মায়ের ভালোবাসা ও বউ শাশুড়ির গল্প ২০২৪

 মায়ের ভালোবাসার গল্প

মায়ের ভালোবাসার গল্প

মায়ের বয়স হয়েছে।আমার বড় ভাইয়ের সাথে আর থাকতে চাচ্ছে না।বড় ভাবির সাথে প্রায়ই লেগে যায়। মা'কে বোঝালেও বোঝে না।ভাবিও মায়ের কথা শুনতে চায় না।ভাইয়া মাকেই বোঝাতে চায়। মা আরও রেগে যায়। অনেক দিন থেকেই মা বলছে আমাকে একটু নিয়ে যাও তোমার কাছে।এখানে আর ভালো লাগছে না।দমবন্ধ হয়ে আসছে।


আমিও তো অপারগ। আমার মা'কে এখানে আনলে শাশুড়ি আম্মা আমার নামে নানান কথা মা'কে শোনায়।আমার নামে অনেক অভিযোগ করেন মায়ের কাছে।  মা কষ্ট পায়।আর আমার হাসবেন্ডও আমার মায়ের এখানে বেশি দিন থাকা পছন্দ করে না।আমার বাবার কিছু গ্রামের জমি পেয়েছিলাম আমি। সেগুলো বিক্রি করে আমার হাসবেন্ড তমাল তার ব্যবসার জন্য টাকা চেয়েছিল।টাকা আমি দিতাম।কিন্তু ইচ্ছা করেই দেইনি।সে কখনো আমার মা'কে সম্মান দেয়নি।বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিল।সে একবারও দেখতে যায়নি।শুধু মৃত্যুর পর মাটি দিতে গেছে। এটাও হয়তো যেতো না।যদি মানুষ কিছু না বলতো। মানুষ কী বলবে তাই গেছে। আমার মন তখনই উঠে গেছে।


 আমি মাঝে মাঝে মা'কে দেখে আসি।আর আমার হাত খরচের টাকা থেকে কিছু টাকা মা'কে পাঠাই।সেটাও টের পেলে বড় ভাই মায়ের কাছে থেকে নিয়ে নেয় কোনো অজুহাতে।বড় ভাবির ব্যবহার দিন দিন সহ্য ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মা আর কিছুতেই থাকতে চায় না।


সেদিন মা কান্না করলো ফোন দিয়ে। বলছিল,

আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও।আমি আর এতো কথা শুনতে চাই না।ছেলেটা তো আমারও।আমি ছেলের কামাই খাই।কিন্তু মিতু সবসময় খোঁটা দেয়।তার স্বামীর টাকায় চলে সংসার।আমি তোমার বাসায় কাজ করবো।তাও আমাকে নিয়ে যাও।তোমার শাশুড়িকে কিছুই বলবো না।মায়ের কথা গুলো কলিজায় গেঁথে গেল। 


সেদিন তমাল অফিস থেকে আসার পর বললাম,ভাইয়া তো অনেক দিন মা'কে তার কাছে রাখলো।এবার আমি আমার এখানে রাখতে চাই। আম্মাও একা থাকে।দু'জনে এক সাথে থাকবে।


তমাল রেগে গেল।বলল, তার মানে? তুমি কী আমার বাসায় আনার কথা ভাবছো? তোমার মায়ের দায়িত্ব আমার না।তোমার ভাইয়ের।


আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, এটা শুধু তোমার একার বাসা? এখানে আমার কোনো অধিকার নেই? তোমার মায়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার। তোমার আরও ভাই বোন আছে। তারা কেউ রাখে না।কেউ আসেও না দেখতে।কেউ দুই টাকা দেয় না।আমি কখনো বলেছি তোমাকে আমি একা কেন দায়িত্ব নিব?আজ আমার মা তোমার কাছে বোঝা হয়ে গেল?তোমার সংসার সামলাতে গিয়ে লেখাপড়া করেও চাকরি করা হলো না।আজ নিজে চাকরি করলে তোমার দয়া লাগতো না।তখন তো বলেছিলে,কীসের অভাব তোমার? আজ বুঝতে পারছি কীসের অভাব আমার? নিজের ঘরে অধিকারের অভাব আমার। তোমার কিছু করতে হবে  না।যা করার আমিই করবো।


তমাল তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,ও আচ্ছা? তাই নাকি? তো কী করবেন আপনি? 

আমি তমালের দিকে তাকিয়ে বললাম,ভেব না।সেটা আমার কাজ।আমি আর কিছু বললাম না।মা'কে বললাম,কয়টা দিন ধৈর্য ধরো।তোমাকে নিয়ে আসবো।মা খুব খুশি হলো।ভাবতে লাগলাম কী করবো? আমার লেখাপড়ার পিছনে মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। কিন্তু মায়ের জন্য কিছু করা হলো না।বাবার দেওয়ার জমির কথা মনে পড়ে গেল।বাড়িতে চাচাকে বলে জমিটা বিক্রির কথা বললাম।চাচার বলল,মা এটা একটা সম্পদ।বিক্রি করা কী খুব দরকার? আমি চাচাকে শুধু বিক্রি করে দিতে অনুরোধ করলাম।চাচা নিজেই কিনবেন বললেন। 


আমার বাসার কাছেই আমার বান্ধবী তনু থাকে।ওরা হাসবেন্ড ওয়াইফ এক রুমে থাকে।টাকার সমস্যার জন্য আর একটা রুম সাবলেট দেয়।কিছু দিন হয়।ভাড়াটিয়া চলে গেছে। ওকে বললাম,আমি মা'কে এখানে রাখবো।ও রাজি হলো।মা'কে কাছাকাছি রাখার আর কোনো উপায় নেই। বাকি জীবনটা মা শান্তিতে থাক।আমি যা রান্না করার করে দিয়ে আসবো। মা'কে সারাদিন কষ্ট করতে হবে না।আজ আমি যদি আমার মায়ের জন্য কিছু করতে না পারি।আমার সন্তান আমার সাথে ঠিক এটাই করবে।জমি দিয়ে কী হবে? যদি মা'ই ভালো না থাকে।


মা'কে নিয়ে আসলাম।তমালকে জানালাম মাকে তনুর বাসায় এক রুম নিয়ে রাখবো।তমাল রেগে গিয়ে বলল, 

--- ভাড়া আর খরচ কে দিবে? আমি শুধু বললাম,তোমাকে ভাবতে হবে না। সেই চিন্তা আমার। তমাল রেগে বলল,

---এখন থেকে নিয়ে নিয়ে খাওয়াবে তো এখানেই রাখতে।মানুষের কাছে আমাকে ছোট করার কী দরকার? 


আমি তমালকে বললাম, তোমার কোনকিছু নিয়ে মা'কে দেখার ইচ্ছা নেই। বাবার দেওয়া জমি বিক্রি করেছি সেই টাকা থেকে মা'কে দিব।আমি নিজেও কিছু করবে এখন।বাচ্চারা বড় হয়েছে। এখন আমার নিজের টাকা দরকার। এখন সত্যি আমার অভাব। তমাল রেগে বের হয়ে গেল।


তমালের মন মেজাজ খারাপ থাকলে বন্ধু মাসুমকে ফোন দেয়।মাসুম দেখা করতে আসলো তমালের সাথে। তমালের কথা শুনে মাসুম অনেক বোঝাতে চেষ্টা করে তমালকে।আমার মা'কে যেন তমাল নিজের মা মনে করে কাছে রাখে এটা বোঝায়।অনেক ছেলের বউ শাশুড়িকে কাছে রাখতে চায় না।অথচ আমি যে চাকরি ছেড়ে সংসার করছি।তমালের মায়ের জন্য এতকিছু করছি তা মাসুম বোঝাতে চাইল।কিন্তু তমাল তার কথাও না শুনে চলে আসে।এটা অবশ্য মাসুম আমাকে বলেছিল পরে একদিন। 


আমি আমার বান্ধবী তনুর সাথে ছোট করে বুটিকসের বিজনেস শুরু করে দিলাম।বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে এসে মা'কে সারাদিন ও রাতের জন্য রান্না করে দিয়ে আসি।আমার কোনো অসুবিধা হলে তনু মায়ের খেয়াল রাখে।আমার শাশুড়ি আমার কাজে মোটেও খুশি না।তবে আমি তমালকে সরাসরি বলে দিয়েছি আমাকে কাজ না করতে দিলে ঘর ছেড়ে যাবো।আর আম্মার দায়িত্ব আমার একার না।তোমার ভাইদের বলো তাকে রাখতে।


তমাল এরপর আর কিছু বলার সাহস পায়নি।আমার অনেক কষ্ট হলেও মায়ের জন্য আমার কিছু করা হচ্ছে। আমার নিজেরও ইচ্ছা পূরণ হবে।মা মাঝে মাঝে বলে,আমার জন্য জামাইয়ের সাথে ঝগড়াঝাটি করো না। নিজের সংসার ঠিক রেখো।


একদিন অফিসের কাজে তমালকে চট্টগ্রামে যেতে হলো।আম্মার রাতে হাঠাৎ শরীর খুব খারাপ হয়ে গেল।বুকে ব্যাথা শুরু হলো।তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে গেলাম।তমালকে জানালাম। কিন্তু ও তো এতে তাড়াতাড়ি আসতে পারবে না।আর অফিসের কাজটাও জরুরি। তমালের কোনো ভাই বোনকে বলে লাভ হলো না।


এদিকে আমার কাছে টাকা বলতে জমি বিক্রির কিছু টাকা আছে। শুক্রবার হওয়ার জন্য ব্যাংক বন্ধ।  তলাম টাকা দিতে পারছে না।আমিও আম্মার বিষয়ে রিক্স নিতে পারছি না।


মা আমার হাত ধরে বলল,তোমার যে টাকা আমার  কাছে রেখেছো তা নিয়ে তোমার শাশুড়ির চিকিৎসা করো।জীবন আগে।আমি অবাক হলাম।মা'কে আম্মা কতো কথা বলে।মা'কে তমাল তার বাসায় রাখলো না।তারপরও মা এমনটা বলছে।আম্মার মিনি হার্ট এটাক হয়েছিল। রবিবার তমাল ঢাকার এলো।আম্মা তখন একটু সুস্থ। আমি কীভাবে সবকিছু সামলে নিয়েছি তা আম্মা তমালকে বলল।


তমাল আমার দিকে তাকিয়ে বলল,আজ তুমি বউ হয়ে ছেলের কাজ করেছো।আমার হাত ধরে কেঁদে দিল।বলল,আজ তুমি না থাকলে আম্মার কীযে হতো?আমি তমালকে শান্ত হতে বললাম। 


---আসলে তমাল আম্মাকে আমি নিজের মায়ের  মতোই মনে করি।আর আম্মার প্রতি আমারও তো দায়িত্ব আছে। 


আম্মা তমালকে বলল,এই কয়দিন বউয়ের মা আমার সাথেই ছিল। নিজের ছেলে মেয়েদের সময় হয় না।শুধু তোর বড় ভাই এসে একবার দেখে গেছে। মাস শেষ তাই নাকি কারো হাতে টাকা নাই। 


আম্মা সুস্থ হলেন। হাসপাতাল থেকে বাসায় আনলাম।আম্মা এখন কিছুতেই মা'কে তার বাসায় যেতে দিবেন না।মা'র কাছে আগের সবকিছুর জন্য ক্ষমাও চেয়েছে।সবকিছু ভুলে এক সাথে থাকতে বলেন।মা আম্মার দিকে তাকিয়ে বলে,না আপা।মেয়ের সংসার কীভাবে থাকি? মানুষ কী বলবে? তাছাড়া আমার জন্য ওর অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি আমার ছেলের কাছেই যাবো ভাবছি।


সেদিন বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ বলে আমি মায়ের জন্য বাজার করে তনুর বাসায় গিয়ে দেখি মা নেই। সবকিছু নিয়ে মা চলে গেছে। বুঝতে পারলাম মা বড় ভাইয়ের কাছে চলে গেছে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে।মনের কষ্ট চাপা দিতে ওখানেই কিছুক্ষণ কাঁদলাম। 


বাসায় এসে দেখি মা আমাদের বাসায়। মা'কে দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।আমার এমন কান্না দেখে মা বলল,বাচ্চাদের মতো কাঁদছো কেন?আম্মা কাছে এসে বলল,আর কাঁদতে হবে না।আপা আমাদের সাথেই থাকবেন। যাচ্ছিলেন ছেলের কাছে চলে। তমালের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। তমাল জোর করে নিয়ে এসেছে। যদিও আমি আর তমাল আজ ওনাকে আনতে যেতাম।এই বাসায় এক মা থাকতে পারলে এই মা-ও পারবে।সন্তানের জন্য আমরা দুই মা কম কষ্ট তো করিনি।আমি আম্মাকে খুশিতে জড়িয়ে ধরলাম।বাচ্চা গুলো এক সাথে নানী দাদীকে পেয়ে মহা খুশি। 


আজ সত্যি তমাল অনেক বড় সারপ্রাইজ দিল।তমাল কাছে এসে বলল,তুমি এতো বছর পর কিছু শুরু করেছো। তোমার ব্যবসার জন্য এটা রাখো।হাতে টাকা আসলে আরও কিছু দিব।


টাকা গুনে দেখি আমি যা আম্মার চিকিৎসার জন্য দিয়েছিলাম। তার সাথে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা বেশি আছে। আজ সত্যি অনেক আনন্দের দিন আমার। তার মানে আমি ব্যবসাটা এখন মন দিয়ে করতে পারবো।মা'কে কাছে রাখতে পারবো এটা সবচেয়ে বড় আনন্দের।


ছোট_গল্প -ঃমায়ের জন্য 

ফারজানা ইয়াসমিন 


এমন আরও বাস্তব জীবনের বউ শাশুড়ির গল্প পড়ুন।