বিপদের সময় কেউ পাশে থাকে না? বাস্তব গল্প

 বাস্তব জীবনের গল্প

বাস্তব জীবনের গল্প

আমার শ্বশুরের কোনো ছেলে নেই ফলস্বরূপ ছেলের দায়িত্বটা অনেকাংশে আমাকেই পালন করতে হয়। এই নিয়ে যদিও আমি মনে মনে বেশ বিরক্ত তবে রাইসাকে খুব বেশি ভালোবাসার দরুন মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারিনা। যদিও আমার স্ত্রী আমার বিরক্তিটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে তবুও শ্বশুর আব্বার টুকটাক কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে অনেকটা জোরপূর্বকই শ্বশুরের নিকট পাঠিয়ে দেয়। 


আমার শালিকা রুহির বয়স সবেমাত্র ঊনিশ এবং ওর কলেজের প্রায় সব খরচ আমাকেই দিতে হয়। তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো আমার পরিবারের সদস্যগণ অর্থাৎ আমার বাবা মা এসব বিষয় জানা সত্ত্বেও তাঁরা কখনোই আমাকে জেরা করেননি যে আমি কেন শ্বশুর বাড়িতে এতো টাকা ঢালি? আমার কেন যেন মনে হয় রাইসা আমার বাবা মাকে নিজের দায়িত্ববোধ এবং ভালোবাসা দিয়ে এতোটাই ঘায়েল করে রেখেছে যে বাবা মা হয়তো মন থেকেই চান আমি শ্বশুর শাশুরীর ছেলের দায়িত্বটা নিজেই পালন করি। বাবা মায়ের এভাবে নিশ্চুপ থাকার ফলে আমিও এসব বিষয়ে কোনোদিনই প্রশ্ন তুলিনি।

.

আমার ছোটবোন মিহি ইদানিং প্রায়শই শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে আমাদের বাসাতেই থাকছে। মিহির শ্বশুর শাশুরী যে অতোটা সুবিধার না সেটা আমি বেশ আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলাম। মিহির স্বামীটাও না কেমন যেন, মিহির ভাষ্যমতে সে তাকে ভালোবাসলেও বাবা মায়ের কথাটাই একটু বেশি শুনে। তাই মাঝে মাঝে মিহির শাশুরী ওর কাজকর্মে খুঁত ধরে ওকে কটু কথা শোনালেও মিহির স্বামী সর্বদা নিশ্চুপ শ্রোতার ভূমিকাই পালন করে। আর এসব কারণেই সে কিছুদিন পর পরই আমাদের এখানে চলে আসে।


মিহি এখন আট মাসের গর্ভবতী এবং আল্ট্রাসনো রিপোর্টে আমরা ইতোমধ্যে জেনে ফেলেছি যে ওর মেয়ে হবে। এসব ঘটনা যখন ওর শ্বশুর শাশুরীর কানে গেলো তখন থেকে তাঁরা অনেকটাই মিহির খোঁজখবর নেওয়া বন্ধ করে দিলেন। পরবর্তীতে মিহির স্বামী আতিকের মুখ থেকে জানতে পারি যে ওর মেয়ে হবে বলে তাঁর বাবা মা চরম অখুশি। তবুও আতিক মাঝেমধ্যেই মিহির অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের এখানে প্রায়শই আসতো।

.

ডাক্তার ডেট দিয়েছেন যে আগামী শুক্রবারেই মিহির ডেলিভারী হবে। কিন্তু হঠাৎই ওর শ্বশুর বাড়ি থেকে আমার ফোনে কল আসে। 


কলটি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ কান্নামাখা স্বরে আমাকে বলে ওঠে,

– “ ভাইজান, আতিক এক্সিডেন্ট করেছে এবং ওর অবস্থা খুবই গুরুতর। আমরা ওকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছি আপনি দ্রুত চলে আসুন। ”


অপর পাশ থেকে এমন কথা শুনে মুহূর্তেই আমার পুরো শরীর জুরে নিস্তব্ধতা বিরাজ করলো। আমি তখনো ভেবে পাচ্ছিলাম না যে মিহির এমন অসুস্থ অবস্থাতে ওকে এসব ঘটনা জানানো ঠিক হবে কিনা?


অজস্র দৌড়াদৌড়ি করার পরও আমরা আতিককে বাঁচাতে পারলাম না। মিহির কানে যখন এই খবর চলে গেলো তখন আমাদের ওকে শান্ত করাটাই বেশ দুরূহ ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কারণ একটি মেয়ের সন্তান জন্মদানের ঠিক আগমুহূর্তে স্বামীর মৃত্যুর কষ্টটা যে কতটা প্রখর হতে পারে তা সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ডেলিভারীর আগের কয়েকদিন স্বামীর শোকে মিহি বেশ দুর্বলই হয়ে গিয়েছিলো। এরমধ্যে আমি নিজের বোন জামাইকে বাঁচাতে গিয়ে ব্যাংকের অবশিষ্ট সঞ্চয়গুলোও খরচ করে ফেলেছিলাম। কারণ আতিকের পরিবার এতোটাও অবস্থাসম্পন্ন ছিলো না।


মিহির ডেলিভারী ডেট যতই ঘনিয়ে আসছিলো আমার চিন্তার রেশ যেন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। কারণ ডাক্তার সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে ওর শরীরের যা অবস্থা তাতে যদি নর্মাল ডেলিভারী করা হয় তবে মিহির সন্তান কিংবা মিহি দুজনকেই বাঁচানোটা দায় হয়ে যাবে তাই এখন একটাই উপায় যে ওর সিজার করতে হবে। কিন্তু আতিককে বাঁচাতে গিয়ে তখন আমার হাত ছিলো শূণ্যের কোঠায় আর তাছাড়া সিজার করতে হলেও কমছে কম সব মিলিয়ে ত্রিশ হাজার টাকার উপরে লেগে যাবে। আমি জানি যে মিহির শ্বশুর বাড়ির লোকজন ওর সিজারে একটি টাকাও খরচ করবে না কারণ একদিকে ওনারা যেমন মেয়ে হবে বলে আগেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো অপরদিকে তাঁদের ছেলেই যেখানে বেঁচে নেই সেখানে কেনইবা ওনারা নিজের পুত্রবধুর জন্য টাকা খরচ করবে?

.

পাশের রুমে আমার বোন মিহি গর্ভযন্ত্রনায় ছটফট করে চিৎকার করছে আর আমি এই রুমে চিন্তায় চিন্তায় না ঘুমিয়ে চোখদুটো ইতোমধ্যে লাল করে ফেলেছি।মিহির এমন অবস্থা দেখে আমার স্ত্রী রাইসা পাশের রুম থেকে দৌড়ে এসে আমাকে বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে বলে উঠলো,

– “ শোনো! মিহির অবস্থা বেশি ভালো না। তুমি যতদ্রুত সম্ভব ওকে এখনি হসপিটালে নিয়ে চলো। বেশি দেরী করলে যেকোনো মুহূর্তে অঘটন ঘটে যেতে পারে। ”


কিন্তু রাইসার কথায় আমি তোয়াক্কা না করে তখনও পর্যন্ত আমি সেই পূর্বের ন্যায় স্থির হয়ে বসে রয়েছি। 


আমার এমন ব্যবহারে এবার রাইসা বেশ উত্তেজিত কন্ঠেই বললো,

– “ কি হলো কিছু বলছো না কেন? এভাবে ঘাপটি মেরে বসে থাকলেতো নিজের বোনের সাথে সাথে ভাগ্নীকেও হারাবে। ”


আমি নীরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলাম,

– “ এখন হয়তো সেটাই হবে। এই পর্যন্ত আমি অন্ততঃ পক্ষে দশজনের নিকট টাকা চেয়েছি কিন্তু সবাই টাকা নেই বলেই আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তুমিতো জানোই আমার হাতে এখন একটা টাকাও নেই তাহলে মিহির সিজারের এতোগুলো টাকা কিভাবে দিবো তুমিই বলো। ”


আমার এমন কথায় রাইসা মুহূর্তেই নিশ্চুপ হয়ে গেলো। 


বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর হঠাৎই রাইসা বলে উঠলো,

– “ শোনো টাকার জন্য এভাবে মিহিকে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবেনা। তুমি বরং এখনি খোদা তায়ালার উপর ভরসা করে হসপিটালে নিয়ে যাও।তিনি একটা না একটা ব্যবস্থা করবেনই। ”


অতঃপর প্রভুর উপর ভরসা করেই মিহিকে সেই মুমূর্ষু অবস্থাতেই হসপিটালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তাররা যদিও টাকা জমা না দেওয়ার আগপর্যন্ত কোনো রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান না কিন্তু মিহির এমন মুমূর্ষু অবস্থা দেখে এবং আমার ওয়াদাবদ্ধ হওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁরা ওর সিজার করার জন্য রাজি হলেন। এরমধ্যে আমি আরো কিছু জায়গাতে টাকার খোঁজ করেও সফল হলাম না। হয়তো বিপদের মুহূর্তে একমাত্র প্রভু ব্যতীত আর কেউই সেই বিপদগ্রস্থ ব্যক্তির পাশে থাকে না।


দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে যখন হসপিটালের বারান্দায় উপস্থিত হই তখন আমার মা অনেকটা দৌড়ে এসে বলে উঠলেন,

– “ বাবা, কোথাও কি টাকা ধার পাইলি? ”


– “ না মা, যাদের কাছে গিয়েছি তাঁদেরকে আমি তাঁদের বিপদে সহযোগীতা করলেও তাঁরা আমাকে সামান্য কটা টাকাও ধার দিলো না। ”


আমার কথা শুনে এবার মা নিজের চোখের অশ্রুবাঁধ আর আটকে রাখতে পারলেন না। হয়তো তিনি ভাবছেন সামান্য এই কয়টা টাকার জন্য আজ তাঁর মেয়েকে নিয়ে যে এতোটা বিপদসংকুল মুহূর্তে পরতে হবে এটা বোধহয় কখনোই কাম্য ছিলোনা।


কিছুক্ষণ অন্তর আমার স্ত্রী রাইসা এবং আমার শ্বশুর শাশুরী হসপিটালে উপস্থিত হলেন। তাঁদেরকে দেখে আমার মনে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলোনা কারণ আত্মীয়স্বজনদের বিপদে তাঁরা দেখা করতে আসবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎই আমার শ্বশুর আব্বা আমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে একটি কাপড় দিয়ে পেঁচানো টাকার বান্ডেল আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন,


– “ বাবা এটা তুমি রাখো। এখানে একচল্লিশ হাজার টাকা আছে, তোমার শাশুরী তাঁর ছোট মেয়ের বিয়ের জন্য আগে থেকেই এই টাকাগুলো জমিয়ে রেখেছিলো। তাছাড়া তুমি আমাদের ছেলের মতোই আমাদের বিপদে আপদে যেভাবে পাশে ছিলে সেসবের কাছে এই সামান্য টাকাগুলো কিছুই নয়। আমার পরিবার মানেইতো তোমার পরিবার, আর তোমার বোন মানেই আমার মেয়ের সমতুল্য। আর এই বিপদের মুহূর্তে যদি আমি আমার মেয়েকে সামান্য সাহায্যটুকুও করতে না পারি তবে আমি কেমন বাবা হলাম তুমিই বলো? ”


শ্বশুর আব্বার এমন কথায় তখনো আমি হতবিহ্বল হয়ে স্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কাঁপা কাঁপা হাতে টাকাগুলো নিতেই ভাবলাম এতোদিন আমি সত্যিই কোনো ভুল মানুষের হয়ে ছেলের দায়িত্ব পালন করিনি ইনিই হলেন সেই বাবার সমতুল্য শ্বশুর যারা কখনোই উপকারের প্রতিদানটা দিতে একমুহূর্ত পিছু হঁটেন না। আজ আমি সত্যিই ধন্য, হ্যাঁ সত্যিই ধন্য। 

.

(সমাপ্ত)


----------------------------

-ছোটগল্প

-দায়িত্বের_প্রতিদান

-Misk_Al__Maruf 

----------------------------


এমন আরও অনেক গল্প পড়ুন।