বাস্তব শিক্ষনীয় গল্প
– “ মেয়েরা বেশি শিক্ষিত হলে সংসারে সুখ শান্তি আসে না। ” আরিফের হঠাৎ এই ধরনের কথায় চমকে ওঠে তানিশা।
– “ আমি এমবিবিএস ফোর্থ ইয়ারে পড়ছি আর তুমি এ সময় এ ধরনের কথা বলছো!সাড়ে তিন বছরের রিলেশনে তো কোনদিন বলোনি। ”
– “ সম্পর্ক চলাকালীন সময়ে বলিনি সেটা ভিন্ন কথা।এখন আমি তোমাকে বিয়ের চিন্তাভাবনা করছি , দুটো দুই জিনিস। ”
– “ আমি তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না। ”
– “ দেখো তানিশা আমি চাইনা আমার বউ চাকরি-বাকরি করুক বরং আমি চাই সে আমার বাবা-মায়ের সেবা যত্ন করবে।আমি অফিস থেকে ফিরলে আমার ক্লান্তি দূর করার কারণ হবে। আমার সন্তানদের ঠিকমত যত্ন করবে,নিশ্চয়ই আমার চাওয়ায় কোন ভুল নেই? ”
– “ অবশ্যই না ” (মোলায়েম কন্ঠে বললো তানিশা) “ সোজা সাপ্টা ভাবে বলো তুমি একটা পরিপক্ক সংসারী মেয়ে চাও। ”
– “ হ্যাঁ , সেটা চাওয়া কি অপরাধ? ”
– “ আমি তো একবারেই বললাম কখনোই সেটা অপরাধ না বরং তুমি খুব ভালো করেছো বিয়ের আগে বলে দিয়ে কিন্তু আমার সাথে সম্পর্ক হওয়ার আগেই তোমার এটা বোঝা উচিত ছিল মেডিকেল থেকে পাশ করা একটি মেয়ে নিশ্চয়ই তার মেধা, শ্রম, স্বপ্ন, অসংখ্য রাত জেগে পড়াশোনা করার ক্লান্তি, বাবা-মায়ের অর্থের বিনিয়োগ সবকিছু রান্না বান্না আর গৃহ পরিচর্যায় খরচ করবে না, অন্তত ৯৯% মেয়ে তা করবে না।একটা ছেলে সংসারী মেয়ে চাইতেই পারে কিন্তু সেই সংসার উপহার দেয়ার জন্য আরেকটা মেয়েকে তার স্বপ্ন বলিদান দিতে হবে কেন?এরকম অনেক মেয়ে খুঁজলে তুমি পাবে যারা নিজেরাই পরিপক্ক গৃহিণী হতে চায় আর তোমাকে কে বললো যে মেয়েরা কর্মস্থলে কাজ করলে সংসার সামলাতে পারে না? ”
– “ অত কথা আমি বুঝিনা, তুমি ডাক্তার হবে তো কি হয়েছে আমি চাইনা তুমি প্র্যাকটিস করো ”
– “ আর যদি করি? ”
– “ ব্রেকআপ! ” (নিষ্ঠুরভাবে বললো আরিফ।)
---------
-------------
------------------
ওদের প্রেমটা শুরু হয়েছিল তানিশা যখন মেডিকেল ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।এক কাজিনের বিয়েতে গিয়ে প্রথম পরিচয়।পরিচয় থেকে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব তারপরে প্রেম।আরিফ যখন ব্রেকআপ বললো, তখন তানিশা আর দাঁড়ায়নি আরিফ নিজেও আর পেছন থেকে ডাকে নি।
কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে আরিফের পরিবার থেকে সম্বন্ধ আসে। আরিফের পরিবারে ওরা চারজন, আরিফের বাবা-মা আর ছোট একটা বোন, সবাই এসেছে। তানিশার বাড়ি থেকে যথেষ্ট পরিমাণ আপ্যায়ন করা হলো।
– “ মামনি তোমাকে কিন্তু আমাদের ভীষণ পছন্দ ” আরিফের মা রাহেলা বেগম বললেন।
তানিশা কি বলবে কিছু বুঝতে না পেরে মাথা নিচু করে বসে রইলো।
– “ আমরা চাই এই মাসেই তোমাদের বিয়েটা সম্পন্ন করে ফেলতে, শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই ভালো। ”
– “ কিন্তু আপা আমাদের তো একটা প্রস্তুতির ব্যাপার আছে ” তানিশার মা বলে উঠলেন।
– “ সে তো বুঝতেই পারছি আপা কিন্তু আমার মেয়েটাকে দেখছেন তো।ও আবার হায়ার স্টাডিজ এর জন্য দেশের বাইরে চলে যাবে তাই থাকতে থাকতে ভাইয়ের বিয়েটা দেখে যেতে চায়। ”
তানিশা আর আরিফের সম্পর্কটা ওপেন সিক্রেট ছিল।সেদিন ব্রেকআপের ব্যাপারটাও তানিশা ওর বাবা মাকে জানিয়েছিল।ওর বাবা-মা ওর সাথে খুবই বন্ধুত্বপরায়ণ, সুখে-দুঃখে সবসময়ই তারা মেয়েকে সাপোর্ট দিয়ে গেছেন।
– “ আপা কি বললেন, আপনার মেয়ে কোথায় যাবে? ” রহমত সাহেব মানে তানিশার বাবা বললেন
– “ ও উচ্চতর পড়াশোনা করার জন্য সিডনী যাচ্ছে ”
– “ কিন্তু মাত্র দুই-তিন দিন আগে আপনার ছেলে আমার মেয়েকে বলেছে যে মেয়েরা বেশি শিক্ষিত হলে নাকি সংসার সুখের হয় না ”
– “ আসলে ভাই হয়েছে কি, আমাদের মেয়ে তো চলেই যাচ্ছে।মানে ও দেশের বাইরে পড়াশোনা করার জন্য গেলেও ওখানেই সেটেল হওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে।এদিকে আমার তো ঘর খালি তাই আমি চাই আমার ঘরে একটা মেয়ে থাকুক।মেয়ের মতোই তাকে যত্ন করবো, কখনোই বউয়ের মত দেখবো না।আমি আর আরিফের বাবা কখনোই চাই না সেই মেয়ে কর্মস্থল থেকে ক্লান্ত হয়ে ঘরে আসুক বরং সে বাড়িতে থাকবে আমাদের সাথে হাতে হাতে কাজকর্ম করবে, হাসিখুশি জীবন যাপন করবে। ”
– “ আপা , আপনারা যেহেতু আমার মেয়েকে নিজের মেয়ের মতোই দেখবেন তাহলে আমাদের মনে হয় একই সাথে তার চাকরি বাকরি করা আর সংসার সামলানো একদমই কঠিন হবে না। এরকম প্রচুর মেয়ে আছে যারা কাজের ক্ষেত্র সামলেও সুনিপুণভাবে সংসার সামলে যাচ্ছে। যেমন আমার বৌমার কথা ধরুন না, কি সুন্দরভাবে স্কুল সামলে আবার সে সংসারের কাজেও আমাদেরকে সাহায্য করছে বলা চলে সংসারের বেশিরভাগ কাজটা সেই করছে। ”
– “ দেখেন ভাই মেয়েদের চাকরি তো বড় কথা না, সংসার ধর্মটাই হচ্ছে বড় কথা ”
– “ তাহলে আপনার মেয়েটিকে পড়াশোনা করাতে এত টাকা খরচ করে বাইরে পাঠাচ্ছেন কেন? ”
– “ আপনারা তো দেখি আগেই তুলনায় চলে এলেন, যে জায়গায় আমরা বললাম যে আমার মেয়ের জায়গাটাই আপনার মেয়েকে দিতে চাই ”
– “ খুবই ভালো কথা আপনার মেয়ের জায়গা যদি আমার মেয়ে পায় তাহলে আমার মেয়েরও তো হায়ার স্টাডিস করার জন্য দেশের বাইরে না গেলেও দেশের ভেতরে ব্যবস্থা থাকা উচিত। ”
কথা ক্রমশ ঘোলাটে হতে লাগলো, থামিয়ে দিল তানিশার বড় ভাই তামিম।
– “ আঙ্কেল-আন্টি আমাদেরকে ক্ষমা করবেন, আমার মা বাবা আর বোনের অনুমতি ছাড়াই কথাগুলো বলছি।আমার মনে হয় না আমার বোন আপনাদের ফ্যামিলি তে অ্যাডজাস্ট করতে পারবে।আপনারা যেমন মেয়ে খুঁজছেন সেরকম অসংখ্য মেয়ে পেয়ে যাবেন।অযথা একটা মেয়ের স্বপ্ন কিংবা একটা পরিবারের স্বপ্নকে নষ্ট করে দেবেন না। ”
মুহূর্তে জ্বলে উঠলো রাহেলা বেগম
– “ এই দেশে হাজার হাজার এমবিবিএস ডাক্তার ঘরে বেকার বসে থাকে, দেখব কি এমন মহা পন্ডিত হয়ে যায় তোমার বোন, এই সবাই চলো , এতোটুকু স্যাক্রিফাইস করতে পারেনা আবার ঘাড় থেকে মেয়ে নামাতে এসেছে, আমার মেয়ে বাইরে যাওয়ার আগেই আমি আমার ছেলেকে বিয়ে করাবো এবং সে তার ভাইয়ের বিয়ে খেয়ে তার পরেই যাবে। ”
তানিশা অবাক হয়ে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে থাকলো।এই এতটুকু কথায় তার মুখের ভাষা এভাবে পাল্টে যাবে কেউ ভাবতে পারেনি।
সত্যি সত্যি ওদেরকে অবাক করে দিয়ে মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় আরিফ বিয়ে করে ফেললো। তানিশা ভেবেছিল এত কিছু হয়ে যাবার পর ওর বোধহয় কোন প্রকার কষ্ট হবে না। আরিফ ওকে অনেক আগেই ব্লক করে দিয়েছে ।এক বান্ধবীর ফেসবুকে আরিফের বিয়ের ছবি গুলো দেখলো ও। মনের অজান্তে চোখ ভিজে উঠলো, সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, মনে হচ্ছে চারপাশে অসীম শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই।
----------
--------------
--------------------
পরিবারের সাপোর্টে, ভালোবাসায় আর মোটিভেশনে তানিশা আবার পড়াশোনায় মনোযোগী হলো। কিন্তু মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়, বুকের ভেতর কেমন চাপ চাপ একটা ব্যথা। হঠাৎ খুব ইচ্ছা করে আরিফকে একটি ফোন দিতে, একটা দুর্দমনীয় ইচ্ছা শক্তি ওকে প্রবলভাবে ছুড়ে দেয় আরিফের কণ্ঠস্বর শোনার জন্য।অনেক কষ্টে নিজেই নিজেকে শান্ত করে তানিশা।
------------
----------------
কেটে গেছে আরো চারটা বছর। তানিশা এরই মধ্যে এমবিবিএস ইন্টার্নশিপের পার্ট চুকিয়ে ঢাকায় স্বনামধন্য একটা প্রাইভেট হসপিটালের মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছে।তবে চাকরিটা সে ছেড়ে দেবে কারণ সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় আর বাবা-মায়ের দোয়ায় প্রথমবারের প্রস্তুতিতেই তার বিসিএস টা হয়ে গেছে। আগামী মাসেই সে জয়েন করবে।
..
..
সকাল প্রায় আটটা, তানিশার আজ নাইট ডিউটি ছিল।ওর ডিউটি ছিল চারতলায়, লেবার রুম থেকে চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসছে।এক পেশেন্টের ডেলিভারি পেইন হচ্ছে কিন্তু তার হাজবেন্ড কিছুতেই পুরুষ ডাক্তার অ্যালাও করবে না।এদিকে পেশেন্টের অবস্থা খুব খারাপ। সিস্টার আয়া কাউকেই ধরতে দিচ্ছে না তার একজন ফিমেল ডাক্তার প্রয়োজন। ওদিকে এই সময়টাতে যেহেতু রোস্টার ডিউটি তাই ডাক্তারদের আসা-যাওয়ার একটা তাড়া থাকে। তবুও তানিশা চুপচাপ লেবার রুমে ঢুকে গেল, ঘন্টাখানেকের পরিশ্রমে নবজাতক একটি শিশু কন্যা কোলে তুলে নিল।
– “ ম্যাডাম আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ” ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে আরিফ স্তম্ভিত হয়ে গেল
– “ মেয়েদের বেশি শিক্ষিত হতে নেই কিন্তু বাচ্চা প্রসবের সময় তোমরা ছেলেরা সবসময় চাও একজন মহিলা ডাক্তার, কি অদ্ভুত তাই না আরিফ! ” তানিশা মুচকি হেসে চলে যাচ্ছিলো
– “ সেঁজুতি কেমন আছে, মানে আমার স্ত্রী...৷ ” মাথা নিচু করে বললো আরিফ।
– “ ভালো আছে, ”
তানিশা একটু দাঁড়ালো।
– “ তুমি একা কেন, বাকিরা কোথায়? ”
আরিফ মাথা নিচু করেই থাকলো, তারপর ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে বললো,
– “ আসলে সেঁজুতি একান্নবর্তী পরিবার পছন্দ করে না।আমি ওকে নিয়ে আলাদা থাকি, তাই বাবা-মা আমার সাথে এখন আর যোগাযোগ করে না।আর ওর বাড়ি তো পিরোজপুরে, খবর দিয়েছি আসতে সময় লাগবে। ”
– “ ভালো, ”
তানিশার কেমন যেন আরিফের জন্য একটু মায়া লাগলো।
---
– “ কিরে মা তোকে ফোনে পাচ্ছি না, এদিকে চিন্তায় চিন্তায় তোর মা অস্থির হয়ে গেছে , এত দেরি কেউ করে ? তোর ডিউটি তো আটটা পর্যন্ত। ”
– “ আরে বাবা তোমাদের নিয়ে না আর পারিনা, এক দুই দিন দেরি হতে পারে না, আর এই বৃষ্টি মাথায় করে তুমি চলে এসেছো, ” তানিশা কপোট রাগ দেখালো।
আরিফ চমকে উঠলো ইনিতো রহমত সাহেব মানে তানিশার বাবা নন!
– “ মিস্টার আরিফ পরিচয় করিয়ে দিই, উনি আমার বাবা মানে আমার শ্বশুর আব্বা। আর বাবা, উনি মিস্টার আরিফ আমার পেশেন্টের হাসবেন্ড।বাবা তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি আমার ব্যাগটা নিয়ে আসছি, আসলে লেবার রুমে ছিলাম তো তাই ফোন ধরতে পারিনি। ” (তানিশা)
.
.
"আমার পেশেন্টের হাসবেন্ড"কথাটা আরিফের কানে দপদপ করে বাজতে লাগলো । ও এখন "মিস্টার আরিফ"। মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে কেমন একটা ভাঙাচোরা মানুষ মনে হলো তার।দেখেই বোঝা যাচ্ছে তানিশা অন্য একটা পরিবারকে কিভাবে আপন করে নিয়েছে এবং সেই পরিবার তাকে কিভাবে আগলে রেখেছে, যেটা আরিফ বা আরিফের পরিবার পারেনি অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে পারার মানসিকতা রাখে না। তানিশার কাছে এখন আরিফের একমাত্র পরিচয় সে তার পেশেন্টের হাজবেন্ড।
(সমাপ্ত)
-শেষটা_সুন্দর
-সুবর্ণ_শারমিন_নিশি