মায়ের পর বোন আপন হয় | ভাই বোনের মধুর সম্পর্ক

ভাই বোনের ভালোবাসা

ভাই বোনের ভালোবাসা

 বড়_আপা

 ছোট_গল্প

 

বড় আপা যখন দুলাভাই কে সামনে রেখে রুই  মাছের মাথাটি আমার পাতে তুলে দিয়ে বললেন খা, তখন আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। এতো করে না না বললাম কে শুনে কার কথা। দুলাভাই ও জোর করতে লাগলো। কি করা এক রকম বাধ্য হয়ে ই খেতে হলো। 


রবীন্দ্রনাথের মতো আমাদের বড়'দা, মেঝ'দা,ছোড়'দা ছিলো না। তবে বড় আপা, মেঝো আপা,ছোট আপা ছিলো। আর বাকি আপাদের নাম ধরেই ডাকতাম। যদিও আমার ইমিডিয়েটলি বড় আপারা মাঝে  মাঝেই রাগ করে এই অনিয়েমর বিরুদ্ধে মায়ের কাছে শালিস দিতো। কিন্তু বিচারে আসামি অপরিপক্ক আর একমাত্র পুত্র সন্তান বিধায় রায় বরাবর আসামি পক্ষের দিকেই ঝুঁকত। আর এই নিয়েও আদালতে চলতো হৈ হুল্লোড়। 


প্রায় ই বিচারকের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠতো।

কিন্তু সেই বিচারক শত অভিযোগের ভিতর ও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতেন। 

এর ফলে কনিষ্ঠ আসামি আরো আশকারা পেতো। আর এই ভাবেই বড় আপাদের অভিযোগও সময়ের সাথে সাথে চলতে না পেরে এক সময় বন্ধ হয়ে যেত।

তাই ঘরের বড় আম, বড় পেয়ারা, মুরগীর মাংসালো পিছ, ইলিশ মাছের মাথার একচ্ছত্র অধিকার থাকতো শুধু আমার।

 

মাছের মাথা খুব যে প্রিয় সেটা বলবো না,তবে বাড়িতে বড় মাছের মাথা বরাবর আমার পাতেই আসতো, অন্ততঃ মা যত দিন বেঁচে ছিলেন। মজার বিষয় ছিল এই মাছের মাথা খেতে খেতে মুরগির মাথা ও এক সময় বাড়িতে আমার জন্য  অঘোষিত বরাদ্দ থাকতো। 

অবস্য সানিয়া, যায়েদ বড় হওয়ার পর এমনিতেই কমে গিয়েছিলো, কেনোনা আমার মতো তারাও মাথা পছন্দ করতো। তখন হতো কি, বৌ বুদ্ধি করে একেই দিনে সমস্ত মাথা রান্না করতো ব্যাস ঝামেলা মিঠে যেতো।


মাকে হারাইয়াছি অনেক দিন। মৃত্যুর বছর দুই আগে থেকেই মায়ের শরীরে প্রচুর রক্ত দিতে হতো। মায়ের রোগের নাম ছিলো লিভার সিরোসিস, যতই রক্ত দিতাম কাজ হতো না, একমাসেই রক্ত শুন্যতা দেখা দিতো। ও পজেটিভ ছিলো বিধায় নিজেই অনেকবার পূরন করেছি। তারপর সংরহ করতে হতো, এই নিয়ে মা কতবার আমাকে ধরে ধরে কেঁদেছিলেন আর বলেছিলেন 

"আমি মরে গেলে কেডায় আমারে মা-মা কইয়া বড় বড় ডাক দিবো! কেডায় তরে ডাকদা ডাকদা খাওয়াইবো?


বড় হওয়ার পরে মা কাছে বসিয়ে খাওয়ানোর জন্য কত চেষ্টা ই না করতেন। আর পিঠে হাত বুলিয়ে বলতেন 

"আমি খাওয়াইয়া যাই, মরে গেলে আর কেউ বলতো না। আমি মইরা গেলে এগুলো মনে কইরা কান্দিস"। আর কত কি!! আমি ছিলাম মায়ের একমাত্র পুত্র, মায়ের আদর, শাসন সবই থাকতো আমাকে ঘিরে।


মা তো মা-ই,  সেই জায়গায় পূরণ কেউ করতে পারবে না।

আমার অনেক বোন, কিন্তু কোন বোনের ব্যাপারেই স্পেশাল করে কখনো কারো কাছে কিছু বলিনি। কারণ সবাই আমাকে ছোট হিসেবে যথেষ্ঠ ভালোবাসে। এই ভালোবাসা একেকজনের কাছে একেক রকম করে প্রকাশ পায়। কোন বস্তুতে এর পরিমাপ হয় না।


আমিও ভালোবাসি কিন্তু কখনো ই বলা হয়নি। 

খুব আপনজনদের ভালোবাসি বলতে নেই, এতে করে ভালোবাসা শব্দটাকে ছোট করা হয়। ভালোবাসা হচ্ছে এমন এক অনুভূতি, যে অনুভূতির রং প্রকাশ করলে গাড় থেকে হালকা হয়ে যায়। যারা এই রং বুঝতে পারেনা তারা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।


খুব ছোট বেলায়, বালিশ নিয়ে ঝগড়া, প্লেট নিয়ে ঝগড়া কে ছোট খাবে? কে বড় খাবে?  মেলাতে দলের বেধে যাওয়া, খাবার সময় লাইন করে বসে খাওয়া, বৃষ্টির দিনে চোর পুলিশ খেলা, লুডু খেলা।আহা কতই না মধুর স্মৃতি আজ কতদূরে। 


ক্লাস নাইনে পড়ি সময় বড় আপার বাসায় থাকা হতো। তখন থেকেই মায়ের ভালোবাসার কিঞ্চিৎ আপার কাছে খোঁজে পেতাম। কোথাও ঘুরতে গেলে কখনোই আপার কাছ থেকে টাকা চাইতে হয় নি, আগে থেকে ই  টাকা রেডি করে হাতে গুজে দিতেন।


মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে সব বন্ধুদের নিয়ে সারা দিন এ্যায়ারগান দিয়ে বক্ শিকার করে রাতে আপার বাসায় চলে আসতাম,  উনি খুব খুশি চিত্তে সমস্ত আয়োজন করতেন। আর চলতো ভাগিনা ভাগ্নিদের সাথে হৈ হুল্লোড়। 


আজ এতোদিন পড়েও যেকোনো অকূলেই আপার এখানে কূল খোঁজে পাই। এখনো সপ্তাহে দুএকবার ফোন দিয়ে খোঁজ রাখবে কি করছি কোথায় আছি!

মাঝে মাঝে মনে হয় মা এখনোও বেঁচে আছেন। 


কিন্তু ইদানীং খুব ভয় হয়, বড় আপার কিছু হলে আমি কি ভাবে শোক কাটিয়ে উঠবো! যে ঋণে আবদ্ধ হয়ে আমি চষে বেড়াচ্ছি সেই ঋণ আমি কি ভাবে পরিশোধ করবো! এই ঋণ অর্থ দিয়ে শোধ হয় না, কখনো ভালোবাসার দিয়েও না। কিছু প্রতিদান আজীবন ই বাকী থাকে।


তখনও মা বেঁচে ছিলেন। দুই বছর হয় বিয়ে করেছি,এমন সময় জীবিকার তাগিদে যেতে হলো আফ্রিকার দেশ লিবিয়াতে। 

সেখানে অবশ্য আমার ভাই বহু দিন ধরে পরিবার নিয়ে স্থিতি আছেন। তাই কিছু না ভেবেই পারি দিলাম সাত সমুদ্র তেরো নদী। 

"অভাগা যেদিক চায় সাগর শুকিয়ে যায়" আমার হলো সেই হাল। যেতে না-যেতেই শুরু হলো সেই  আরব বসন্ত। মিশর, তিউনিসিয়া হয়ে যুদ্ধ আরম্ভ হলো লিবিয়াতে, সৈরাচারী গাদ্দাফিকে হটানোর যুদ্ধ। 


এর যাতাকলে প্রবাসীদের ত্রাহিত্রাহি অবস্থা। পনের দিন তিউনিসে উদ্ভাস্তু জীবন কাটিয়ে যখন জাতিসংঘের বিশেষ বিমানে করে ঢাকা পৌছেছি তখন রাত তিনটা। নিজেকে খুব দুঃখী আর একা লাগছিলো। সেই ঘুটঘুটে রাতে কালো বোরকা পড়া এক মহিলা আমার জন্য সেই সন্ধ্যা হতে প্রধান ফটকে দাড়িয়ে ছিলেন কান্নাজড়ানো চোখে। এগিয়ে যেতে ই ঝাপটায়ে ধরে বড় আপা বড় বড় গলায় কাদঁতে লাগলো। 


কিন্তু সেদিনের আবেগ বুঝার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান তখনো ভিতরে আমার তৈরি হয়নি। মা চলে যাওয়ার শুন্য দিনগুলোতে আপার উপস্থিতি আমাকে নতুন পৃথিবীতে মায়াভরা অবলম্বনের ঠিকানা খুজে দিয়েছিলো।


 অর্থের লেন-দেন যে ছিলো না, এমন নয়। কিন্তু সেটা কখনোই ভালোবাসা কে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। 

 তবে এই যে সমাজে শুনি, অর্থের লোভ ভাই বোনের সম্পর্ক কে নষ্ট করে দেয়? এটা নেহাৎ মিথ্যে নয়, তবে সম্পর্ক টিকে রাখার জন্য বোনের যেমন ইচ্ছে থাকে তেমন ভাইয়েরও স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ার মতো মন লাগে। যেটা আমাদের হয়তো ছিলো।


আসলে পৃথিবীর সকল ভাইয়ের ভালোবাসায় খাদ মেশানোর জন্য কিছু লোভ কোন কোন নারী ঢুকাতে পারলেও, বোনের ভালোবাসার অন্দর মহলে কোন পুরুষ ঢুকার সাহস পায় না, যদি না বোন ইচ্ছে না করে ঢুকায়। ভাই বোনের ভালোবাসা হচ্ছে নিরেট পবিত্র ভালোবাসা।


এমন আরও গল্প পড়ুন।