আব্বার নতুন বউ | বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

বাস্তব জীবনের গল্প

বাস্তব জীবনের গল্প

আব্বা নতুন একটা বউ এনেছে।আমি বউকে পর্দার ফাঁকে দেখছি।হাত ভর্তি চুড়ি, লাল ঠোঁট,লাল শাড়ি,নাকে বড় একটা কানের রিংয়ের মতো পড়ে আছে।বউ টা আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলো।


-- বললাম, " আমার নাম টগর,বয়স দশ,পঞ্চম শ্রেণী, রোল নং ১। "


বউ টা হাসছিলো বেশ জোরে জোরে।তখন আমি তার হাসির কোন কারন খোঁজে পাচ্ছিলাম না,তাই লজ্জা লাগছিলো।


আম্মা আমার লজ্জা আরো বাড়িয়ে দিলেন।নতুন বউ কে বকাঝকা করছেন।নতুন একটা মানুষ কে কেনো যে বকাবকি করছেন।


আব্বা বেশ চিন্তিত হয়ে সারা বাড়ি হাঁটাহাঁটি করছেন। আম্মা কে বুঝানোর চেষ্টা করছেন।


এরপর থেকে ঘরে প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়া থাকতো।আম্মা নতুন বউয়ের সাথে,নতুন বউ আম্মার সাথে অথবা আব্বা সবার সাথে। এর প্রভাব পড়লো আমার উপর। 


প্রথম সাময়িকী পরীক্ষায় প্রায় প্রতিটি বিষয়ে ফেল করতে গিয়েও করিনি। আম্মা আমার প্রতি সব সময়ই মনোযোগী রেজাল্টের অবস্থা দেখে আব্বার সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করে নানার বাড়ি চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।


আমি গোসল করলাম,মাথা ভর্তি করে সরিষার তেল দিলাম,চুল আঁচড়ালাম,গলায় পাউডার দিলাম,আম্মার স্নোর কৌটা থেকে স্নো দিলাম,আব্বার স্প্রে টা লুকিয়ে একটু দিয়ে নিলাম।

আলমারিতে তুলে রাখা আমার বেড়াতে যাবার শার্ট-প্যান্ট ভালো করে ঝেড়ে পরলাম।আম্মা বলেন, কাপড় ভালো করে ঝেড়ে পড়তে হয়।অন্য সময় আম্মা এই কাজগুলো করে দেন। আজ নিজে নিজে করতে হচ্ছে। আম্মার মেজাজ খারাপ,তার মন মতো কাজ না করলে নানা বাড়ি যাওয়া টা যদি বন্ধ করে দেন,সেই ভয়ে ভয়ে সব ভালোভাবে করছি।আমার খুব আনন্দ হচ্ছে নানা বাড়ি যবো।

.

.

আমরা নানার বাড়িতে ভালোই আছি। তবে মাঝে মাঝে নানা আব্বা কে বকাবকি করেন,তখন আমার খারাপ লাগে। পরে নানা আমার মাথায় হাত দিয়ে আদর করে দেন। তখন আমার মন টা খুশি হয়ে যায়।আমাকে এখানে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে।


একদিন আমার ছোট খালা বললেন,

-- " তোর আব্বার কথা মনে হয়? "


বললাম,

-- " মনে হয়।"


-- " তোর জন্য একটা নতুন আব্বার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।আগামী কাল তোর আম্মা আর তোকে দেখতে আসবে। "


কেন আসবে জানতে চাইলাম।খালা বললেন,


-- " তুই যেমন পছন্দ করে ঈদে কাপড় কিনিস তেমন সে ও তোদের পছন্দ করবে।পছন্দ হলে তারপর নিয়ে যাবে। "


আম্মা সকাল থেকে কাঁদছে।লোকটা আমাদের পছন্দ করেছে।তিনি আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। 


আমি বললাম, -- " নাম টগর,বয়স দশ,পঞ্চম শ্রেণী,রোল নং ২৬। "


লোকটা আমাকে পাঁচশত টাকা হাতে দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন,

-- " রোল নং এতো বেশী কেন? "


-- " স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছিতো তাই। "


-- " এখন থেকে আমাকে আব্বু ডাকবে আর আম্মা নয়, আম্মু ডাকতে হবে। "

.

.

আম্মা কে আম্মু ডাকতে আমার খুব লজ্জা লাগছিলো,আর কেন যেনো অচেনা মনে হচ্ছিলো সব কিছু।


আম্মা সকাল থেকে কাঁদছে,আগামী কাল নাকি আম্মার বিয়ে।


' আম্মু কাঁদছো কেনো' বলতেই, আম্মা আমার গালে এক চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন,

-- "আম্মা বল।"


এই প্রথম আম্মার হাতের চড় আমার ব্যথা লাগেনি বরং সব কিছু আবার আগের মতো পরিচিত মনে হচ্ছিলো।মনে মনে ভাবছিলাম, 'আম্মা নতুন জিনিস দেখলে এতো রাগ করে কেনো?'

.

.

সেদিন রাতে লুকিয়ে আম্মা আমাকে নিয়ে, আমার ফুফু আম্মার বাসায় চলে আসেন।সেখানে কিছুদিন থাকি এরপর আম্মা একটা অল্প বেতনের চাকরি নেন, স্কুলে ভর্তি করেন।নানা আবার আমাদের নিয়ে যেতে চান।আম্মার আর ফিরে যাননি,আমার লেখা-পড়ার ক্ষতি হবে ভেবে।


নানা-মামারা সাহায্য করতেন,আত্মীয় স্বজন ও সাহায্য করতো।ফাঁকা পেলে আম্মা কে বুঝানো হতো, তিনি বিয়ে না করে চরম ভুল করছেন।আবার কেউ বুঝাতেন কষ্ট করে হলেও আব্বার সংসার করার।

.

.

.

.

.

আজ অমি ইঞ্জিনিয়ার সমাজে প্রতিষ্ঠিত,আম্মার মুখে হাসি ফুটাতে পেরেছি।সেদিন নানা রা হয়তো আম্মা কে কোন ভুল সিদ্ধান্ত দেননি। কিন্তু আম্মা আমার জন্য নিজের প্রয়োজনে নতুন কোন সিদ্ধান্ত নেননি।


এই প্রথম আমার কোন মেয়ে কে বউ বানাতে ইচ্ছে করছে।আম্মা কে আমার পছন্দের কথা জানালাম।আম্মা খুশি হলেন। 

.

.

আমি আর আম্মা রোদেলাদের বাসায় বসে আছি,রোদেলার মা আমাদের সাথে গল্প করছেন।

রেদেলা নাস্তা নিয়ে আমাদের সামনে আসলো।রোদেলার বাবা আমাদের পাশে বসলেন,আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন।


-- " আমি টগর, বয়স ১০,পঞ্চম শ্রেণীর রোল নং ২৬। "

রোদেলার বাবা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন।


আম্মা রোদেলার বাবার কে হয়তো চিনতে পারেন নি।রোদেলার বাবা হয়তো এখন আমাকে চিনতে পারছে।আম্মা আমার মোবাইল টা হাতে দিয়ে বললেন,


-- " নতুন একটা সম্পর্কে যাবি এতো উদাস হলে চলবে।হবু বউ মা কল দিচ্ছে ধর। "

.

.

রোদেলার বাবা আমার নতুন বাবা হতে চেয়েছিলেন।তার বউ বাচ্চা দেশের বাহিরে ছিলো।তিনি মাঝে মাঝে দেশে আসতেন,তাই দেশেও একটা সংসার পাতার শখ হয়েছিলো তার।রোদেলার উপর আমার আগ্রহ থাকলে ও সামাজিকতার একটা অদৃশ্য শিকলে আমি আটকে গেছি। 


চুপ করে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলাম।

.

.

.

আব্বার নতুন বউটা চলে গেছে অনেক আগেই। আমি আমার হারানো শৈশব টা ফিরে পেতে চাই। আমার ঘরে আম্মা থাকবে আব্বা থাকবে যেমন টা আমার বন্ধুদের ছিলো।আব্বা কে আমাদের কাছে নিয়ে আসতে গেলাম।

.

.

আব্বা আসার সময় আম্মার জন্য স্নো,চুড়ি,শাড়ি, আমার জন্য রং পেন্সিল, লাটিম,বল কিনলো হাতে দিলো বারো টাকা দিয়ে একটা আইসক্রিম ছোট বেলায় এর দাম ছিলো পাঁচ টাকা।

.

.

অমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছো। দোকানে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের মতোই খেতে শুরু করে দিলাম। আব্বা বললো, 

-- " আর কিছু খাবি? "


আমি আঙ্গুল দিয়ে মুড়ি নাড়ুর বৈয়ম দেখিয়ে দিলাম।একটা আম্মার জন্য একটা আমার জন্য নিলাম।কত অভিজাত হোটেলে-রেস্টুরেন্ট, দেশ-বিদেশের ঘুরে খাবার খাই বাবার কিনে দেয়া দোকানের খাবারের মতো এতো মজা কখনো লাগেনি।


আব্বা কে দেখে আম্মা স্বাভাবিক আচরন করছেন,আমার বেশ অবাক লাগছে।হারিয়ে যাওয়া দিন গুলো আমার ফিরে পেয়েছি।

.

.

.

আম্মা আমার নোংরা থাকা নিয়ে আগের মতোই বকাবকি করছেন।আব্বার শার্ট আয়রন করে দিলেন,খাবার রান্নার করলেন,গোসল না করলে আমাদের বাপ বেটার খাবার বন্ধ ঘোষণা দিলেন।আমাকে জোর করে বাথরুমে নিয়ে শরীর ঘষে গোসল করালেন,আমি গোসল না করার জন্য কান্নাকাটি করতে লাগলাম।মাথা ভর্তি করে সরিষার তেল, বাম দিকে সিঁথি ,মুখে স্নো,গলায় পাউডার দিয়ে স্যুটকোট পড়িয়ে দিলেন আম্মা।


বুঝতে পারলাম আমরা নানা বাড়ি যবো খুশিতে আমি আত্মহারা।লুকিয়ে আব্বার স্প্রে টা দিতে গেলাম,কিন্তু পেলাম না।কারন আব্বা এখন আতর মাখেন। আমি আতর মাখি না কিন্তু এই আতরের ঘ্রানে আছে নেশা, আতর মাখলাম।


আমাদের প্রাইভেট কার গিয়ে থামলো , রোদেলাদের বাড়ির সামনে।


আমার বুঝতে বাকি রইলো না, আম্মা কেনো আব্বা কে খুব স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিলেন।রোদেলার বাবা কে আম্মা সেদিন ঠিকই চিনেছিলেন।


আম্মা আমার ভালোর জন্য জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্ত গুলো এভাবেই নিয়ে গেছেন।


আব্বা আমাকে শিখিয়ে দিচ্ছেন, নাম জিজ্ঞেস করলে শুধু নাম বলবি,শ্রেণী রোল নং বলার প্রয়োজন নাই।


আম্মা কে জড়িয়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। হারানো দিনের কষ্ট গুলো কেমন যেনো বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছিলো।


--------সমাপ্ত-------

গল্প-‌সম্পর্ক


তানজীনা আফরিন মেরিন


বাস্তব জীবনের সকল প্রকার গল্প পড়ুন।