সংসার জীবনের কষ্ট | মেয়েদের সংসার জীবন

সংসারের গল্প

সংসারের গল্প

 আমি তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্বা। মাঝরাত্রিতে ঘুম ভেঙে গেছে। পাশ ফিরে দেখি বর বিছানায় নেই। ড্রিম লাইটের আলোতে বুঝলাম সে রুমেও নেই। বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম, সেখানেও নেই। বাথরুমে চাপ সইতে না পেরে বাথরুম শেষ করে, বাহিরে গিয়ে দেখি বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে হাস্যচ্ছলে ফোনে কথা বলছে। ওকে বিরক্ত করলাম না, কিন্তু আমার আর সহ্য হল না, দম বের হয়ে আসছিলো। চুপচাপ বিছানায় এসে বালিশ আকড়িয়ে কান্না করতে লাগলাম। মনকে বুঝ দিচ্ছিলাম, আমার কপালটাই পোড়া। স্বামীর ভালবাসা আমার কপালে নেই। ধর্মে তো, পুরুষ মানুষের চার বিয়ের পারমিশন আছেই। 

কান্না করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গেছি খেয়াল নেই। বরের চিৎকারে ঘুম ভাঙল। শালী, ফকিন্নির বাচ্চা, আর কত ঘুমাবি? নাস্তা বানাবে কে? ঘরের কাজ করবে কে??

এই শরীর নিয়ে উঠলাম। ঠিকমত হাটতে পারছিলাম না। চুপচাপ রান্না ঘরে গিয়ে নাস্তা বানাতে মন দিলাম। নাস্তা বানিয়ে টেবিলে রেডি করে আবার দুপুরের জন্য রান্না চুলায় বসিয়ে দিলাম। কি রান্না করবো, আর কত বাজে রান্নার অপবাদ শুনবো, মনে মনে এসব হজম করার প্লান করছি।

ওদিকে শ্বাশুড়ী আম্মা আর বর মিলে নাস্তা করছে। আমার মেয়ে দুটোর রুমে যাবার সময় পাই নি, হয়ত উঠেছে কি না। মার খাবার ভয়ে তারা বাবার ধারে কাছে ভিড়তে চাই না। আর ঐদিকে আমার একমাত্র ননদ তখনও ঘুমে। শ্বাশুড়ী আম্মা চিৎকার করে ডাকছে, মৌ এদিকে আয়, বেলা হয়ে গেল, নাস্তা করে যা। আর কত ঘুমাবি? 

বুকটা ফেটে যায় যখন আমার মেয়ে দুটোকে রেখে ওরা নাস্তা করে। মৌ মাঝেমাঝে ডেকে নিয়ে যায় কিন্তু শ্বাশুড়ী চোখে দেখতে পারে না। 

হঠাৎ একটা কথা কানে ভেসে আসলো,

শ্বাশুড়ী আম্মা বলতেছে, ''লক্ষণ তো এবারও ভাল না, আবার মেয়ে হবে।' বাপ, তুই এক কাজ কর, আরেকটা বিয়ে কর। একে ছেড়ে দে।' 

হাজব্যান্ড কিছু না বলে উঠে গেল। শ্বাশুড়ী নাস্তার প্লেট নিয়ে ননদের রুমে ডুকলো। আর আমি রান্না ঘরে চোখের পানি ফেলছিলাম...

.


মনি আর মুক্তা হওয়ার পর আমি আর বাচ্চা নিতে চাই নি। ইচ্ছে ছিল মেয়ে দুটোকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবো। নিজের মনে লালিত অধরা স্বপ্নগুলো মেয়েরা যেন পূরণ করতে পারে সেভাবেই মানুষ করবো। কিন্তু বরের কথা তার ছেলে চায়ই চাই। এজন্য তাকে প্রয়োজনে যতবার দরকার ততবার বেবি নিতে হবে। আমার শরীর খুব একটা ভাল না, কিন্তু মনের বিরুদ্ধে জোর করে বেবি নিতে বাধ্য করল। মায়া দয়াহীন আচরণ করতো। নিজ স্বামী দ্বারা প্রতিদিন ধর্ষিত হতে লাগলাম।

.

দিনকে দিন অবহেলা বাড়তে লাগলো। শ্বাশুড়ী আম্মা রান্নাঘরে পা মাড়ায় না। সিরিয়াল দেখা নিয়ে সবসময় ব্যস্ত। আর ননদিনী সে তো রাজকন্যা, সে আসবে রান্না ঘরে তার প্রশ্নই উঠে না। চেহারা নষ্ট হয়ে যাবে, দিনরাত ফোন নিয়ে পড়ে থাকে। তার চলাফেরাও আমার ভালো লাগে না। বয়স আর কত, কলেজে পড়ছে, অতি স্মার্ট চলাফেরা। বাড়িতে সবসময় পাতলা গেঞ্জি পরে থাকে। ওরনার বালাই নেই। মেয়ে হয়ে এমন অবস্থায় ভাইয়ের সামনে চলাফেরা করে, অথচ কেউ কিছু বলে না। আমি ভয়ে কিছু বলি না, এ বাড়িতে আমি কথা বললেই দোষ।

.


গত সোমবারে মাংসে লবণ একটু বেশি হয়েছে, মনে হয় ভুলে দুবার দিয়ে ফেলেছি। শ্বাশুড়ী বললো- নবাবজাদীর রান্না করার সময় মন কোথায় থাকে? এককেজি মাংসের দাম কত জানিস? কত টাকা ইনকাম করিস?

স্বামী শ্বাশুড়ীর কথায় পুরুষত্ব প্রমাণ করতে চুলের মুঠি ধরে আমার গালে এমন একটা চড় মারলো, ঠোটের কোণে কেটে গিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। আমি চুপচাপ রুমে গিয়ে কান্না করলাম। 

আল্লাহর কাছে বলতে লাগলাম, আর কত পরিক্ষা নিবা ধৈর্যের? আর যে আর পারছি না। মেয়ে দুটো মুখের দিকে চেয়ে কোথায় যেতেও পারি না, সব মুখ বুজে সহ্য করি। আমার অনাগত পেটের সন্তানটা, তার কি দোষ? পৃথিবীতে আসার আগেই এত কথা শুনতে হচ্ছে? 

ইচ্ছে করছিলো, নিজের পেটে নিজের ঘুষি মারি, গলাটিপে মেরে ফেলি। এই পরিবারের মানুষগুলো জানোয়ার, হিংস্র পশুর মত, এদের মনুষ্যত্ব বলে নেই। 

.

সাত মাস চলছে।

বর একটাবারও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় নি। আমি ঠিকমত চলাফেরা করতে পারি না। মাঝেমধ্যে অনেক পেইন হয়। ইদানীং মৌ আমার খোঁজ খবর নেয়।শ্বাশুড়ী আম্মা ঘুরেও তাকায় না, উল্টো মৌ'কে বলে দরদ বেশি হয়ে গেছে তোর? মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। মৌ'র উল্টো জবাবে মা চুপ করে থাকে। মৌ'র আচরণ কিছুটা অবাক করলেও, বুঝতে পারি সব মানুষ তো এক না।

মৌ তার ভাইকে বারবার বলে একজন কাজের মানুষ ঠিক করে নিয়েছে। তারপরও সমস্ত দিক আমার খেয়াল রাখতে হয়। 

ইদানীং স্বামী আমার বিছানায় আসে না, গেস্টরুমে থাকে। ওর আর সময় হয় না একটাবার আমাদের খোঁজ নেওয়ার। আমি আর ওর কষ্ট বাড়ায় নি, দু মেয়েকে নিয়ে মেয়ের ঘরে থাকতে শুরু করছি। মনির বয়স ছয় আর মুক্তার তিন। এখনও সবকিছু বোঝে না...

.

বিয়ের প্রথম প্রথম বর আমাকে খুব ভালোবাসতো। সবকিছু ঠিকমতো খেয়াল রাখতো। কিন্তু সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। মুক্তা হবার পর আস্তে আস্তে সবকিছু পাল্টে যেতে থাকে। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার চেহারা রুক্ষ, শুষ্ক, মলিন হয়ে যায়। যে চেহারা দেখে আমায় বিয়ে করেছিল, বাচ্চা হবার পর চেহারা আর আগের মত নেই। এজন্যই হয়ত স্বামীর ভালবাসা পাই না।

.

স্বামীর পকেটের খুচরো কয়েনগুলো মাটির ব্যাংকে জমিয়ে রাখতাম। মৌ'-কে রাজী করিয়ে সাথে নিয়ে 

আল্ট্রা করে জানতে পারি মেয়ে হবে। খবর বাতাসের আগে বরের কানে চলে গেলো, শ্বাশুড়ীর এত দিনের মনঃবিশ্বাস আজ আত্নবিশ্বাসের সাথে বাস্তবে মিলে গেছে। তার সিদ্ধান্ত আমাকে আর বাসায় রাখবে না, আমার বৃদ্ধ মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিবে। যে বৃদ্ধ মা আমার চাচার বাড়িতে আশ্রিতা। মাকে এখানে এনে রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু শ্বাশুড়ী রাখার অনুমতি দেই নি। যে বাড়িতে আমার নিজের অস্তিত্ব সংকটে,

শ্বাশুড়ীর পা ধরে কাকুতি মিনতি করলাম, আমাকে এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েন না। আমারে দাসীবাঁদীর মত রাইখেন, তবুও তাড়িয়ে দিয়েন না। শ্বাশুড়ীর মন কিছুটা গললো, কিন্তু অবহেলা আর অত্যাচারের পাল্লাটা দিনকে দিন আরো ভারী হল। 

.

আল্লাহর কাছে দিনরাত প্রার্থনা করতাম আর চাইতাম "আল্লাহ আমার যেন একটা ছেলে হয়। আল্টাসনোগ্রাফির রিপোর্ট যেন ভুল হয়। আমি যে আর পারছি না, এত অত্যাচার সইতে। আমার কি দোষ বলো? আমার আর তোমার কাছে কিচ্ছু চাই না, শুধু একটা ছেলে সন্তান দিও।"

সহ্য হয় না তবুও চুপ থাকি এই ভেবে যে ছেলে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

.

নয় মাসের শুরুতে হঠাৎ করে খুব পেইন উঠে। মৌ'কে সাথে নিয়ে যায়, ডাক্তার বলে ফলস পেইন। ব্যাথা কমানোর জন্য স্যালাইন আর ইনজেকশন দেয়। ডাক্তার আরো কিছু টেষ্ট করাতে বলে, পর দিন রিপোর্ট দেখে বলে তের তারিখের মধ্যে সিজার করতে হবে। বেবীর ওজন কম আর আমার কিছু প্রবলেম আছে।

বরকে বললাম, বর সোজা না করে দিলো, বললো কোনো টাকা খরচ করতে পারবে না। অথচ আমার চোখের সামনে হাজার হাজার টাকা পরকিয়া করে ফুরাচ্ছে। অথচ বরকে মুখে কিছুই বলি নি। আমার কলিজাটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। আমার বরের এত টাকা থাকতেও আমার আর আমার অনাগত সন্তানের জন্য হলো না। শেষমেশ উপায় না পেয়ে আমার সেই চাচার কাছে ফোন দিলাম, সবকিছু খুলে বললাম। চাচা আর তার ছেলের বউ পরের দিন হাজির। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করালো, ভাবী সার্বক্ষণিক আমার দেখাশোনা করতে লাগল। এতকিছুর পরও আমার বর বা শ্বাশুড়ী কেউ আসে নি। মৌ একবার এসে দেখা করে গেছে।

.

তের তারিখ বিকেলে আমার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখতে পাই। আল্লাহ আমার প্রার্থনা শুনেছেন। আমার ছেলে হয়েছে। এই খবর শোনামাত্রই বর ছুটে এসেছে, শ্বাশুড়ী মা এসেছে। বংশ রক্ষা হয়েছে, বংশের বাতি জ্বলেছে। মুহূর্তেই সবকিছু পরিবর্তন হয়েছে।

বর এসে হাতে হাত রেখে বলছে, 'মাপ করে দাও, ভুল হয়ে গেছে।' আমি কিছু বলতে পারি নি... চোখের কোণা দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে...


(বাস্তব ঘটনা থেকে)


এমন আরও বাস্তব জীবনের ঘটনা ও গল্প পড়ুন।