সেরা ভালোবাসার গল্প | মিথ্যা ভালোবাসা

ভালোবাসার গল্প

ভালোবাসার গল্প

মীরা প্রায় দশ মিনিট ধরে বারান্দায় পায়চারী করছে মঈনকে কিছু বলার জন্য। মঈন অফিসের জন্য বের হয়ে নীচে নেমে গেটের কাছে যাবার আগেই মীরাকে তার চোখে পড়লো। সে চোখ নামিয়ে এগিয়ে যেতেই পেছনের বারান্দা থেকে মীরা ডাকলো,


-শুনুন, আপনার সাথে দু’মিনিট কথা বলবো।

-আমি অফিসে যাচ্ছি। ফিরে এসে আপনার কথা শুনি?

-আমি তো বললাম মাত্র দু’মিনিট!

-জী বলুন।

-আমার বাবার প্রেশার হাই, উনার রাতে ভালো ঘুম হয় না, আর আপনি রাতে যেসব কাজ করেন তাতে আমার বাবা ঘুম তো দূরের কথা, বিছানায় উঠে বসে থাকেন। আপনার সমস্যা কী, বলুন তো!

-আমার তো কোন সমস্যা নেই!

-সমস্যা নেই মানে? আপনি রাত বিরাতে বাঁশি বাজান মনের সুখে, গত মাঝরাতে আপনি খুটখুট খুটখুট শব্দ করে বাবাকে এবং আমাকে দুজনকেই ঘুমাতে দেন নাই! আবার বলছেন আপনার সমস্যা নেই! 

-এ ব্যাপারে আপনার সাথে পরে কথা হবে। এখন যাই, দেরী হয়ে যাচ্ছে।


মীরা দেখলো গেট থেকে বের হবার সময় মঈন খলিলের দিকে তাকিয়ে বলছে,


-খলিল মিঁয়া কেমন আছো? ঠিক মত ডিউটি করো। শহরের অবস্থা কিন্তু খুব খারাপ! চোখ কান খোলা রাখবা। গেটের সামনে ময়লা, আবর্জনা থাকলে সিটি কর্পোরেশন তা নিজ দায়িত্বে বাসার ড্রইং রুমে ফেলে যাবে কিন্তু!


মীরার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। রাগে তার মুখ তিতা লাগছে। একটা মানুষ কি নির্লিপ্ত ভাবে নিজের সমস্যার কথা শুনেও না শোনার মত করে চলে গেল!


মীরাদের দেড় তলা বাড়ির এক তলায় থাকে মীরা আর তার বাবা রাইসুল আমিন। ছাদের উপর দুই রুমের একটা ছোট বাসা, বাকি খোলা ছাদটুকুতে মীরা বিভিন্ন রকম ফল, ফুলের বাগান করে সময় কাটায়। গত দুই মাস ছাদের ঘর দুটো খালি ছিল। আগের ভাড়াটিয়া প্রায় সাত বছর থাকার পর বড় বাসার প্রয়োজনে অন্য দিকে শিফ্ট করেছে। মঈন এসেছে এ মাসের এক তারিখে, দু’ সপ্তাহ চলছে। এর মধ্যেই মঈনের বিভিন্ন রকম বিরক্তিকর কাজ মীরাকে চিন্তায় ফেলেছে। ব্যাচেলর কাউকে বাসা ভাড়া দেয়াতে মীরার প্রচন্ড আপত্তি। মঈন বলেছিল সে আর তার ছেলে থাকবে। দুই সপ্তায় ছেলের কোন খোঁজ নেই। মাঝরাতে ছাদ থেকে বাঁশির সুর কানে বাজে। উথাল পাথাল রকমের বেদনা ভরা সেই সুর। মীরা যে কোন ধরণের ব্যথা, বেদনা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। গতরাতে এমন ভাবে খুটখুট শব্দ শুরু করেছিল, ঘুমের বারোটা বেজে গেছে। মীরা ভাবছে বাবাকে বলে তাকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিতে হবে।


রাইসুল আমিন বরারবরই রাতে হাল্কা খাবার খান। তিনি নিজের শরীরের ব্যাপারে মোটামুটি সচেতন। স্বল্পভাষী হলেও সম্পর্কের প্রতি যত্নশীল মানুষ। মীরা রাতের খাবারের জন্য তার এবং বাবার জন্য দু’বাটি স্যুপ তৈরী করছে। রান্নাঘরের জানালার বাইরে থেকে পান খাওয়া দাঁত বের করে খলিল হাসছে। আবছা আলোতে বড্ড ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে খলিলের মুখ।


-আপা।

-খলিল, তোমাকে না বলেছি রান্নাঘরের জানালা দিয়ে কখনো কথা বলবে না।

-আচ্ছা, আর বলবো না আপা। ঐ যে নতুন স্যার আপনার সাথে কথা বলবার চান?

-নতুন স্যার? তিনি আবার কে?

-আমাদের নতুন ভাড়াটে।

-তিনিও কি এই জানালা দিয়েই কথা বলবেন? যাও উনাকে ভেতরে নিয়ে বসাও।


মীরা দরজা খুলে দেয়। মঈন দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে জলাপাই রঙের একটা টি শার্ট, টি শার্টের বুকে সাদা অক্ষরে লেখা “ Life is nothing, but sun is hot”

মীরার অবাক লাগে আজকাল এসব লেখা টি শার্টও বাজারে পাওয়া যায়!


-ভেতরে আসুন।

-জী না, আমি এখানে দাঁড়িয়েই দুটো কথা বলে চলে যাবো, চুলায় ভাত বসিয়ে এসেছি।

-বলুন।

-আমি সকালে আপনার কথার জবাব দিতে পারিনি, অফিসের তাড়া ছিল তাই। দেখুন আমার মনে হয় প্রতিটি মানুষেরই তার ব্যক্তিগত কিছু সুযোগ সুবিধা থাকা উচিৎ। আমি আপনাদের বাসা ভাড়া নিয়েছি বলে আমার সমস্ত ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধা, পছন্দ অপছন্দ আমি তো গাঙের পানিতে জলাঞ্জলী দিতে পারি না!

-আপনার কথায় যুক্তি আছে মানলাম, কিন্তু মধ্যরাতে আপনি আপনার ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধার নামে অন্য মানুষের ঘুমের জলাঞ্জলী দিতে বাধ্য করতে পারেন না। পারেন?

-এখানে আসার পর প্রথম যে রাতে আমি বাঁশি বাজিয়েছিলাম, তারপর দিন অফিস থেকে ফেরার সময় আংকেল মানে আপনার বাবা বারান্দা থেকে আমাকে ডেকে বলেছিলেন, আমার বাঁশি বাজানো নাকি চমৎকার এবং তিনি মুগ্ধ হয়েছেন! আমি যেন সুযোগ পেলেই এমনি করে বাঁশী বাজায়।

-আরে বাহ্! তবে তো আর কোন কথাই নেই! তো বাঁশি হাতে করেই আসতেন। বাবার কানের কাছে বসে বাজালে নিশ্চয় উনি আরো প্রীত হতেন!

-আমি যখন তখন বাঁশি বাজাই না। রাত যত গভীর হয়, বাঁশির সুরও তত গভীর হয়।

-তো মঈন সাহেব মধ্যরাতে বিকট শব্দে খুটখুটানীর তর্জমা কী?

-সেটার জন্য আমি দুঃখিত। আসলে অনেকদিন পর গতকাল অফিস থেকে ফেরার সময় একটু গরুর মাংস কিনেছিলাম। সব কাজ শেষ করে রান্না করতে দেরী হয়ে গেল। আদা, রশুন বাটা না দিলে কিসের গরুর মাংস! স্টিলের বাটির মধ্যে আদা, রশুন কুচি করে হাতুড়ী দিয়ে পেটাচ্ছিলাম! মেঝেতে বসে পেটাচ্ছিলাম তো তাই শব্দটা আপনাদের কানে বেশী লেগেছে।

-বাহ্, কি দারুন ব্যাপার! হাতুড়ীর নীচে আদা, রশুন পিষ্ট!

-জী, আপনার কাছে যেটা কটাক্ষ, আমার কাছে সেটাই নিত্য বাস্তব। আমি আসি।

-মঈন সাহেব, আমি আসলে আমার বাবার মত করে আপনার বাঁশির সুরে প্রীত হতে পারলাম না। আপনার বাঁশির সুর খুবই করুণ! আমি কষ্ট ছড়িয়ে দেয়া কোনো সুর, গান, কবিতা নিতে পারি না। মাফ করবেন।

-আসলে আপনি নিজের মনে খুব একা এবং দুঃখী একজন মানুষ, তাই কষ্টের সুর আপনি ভয় পান।

-আপনি কি মুখ দেখেই সর্ব সমস্যা সমাধানে বিশেষজ্ঞ জ্যোতিষী হিসাবে নিজেকে দাবী করছেন? যান, আপনার ভাত পুড়ে যাবে!


মঈন চলে যাবার পর মীরার কানে একটা কথাই ঘুরে ফিরে আসছে, “আপনি নিজের মনে খুব একা এবং দুঃখী একজন মানুষ”। বুকের গভীর থেকে পরিচিত সেই দীর্ঘশ্বাস অনুভব করে মীরা।

                      ————————


ছাদে যাওয়া হয় না অনেকদিন। খলিল গাছ গুলোতে ঠিকমত পানি দিচ্ছে কিনা দেখা দরকার। বিকেলে মীরা ছাদে যায়। গাছের মরা পাতাগুলো ফেলে দেয়। ছাদ বাসার বারান্দায় চোখ পড়তেই দেখে এক ছোট্ট মুখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। মীরা বুঝতে পারে মঈন তার ছেলেকে নিয়ে এসেছে। সে তার কাছে যায়।


-কী নাম তোমার?

-আমার নাম উৎসব। তোমার নাম কী?

-আমার নাম মীরা। তুমি বাগানে আসো।

-আমি তো তালা দেয়া, কীভাবে আসবো?

-তুমি এভাবে তালাবদ্ধ থাকো?

-হ্যা, বাবা অফিস যাবার সময় তালা দিয়ে যায়। আমার কাছে ডুপ্লিকেট চাবী আছে। শুধু ইমারজেন্সীর জন্য।

-উৎসব, তুমি এক কাজ করো, ডুপ্লিকেট চাবী দিয়ে তালা খোলো তারপর আমার সাথে বাগানে আসো।

-না, বাবা জানলে কষ্ট পাবে।

-কেন?

-বাবা বলেছে অপরিচিত কেউ ডাকলে না যেতে। কেউ আমাকে চুরি করতে পারে।

-কিন্তু আমরা দুজন তো এখন পরিচিত হয়ে গেলাম।

-তুমি কি এ বাসায় থাকো?

-হুম, নীচ তলায়।

-এটা তোমার বাড়ি?

-না উৎসব, এটা আমার বাবার বাড়ি।

-তোমার বাড়ি কোনটা?

-আমার তো কোন বাড়ি নেই, আমি বাবার কাছে থাকি।

-আমিও বাবার কাছে থাকি। আমি তোমার কাছে আসতে পারি যদি তুমি আমার বাবাকে সেটা না বলো।

-কিন্তু বাবার সাথে তো মিথ্যা বলতে নেই। বাবারা সব মিথ্যা বুঝতে পারেন।

-তাহলে থাক। আমি তোমাকে কী ডাকবো?

-তুমি আমাকে নাম ধরেই ডাকো!

-বড়দেরকে নাম ধরে ডাকতে নেই।

-দেখতে বড় হলেই কি মানুষ বড় হয়ে যায় উৎসব? আমি দেখতে বড় কিন্তু আসলে আমি তোমার সমান।

-মীরা, তুমি কি রোজ এখানে আসো?

-না, মাঝে মাঝে আসি।

-তুমি এলে আমাকে ডেকো। গল্প করবো।

-নিশ্চয় ডাকবো।

-তুমি খুব সুন্দর!

-তুমিও খুব সুন্দর, উৎসব।


কী যে মায়া ভরা সেই ছোট মুখ খানিতে। তালাবদ্ধ শিশুর মুখ দেখে মীরার বুকটা কেমন যেন শূণ্য লাগে। দিনে দিনে সেই শিশুর সাথে গড়ে ওঠে মীরার অকৃত্রিম এক বন্ধুত্ব। শিশুদের ভেতর কোন স্বার্থ বোধ থাকে না, বন্ধু হিসেবে তারা নির্ভেজাল।


মঈন অফিসের দিকে যাচ্ছিল। মীরা বারান্দা থেকে ডাকে।


-মঈন সাহেব, আপনার সাথে দু’মিনিট কথা ছিল।

-অফিস থেকে ফিরে কথা বলি?

-না, কথাটা জরুরী।

-বলুন।

-এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে তো জরুরী কথা বলা যায় না, আপনি ভেতরে আসুন।


মঈন খুবই বিরক্ত মুখে ভেতরে আসে। তার মাথায় অফিসের তাড়া।


-জী বলুন।

-মঈন সাহেব, একটা ছোট শিশুকে আপনি দিনের পর দিন এভাবে তালা বন্ধ করে রাখতে পারেন না। এটা অমানবিক! 

-ছোট শিশুটার যাপিত জীবন সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা নেই। আমরা বাইরে থেকে কারো ভেতরের অবস্থা বুঝতে পারি না তাই নিজের মত একটা মন্তব্য করে বসি। আমি তিন মাস বয়স থেকে এই শিশুটিকে অমানবিক কিছু নিয়ম-কানুনের ভেতর দিয়ে বড় করছি কারণ আমার কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই।

-আপনি অফিস যাবার সময় উৎসবকে আমার কাছে রেখে যাবেন। আমি তার কোন অযত্ন করবো না।

-মাফ করবেন, আমি আমার ছেলেকে কিংবা তার দায়িত্বকে অন্যের উপর ছেড়ে দিয়ে তাদেরকে বিব্রত করতে চাই না। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।


মীরা মঈনের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেন জানি তার চোখ ভিজে ওঠে। প্রতিটি মানুষ তার নিজের ভেতরে কত চাপা কষ্ট বয়ে চলে, এক জীবনে মানুষ কতবার বেঁচে থেকেও মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে, কে তার খোঁজ রাখে! এই যে তার বুকে একটা শিশুর জন্য যে অসীম শূণ্যতা, মঈন কেমন করে তা জানবে! একটা শিশু জন্ম দিতে না পারার ব্যর্থতা তাকে জীবনের এক কক্ষপথ থেকে ছিটকে আরেক কক্ষপথে নিয়ে এসেছে! নিজ হাতে তিলেতিলে সাজানো সংসার, সংসারের মানুষগুলো সব বদলে গিয়েছিল একদিন। নিজ সংসারে সে হারিয়েছিল তার গ্রহণ যোগ্যতা। শারীরিক জটিলতা তাকে মা হওয়া থেকে বঞ্চিত করেছে, কিন্তু মন তো তবু একটা মা ডাক শোনার জন্য, একটা কোমল হাতের স্পর্শ গালে ছোঁয়াবার জন্য ব্যাকুল হয়! যা নিজের সীমার বাইরে মন কেন তার জন্য আকুল তবু!


                 ————————-


বাসার পাশেই যে স্কুল উৎসব সেখানে ভর্তি হলো। ক্লাস ওয়ানে পড়া ছেলেটা বাবার হাত ধরে সকালে স্কুলে যায়, ছুটির পর একা একাই হেঁটে বাসায় ফেরে। মীরা তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করে বেলা এগার’টা বাজতেই বারান্দায় দাঁড়ায়। তার জন্য অপেক্ষা করে, তার একটু দেরী হলেই মীরার মন উৎকন্ঠায় ভরে ওঠে। পা দিয়ে একটা নুড়ি পাথরকে বলের মত এগিয়ে নিয়ে হেঁটে আসছে উৎসব। আনন্দে মীরার মন ভরে যায়।

-উৎসব, পথে কোন সমস্যা হয় নি তো?

-না, মীরা। বাবা আমাকে পথ চলা শিখিয়ে দিয়েছে।

-আগে আমার কাছে আসো, পরে বাসায় যাও।


মীরা মুরগীর মাংস দিয়ে ভাত মাখায়। উৎসব হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে বসে। মীরা তার মুখে মাখানো ভাত তুলে দেয়।

-মীরা, বাবা তো আমার খাবার টেবিলে গুছিয়ে যায় তবু তুমি রোজ আমাকে ভাত দাও কেন?

-তোমাকে নিজের হাতে খাওয়াতে খুব ভালো লাগে তাই।

-কেন ভালো লাগে?

-হয়তো তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

-কেন ভালোবাসো?

-তুমি কত ভালো, কত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলো! তোমাকে ভালো না বেসে উপায় আছে বলো? হোম ওয়ার্ক দেখাবে কিন্তু। হোম ওয়ার্ক শেষ করে বাসায় যেয়ে একটা ঘুম। বিকেলে আবার ছাদে বসে গল্প হবে।


মঈন অফিসের পথে বের হয়ে গেটে মীরার সাথে দেখা। মীরার হাতে অনেকগুলো বাজারের ব্যাগ।


-আমি কি আপনার ব্যাগগুলো বাসায় পৌছে দেবো?

-জী না, ধন্যবাদ। আপনি একা কেন? উৎসব স্কুলে যাবে না আজ?

-না, ওর জ্বর। প্যারাসিটামল দিলাম। শুয়ে আছে।

-জ্বর নিয়ে বাচ্চাটা একা থাকবে?

-উৎসব তো একা নয়, ছায়ার মত কেউ তো সব সময় তার পাশে থাকে। তাকে খাওয়ানো, হোম ওয়ার্ক করানো, বিকেলে গল্প গুজব সবই তো চলছে। 


আজ মীরার হাতে অনেক কাজ। প্রতি মাসে একবার পাশের একটা এতিমখানার ত্রিশজন আবাসিক ছাত্রদের জন্য মীরা নিজের হাতে রান্না করে পাঠায়। উৎসবের জ্বরের কথা শুনে তার মনটা বার বার উদাস হয়ে যাচ্ছে। মীরা কাজ শুরু করার আগে ছাদে গেল। বারান্দার দরজা ধরে দাঁড়িয়ে মীরা।


-উৎসব, একটু শোন।


টুকটুক করে পা ফেলে উৎসব এগিয়ে আসে, তার মুখটা বড্ড শুকনো। গ্রীলের ভেতর দিয়ে উৎসবের কপালে হাত রেখে চমকে ওঠে মীরা।


-তোমার গা তো পুড়ে যাচ্ছে বাবা! ডুপ্লিকেট চাবিটা নিয়ে আসো তো!


উৎসব চাবি নিয়ে আসে। মীরা তাকে সাথে নিয়ে বাসায় ফেরে। বুয়াকে রান্নাঘরের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে মীরা উৎসবের মাথায় পানি ঢালে।


-শরীর খুব খারাপ লাগছে, উৎসব?

-হুম, মীরা। একা থাকতে ভয় লাগছিল।

-আচ্ছা, তুমি আমার কাছে থাকো। তুমি কি তোমার বাবার সাথে কথা বলবা? 

-হুম, আমার কাছে ফোন আছে, বলছি।


ছোট হাত দিয়ে পকেট থেকে একটা খুব সাধারণ ফোন বের করে সে বাটন প্রেস করে।


-হ্যালো বাবা, আমি মীরার কাছে।


রাইসুল আমিন সাহেব ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সব দেখছেন। তিনি এগিয়ে এসে মীরার মাথায় হাত রাখেন। তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তিনিও তো মেয়ের এমন একটা ব্যস্ত জীবনই আশা করেছিলেন।


গা পুড়িয়ে উৎসবের জ্বর। মীরা তাকে বুকের কাছে নিয়ে শুয়ে আছে। ঘুমের ঘোরে সে অস্পষ্ট সরে ডাকছে, মা মা!

মীরা আলতো করে তার কপালে চুমু দেয়। গভীর কান্নায় বুক ভেঙে আসে। কান্না চেপে রেখে মীরা বলে,


-এই তো বাবা আমি।


  বুকের সাথে উৎসবের মাথাটা আরেকটু চেপে ধরে মীরা। তার শূণ্য বুক কি এক পূর্ণতায় ভরে উঠছে। পরিণতি কী হবে জানা নেই। অবাধ্য মন আবার শুনতে চায়, মা মা!


                    ——————————


মঈন বসে আছে ড্রইং রুমে রাইসুল আমিন সাহেবের মুখোমুখি।


-আংকেল, আমি সামনের মাসেই বাসাটা ছেড়ে দেবো। অফিসের কাছাকাছি একটা ছোট বাসা পেয়েছি।

-উৎসবের স্কুল?

-ওখানেও কাছাকাছি একটা ভালো স্কুল আছে।


মীরা পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢোকে।


-বাবা, আমি মঈন সাহেবের সাথে একটু একা কথা বলতে চাই।


রাইসুল আমিন সাহেব নিজের মেয়ের মুখে অন্য এক ছায়া দেখেন। এ মেয়ে যেন অন্য কেউ। তিনি বসার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় বসেন। মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হয়, আকাশ বুঝি মানুষের মনের খবর রাখে!


মীরা আর মঈন মুখোমুখি বসে।


-মঈন সাহেব, আমি উৎসবকে কোথাও যেতে দেবো না!

-মীরা, আমি আপনাকে অনেক ম্যাচুউরড ভাবতাম, কিন্তু এই কয়মাসে আপনি খুব ছেলেমানুষীর পরিচয় দিয়েছেন।

-আমি আপনার কাছে আমার পার্সোনালিটির বর্ণনা শুনতে চাচ্ছি না। আমার এবং উৎসবের মধ্যে যে বন্ধন আমি তা ছিন্ন করতে পারবো না।

-আমি আমার ছেলেকে এমন কোনো মায়ায় জড়াতে চাই না যা অলীক।

-কোন কিছুই অলীক না! সবটাই বাস্তব এবং সত্য।

-নির্মম কোন বাস্তবতার সাথে আমি নতুন করে আমার সন্তানের পরিচয় করাতে চাই না। তাকে আমার মত করে বড় করতে দিন, প্লিজ! যে মায়ায় আপনি আর উৎসব বাঁধা পড়েছেন তা খুব কঠিন মায়া। একদিন যখন আপনাদের এই বাঁধন ছিন্ন হবে, আপনারা দুজনই খুব কষ্ট পাবেন। সম্পর্ক হারায়, মায়া হারায় না। মানুষ নিজের অজান্তেই নিজের ভেতর এই মায়ায় জড়িয়ে থাকে, মীরা।

-আপনিও বুঝি সেই মায়ায় জড়িয়ে আছেন?

-উৎসবের মা কোন মায়া রেখে যান নি। তিনি রেখে গেছেন ঘৃনা, তবু তাঁর মায়া আমাকে ঘিরে রাখে।

-তিনি কেন চলে গেছেন?

-তিনি আমার চেয়েও ভালো কাউকে ডিজার্ভ করতেন হয়তো, তাই সেই ভালো কারো হাত ধরেছেন। তিন মাসের বাচ্চাকে ফেলে যেতে একজন মাকে যথেষ্ট যুদ্ধ করতে হয়। তিনিও সেই যুদ্ধ করেছেন, হয়তো জিতেও গেছেন। 

-আমার জীবনের কথা আপনার কখনো জানতে ইচ্ছে করেনি, মঈন সাহেব।

-আমি আপনার কথা, আপনার জীবনের কথা সব জেনেছি, মীরা।

-কিন্তু কীভাবে?

-আংকেলের সাথে আমার অনেক কথা হয়। উনি রাতে মাঝেমাঝে ছাদে যান। বয়স্ক মানুষেরা নিজের কথা বলতে পছন্দ করেন, কিংবা কথা বলে হাল্কা হতে চান।


মীরা কাঁদছে। মঈনের চোখে আজ মীরাকে বড় বেশী মায়াবী মনে হচ্ছে। এ সংসার মায়ার অদৃশ্য জাল বিছিয়ে রেখেছে মানুষকে সেই অদৃশ্য জালে আটকাতে।

                     ————————-


অকৃপণ চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে মীরাদের ছাদ। যেন কতকাল পরে মীরা আজ জ্যোৎস্নায় ভাসছে। উৎসব মীরার কোলে মাথা রেখে আকাশের তারা গোনার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মঈন বারান্দায় বসে সেই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখে মুগ্ধ। মীরা ডাকে মঈনকে।


-মঈন সাহেব, তুমি কি তোমার বাঁশি নিয়ে এখানে আসবে? আজ সারা রাত বাঁশি বাজাও, প্লিজ! আমাদের বালিশগুলো এনো। আজ আমরা তিনজন ছাদে ঘুমাবো।


রাইসুল আমিন সাহেব বহুদিন পর বাঁশির সুরে ছাদে আসলেন। ছাদে আসার শেষ সিঁড়িতে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। মঈন বাঁশি বাজাচ্ছে আপন সুরে, মীরা মঈনের কাঁধে মাথা রেখে সেই সুর শুনছে, উৎসব মীরার কোলের কাছে শুয়ে হাত নেড়ে কী যেন করছে। রাইসুল আমিন সাহেব চোখের পানি মুছতে মুছতে নীচে নামতে থাকেন। আজ তাঁর জীবন পূর্ণ! একমাত্র মেয়েকে এভাবেই তো তিনি দেখতে চেয়েছিলেন। 


                   —————————-

-ফ্লোরা বন্যা

-মীরার_সংসার


এমন আরও বাস্তব জীবনের গল্প পড়ুন।