ভালোবাসার কিছু বাস্তব কথা | বাস্তব জীবনের কিছু গল্প

বাস্তব জীবনের ঘটনা ও গল্প

বাস্তব জীবনের ঘটনা ও গল্প

মেয়েমানুষের শরীর থেকে যৌবন নামক বস্তুটা চলে গেলে শরীর হয়ে যায় হয় থলথলে  নয়ত চিমসে।   সালোয়ারকামিজ বা শাড়ি কোনো পোশাকেই আগের সুশ্রী ভাবটা ফুটে উঠে না । এখানে  যারা হাঁটতে আসেন তাদের প্রেত্যেকের বয়স পঞ্চান্ন ছুঁইছুঁই।   চুলে কৃত্রিম রঙ, সাজপোশাকে কেউ নিজেকে চল্লিশের কোঠায় রাখতে পছন্দ করেন।এখানে সবাই হাঁটতে আসে, হাঁটার চেয়ে কথা হয় বেশি। গলির মাথায় খাবারের দোকান।তেলে চপচপে পরোটার দিকে সাবেক কর্নেলের স্ত্রীর  চোখ চকচক করে উঠে।


-বুঝলেন ভাবী,  সকালে এক ঘণ্টা হাঁটার পর ভীষণ ক্ষুধা পায়।ছেলের বউ দুইটা শুকনা রুটি আর কোনোরকম ভাজি রেখে নাতি নিয়া স্কুলে ছুটে।    একদিন জিজ্ঞেসও করে না দুইটা রুটিতে আমার হয় কী না।


  নীচতলার  নীলুফার বেগম মুখ ভেঙচে  উত্তর দেয়, 

-আপনার বউ  তবু খাবার রেখে যায়। আর আমারটা সকালে ঠোঁট পালিশ করে অফিসে ছোটে।   নিজের স্বামী-সন্তানের খবর রাখার সময় না আমি তো পরের মা।  


আজমেরী হক চায়ে চুমুক দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।  উনি না বললেও উনার অব্যক্ত কথা সবাই বুঝে নেয়।   ভদ্রমহিলার স্বামী গত হয়েছেন ১৪ বছর আগে। একটাই ছেলে স্ত্রীসহ অস্ট্রেলিয়া থাকে। দুবছর অন্তর কয়েকদিনের জন্যে নাতি-নাতনীর মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়। 


এদের তুলনায় সবচেয়ে সুখী বোধহয় আমি। তাই পুত্রবধূকে দোষারোপ করার মত কারণ খুঁজে পাই না।   


   আট-দশটা পাত্রী দেখেশুনে  নিজের পছন্দসই বউ ঘরে আনার সময় হয় নি । আমার ছেলে নাহিদ  সে ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়েছে ।  বিবিএ শেষ করে একটা বেসরকারি  ফার্মে জয়েন করেছে। এমবিএ তখনও রানিং। এরমাঝে গো ধরল বিয়ে করবে।  ওর ক্লাসেপড়ুয়া এক মেয়ের সাথে ভাবভালোবাসা ছিল।সে মেয়ের  বিয়ের সম্বন্ধ আসছে।    পুত্রধন এমেয়ে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না।


দিবা।  ছোটখাট গড়নের সাথে ছোট্ট নামটা চমৎকার মানিয়ে যায়। আমার ৫ ফুট ১১ ইঞ্চির ছেলের পাশে ওকে এতটুকু লাগে। টকটকে ফর্সা রঙ।হাসলে দু'গালে লালচে আভা পড়ে।  নাক-মুখ বোচা কিন্তু অল্পবয়সে যেকোন মেয়ের দেহে লাবণ্যের ছোঁয়া থাকে। আমার ছেলের ভালো লাগে ওকে। আমার পছন্দ -অপছন্দতে কী আসে যায়।  


নাহিদ তখন কুঁড়ি হাজার টাকা মাইনে। ওর বাবার পেনশনের টাকা আর গ্রাম থেকে আসা কিছু তরতাজা শাকসবজিতে একরকম  চলে যায়। মাস শেষে  সঞ্চয় হত না আবার কারো কাছে ঋনীও হতে হত না।    ভালো ছিলাম বেশ।


দিবাকে অসহ্য লাগত। রান্না করতে গেলে   সবজি পুঁড়িয়ে ফেলত।ঘর ঝাড়ু দিলে কোণায় কোণায় ময়লা জমে থাকে। কি মেয়ে!  বাপ মা কয়েকটা কাগজের ডিগ্রি ছাড়া কিছুই শিক্ষাদীক্ষা দেয় নি ।  বিরক্ত হয়ে বলতাম, 

-থাক, তোমাকে কিছু করতে হবে না। ঘরে বসে থাকো ।


মেয়েটা লজ্জা পেয়ে রুমে চলে যেত।সারাদিন চুপচাপ।  রাতে নাহিদ বাড়ি ফিরলে চোখমুখ উজ্জ্বল।কোনদিন দেখতাম বিকেল হতে শাড়ি-টিপ পড়ে  লজ্জায় রাঙা হয়ে ঘুরছে। ছুটির দিনে দুজনে ঘুরতে বের হত। বাড়ি ফিরে   আমার রুমে ঢুকত।


-মা, দেখেন আপনার ছেলে কি কিনে দিয়েছে! 


তাকিয়ে দেখতাম দু'হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি।  রিনিঝিনি শব্দে সারাবাড়ি ছুটে বেড়াত।  বারান্দা থেকে গুণগুণ গান ভেসে আসত। 


দু'বছর পর ছেলের প্রমোশন হয়। দিবাও কনসিভ করে। ছেলের আদিখ্যাতা দেখে আর বাঁচি না। আর কারো বউ প্রেগন্যান্ট হয় না। রাতে অফিস থেকে ফিরে খাইয়ে দিচ্ছে। বউ বাথরুমে গেলে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকছে।

-দিবা,সাবধানে পা ফেলো।মেঝে পিচ্ছিল।


কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। ফর্সা রঙ,  হাত-পায়ের গড়ন লম্বা।রাতের বেলা বউ নাক ডেকে ঘুমায়,বাচ্চাটা কাঁদলে বাপ উঠে  কোলে নিয়ে হাঁটে।   

বছর গড়ায়।প্রমোশনের সাথে ছেলের ব্যস্ততাও বাড়ে। দিবা ঘুমঘুম চোখে সকালে রুটি বানায়, ডিমপোচ করে।  বরকে অফিসে পাঠিয়ে মেয়ের  খিচুরী রান্না করতে বসে। দুপুরের রান্নাটা আমিই করি।

 

আমার স্বামী গত  হয়েছেন দিবার    ছেলে হবার কয়েকমাস পর। তিনি মারা যাবার পর আমার কিছুদিন পর এমেয়ের বাড়ি, ও মেয়ের বাড়ি যেতে হয়। বাবা নেই, আমি না গেলে মেয়েরা মন খারাপ করে।


আট বছর!  সময়টা খুব কম নয় আবার বেশিও নয়।এই সময়টাতে দিবা তরুনীর খোলস ছেড়ে মধ্যবয়স্কা মহিলা।   ভোরে নামাজ পড়তে উঠে দেখি মেয়েটা আমার আগে ঘুম থেকে উঠে গেছে।চুলায় ডাল-ভাত বসিয়ে  সবজি কাটছে।  দেড় বছরের ছেলে ঘুম থেকে উঠে কাঁদছে।   নাহিদ ডাকছে,

-দিবা, প্লিজ থামাও ওকে।শান্তিমত একটু ঘুমাতেও দিবে না। 


ছেলে কাঁধে নিয়ে ঘুম পাড়ায় আর মেয়ের স্কুলের ব্যাগ গুছায়।  টিফিন রেডি করে।খাবার টেবিলে কে কি খায় তা খোঁজখবর নেবার সময় ওর হয় না।মেয়েকে খাইয়ে স্কুলের জন্যে রেডি করাতে হয়।  ছেলেটা একা টেবিলে নাস্তা সেরে অফিসে চলে যায়।  


দু'ঘণ্টার জন্যে ছেলেকে আমার কাছে রেখে মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসে। গ্যাস বিল,ইলেক্ট্রিসিটি বিল, টুকিটাকি বাজার করা দিবা অবলীলায় করে।বাড়ি ফিরে ছেলেকে খাইয়ে দুপুরের রান্নার যোগাড় করে। কোনদিন বিকেলে দেখি মা-ছেলে দু'চোখের পাতা এক করেছে  অতঃপর মেহমান এসে হাজির। হাসিমুখে চা-নাস্তা বানিয়ে গল্প  করে।


সন্ধ্যায় নাহিদ বাড়ি ফিরে চিৎকার করে।

-আমার তোয়ালে কই? নীল শার্ট ধুয়ে রাখতে বলছিলাম। এখানে ফেলে রাখছ।


সারাদিন কাজ করে আসছি এককাপ চা বানিয়ে দেবার লোক নাই।  

দিবা তখন মেয়ের হোমওর্য়াক দেখিয়ে দিচ্ছে।ছেলের জন্যে দুধ গরম করছে।    এক ফাঁক চা বানিয়ে দিয়ে আবার ছুটছে।

দিবার ৩২তম জন্মদিনে  নাহিদ ডায়মন্ডের ইয়ার রিঙ গিফ্ট করেছিল। দিবা আমাকে দেখানোর প্রয়োজনবোধ করে নি। এই মেয়ে বিয়ের পর আমার পিছুপিছু ঘুরত  যেকোন কাজে হাত লাগাত। এখন দিবা সারাদিনে একবার আমার ঘরে আসে না।দুপুরে খাবার টেবিল গুছিয়ে ডাক দেয়,

-মা খেতে আসেন ।

ঘুমানোর সময় দরজা থেকে বলে,

-মা কিছু লাগবে কী না?

কয়েক বছর ঘুমানোর আগে কিছুক্ষণ পাশে বসে গল্প করত।  চুলে তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিত। সময়ের সাথে সুন্দর মুহূর্তগুলো অতীত হয়।


আজমেরী হক জিজ্ঞেস করেছিলেন,

-আপনার ছেলের বউ বুঝি খুব খাতিরযত্ন করে।

-একথা কেন?  

-কোনদিন কিছু বললেন না।

মলিন হাসি হাসলাম।


-আট বছর আগে যখন ছেলের বউ ঘরে আনি ও হাসলে দু'গালে লালচে আভা  বের হত  ।  গালে এখন মেস্তার দাগ।


বাকি তিনজন চুপচাপ।


 -ছেলের ঝামেলা সামলাচ্ছে, নাতিনাতনির ঝামেলা সামলাচ্ছে। আমি আর আমার সংসার ভিন্ন কি!  


-সংসারের গল্প

হাবিবা সরকার হিলা


এমন আরও অন্যরকম গল্প পড়ুন।