গল্প:জ্বীনকন্যা | রহস্যময়ী নারী ২০২৪

 পৃথিবীর রহস্যময় মৃত্যু

পৃথিবীর রহস্যময় মৃত্যু

জ্বীনকন্যা...👽👹

পর্বঃ ০১


জানালার পাশে বসে সকালের সৌন্দর্য দেখছিলেন মিসেস নিষ্পাপ আহমেদ।সিলেট শহরটা তার কাছে অপার ভালোলাগার একটা জায়গা। গত ৬বছর ধরে এখানেই তার স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস। কাজের মেয়ে মালিহার গলা শুনে তার ধ্যান ভাঙল।

-- কি হয়েছে মালিহা?

-- ছোট্টমণি খাচ্ছেনা। কত চেষ্টা করছি একটু কিছুও মুখে দিচ্ছেনা।

-- তুমি খাবারটা আমায় দাও। চায়ের কাপটাও নিয়ে যাও। মালিহার কাছ থেকে খাবারের ট্রে টা নিয়ে নিজের মেয়ের রুমের দিকে গেলেন নিষ্পাপ। "মেয়েটা কে নিয়ে আর পারা যায়না, যত বড় হচ্ছে তত এর বায়না বাড়ছে। কোন রাজকার্য করছে যে একটু কিছু খাওয়া যায়না।" বিড়বিড় করতে করতে মেয়ের রুমে ঢুকলেন। ঢুকেই চক্ষু ছানাবড়া।তার মেয়ে হাদিস শিক্ষার বই ঘাটাঘাটি করছে। বিস্মিত হয়ে বললেন,

-- নূরজাহান তুমি এখন এসব নিয়ে বসেছো কেন?

-- মাম্মা, আজ তো হলিডে। তাই একটু এইগুলো পড়ছি।

-- কিন্তু ব্রেকফাস্ট না করে এসব পড়লে তো হবেনা। নাও ব্রেকফাস্ট করে স্কুলের হোমওয়ার্ক শেষ করো। বিকালে অবসর মোমেন্টে এসব পড়ো কেমন সোনা!

-- আচ্ছা মাম্মা। ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিয়ে নিষ্পাপ রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। এমনসময় তার স্বামী সায়েম আহমেদের ডাক এলো। নিজের রুমে ঢুকে বললেন,

-- ডাকছিলে কেন?

-- টাই টা পড়িয়ে দাও। নিষ্পাপ সায়েমের টাই বেধে দিতে দিতে বলে,

-- ৬বছরের মেয়ের বাবা হয়ে গেছো এখনো টাই বউকে পড়িয়ে দিতে হয়?

-- হুম হয়। আমার মামণি কই?

-- রুমে বসে বসে হাদিসের বই ঘাটাঘাটি করছিল। বকে খাইয়ে দিয়ে এলাম। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে সকাল সকাল অইসব নিয়ে বসেছে।

-- এমন করো কেন? এটা তো ভালো গুন ই। এমন মেয়ে লাখে একটা পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ।

-- এত অল্প বয়সে এসব দিকে এত আগ্রহ আমি কোনো বেবির দেখিনি। আমার মনটা কেমন খুতখুত করে।

সায়েম নিষ্পাপের হাত দুটো জড়িয়ে বলল, জানোই তো আমাদের মেয়েটা একদম আলাদা। ডা. রা তো বললেন, ও একটু অস্বাভাবিক। ওর বুদ্ধিদীপ্ত সবদিক দিয়ে সবার থেকে বেশি।

-- তাও আমার ভয় হয় গো।

-- ভয় পেয়োনা তো। শুধু শুধু ভয় পাওয়া আমার বউয়ের একটা বদগুন। আমার মামণির মত সাহসী হও বুঝচ্ছো।

-- হয়েছে হয়েছে। যাও অফিসে যাও। আমি তোমার গুনবতী মেয়েটাকে দেখে আসি। হোমওয়ার্ক গুলা শেষ করল কিনা! বলেই নিষ্পাপ নিজের মেয়ের রুমে চলে এলেন। এসে দেখেন তার মেয়ে জানালার ধারে বসে আনমনে কি যেন ভাবছে।

নিষ্পাপ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কি ভাবছো নূরজাহান?

-- মাম্মা দিন এত সুন্দর কেন? দেখো সূর্যমামা তার সময়মত উঠে পড়ে আবার ডুবে যায়। সবকিছুতেই একটা রুটিন আছে আমার পড়ার রুটিনের মত। 

-- ওরা ওদের রুটিনের হেরফের করেনা। আল্লাহ তাদের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে দিয়েছেন। কিন্তু তুমি তো তোমার রুটিনের নিয়ম মেনে চলোনা। হোমওয়ার্ক করেছো?

-- জ্বি মাম্মা। সব ফিনিশ। নিষ্পাপ অবাকতুর হয়ে বলল,

-- এত তাড়াতাড়ি? কই আমাকে দেখাও তো। সত্যিই তো সবগুলাই শেষ। এত তাড়াতাড়ি কি করে করলে?

আচ্ছা চল মাম্মার সাথে একটু ঘুরে আসবে।

-- পরে যাই মাম্মা? বইগুলো পড়া হয়নি!

-- আচ্ছা পড়ো। মিসেস নিষ্পাপের মনটা কেমন জানি বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। তার মেয়েটা কেন এমন!আচ্ছা তার মেয়ের কোনো ক্ষতি হবেনা তো? নূরজাহান যে তার দুনিয়া, তাকে ছাড়া সব অচল।নিজের মেয়ের চোখের দিকে তাকালে তার সব কষ্ট, ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। নুরজাহান টকটকে ফর্সা, ডাগর ডাগর নীল চোখ, লম্বা খাড়া নাক, চুলটা হালকা সোনালী রঙের। সব মিলিয়ে মনে হয় ছোটখাট পরীর বাচ্ছা।প্রথম দেখায় যে কারো মন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা তার আছে। অন্য বাচ্চাদের তুলনায় অনেক বেশি বুদ্ধিমতি, একদম শুদ্ধভাবে স্পষ্ট কথা বলে।

শুধু চিন্তার ব্যাপার একটাই যুগের সাথে তাল মেলাতে চায়না। নিজের আলাদা জগতে থাকতেই সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ার পরও নুরজাহানের আগ্রহ আরবি নিয়ে। ইসলামের নানাদিক সম্পর্কে তার জানা চাই ই চাই। সায়েম তার মেয়ের এসব গুন দেখে খুবই খুশি। শুধু আমার মনটা কেমন জানি করে! আমি জানি এসব ভালো, কিন্তু আমাদের কারো এমন গুন নেই তাহলে নুরজাহান পেল কি করে?

ভাবতে ভাবতে নিষ্পাপ নিজের কাজে মন দেয়।

মাঝরাতে নূরজাহানের চিৎকার শুনে নিষ্পাপ আর সায়েম নূরজাহানের ঘরে ছুটে আসে। নূরজাহান প্রচন্ড হাপাচ্ছে। নিষ্পাপ তাকে পানি খাইয়ে বুকে টেনে নেয়। সায়েমের দিকে ভয়মাখা চাহনীতে তাকিয়ে বলল,

-- সায়েম এসব কি হচ্ছে বলো তো!

-- ভয় পেয়োনা। দুঃস্বপ্ন দেখে একটু ভয় পেয়ে গেছে। তুমি ওকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। ওর কাছেই থাকো বরঙ।

সায়েম এগিয়ে এসে নূরজাহানের কপালে চুমু দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলে। নিষ্পাপ মেয়ের চোখে ভয় আর অবাকতা দেখছে।নূরজাহানকে পাশে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, " কি দেখেছো সোনা? মাম্মাকে বলো। নুরজাহান কাপা কাপা কন্ঠে বলে,

-- একটা মহিলা অনেক উপর থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে। জানো মাম্মা উনার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। কাদছিল খুব। মনে হচ্ছিল আমাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছিল। হঠাৎ নিচের কুয়াশায় উনি হারিয়ে গেলেন। এসব শুনে নিষ্পাপ মেয়েকে আরো আঁকড়ে ধরেন। এই ঘটনা তার নতুন শোনা নয়। গত ৩ বছর ধরে উনি এই বর্ণনাই শুনে আসছেন। মাঝে মাঝেই নুরজাহান মাঝরাতে চিৎকার করে উঠে আর এই ঘটনাই বলে। কত সাইকোলিজিস্ট দেখালেন। সবার একটাই কথা, " এটা তার কল্পনায় বানানো চিত্র। হয়তো কোনো মুভি দেখে সে নিজের মাথায় এই চিত্র গেথে নেয়। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে!"


ঠিক হওয়ার তো নামই নেই। দিনদিন তা বেড়েই যাচ্ছে, এইটুকু বাচ্চাকে কেন এত প্রেসার দিচ্ছো আল্লাহ! কেন ওকে সবার মত সাদামাটা বানালে না। তাহলে ওর এত কষ্ট আমাকে দেখতে হতনা। ভেবেই নিষ্পাপের চোখ থেকে দু'ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ল।

নূরজাহান চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, "কাদছো কেন মাম্মা? তুমিও কি উনার মত কষ্ট পাচ্ছো। কষ্ট পেয়োনা। তোমার নুরজাহান আছেনা আমি সবার কষ্ট দূর করে দিব দেখো।" নিজের মেয়ের এমন মিষ্টি কথায় নিষ্পাপের মুখে হাসি ফুটে ওঠল। তার কপালে চুমু দিয়ে বলল, "সোনা মেয়ে আমার! ঘুমো এখন"

নুরজাহানকে স্কুলে যাওয়ার জন্য মালিহাকে রেডি করতে বলে নিষ্পাপ সায়েমকে চা দিতে গেল। চা টা রেখে সায়েমের টাই বেধে দিতে দিতে বলল,

-- সাবধানে যেও। নুরজাহান স্কুলে ঢুকে গেলে তবেই তুমি অফিসে যাবা অকে।

-- জো হুকুম মহারাণী। কিন্তু তোমার কি মনে হয়না তুমি নুরজাহানকে নিয়ে একটু বেশি চিন্তা করছো।

-- মা হও তবে বুঝবে কেন এত বেশি ভাবি।

-- এত রাগ করো কেন? নুরজাহান তো আমারো মেয়ে। এই কথাটা শুনে নিষ্পাপের অন্তর আত্মা কেপে উঠল। সে যেন ভাবনার জগতে হারিয়ে গেল। সায়েম তাকে এভাবে ঠায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে গা নাড়া দিয়ে বলল,

-- কি ভাবছো এত?

-- না কিছুনা।

-- যাও দেখে এসো নুরজাহান রেডি হয়েছে কিনা? স্কুলের টাইম হয়ে যাচ্ছে যে।

-- তুমি বের হও আমি এক্ষুনি ওকে নিয়ে আসছি।

নুরজাহানকে নিয়ে মালিহা ড্রয়িং রুমে এসে দাড়াতেই নিষ্পাপ তার মেয়েটিকে এক নজর দেখে নিলেন। আজ তার মেয়ে হিজাব পড়েছে।

-- নুরজাহান এটা তুমি কেন পড়েছো?

-- কেন মাম্মা? সুন্দর লাগছেনা আমায়?

-- হুম খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু মাম্মা তোমার স্কুলে তো এসব নিষেধ। খুলে ফেলো মাম্মা।

-- না মাম্মা পড়িনা প্লীজ।

-- জেদ করোনা সোনা।তুমি না মাম্মার গুড গার্ল।

সায়েম পিছন থেকে এসে বলল, " আমার মামনিটাকে তো খুব সুন্দর লাগছে!"

-- থ্যাংক ইউ পাপা। কিন্তু মাম্মা এটা খুলে ফেলতে বলছে, তুমি মাম্মাকে বুঝাওনা।

-- নিষ্পাপ খুলতে বলছো কেন?

-- ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে এসব এ্যালাউ না তুমি জানোনা।

-- তাতে কি হয়েছে? একদিন পড়লে কিচ্ছু হবেনা। আমি ম্যামের সাথে কথা বলে নেব। আচ্ছা আমরা বেরিয়ে পড়ি। 

-- হুম সাবধানে যেও। টাটা মাম্মা

-- আল্লাহ হাফেজ মাম্মা। বলে নুরজাহান সায়েমের সাথে বেরিয়ে গেল। নিষ্পাপ তাদের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইলাম। বুকের ভিতরে মনে হচ্ছে কে হাতুরি দিয়ে আঘাত করছে। মনের ভেতরটা কু ডাকছে।

আল্লাহ তুমি আমার মেয়েটাকে হেফাজত করো।

.

সব কাজ শেষ করে সবেমাত্র রেকিং চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন নিষ্পাপ। এমনিসময় কলিংবেলটা বেজে উঠল। ঘড়ির দিকে তাকালেন, এখনো নূরজাহানের ফেরার সময় হয়নি। তবে কে এলো? মালিহাকে ডেকে দরজা খুলতে বলে চোখজোড়া বুজলেন কিচ্ছুক্ষনের জন্য।

মেয়েলী কন্ঠে কেউ একজন বলল, "বুবু কেমন আছ?" চোখ খুলে দেখেন উপরের ফ্ল্যাটের ভাবী এসেছে। উনার সম্পর্ক টা অনেকটা বোনের মত। কথাবার্তায় খুব আপন মনে হয়, নিয়মিত অবাধ যাতায়াত একে অপরের বাসায়। 

-- আরেহ বোন, দেশের বাড়ী থেকে এলে কখন?

-- কাল রাতেই এলাম বুবু। পথে বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাই ফিরতে রাত হল।

-- বসো বোন। চা খাবে?

-- না বুবু, কিছু খাবোনা। নূর সোনামণি কই?

-- স্কুলে গেছে। তোমার বাচ্চারা কোথায়?

-- তারাও গেল। নূরকে অনেক মিস করছি বুবু, তাই দেরী না করে চলে এলাম দেখতে।

-- একটু বেশিই আদর করো ওকে।

-- করতে তো হবেই। এত মিষ্টি একটা মেয়েকে আদর না করে থাকা যায় বলো! বুবু কাল রাতে নূর চিৎকার শুনলাম মনে হলো।

-- তুমি কি করে শুনলে?

-- কাল রাতে যখন ফিরলাম তোমাদের দরজার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখনি শুনলাম। অতরাতে তোমাকে আর বিরক্ত করতে চাইনি, তাই নক করিনি।

-- আর বলোনা বোন। মেয়েটার সাথে যা হচ্ছে, মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠে।অনেক সাইকোলজিস্ট দেখালাম, সবাই বলে এটা ওর কল্পনামাত্র। ভয়ের কিছু নেই। তারপরও আমার খুব চিন্তা হয়। শত হলেও মায়ের মন।

-- তুমি কোন হুজুরের শরণাপন্ন হও নাই?

-- এসবে আমার বিশ্বাস একটু কম তাই ট্রাই করিনাই।

-- কি যে বল! একবার ট্রাই করে দেখো ঠকবানা। বুঝোই তো পার্বত্যাঞ্চলে থাকো, এখানে আবার খারাপ জিনিসের প্রকোপ একটু বেশি। আমার পরিচিত এক বড় আলেম আছেন, উনি খুব সহজে আসল সমস্যা ধরতে পারেন। তুমি চাইলে ঠিকানা দিতে পারি। একবার চেষ্টা করলে তো ক্ষতি নেই।

-- তুমি যখন বলছো একবার গিয়েই দেখি। তুমি ঠিকানাটা লিখে দাও।আরো কিছু কথা বলে মহিলা চলে গেল।

মাঝরাত হয়ে গেলেও নিষ্পাপের চোখে ঘুম নেই। ও বিশ্বাস করেনা, নূরজাহানের মাঝে খারাপ কিছু আছে। আবার অবিশ্বাস ও করতে পারছেনা। একপ্রকার দোটানা কাজ করছে। একবার গিয়ে দেখলে তো সমস্যা নেই। সায়েমকে কি বলব? ও কি রাজি হবে? আচ্ছা সকালে ওকে ম্যানেজ করে নূরজাহানকে নিয়ে হুজুরের কাছে যাব।সকালে সায়েম আর নূরজাহানকে নিয়ে রওনা দিলাম। সায়েম জিজ্ঞেস করল,

-- তুমি তো এসব বিশ্বাস করোনা, তাহলে আজ যাচ্ছো কেন? আমি খানিকটা চুপ করে থেকে বললাম,

-- কখনো কখনো পরিস্থিতি বিশ্বাসের গন্ডি পেরোতে বাধ্য করে। এসো, আমরা পৌছে গেছি।

অনেক বড় দরবার হুজুরের।ভীড় ও লেগে আছে খানিকটা। ভীড় ঠেলে কোনোরকমে হুজুরের কাছে গেলাম। হুজুর অনেক সুন্দর দেখতে, বসে বসে অবিরত তাসবীহ গুনছেন। মাঝে মাঝে মোনাজাত করে লম্বা দাড়িতে হাত বুলাচ্ছেন।উনি আমাদেরকে ইশারায় বসতে বললেন। সুন্দরকন্ঠে বললেন, "কি কারণে এসেছো এইখানে?"

আমি উনাকে সবটা খুলে বললাম। উনি বললেন,

-- নূরজাহান, এদিকে এসো মা। নূরজাহান সাবলীলভাবে উনার কোলে গিয়ে বসলেন। হুজুর খানিকক্ষণ ওর সাথে গল্প করলেন তারপর বললেন,

-- নূরজাহান তোমাদের একমাত্র মেয়ে?

সায়েম কিছু বলার আগেই আমিই বললাম, হ্যাঁ ও আমাদেরই মেয়ে। একটাই মেয়ে আমাদের।

-- নূরজাহান তুমি স্বপ্নে কাকে দেখো?

-- একটা সুন্দর মহিলাকে। খুব আপন মনে হয় উনাকে। জানো উনার না অনেক কষ্ট। কেউ উনার কষ্ট বুঝেনা।

হুজুরকে খানিকটা চিন্তিত দেখাল। উনি বললেন,

-- তোমরা আজ যাও মা। খুব তাড়াতাড়ি আমি তোমাদের সাথে যোগাযোগ করব। ততদিন অব্ধি ওর দিকে নজর রেখো।আল্লাহ তোমাদের ভালো করুক।

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে এলাম। মাথার মধ্যে নানারকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। চিন্তাগুলো কে ঝেড়ে সংসারে মন দিলাম আবার। নিজেকে স্বাভাবিক করলাম কারণ, আমার মন বলছে আমার মেয়ে স্বাভাবিক।এটা শিশুবয়সের কল্পনাবলি মাত্র। নানাকাজে হুজুরের কথা ভুলেই গেছিলাম। নূরজাহানের সব কিছু স্বাভাবিক হিসেবে নিতে চেষ্টা করছিলাম বলে আর ভাবার প্রয়োজন পড়েনি। নূরজাহানের রুমে দুধের গ্লাস নিয়ে ঢুকলাম।

-- সোনা, কি করো তুমি?

-- লিখছি মাম্মা।

-- কি লিখছো, দেখাও তো। দেখলাম তার খাতার পৃষ্ঠা ভর্তি মুশায়রা লেখা। চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম,

-- এটা কার নাম মাম্মা?

-- জানিনা তো। মাথায় ঘুরঘুর করছে তাই লিখে ফেললাম।নামটা সুন্দর না মাম্মা?

-- হুম সুন্দর। তুমি দুধটা খেয়ে নাও মাম্মা।

বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। নামটা কার? নূরজাহানের মাথায় এই নামটাই বা ঘুরঘুর করছে কেন!হয়তো কোথাও শুনেছে। এমনি ভাবনার সময় কলিংবেল বেজে উঠল। গিয়ে দরজা খুলে দেখি সেই হুজুরটা দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি মাথা কাপড় টেনে সালাম দিলাম। তারপর ভেতরে এনে বসালাম।

উনি মুচকি হেসে বললেন, "কেমন আছ, মা?"

-- জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি বাসায় আসলেন ভাবতেই ভালোলাগছে। আপনি বসুন আমি আপনার জন্য কিছু নাস্তাপানির ব্যবস্থা করি।

-- ব্যস্ত হয়োনা মা। আমি কেবল কিছু জানতে এবং বলতে এইখানে এসেছি। তুমি আমার কিছু কথা উত্তর দাও। আমি বিনীতস্বরে বললাম," অবশ্যই।"

-- নূরজাহান প্রকৃতপক্ষে কার মেয়ে?

এই প্রশ্ন শুনে আমি হতহিব্বল হয়ে গেলাম।.....


জ্বীনকন্যা...👽👹

পর্বঃ ০২


-- নূরজাহান প্রকৃতপক্ষে কার মেয়ে?

এই প্রশ্ন শুনে আমি হতহিব্বল হয়ে গেলাম।


-- হুজুর আমি তো সেইদিনও বলেছি ও আমার মেয়ে।তাও আপনি এসব কেন জিজ্ঞেস করছেন। আমরা ছাড়া কে বা ওরা মা-বাবা হবে!

-- তুমি সত্যি বলছোনা মা।

-- এটাই সত্যি হুজুর। নূরজাহান আমার মেয়ে, ওকে আমি এতদিন আদর-যত্নে লালনপালন করে বড় করেছি।

-- পেটে ধরেছো কি? এইধরনের প্রশ্ন শুনে নিষ্পাপ চুপসে যায়। বুকের ভিতরে উথালপাথাল ঝড় বয়ছে। নিজেকে কোনোরকম সামলে বলল,

-- ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন।আপনি এখন আসতে পারেন।

-- আর কতদিন সত্য থেকে পালিয়ে বেড়াবে? একদিন তো তার মুখোমুখি তোমাকে হতেই হবে। সেইদিন তোমার ন্যায় অসহায় কেউ থাকবেনা।এখনো সময় আছে।নিষ্পাপ রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

-- আপনি এখন আসতে পারেন হুজুর। আর কখনোই এই বাড়ীমুখো হবেননা। আপনার হাদিয়া আমি আপনাকে পাঠিয়ে দিব।

হুজুর চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। কি ভেবে পিছু ফিরে বললেন, "একদিন তোমার আমাকে প্রয়োজন পড়বে। সেইদিন আমি তোমাকে তাড়িয়ে দেবনা। আমার দরবার তোমার জন্য সবসময় খোলা থাকবে। তখন আশা করি সত্য নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হবে। ভাল থেকো।" এরপর হুজুর এক মূহুর্ত ও দাড়ালেননা। হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।

নিষ্পাপ কান্না করতে করতে লুটিয়ে পড়ে নিচে।এইদিনটা ও দেখতে হল তাকে। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। হঠাৎ কেউ যেন তার পিঠে হাত রাখল।চমকে উঠে পিছনে ফিরল নিষ্পাপ।

.

নূরজাহান তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। নিষ্পাপ তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে বলল,

-- মাম্মা কিছু বলবা?

-- মাম্মা আমি তোমার নিজের মেয়ে না? নিষ্পাপ নূরজাহানকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত চুমু খেয়ে বলল," না সোনা, তুমি আমার নিজের মেয়ে! অই দাদুটা মিথ্যে বলছে মাম্মা।" নূরজাহান মুচকি হেসে বলল,

-- তুমি কাদছো কেন তাহলে? যদি দাদুই মিথ্যে বলে থাকে। সত্যি করে বলোনা মাম্মা আমি কার মেয়ে? আমার নিজের মাম্মা কে? নিষ্পাপ মাথায় রাগ চড়ে গেল, নূরজাহানকে এক চড় দিয়ে বলল,

-- কতবার বারণ করেছি, মুখে মুখে তর্ক করবানা। যাও নিজের রুমে যাও। এসব টপিক নিয়ে আর একটা কথ বললেই কিন্তু মাইর দিব। যাও এখান থেকে।

নূরজাহান কাদলোনা ফ্যালফ্যাল করে নিষ্পাপের দিকে তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।

নিষ্পাপ শান্ত হয়ে গেল। যে মেয়েটার গায়ে আজ অবধি হাত তুলেনি, আজ অন্য একটা কারণে ও হাত তুলে ফেলল। নূরজাহান নিশ্চয়ই খুব অভিমান করেছে।মালিহাকে দিয়ে আইসক্রীম আর চকলেট আনিয়ে অইগুলো নিয়ে মাম্মা বলে ডাকতে ডাকতে নূরজাহানের রুমে ঢুকল। কিন্তু রুমের কোথাও নূরজাহান নেই। ও তো রুমের দিকেই এলো, এখন তাহলে রুমে নেই কেন? সারা বাসা খুজেও নূরজাহানকে কেউ কোথাও পেলনা।

সায়েম বাসায় ফিরতেই নিষ্পাপ তাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাদতে শুরু করল। হুজুরের ব্যাপারটা সে চেপে গেল। সে চায়না সায়েম এসব ব্যাপারে জানুক। সায়েম এক মূহুর্ত দেরী না করে নূরজাহানকে খুজতে বাহিরে বেরিয়ে গেল। সারারাত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেও কোথাও পেলনা।অবশেষে থানায় জিডি করে বাসায় নতমুখে ফিরে আসল। আসতেই নিষ্পাপ সায়েমকে পাগলের মত জিজ্ঞেস করতে লাগল। সায়েমকে নীরবে কাদতে লাগল। নিষ্পাপ বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে আর বিলাপ করছে, "নূরজাহানকে এনে দাও আমাকে। আমি আর কখনোই বকবনা। প্লীজ সায়েম আমার মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে এনে দাও।"

পুরো ২দিন কেটে যাওয়ার পরও কেউ নূরজাহানের সন্ধান পেলনা। নিষ্পাপ অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, কিচ্ছুটি মুখে তুলছেনা। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। হঠাৎ তার হুজুরসাহেবের কথা মনে পড়ল। পাগলের মত ভরসন্ধ্যায় বেরিয়ে গেল।সায়েম তা দেখতে পেয়ে নিষ্পাপের পিছু পিছু ছুটল। মাঝরাস্তায় নিষ্পাপকে ধরে ফেলল,জিজ্ঞেস করতে লাগল,"কি হয়েছে তোমার?তুমি এভাবে ছুটে কোথায় যাচ্ছ?" নিষ্পাপ ফোপাতে ফোপাতে বলল, "হুজুর সাহেবই পারবে নূরজাহানের খোজ দিতে।আমাকে তার কাছে যেতে দাও।"

-- আমরা কাল সকালে যাব নিষ্পাপ। চলো বাসায় চল।

নিষ্পাপ সায়েম বাহুডোর থেকে বেরিয়ে এসে বলল,

-- আমি আর এক মূহুর্ত ও দেরী করতে পারবনা। কেন বুঝতে পারছোনা আমাদের মেয়ে উধাও হয়ে গেছে। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারব সায়েম।

-- আচ্ছা চল, আমিও যাব তোমার সাথে।

হুজুরের দরবারে এসে পৌছালো দুজন। নিষ্পাপ সায়েমকে রেখে দৌড়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। দেখল হুজুর নামাযের মোনাজাত শেষ করে সবে উঠেছেন। নিষ্পাপ হাতজোড়ে কেদে কেদে বলল,

-- হুজুর আমার মেয়েটা হারিয়ে গেছে। তাকে খুজে বের দিন। আমাকে ক্ষমা করুন সেইদিনের ব্যবহারের জন্য।

সায়েম এসে এটা দেখে অবাক হয়ে গেল এবং বলল,

-- তুমি কবে হুজুরের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছো?

-- সেদিন হুজুর আমাদের বাসায় গিয়েছিলেন নূরজাহানের আসল পরিচয় জানার জন্য। আমি ওকে হারানোর ভয়ে উনাকে তাড়িয়ে দিয়েছি।

-- আসল পরিচয় মানে কি? হুজুর সায়েমকে শান্ত হতে বলে বলল, " নূরজাহানের অন্য একটি পরিচয় আছে, যেটা তোমরা কেউ জানোনা। তবে সবচেয়ে বড় সত্যি এটাই নূরজাহান তোমাদের মেয়ে নয়।" সায়েম বলল,

-- কি বলছেন কি? নূরজাহান কে আমি সেই ছোট থেকেই নিজের হাতে বড় করেছি আজ বলছেন সে আমাদের মেয়ে নয়।

-- তুমি তোমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করো। সায়েম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিষ্পাপের দিকে তাকাল। নিষ্পাপ কাদতে কাদতে বলল, উনি সত্যি বলছেন নূরজাহান আমাদের মেয়ে নয়। সেইদিন হসপিটালে আমাদের ৩য় বারের মত মৃত বাচ্চা হয়েছিল। সেইদিন ঠিক একি সময় পাশের বেডে একটা মেয়ে বেবি হয়েছিল। আমার আমাদের বেবির কথা শুনে যখন কাদছিলাম, তখন দেখলাম অই মহিলার কাজের বুয়া বাচ্চা কোলে নিয়ে বসেছিল এবং বাচ্চার কান্না থামাতে চেষ্টা করছিল। কিছুতেই পারছিলনা। আমি ওকে ডেকে বাচ্চাটাকে কোলে নিতেই ও শান্ত হয়ে গেল। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম,


-- বেবির আম্মু কোথায়?

-- ভাবী ভাইয়াকে আনতে গেছে। আমার কাছে রেখে গেছে, খুব তাড়াতাড়ি ফিরবেন বলেছেন।

কিন্তু ২দিন পার হওয়ার পরও ওর আম্মু আসেনি। তাই আমি অই মেয়েটাকে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে নিজের কোল পূরণ করার জন্য বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে এসেছি। আর তুমি ঢাকা থেকে ফেরার পর বলেছি ও আমাদেরই মেয়ে।

সায়েমের চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু পড়ল। হুজুর শান্ত গলায় বলল, "জানো ও কে?" নিষ্পাপ চোখের পানি মুছে বলল,

-- কি তার পরিচয়? 

-- ও জ্বীনকন্যা। জ্বীন মুস্তফা আর মনুষ্যকন্যা মুশায়রার মেয়ে। সায়েম অবাক হয়ে বলল,

-- কি বলছেন আপনি এসব?

-- এটাই সত্যি। তোমরা কি ওর মাঝে আলাদা কিছু লক্ষ করোনি? নিষ্পাপ আর সায়েম দুইজন দুইজনের দিকএ তাকাল। ওদের সব মনে পড়ে গেল।

নিষ্পাপ অবাক হয়ে বলল, "আপনি কি করে জানেন?"

-- আমার যে জ্বীনজগতের সাথে যোগাযোগ আছেরে মা। পুরো জ্বীনজগত অধীর হয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। কবে তাদের জ্বীনকন্যা আসবে? তাদেরকে রক্ষা করবে কষ্টের হাত থেকে।

-- নূরজাহানের বাবা-মা কোথায়?

-- আমি যতটুকু জানি তারা খুন হয়েছে মুশায়রার মায়ের হাতে। শুনে নিষ্পাপের অন্তরাত্মা কেপে উঠল। সে বিনীতস্বরে বলল, ওর যখন মা-বাবা জীবিত নেই, তবে আমাদের কাছে থাকতে কিসের বাধা হুজুর?

-- ও এই পৃথিবীতে পাচ-দশটা মেয়ের মত জীবন কাটাতে আসেনি। ওর যে সামনে কঠিন লড়াই। তাই ও তোমাদের কাছে আর ফিরতে পারবেনা।

নিষ্পাপ চিৎকার করে বলল, "হুজুর আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবনা। ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। আমি হাতজোড় করে ভিক্ষে চাইছি আমার মেয়েকে।"

.

এমনসময় নূরজাহান পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এসে নিষ্পাপকে লক্ষ করে বলল, "মাম্মা, তুমি ফিরে যাও!"

নিষ্পাপ নূরজাহানের কাছে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, "মাম্মা তুমি এইখানে কি করে এলে? চল আমাদের সাথে ফিরে চলো।"

-- তা সম্ভব না মাম্মা। আমি আমার আসল পরিচয় আর কর্তব্য সম্পর্কে জেনে গেছি।

-- মাম্মা অইসব মিথ্যে । তোমাকে মিথ্যে বলা হয়েছে। মাম্মার সাথে চল সোনা। মাম্মা যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা।

-- মাম্মা, তুমি চলে যাও। আমি তোমাদের কাছে ফিরতে পারবনা। নিষ্পাপ লালচোখে হুজুরের দিকে তাকাল।

-- আপনি আমার মেয়েটাকে তুলে এনে কি বুঝিয়েছেন?

কেন এভাবে আমার সুখের সংসারটা তছনছ করছেন?

-- মাম্মা উনি আমাকে তুলে আনেনি।আমি স্বেচ্ছায় এখানে সত্যিটা জানার জন্য।মাম্মা আমার যে অনেক দায়িত্ব,যে আমার আসল পাপা-মাম্মাকে খুন করেছে তাকে শাস্তি দিতে হবে। এই কাজটা আমাকে তোমাদের থেকে বিছিন্ন থেকেই করতে হবে।

-- নূরজাহান এসব কি বলছো? নিষ্পাপ উঠে সায়েমের কাছে এলো। তাকে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল, "তুমি চুপ করে আছো কেন? ওকে কিছু বলবানা, বুঝাবানা। প্লীজ সায়েম কিছু তো বলো।" সায়েম ধীরপায়ে নূরজাহানের গালে হাত রেখে চুমু খেয়ে বলল, "নিষ্পাপ যা আমাদের নয়, তা আমরা কখনোই জোর করে ধরে রাখতে পারবনা। একদিন না একদিন তো সে আমাদের ছেড়ে যাবেই। ওকে তুমি আটকিয়ো না, তাকে তার কাজটা ঠিকমত করতে দাও। তাতেই সবার মঙল।" নূরজাহান সায়েম জড়িয়ে ধরে পায়ে হাত রেখে সালাম দিয়ে বলল,

-- পাপা আমার জন্য দোয়া করো যাতে তোমার মামণি তার কাজে সফল হয়। মাম্মাকে বুঝিয়ে নিয়ে যাও। আমি একদিন ঠিকিই তোমাদের কাছে ফিরব। ততদিন তুমি মাম্মাকে দেখে রেখো।

-- দোয়া করি মামণি। নিষ্পাপ জোরকন্ঠে চেচিয়ে bolol

-- সায়েম তুমি এটা করতে পারলা? একবারো আমার কথা ভাবলানা। ও চলে গেলে আমি কি নিয়ে বাচবো। আমি তোমার পায়ে পড়ছি ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।

-- নিষ্পাপ ও আমাদের নিজের মেয়ে নয়।তাই ওকে আটকানোর সাধ্য নেই আমাদের। চলো আমরা ফিরে যাই। ও জ্বীনকন্যা, মানুষের মায়ার ডোরে ওকে বেধে রাখা যাবেনা। হুজুর আপনি ওকে দেখে রাখবেন। আমরা কালই এই এলাকা ছেড়ে চলে যাব। হয়তো ওর সাথে আর কখনোই দেখা হবেনা, আপনি ওকে একটু আগলে আগলে রাখবেন। ওর জন্য সবসময় দোয়া রইল। সায়েম নিষ্পাপকে টেনে নিয়ে গেল। নিষ্পাপ কাদতে কাদতে বলল, সায়েম নূরজাহানকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবনা। প্লীজ এমনটা করোনা। নিষ্পাপের আর্তনাদ নূরজাহানের কাছে আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে গেল। নূরজাহান চোখের পানি মুছে হুজুর কে বলল,

-- আপনি আমাকে বলুন এখন আমাকে কি করতে হবে? কি করলে আমি আমার মাম্মা-পাপার হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারব! আমি কি কখনোই আমার আসল মাম্মা-পাপাকে খুজে পাবনা।

-- শান্ত হও দাদু। এখনি এত ভেঙে পড়োনা।তোমার মনটাকে শক্ত করো। সব জানতে পারবে তুমি।এসো আমার সাথে।

হুজুরের পিছু পিছু নূরজাহান একটা বড় ঘরে ঢুকল। ঘরে রাশিরাশি ইসলামিক বই আর কুরআন ।চারিদিকের দেয়ালে আল্লাহর কালাম লেখা। হুজুর তাকে বসতে বললেন ইশারায়। নূরজাহান মেঝেতে বসে পড়ল এবং হুজুরকে জিজ্ঞেস করল,

-- আমরা এখানে আসলাম কেন?

-- এটা নামাযঘর দাদু। এই ঘরে আমি একজন ডাকব যে তোমাকে সব সঠিক তথ্য দিতে পারবে তোমার মা-বাবার সম্পর্কে এবং তার পরর্বতীতে তোমাকে কি করতে হবে তা বলে দিবে।

-- কাকে ডাকবা দাদু?

-- জ্বীনসর্দার। সম্পর্কে সেও তোমার দাদু হয়। এখন চুপটি করে বসো। হুজুর ঘরের আলো নিভিয়ে দুটো মোম জ্বালালেন। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর মনে হল ঘরটা কেপে উঠল।একটা দমকা বাতাস জানালা দিয়ে ঘরে ডুকল।

একটা গম্ভীর মিহি কন্ঠে কেউ বলে উঠল,

-- আমাকে স্মরণ করার কারণ কি হুজুর?

-- আপনার থেকে অনেককিছু জানার ছিল সর্দার। এই মেয়েটির দিকে লক্ষ করুন, এই আপনাদের মুস্তফার সন্তান। আমাদের বংশের ভবিষ্যৎ, সে এসেছে আপনাদেরকে অন্যায়ের হাত থেকে রক্ষা করতে।

অদৃশ্য মিহি কন্ঠটি পুলকিত হয়ে বলল,

-- সে এসেছে? তার জন্য এতদিন আমরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। 

-- জ্বী সর্দার। এখন আপনি তাকে সবকিছু খুলে বলুন যাতে সে তার কাজগুলো সুনিপুনভাবে করতে পারে।

নূরজাহান উদ্দেশ্য করে অদৃশ্য কন্ঠটি বলে উঠল,

-- শোনো দাদু, তোমার নানাভাই ছিল একজন নিষ্ঠ আলেম। তোমার নানুকে নিয়ে তার জীবন খুব ভালোই চলছিল। সেইসময় আমাদের ভালো জ্বীন আর বদজ্বীনের সাথে যুদ্ধ চলছিল। আমরা তাদের হাত থেকে মানুষ আর জ্বীনজাতিকে রক্ষা করার জন্য বদজ্বীন সর্দারকে হত্যা করি। এতে তাদের দল দূর্বল হয়ে পড়ে, একে অপরের থেকে বিছিন্ন হয়ে যায়। বদজ্বীন সর্দারের স্ত্রী উপায়ান্তর না দেখে ঘটনাক্রমে তোমার নানুর শরীরে আশ্রয় নেয়। আস্তে আস্তে তোমার নানুর আত্মাকে নিঃশেষ করে তার শরীর পুরোপুরি দখল করে নেয়। নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকে তার খারাপ শক্তি জাগ্রত করে জ্বীনজগতে ফিরে আসার। আলেম সাহেব তা বুঝতে পেরে তাকে বের করে দেন। ততদিনে সে অনেক ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছিল তাই তাকে ধবংস করার জন্য আমি আর উনি ঠিক করি মুস্তফা আর মুশায়রার বিয়ে দেওয়ার। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল তাদের সন্তান দ্বারাই অই মহিলাকে হত্যা করার। সেই মহিলা এসব জানতে পেরে নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগল তুমি যাতে জন্ম নিতে না পারো।

তোমার বাবা অনেক ক্ষমতাধর হওয়া সত্ত্বেও তুমি আর তোমাকে মাকে রক্ষা করতে পারলনা। কেননা, তাদের মিলনের ফলে তার সব শক্তি তোমার মাঝে স্থানান্তর হয়েছিল।

নূরজাহান অবাক হয়ে সব শুনছিল;তার জন্ম নেওয়ার পিছনে এত রহস্য ছিল।জ্বীনসর্দার একটু থেমে আবার বলা শুরু করলেন, "তোমার বাবাকে ওই মহিলা বন্ধি করার পরই তোমার মায়ের প্রসবব্যথা উঠে, এর পরেরদিনই তোমার জন্ম হয়। তোমার মা মুস্তফাকে বাচানোর জন্য মিথ্যে গর্ভবতীর অভিনয় করে সেখানে যায়। অই মহিলা ভয় দেখিয়ে তোমার মাকে পাহাড় থেকে ফেলে দেয়। তারপর থেকে শুরু হয় জ্বীনজগতে অই বদমহিলার রাজত্ব। অকথ্য নির্যাতন চলছে এখনো অবধি ভালো জ্বীনগুলোর উপর। আমরা জানতাম তুমি আসবে অই মহিলাকে শেষ করতে, তাই এত অপেক্ষা তোমার জন্য।"

নূরজাহান বিস্মিত হয়ে বলল, "আমি কি করে তাকে শেষ করব?

-- তুমিই পারবে।এর আগে তোমাকে ১৮বছর বয়সে উপনীত হতে হবে। তাতে তুমি তোমার বাবার দেওয়া শক্তি ফিরে পাবে। তবেই তুমি তাকে শেষ করতে পারবে।

-- কিন্তু আমি তো এখনো ছোট, ১৮ বছর হতে অনেক দেরী।

-- তুমি খুব শীঘ্রই ১৮ বছর বয়সে উপনীত হবে। তবে আর জন্য তোমাকে নিজের মাকে খুজে বের করতে হবে।

-- আমার মা কি বেচে আছে দাদু? কোথায় পাবো তাকে?

-- হুম তোমার মা জ্বীনরুপে বেচে আছে, তাকে তোমায় ই খুজে বের করতে হবে।তবেই তুমি তোমার শক্তি ফিরে পাবে। হয়ে উঠবে ১৮ বছরের তরুনী।

তবে মনে রেখো তুমি এইসময়ে কোনো মানুষের সাথে বৈবাহিক কিংবা প্রণয় সম্পর্কে জড়াতে পারবেনা। তাহলে তুমি জ্বীনকন্যা থাকবেনা, সব শক্তি হারাবে। হয়ে পড়বে এক সাধারণ বালিকা।

নূরজাহান জোরগলায় বলল, সব মানতে রাজি আমি।আপনি শুধু বলুন আমার মাম্মাকে কোথায় পাব? কি করে চিহ্নিত করব?

-- দেখো তোমার বা হাতে একটা জন্মদাগ আছে, এমন একটা দাগ তোমার মায়ের হাতেও আছে। তোমরা যখন মুখোমুখী হবে, দুটো দাগ থেকে আলো বিচ্চুরিত হবে।

তখনই তুমি নিশ্চিত হবে ওইটা তোমার মা।

তুমি যখন মায়ের সাথে মিলিত হবে অই বদজ্বীনি জেনে যাবে তোমার আসল পরিচয়। তোমাকে বাধা দিতে থাকবে প্রতি পদে, চাইবে তোমাকে হত্যা করতে।


জ্বীনকন্যা...👽👹

পর্বঃ ০৩


জ্বীনসর্দার আবার একটু থেমে বললেন, "আজ থেকে তোমার লড়াই শুরু। প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাও দক্ষিণের জঙলের দিকে। বিপদসঙ্কুল স্থান, সাবধান থাকব।

আমি তোমায় অন্য কোনো সাহায্য করতে না পারলেও পরামর্শ আর কিছুটা সহযোগিতা দিতে পারব। দরকার হলেই আমাকে স্মরণ করো, তবে আমি কিন্তু তোমায় দুইবারের বেশি সাহায্য করতে পারবনা।আল্লাহ তোমার সহায় হোক, ফি-আমানিল্লাহ।" বলেই দমকা হাওয়া আবার জানালা দিয়ে শব্দ করর বেরিয়ে গেল।হুজুর আমার দিকে ফিরে বললেন, "বুঝেছো তো?"

আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম।সারারাত আর ঘুম এলোনা।শুধু ছটফট করছি, কখন আমার মাম্মাকে দেখতে পাব! আমার প্রতিশোধ পূর্ণ করতে পারব।

সকাল হতেই আমি বেরিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু হুজুরদাদু আমাকে বাধা দিলেন এবং বললেন, "তাড়াহুড়োয় কাজ কখনোই ভালো ফল দেয়না। তোমার এখনো কিছু প্রস্তুতি নেওয়া বাকি।" হুজুরদাদু একটা ব্যাগ আমার হাতে দিয়ে বললেন, "এটা তোমার কাজে আসবে। সাথে রেখো এটা। তোমাকে একা ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছেনা। কেননা, তুমি এমন এক বিপদজনক স্থানে যাচ্ছো, যেখানে তোমাকে একা যেতে দেওয়ার সাহস আমার নেই। তবুও যে তোমাকে যেতেই হবে।" হুজুর দোয়াকালাম পড়ে মাথায় ফু দিয়ে বললেন,

-- আল্লাহ তোমার হেফাজত করবেন। সাবধানে যেও। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।তিনিই তোমায় সঠিক পথ দেখাবেন। ফি-আমানিল্লাহ।আমি উনাকে সালাম করলাম।খানিকটা এগিয়ে দিয়ে হুজুরদাদু বিদায় জানালেন। পিচের রাস্তা ছেড়ে আল্লাহর নাম নিয়ে দক্ষিনের সরুপথে চলতে লাগলাম। সিলেট শহরে এমনিতে জঙল আর পাহাড়ের অভাব নেই। চলতে চলতে পাহাড়ি রাস্তায় এসে পড়লাম। পথে আদিবাসীরা যাতায়াত করছে। বুঝলাম আমি শহর পেরিয়ে এসেছি। দু-একজন আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে, বোধহয় কিছু জিজ্ঞেস করার সুবিধে পাচ্ছেনা।

আমি তোয়াক্কা না করে নিজের পথে হাটতে লাগলাম। আস্তে আস্তে আদিবাসীদের ঘর-বাড়ি, চাষক্ষেত সব পিছনে পড়ে গেল। এমন একটা জায়গায় এসে পৌছালাম যেখানে চারিদিকে গাছপালা, জনমানবশূন্য।

তাহলে এটাই সে জঙল, যেটার কথা জ্বীনদাদু বলেছিলেন। কড়া রোদে হেটে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, তার উপর ভারী ব্যাগের বোঝা। বাচ্চা মানুষ আমি, কতটুকুই হাটতে পারি! মাটিতে ঘাসের উপর বসে পড়লাম।

পেটে মনে হয় নেংটি ইঁদুর দৌড়াচ্ছে, সাথে করে তো খাবার-দাবার কিচ্ছু আনিনি। এখন খাবোটা কি?

মাথা চুলকোতে চুলকোতে ব্যাগের দিকে চোখ পড়ল। ব্যাগে দাদু খাবার দিয়েছে কিনা একটু দেখি। ব্যাগ খুলতেই বড় পলিথিনে কিছু বিস্কিট,চিপস আর পানির বোতল পেলাম। সাথে একটা খিচুড়িভর্তি টিফিন বক্স ও ছিল। দেরী না করে খানিকটা খেয়ে নিলাম।হিসেব করে খাওয়া লাগবে, জানিনা তো আর কতটা গেলে মাম্মাকে পাবো! মাম্মার কথা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ পাশের ঝোপ থেকে মানুষের আর্তনাদের আওয়াজ আসতে লাগল।ভয় পেয়ে গেলাম, এই নির্জন জংগলে মানুষ এলো কোথা থেকে! কিছু ভাবার আগেই ৩-৪ জন বাজে চেহারার লোক আমার সামনে চলে এল। ফিসফিস করে দুই-একটা কথা বলেই একটা লোক আমাকে শক্ত করে ধরে ফেলে। পা ছুড়াছুঁড়ি করতে আমার নাকে রুমাল ধরল।

জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমাকে একটা ছাউনির খুটিতে বেধে রেখেছে, মুখে রুমাল গুজে দিয়েছে। চেষ্টা করলাম হাতের দড়িটা খোলার কিন্তু এত শক্ত দড়ি যে কিছুতেই খুলছেনা। ওপাশের তাবুর ভেতর থেকে কিছু কথা ভেসে আসছে। কোনো এক মোটাকন্ঠ কাউকে অর্ডার করছে, "আজ প্রায় বাচ্চা ছেলেমেয়েদের থেকে ৮টা কিডনী পেয়েছি, কিছুদিনের জন্য এটা যথেষ্ট। তবে বাচ্চা মেয়েটার জ্ঞান ফিরলে তার ও কিডনী নিয়ে নিতে হবে। বেশী দেরী করা ঠিক হবে।" গলা শুকিয়ে গেল এসব শুনে। না এভাবে হার মানলে তো চলবেনা, হে আল্লাহ! তুমি আমায় রক্ষা করো। জ্বীনদাদু তুমি কোথায়? এসোনা একবার।

এমনসময় কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে অজ্ঞানের ভান ধরলাম। কেউ এসে কিচ্ছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার চলে গেল।এখানেই কি আমার জীবনের ইতি হবে? তা কি করে হয়, আমি চলে গেলে আমার মাম্মার কি হবে ? প্রতিশোধ ই বা নিব কি করে? ভাবতে ভাবতে দেখি একটা বড় ইঁদুর আমার তাকিয়ে আছে। ওটা আমার হাতের বাধনের কাছে গিয়ে দাত দিয়ে দড়ি কেটে দিল। আশে-পাশের লোকগুলা আচমকা চিৎকার করে উঠল।পাশে পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন ব্যাগটা নিয়ে পালাতে গিয়ে দেখি ওদের সবার চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে, মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে।আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে দেরী না করে দৌড়ে ওখান থেকে বেরিয়ে গভীর জঙলের সরুপথটা ধরলাম।


পচা লোকগুলো ব্যাগটাকে ছিন্নভিন্ন করে রেখেছে, হয়তো ভেবেছে দামী কিছু আছে। বেশ শাস্তি হয়েছে তাদের, মানুষের ক্ষতি করার ঠেলা এখন বুঝো। বিকাল পেরিয়ে এদিকে সন্ধ্যা নামতে চলল। তখন তো কিছু দেখতেও পাবনা, হাটতে পারবোই না। কোথাও আশ্রয় নিতে হবে। কোথায় নেওয়া যায়? ভাবতে ভাবতে দেখি জঙলের ২টো রাস্তা দুদিকে বেকে গেছে। কোনটা দিয়ে গেলে আসল স্থানে পৌছাতে পারব তাও জানিনা। জ্বীনদাদুকে একবার জিজ্ঞেস করব? না থাক আরেকটা সাহায্য কখন দরকার পড়ে কে জানে। বুদ্ধি খাটিয়ে আসল পথ বের করতে হবে।

কিছুই ভেবে পাচ্ছিনা। পরে মাথায় আসল বরাবর দক্ষিণের যাওয়ার কথা আমার। কিন্তু কি করে বুঝবো দক্ষিণ কোনটা? এখানের গাছপালা এত ঘন যে ঠিকমত সূর্য দেখা যাচ্ছেনা।

চোখ পড়ল হাতে থাকা ঘড়ির দিকে। দেখি ঘড়ি দিয়ে বের করতে পারি কিনা? সোজা কাটা অনুসরণ করে সামনের পথে হাটতে থাকল। সূর্য প্রায় ডুবুডুবু অবস্থা। চারিদিকে ঝি ঝি পোকার ডাক শুরু হয়ে গেছে।

আর সামনে এগোনো যাচ্ছেনা। পথিমধ্যে ই ধপাস করে বসে পড়ল। এইখানেই রাতটা পার করা যায়, যদি বাঘ-শেয়ালের সামনে না পড়ি।

খানিকটা সময় কেটে যাওয়ার পর দেখলাম জ্বলজ্বল করে থাকা এক জোড়া চোখ আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

.

নূরজাহান ভীষণ ভয় পেয়ে গেল।ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে উঠে দৌড়তে লাগল অন্ধকার পথে। চোখগুলো ও যেন তার পিছু পিছু ছুটে আসছে। কিসের সাথে হোচট খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। চোখগুলো তার কাছাকাছি চলে এসেছে। পায়ে বড্ড চোট লেগেছে, উঠতে পারছিনা। আল্লাহর নাম জপতে লাগলাম। শেয়ালটা আমার একদম কাছে আসতেই একটা জমকালো আলো বিচ্চুরিত হলো তার শরীর থেকে, আমার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে গেল, "মাম্মা।" তারপর চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে এল।চোখ খুলতেই দেখি আমি একটা কুড়েঘরে শুয়ে আছি চারিদিকে পাখি ডাকছে, সকাল হয়ে গেছে। উঠে বসতেই লক্ষ করলাম আমি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছি । দাদু তো এটাই বলেছিল যে, মাম্মার সাথে দেখা হলেই আমার বয়স ১৮ বছর হয়ে যাব।

একটা বোরকাপড়া সুন্দরী মহিলা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, আমিও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম, "কেমন আছো মাম্মা?"

-- তোকে পেয়ে খুব ভালো আছি মা। কখনো ভাবতে পারিনি তোকে আবার আমি ফিরে পাব। এই জঙলে পশু-পাখির রুপ নিয়েই শেষ জীবন কাটাচ্ছিলাম।

-- এসব বলোনা মাম্মা। দেখবে আমি পাপাকেও ফিরিয়ে নিয়ে আসব। আবার তোমরা খুব ভালো জীবন কাটাবে।

-- উনাকে কখনো ফিরে পাব কিনা জানিনা। তবে তার বড় একটা আমানত আমি নিজের কাছে ফিরে পেয়েছি এতেই আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া। তোকে আর হারাতে দিবনা মা। চল, আমরা নিজের জগতে ফিরে যাই।


-- না মাম্মা, ওই বাজে মহিলাটাকে শেষ না করে আমি কোথাও যাবনা। জ্বীনজাতির প্রত্যেকে আমার দিকে চেয়ে আছে, কবে আমি তাকে শেষ করে তাদের জীবনে শান্তি ফিরিয়ে দিব।আমি যে জ্বীনদাদুকে কথা দিয়ে এসেছি , আমি কি করে কথার খেলাপ করব মাম্মা?

-- কিন্তু এসবের মধ্যে যদি আমি আবার তোকে হারিয়ে ফেলি? খুব ভয় হয়রে মা।

-- ভয় পেয়োনা আমার কিছু হবেনা। আমি সাহসী জ্বীন মুস্তফার মেয়ে নূরজাহান, এত তাড়াতাড়ি হার মানবনা মাম্মা।

-- নূরজাহান নয় আজ থেকে তোর নাম মুনতাহা। তোর বাবার এই নামটা রাখার খুব শখ ছিল। মানুষটা তো আর নেই। বলেই মুশায়রা কাদতে লাগল। মাম্মাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই, তাও মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,

-- ভেবোনা মাম্মা, আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। আমার গায়ে বোরকা আর নিকাব এলো কোথা থেকে? মুশায়রা কান্না মুছে মুচকি হেসে বলল,

-- উপযুক্ত মেয়েদের পর্দা করা ফরজ। তোর ব্যাগে এসব ছিল, তাই পরিয়ে দিয়েছি। 

-- মাম্মা, তুমি আর এইখানে থেকোনা। শহরের দিকে ফিরে যাও, সেখানে এক হুজুরদাদু আছে।তার কাছেই আশ্রয় নাও আপাতত।

-- আর তুই?

-- আমি কালপাহাড়ে যাব, যেখানে বাজে মহিলাটা ছিল। জানিনা এখনো সেখানে পাব কিনা!

-- যাস না। ও বড্ড ভয়ানক, তোকেও মেরে ফেলবে।

-- আল্লাহর উপর ভরসা আছে তো তোমার? উনি আমাকে হেফাজত করবে। তুমি চলে যাও মাম্মা। আমাকে শুধু বলে দাও সেখানে যাওয়ার পথটা কোনদিকে?

-- কিছুটা পার হলেই এই জঙলের শেষে একটা গ্রাম পড়বে, তার শেষসীমান্তেই সব চেয়ে বড় পাহাড়টাই কালপাহাড়। ওই পাহাড়ের নিচের গুহায় ওই মহিলা নিজের তন্ত্র-মন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমিও তোর সাথে যাব, চল।

-- না মাম্মা। তুমি ফিরে যাও, এই যুদ্ধ শুধু আমার একা। আমাকে আল্লাহর ভরসায় ছেড়ে দাও। মাম্মা ব্যাগে কিছু ফল-পানি দিয়ে খানিকটা এগিয়ে দিল। তারপর আমার অনুরোধে অদৃশ্য হয়ে চলে গেল শহরে।আমি মাম্মার কথামত হাটতে থাকলাম।

হাটতে হাটতে জঙলের শেষে চলে এলাম। এইখান থেকে গ্রামটা দেখা যাচ্ছে, জনমানব ও আছে অনেক। একটু জিরিয়ে নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করলাম। এর মধ্যেই নতুন সমস্যার মুখোমুখি হলাম। কিছু মানুষ আমাকে ঘিরে ধরল। তারা আমাকে জঙ্গী ভেবে মারতে তেড়ে আসল। বহু বলার ও শুনলোনা, শুরু করল ইট ছোড়া। তখনি এক ২০ বছর বয়সী যুবক এগিয়ে আসল আমাকে বাচাতে। সে তার হাত বাড়িয়ে দিল আমি উঠার জন্য। আমি শান্তগলায় বললাম,

-- বেগানা পুরুষকে স্পর্শ করা হারাম। তারপর আমি নিজেই মাটি থেকে উঠে দাড়ালাম। লোকজন আবার আমার দিকে তেড়ে আসতে চাইল। যুবকটি ওদের থামিয়ে বলল, "উনি জঙ্গী নন, আমার বিবাহিত স্ত্রী।"

শুনে আমি চমকে উঠলাম। এসব কি বলছে ছেলেটা? একজন লোক বলল,

-- তুই আবার কবে বিয়ে করলি?

-- আমাদের ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল অনেকদিন। কিছুদিন আগে ওকে বিয়ে করলাম, ও শহরেই থাকে। আমি ভেবেছি ঘরবাড়ি বড় করে তুললে ওকে নিয়ে আসব। ও তা না মেনে নিজেই চলে এসেছে।

সবার মুখে হাসি দেখা গেল। তাদের একজন বলল, "ভালো কাজ করলি। যা বউমাকে ঘরে নিয়ে যা। কাল তোর বিয়ের দাওয়াত খেতে আসব। রান্নাটা কিন্তু বউমা করবে!"

ছেলেটা লাজুক হয়ে বলল, "হ, চাচা। অবশ্যই।" আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-- আসুন আমার সাথে। ভরসা পেলাম না তাও ছেলেটার পিছু পিছু তার বাসায় চলে এলাম। গ্রামের অন্যান্য ঘর থেকে উনার ঘর অনেক সুন্দর, কিছুটা শহুরে স্টাইলের। আমাকে একটা রুমে বসিয়ে বললেন, "আপনি বিশ্রাম করুন, আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করছি।"

-- আপনি আমাকে এইখানে কেন আনলেন?

-- না আনলে গ্রামবাসীর হাতে মার খেয়ে মরতেন। এভাবে হাতপায়ে মোজা,বোরকা কেউ পরে? চোখটা ও ঠিক মত দেখা যাচ্ছেনা। সবাই তো জঙ্গি ভাববেই।

-- আপনি আমাকে এভাবে বকছেন কেন?

-- বকছিনা, আপনাকে বুঝানোর চেষ্টা করছি। আপনি বিশ্রাম নিন, কপাল থেকে তো রক্ত ও বের হচ্ছে ইটের বাড়ি খেয়ে।আমি ওষুধ আনছি।

উনি হুড়মুড় করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি বিছানায় ক্লান্ত হয়ে বসলাম। কপালের কাটা জায়গায় জ্বালা করছে,রক্তে নিকাব টা ভেজা ভেজা হয়ে গেছে।

ছেলেটাকে সুবিধার লাগছেনা, একটু বেশিই বিনয়ী। তাও উনার নিকট আমি কৃতজ্ঞ, আজ যেভাবে বাচালেন আমায়। নিকাব খুলতে যাব দেখি উনি রুমে ঢুকলেন। তাড়াতাড়ি আবার পড়ে নিলাম। 

-- ভয় পাচ্ছেন নাকি?

-- ভয় পাবো কেন?

-- মনে হল। এই নিন ওষুধ, কাটা জায়গায় লাগিয়ে নিন। পারবেন তো? নাকি আমি সাহায্য করব আপনাকে? ওষুধটা কেড়ে নিয়ে বললাম,


জ্বীনকন্যা...👽👹

পর্বঃ ০৪ ও শেষ 


-- মনে হল। এই নিন ওষুধ, কাটা জায়গায় লাগিয়ে নিন। পারবেন তো? নাকি আমি সাহায্য করব আপনাকে? ওষুধটা কেড়ে নিয়ে বললাম,

-- আমি পারবো।ধন্যবাদ।

-- আচ্ছা। আপনার বোরকা আর নিকাব তো রক্তে ভিজে গেছে। এই নিন এসব ছেড়ে শাড়িটা পড়ে নিন। পরে অইগুলো শুকোলে আবার পড়ে নিবেন।

-- শাড়ি পরলে সবাই আমার মুখ দেখে যাবে।

-- আপনি এই যুগেও এমন কেন? শুনুন একটু সমস্যায় পড়েছেন, উদ্ধার পাওয়ার জন্য আপনাকে একটু অভিনয় করতে হবে। আমার স্ত্রী হওয়ার অভিনয়।

-- অসম্ভব। আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।

-- আচ্ছা যান, পরে গ্রামবাসীরা আবার পিটুনি দিলে আমি কিন্তু কিছু জানিনা।

-- ভয় দেখাচ্ছেন?

-- ভয় পাচ্ছেন বুঝি?

-- মোটেও না। আমি বেশীদিন অভিনয় করতে পারবনা।

-- করা লাগবেনা। শুধু ২-৩দিন করলেই চলবে ওদের বিশ্বাস করার জন্য। তবেই এই গ্রামের সীমানা পার হতে পারবেন নতুবা ওরা আপনাকে গ্রাম থেকে বের হতে দিবেনা। আমাদের গ্রামের মানুষ এমনিতে শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিছুদিন আগে একটা দাঙ্গা হয়েছিল। তারপর থেকে সবাই একটু সর্তক থাকে আর কি! অপরিচিত কাউকে দেখলেই তেড়ে আসে। যাই হোক, আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। দরকার হলে ডাকবেন।

বলেই চলে গেল। বড্ড অদ্ভুত লোক দেখছি! কাটা জায়গায় ওষুধ লাগিয়ে ফ্রেশ হয়ে শাড়িটা পরে নিলাম। আয়নায় নিজেকে দেখে অবাক লাগছে এই প্রথম নিজের অন্যরুপ দেখছি। ঠিক মায়ের মত মুখটা লাগছে। মাম্মা কি দাদুর কাছে যেতে পারলো, জানতে ও তো পারলামনা।

দরজায় আবার কড়া পড়ল, নিশ্চয়ই ছেলেটা আবার এসেছে। এত্ত ছ্যাচড়া কেন ছেলেটা? বিপদে না পড়লে এর ছায়া ও মাড়াতামনা। বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই দেখি.....

.

আমার সমবয়সী কয়েকটা মেয়ে হুড় করে রুমে ঢুকে গেল। বিছানার উপর বসে পা দোলাতে দোলাতে সবার মধ্যে একজন তার পাশের সামান্য জায়গা দেখিয়ে বলল,

-- ভাবী বসুননা। আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, না, আপনারা বসুন। সে আবার বলল,

-- ভাবী আপনাকে হলুদ শাড়ীতে খুব সুন্দর লাগছে, আপনি তো দেখতে পরীর মত। এইজন্য ভাইয়া এতদিন আপনার প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে গোপনে বিয়েও করে ফেলল। অন্য একটা মেয়ে মুখ ভেঙ্গচিয়ে বলল,

-- সুন্দর তো আমিও কম না, শুধু নাকটা একটু বোচা বলে ভাইয়া পছন্দ করলনা। নতুবা আমার জায়গাটা এই মেয়েটা কখনোই নিতে পারতনা।

আমার হাসি পেলেও চেপে বললাম, বোন দুঃখ করোনা।আমি যদি কখনো চলে যাই তখন আপনি উনাকে বিয়ে করে নিবেন কেমন! মেয়েটা আমার সমবেদনার ভাষাটা হয়তো পছন্দ করলনা, কথার উত্তরে মুখ বাকালো।

মেয়েগুলো কথা শুরু করেছে যে এখনো থামার নাম নেই।চাপার খুব জোর আছে বলতে হয়। মি. ছ্যাঁচড়াটা কোথায়! এত্তক্ষণ তো বেশ রুমের সামনে ঘুরঘুর করছিল, এখন কোথায় এসে মেয়েগুলো সরিয়ে নিয়ে আমাকে একটু শান্তি দিবে সেটাই উনি লাপাত্তা। প্রায় ঘন্টাখানেক আমার কান দুটো ঝালাপালা করার পর তারা বিদায় হলো।যাওয়ার সময় বলে গেল, "ভাবী পরে আবার আসব!" সত্যিই যদি কিচ্ছুক্ষণ পর আবার আসে সেই ভয়ে দরজা লক করে দিলাম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, একটু ঘুমিয়ে নিলে ভালো হত। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম চলে এল।

দরজা নক করার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দরজা খুলতে দেখি উনি দরজার সামনে হাতে খাবারভর্তি ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।আমি সরে আসতে উনি রুমে ঢুকে টেবিলে ট্রে রেখে বললেন, "এই সন্ধ্যাবেলায় ঘুমাচ্ছিলেন?" 

রুমের জানালা দিয়ে বাহিরে উঁকি দিয়ে দেখি আসলেই সন্ধ্যা নেমে এসেছে। উনার কথায় সায় দিয়ে বললাম, "বুঝতে পারিনি!"

-- ফ্রেশ হয়ে খেতে বসুন। ওয়াশরুম টা এইদিকে।

-- ধন্যবাদ। ফ্রেশ হয়ে এসে বসলাম। লজ্জা লাগছে খেতে, উনি ছানাবড়া চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,

-- আপনি কি এখানে এভাবে দাড়িয়ে থাকবেন?

-- কেন বসবো? কপালটা রাগে কুচকালাম। উনি মুখ টিপে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। খুব ক্ষিদে পেয়েছে তাই দেরী না করে খেয়ে নিলাম।

অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও মি. ছ্যাঁচড়া এলেননা। তাই আমি ট্রে টা কিচেনে রেখে আসার জন্য রুম থেকে বের হলাম। শাড়ি পরায় একটুও ঠিকমত হাটতে পারছিনা, মনে হচ্ছে হিজিবিজি করে কাপড় জড়িয়ে রেখেছি। অনেক বড় বাসা,তাতে রুমের সংখ্যা কম নয় বৈকি । কিচেনের হদীস পাচ্ছিনা, উকি দিয়ে রুম চেক করে পরে কিচেন পেলাম। কিচেনে ট্রে টা রেখে রুমে চলে আসব দেখি ছাদের দরজা খোলা। খোলা পরিবেশে বাতাস অনুভব করতে ইচ্ছে হলো একটু। তাই ছাদে উঠলাম। হালকা চাঁদের আলোয় ছাদটা বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে, গিয়ে এক ধারে পাতা বেঞ্চিতে বসলাম। "হাওয়া খাচ্ছেন বুঝি?" শুনে ঘুরে তাকালাম। মি. ছ্যাঁচড়া এখানেও চলে এসেছে, আচ্ছা লোক তো! আমি অবাক হয়ে বললাম,

-- আপনি কখন এলেন? আমার পাশের খালি জায়গায় দূরত্ব রেখে বসে বলল,

-- ছাদেই ছিলাম, আপনি খেয়াল করেননি।

-- ওহহ আচ্ছা।

-- আপনার সম্পর্কে তো কিছুই জানা হল না। কে আপনি? থাকেন কোথায়? আর জঙ্গল পেরিয়ে এই গন্ডগ্রামেই বা এলেন কেন? ছেলেটার প্রশ্ন শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম, আমার আসল পরিচয় জানতে পারলে হয়ত এরা আমাকে এইখানে শেষ করে দিবে। জঙ্গী ভেবে যা করল, জ্বীন জানলে তো বন্ধি করে শূলে ছড়াবে। একে আসল পরিচয় বা উদ্দেশ্যের কথা বলা যাবেনা।

-- আমি মুনতাহা, মাম্মার সাথে সিলেটের এক অভিজাত শহরে থাকি। শুনেছি এই গ্রামের শেষ সীমানায় অনেক সুন্দর পাহাড় আছে, ঘুরার জন্য পারফেক্ট। তাই ঘুরতে এলাম। ছেলেটা হকচকিয়ে তাকিয়ে বলল, "শুধুমাত্র ঘুরার জন্য এতদূর এলেন? পাহাড়গুলোর সম্পর্কে ধারণা আছে আপনার?"


-- আপনারো কি আমাকে জঙ্গী মনে হয়? ধারণা নেওয়ার জন্য ই তো এসেছে। এইবার আপনার পরিচয়টা জেনে নিই।

-- আমি হাসনাত, এখানের গ্রামপ্রধানের ছেলে। মা-বাবা অবশ্য ২বছর আগেই গত হয়েছেন। তাই একাই থাকি, ইন্টারন্যাশনাল সফটওয়্যার কোম্পানীতে জব করি। বাবা এই গ্রামের সবার প্রিয়জন ছিলেন।তাই গ্রামবাসীরা খুব ভালোবাসে আমাকে।ইদানীং গ্রামে খুব দাঙ্গা এবং খারাপ শক্তির উৎপাত হয়েছে।তাই গ্রামটার চারিপাশে বন দেওয়া হয়েছে, যাতে গ্রামের মধ্যে কেউ প্রবেশ করলেও কোনো অলৌকিক শক্তি ব্যবহার করতে না পারে। আপনার বেশ দেখে তাদের সন্দেহ হয়েছিল তাই ওরা এমন করেছে।তাদের হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি।

-- আমি কিছু মনে করিনি, আপনি ক্ষমা চাইবেননা। আমি তো আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।

-- ওসব ছাড়ুন। ২দিন এইখানে কাটিয়ে শহরে ফিরে যান। আমি আপনাকে দিয়ে আসব।

-- আমি আমার কাজ শেষ না করে যেতে পারব না। আমাকে সেখানে যেতেই হবে

-- জায়গাটা নিরাপদ নই বুঝার চেষ্টা করুন।

-- আশা করি আপনি আমাকে বাধা দিবেননা। যদি একান্তই দিতে চান, তবে আমি এক্ষুণি এই স্থান ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হব ।

-- আচ্ছা দিবনা। একটা কথা ছিল?

-- জ্বি বলুন।

-- আপনাকে এত আলাদা লাগে কেন? চোখ দুটো এত ঘন নীল ,চুলের রঙটা

অন্যরকম, গায়ের রঙ সবমিলিয়ে আপনাকে আলাদা জগতের মানুষ মনে হয়।

-- আল্লাহর সৃষ্টির উপর কারো হাত থাকেনা। উনি আমাকে যেমন বানিয়েছেন আমি ঠিক তেমনি। আর এতবার আমার দিকে তাকাবেননা, কেননা আমি বেগানা নারী। 

-- আচ্ছা। অনেক রাত হলো। চলুন কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন।

-- আমি আর কিছু খাবনা। বলে উঠলাম, হাটতে গিয়ে শাড়িতে পা জড়িয়ে গেল। পড়তে পড়তেও পরলামনা। উনি আমার হাত শক্ত করে ধরে আছেন।তাড়াতাড়ি উঠে বললাম,

-- হাতটা ছেড়ে দিন।

-- দুঃখিত, আসলে আপনি পড়ে যাচ্ছিলেন ।

-- এভাবে বেগানা মেয়েদের স্পর্শ করা যায়না। আর স্পর্শ করবেন না আমায়। বলেই উনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিচে নেমে এলাম। ছেলেটা আসলেই মি. ছ্যাঁচড়া ।

সকালে উঠেই দেখি পুরো বাড়ী গমগম করছে। কালকের মেয়েগুলো, ইট ছোড়া সেই লোকসহ আরো অনেক অপরিচিত মহিলা আশে পাশে ঘুরঘুর করছে। মেয়েগুলা আমাকে দেখে বলল, ভাবী তোমার হাতের রান্না খাওয়ার জন্য গোটা গ্রাম চলে এসেছে। চল রান্নাঘরে চল। কি বলে মেয়েগুলো? আমাকে এত মানুষের রান্না করতে হবে? আমি তো রান্নাই জানিনা।এইবার কি হবে? মি. ছ্যাঁচড়া টা কোথায়? অতি বিনয় দেখানোর নাম করে আমাকে এভাবে বাশ দেওয়া। একবার শুধু হাতের কাছে পাই ব্যাটাকে। কিন্তু এখন এদিক সামলাব কেমন করে?

মেয়েগুলো আমাকে রান্নার জিনিসপত্র বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটু হেল্প করার জন্যও দাড়ালোনা। কি করে রান্না করব কিছুই বুঝতে পারছিনা।

এমনসময় উনি এলেন এবং কিচেনের ডোর লক করে দিলেন। ভয় পেয়ে গেলার উনার আচরণে। উনি আমার কাছে আসতেই আমি জোরে চিৎকার দেওয়ার আগেই উনি মুখ চেপে ধরলেন।

-- চেচাচ্ছেন কেন? আমি আপনাকে হেল্প করার জন্য এসেছি। না চেচিয়ে চুপ করে আমার কথামত কাজ করে যান। বুঝচ্ছেন?

-- হুম। সব রান্না ,কাটাকুটি উনিই করলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম একটা ছেলে কি করে মেয়েদের কাজে এত পটু হয়?

.

২দিন টা খুব ভালোই কাটলো। মি.ছ্যাঁচড়া অনেক হাসাতে জানে, খুব ভালোই লেগেছে ওর আর গ্রামের মানুষের সাথে কাটানো সময়গুলো। এখন আমাকে আমার পথেই ফিরতে হবে। বোরকা পড়ে,ব্যাগ গুছিয়ে নেওয়া মাত্রই মি. হাসনাত আমার সামনে চলে এলেন। গম্ভীরকন্ঠে বললেন, "চলে যাবেন?"

-- জ্বী, ফেরার সময় হয়ে এল। নিজের কাজে এমনিতে অনেকটা বিঘ্ন ঘটেছে।

-- আপনাকে আমার কিছু কথা বলার ছিল, যেটা এই মূহুর্তে বলা জরুরীবোধ করছি।

-- জ্বী বলুন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,

-- জানিনা ব্যাপারটা আপনি কেমনভাবে নিবেন। তবে আমি সরাসরি বলে দিচ্ছি আমাদের এই অভিনয়ের স্বামী-স্ত্রী চরিত্র বাস্তবতায় রুপান্তর করা যায়না? আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।

-- এসব আপনি কি বলছেন? হুট করে চিনেন না জানেন না একটা মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছেন। বিপদে পড়েছিলাম আপনি আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন তার জন্য আমি আপনার কাছে যথেষ্ট কৃতজ্ঞ।কিন্তু তার মানে এই না যে আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাব। এমন বাজে আচরণ আপনার থেকে আশা করিনি। ভালো থাকবেন, আসি। ব্যাগটা নিয়ে তাড়াতাড়ি করে উনার বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। গ্রামটা পার হয়ে শেষসীমানায় যেতে আরো আধঘন্টার মত প্রায় লাগবে। বিকালের পড়ন্ত রোদে প্রচুর গরম লাগছে। ১৮বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর তো আমার শক্তি ফিরে আসার কথা। এটার কথা একদমি ভুলে গেছি।সেটা মনে থাকলে এত ঝামেলা পোহাতে হত না। যাই হোক, অদৃশ্য হওয়ার চেষ্টা করলাম পারলামনা।

বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও বিফল হলাম। হঠাৎ হাসনাতের কথা মনে পড়ল এই গ্রামে কোনো অলৌকিক শক্তি দ্বারা কিছু করা যাবেনা।

নিরুপায় হয়ে পথ চলতে লাগলাম। শেষসীমানায় পৌছে গেছি, এখানে মাম্মার বলামতই পাহাড় আছে। সবচেয়ে বড় পাহাড়টাই কালপাহাড়। কালপাহাড়ের নিচেই গুহাটা আছে। দেখে মনে হল না কেউ আছে। পিছন থেকে ডাক এলো নূরজাহান, এটা তো নিষ্পাপ মাম্মার কন্ঠস্বর। পিছনের পথটায় এগিয়ে কাউকে পেলামনা, একিভাবে ডান এবং বামপাশের পথ থেকে ছ্যাঁচড়া এবং মায়ের গলাস্বরে কেউ আমাকে ডাকলো। মনে হচ্ছে আমার চারপাশটা ঘুরছে। গুহার পথটা আমি হারিয়ে ফেলছি। বুঝলাম এভাবে আমাকে আটকাতে চাইছে ওই শয়তানি। আমাকেও তো চিনোনা তুমি। ভেবেছো তোমার এমন ফাদে পা দিয়ে আমি হার মানব। তা তো হবেনা, আল্লাহ বলে মনে মনে আসল গুহার পথ খুজার চেষ্টা করলাম।

ব্যস! চারপাশটা স্থির হয়ে গেল। গুহাটা আগের জায়গায় ই আছে। গুহার ভেতরে ঢুকলাম, কিসের একটা চোখ ধাধানো আলো গুহাটাকে আলোকিত করে রেখেছে।

এক মহিলার উচ্চস্বরে হাসি শুনলাম এবং সে আমায় বলল, স্বাগতম নুরজাহান ওরফে মুনতাহা। সামনে তাকিয়ে দেখি অসম্ভব বাজে দেখতে একটা মহিলা বিরাট সিংহাসনে বসে আমাকে দেখে কুৎসিতভাবে হাসছে।

-- এসো। তোমার আসার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। খুব নাম শুনেছি তোমার, অনেক আগে থেকেই। তুমি আসবে আমাকে ধবংস করতে, জ্বীন আর মানুষজাতিকে শান্তি ফিরিয়ে দিতে। শুনতে শুনতে কানে তালা লেগে গিয়েছিল, চেয়েছিলাম তোমার মা আর বাবাকে শেষ করে তোমার নামটাই মুছে দিতে।

কিন্তু না তুমি অত সহজে হার মানলেনা।কায়দা করে ঠিক আমাকে মারার জন্য জন্ম নিলে। চাইলাম গ্রামবাসীদের দিয়ে তোমাকে আঘাতে আঘাতে শেষ করতে তাতেও তুমি পার পেয়ে গেলে। পথ ভুলিয়ে তোমাকে অন্ধকার জগতে পাঠাতে চেয়েছিলাম তাতেও তুমি জিতে গেল।কিন্তু দুঃখের বিষয় কি জানো? ভাগ্য সবসময় সবার সহায় হয়না।যেমন এখন তোমার সহায় থাকবেনা। আজই তোমার খেলা শেষ।

বলে আমাকে দূরে ছুড়ে ফেলল,গুহার বাহিরে। নিচে পড়ে গিয়ে হাতে ব্যথা পেলাম।

আবার উঠে দাঁড়িয়ে আল্লাহর নাম নিলাম। ততক্ষনে সেও গুহার বাহিরে এসে পড়েছে। আমি হেসে বললাম,

-- সব সময় খারাপ রা জিতবে সেটা কোথায় লেখা আছে নানুজান। অনেকদিন তো রাজত্ব করলেন, ইচ্ছেমতো নিজের শক্তির অপচয় করলেন। এখন না হয় মরার আগে কালেমাটা পড়ে নিন। কেননা, এটাই আপনার শেষমুহুর্ত।

-- আমাকে ভয় দেখাস? এত সাহস তোর! দেখ তোর কি হাল করি। বলেই অনেকগুলো আগুন গোলা ছুড়ে মারল। নিজের শক্তি তা ওর দিকেই ফিরিয়ে দিতে চাইলাম। আগুনের গোলাগুলো তার দিকে চলে গেল। তার মানে আমার শক্তি কাজ করছে। মহিলা উড়ে পাহাড়ের উপরের অংশে উঠে হাসতে লাগল।

নিজের শক্তি দিয়ে ওকে আঘাত করতে চাইলাম, কিন্তু কিছুই হচ্ছেনা। তার এতবছরের শক্তিশালী শক্তির কাছে আমার শক্তি খুব সামান্য। সে এইবার আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি আল্লাহর নাম জপ করতে লাগলাম। জ্বীনদাদুর কন্ঠস্বর আমার কানে ভেসে আসলো। 

"দাদু এভাবে ও শেষ হবেনা। তোর ব্যাগে একটা আল্লাহর কালামযুক্ত তলোয়ার আছে সেটা তুমি আল্লাহর কালাম পড়ে তাকে আঘাত করো। এই তলোয়ার কেবল তোমার হাতেই কাজ করবে।" দাদুর কথায় জোর পেলাম। ব্যাগের তলা থেকে সযত্নে কাপড়ে মুড়ানো তলোয়ারটা বের করলাম।ডাইনীটা এখনো হাসতে হাসতে আমার দিকে আসছে।

আল্লাহর কালাম মনে মনে জপতে জপতে লাফিয়ে ডাইনীর বুকে বসিয়ে দিলাম। শক্তি ব্যবহার করে। পাহাড়ের উপর তুলে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলাম। শান্তি লাগছে প্রতিশোধ নিতে পেরে। মাম্মা আমার পাশে কান্নাভেজা চোখে দাঁড়িয়ে আছে। পাপার কথা ভেবেই কান্না পাচ্ছে। সবি হলো ,কিন্তু পাপাকে ফিরে পাওয়া হলোনা। কান্না করতে করতে মাম্মাকে জড়িয়ে ধরলাম। একটা মিষ্টি কন্ঠস্বর বলল,

-- মুনতাহা মা! চমকে উঠলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি একজন সুশ্রী পুরুষ হাত বাড়িয়ে আমাকে ডাকছে। মাম্মা কাপা গলায় বলল, তোর বাবা!

পাপাকে জড়িয়ে ধরে কেদে কেদে বললাম, আমি তো ভেবেছি তোমাকে আর ফিরে পাবোনা।

-- তোমাদের জন্য ই তো বেচে ছিলাম। ডাইনীটা আমাকে নিজের প্রতিপত্তি বৃদ্ধির প্রয়োজনে বাচিয়ে রেখেছিল ।সেদিন তোমার মাকে ভয় দেখানোর জন্য আমার বুকে সামান্য তীব্র ব্যথার সৃষ্টি করেছিল।চল মা আমরা জ্বীনজগতে ফিরে যাই।

এই জগত আমাদের জন্য নয়।

হঠাৎ দেখি মি. ছ্যাঁচড়া দাঁড়িয়ে আমার দিকে কান্নাভেজা চোখে তাকিয়ে আছে। তার কাছে তার হাত স্পর্শ করে বললাম, "খারাপ ব্যবহারের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আসলে আমিও আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার শর্ত ছিল আমার লড়াই চলাকালীন কোনো প্রকার প্রণয়ে আমি জড়াতে পারবনা। তাহলে আমি আর জ্বীনকন্যা থাকবনা। কিন্তু আপনি এখানে এলেন কি করে?"

-- আপনার পিছু নিয়ে চলে এসেছি। এখন তো আপনার লড়াই শেষ। এখনো কি আমাকে ফিরিয়ে দিবেন?

-- আমাকে ক্ষমা করুন আমি আপনার প্রস্তাব কখনোই গ্রহণ করতে পারবনা। আমার কর্তব্য শেষ, এখন আমাকে আমার জগতে ফিরে যেতে হবে। আমার মাম্মা-পাপা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।তবে সবসময় আপনি অনুভব করবেন আপনার ভালবাসা আপনার আশে পাশে কোথাও আছে। বিদায়!

ফি-আমানিল্লাহ।

হাসনাতের চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। ঝাপসা দৃষ্টি তে দেখছে মুনতাহা তার বাবা-মায়ের হাত ধরে ঘন ধোয়ায় মিলিয়ে গেল।

হয়তো আর দেখা হবে না কিন্তু অনুভব করতে তো পারব জ্বীনকন্যাটাকে।


......সমাপ্ত.......


লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা


রহস্যময় গল্প গুলো পড়ুন।