বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প | বাস্তব জীবনের গল্প

বাস্তব জীবনের কিছু গল্প

বাস্তব জীবনের কিছু গল্প

 – “ ২১ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল আমার। যদিও চেয়েছি পড়াশোনা করতে। মা-বাবার কথায় বিয়ে করেছিলাম। ওই যে বলে না কুড়িতে বুড়ি, তাই বসে ছিলাম বিয়ের পিঁড়ি।চেনা পরিচিত জায়গা ছেড়ে চলে গেলাম শ্বশুর বাড়ি।সেই বাড়ির নাম কী জানো? ”


– “ না, জানবো কীভাবে? ”


– “ তাও ঠিক তোমার জানার কথা না।বাড়ির নাম ‘ক্লান্তি শেষে।’ যদিও বাড়ির নামের সাথে আমার আগমনের কোনো মিল নেই।কিন্তু বেরিয়ে আসাটা কিভাবে যেন মিলে গেলো। ”


– “ মানে? ”


– “ শুনবে গল্পটা? ”


– “ জ্বি। ”


তানিয়া হাসলো। এত বছর পর এই প্রথম কাউকে বলবে নিজের জীবনের গল্পটা।তার সামনে বসে আছে রেহানা বেগম।তানিয়ার মেয়ের আয়া। 


– “ আমার বিয়ের তিন বছর পর জানতে পারলাম আমি কোনোদিন মা হতে পারব না।জন্মেছি নারী হয়ে, নিজের মাঝে লালন করছি মাতৃত্ব অথচ সৃষ্টিকর্তা আমায় মা হওয়ার শক্তি দেননি। একটা মেয়ের জীবনে এর চেয়ে বড় অভিশাপ বোধ হয় আর কিছু নেই। ”


– “ আপনার শ্বশুর বাড়ির লোক মেনে নিয়েছিল আপনাকে? ”


– “ এখানেই ব্যাপারটা অন্যরকম।এই ধরনের ব্যাপারে কী হয় জানো?হয়তো বিচ্ছেদ হয় না হয় ব্যাপারটা মেনে নেয়।পৃথিবীতে স্বচ্ছ কাচের মত মন নিয়েও কেউ কেউ জন্মায়।সমাজ, পরিবার আর ধর্মকে সাক্ষী রেখে যেই পবিত্র সম্পর্কের সূচনা হয় তা এত সহজে ভাঙতে দেয় না।একটা  বাচ্চাকে দত্তক নেয় তাকে নিয়েই পাড় করে সারাটা জীবন।আমার বেলায় বিচ্ছেদও হয়নি আবার স্বাভাবিক ভাবে জীবনটাকেও উপভোগ করতে পারিনি। ”


– “ তবে কী হয়েছিল? ”


– “ আমার প্রাক্তন স্বামী ইশতিয়াক যদি আমাকে এই ব্যাপারটার কারণে ডিভোর্স দিতেন তবে হয়তো আমি মেনে নিতাম।অবশ্য মেনে নিতে বাধ্য থাকতাম।কেননা আমার দূর্বলতার জন্য তো আর একটা মানুষ বাবা হওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারে না। তাই না?কিন্তু তিনি সেটা না করে বলেছিলেন, বিয়ে মানে আজীবন সাথে থাকার প্রতিশ্রুতি। সন্তান না-ই হলো। এক জীবন ঠিকই পেরিয়ে যাবে দুজন দুজনার পাশে থেকে।


ঠিক সেই মূহুর্তে আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী নারী ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার ধারণা অত্যন্ত ভুল।বোধ হয় আবেগের বশেই সেদিন আমার স্বামী মেনে নিয়েছিল আমাকে।কিন্তু তার এই আবেগ, অনুভূতি ধীরে ধীরে শুন্য হয়ে গেল।অবশ্য এ ব্যাপারে আমার শাশুড়ী মা, ননদ বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। ”


– “ কি রকম? ”


– ❝ আমার ননদ ইনায়া, যার বিয়ে হয়েছিল আমার বিয়েরই ঠিক এক বছর আগে, সে ৭ মাসের ভরপেট নিয়ে আমাদের বাড়িতে উপস্থিত।বিশেষ করে সেই সময়টাই তো মেয়েরা বাবার বাড়ি থাকে। আমার খুব ইচ্ছে হত ওর কাছে যেতে, ওর থেকে জানতে কেমন হয় মা হওয়ার অনুভূতি,  যখন বাচ্চার হৃদস্পন্দন অনুভব করে তখন কতটা ভালোলাগা কাজ করে মনের মাঝে। তবে আমার এই ইচ্ছাটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো।


একদিন তার পাশে গিয়ে বসে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখনই শ্বাশুড়ী মা ঘরে ঢুকলেন।আর যা বলেছিলেন তার মানে এই যে আমি বাজা, অলক্ষুণে মেয়ে। তার মেয়ের কাছে আসলে হয়তো তার বাচ্চাটার ক্ষতি হবে।ইনায়া তার সাথে মিলিয়ে বললো, – ‘নিশ্চয়ই হিংসে হচ্ছে। হয়তো কোনো ক্ষতি করতেই এসেছে। ’


সেই প্রথম তাদের কথায় কষ্ট পেয়েছিলাম।নিজে মা হতে পারবো না বলে আরেকজনের সন্তানকে কেঁড়ে নিবো এতটা বিষাক্ত মানসিকতা আমার নয়।সেই থেকেই শুরু।


মা থালা ভরতি ফল ইনায়ার সামনে রেখে বলতেন, – ‘ফলমূল আর দুধ খেলে বাচ্চার গায়ের রঙ ফর্সা হয় বুঝলি?ছেলে বউয়ের তো আর এমন সময় আসবে না।না হয় ঠিকই তাকেও এভাবে যত্ন করতাম।’


হয়তো তাই। হাজার হোক তিনিও মা। যদি আমার সন্তান পৃথিবীতে আসত তাহলে নিশ্চয়ই তিনি খুশিই হতেন। 


ইনায়া ঘরে ঢুকা তো দূরে থাক ওর কোনো জিনিস স্পর্শ করাও নিষিদ্ধ ছিল আমার জন্য।কখনও কোনো এক কথার রেশ ধরেই মা বাড়ি মাথায় তুলত। আর বারবার মনে করিয়ে দিত আমার অক্ষমতার কথা।


এই ধরনের ঘটনাগুলো ইশতিয়াকের কানে গেলে সে কখনও কখনও মন খারাপ করতো।আবার আমায় বোঝাতো। কিন্তু এইসব তার ধৈর্যের সীমা পাড় করেছিল। একটা সময় তার মনে হতো এইসব নিত্যদিনের অশান্তির জন্য আমিই দায়ী। আস্তে আস্তে আমি হয়ে গেলাম তার অবহেলার পাত্রী। 


আমার দেখা একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন ইনায়ার বর।ইনায়া আমাদের বাড়িতে থাকত কিন্তু তিনি ব্যস্ততার কারণে তার নিজের বাড়িতেই থাকত।প্রতি সপ্তাহে এসে নিজের স্ত্রীকে দেখে যেত।ওই বাড়িতে আমাকে সাপোর্ট দিয়েছিলেন কেবল তিনি।কোনো মোহ থেকে নয়, বোধ হয় নারীর প্রতি সম্মান থেকেই তিনি তা করেছিলেন।


ইশতিয়াক যেদিন প্রথম আমার গায়ে হাত তুলেছিল সেদিন উনিই বাঁধা দিয়েছিলেন।অনেক বুঝিয়েছিল ওকে। কিন্তু দিনকে দিন অবহেলার পরিমাণ যেন বেড়েই চলেছে।আবার ইনায়ার বরের আমার প্রতি এই দয়া তারা ভালোভাবে নিতে পারেননি। তাই তো চরিত্রে হালকা কালী লেপন করে দিলেন। 


আর সহ্য করলাম না। একদিন স্বেচ্ছায় তালাকনামায় সই করে চলে এলাম।বাড়ির বাইরে এসে একবার পেছন ফিরে তাকিয়েছিলাম। গেটের পাশে সাদা নেমপ্লেটের উপর কালো কালীতে লেখা  - 'ক্লান্তি শেষে'।


এদের অপমান, অবহেলা সহ্য করতে করতে আমি সত্যিই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম।সেদিন সকল ক্লান্তির শেষে সূচনা হয়েছিল আমার সংগ্রামী জীবনের।মা বাবার কাছে এলাম।ভেবেছিলাম ২১ বছর যাদের সাথে ছিলাম তারা ফিরিয়ে দেবে না। ফিরিয়ে দেয়নি ঠিকই তবে কীভাবে কাটবে বাকী জীবন এই নিয়ে তাদের চিন্তার অন্ত নেই।


আমি থেমে থাকিনি। তাদের কাছে থেকেই পড়াশোনা শেষ করে বেরিয়ে গিয়েছিলাম চাকরির খোঁজে।পেয়েও গিয়েছিলাম।খুব ভালো না হলেও যা বেতন পেতাম, যথেষ্ট ছিল। 


একদিন মা এক পাত্রের খোঁজ নিয়ে এলো।ছোট একটা বাচ্চা আছে, তিন বছর আগে স্ত্রী মারা গিয়েছে তার।মায়ের মতে তাকে বিয়ে করলে আমি সন্তান পাবো আর বাচ্চাটা মা পাবে।মায়ের কথায় মত দিতে পারিনি। ছেড়ে আসা সংসারের মায়াই ত্যাগ কর‍তে পারিনি আবার নতুন সংসার গড়ব!

কিন্তু একজন ছিল। যার সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। সে আমার পুষ্প। আমার মেয়ে। যাকে আমি জন্ম দিইনি, দত্তক নিয়েছিলাম অথচ তার মা হতে পেরেছি।


অদ্ভুত ব্যাপার কী জানো?

আমাদের তালাকের ৭ বছর পর ইশতিয়াক ফিরে এসেছিল। ❞


– “ মানে? কেন? তিনি অত দিনে বিয়ে করেননি? ”


– “ না। এমন নয় যে তিনি আমাকে ভুলতে পারেননি। শুনেছি তার বোন পর পর তিনবার মৃত সন্তান প্রসব করেছিল।বোনের জীবনে এমন পরিস্থিতি তার উপর এই ঘটনার কারণে তার মা অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। তার বিয়ে করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সে আমার কাছে ফিরে এসেছিল অন্য একটা কারণে। ”


– “ কী কারণ? ”


– “ তৃতীয়বার মৃত সন্তান হওয়ার পর ডাক্তার জানিয়েছিল ইনায়ার গর্ভে আর বাচ্চা ধারণ করা সম্ভব নয়।ইনায়া স্বামী ব্যাপারটাকে আল্লাহর ইচ্ছা বলে মেনে নিয়েছিল।আর তারাও বাচ্চা দত্তক নিয়ে লালন-পালন করছে।

এতে ইশতিয়াকের নিজের কাছে নিজেকে নিচ মনে হয়েছে। তার মনে হয়েছিলো আমার চোখের পানির মূল্য আল্লাহ এভাবেই পরিশোধ করেছে। সে চাইলেই আমার সাথে এমনভাবেই সংসার সাজাতে পারতো।তাই নিজে এসে ক্ষমা চেয়েছিল। ”


– “ কী বলেছিলেন তখন? ”

– “ ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।হেসে বলেছিলাম, ‘সংসার হারিয়েছি কিন্তু আত্মসম্মান খোয়াতে পারবো না।’ ”


– “ কতটা কষ্ট নিয়ে এতগুলো বছর কাটালেন।আচ্ছা, আমি সামান্য আয়া।অথচ এত সহজে আমাকে নিজের কথা গুলো কীভাবে বললেন? ”


– “ তাতে কী হয়েছে রেহানা?সেইদিনগুলোয় তো কেউ ছিল না।শুধু তুমি ছিলে। তোমার উপর ভরসা করে আমার ছোট্ট পুষ্পকে রেখে দিনের পর দিন জীবিকার তাগিদে বেরিয়ে গিয়েছি।পুষ্প আমার জীবনের বসন্তে ফোটা ফুল নয়। চৈত্রের খরায় অনেক যত্নে লালিত গাছের ফুল।আর তুমি তাকে আগলে রেখেছো।তাই  ক্লান্তি শেষের গল্পটা শুধু তোমাকেই বললাম। ”

.

(সমাপ্ত)

-----------------------------

-ছোটগল্প

-ক্লান্তি_শেষে 

-ফারজানা_আহমেদ

-----------------------------


এমন আরও অনেক গল্প পড়ুন।