বাস্তব জীবনের কিছু গল্প | শিক্ষনীয় বাস্তব গল্প

কঠিন বাস্তবতার গল্প

কঠিন বাস্তবতার গল্প

 -- " আমার মা যখন এক টাকাওয়ালা লোকের হাত ধরে বাড়ি ছাড়েন তখন আমার বয়স সবে পাঁচ বছর। "


সেদিন বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব করে কেঁদেছিলেন।আমি তখন কিছু না বুঝলেও বাবার কান্না আমার ছোট্ট হৃদয়ে তীরের মতো আঘাত করেছিলো।বাবা ছেলের এই জড়াজড়ি করে কান্না করা দেখে সেদিন আশেপাশের অনেকেই এমনকি দাদির চোখের অশ্রুও বাঁধ মানেনি। সবাই সেদিন মায়ের প্রতি ছি. ছি. করেছিলো যে এতোটুকুন এক ফুটফুটে ছেলেকে রেখে কী করে উনি টাকার মোহে অন্য পুরুষের হাত ধরতে পারেন? 


এর কদিন পরেই একটি প্যাকেটে করে আমার মা বাবাকে ডিভোর্স লেটার ও একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন।বাবা চিঠিটি পড়েই অতিরিক্ত রাগের বসে চিঠির কাগজটি জ্বলন্ত চুলায় নিক্ষেপ করেন এবং ডিভোর্স পেপারে সাথে সাথেই সাইন করে দেন।সেই চিঠিতে কী লেখা ছিল তা বাবা ব্যতীত আজ পর্যন্ত আমরা কেউই জানতে পারিনি।


দাদা বাড়ির সবাই আমাকে আদর ও স্নেহ করতেন আর বাবার চোখের মনি ছিলাম আমি।তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আর বিয়ে করবেননা কেবলমাত্র আমার জন্যই।কারণ সৎ মা যদি আমাকে অবহেলা করেন তাহলেতো তার দ্বায়ভার নিজেকেই নিতে হবে। কিন্তু কয়েকমাস যেতেই আমার দাদি বাবার নিকট আবদার করে বসেন যে বাবাকে পুনরায় বিয়ে করতে হবে।কিন্তু বাবা তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন।তার একটাই কথা আমি আমার ছেলেকে নিয়ে সারাজীবন পাড় করে দিবো তবুও আমার কোন নারীর প্রয়োজন নেই।কিন্তু আমার দাদি বাবাকে বার বার বুঝাচ্ছিলেন যে তোর ছেলেরও একটা মায়ের দরকার আছে।


এভাবে দাদি অনেক প্রচেষ্টার ফলে বাবাকে দুই বছর পর বোঝাতে সক্ষম হলেন।কিন্তু বাবার একটি শর্ত ছিলো, যে মেয়ে অবশ্যই বন্ধ্যা অর্থাৎ সন্তান জন্মদানে অক্ষম হতে হবে।আমার দাদি বাবার শর্তে রাজি হলেও খুব চিন্তায় ছিলেন যে এখন আবার বন্ধ্যা মেয়ে কোথায় পাবে?অবশেষে এক ডিভোর্সী বন্ধ্যা মহিলাকে পাওয়া গিয়েছিল। তার স্বামী তাকে বন্ধ্যা হওয়ার কারণেই ডিভোর্স দিয়েছিলেন।


বাবা আর আমার নতুন মায়ের যেদিন বিয়ে হয় সেদিন আমি দাদির নিকটই ছিলাম।আমার ঠিক মনে আছে যে বাবার বিয়েতে কোন বড় রকমের আয়োজন ছিলনা।দুই পরিবারের কিছু লোক ছিলো হয়তো। বিয়ের দিন রাতে যেটাকে মূলত বাসর রাত বলে ঐসময় হঠাৎই বাবা আমাকে দাদির রুম থেকে সেই মহিলার নিকট নিয়ে যান।তখন বাবা মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বলেন,


-- " আমি জানিনা লায়লা তুমি আমার ছেলেকে পরিপূর্ণভাবে নিজের আপন ছেলে রূপে গ্রহণ করতে পারবে কীনা তবে তোমার নিকট একটাই অনুগ্রহ ওকে কখনো অবহেলা করোনা।আমার ছেলে আমার হৃদয়েরই একটি অংশ আর আমি আশা করি তুমি একজন স্ত্রী হয়ে নিজের স্বামীর হৃদয়ের গহীনে কোনরূপ ফাটলের সৃষ্টি করবেনা।আমি জানি তুমি বন্ধ্যা তাই আমি তোমাকে একটি রত্ন উপহার দিলাম তুমি এর উপযুক্ত যত্ন করতে ভুলোনা কিন্তু। "


আমার নতুন মা সেদিন খাট থেকে নেমে আমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলেন।আমার বাবার চোখেও সেদিন এক প্রাপ্তির অশ্রু দেখতে পেয়েছিলাম। বাবা আমাদের দুজনকে রুমে রেখে বাহিরে চলে গিয়েছিলেন।আমার নতুন মা তখন নিজের অশ্রু শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে আমাকে সুন্দরভাবে খাটে বসিয়ে ভালোমন্দ প্রশ্ন করছিলেন যে আমার কী পছন্দ কী খেতে ভালো লাগে ব্লা ব্লা। আমি তখন অবুজ শিশুর মতোই তার প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলাম।


এভাবেই যাচ্ছিল আমার স্বর্ণশেখর দিনগুলো। আমি আমার নতুন মায়ের কারণে কখনো আপন মায়ের শূণ্যতা অনুভব করিনি। তিনি আমার প্রতি এতই যত্নশীল ছিলেন যে আমার মনে হয়না কোনো আপন মাও তার সন্তানের প্রতি এতো যত্নশীল হয় কীনা?পাশের বাড়ির আন্টিরা আমায় মাঝে মাঝেই ডেকে নিয়ে নতুন মায়ের সম্পর্কে এটা ওটা প্রশ্ন করতেন যে আমাকে মারে কীনা কিংবা বকা দেয় কীনা? আমি ছোটবেলায় কখনো মিথ্যা বলতাম না যা সত্যি তাই বলতাম। আর এই সদা সত্য কথা বলাটাও আমার নতুন মায়ের নিকট থেকেই শেখা। পাশের বাসার আন্টিরা যখন আমার মুখ থেকে নতুন মায়ের যত্নশীলতার কথা শুনতেন তখন তারা সত্যিই অবাক হতেন এই ভেবে যে সৎ মাও এতো ভালো হয়?আমার মা ধর্মীয় শিক্ষা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা উভয়েই পারদর্শী ছিলেন। ফলস্বরূপ আমি ছিলাম স্কুলের ফাষ্ট বয়।


এভাবে কেটে গেছে ১৫টি বছর....

আজ আমি মেডিকেলের ইন্টার্নি করা এক ছাত্র।আমার এই সফলতার পেছনে শুধু একজনেরই অবদান রয়েছে আর সে হচ্ছে আমার নতুন মা। নতুন মা কেন বলছি তিনিই এখন আমার একমাত্র মা। আমার দাদুবাড়ি এমনকি গ্রামের সবাই আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করে যে আমি একজন ভবিষ্যত ডাক্তার। কিন্তু তারা আমার থেকেও আমার সৎমাকে নিয়ে গর্ববোধ করে।কারণ এই ডাক্তার তৈরির কারিগর এবং একমাত্র ক্রেডিট তারই। আর তিনি সৎ মা হয়েও যে বিরল নজির স্থাপন করেছেন তা সত্যিই গর্বের বিষয়।


আজ ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরেছি হঠাৎই বাড়ির মধ্যে সামান্য কোলাহল দেখতে পাচ্ছি। ভীড় ঠেলে সামনে এগোতেই সবাই আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।হঠাৎই একজন মহিলা দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলেন।আমি তাকে যথেষ্ট নিজের থেকে ছাড়িয়ে চেনার চেস্টা করছি। আমার স্মরণশক্তি ছোটবেলা থেকেই প্রখর তাই চিনতে আর অসুবিধে হলোনা। হ্যা ইনিই আমার জন্মদাত্রী মা যে আমাকে জন্ম দিয়েও মায়ের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে পারেনি। আমি এক ঝটকায় তার হাতটি ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলাম।তিনি আমার এহেন কান্ডে হতবিহ্বল হয়ে গেলেন।শুনেছি তিনি যাকে বিয়ে করেছেন সেও নাকি একজন পুরুষ বন্ধ্যা। আমি বললাম,


-- " যখন নিজের সুখের জন্য পাঁচ বছরের একটি শিশুকে রেখে অন্য পুরুষের হাত ধরেছিলেন তখন কোথায় ছিল এই ভালোবাসা।এখন আসছেন দরদ দেখাতে?আর এই মহিলাকে দেখুন যিনি আমার আপন মা নাহয়েও আমাকে কখনো মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত করেননি।ওনার থেকে শিক্ষা নিন। আমি জানি আজ আপনি কেনো এসেছেন? কিন্তু আজ আপনাকে আমার কোন প্রয়োজন নেই, আসতে পারেন এখন। "


ভরা মজলিসে আমার থেকে এধরণের কথা শুনে তিনি আর একমুহুর্ত দাঁড়ালেন না।আঁচল দিয়ে অশ্রুজল মুছতে মুছতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন।আমি আমার নতুন মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি দরজার এককোণে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে কান্না করছেন।আমি মায়ের নিকট যেয়ে কপালে একটি চুমু এঁকে বললাম,


-- " তুমি কেনো কাঁদছো মা?তোমারতো আজ খুশি থাকার দিন। "


তিনি আমার কথা শুনে এক চিলতে হাসির ব্যর্থ চেস্টা করলেন। আমি খুব করে ভাবছি আজ যে,


"কেউ পেয়েও হারায় আর কেউ না পেয়েও প্রাপ্তির হাসি হাসে।এটাই বুজি প্রকৃতির অপূর্ব লীলাখেলা..."


(সমাপ্ত)


ছোটগল্প - প্রাপ্তির হাসি

কলমেঃ Misk Al Maruf


এমন আরও অনেক গল্প পড়ুন।