অবহেলার কষ্টের গল্প | অবহেলার কষ্টের স্ট্যাটাস

 খুব কাছের মানুষের অবহেলা

খুব কাছের মানুষের অবহেলা

পাঁচ বছর, তিন মাস, বারো দিন পরে আমার স্বামী আবিরকে আবার দেখছি। স্বামী না বলে প্রাক্তন স্বামী বলাই মনে হয় ঠিক হবে। যদিও অফিসিয়ালি বিবাহ বিচ্ছেদ আমাদের হয়নি।আবির এখন আমার বাসার ড্রয়িং রুমে বসে আছে। ভাবতে অবাক লাগছে, এই মানুষটাকে এক সময় পাগলের মত ভালোবাসতাম। আমার ধারণা ছিল, আমার মত এতটা না হলেও, সেও আমাকে ভালোবাসে। যদিও তার প্রকাশটা কখনো ঐভাবে দেখিনি। কিন্তু ভাবতাম, সবার প্রকাশ ক্ষমতা এক রকম হয় না। 


ভালোবাসা কখনো কখনো মানুষের সর্বনাশের কারণ হয়। আমারও তাই হলো। আমার জরায়ুতে ছোট একটা টিউমার হয়েছিল । ছোট হলেও দুর্দান্ত গতিতে রক্তক্ষরণ করতো সেটা। আমার বয়স তখন চুয়াল্লিশ। ডাক্তার বললেন, জরায়ুটা ফেলে দেওয়াই ঠিক হবে। আমার একটাই মেয়ে মেঘলা, তখন ভার্সিটিতে পড়ে। বাচ্চা কাচ্চা এতদিনে যখন আর হয়নি, তখন আর হবে বলে মনেও হলো না। তাই ফেলে দেওয়া হলো জরায়ুটা। 


অপারেশনের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই নতুন ধাক্কা শুরু হলো। আমার ননদ প্রায় প্রায়ই বলতে লাগলো,


– “ আবিরের মুখের দিকে তাকানো যায় না। একটা ছেলের এত শখ ছিল ওর। ”


আমি জানি, আবির ছেলে খুব পছন্দ করতো। কিন্তু তার জন্য মন খারাপ করবে, এটা কখনোই ভাবিনি। ভাবলে, রক্তক্ষরণ হতে হতে মরে গেলেও আমি জরায়ু ফেলতাম না। আবিরকে জিজ্ঞাসা করলে, ও চুপ থাকতো। আস্তে আস্তে অপরাধবোধে ভুগতে থাকলাম আমি। ভালোবাসার মানুষটা এভাবে কষ্ট পাচ্ছে, সহ্য করতে পারছিলাম না। 


তাই আমার ননদ যখন একদিন বুদ্ধি দিলো, 

– “ আবিরকে আর একটা বিয়ে দিয়ে দিই ”


তখন আমার কাছে ব্যাপারটা খুব বেশি খারাপ লাগেনি। আশংকা করছিলাম, আবির রাজি হবে কিনা। কিন্তু যেহেতু সে আমার ননদের কথায় ওঠে বসে, কাজেই বোনের আদেশ পাওয়া মাত্রই রাজি হয়ে গেল। 


সম্ভবত আমার ননদ আগে থেকেই মেয়ে দেখে রেখেছিল। তাই খুঁজতে একদম সময় লাগলো না। মেয়ে দেখে আমি অবাক হলাম। একেবারেই বাচ্চা মেয়ে। আমার মেয়ে মেঘলার থেকে বড়জোর চার পাঁচ বছরের বড় হবে। 


আবিরকে বললাম, 

– “ তোমার সাথে বয়সের ডিফারেন্স অনেক বেশি হয়ে যাবে। ”


আবির বললো, 

– “ সমস্যা নেই। ”


মেঘলা দারুণ ক্ষেপে গেল। ওকে বোঝালাম, কিছুদিন পরে তোর বিয়ে হয়ে যাবে। আমরা একলা হয়ে যাবো। তোর বাবার এত সম্পত্তি, তার একজন যোগ্য উত্তরাধিকারও তো থাকা উচিত। তুইতো জানিস, তোর বাবাকে আমি কতটা ভালোবাসি। তার মন খারাপ, আমি সহ্য করতে পারি না। মেঘলা রাগ করে হোস্টেল থেকে বাড়িতে আসা বাদ দিলো। কিন্তু তাতে বিয়ে আটকানো গেল না। আসলে এখন বুঝতে পারি, হয়তো অবচেতন মনে আমিও বুঝেছিলাম, ঠেকানোর চেষ্টা করেও লাভ নেই।


অবাক করা ব্যাপার হলো, বিয়ের দিন আমার তেমন খারাপ লাগেনি। আমাদের ভিতরে অনেক দিন হলো, সম্পর্কটা ঠিক স্বামী স্ত্রীর মত ছিল না। সম্পর্কটা ছিল অভ্যস্ততার। তাই আমার স্বামী আমার হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে, এরকম ফিলিংস তখনও আসেনি। আমি নিজে চাকরি করি। যা বেতন পাই, তা দিয়ে রাজার হালে থাকতে পারি। কাজেই খাবো কি, পরবো কি - এই চিন্তাটাও মাথায় ছিল না। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো, বিয়ের পরে।


না, এমন নয় যে, আবির আমার কাছে আসছে না, সেজন্য আমার কষ্ট হচ্ছিলো। সে তো বহুদিন থেকেই তেমন করে কাছে আসতো না। আমার কষ্ট হচ্ছিলো, নতুন বউ এর প্রতি তার কেয়ারিং দেখে। এই মানুষটা এত কেয়ারিং, এত রোমান্টিক হতে পারে, আমার ধারণাই ছিল না। নতুন বউ যা ই বলে, সে সেটাই শোনে। আমি যে কাজ ভয়ে জীবনেও করতে পারতাম না, সে সেটা অনায়েসে করে। এমনকি, যে ননদের ভয়ে জীবনে একটা কথাও বলতে পারতাম না, সে তার সাথে অনায়েসে ঝগড়া করে। যে আবির বলতো, আমার মা, বোনের মুখের উপর জীবনে কোন কথা বলবা না, সে দেখি নতুন বউ এর হয়ে বোনকে ধমকায় !


তিনটা মাস, তিনটা মাসেই আমি বুঝে গেলাম, আমি কত বড় গাধা ছিলাম। সারাজীবন শুধু সংসার ভেঙে যাবে, এই ভয়ে কম্প্রোমাইজ করে গেছি। কোনদিন নিজের অধিকার জোর করে আদায় করিনি। কোন দিন নিজের ভালো লাগার মূল্য দিইনি। নতুন বউকে আমার হিংসা হতো। এজন্য নয়, সে আমার স্বামীকে নিয়ে নিয়েছে। এজন্য যে, আমি কখনো তার মত করে পারিনি। আবিরের উপর রাগ হতো না, তীব্র রাগ হতো নিজের উপরে। কিভাবে আমি আমার জীবনের বাইশটা বছর নষ্ট করেছি, এই ভেবে।


যে সিদ্ধান্তটা অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল, দেরিতে হলেও সে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম। অফিসিয়ালি ডিভোর্স আবিরকে দিলাম না। কারণ মনের সম্পর্কটাই যেখানে আর নেই, সেখানে কাগজের সম্পর্কে কি করবো ? কিন্তু সেপারেশন এর সিদ্ধান্ত নিলাম। মেঘলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো, তাই আমার পোস্টিং তদবির করে ঢাকাতে নিলাম। আবিরকে বলে এসেছিলাম, সে এবং তার পরিবারের কেউ যেনো কোনদিন আমার আর মেঘলার সাথে যোগাযোগ না করে। আবির এতদিন সে কথা রেখেছিল। কোনদিন যোগাযোগ করেনি। কিন্তু আজ পাঁচ বছর, তিনমাস, বারো দিন পরে হঠাৎ করেই বাসায় হাজির। সম্ভবত অফিস থেকে ঠিকানা জোগাড় করেছে।


অনেকক্ষণ হলো দুজনে চুপচাপ বসে আছি। শেষে আবিরই কথা শুরু করলো।


– “ কেমন আছো রেবা ? ”


– “ ভালো আছি। অনেক ভালো আছি। নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছি। এরচেয়ে বড় পাওয়া, পৃথিবীতে আর কি থাকতে পারে ? ”


– “ মেঘলা কেমন আছে ? ”


– “ আলহামদুলিল্লাহ।মেঘলা অনেক ভালো আছে। দুই বছর আগে ওকে বিয়ে দিয়েছি আমার এক কলিগের ভাইপোর সাথে। ছেলেটা অসম্ভব ভালো। ওর পরিবারের সবাইও অসম্ভব ভালো। মেয়ে আমার সারাজীবনে যে সুখ পায়নি, এখন সে সুখ পাচ্ছে। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। গত মাসে আমাকেও বিদেশে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। আলহামদুলিল্লাহ। ওরা সত্যিই অনেক সুখে আছে। ”


– “ মেঘলার বিয়ে দিলে, অথচ আমাকে একটা খবর দিলে না ? বাবা হিসাবে আমারও তো কিছু দায়িত্ব ছিল ? 


– “ দিতে চেয়েছিলাম। মেঘলা ই না বলেছে। ছেলে পক্ষও সব জানতো, তাই সমস্যা হয়নি। ”


আবিরের মুখটা বেদনায় ছেয়ে গেল। আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম,


– “ তোমার ছেলে কেমন আছে ? ”


– “ আমার ছেলে? ও আচ্ছা। না, আমার আর কোন ছেলে মেয়ে হয়নি। আসলে তুলির বয়স কম ছিল বলে বাচ্চা নিতে চাইতো না। ”


– “ এখন তো বয়স হয়েছে । এখন নিয়ে নাও। ”


– “ গত মাসে তুলি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ”


– “ মানে ?!! ”


– “ আসলে ও একটা ছেলেকে পছন্দ করতো।ছেলেটা তখনও ভালো চাকরি বাকরি পায়নি দেখে ওর বাবা মা জোর করে আমার সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। ব্যাপারটা আমি জানতাম না। ঐ ছেলেটা এখন ভালো চাকরি পেয়েছে। তাই তুলি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ”


খুব করুনা হচ্ছিলো আবিরকে দেখে।কিন্তু ও যখন বললো, – “ রেবা, তুমি আমার সাথে যাবে ? ওটাতো তোমার ই সংসার ” , তখন রীতিমত ঘেন্না লাগছিল।


কাজের মেয়েকে ডেকে বললাম, 

– “ এই সাহেব কফি শেষ করলে, বিদায় দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিস। ”


ভিতরের ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখলাম, আবির কফি না খেয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাচ্ছে।


-

(সমাপ্ত)


ছোটগল্প

"ঘেন্না"


এমন আরও বাস্তব জীবনের ঘটনা ও গল্প পড়ুন।