গল্প:জমাট অন্ধকার | রহস্যময় গল্প ২০২৪

 ভয়ংকর গল্প

ভয়ংকর গল্প

জমাট অন্ধকার...👽👹

পর্ব: ০১


বিরক্ত হয়ে সবকটা ছেলেকেই ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে রিমুভ করে দিলাম। তার খানিকটা পর অপরিচিত একটা আইডি থেকে মেসেজ আসলো। নাম, নূরা আহমেদ। 

-- কেমন আছেন আপু?

-- আমি হাসি মুখ করে বল্লাম,  জ্বি ঠিকঠাক আছি। 

-- আপু সত্যি বলতে আমি একজন ছেলে!  একটা ভিডিও দেই, দেখেন। আপনার ভালো লাগবে, মজা পাবেন, শিক্ষনীয় ব্যাপার। 

-- আমি শুকনো মুখে বল্লাম, আচ্ছা!

ভিডিও অন করে আমি কেমন নিথর হয়ে গেলাম। হাত থেকে ফোন পরে গেলো। শরীরে বিন্দু বিন্দু  ঘাম জমা হতে লাগলো। ফোনটাকে আর ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ঘেন্না লাগছে, অশ্লীলতার ঘেন্না!

.

পাশের মেস বাড়িতে আপত্তিকর অবস্থায়  "মেয়ে" ধরা পরেছে! 

চার দিকে এই নিয়ে বেশ হৈহল্লোর শুরু হলো। জৈষ্ঠ্য মাসের মাছির মত একএক করে মানুষ ঝোড়ো হতে লাগলো। পাশের বাসার ছোট ছেলেটা দৌড়াচ্ছে আর বলছে, ছেলেমেয়ে ধরা পরেছে গো!

এখন সময় রাত সারে ন'টা, রমজান মাস। আমি মোবাইল রেখে হৈহল্লোর শুনে জানালা দিয়ে উকি দিলাম। ল্যাম্পপোস্ট-এর আলোয় আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে মসজিদের মুসল্লীরাও ঝোড়ো হচ্ছে একসাথে! ভীড়ের মাঝখানটায় এক জোড় কাপল অর্ধ বস্ত্র অবস্থায় দাঁড়ানো। একজন বুক ফুলিয়ে গিয়ে ছেলেটার মুখে থাপ্পড় মারলো কষিয়ে! ঝোড়ো হওয়া আমজনতার মাঝখান থেকে কেউ কেউ জুতো ছুড়ে মারলেন। খবর টা চেয়ারম্যান অব্দি চলে গেলো।

ভীড় ঠেলে চেয়ারম্যান সাহেব ঘটনার কেন্দ্রে গিয়ে বসলেন। পরিস্থিতি নিরব হচ্ছে আস্তে আস্তে।

জানালাটা লাগিয়ে দেয়াই এখন শ্রেয়। আমি জানালা লাগিয়ে পর্দা টেনে দিলাম! 

.

সেহরির সময়, টেবিলের বিপরীত পাশের চেয়ারটায় ঘুম ঘুম চোখে আমার ছোটবোন বসে আছে। নাম, মিমি। 

-- মা পাশের চেয়ারে বসে ভাত দিতে দিতে বল্ল, ঝিমি তোর পড়ালেখা কেমন চলছে?

-- আমি প্রসঙ্গ পাল্টাবার ভঙ্গিমায় বল্লাম, বাবা  বাসায় ফিরেনি?

-- মিমি লোকমা মুখে দিতে দিতে বল্ল, মা আপু কিন্তু কথার প্রসঙ্গ ঘোরাচ্ছে। 

-- ছোট বোনের চোখে তাকিয়ে বল্লাম, মা  ঐযে ফকির বাড়ির লম্বা করে একটা ছেলে আছে না?

-- মিমি আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বল্ল, জানো মা আপু আজকাল প্রচুর পড়াশোনা করে। পড়া শেষ করে নামাজ, নামাজ শেষ করে আবার পড়া। মাঝে মাঝে দেখি ওয়াশ রুমেও বই নিয়ে যায়! আজকাল দিনের বেলা আপুকে খাইতেও দেখিনা।  খালি পড়ে আর পড়ে।

-- মিমির দিকে তাকিয়ে কথার তাল মিলিয়ে মা বল্ল, ঠিকই তো। রোজার মাস চলছে দিনের বেলা খাবে কেন? 

আমার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে মা বল্ল, তোদের বাবা বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গেছেন। 

মায়ের হাসিমুখ দেখে আমি চমকপ্রদ হলাম। বাবা বাসায় নেই অথচ সেকথা আমাদের সাথে মা হাসিমুখে বলছে! 

যে কারণেই হোক বাবা যদি রাত ন'টার পর বাসায় ফিরে তাহলে পরবর্তী দুদিন মায়ের মুখ গোমড়া থাকে। এক লোকমা ভাত ও মুখে নেয় না। 

-- বাবা কত আব্দার করে বলে, একটু খাও সোনা। 

-- মা কঠিন মুখ করে বলে, সোনা রুপা সব খাবো, তবুও তোমার বাড়ির ভাত খাবো না!

.

মাঝে মাঝে এসব কথা শুনে আমার ভালো লাগে। আজ বিচিত্র কারণে খারাপ লাগছে! রহস্য খুব গভীর ব্যাপার। বুঝতে পারলে এক আকাশ মিটমিট হাসি জমা হয় মনের ভেতর। না বুঝলে সেটা হয় তিতায় বিদঘুটে অবস্থা, যেন প্রকাণ্ড নিমগাছ! আমি রহস্য বুঝলাম না। আমার মন কেমন যেন তেতো তেতো লাগছে!


সকাল নয়টায় ঘুম ভাংলো আমার। পাশের বালিশে চিংড়ির মত গুটি মেরে শুয়ে আছে মিমি।  বালিশের ওপাশে আমার ফোন। কেন জানি আবার ইচ্ছে হলো ফোনটা হাতে নেই।

-- হিন্দু একটা ছেলে সালাম দিয়ে মেসেজ রিকুয়েষ্ট দিলো! কি বিষ্ময়কর ঘটনা, হিন্দু মানুষ ও সালাম দেয়?

-- আমি কৌতুহল নিয়ে সালামের উত্তর দিলাম!  বিষ্ময় নিয়ে জানতে চাইলাম, আপনার কি নাম?

-- উনি মেসেজ সিন করলো না! 

আগ্রহ নিয়ে মেসেজ করার পর সিন না করলে কেমন লাগে আমি প্রথম জানলাম! আমার খানিকটা বিরক্তি আসলো। বিরক্তি নিয়ে ছোটবোন কে ডাকলাম। 

-- এই মিমি, বেলা অনেক হয়েছে, উঠ এখন!

-- মেয়েটা কালো মুখ করে বল্ল, হুম উঠছি!

-- আমি চুপ করে থাকলাম, কিছু বল্লাম না। 

মিমির এখন যৌবন গ্রহণের কাল, নানান কারনে মুখ কালো থাকবে নানান কারনে হাসবে সেটাই তো সাভাবিক।

আমার ছোট বোন এখন নিউ টেন-এর বাঘা একজন ছাত্রী। বিষ্ময়কর ভুবনে বাঘা বাঘা মানুষের কষ্টটাও থাকে বাঘা বাঘা। মিমির কষ্টের তীব্রতা আমি টের পাই। 

একরাতের এগারোটার দিকে টেবিলে বসে মনযোগ দিয়ে সরল অধ্যায়ের অংক কষছে মিমি। কি কঠিন মনযোগ! আমি ডাক দিতে গিয়েও দিলাম না। 

খানিকটা পর টেবিল থেকে ফোপাঁনো কান্নার আওয়াজ পেলাম।  কান্না করে বইয়ের পাতা ভিজিয়ে ফেল্ল। একটু পর পর নাক ঝাড়ে আবার ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। 

আমি ঘুমের ভাব ধরে কাঠের মত শুয়ে থাকি। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারিনা।


আরেকদিন আমি কলেজে গেলাম না, দুপুর বেলায় মিমি মন খারাপ করে স্কুল থেকে বাসায় এসে হাজির!

-- আমি শুকনো গলায় জিগ্যেস করলাম, কিরে টিফিন পিরিয়ডে বাসায় কেন?  নাকি স্কুল ছুটি দিয়েছে?

-- মিমি কিছু বল্ল না, আমায় পাশকাটিয়ে রুমে চলে গেলো। গোছলখানায় ঢুকার আওয়াজ পেলাম। ঘন্টা খানেক লাগিয়ে গোসল শেষে মিমি এসে আমার পাশে বসলো। আমি কিছু বলার আগেই মিমি আমায় জড়িয়ে ধরে বল্ল, জানিস আপু আমাদের ক্লাসের সব মেয়েই মা হতে পারবে শুধু আমিই পারবো না! লিলি নামের একটা মেয়ে আমার মতই ছিলো এতোদিন।  তার-ও আজ গভীর পেট ব্যাথা হলো। 

-- আমি নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কিরে লিলি পেটের ব্যাথা কি খুব যন্ত্রণাদায়ক? কষ্ট হচ্ছে তোর? 

-- লিলি কান লাল করা লজ্জা পেয়ে বল্ল, পেটের এই ব্যাথা সুখদায়ক। বড় ভালো লাগছে আমার।


দু'জন  বান্ধবী ধরাধরি করে লিলিকে বাসায় নিয়ে গেলো। সারা স্কুলের মধ্যে নিজেকে তুচ্ছতম মনে হচ্ছিলো। ক্লাসের মেয়েরা জানি আমার দিকে কেমন করে তাকায়! 

আমি আর স্কুলে যাবো না আপু।

মিমির পিঠ চাপড়ে ধরে বলেছিলাম, আচ্ছা থাক যেতে হবে না!

আমার ভাবনার রেশ কাটলো হিন্দু ছেলেটার মেসেজের শব্দে। 

-- মন খারাপ করে বসে আছেন কেন?

-- কাকতালীয় ব্যাপার!  আমার মন খারাপ সে কি করে জানলো? আমি মৃদু হেসে বল্লাম, জানতে চেয়েছিলাম...  আপনার নাম কি?

-- ছেলেটা দ্রুতই বলে দিলো, আপনার নাম যদি "ঝিমি" হয় আমার নাম "বমি"! নাকে রুমাল চাপ দেন। তা-না হলে আমার নামের গন্ধে আপনার 'বমি" আসবে!

-- আমি দ্রুতই এক হাতে নাকে ওড়না চেপে ধরলাম। মিমি আমার কাণ্ড দেখে ঘর কাপিয়ে হাসতে লাগলো। আমি খানিকটা লজ্জা পেয়ে বল্লাম, আপনি ভারী দুষ্টু! 

আমাদের কথা চলতে থাকলো। বিকেলেই জানলাম ছেলেটার নাম, "শান্ত চন্দ্র দাস"। নাম শুনবার পর থেকেই ভেবে রেখেছি তাকে আমি শান্ত বলে ডাকবো।


পাশের বাসার এক মহিলা এসে মায়ের সাথে কি যেন ফিসিরফিসির কথা বলছে। 

-- কথার এক পর্যায়ে মা ক্ষেপে গিয়ে বললেন, আমার মেয়ের পিরিয়ড হয়না এটা আমাদের সমস্যা। আপনি এটা নিয়ে ফিসিরফিসির করছেন কেন?

বৃদ্ধ মহিলা টি মায়ের কথায় আক্রান্ত হয়ে লেজ গুটিয়ে বেড়িয়ে গেলো।

এক'কান দু'কান করতে করতে মহল্লা ছড়িয়ে গেলো। এক ভাবি আরেক ভাবির সাথে মিমির ব্যাপারে ফিসফিস করে কি যেন বলে। সাথে সাথে কেমন ফ্যালফ্যাল করে হাসে। মিমি এসব নিয়ে এখন আর কাঁদেনা। সাভাবিক গলায় মাকে গিয়ে বলে, আমার জন্য অনেকের অনেক কথা শুনতে হয় তোমাদের। আমি বরং এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। মা কোন কথা বলতে পারেনা, মিমি কে আষ্টেপৃষ্ঠে আকড়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে।মিমি কাঁদেনা, পাথর হয়ে বসে থাকে মায়ের কোলে।

আজ, ২৬তম রমজান। শবেকদর হবার চতুর্থতম  রাত্রি। রাত্রিটা কেমন নিঝুম, সারা ঘর অন্ধকার। জায়নামাজে বসে গভীর প্রার্থনায় মগ্ন আমি। প্রার্থনার মূল বিষয়বস্তু, আমার বোন,আমার বাবা, আমার প্রেমিক।

.

চারদিন ধরে বাবা বাসায় ফিরলোনা। গত তিন রাত মায়ের চোখে ঘুম নেই। মায়ের চোখেমুখে কেমন হতাশার রেখা! বাবা প্রতিদিনই বলে আজই চলে আসবো। কিন্তু বাবার আসা হয় না! বাবার জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকি। এই অপেক্ষা বড়ই বেদনার। 

.

সবকিছু ছাপিয়ে ১৫ বছর বয়সে আমার বোনের প্রথম "ঋতুস্রাব" হলো। 

-- মা পাশের ঘর থেকে গলা উঁচু গলায় বলছেন, এতো খুশী হবার কিছু নেই। সব মেয়ের জীবনেই এরকম হয়

-- মিমি কথা বলে না, চোখ দিয়ে শুধু পানি পরে। আমি মুগ্ধ হয়ে ছোট বোনের সুখের কান্না দেখি!

-- মা রান্না বসাতে বসাতে খিটখিটে গলায় বল্ল, যেখানে সেখানে হরহামেশাই বসে পরবিনা। মনে থাকে যেন। বারবার এক কথা বলতে পারবোনা। 

মা'য়ের এমন খিটখিটে আচরণের কারণ আমরা দুবোনেই টের পেয়েছি। ৫টা দিন হয়ে গেলো বাবা এখনো বাড়ি আসছেনা। মা এই কদিনে শুকিয়ে টিকটিকির মত হয়ে গেছে। খালি কথায় কথায় ক্যাঁট ক্যাঁট করে।

-- মিমি, মায়ের কথামতো কোথাও হরহামেশাই বসে পড়েনা। প্রায় সময়ই বেলকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থেকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মিন মিন করে কি যেন বলে। তার মুখে কেমন অস্পষ্ট হাসির রেখা ভেসে ওঠে। 

মিমির জন্য দুপুরে রান্না করা হয়েছে। টেবিলের উপর প্লেট রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে সে। কি জানি ভেবে মিমি চেয়ারে বসলো না। মায়ের কঠোর নিষেধ, সবজায়গায় হরহামেশাই বসা যাবে না। মিমির কাছে মনে হচ্ছে, দাঁড়িয়ে খাওয়াটাই পৃথিবীর সবচাইতে সুখের খাওয়া। 

.

ইফতারির আগে আগে বাবা বাসায় ফিরলেন। আমার মনে হচ্চে, কত জনম পর বাবাকে দেখলাম। মা ইফতারি বানানো রেখে কঠিন মুখ করে ঘরে চলে গেলেন। বাবা এসেছে সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি বুঝলাম বাকি ইফতারি টুকু আমাকেই বানাতে হবে। বাবার হাতে একটা শাড়ীর শপিংব্যাগ দেখলাম। মা যখনই বাবার সাথে বেশি রাগ করে, বাবা তখনই মাকে শাড়ী উপহার দেয়। নতুন শাড়ী দেখে মায়ের মুখ কেমন ছেলেমানুষী হয়ে যায়। মায়ের রাগ আস্তে-আস্তে ভালোবাসায় পরিণত হতে থাকে।

মাগরিবের আজান পরে গেলো। ইফতার রেডি। টেবিলের ওপাশে মা-বাবা পাশাপাশি চেয়ারে বসেছেন। তাদের মুখ কি হাসিহাসি ভাব। আমি একা টেবিলের এপাশটায় বসে আছি। আমার পিছনে চেয়ার ধরে মিমি দাড়িয়ে আছে। 

-- বাবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বল্ল, কিরে মিমি দাড়িয়ে আছিস কেন? বসে ইফতার কর।

-- মিমি কিছু বল্ল না। লাজুকলতার মত আরো পেচিয়ে দাঁড়ালো চেয়ারের সাথে।

-- মা পাশ থেকে বল্লেন, বসে পর মা, কিচ্ছু হবে না।

-- মিমি সংকোচ বোধ করে করে নিশ্বব্দে বসলো।

-- বাবা সবাইকে অবাক করে দিয়ে শাড়ীর শপিংব্যাগ টা মিমির হাতে দিয়ে বল্লেন, আজকের বিশেষ দিনে তোর একমাত্র ছেলেটার ছোট্ট উপহার। দয়া করে উপহার গ্রহন করে আমায় ধন্য করুন, ছোট মা। 

মায়ের চোখে ভালোলাগার পানি এলো। আমি "থ" হয়ে তাকিয়ে রইলাম। 

-- মিমির মুখ লজ্জায় পাকা টমেটো হবার অবস্থা। লাজুকতা রেশ যেন সাগরের ঢেউয়ের মত উপচে পরছে তার মাঝে। শাড়ীটা বুকে চেপে ধরে মিমি ঘরে চলে গেলো। প্রকৃতি মিমিকে আজ কৈশোর কাল শেষ করিয়ে যুবতীর কাতারে নাম লেখালো। মিমির লজ্জার গ্রাফ এখন কেবলই উর্ধ্বমুখী! 

.

শান্ত ছেলেটার সাথে আমার কথা বলা ক্রমেই বাড়তে লাগলো।  আমাদের সম্পর্কটা "আপনি করে বলা" থেকে "তুই করে বলাতে" গড়ালো। তার কথার বিষ্ময়ে আমি  অভিভূত হই। সব কথাই একটু ঘুরিয়ে বলে। এই যেমন, আজ দুপুরেই বলল...

-- তোর একটা রিলেশন থাকলে ভালো হতো।

-- আছে তো রিলেশন! 

-- এতো দূরের না, আরো কাছের থাকলে ভালো হতো। তুই, আপনি বাদ দিয়ে তুমিতে আসতে হবে।

-- দূরে কোথায়? আমরা একি কলেজে একই ক্লাসে পড়ি। দু'জনই দুজনের কাছের মানুষ। একে অপরকে তো তুমি করেই বলি। ও আমাকে প্রচুর ভালোও বাসে।

-- শান্ত খানিকটা চুপ থেকে বল্ল, ওহহ... আচ্ছা। বেস্ট অফ লাক!

আমি বুঝলাম সে কষ্ট পেয়েছে। আমি রিপ্লাই দেয়ার আগেই মল্লিকার ফোন আসলো। মল্লিকা আমার কাছের মানুষ। আমার নিকটতম বান্ধবী।  জসিমের সাথে আমার রিলেশনটা করানোর প্রধান কারিগরও মল্লিকা নিজেই। জসিম কে আমার বেশ ভালো লাগতো। শুধু আমার একা না ক্লাসের মাধবী নামের মেয়েটাও তার প্রতি কেমন মুগ্ধ হয়ে তাকায়। মন চায় মাধবী মেয়েটার চোখে কলম গুঁজে দেই। মন চাইলেইতো আর সব হয় না।

জসিমের মধ্যে সবসময়ই কেমন স্মার্ট স্মার্ট ভাব। তার এমন ভাবভঙ্গি দেখে তাঁর প্রতি আমার প্রেম হয়। সে প্রেম থেকেই আমি আর জসিম তিন মাসের রিলেশন নামক বন্ধনে আবদ্ধ। কিছুদিন যাবৎ তাঁর সঙ্গে আমার ফারাক চলছে। শুধুই ব্যস্ততা দেখায়। আমি তার ব্যাস্ততা সারবার অপেক্ষায় ছিলাম।

-- মল্লিকা ফোনের ওপাশ থেকে বল্ল, জসিম আর মাধবী কে একই রিকশায় ঘুরতে দেখলাম আজ!

-- আমার বুকের ভেতরে হু হু করে উঠলো। তাও সহজ ভাবেই বল্লাম, লাঠিমের মত ঘুরতে দেখলি নাকি কার্তিক মাসের কুকুরের মত?

-- মল্লিকা জবাব দেবার আগেই কল কেটে দিলো। 

আমি ভাবছি, যদি কল দেই মল্লিকা কি উত্তর দিবে? লাঠিমের মত ঘুরছিলো নাকি কার্তিক মাসের কুকুরের মত? রহস্যের ব্যাপার। রহস্য ভেদ কারবার জন্য আমাকে জসিমের সামনে গিয়ে দাড়াতে হবে।

আমি কল ফেরত দিতে গিয়েও দিলাম না এবার। 

সিরিয়াস মুহুর্তেও মল্লিকার সভাব মিসডকল দেয়া। আমার সাতজন্মের কপাল যে মল্লিকার কলটা আজ ধরতে পেরেছি। বুঝতে পারলাম জসিমের সাথে আমার সখ্যতা গড়ার দিন বোধহয় ফুরালো।

ফোন হাতে নিয়ে শান্ত'র ইনবক্সে ঢুকলাম। উপরে স্পষ্ট করে লেখা ভাসলো, active 14 minutes ago...


ক্লাসের কোন মেয়ে যখন মনযোগীর মত কিছু লিখতে বসে। বেখেয়ালি ভাবে তার হাতের কুনুই দুটি বেঞ্চের উপরে রাখে। 

ক্লাসের সব গুলো ছেলের মাথা তখন বেঞ্চের সাথে মিশে যায়, কারো মাথা আবার বেঞ্চের নিচেও চলে যায়। কুনুইয়ের নিচ দিয়ে তারা কি যেন দেখে! 

পাশের বান্ধবী গুলো ফিসফিস করে কি একটা ইশারা দেয় মেয়েটাকে, লিখতে থাকা মেয়েটা তখন ওড়না ঠিক করে বসে।

এতো কিছু ঘটে চারপাশে রিহানের সেদিকে খেয়াল নেই।  

কিছুদিন হলো রিহান একটা গোলাকৃতির ছোট আয়না কিনলো।

রিহান সময় পেলেই আজকাল আয়না দেখে।

-- কিরে রিহান, কি করিস?

-- আয়নায় মুখ দেখি।

-- সবসময় আয়না দেখার কি আছে? 

-- আমার নতুন গোঁফ জন্মাচ্ছে, আমি দেখবো না  কে দেখবে? শান্ত, দেখ দেখ গোঁফের এই চুল টা বেশি গাঢ়তর কালো দেখায়। পাশের টা দেখ কেমন রোগা-সোগা হয়ে আছে। জানিস শান্ত, আমার চাপ দাড়ির খুব শখ। হবে তো?

-- রিহানের এমন প্রশ্নে আমি বোবা বুনে গেলাম। আমার মুখে বুলি নেই। আমার চোখ দুটি তখন ছলছলিয়ে উঠেছিল। 

এতো গেলো নবম, দশম শ্রেণির কৌতূহল! 

.

-- একটু আগেই রিহান আমায় জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা শান্ত, সৃষ্টি কর্তা ছেলেদেরকে স্তন দিলো কেন? 

যদি সন্তান সন্ততিদের দুধ খাইয়ে সাহায্য নাই করতে পারে তাহলে কোন লাভের জন্য এই অপ্রয়োজনীয় জিনিষ সারাজীবন থেকে যায় প্রত্যেকটি পুরুষের মাঝে? 

-- রিহানের এরকম প্রশ্নে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। এমন প্রশ্ন কেউ করে? রিহানের চলাফেরা, বাচনভঙ্গি সব কিছুতেই কেমন আধ্যাত্মিক রকমের কৌতূহলী! কত কি ভাবলাম, কাজের কাজ হলো না, প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। আমি চুপ থাকলাম। 

-- রিহান আমার দিকে না তাকিয়ে ভাসা ভাসা গলায় বল্ল, মানুষের রহস্যই মানুষ বুঝে-না সৃষ্টি কর্তার রহস্য তো সেখানে অসীম ফারাক।

-- রিহানের কাছে আমি এসেছিলাম ঝিমির ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে। তার এমন উদাস উদাস ভাব দেখে ঝিমির কথাটা আড়াল  করলাম। আমি জানি, রিহান একটা সময় নিজে থেকেই বলবে এখন তোর কথা বল শুনি। আমি সে সময়ের জন্য অপেক্ষমান। 

ছোট্ট থেকেইতো রিহানের সাথে আমার পথ চলা। তখন থেকে রোজই এই জায়গাটায় এসে বসি আমরা। আমাদের বসার জায়গাটা ছোট্ট খালের উপর একটা বাঁশের তৈরি পুল। আমরা বসলেই বাশের পুলটা ক্যাঁ ক্যাঁ শব্দ করে। 

রিহান মাঝে মাঝে বলে, এই শালা... কে কে করিস কেন?  চিনস না আমাদের? দিবো এক লাত্থি! 

সেদিন রিহান সত্যিই সত্যিই উঠে লাথিটা ঝেড়ে দিলো পুলের উপর। ওমনি পুল ভেঙ্গে ধপাস করে পানিতে পরলো।  তখন খাল ভর্তি পানি, দুজনের কারোরি সাতার জানা নেই। আহহা কিযে আহাজারি তার! 

বলাবাহুল্য সেদিন ফেরেশতার মতো স্কার্ফ পরা যে মেয়েটার উছিলায় তার প্রাণ বাচলো, সে মেয়ের জন্যই নাকি রিহানের মন কাঁদে, চোখও কাঁদে। মজার ব্যাপার হলো, ব্যাপক খোজাখুজির পরও সে মেয়ের কোন খোজ পাওয়া গেলো না!

কিন্তু, রিহান হঠাৎ "ছেলেদের স্তন" নিয়ে প্রশ্ন কেন করলো! তার কি কৈশোরের কথা মনে পরলো?

আমার প্রখর ধারণা বলে, রিহানের প্রথম কৌতূহল লক্ষ্য করলাম সপ্তম শ্রেণীতে। তখন আমরা চনমনে কিশোর। এই সময়টাতে প্রকৃতি কত কি উপহার দেয়। 

সেদিন  স্কুলে অনাগত ভাবেই রিহানের বুকে কে যেন থাপ্পড় মারলো। রিহান ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো, দুই হাতে বুকে চেপে ধরে বসে গেল। কিছুদিন যাবৎ আমার বুকেও কেমন অজানা একটা ব্যাথা লাগে। স্তনের ভেতর ২টাকার কয়েনের মত কি যেন জমাট বেঁধে আছে। কাপড় পরবার সময় একটু লাগলেই ব্যাথা হয়।অসহ্য রকম ব্যাথার ভয়ে ঘুমাবার সময়ও বুকের  উপর হাত রেখে ঘুমাতাম। এ ব্যাথা যেন চোখে পানি আসবার মত। খবর নিয়ে জানলাম, ক্লাসের প্রায় সবছেলের একই অবস্থা। সুযোগ পেলেই একজন আরেকজনকে দুষ্টুমির ছলে ব্যাথা দেবার চেষ্টা করে।

সমবয়সীদের মাঝে সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে দুষ্টুমিটা বেশিই হয়। তারপর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত গড়ালো এই দুষ্টুমি। আমি খুব অবাক হলাম, ক্লাসের মধ্যে একমাত্র রিহান এমন দুষ্টুমি কারো সাথেই করেনি! 

আস্তে আস্তে বুকের সে অসহনীয় ব্যাথা কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো! 

.

রিহান আমায় বলল, "শান্ত, তোকে দেখলেই বুঝা যায় তুই এখন ভরষা হারানো মানুষ। কি জন্যে হারিয়েছিস বল।" 

-- আমি ইচ্ছে করেই কথা বললাম না।

-- রিহান আমার দিকে আরো একটু এগিয়ে এসে বলল, কেমন লাগে, এখনো চুপ হয়ে আছে!

এই শালা কথা বল, নাহয় জিব টেনে কুত্তার গু লাগিয়ে দেবো।

-- আমার অপেক্ষা ফুরালো, তাও উল্টো জিজ্ঞেস করলাম, কি বলবো?

-- ঝিমির ব্যাপারে বল।

-- আমি ভরষা হারানো মানুষের মতই বল্লাম, ঝিমির আরেকটা সম্পর্ক আছে।

-- সম্পর্ক আছে ভালো কথা, তাহলে বিষ খেয়ে ফেল। খাবি? এনে দিবো?

-- আমি শক্ত হয়ে বল্লাম, সিরিয়াস মেটার, মজা করিস না।

-- ওহহ, সিরিয়াস মেটার! দাঁড়া তাহলে এখনি বিষ আনতে যাচ্ছি, যাবিনা একদম। গেলে তোর পায়ের রগ কেটে দিব।

-- রিহান সত্যিই চলে যাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই অনেক দূর চলে গেলো। চোখের আড়াল হয়ে টেক্সট দিয়ে বল্ল, সন্ধা হয়ে আসছে, বাসায় চলে যা। চিন্তা করিস না, ঝিমি নক করবে, আজ রাতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

সত্যি সত্যি ঝিমি রাতে নক দিল রাত বারোটার ঠিক আগে আগে। আমি খানিকটা চমকালাম, ঝিমি মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে...

-- কেমন আছিস শান্ত? 

তোর কি মন খারাপ? 

আমার উপর রেগে আছিস?

চুপ করে আছিস যে কিছু বলবিনা?

এতো দেমাগ ভাল্লাগে না। কয়টা প্রশ্ন করলাম কোন উত্তর নেই!

-- আমি সমস্তই দেখলাম, কিছু বল্লাম না। ফোন চার্জে বসিয়ে। ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। আমার ঘুম এলো না।  মশারীর ভেতর মশা গুলো ভোঁ-ভোঁ   শব্দ করছে, অন্যান্য দিন হলে মশা গুলো মেরে দিতাম। বিচিত্র কারণে মশার ভোঁ-ভোঁ  শব্দই আজ মধুর মত লাগছে। ধীরে ধীরে চোখ বুঝলাম। আমার চোখে প্রগাঢ় ঘুম এলো। স্বপ্নে দেখলাম, ঝিমির হাত কে যেন শক্ত করে ধরে আছে। স্বপ্নেই আমার বুক হু হু করে কেপে উঠলো। দুজনের হাতেই নতুন সোনার আংটি!

রিহান, 

 শান্ত'র মন ভিষণ খারাপ। প্রিয় মানুষের সাথে অন্যকারো সম্পর্ক থাকাটা বড়ই বিষন্নতার। আজ রাতে সে বিষন্নতা কিছু হলেও গুচাবে। 

শান্ত'র কাছ থেকে বাড়িতে ফিরতে সন্ধা হলো। বাড়িতে ফিরে দেখি, মা'য়ের কান্নাকাটিতে হুলুস্থুল অবস্থা।

-- মা'র কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে?

-- মা অঝোর ধারায় কাঁদছে। 

-- আমি আবারো বল্লাম, কি হয়েছে মা?

-- মা আবছায়ার মত করে বল্ল, সকালে তোর আপু বই কিনতে গেছে এখনো ফিরেনি। কল দিলে রিং হয়, কিন্তু রিসিভ করেনা।

-- আমি মাকে শান্ত করে বারান্দায় বসালাম। একে একে সব যায়গায় খোঁজ নিলাম। মায়ের চোখের জোয়ার বাড়তে লাগলো।

-- মা ভারী-ভারী গলায় বল্লেন, কিরে খোকা খোজ পেলি? তোর বাবা যদি বাড়ি এসে এই খবর শুনে আমায় মেরে ফেলবে।

-- সব যায়গায় খোজ নিয়েও আপুর কোন খবর মিল্ল না। মা এমনিতেই হার্টের অসুখে মরণাপন্ন অবস্থা। বাহিরে বাবা আসার শব্দ শোনা গেলো। মা অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আমি মায়ের মাথায় পানি দিচ্ছি। বাবা টিউবওয়েল থেকে পানি আনছেন। 

-- তাড়াহুড়োর মাথায় বাবা জিজ্ঞেস করলেন, তোর আপু কই?

-- আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বল্লাম, আপু বোধহয় চাচাদের বাড়ি গেলো, কি যেন খুজতেছিলো দেখলাম। 

-- বাবা আর কথা বাড়ালেন না, গাড়ির ব্যাবস্থা করতে বাহিরে গেলো। মাকে হাসপাতালে নেয়া হবে।

বাবা গাড়ি নিয়ে আসলেন।  মাকে কোলে করে গাড়িতে উঠানো হলো। ডাক্তার সাহেব মা'য়ের নাকের কাছে আংগুল নিলেন, তারপর হাতের কব্জি ধরলেন, খানিকটা পর বিষন্ন গলায় বল্লেন, উনি আর বেচে নেই! ডক্তার সাহেব মায়ের চোখ বুঁজিয়ে দিলো, মা কি সুন্দর করে চোখ বুঁজে ফেল্ল! বাবা দাঁড়ানো থেকে বসে পরলেন। আমার মনে হলো, কলিজা থেঁতলে যাবার কষ্টটা বোধহয় এমনি। মায়ের ফোনে আপুর কল আসলো। আমি কল ধরলাম। 

-- আপু সুখী মানুষের মত বল্ল, বিয়েটা সেড়ে নিলাম। মাকে বলিস আমি ভালো আছি। 

-- মায়ের মরা মুখটা আরো একবার পরখ করে দেখে বল্লাম, আচ্ছা বলবো!


জমাট অন্ধকার...👽👹

পর্ব: ০২


আমার বড়বোন সারারাত মনের মানুষের সাথে কাটিয়ে কাক ডাকা ভোরে বাসায় ফিরলো। তার শরীরে নোংরা মানসিকতার দাগ এখনো স্পষ্ট। 

.

আপুর দিকে আমি একবার তাকিয়ে দৃষ্টি নিচু করলাম। আপুর মুখে এখনো হাসি হাসি ভাব। যেন সময়টা বড়ই মধুর।

সময়টা কি আসলেই মধুর? তাহলে আমি হাসছি না কেন? পিছন থেকে বাবাকে এগিয়ে আসার আওয়াজ পেলাম। বাবার হাটার আওয়াজ আজ বড্ড ভারী ভারী লাগছে। আপুর মুখে এখনো হাসিহাসি ভাব। বাবা সামনে এসে আপুর হাসিহাসি গালে কশিয়ে চর বসিয়ে দিলেন। আমি ভয়ে কেপে উঠে এক পা পিছনে সরে গেলাম। বাবাকে কিছু বলে উঠবার আগেই ঘার ধাক্কা দিয়ে আপুকে বের করে দিলেন বাড়ি থেকে। জীবনের এই প্রথম আপুর গায়ে বাবা হাত তুললো, এই প্রথম বাবাকে আমি প্রকট ভয় পেলাম। আমার খেয়াল হলো, বাবার ঘরে মাকে একলা শোয়ানো হয়েছে। আমি মায়ের পাশে এসে বসলাম, মায়ের মুখ সাদা কাপড় দিয়ে মুড়ানো। 

.

মায়ের লাশ দাফন করে বাসায় ফিরলাম। আমার চোখে পানি নেই। বাবা আমায় পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলো।

-- কিছুসময় পর বাবা আমার গাল, কপাল, ঘার ছুয়ে বলল, কিরে রিহান তোর গায়ে তো ভীষণ জ্বর।

-- আমি আমতা-আমতা করে বল্লাম, কই নাতো বাবা। আমার বরং অসহনীয় গরম লাগছে। আমি গোসল করবো।

বাবা ঘর থেকে আমার লুঙ্গি এনে দিলেন। আমি টিউবওয়েল চেপে বালতি ভরবার চেষ্টা করছি। গোছলের বালতিটা আমার কাছে ছাদের উপর থাকা পানির ট্যাংক- এর মত বিশাল মনে হচ্ছে। আদৌ কি এই বালতিটা আমি ভরতে পারবো? আমি যে বালতিটা ভরবার চেষ্টা করে যাচ্ছি সেটার আকৃতি গোলাকার। আমি আজ অব্দি আয়তাকার বা চারকোনা আকৃতির কোন গোসলের বালতি দেখিনি। আচ্ছা বালতি গোলাকৃতির থাকে কেন? যদি আয়তাকার (চারকোনা) আকৃতির থাকতো তাহলে কেমন হতো? সেখানে ক্ষেত্রফল মাপার জন্য "পাই" এর সূত্র ব্যাবহার না করে আয়তক্ষেত্রে সূত্র ফেলানো হতো নিশ্চয়ই? লম্ব ইন্টু ভূমি! 

বাহহ, মজার ব্যাপার তো, একই সূত্রে মায়ের কবরটাও মাপা যাবে। মায়ের কবরটাও তো আয়তাকার আকৃতির!ক্ষেত্রফল মাপার জন্য সুত্র পরবে লম্ব ইন্টু ভুমি।

আমি গোসল সেড়ে বাহিরে বের হলাম। শান্ত নিথর হয়ে বারান্দায় বসে আছে। 

-- আমার বের হওয়া দেখে সে উঠে এসে বলল, চল ডাক্তার খানায় যাই।

-- আমি ঠিকঠাক ভাবেই বললাম, দাঁড়া কাপড় নিয়ে আসি, পুল পারে যাবো।

-- শান্ত হয়তো বলতে চেয়েছিলো, এই ভরদুপুরে পুলপারে কেন? সে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। 

.

বাঁশের পুলটায় দুজন পা ঝুলিয়ে পাশাপাশি বসে আছি। আচমকা ব্যাপার বাঁশের পুলে আজ ক্যাঁক্যাঁ শব্দ হচ্ছে না। বাঁশের মনে হয় আজ মন ভেজাই খারাপ। ভয়াবহ ব্যাপার, মা মারা গেলো আমার কিন্তু মন খারাপ করে আছে বাঁশের পুলটাও! 

-- নিরবতা সরিয়ে শান্ত'কে বললাম, ঝিমির কি খবর? 

-- ভালো।

-- কথা হয়েছে?

-- না, হয়নি।

-- কেন, ব্লক করে দিয়েছে?

-- রাতে নক দিয়ে আমার খবরাখবর জিজ্ঞেস করলো কিন্তু একবারো আমার মনের খবর জানতে চাইলো না। ঝিমির এমন অবহেলা আমায় খুব কষ্ট দেয়, রাত জাগায়, চোখের জ্বল ঝড়ায়।

-- আমি চুপ করে থাকলাম। শান্ত'র চোখে পানি টপটপ করছে। এই প্রথম আমি কোন পুরুষের চোখে টপটপ করা পানি দেখলাম!

-- শান্ত তারপর বল্ল, ঝিমির এমন ছাড়াছাড়া ভাবভঙ্গীর কথা দেখে আমি আর রিপ্লাই দেইনি রাতে।

-- আমি ভ্রু কুঁচকে বল্লাম, তাহলে রিপ্লাই কি সকালে দিয়েছিলি?

-- শান্ত ঊর্ধ্বশ্বাসে বল্ল, নাহহ.. সকালেও দেইনি। ঘুম থেকে উঠে দেখি ব্লক করে দিয়েছে! 

ব্লক করার আগে রাতের বেলা ঝিমি একটা ছেলের ছবি দিয়ে বল্ল, বাবা এই ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করলো। আমি প্রথমে রাজি ছিলাম নারে। পরিবারের জোড়াজুড়িতে আমার আর কিছু করার ছিলোনা। তুই ক্ষমা করে দিস আমায়?

-- আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললাম, এভাবে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা হবে নাকি? এসে পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে, সে না আসলে তার বাপ আসবে। মগেরমুল্লুক নাকি এটা।

-- শান্ত আমার দিকে চেয়ে মিটমিট করে হেসে দিলো। বাঁশের পুল টা আবার ক্যাঁক্যাঁ শব্দ করতে লাগলো। চারদিকে কেমন সুখী সুখী পরিবেশ। আমার স্পষ্ট মনে পরলো আমার মা নেই, আমি এতিম! আমার শরীর ঘাম দিয়ে উঠলো, এখন আর গায়ে একদমই জ্বর নেই!

.

বাড়িতে ফিরতে দুপুর গড়ালো। বোবা মানুষের মত বারান্দায় বসে আছেন বাবা। আমাকে দেখে তার কাছে যাবার জন্য ডাকলেন। 

-- বাবা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, সুপুরুষদের পিছুটান থাকতে নেই। আমি খুশি হলাম, তুই সেই সুপুরুষ। 

-- আমি মাথা নিচু করলাম। 

-- বাবা থেমে থেমে বলতে লাগলেন, তোর মা'য়ের এবং আমার সব সম্পদ তোর নামে করে দেয়া হয়েছে। এখন থেকে তুই ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করবি। সব গোছগাছ করে রাখ এখনি। আমি মাস্টার সাবের সাথে কথা বলেছি, আজ রাতের ট্রেনেই তুই ঢাকায় যাবি।

-- বাবার কোন কথায় আমি বিচলিত হলাম না। কিন্তু, ভেবেই পাচ্ছি না শান্ত'কে ছাড়া আমি কি করে থাকবো। শান্ত আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। আমার বড্ড বেদনা হচ্ছে, শান্ত'র সাথে বাশের পোলে আর আড্ডা জামানো হবে না। ব্যাপারটা কি শান্ত'কে জানাবো? 

না জানানোটাই ভালো, বলে কয়ে বিদায় নেয়া টা আরো বেশি কষ্টের।

সন্ধা সাতটায় বাবা একটা গাড়ি ডেকে সব গুছিয়ে আমায় স্টেশনে পাঠিয়ে দিলেন। এগিয়ে দেবার জন্য কেও আসেনি, মা থাকলে নিশ্চয়ই আচলে মুখ চেপে ধরে হলেও আসতো, শান্ত জানলে সেও আসতো। আমার মনে হচ্ছে সে আসবে। কিন্তু কি করে আসবে?

আমি একা একাই ট্রেনে উঠলাম। ভেতরে যথেষ্ট ভীড়। ভীড় ঠেলে ট্রেনে উঠা মুশকিলের কাজ। মহিলা মানুষ থাকলে সে মুশকিল ব্যাপারটা জঘন্য মুশকিল হয়ে দাড়ায়। 

-- এক আন্টি করা গলায় এক ভদ্রলোক কে বললেন, শরীরের সাথে ঘেঁষে দাড়িয়ে আছেন কেন? মেয়ে মানুষ দেখলেই আপনাদের বিগড়ে যায়, তাই না?

-- ভদ্রলোক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। মানুষের এমন ভীড়ে তার যেন করার কিচ্ছু নেই। মহিলাটার এমন করা কথায় ভদ্রলোক টা যথেষ্টই অপমানিত হলেন। ভদ্রলোকের চোখমুখ লজ্জায় ঝাপসা হবার উপক্রম। ভদ্রলোকের মুখ দেখে আমার মায়া হলো। সে মায়া অনেকটা গাঢ়তর নীল!


ট্রেন ছাড়ার শেষ বাঁশি বাজিয়ে দিলো। আমি জানালায় হাত রেখে বসলাম। 

শান্ত আমার হাত ভেতরে ঠেলে দিয়ে বলল, হাত ভেতরে নে, জানালায় রাখবি না একদম। 

আমি অতি চেনা মানুষের গন্ধ পেলাম! ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে শুরু হলো। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ঠোট চেপে চেপে শান্ত'র সে কি কান্না! 


একটা ভিডিও দেখেছি, যেখানে মেয়েটা বোরকা পরিধান করে খদ্দের খুজে বেড়াচ্ছে। 

আমি মিনিস্কার্ট পরা মেয়েকেও সমাজ সেবার নামে বৃদ্ধের গায়ে হাত তুলতে দেখেছি, তবে ওটা ভিডিও না বাস্তব চিত্র। এই শহর বড় আজবের শহর। 

 বাড়ি ছেড়ে এই শহরে আসলাম অনেকদিন হয়ে গেলো। আমার জন্মস্থান, আমার বন্ধু, আমার পরিবার, সময় সময় পুলপারে সেই জমানো আড্ডা সব শেকড় ছেড়ে এই শহরে পাড়ি জমালাম। 

আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি তখন এই শহুরের নতুন বাশিন্দা। আমার পাশ ধরে যে মেয়েটা হাটছে তার চোখ দেখে সঠিক বয়স অনুমান করা কষ্টকর। তা-ও মন বলে বয়স আঠারো কিংবা বিশ হতে পারে। গায়ে কুচকুচে কালো বোরকা। সারা মাথা জুড়ে কোন চুল খুজে পেলাম না, হিজাব দিয়ে মোড়ানো হয়েছে। 

আমার মনে হরেকরকম ভাবনা আসলো। এই ধরেন, একটা মিনি স্কার্ট পরা মেয়ের দিকে যখন কোন ছেলের চোখ যায়। ছেলেটা তার বিশেষ অংগগুলোর সমস্তটাই দেখবার চেষ্টা করে। সব শেষে কটুক্তি নিয়ে বলে, ঠাসা মা#...।

(বলাবাহুল্য, ইসলামে মুত্তাকিনদের বলা হয়েছে, তোমাদের দৃষ্টি নিচু করো।)

যে মেয়েটা আমার পাশাপাশি হাটছে তার বিশেষ অংগগুলোর কিছুই দেখবার উপায় নেই। সবশেষে পরাজিত সৈনিকের মত পায়ের দিকে তাকালাম, সেখানেও আমার মন পরাজিতই হলো। একই সাথে তার সমস্তই দেখলাম আবার কিছুই দেখলাম না। ভালোলাগার এক ফালি হাসি ফুটিয়ে মনে মনে বললাম, মা জাতি। 


 পরবর্তীতে জানতে পারি মেয়েটার নাম, নুপুর। একটা সময় নুপুরের সাথেই আমার প্রেমের মহল গড়ে উঠে। সেই মহলের কোন জানালা নেই, কপাট দেবার মত দরজা নেই। মহল টার নড়বড়ে ছাদ থেকে মাঝে মধ্যে টুপটাপ জ্বল গড়ায়। যার নাম, আঁখি।

একদিন বিস্তীর্ণ মাঠে নুপুরের কোলে আমি শুয়ে আছি। তার আঁখি জ্বল আমার নাকের ডগায় এসে ঠেকল। কোল থেকে মাথা তুলে বিশ্বাস যোগ্য মানুষের মত তার হাত ধরে বললাম, ভালোবাসি। তার চোখের জ্বল ক্রমশ বেড়েই চলল। আমি গভীর মমতায় তাকে জড়িয়ে ধরলাম। সে ঢেকুর তোলা কান্নায় বলল, রিহান আমার একটা ভয়ংকর রকমের অতীত আছে। গা শিউরে উঠার মত ভয়াবহ সে অতীত। 

আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, আমি তোমার অতীতকেও ভালোবাসি। 

পর্যায়ক্রমে তার বিষাক্ত কৈশোরের গল্প শুনলাম,।

সে অতীত, ভয়ংকর কুকুরের গল্প! কুকুরদের প্রধান সভাব প্রভু ভক্তি। নুপুরের কথা শুনে বুঝলাম, তাদের পরিবারের কুকুর গুলোর প্রভু ভক্তি বলে কিছুই নেই। থাকবেই বা কি করে, এই কুকুরের তো লেজ নেই। দেখতে মানুষের মত হলেও এদের চোখ, এদের নাক, এদের নখ কুকুরের চেয়েও বিষাক্ত। কুকুর গুলো সুযোগ পেলেই নুপুরের উপর লালসার থাবা বসাত, বিষাক্ত সে থাবায় তার কৈশোর দুমড়েমুচড়ে যায়। তাও সে মরেনা, পরগাছা দের মরণ ওতো সহজ না। নুপুরের জীবন পরগাছা থেকে কম কিসে? ছোটবেলায় যারা মা-বাবা হারায় তাদের অবস্থা পরগাছার চেয়েও ছিন্নমূল। আগেই জেনেছি নুপুরের বাবা-মা নেই। বড় হয়েছে চাচাদের বাসায়।

নুপুর আমার দিকে অসহায়ের মত তাকালো, আমি তার গভীর চোখে তলিয়ে যেতে লাগলাম। অদ্ভুত কারণে তাকে যেন-তেন পরগাছা মনে হচ্ছে না । আমার মনে হচ্ছে সে বটবৃক্ষ জাতের পরগাছা। একটা খেজুর গাছে সে বটবৃক্ষের জন্ম। খেজুর গাছের বিষাক্ত কাঁটার আঘাতে সে বটবৃক্ষ এখন বিষাদময়। 

সে বটবৃক্ষকে সংরক্ষণ করলাম। মস্ত মস্ত প্রকৌশলী (ইঞ্জিনিয়ার) ডেকে আমার বুকের ভেতর তার জন্য বিস্তীর্ণ একটা মাঠ বানিয়েছি। সে মাঠের বা পাশে তাকে নতুন করে রোপণ করলাম। সে বটবৃক্ষ একদিন প্রকাণ্ড বড় হবে। আমি ক্লান্ত হয়ে তার শীতল ছায়ায় আশ্রয় নিবো। সে এক আকাশ লজ্জা নিয়ে আমার দিকে মিটমিট করে তাকিয়ে থাকবে, যেন আমিই তার সব!


পরিবারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিষাদময় কুকুরের গল্প আমায় শুনিয়ে নুপুর যেন তার বুকের উপর থেকে বিশাল পাথর টা সরাল। আমি ক্রমান্বয়ে তাকে আরো ভালোবাসতে লাগলাম। যেন আমার ভালোবাসায় তার সব দুঃখ ঘোচে যায়।

.

.

মাস সাতেক পর শান্ত'র সাথে আমার কথা হলো। ইনিয়েবিনিয়ে কত কথা যে বলল। তার সব কথাই ঝিমি কে নিয়ে। 

-- এই যেমন, প্রথম কথাটাই খুব আবদারে নিয়ে বলল, ৪দিন পরেই ঝিমির বিয়ে, ফাইনাল ডেট। রিহান তুই বিয়েটা আটকানোর ব্যাবস্থা করে দে। 

-- আমি শান্ত'র কথার জবাব না দিয়ে বললাম, এ ক'দিনে আর কি কি কথা হলো?

-- শান্ত থেমে থেমে বলতে লাগলো... জানিস, ঝিমি আবার ব্লক খুলে দেয়। কিন্তু, তাদের দুজনের ছবি একসাথে দেখে আমার মাঝে মাঝে খারাপ লাগতো, তাও ঝিমিকে কিছুই বলতাম না। আমি টের পাই, ঝিমি ধীরে ধীরে আমার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে অনলাইনে আসাটাও বন্ধ করে দিচ্ছে। একদিন দেখি, অনলাইনে Aj Jhimi নামের কোন আইডিই নেই। আমার বুকে ধরনীর প্লাবন শুরু হলো। ঝিমি আমার থেকে এভাবে চলে যাবে এমনটা ভাবতেই পারিনি। 

তারও প্রায় মাসখানেক পর, ঝিমির খালাতো বোনের আইডি দিয়ে আমায় নক করে। প্লাবিত ধরনীর মাঝে আমি যেন সুখের ভেলা খুজে পাই।আইডিটার নাম ছিলো, "মন আমার তোর কিনারে"। কি অদ্ভুত নাম! আমার সমস্ত আকুতি মিশিয়ে ঝিমিকে বলেছিলাম, আই লাভ ইউ। ঝিমি বোধহয় নিথর হয়ে গিয়েছিল। আমায় স্তম্ভিত করে দিয়ে ঝিমি সাভাবিক ভাবেই বলল, আমায় বিয়ে করবি? তখন আমি নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার চোখে পানি টলমল করছিলো। এই আইডি দিয়ে তার সাথে কথা বললাম আরো দুই মাস। হঠাৎ এই আইডির ও খোজ নেই। আবার কথা বলা অফ!


যাইহোক অপেক্ষার প্রহর নাকি ভালো হয়। কিছুদিন পর ঝিমির বেস্ট ফ্রেন্ড মল্লিকার আইডি থেকে নক আসে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর বলতেছে ঝিমির বিয়ে 29 তারিখ। আমাকে বিয়ের দাওয়াত দেওয়া হলো। আমাকে ভালো থাকার কথাও বলা হলো। ভালো থাকার বলে সেই যে গেলো তো গেলোই। আর আসা হয়নি। মল্লিকা নামের আইডিটাও শেষ!

-- আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে না বুঝেই বললাম, হুম বুঝছি খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো! তারপর কি ঝিমির বিয়ে হয়ে গেলো, আর তুই দেবদাস হয়ে গেছিস তাই না? 

-- শান্ত হেসে হেসে বলল, ধুর বেটা। বিয়ে হলে কি তোকে বিয়ে আটকানোর কথা বলতাম? আমি গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি, বিয়েটা চারদিন পর।

-- আমি বোকার মত হয়ে বললাম, দেখি কি করা যায়।

.

.

কিছুদিন আগেই মাস্টার সাবের মোবাইল দিয়ে বাবা কলদিয়ে বললেন, পুরুষ মানুষের পিছুটান থাকতে নেই। 

বাবার কাছে মোবাইল নেই। কিছুদিন পর পর বাবা ফোন দিয়ে আমার খোজ নেয়। লেখাপড়া কেমন চলছে, শরীর কেমন এইসবই।


কেন জানি, দু'দিন ধরে বাবার জন্য মন ছটফট করে উঠে। স্বপ্নের ঘরে বাবা এসে বলে, খোকা ভালো থাকবি তুই। তোর মাও ভালো আছে, আমিও ভালো আছি।

আমি বোকার মত বাবাকে জিগ্যেস করলাম, বাবা... আপু কেমন আছে?

বাবা কিছু বলেন না, গম্ভীরমুখে স্বপ্নের সাথে মিলিয়ে যান।

আমি ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে পরি, এমন স্বপ্নের কোন অর্থই বুঝলাম না,

বাবা কি করে জানলো মা ভালো আছে! আমাকে বিচিত্র রহস্যরা ঘিরে ধরলো। বাবার কিছু হয়নি তো?


জমাট অন্ধকার...👽👹

পর্ব: ০৩ ও শেষ পর্ব


-- কল দিয়ে আপু ধরা ধরা গলায় বললেন, আমার জমিজমা আমায় বাগবিতণ্ডা করে দে। শহর থেকে তুই আজই বাড়ি আয়।

-- কতদিন পর আপুর সাথে কথা,আহ্ কি সুখ! সুখের হাওয়ায় আমার চোখে ভারী ভারী মেঘ জমতে লাগলো। আমি টেনে টেনে বললাম, কেমন আছিস আপু? 

আপুর কাছে আমার জিগ্যেস করা কথার কোন জবাব পেলাম না! আপুর বলতে থাকা কথা গুলো আমার কাছে জানি কেমন জানি বিদঘুটে লাগলো। আমি বিনয় করে বললাম, বাবা তো বাড়ীতেই আছেন। জমিজমার ব্যাপারে বাবার সাথে কথা বলো।

-- আপু সাভাবিক ভাবেই বলল, বাবা কাল মারা গেছেন। দাফনকাজ ও শেষ।

-- আমার ভেতর থেকে কোন কথা আসলো না। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে সমস্ত শরীর মুহুর্তেই জমা হয়ে গেল। আমি শক্ত করে বসবার চেষ্টায় দেয়ালে হেলান দিলাম। মাথার উপরে থাকা টিকটিকি বলে উঠলো, ঠিকঠিক! আমি টিকটিকির করা ক্যাঁটক্যাঁট শব্দকে উপেক্ষা করে মৃদু হেসে আপুকে বললাম, বাবা মায়ের জমিজমা সবকিছুই তোমার নামে করে দিয়ে গেছেন। 

-- আপু কল কেটে দিলো! 

.

রাত পোহালেই শান্ত'র ভালোবাসার মানুষটার (ঝিমির) বিয়ে। বিয়েটা ভাঙ্গবার জন্য বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হতে যাচ্ছিলাম। সব গোছগাছ শেষ করে ছাড়া-ছাড়া ভাব নিয়ে বাসের পিছনের দিকের একটা সিটে গিয়ে বসলাম। শান্ত কাল থেকে আজ সারাসময় কল দিয়ে গেলো, আমি একটা কলও ধরলাম না। মেসেজ লিষ্টটা ওপেন করে বুঝলাম বাবার মৃত্যুর খবর দেয়ার জন্যই শান্ত'র এতো গুলো কল।

সারা বাসে মানুষের সংখ্যা কম, সিটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই খালি পরে আছে। খানিকটা সময় আগে আমার সামনের সিটে একটা "সমবয়সী ভদ্রলোক" বসলো। ভদ্রলোকটা বাস ভাড়া দিয়ে মানিব্যাগটা পকেটে রাখার সময় বেখেয়ালি ভাবে নিচে পরে যায়। পিছনের সিট থেকে নিচু হয়ে মানিব্যাগটা তুলতে গিয়ে আমি ভরকে গেলাম। মানিব্যাগ-এর মধ্যে থাকা নুপুরের ছবিটা ঝলমলিয়ে উঠলো। কেন জানি মনে হলো আমার সব হারিয়ে যাচ্ছে।

.

মানুষের সুখ প্রকৃতি বেশিদিন সহ্য করেনা, নুপুরের সাথেও আমার সুখের অবনতি হয়েছে অনেকটা, তার সাথে কথা হয়না দুমাস হলো। প্রতি রাতেই তার জন্য আমার কষ্ট হয়। চোখে পানি আসে। খুব ইচ্ছে হয়, সে এসে আমায় আচ্ছামত বকে দিয়ে একবার খাবারের কথা বলুক। আমার ঘামে ভেজা বুকে জড়িয়ে ধরে বলুক, এই বুক আমার একার ঘর। এরকম হাজার ইচ্ছে গুলো ইচ্ছেতেই পচে মরে। আবার নতুন ইচ্ছে মাথা তুলে দাড়ায়। আমি ইচ্ছে গুলোকে ছাটাই করতে করতে ক্লান্ত। যেকোনো উপায়ে আমার একটু সুখ প্রয়োজন। আমার একটু নুপুরের হাত ধরা প্রয়োজন। আমার একটু নুপুরকে দেখার বড্ড প্রয়োজন। 

.

আমি নুপুরদের বাসার কলিংবেল দুইবার চাপার পর নুপুরের দাদী এসে দড়জা খুলেই জিজ্ঞেস করলো, কে আপনি? কাকে চান?

-- আমি হাসিমুখে বললাম, মাত্রই যে একটা ভদ্রলোক আপনাদের বাসায় আসলো আমি তার বন্ধু।

-- নুপুরের দাদী উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, আরে আরে... আসো, ভেতরে আসো।

নুপুরের দাদীকে পাশ কাটিয়ে আমি ভেতরে আসলাম। 


সোফার একপাশে নুপুর কি সেজেগুজে বসে আছে! চোখে আলতা, ওহহ সরি চোখে কাজল, ঠোঁটে গোলাপি রঙের লিপস্টিক, চুল গুলি কি সুন্দর আঁচড়ানো! আমি দেখে আবারো তার প্রেমে পরলাম। 

নুপুর আমায় দেখে বেশ বিচলিতই হলো! গলা খাঁকারি দিয়ে সোফার হাতা ধরে আরো শক্ত হয়ে বসলো। 

-- নুপুরের সামনে বসা ভদ্রলোক আমায় দেখে চোখ কপালে তুলে বল্ল, আরে আপনি আমার পিছনের সিটে বসা মানুষ টা না?

-- আমি পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে করতে বললাম, দেখুন তো এটা আপনার কি না?

-- ভদ্রলোক মুহূর্তেই তার পকেটে হাত দিয়ে দেখলন মানিব্যাগ নেই! ভদ্রলোকের কপালে ঘাম জমে গেছে, ঘাম নুপুরের কপালেও ফোটা ফোটা জমা হচ্ছে। ভদ্রলোক আমার হাত থেকে মানিব্যাগ নিয়ে বললেন জ্বি এটা আমারই। কিন্তু, ভেতরের ছবিটা কই?

"ভৌতিক গল্প ও রহস্যময় কাহিনী" পেজের সাথেই থাকুন। আমাদের পেজের লিংক facebook.com/voutik03 পেজটাতে লাইক এবং ফলো দিয়ে রাখবেন যাতে পরবর্তী গল্প গুলো সহজেই আপনি পেতে পারেন।


-- আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম, ভাই ছবিটার মানুষ কি হয় আপনার? খুব সুন্দর, আমি রেখে দিয়েছি।

-- ভদ্রলোক লজ্জায় মাথা নিচু করে বিরবির করে বললেন, আমার কাজিন। 

নুপুর আমার দিকে খানিকটা পর পর কেমন অসহায়ের মত তাকায়। যেন তার অপরাধ আকাশের মত! ভদ্রলোকের মানিব্যাগে যে ছবিটা ছিলো সেটা নুপুরের ছবি। হয়তো নুপুরই তাকে দিয়েছে। নুপুরের ছবি অন্য কারো কাছে থাকবে এমন টা আমি ভেবে উঠতে পারিনি। 

-- আমি ভদ্রলোককে বললাম, আপনার মানিব্যাগের জন্যই আসা। তাহলে আজ আমি আসি।

-- পাশের সোফা হতে নুপুরে সেজু চাচা বলল, বসো বসো মিষ্টি মুখ করে যাও।

-- আমি উনাকে পরখ করে দেখলাম। 

-- পাশের সোফা থেকে নুপুরের ছোট চাচা বললেন, বসলে বসেন! না বসলে বেড়িয়ে যান।

-- আমি বেহায়া মানুষের মত সোফায় বসবার জন্য এগিয়ে গেলাম। কেউ বুঝে উঠবার আগেই টেবিল থেকে পানি ভর্তি কাচের জগ দিয়ে নুপুরের ছোট চাচার মাথা একদম থ্যাতলিয়ে ফেললাম। ভদ্রলোক টা ভয়ে কেপে কেপে দাঁড়ানো থেকে সোফায় বসে পরলেন। আমি টেবিল থেকে ফল কাটার ছুড়ি নিয়ে নুপুরের সেজু চাচার থুতনির নিচে জুরসে ডাবিয়ে দু'হাত মেলে সোফায় বসলাম। বাহির থেকে কে যেন কলিংবেল বাজাচ্ছে, ঘরের সবাই মোমের মত ঠায় দাড়িয়ে আছে। নুপুর আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না শুরু করলো। নুপুরকে আমি চোখ ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখছি। এই মেয়েটার ছবিইতো অন্যের মানিব্যাগে ছিলো, আহ্ সে ছবি কি সুন্দর।

তার প্রতি এখন আমার একই সাথে দ্বৈত অনুভূতি! আমি এখন একই সাথে নুপুরকে ভালোবাসি এবং ঘৃণা করি। 

আমি শক্ত হাতে আমার বুকে নুপুর কে জড়িয়ে ধরলাম। নিচে পুলিশের গাড়ির শব্দ শুনা যাচ্ছে। নুপুর পাগলের মত বার বার বলছে তুমি পালিয়ে যাও পালিয়ে যাও। আমার পকেটে আবারো ফোন বেজে উঠলো, আমি ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম শান্ত কল দিচ্ছে। আমি ফোনটা জানালা দিয়ে বাহিরে ফেলে দিলাম!#ভৌতিক_গল্প_ও_রহস্যময়_কাহিনী

.

.

শান্ত...

রিহানের বাবা মারা গেলেন সে খবরটাও তাকে দিতে পারলাম না। এইযে রিহানকে কল দিয়েই যাচ্ছি, দিয়েই যাচ্ছি একটা কলও সে উঠাচ্ছে না। আমি জানি যত যাই হোক ঝিমির বিয়ে ভেঙ্গে আমার কাছে ঝিমিকে নিয়ে আসবে। আমি সে খবরের অপেক্ষায় রইলাম। 

.

.

ঝিমি...

আমি শান্তকে যেমন ভালোবাসি তারচেয়ে বেশি ভালোবাসি আমার পরিবার কে। কিছু না বুঝেই হয়তো শান্ত'র মনের সাথে মিশে গিয়েছিলাম। আমি তো জসিমের সাথেও মিশে গিয়েছিলাম এমন করেই, সেই জসিমও আমায় ছেড়ে অন্যের হাত ধরলো। বিচিত্র কারণে এখন মনে হচ্ছে আমার হবু স্বামীই আমার জন্য পার্ফেক্ট। শান্ত একের পর এক মেসেজ দিয়েই যাচ্ছে। এক শ্রাবণ চোখের পানি নিয়ে শান্ত কে শেষবারের মত ব্লক করলাম। 

শান্ত'র কথা এখন আর ভাবনাতেও নেই, আমি ভাবছি মিমির কথা। আমার বিয়ে অথচ আমার ছোট বোন মিমি কে আজ কোন হৈহল্লা করতে দেখলাম না!

.

.

মিমি...

আপুর বিয়ে অথচ আমি ছন্নছাড়া হয়ে বসে আছি। আজ দুপুর থেকে হঠাৎ আমার পেটে যন্ত্রণা শুরু হলো। আমি পেট চেপে কতটা সময় উপুড় হয়ে শুয়ে রইলাম। ভয়ে কোথাও বসতে পারছিনা। 

-- শেষ বিকেলে ফকির বাড়ির লম্বা ছেলেটা কল দিয়ে বলল, একটু আগে তোমায় দেখলাম, কেমন মন ভার করে বসে আছ। যেমনই থাকো আজ কিন্তু তোমাকে অপ্সরাদের মত লাগছে।

-- আমি লজ্জায় ফোন কেটে দিয়ে মনে মনে বললাম, সাড়া শরীরে নারীত্বের যন্ত্রণা বইছে আমার। অথচ তার চোখে আমি নাকি অপ্সরাদের মত। সুখে আমার বুক ভরে গেলো। 

কিন্তু আপুর বিয়েটা হবে তো? শুনলাম শান্ত ভাইয়ার বন্ধু নাকি বিয়ে ভাংচুরের ব্যাবস্থা করছে!

.

.

ন’মাস পর,

রিহান... 

আমার ফাঁশির রায় হয়েছে। 

-- প্রথম যেদিন জেলখানার দেয়ালে পিঠ চেপে ঘুমিয়েছিলাম বাবা স্বপ্নে এসে বলল, মানুষ খুন করার পর মানুষের মাথায় শুধু খুন করার দৃশ্য ঘুরপাক খায় তোর কি তেমন হয়েছে নাকি?

-- আমি বাবাকে কঠিন করে বললাম, আমি কুত্তা মেরেছি, মানুষ না।

-- বাবা হাসিমুখ করে বললেন, এজন্যই তোকে নিয়ে আমার গর্ব হয়। 

আমি লজ্জায় মাথা নিচু করতেই বাবা চলে যান।আর বাবার দেখা নেই।

আজ শেষ বারের মত পরিবারের সাথে আমার সাক্ষাৎ হবার কথা। পরিবার বলতে শুধু শান্ত আসলো। শান্ত এসে আমার সামনে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো। 

-- কাশি দিয়ে আমিই জিজ্ঞেস করলাম, শুকিয়ে গেছিস দেখছি। আগের মত বাঁশের পুল পাড়ে গিয়ে এখনো বসে থাকিস ?

-- শান্ত উদাসীন হয়ে আমার চোখের দিকে তাইকিয়ে বলল, অনেকদিন পর কাল একবার বসবার জন্য গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি পুল টা ভেঙ্গে গেছে রে।

-- আমার বুক কষ্টে মুচড়ে উঠলো তাও মিথ্যে হাসি দিয়ে বললাম, ঝিমির কি খবর? 

-- শান্ত'র চোখ এবার টলমল করে বলল, ঝিমির বিয়ে হয়ে গেছে রে। শেষবার বলেছিলো তাকে ক্ষমা করে দেবার জন্য, আমি তাকে সর্বহস্তে ক্ষমা করে দিলাম। 

-- আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম, তোর চোখে পানি কেন?

-- শান্ত চোখ চেপে ধরতে গিয়ে তার কাশি আসলো, শান্ত দুহাতে মুখ, গলা চেপে ধরেও কাশি থামাতে পারলো না। কাশির সাথে তার গলা ভরে রক্ত আসলো। শান্ত সে রক্ত চেপে ধরে বলল, তুই চিন্তা করিস না আমার কিচ্ছু হয়নি।

-- শান্ত'র মুখ থেকে ঠোঁট বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পরছে, সে রক্ত হাত বেয়ে কুনুই অব্দি চলে গেছে। আমি আর কিছু না বলে তার সামনে থেকে চলে আসলাম। 

-- শান্ত রক্তমাখা গলা নিয়ে চেচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, রিহান আমি তোর কে?

-- আমি পিছন ফিরে তাকিয়ে বললাম, চিনি না। আমি জানি, এ দেখাই তার সাথে আমার শেষ দেখা!

.

আমাকে ফাশির মঞ্চে দাঁড় করানো হলো। ফাঁশির মঞ্চটাকে আমার কাছে প্রাইমারি স্কুলের বার্ষিক ক্রিয়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের মঞ্চের মত লাগছে। সামনে কিছু লোক কালো কোড পড়ে দাড়িয়ে আছে, উনাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে, আমি মঞ্চে দাড়িয়ে যে কবিতা বলবো উনারা সে কবিতার বিচারক মণ্ডলী। 

আমার মাথায় কালো কাপড় পড়ানো হলো। আমার মনে হচ্ছে কিছু কালো মাইক্রোফোন আমার সামনে রাখা হলো। আমি কবিতা বলবার প্রস্তুতি নিলাম, 

কবিতার নাম "তালগাছ"। লিখেছেন, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন। 

ঐ দেখা যায় তাল গাছ 

ঐ আমাদের গাঁ।

ঐ খানে তে বাস করে 

কানা বগীর ছা।

আমার তাল গাছটার নিচ থেকে ধীরে ধীরে পৃথিবীর সমস্ত মাটি সরে যেতে লাগলো! আমি ভয়ে আতকে উঠলাম! আমায় ঘিরে ধরলো অতি ভয়ংকর কিছু জমাট অন্ধকার।  

আমার মুখ দিয়ে আর কবিতা আসলো না, আমি পড়া শুরু করলাম... লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ)


........সমাপ্ত..........


লেখক: মোহাম্মদ নাহিম


রহস্যময় সমস্ত গল্প গুলো পড়ুন।