গল্প রোমান্টিক | রোমান্টিক লাভ স্টোরি গল্প ২০২৩

 হঠাৎ বিয়ের রোমান্টিক গল্প

হঠাৎ বিয়ের রোমান্টিক গল্প

১২ বছর বয়স ছিল আমার যখন প্রথম বিয়ে করে স্বামীর বাড়িতে পা রাখি। ছোট ছিলাম।বাচ্চা আমিটার মাথায় ঢোকেনি লাল টুকটুকে বেনারসি, গা ভর্তি গয়না পড়ে সেজেগুজে সাত পাক ঘুরে সিঁথিতে সিঁদুর রাঙানোর মানে।

ফুলসজ্জার ঘরে ঢুকে আমার স্বামী সোজা বলে দিলেন,

"তুমি জানো আমার বয়স কত?তোমার কতবছরের বড় আমি?"


ভয়ার্ত চোখে মাথা নাড়লাম। অর্থাৎ আমি জানি না।

উনি মাথায় থাকা পাগড়িটা খুলে নামালেন।সাথে সাথে মুখের ওপরে ঝুলে থাকা ফুলের শেহরা টা সরে গেল।

প্রথমবারের মতো ওনার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। কিন্তু ওনার সৌন্দর্য বর্ণনা করার মতো শব্দ পেলাম না।

আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে উনি উত্তর দিলেন,

"আমার বয়স ২১ বছর। তোমার চেয়ে গুণে গুণে নয় বছরের বড় আমি। "

চমকে তাকালাম। কি বলা উচিত ঠিক বুঝে ওঠার আগেই আমার স্বামী নিজেই বলতে শুরু করলেন,

"আমার লেখাপড়া এখনো শেষ হয়নি! সামনের সপ্তাহে আমার লন্ডনে যাবার কথা।  আসলে হায়ার স্টাডিজের জন্য স্কলারশিপ পেয়েছি বলেই যাওয়া।

আমার বাবা মায়ের ধারণা বিদেশের অতিআধুনিকা মেয়েদের পাল্লায় পড়লে আমি আর তাদের কাছে ফিরবো না। সেজন্যই জোড় করলো বিয়ে করার জন্য। 

আর আমার মায়ের ঘুরেফিরে তোমাকেই পছন্দ হয়ে গেল। একটা বাচ্চা মেয়েকে পছন্দ হয়ে গেল।

কোন ক্লাসে পড়ো তুমি? বিয়ে যে করে নিলে, পড়াশুনো করার শখ নেই?আচ্ছা, তো আদৌ পড়াশুনো  করেছো তো নাকি?"


আমি কাঁপা কাঁপা স্বরে জবাব দিলাম,

"আজ্ঞে!হ্যাঁ, পড়তাম তো। আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি! কিন্তু বড়মা বলেছে, আমার আর পড়াশুনো করা হবেনা।"


উনি আমার পাশে বসেলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

"তুমি এখন বিবাহিতা, আমার স্ত্রী। তোমার বড়মার কথা এখানে খাটবে না। তুমি পড়বে,আর আমি পড়াবো। চিন্তা করো না।

লন্ডনে গেলে আপাতত দুবছরের আগে আমি ফিরবো না, এ দুবছরে যেন তোমার পড়ায় কোন গাফিলতি না হয়!ওকে?"


আমি ঘোর লাগা চোখে ওনার দিকে তাকাতেই উনি তাড়া দিয়ে বলে উঠলেন,

"কাবার্ড থেকে একটা সুতি শাড়ি নিয়ে  চেঞ্জ করে নাও। ছোট মানুষ। এত ভারী শাড়ি পড়ে থেক না!


আর ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো আমিও ঘুমোচ্ছি!শুভ রাত্রী কাল কথা হবে।"


শুয়ে পড়তে নিতেও উনি আবার আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন,

"তোমার নামটা যেন কি?"


আমি হালকা হাসলাম। বিয়ে করা বউয়ের নামটাই যে জানেনা!কি একটা অবস্থা!

তারপর ওনাকে মিনমিনে স্বরে জবাব দিলাম,

" আপনার যা ইচ্ছে হয়, সে নামেই ডাকবেন নাহয়! আমার নামটা অজানাই থাক।"

উনি হেসে ফেলে বললেন,

"আচ্ছা? ঠিক আছে। নামটা তবে কাল ঠিক করবো। এখন ঘুমাই হ্যাঁ। চেঞ্জ করে তুমিও ঘুমোও। শুভ রাত্রী! "

আমি কথা বাড়ালাম না। হেসে সম্মতি জানালাম।

গুটি গুটি পায়ে কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা ছাইরঙা সুতি শাড়ি নিয়ে চেঞ্জ করে ঘুমিয়ে গেলাম।

পরের দিন সকালের কথা! 

বাবা-মা মারা যাবার পরে জেঠু-বড়মার ঘরেই মানুষ আমি। আমার ১০ বছর বয়সে যখন অনাথ হয়ে গেলাম, তখন থেকেই বড়মার ঘাড়ে যেন বোঝা হয়ে চাপলাম। সেই সুবাদে বড়মাও আমাকে দিয়ে গোটা বাড়ির সব কাজ করাতো।

তাই রোজ বেশ ভোরেই ঘুম থেকে উঠে গাঁধার খাটুনি খাটতে লেগে যেতাম।

তাই সেদিন সকালেও বেশ ভোর ভোর উঠে স্নান সেড়ে নিলাম।

স্নান করে একটা কালো শাড়ি পড়ে ভেজা মাথার চুলগুলো ঝেড়ে দিয়ে তোয়ালেটা বারান্দায় মেলে দিয়ে আসতেই দেখি উনি আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ওভাবে কেন তাকিয়ে আছেন তা চমঠিক বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,

"কি দেখছেন?"


উনি উঠে বসে হালকা হেসে জবাব দিলেন,

"তোমার নাম! "

কপালে ভাজ ফেলে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে!

উনি এবার প্রশস্ত হেসে বললেন,

"শুভ সকাল কৃষ্ণকায়া!"


শরীরটা কেঁপে উঠলো যেন।শিহরিত হয়ে ওনার দিকে তাকাতেই দেখলাম ওনার চোখে ঘোরলাগা দৃষ্টি।

তবে তখন সে দৃষ্টির অর্থোদ্ধার করে উঠতে পারিনি।


আমি আর ঘাটলাম না। ধীর পায়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই নিজের দিকে চোখ পড়লো।

বড়মার বাড়িতে যখন ছিলাম! তখন কখনো আয়নায় নিজেকে দেখার সুযোগ হয়নি।অত কাজের ভীরে আমার আবার সময় কোথায় নিজের দিকে দুদন্ড তাকাবার!

আজ নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না।

একদৃষ্টে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে মনে হলো, আমাকে পছন্দ করার মতো বিশেষ কোন কারণ নেই।

কাল যে শাশুড়ি মা তার ছেলেকে বেঁধে রাখার গুরু দায়িত্বটা আমার হাতে সপে দিলেন সেটা পালন করতে পারা নিয়ে নিজের মনেই সন্দিহান হয়ে রইলাম।

কালো গায়ের রঙে কালো শাড়ি পড়ে নিজের মনেই মনে হলো, কৃষ্ণকায়াই বটে!

সেদিন স্বামীর দেয়া নতুন নামটাকে আমার নেহাতই অপছন্দ হয়েছিল।

তবে সময়ের আবর্তনে সেই নামেই একদিন ভুলেছিলাম। সদ্য শৈশব থেকে কৈশোরে পা দেয়া আমি এই নামদাতার প্রেমে পড়েছিলাম।


হৃদিতা খুব আগ্রহ ভরে এতক্ষণ ধরে সবটা শুনছিল। তবে, হঠাৎ থেমে যাওয়ায়, সে আবার ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

"কি হলো, দিদা?থামলে কেন? বলো!তারপর কি হলো?দাদুর সাথে তোমার প্রেমের শুরু হলো কবে?বল না প্লিজ! "


কাদম্বিনী দেবী মৃদু হেসে বললেন,

"সেসব অনেক লম্বা কাহিনি দিদিভাই। শুনতে গেলে রাত পার হয়ে যাবে। অন্য কোনদিন শুনো নাহয়। "

হৃদিতা নারাজ। সে জেদ ধরলো এখনি সবটা শুনবে। অগত্যা নাতনীর কথায় বাধ্য হয়ে কাদম্িনী দেবী বলতে শুরু করলেন,

"বিয়ের পরেরদিনই উনি আমার হাতে স্কুলে ভর্তির ফর্ম ধরিয়ে দিলেন।ওনার ইচ্ছে ছিল যাবার আগে, আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে যাবেন।সে মতো ব্যবস্থাও করলেন।

ঠিক এক সপ্তাহ বাদে বাক্স প্যাট্রা গুছিয়ে নিয়ে পারি জমালেন ভিনদেশে।

যাবার আগে বলে গেলেন, আমি যেন ঠিক মতো পড়াশুনা করি।বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়লাম।

শাশুড়ী মা, শশুড় মশাইকে বলে গেলেন, খেয়াল রাখতে।

ছেলের আচরণে তারা তো মহাখুশি। আমাকে বাড়ির বউ করে আনা সার্থক। ছেলে হয়তো বাঁধা পড়েছে।এবারে তার ফিরে আসা নিশ্চিত।

তাদের আশা দেখে আমিও নিশ্চিন্ত হলাম এই ভেবে যে শাশুড়ি মায়ের দেয়া দায়িত্ব হয়তো বা পালন করতে পেরেছি।

দুটো বছর দেখতে দেখতে এভাবেই গেল। 

কিন্তু দুশ্চিন্তার রেখা তখন দেখা দিল, যখন দু বছর পেরিয়ে যাবার পরেও তিনি এলেন না।

ফিরলেন না এদেশে। 

শাশুড়ি মা চিন্তায়  শয্যা নিলেন।শশুড়মশাই চেষ্টা করলেন যোগাযোগের তবে বিশেষ লচভ হলো।

চিঠি পাঠালে উত্তর আসতো তিন চার মাস পর, তাও উত্তরে আশাজনক কিছু থাকতো না।

নিছক কুশলাদি বিনিময় শেষেই পত্রের ইতি হতো।

দিন কে দিন পুত্র চিন্তায় শাশুড়ি মায়ের শরীর ভেঙে যাচ্ছিল।

আমার কি করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না।

তারপরে হঠাৎ একদিন শাশুড়ি মা দেহ রাখলেন।

শোকের ছায়ায় আচ্ছন্ন বাড়ি যখন হরিধ্বনীতে মুখরিত তখনই,

বিশাল বড় একটা সাহেবী বাক্স হাতে সাহেবী পোশাকে বাড়ির সদরদরজায় এসে দাঁড়ালেন উনি, সুদীর্ঘ চারবছর পর।

বাড়ির বাইরে এত লোকের ভীর ঠেলে বাড়ির ভেতরে এসে যখন মা কে নিথর ভাবে পড়ে থাকতে দেখলেন তখন হাঁটুমুড়ে মায়ের সামনে বসে ডুকরে কাঁদলেন।

বাবা এসে ওনাকে জড়িয়ে নিলেন।

তারপরে নিজেদের সামলে নিয়ে শাশুড়ি মায়ের শেষকৃত্য শেষে বিধ্বস্ত বেশে যখন উনি ফিরে এলেন, তখন ওনাকে দেখে বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো।

বাবা মায়ের এক ছেলে, বড় আদরের, সে ছেলে মায়ের স্নেহের আচলখানি হারিয়ে ঠিক কতটা অসহায় হয়ে পড়তে পারে তা ওনাকে না দেখলে বুঝতাম না।

টানা পনের দিন হবিশ্য করে যখন মায়ের শ্রাদ্ধকর্ম শেষ করে,  যেদিন আমার সামনে এসে হাত দুটো ধরে বললেন,

"কৃষ্ণকায়া? শেষ সময়টাতে মায়ের মুখে একটিবার জল দেবারও সুযোগ হলো না।  কেন বলোতো। বিশ্বাস করো, ইচ্ছে থাকলেও আমি আসতে পারিনি। ও দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা খুব কড়া যে। 

কিন্তু মাকে যে এভাবে হারিয়ে ফেলবো তা তো ভাবিনি!"


ওনার কথায় চোখ জলে ভরে গেল। উত্তর দিতে পারলাম না।

শুধু ওনাকে ধরে শুঁইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।ঘুমিয়ে পড়লেন।


তারপর আবার কিছু দিনের ভীরেই সবটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। শোক ভুলে আবার সবাই নিত্য কাজে মন দিলাম।

এমনই একদিন জৈষ্ঠের রাতে উনি আমাকে পড়াতে বসিয়েছিলেন।

তখন সামনেই আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা! গণিতে একটু কাঁচা ছিলাম বলে উনি নিয়ে বসেছিলেন অংক করাতে।।

হঠাৎ আকাশ খারাপ করে ধুলোঝড় উঠলো। 

জানালাটা খুলে রাখা ছিল ভ্যাপসা গরমটা কাটাতে। কিন্তু তার জন্য গোটা ঘর ধুলোময় হয়ে গেল।

আমি উঠে গিয়ে জানালা লাগিয়ে দিতে যাব এমন সময় হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। বাতাসে বৃষ্টির ছাট জানালা গলে এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল আমাকে।

জানালাটা ঠিলেঠুলে চাপিয়ে দিতেই জোড়ে বাজ পড়ার আওয়াজ হল।

বাজ পড়া বরাবর খুব ভয় পাই আমি। চমকে গিয়ে দু পা পিছোতেই কারো সাথে ধাক্কা খেলাম। দেখলাম, পেছনে উনি দাঁড়িয়ে আছে। 

অপ্রস্তুত হয়ে এদিক সেদিক তাকাতেই আবার বাজ পড়লো। এবার ভয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরলাম শক্ত করে।

উনি কি মনে করে জানিনা কোলে তুলে নিয়ে এগোলেন বিছানার দিকে।তারপর 

টেবিলে জ্বলতে থাকা আলোটা নিভিয়ে দিলেন।


স্বামী কাছে আসা অন্যায়ের কিছু না। তবে আমি ওনার কাছে আসাটা মানতে পারিনি।

কেন জানিনা, ওনাকে ধাক্কা দিয়ে দুরে সরিয়ে দিয়েছিলাম।

উনি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন নিষ্পলক,হতবিহ্বল দৃষ্টিতে। "


কাদম্বিনী দেবী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

হৃদিতা আবার জিজ্ঞেস করলো, 

"তারপর?"


কাদম্বিনী দেবী আবার বলতে আরম্ভ করবেন তার আগেই ফোন বেজে উঠলো।

হৃদিতা ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, মায়ের ফোন।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো অনেক বেলা হয়ে গেছে,  খানিক বাদেই সন্ধ্যা নামবে।

তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ করতেই , ওপাশ থেকে শুনতে পেল,

"কটা বাজে হৃদ! বাড়ি আসবে কবে? সেই কখন গেছ বাইরে, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে ।  জলদি এসো। রাখছি!"


হৃদিতা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে কাদম্বিনী দেবীর দিকে তাকিয়ে বরলো,

"আজ আর শোনা হবে না গো দিদা। কাল আবার আসবো হুম? কাল বলো!বলবে তো?"


কাদম্বিনী দেবী হৃদিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

"হুম, বলবো!"


হৃদিতা হাসি মুখে বৃদ্বাশ্রম থেকে বেরিয়ে যেতে তার পথ আগলে দাঁড়ালো একটি ছেলে। হৃদিতার কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গেল বৃদ্ধাশ্রমের পাশে থাকা একটা ভাঙা বাড়িতে।

ভয়ে হৃদিতার আত্মা শুকিয়ে আসতে নিল। 

তার মাথায় ঘুরতে লাগলো, "কে ছেলেটা? কি চায় সে?"


বাস্তব জীবনের গল্প পড়ুন।