার মাকে। বোনকে। ভাইকে। আমাকে। স্বয়ং বাবাকে।

আর আজ বাবার সেই শরীরকে খাবে তুচ্ছ মাটি! ::


অণুগল্প : শরীর

নাসির খান


মানুষের জীবনের বাস্তব গল্প ও ঘটনা পড়ুন।