বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প | বাস্তব জীবনের গল্প

 শিক্ষনীয় বাস্তব গল্প

শিক্ষনীয় বাস্তব গল্প

কেউ এড়িয়ে যাবেন না প্লিজ। 

আমার বিয়ের জন্য যখন পাত্রী দেখা হতে লাগলো তখন হঠাৎ করে মায়ের আচরণ বদলে যেতে শুরু করলো। শান্ত শিষ্ট মা খিটখিটে মেজাজের হয়ে যেতে লাগলেন। 


  সকালে ঘুম থেকে উঠে চেঁচামেচি আরম্ভ করতেন।

  চড়া গলায় বলতেন,"আমার মরণ হয় না কেনো? আল্লাহ প্রতিদিন এতো মানুষের মৃত্যু দেন, আমার দেন না কেনো? আমাকে কি তার চোখে পড়ে না? ঘেন্না ধরে গেলো জীবনের প্রতি। ঘেন্না, ঘেন্না..।"

  বাবা তখন মাকে বলতেন,"সকাল সকাল কি তোমার মাথায় ভূত চাপে? শুধু শুধু চেঁচামেচি করো কেনো?"

  জবাবে মা জ্বলে উঠে বলতেন,"সারাজীবন আমাকে জ্বালিয়ে শেষ করে এখন এসেছো ভালো সাজতে! তোমাকে আমার চেনা আছে। ঘেন্না, ঘেন্না...।"

  বাবা আর কিছু বলতেন না। কিন্তু মা গজগজ করতেই থাকতেন।


  দুপুরে ছোটো বোন যখন মাকে খেতে ডাকতো, মা তখন রাগী কণ্ঠে বলতেন,"তোর রান্না আমি খেতে পারি না। বমি আসে। ওয়াক থু!"

  "আমার রান্না খেতে ভালো না লাগলে, বাহির থেকে খাওয়া নিয়ে আসি?"

  "চুপ থাক। মুখে মুখে কথা বলিস। আমি খাবো না। আমার খিদে নেই।"


  পরে মা'র মেজাজ কিছুটা কমলে ছোটো বোন মা'র রুমে খাবার দিয়ে আসতো। 

  মা সামান্য খেয়ে প্লেট সরিয়ে রেখে বিছানায় শুয়ে নাক কুঁচকে বলতেন,"জঘন্য রান্না। ওয়াক থু!"


  রাতে হয়তো মাকে বললাম,"মা, আমার বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে যাবেন না?"

  মা ক্ষিপ্ত হয়ে তখন বলতেন,"বিয়ে করবি, তাই আনন্দে উড়ছিস, তাই না? শয়তান ছেলে পেটে ধরেছি। যা এখান থেকে।"


  মায়ের এই উত্তপ্ত আচরণে আমরা সবাই বিরক্ত হতাম। তাকে থামতে বললে থামতেন না। জোরে কথা বলতে বলতে এক সময় তার ফর্সা মুখ লাল হয়ে যেতো। পুরো শরীর ঘেমে যেতো। 


  শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে মা তখন বলতেন,"সবাই কি অন্ধ হয়ে গেছিস? দেখছিস না ঘামে ভিজে গেলাম। ফ্যানের স্পিড বাড়িতে দিতে পারিস না?"

  উত্তরে বলতাম,"ফ্যান ফুল স্পিডেই চলছে।"

  "তাহলে এতো গরম লাগে কেনো?"

  "সারাদিন চিৎকার করলে গরম তো লাগবেই।"

  "চুপ কর। জ্ঞান দিতে এসেছিস! তোর চেয়ে আমি ভালো বুঝি।"

  আমি তখন চুপ হয়ে যেতাম।


  দিন দিন মায়ের আচরণ রুক্ষ হয়ে উঠতে লাগলো। অবশ্য সব সময় যে তিনি চিৎকার করতেন তা নয়। যে সময় তিনি চুপ থাকতেন, তখন তাকে দেখলে মনে হতো, এক পৃথিবী ক্লান্তি তাকে ঘিরে ধরেছে। কখনো কোনো কারণ ছাড়া কাঁদতেন।


  মায়ের এই পরিবর্তনের কারণ আমরা বুঝতে পারতাম না।

  কেউ বলতো,"তাবিজ করেছে।"

  কেউ বলতো,"জিনে ধরেছে।"

  কেউ আবার বলতো,"তাবিজ, জিন এসব কিছু নয়। আসল ব্যাপার হলো, নতুন বউ আসবে বাড়িতে। তখন সংসারের কর্তৃত্ব আর তার হাতে থাকবে না। বউয়ের হাতে চলে যাবে। এই ভেবে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।"


  মায়ের ব্যবহারের কারণে বিয়ে করতে ভয় লাগছিলো। পুত্রবধূর সাথে যদি তিনি এভাবে আচরণ করেন তাহলে তো সংসার করা কঠিন হবে। আমি তাই পাত্রী দেখা বন্ধ রাখলাম।


  এদিকে মা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠতে লাগলেন। মায়ের চেঁচামেচিতে এক পর্যায়ে সবাই ত্যক্ত হয়ে গেলাম। 


  বাবা একদিন রেগে গিয়ে মাকে বললেন,"সুখে থাকতে ভূতে কিলায়, তাই না? সহ্যের একটা সীমা আছে। আমি শেষবারের মতো বলছি, তুমি যদি নিজেকে না শোধরাও, তাহলে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেবো।"


  ছোটো বোন একদিন অস্থির হয়ে মাকে বললো,"আপনি আমাকে পাগল বানিয়ে দেবেন। যেভাবেই রান্না করি আপনার পছন্দ হয় না। শুধু ওয়াক থু, ওয়াক থু করেন। অন্য কারো রান্না খেয়ে ওয়াক থু করে দেখবেন, কী হয়? বসে বসে খাচ্ছেন তো তাই টের পাচ্ছেন না।"


  আমি একদিন ফুঁসে উঠে মাকে বললাম,"আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন। আমাদের ভালো ব্যবহারের কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে। ঠিক আছে, এখন থেকে আপনার সাথেও আমরা খারাপ আচরণ করবো।"


  আমাদের রূঢ় ব্যবহারে মা আরো মরিয়া হয়ে উঠলেন। রাতে ঘুমান না, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করেন না, বিষন্ন হয়ে থাকেন, নতুবা কাঁদেন, নতুবা খিটখিট করতেই থাকেন।


  এভাবে চলতে চলতে মা এক সময় শারীরিক ভাবে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমরা মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। আর সেখানে গিয়ে ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে পারলাম মায়ের আসলে কী হয়েছিলো।


  ডাক্তার বললেন,"উনি দীর্ঘদিন থেকে মেনোপজ সমস্যায় ভুগছিলেন। মেনোপজ হলো, নারীদের একটা বয়সের পর মাসিক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া। এটা সাধারণত ৪৫ - ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে হয়। পৃথিবীর সকল নারীর জীবনে এটা ঘটে।"


  তারপর বললেন,"মেনোপজ নারীর শরীরে মনে প্রচুর পরিবর্তন নিয়ে আসে। যেমন, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, হঠাৎ করে খুব গরম লাগতে থাকে, স্মৃতি শক্তি নষ্ট হয়ে যেতে থাকে, খুব ছোটোখাটো বিষয়ে আবেগ প্রবন হয়ে কেঁদে ফেলা, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ইত্যাদি। এ সময় সঠিক যত্ন না নিলে অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ওনার ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছে।"


  অপরাধ বোধে আমরা জর্জরিত হয়ে গেলাম। 


  আমাদের ভুলের কারণে মায়ের ভয়াবহ শারীরিক ক্ষতি হলো। মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে গেলো। হার্টের রোগে আক্রান্ত হলেন। এরপর মা বেশিদিন বাঁচেন নি।


  মায়ের মৃত্যুর পর এই ভেবে কাঁদতাম যে, মায়ের সমস্যাটা বুঝতে না পেরে কতো বাজে আচরণ তার সাথে করেছি। আহারে!


২.

বিয়ের পঁচিশ বছর পর এক মাঝ রাতে আমার স্ত্রী ঘুম ভাঙিয়ে বললো,"আমার এতো গরম লাগে কেনো? ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দাও।"

  বললাম,"ফ্যান ফুল স্পিডে চলছে। আর বাড়ানো যাবে না।"

  সে তখন ঘামতে ঘামতে বললো,"তাহলে আমার এতো গরম লাগে কেনো?"


  তারপর খিটখিটে স্বরে বললো,"জীবনটা বরবাদ হয়ে গেলো আমার। কেউ আমার কথা শোনে না। অসহ্য অসহ্য! আল্লাহ এতো মানুষের মৃত্যু দেন, আমার মৃত্যু দেন না কেনো?..."


  সে বকে যেতে লাগলো। 


  আমার তখন বুঝতে সমস্যা হলো না, স্ত্রীর মেনোপজ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এখন অবহেলা নয়, বকাঝকা নয়, এখন তার প্রয়োজন সুষম খাবার, নিয়মিত ব্যায়াম, এবং অকৃত্রিম ভালোবাসা। 


  মায়ের সাথে যে ভুল করেছি, স্ত্রীর সাথে সেই একই ভুল করতে চাই না। 


  আমি তাই স্ত্রীর খিটখিটে মেজাজ অগ্রাহ্য করে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। পরম মমতায়।


"নারী"

লেখক : রুদ্র আজাদ


এমন আরও গল্প পড়ুন।