বউ শাশুড়ির ভালোবাসা | বউ শাশুড়ির সম্পর্ক

 বউ শাশুড়ির সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত

বউ শাশুড়ির সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত

" শাশুড়ির নামের এই আপদ কতদিন ই বা আর সহ্য করবি ? বৃদ্ধাশ্রমের অভাব আছে? ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আয়। এত সুন্দর ফ্ল্যাটে কি রকম একটা বাজে গন্ধ হয়ে গেছে এটা কি তোর নাকে যায় না? না-কি ঘ্রাণশক্তি হারিয়েছিস? নিজের জীবন তো শেষ করবি-ই মাঝ দিয়ে বাচ্চা টা ও অসুস্থ হয়ে যাবে। তোর এই কেয়ারলেস ব্যাপার টা আমার একদম সহ্য হয় না মোনা "


 

আমার শাশুড়ির মুখে আমার মাকে উদ্দেশ্য করে  বলা কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি । আমি শিহাব। আমি আর মোনালিসা পালিয়ে বিয়ে করার পরে এই দ্বিতীয় বার উনি মানে আমার শাশুড়ি আমার বাসায় এলেন। প্রথম বার এসেছিলেন আমার মেয়ে পুষ্পর জন্মের পরে আর এবার এলেন পুষ্পর প্রথম জন্মদিনে। খুব উচ্চ বিলাসিতা না হলে ও বাবার রেখে যাওয়া আঠারো'শ স্কয়ার ফিট ফ্ল্যাট ও হ্যান্ডসাম স্যালারির একটা কর্পোরেট জবে মোনা মানিয়ে নিয়েছে। প্রথম দুই বছর বাবার বাড়ির সাথে যোগাযোগ ছিলো না। পুস্প পেটে আসলে যোগাযোগ শুরু হয়। আমার মা শয্যাশায়ী আজকে দুই বছর। লোয়ার সাইড প্যারালাইজড। মোনা নিজের হাতে মায়ের কাজ গুলো করে। আমি চব্বিশ ঘন্টার জন্যে লোক রাখতে চেয়েছিলাম কিন্তু মোনা রাজি হয়নি। তাই তিনজন ছুটা বুয়া আছে দুই জন ঘরের কাজে আর একজন মায়ের কাজগুলো দুই টা পর্যন্ত করে। লোক রাখার সময় মোনা বলেছিলো,

--- ” আমি যখন পারবো না তখন রেখো। মা তো কেয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকে না কারও। যতোদিন থাকে মায়ের কাজ আমি করবো ”


কিন্তু আমার শাশুড়ী মা এসব কি বলছেন? একজন মা হয়ে কি পরামর্শ দিচ্ছেন নিজের মেয়েকে? আমার  সমস্ত শরীরের রক্ত কাঁপতে শুরু করলো। মাথা দপদপ করে জ্ব*লে উঠলো। কান থেকে কথা না যেন সীসা গলিয়ে ঢেলে দিচ্ছে । কেমন একটা ঘেন্না মিশ্রিত রাগ এসে ভর করলো। মনে মনে ঠিক করলাম এখুনি গিয়ে মোনালিসা কে সহ ওর মা কে আমার বাসা থেকে ঘাড় ধরে বের করে দিবো। এতো বড়ো সাহস আমার বাড়িতে এসে আমার মা কে বলে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসতে? পা বাড়াতে ই মোনালিসার কন্ঠ ভেসে আসলো। কি জানি বলতে চাচ্ছে আর ওর কথার মধ্যে ওর মাকে কথা বলতে নিষেধ করছে। 

ওর মায়ের সঙ্গে ওর মতটা ও কেন জানি শুনতে ইচ্ছে করলো। তাহলে ষোলকলা পূর্ণ হবে। নিজের সমস্ত রাগ ক্ষোভ কে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে ধরে দমালাম। পর্দা সামান্য কিছু আড়ালে ঢেকে দাঁড়ালাম।  কান খারা করে সজাগ হলাম আরেকটু। 


”  মা তোমার সেই আমাদের ছোটোবেলায় দাদির সাথে বেঁচে থাকা দিনগুলো মনে পরে? আমার মনে আছে মা। তুমি যখন দাদির সাথে খিটমিট করতে দাদির সাথে তর্ক করতে তখন আমাদের ঘরের পরিবেশ টা কেমন বিষাক্ত আর করুন হতো। আব্বা তোমাকে শাসন করলে তুমি রান্না করতে না। তখন দাদির রান্না করা লাগতো। দাদির রান্না করতে কষ্ট হতো। তুমি তবুও সেই রান্না খেতে না। নানা বাড়ি চলে যেতে। তখন আমরা আরও অসহায় হয়ে পরতাম। দাদির কষ্ট তখন বাড়তো। পুরো বাড়ি সহ আমাদের সবার দায়িত্বে দাদি নাস্তানাবুদ হতেন । আর আব্বা এসব নিয়ে অসহায় দিশেহারা হতেন। নিজের ব্যবসায় ও মন দিতে পারতেন না আবার আমাদেরকে ও দেখাশোনা করতে পারতেন না। তোমাকেও মানাতে পারতেন না। আবার ওদিকে দাদি নিজের মা তাকে-ও ফেলে দিতে পারতেন না।  তুমি তোমার মতন থাকতে দাদির কষ্ট হলেও দাদি দাদির মতন। মাঝে দিয়ে আমরা তিন ভাই বোন আর আব্বা কি এক অনলে পু*ড়তাম মা তুমি যদি বুঝতে!! দাদি আগের দিনের মানুষ তোমার সাথে সব মত মিলতো না। বারবার ঘুরে ফিরে একই কথা বলতেন। তোমার পছন্দ হতো না একই কথা বারবার শুনতে। 

 তুমি তো এ-যুগের শিক্ষিত মেয়ে। চাইলেই তুমি কিছু কৌশল অবলম্বন করে এড়িয়ে যেতে পারতে। না করে তুমি চাইলে সত্তর বছর একই মতাদর্শের একজনকে পরিবর্তন করতে।  আরও সহজ হতো যেহেতু আব্বা তোমার প্রতি দুর্বল ছিলো আব্বা বুঝতো দাদির কোন কথা অন্যায় হইছে। সেটা তোমাকে বোঝাতে গেলেও তুমি কোনোদিন মানোনি । তুমি কৌশল অবলম্বন করাকে ছোটো হওয়া ভাবতে। যেটা আমি তখন না বুঝলেও এখন বুঝি। কারন আমি এখন সংসার করি। আমিও কারও স্ত্রী কারও মা। 

তোমার আর দাদির রেষারেষি তে সবচেয়ে বেশি কষ্ট কে পেতো জানো মা? কষ্ট পেতো আব্বা। যে তোমার প্রিয় স্বামী। তোমার প্রানের অধিক প্রিয় সন্তানরা মানসিক অশান্তিতে ভুগতো। অথচ একটু  

ঘুরিয়ে কিন্তু বিষয় টা অত জটিল না হলেও হতো। দিন কি তেমন ই আছে? তোমার ছেলেমেয়েরা ছোটো আছে? তোমাকে জ্ঞান দেওয়া শাশুড়ী আছে?  তোমার স্বামী আছে?  কিছু ই নেই। 

এই সুন্দর ফ্ল্যাট টা আমার শ্বশুর অনেক কষ্ট করে কিনেছেন যাতে আমার শাশুড়ী আর শিহাব সুখে থাকতে পারে। ফ্ল্যাট টা কিনে আমার শাশুড়ীর নামে লিখে দিয়েছেন। নমিনি রেখেছেন শিহাবের প্রথম সন্তান কে। মানে আমার পুষ্প। তুমি বলছো সেই ফ্ল্যাট থেকে আমি আমার শাশুড়ী কে মানে যিনি আমার স্বামীর মা তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবো? তারপর এখানে আনন্দে সুখে শান্তিতে থাকবো? আমি পারবো না মা। ওনার নারী ছেঁড়া সন্তান টা আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। যাকে ছাড়া আমি শূন্য। ওনার কষ্ট করে মানুষ করা সন্তান টা আমার সন্তানের পিতা। আমার বিবেক কোনোদিন ও পারবে না। তুমি যেমন আমার কাছে আমার শাশুড়ী ও তেমন। তুমি যদি অসুস্থ থাকতে তাহলে কি আমি তোমাকে ফেলে দিতাম? আজকে তুমি যদি আমার শাশুড়ির মতন অচল হয়ে যাও রোশানের বউয়ের কাছে ও তো আশা করো তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসবে কোনো বৃদ্ধাশ্রমে তাই না? যেমনটা দাদির সময় তুমি চেয়েছিলে কিন্তু আব্বা তোমার সেই ইচ্ছে পূরণ করেনি। 

জানো মা তোমার কাছ থেকে চলে আসার পরে ওনার কোলে মাথা দিয়ে আমি ঘুমাতাম। 

আমার এই যে লম্বা চুল গুলো দেখছো না? আমি এখন ও আমার লম্বা চুলগুলো বাঁধি না। পারি ও না। অভ্যাস করতে হয়নি। তুমি বড়ো আপু যেমন করে যত্ন নিতে আমার চুলের তারথেকেও বেশি সতর্ক থাকতো আমার শাশুড়ী!  আমার শাশুড়ী আমার চুলগুলো এখনো বেনী করে দেয়। খোপা করে দেয়। অথচ নিজে উঠে ওয়াশরুমে ও যেতে পারে না। হুইলচেয়ারে থাকলে মাঝে মাঝে আমার রুমের বাতি টা ও বন্ধ করে যায়। আমি ঘুমি থাকি টের পাই না। শিহাবের সাথে কিছু হলে কোনোদিন ও আমার শাশুড়ী আমার বিপক্ষে যায় না তাতে আমার দোষ বেশি থাকলেও। শিহাবকে শাসণ করে। তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে বলছো? উনি আমার স্বামীর মা আমার সন্তানের দাদি এই সংসার টা ওনার। ওনার সংসারে এসে আমি ওনাকে ছুঁড়ে ফেলে দিবো?  "


মোনা কাঁদছে! আমার শাশুড়ী নিশ্চুপ হয়ে গেছে। আমার চোখ দিয়ে ও পানি পরছে। আমি হীরে চিনতে ভুল করেছি। একটু আগে মোনার উপর হওয়া খারাপ ধারনার জন্য নিজের কাছে নিজেকে ছোটো লাগছে।  এতদিন একসাথে থেকেও আমি মোনা কে কি করে চিনলাম না? কয়লার গুদামেও যদি হীরে থাকে হীরে কয়লা হয় না। 


---”  নিজের সংসারে তোমরা শাশুড়ী পুত্র বধূ মিলে সারাজীবন দুর্ভিক্ষ তৈরি করে রেখেছো, সুখের দুর্ভিক্ষ। যার ফলাফল ভোগ করেছি আমরা। আমি তেমন ভোগান্তিতে আমার স্বামী সন্তানদের ফেলতে পারবো না । আমাকে এ সব বোঝাতে এসো না। বলা যায় না মানুষের মন কখন ঘুরে যাবে,  যেহেতু আমার শাশুড়ির সাথে আমার নাড়ীর বাঁধন নেই। এসব বলতে আর কোনোদিন আমাদের বাড়ি এসো না মা। এসব শিহাব শুনলে খুব কষ্ট পাবে। তুমি আমার মা। আমি চাই না ভুল করে রাগের মাথায় হলেও শিহাব তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করুক। তোমার যদি আমাদের দেখতে খুব ইচ্ছে করে ফোন দিও আমি গিয়ে দেখা করে আসবো। "


মোনার পায়ের শব্দ পেয়ে দ্রুত সরে গেলাম পর্দার আড়াল থেকে। মোনার হাতে তেলের বাটি। এখন মায়ের রুমে যাবে। প্রতিদিনের রুটিন এটা। বিকেলে মাকে রেডি করে হুইলচেয়ারে বসিয়ে বারান্দায় নিয়ে নিজে বসে মায়ের পায়ের কাছে।


 মোনার মাথার চুল গুলো আমার খুব পছন্দ।  মাকে প্রথম যেদিন মোনার কথা বলেছিলাম প্রথম চুলের কথা তুলেই বলেছিলাম, --- ” একজন আছে যার লম্বা চুল গুলো আমার খুব পছন্দ মা " 

মা হেসে বলেছিলেন,

--- ” শুধু মাথার চুল তো বাড়ি নিয়ে আসা যাবে না মানুষ টা কে নিয়ে  আয়। চুল আপনা-আপনি চলে আসবে ”


বিয়ের পরে থেকে মা মোনার জন্য কি কি লতাপাতা মিশিয়ে তেল বানিয়ে দেয়।  আমাকে দিয়ে ও আমলকী হরৎকি আরও হাবিজাবি কি কি কিনিয়ে আনায় । এখন মোনা শিখে গিয়েছে। নিজেই বানায়। সেই তেল মা মাথায় তেল দিয়ে মাসাজ করে মোনা চোখ বন্ধ করে থাকে। গোধূলির আলোমাখা আমার ছোট বারান্দায় পুষ্প কে কোলে নিয়ে বসে আমি দেখি সেই দৃশ্য। এটা আমার পৃথিবী তে দেখা  দৃশ্যের ভেতর প্রিয় দৃশ্য..... 


  সংসার


এমন আরও বউ শাশুড়ির গল্প পড়ুন।