রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প | ভালোবাসার গল্প

 সেরা ভালোবাসার গল্প

সেরা ভালোবাসার গল্প

শাওন ভাই আমার মেজো ভাইয়া অয়নের বন্ধু।  আগে ভাইয়ার সাথে প্রায়ই বাসায় আসতো। আমাকে ডেকে বলতো,


তিতির বেশি করে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে মুড়ি মেখে আনতো। ঘরে চানাচুর থাকলে অল্প একটু দিবি। আর একটু ধনে পাতা।


এমনিতে  আমি রান্নাঘরে ঢুকিনা। এসব কাজ করতে  খুব বিরক্ত লাগে।  কিন্তু শাওন ভাইয়া আসলে আমি এই কাজ খুব আগ্রহের সাথে করি ।‌ কোনো এক অজানা কারণে শাওন ভাইকে আমার ভালো লাগে। আমি বড় বাটিতে মুড়ি চানাচুর মাখিয়ে আনি। সাথে লেবু চা।


শাওন ভাই বলেন,


এজন্যই তোকে এতো ভালো লাগে। চাও দিয়েছিস।


 শাওন ভাই যতক্ষণ থাকে আমি এটা ওটা ছুতোয় ভাইয়ার ঘরে যাওয়া আসা করি। তখন  শুধু এটুকু বুঝি যে শাওন ভাইয়ের কথা শুনতে আমার ভালো লাগে।


কিন্তু একসময় অয়ন ভাইয়া শাওন ভাইকে অপছন্দ করতে শুরু করল।‌ কারণ ছিলো শাওন ভাইয়ার জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে পড়া।


এইচ এসসির আগে আগে শাওন ভাইয়ের জীবনে একটার পর একটা দূর্যোগ  নেমে এলো।‌ ওনার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়লো।‌ ছয়মাস মৃত্যু যন্ত্রণার সাথে লড়াই করে পরপারে পাড়ি জমালেন। মায়ের মৃত্যুর দু'মাস পার না হতেই ওনার বাবা আবার বিয়ে করলেন।


শাওন ভাই কেমন যেন হয়ে গেলেন। পড়াশোনাটা ঠিকমতো করতে পারলেন না। এইচএসসি র রেজাল্ট খুব খারাপ করলেন। কোথাও ভর্তি পরীক্ষা দিলেন না।


 ভাইয়া ভালো রেজাল্ট করে  ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পেলো। আর শাওন ভাই স্থানীয় কলেজে ডিগ্রী ভর্তি হলেন।


এরপর থেকে ভাইয়ার সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হলো। ভাইয়া খুব একটা পছন্দ করেননা ওনাকে। ছোটবেলার বন্ধুত্ব কেমন আলগা হতে লাগল। ভাইয়া চলে যাবার আগে বন্ধুদের ট্রিট দিলো রেস্টুরেন্টে। কিন্তু শাওন ভাইকে বললো না। চলে যাবার আগের দিন শাওন ভাই বাসায় আসল। ভাইয়া বিরক্ত হয়েই বললো,


যখন তখন এমন হুটহাট বাসায় চলে আসিস না তো। দরকার থাকলে বাইরে দেখা করবি।


শাওন ভাইয়ের মুখটা এতোটুকু হয়ে গেছিলো। কোনোমতে বললেন,


তুই চলে যাবি কাল তাই ভাবলাম দেখা করে দেখি।


তো! আমি কি একেবারে চলে যাচ্ছি নাকি। আবারতো আসবো। এখন যা। মেলা কাজ আছে।‌গোছগাছ বাকি আছে আমার।


শাওন ভাই নীরবে বেরিয়ে গেলেন। আমার ভীষণ খারাপ লাগতে লাগল। ভাইয়ার ওপর অভিমান হলো খুব। বন্ধু তো সেই যে খারাপ সময়ে পাশে দাঁড়াবে। ঠিক পথে ফিরিয়ে আনবে। অথচ ভাইয়া শাওন ভাইকে এড়িয়ে চলতে লাগল।


এরপর সময় গড়িয়ে গেলো। ভাইয়ার পড়াশোনা শেষ। ঢাকায় একটা বড় ফার্মে জয়েন করেছে। আমি অনার্স পড়ছি। শাওন ভাই টেনেটুনে বি এ পাস করেছেন।


 বাড়িতে অশান্তি লেগেই থাকে। ওনার সৎ মা সারাক্ষণ ওনার দোষ ধরতে থাকে। খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো দেন না। ফ্রিজে তালা দিয়ে রাখেন । এসব নিয়ে ঝামেলা লেগেই থাকে। সব দেখে শুনে পাড়ার লোকেরা বিচার বসিয়ে শাওন ভাইকে আলাদা করে দিলো। ওনার বাবার কাছে থেকে কিছু টাকা আদায় করে নিয়ে শাওন ভাই একটা দোকান দিলেন বাজারে।

দোকান বলত ইলেকট্রনিক এর টুকটাক জিনিস। লাইট, সুইচ বোর্ড ,তার এসব ।


আমি এখন কলেজে। শাওন ভাইয়ের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়। তবে উনি তেমন কথা বলেন না। সেবার কলেজে একটা প্রোগ্রাম হলো পহেলা ফাল্গুনে। শহর থেকে ব্যান্ড দল আসল। মাঠের একপাশে দেখি শাওন ভাইও এসেছেন।


 সেদিন বান্ধবীরা সবাই শাড়ি পরেছি। শাওন ভাই এর সাথে বেশ ক'বার চোখাচোখি হয়ে গেলো। ওনার চোখে আমার জন্য মুগ্ধতা আমার দৃষ্টি এড়ালো না। 


আমার কেনো জানি ভীষণ ভালো লাগল। হঠাৎ করেই একটা কেমন অনুভূতি জেগে উঠল শাওন ভাইকে ঘিরে। ইচ্ছে করলো শাওন ভাইয়ের মুখোমুখি বসে থাকি আর উনি দুচোখ ভরে আমাকে দেখুক।


আমি তিতির দূর্বল হয়ে পড়লাম। শাওন ভাইয়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে। সারাদিন ঘুরেফিরে ওনার মুখটা মনে পড়ে। একদিন বিকেলে প্রথমবারের মতো ওনার দোকানে গেলাম। শাওন ভাই অবাক হলেন।


বললেন কিছু লাগবে?


কি বলব বুঝতে পারছিলাম না।‌ আমিতো আসলে ওনার সাথে কথা বলতে এসেছি। মিথ্যে করে বললাম,


একটা বাল্ব দেন।


শাওন ভাই বাল্ব দিলেন। আমি দাম মিটিয়ে বেরিয়ে এলাম।


এর দুদিন পর আবারো দোকানে গেলাম। শাওন ভাই বললেন,


কি খবর তিতির?


আমি বললাম ,

সেদিন যে বাল্ব দিলেন ঐটাতো জ্বলছে না।‌ একটু দেখেনতো।


শাওন ভাই বাল্ব টেস্ট করে দেখল।‌


ঠিক আছে তো।


মনে মনে বললাম,


ঠিকই তো থাকার কথা। আমিতো জ্বালিয়ে দেখিইনি।

মুখে বললাম,


ওহ,তাহলে বোধ হয় আমাদের বোর্ডটায় সমস্যা।


হতে পারে।


আচ্ছা বাসায় আসিয়েন।


আচ্ছা। অয়ন কেমন আছে?


হুম ভালো আছে। জব করছে। স্যালারি ভালো। বিয়েশাদী করবে মনে হয়।


ভালো ভালো‌।


আপনি বিয়ে করবেন না?


আমাকে কে বিয়ে করবে?


এমা এটা কেমন কথা? আপনি চাইলে কত মেয়ে রাজী হবে।


আরে বাদ দে তো। যখন ভাগ্যে আছে হবে।


দুদিন পর আবারো আমার শাওন ভাইকে দেখতে ইচ্ছে করল । আবার দোকানে গেলাম। 


শাওন ভাই বললেন


বালব এর সমস্যা?


হাতে থাকা ছাতা এগিয়ে দিয়ে বললাম,


এইযে ছাতাটা একটু দেখেন তো।‌ ঠিকমতো খুলতে পারছি না।

ছাতাটায় একটু সমস্যা। একবারে খোলা যায় না।


শাওন ভাই ছাতাটা নিয়ে কিছু ক্ষণ টানাটানি করে ঠিক করে দিলেন।


কিছু খাবি?


কি খাওয়াবেন?


ঠান্ডা কিছু আনি।


আচ্ছা।


শাওন ভাই একটা  জুস এনে দিলেন। আমি অল্প অল্প করে শেষে করলাম। 


বেরোনোর সময় শাওন ভাই ডেকে বললেন, 


তিতির,এভাবে ঘন ঘন দোকানে আসিস না। অয়ন  শুনলে রাগ করবে।


আমি এলে আপনার ভালো লাগে না?


আমার মতো মানুষের ভালো লাগা না লাগাতে কিছু যায় আসে না। বাড়ি চলে যা।


আমি হুম বলে বেরিয়ে এলাম। 


এর মাস  ছয়েক পরের কথা। দেখতে ভালো হওয়ায় ইন্টার পড়ার সময় থেকেই ঘটক আসতো। এবার আমার ছোট ফুফু উঠে পড়ে লাগলেন। তার দেবরের ছেলে বিবিএ করে অস্ট্রেলিয়া গেছে। ওর সাথে আমার বিয়ের সম্বন্ধ আনলেন। আমার ছবি দেখে নাকি ছেলের পছন্দ হয়েছে। এখন আমরা এগোলেই সব ফাইনাল হবে। আজ দুপুরে ছেলের মা আর বড় বোন দেখতে আসবে আমাকে। 


আমি খুব সুন্দর একটা শাড়ি পরলাম। একটু বের হবো। বেরোনোর সময় মা বললেন,


এখন শাড়ি পরে কোথায় যাস? 


আমি বললাম,


আমাকে দেখতে আসবে একটু সাজবো না? রুনিকে নিয়ে একটু পার্লারে যাবো। 


মা খুশি হলেন। বললেন,

 

আচ্ছা জলদি আসিস। তোর ফুফু দুপুরে চলে আসবেন। তোকে না দেখলে চিৎকার শুরু করবেন।


আমি একটা রিকশা নিয়ে সোজা চলছ গেলাম সুপার মার্কেট এর দিকে। একটা কফিশপে ঢুকে শাওন ভাইকে ফোন দিয়ে বললাম ,

খুব জরুরী কথা আছে। একটু আসতে পারবেন?

শাওন ভাই এলেন।

আমাকে দেখে কিছুটা থতমত খেলেন। আমি বললাম


আমাকে সুন্দর লাগছে না?


চোখ নামিয়ে বললেন,


হুম। 


আমাকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। কিন্তু আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি।


কি বলিস!


ঠিক বলছি।  এখন একটা কথা মন দিয়ে শুনুন। আমি জানি আপনি আমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু বলতে পারেননা । আজ এখুনি আপনি আমাকে বিয়ে করবেন। নাহলে এখানে থেকে আমি সোজা চলে যাবো বড় বাজার রেল গেটে। ঠিক চারটায় দোলনচাঁপা এক্সপ্রেস আসে।  ওটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়বো।


কি পাগলামি কথা বলিস! 


 পাগলামি না। আপনি শুধু বলেন বিয়ে করবেন কি না।


শাওন ভাই কাছু সময় চুপ করে থাকলেন। একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

আয় আমার সাথে।


 তারপর সোজা কাজী অফিস। 


বাসা থেকে খবর পেলো সন্ধ্যার পরে। ভাইয়া ওর কিছু বন্ধুকে সাথে নিয়ে এসে খুব ঝামেলা করল। আমাকে ফিরে যেতে বলল। কিন্তু আমি জেদ ধরে থাকলাম।  বললাম,


আমি এখন বিবাহিত। এটা আমার স্বামীর বাড়ি। এখান থেকে আমি কোথাও যাবো না।


শাওন ভাইকে খুব আজেবাজে কথা শুনতে হলো।


আমাকে বরণ করে নেবার মতো এ বাড়িতে কেউ নেই।

পাশের বাসার দুজন ভাবি এসে মিষ্টি মুখ করালো। পাড়ার ছোট ভাইরা হৈ হৈ করে এসে  ফুল দিয়ে বাসর সাজিয়ে ফেলল। সবাই যেতে যেতে রাত বারোটা পেরিয়ে গেলো।

আমি বসে আছি। শাওন ভাই বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরিয়েছেন।

একটু পরে এসে দরজা লাগিয়ে দিলেন। খুক খুক করে কাশতে লাগলেন। টেবিলে পানি রাখা ছিলো । পানি খেতে গিয়ে গা ভিজিয়ে ফেললেন।


আমি হাসছি ওনার কান্ড দেখে।


হাসছিস কেনো?


 বললাম,

আমি এভাবে পাগলামি করেছি বলে খুব রেগে আছেন?


নাহ।


তাহলে চুপ করে আছেন যে।


শাওন ভাই আমাকে  বুকে টেনে নিয়ে বললেন,


ভাবছি এসব পাগলামির শোধ নিবো কিভাবে?


হঠাৎ আমার লজ্জা লাগতে শুরু করল। কোনোরকমে বললাম,


আলোটা নেভান।


উহু আঁধারে আমার পাগলামি দেখবি কিভাবে?


আমি লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললাম।


এই মানুষটা যে এতোটা পাগলাটে আগে বুঝিনি।


 আমার ভালো লাগছে। আমি হাসছি। বাইরে আজ বিশাল চাঁদ। সেই আলোতে ভেসে যাচ্ছে ঘরদূয়ার। আর আমরা দুজন ভেসে যাচ্ছি স্বর্গীয় সুখের সাগরে।


-ছোট গল্প

-যখন উঠেছে পঞ্চমীর চাঁদ।

লেখায়- ইশরাত হাসান নিরু।


এমন আরও অনেক গল্প পড়ুন।