বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প | কিছু বাস্তব জীবনের গল্প

 বাস্তব জীবনের গল্প

কাব্যের বয়স যখন দুই বছর সাত মাস, তখন আমি তার মা হয়ে, প্রথম এই বাড়িতে আসি। বিয়ের দিনও জানতাম না, শুধুই একটা বাচ্চার মা হওয়ার জন্য আমার বিয়ে হচ্ছে ।


আমার বাবা একজন সরকারী কর্মচারী । তার সামান্য কিছু বেতন দিয়ে আমাদের সংসার কোনরকমে চলে । আমরা চার ভাই বোন । তিন বোন এক ভাই । ছেলে হবে, ছেলে হবে করে, শেষ বয়সে এসে বাবা মায়ের একটা ছেলে হলো । আমি সবার বড়। যশোর এম এম কলেজ থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স পাশ করেছি ছয় বছর হলো । পৃথিবীর সবাই খুব মেধাবী হয় না । আমিও তেমন মেধাবী হইনি। তাইতো পাশ করার এতগুলো বছর পরেও একটা ভালো চাকরি হয়নি। বাড়ির পাশে একটা ছোটখাটো কিন্ডার গার্টেন স্কুলে পড়াই। তিন হাজার টাকা মাসে পাই। তাও সব মাসে সময় মত দিতে পারে না । আমার ছোট বোনটা সামনে মাস্টার্স পরীক্ষা দিবে। তার ছোটটা ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে । আর ভাইটা ক্লাস ফোরে পড়ে।


ভালো চাকরি পাচ্ছিলাম না, এটার জন্য মায়ের যতটা না কষ্ট ছিল, তার চেয়ে হাজার গুন বেশি কষ্ট ছিল, আমার বিয়ে হচ্ছিলো না বলে । দেখেশুনে বিয়ে দেওয়ার মত আমাদের তেমন আত্মীয় স্বজন নেই। যারা আছেন, তারাও কেউ এগিয়ে আসেননি কোনদিন । বিয়ে নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ কখনোই ছিল না । কিন্তু মা যখন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো, তখন খুব কষ্ট হতো আমার । প্রায়ই আত্মীয় স্বজন এবং পরিচিতদের কে যখন মা বলতো, " আমার নীলার জন্য একটা ছেলে দেখো " তখন মায়ের চোখটা কেমন যেন ছলছল করতো। কেউ দেখতে না পেলেও আমি দেখতে পেতাম, মায়ের চোখে লজ্জা এবং কষ্ট । যেন এই বয়স পর্যন্ত বিয়ে না হওয়াটা লজ্জা এবং কষ্টের ব্যাপার ।


আমার ছোট ফুপি একদিন আমার বিয়ের একটা প্রস্তাব আনলো। ফুপার অফিসের বস। বউ চলে গেছে । প্রেম করে বিয়ে করেছিল। বউটার বাবা বাড়ি থেকে মেনে নেয়নি। প্রথম প্রথম সম্পর্ক ভালোই ছিল । বাচ্চা হওয়ার পর থেকে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে । বাচ্চার বয়স যখন দুই বছর, তখন দুজনের ডিভোর্স হয়ে যায়। বাচ্চা কে রেখেই চলে যায়। তার বাবা মা তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছে। ফুপি বললো, ফুপার বস শাহেদ, ছেলে খুব ভালো । কেন সংসার টিকলো না, সেটাই এক বিস্ময়। বাচ্চাটা কাজের লোকের কাছে মানুষ হচ্ছে । কিন্তু কাজের লোক কি আর ঠিকমত দেখে ? তাই পরিবারের চাপে আবার বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।


মা এবং বাবা দুজনেই ফুপির উপর চটে গেলো। এরকম একটা প্রস্তাব কেমনে ফুপি নিয়ে আসলো, সেটা তাদের বোধগম্য হচ্ছিলো না । সবাই কে অবাক করে দিয়ে, আমি বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম । অল্প বয়সে বিয়ে নিয়ে যে ভাবনা থাকে, আমার তা ছিল না । কখনো স্বপ্ন দেখিনি, ঘোড়ায় চড়ে কোন রাজ পুত্র আসবে । শুধু মনে হচ্ছিলো, আমাকে এখান থেকে উদ্ধার পেতে হবে । মায়ের কষ্ট আমার আর সহ্য হতো না ।


সাদামাটা ভাবেই আমাদের বিয়েটা হলো। বিয়ের দিন রাতে শাহেদ আমাকে বললো, " নীলা, তুমি আমাকে মাফ করে দিও। আসলে আমি এখনো মন থেকে প্রস্তুত না। কাব্যর মা কথাকে এখনও আমি ভুলতে পারছি না । কিন্তু কাব্যর জন্য একজন মা খুব দরকার । তাই তাড়াহুড়ো করেই বিয়েটা করে ফেললাম। আমার ধারণা, তুমিও এখনো প্রস্তুত নও। আমরা দুজনেই বরং একটু সময় নিই। " আমি অবাক হয়েছিলাম, কিন্তু সেই সাথে একটু স্বস্তি ও পেয়েছিলাম। এক সন্তানের জনককে স্বামী হিসাবে পুরোপুরি মেনে নেওয়া, আমার জন্যও খুব সহজ ছিল না ।


হয়তো আমাদের সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল না । কারণ কোন ব্যাপারে একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে, সেই অভ্যস্ততা থেকে উঠে আসা খুব কঠিন । আমি আর শাহেদ বাইরের জগতের কাছে খুব সুখী দম্পতি । শুধু আমরা দুজন জানি, আমরা যে যার মত থাকি। আমি আছি, কাব্য কে নিয়ে । আর শাহেদ আছে, কথার স্মৃতি নিয়ে । আমরা এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি ।


আমি অবাক হয়ে ভাবি, এরকম ভালোবাসা ফেলে, কথা কিভাবে চলে গেলো !! শাহেদের কাছেই শুনেছি, কাব্য হওয়ার পরে, কথা খুব ডিপ্রেশনে ভুগতো । সে সময় শাহেদের অফিসের ব্যস্ততাও বেড়েছিল। কথার ধারণা হয়েছিল, শাহেদ তাকে আগের মত আর ভালোবাসে না । এ নিয়ে প্রায়ই দুজনের গন্ডগোল বাঁধতো। কথার বাবা মা কখনোই শাহেদ কে মেনে নেয়নি। তারাই পরামর্শ দিয়েছে, বাচ্চা শাহেদের ঘাড়ে ফেলে, চলে যেতে। শেষের দিকে শাহেদ খুব চেষ্টা করেছিল, কথাকে ফেরানোর। কিন্তু ততোদিনে বেশি দেরি হয়ে গেছে । 


বিয়ের এক বছর পরেও, আমাদের সম্পর্কটা মোটামুটি আগের মতোই আছে । তবে আজকাল শাহেদ কে একটু উসখুস করতে দেখা যায়। হয়তো কিভাবে শুরু করতে হবে, বুঝতে পারে না । আমার জন্য মাঝে মাঝেই নিজে পছন্দ করে শাড়ি কিনে আনে । শাড়ির সাথে ম্যাচিং অর্নামেন্টস কিনে আনে। সেসব শাড়ি আমি যত্ন করে তুলে রাখি, কিন্তু পরা হয় না । মাঝে মাঝেই শাহেদ দুজনের জন্য কফি বানায়। বেলকনিতে যেয়ে দুজনে কফি খাই । আমি সে মুহূর্ত গুলো অনুভব করতে পারি । কিন্তু কেন জানি, জড়তা কাটাতে পারি না । 


আমার সময় কাটে কাব্য কে নিয়ে । ওর সাথে খেলা, ওকে খাওয়ানো, পড়ানো এসব করতে করতেই দিন চলে যায়। ফুটফুটে একটা বাচ্চা । ওর জগতটাই আমাকে ঘিরে । যত আনন্দ, মান অভিমান, সব আমাকে ঘিরে । মাঝে মাঝেই তার ইচ্ছা মত সবকিছু না করলে, সে আমাকে ভয় দেখায়,


-  আমি একেবারে চলে যাবো। আর আসবো না ।


-  কোথায় যাবা ?


-  নানা বাড়ি । 


আমার বাবা, মা বিয়েতে তেমন রাজি না থাকলেও, এখন কাব্য কে খুব ভালোবাসে এবং আদর করে । কাব্য তাই নানা নানীর ভীষণ ভক্ত । আমার বোনরাও ওকে খুব ভালোবাসে । তাই রাগ হলেই সে আমাকে ছেড়ে, নানা বাড়ি চলে যাবার হুমকি দেয়। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি,


-  একা একা কিভাবে যাবা ?


-  তুমি দরজা খুলে দিবা তারপর আমি লিফটে নিচে নামবো। ড্রাইভার আংকেল এয়ারপোর্টে দিয়ে আসবে। প্লেনে উঠে আমি বলবো, আমাকে জুস দাও। জুস খেতে খেতে আমি নানা বাড়ি চলে যাবো।


আমি তখন ওকে জরিয়ে ধরে আদর করে বলি,


-  আমাকে ছেড়ে যেও না । তুমি চলে গেলে তো আমি একা একা ভয় পাবো।


সে তখন খুব একটা ভাব নেয়। যেন আমাকে ভয় থেকে বাঁচানোর জন্যই সে এ যাত্রা থেকে গেল। আমার মায়া বাড়তে থাকে ।


আজ সে আমার উপর ভীষণ খেপেছে। রাগ করে বলছে,


-  তুমি চলে যাও ।


-  কোথায় যাবো ?


-  যশোর ।


-  আমি চলে গেলে তোমাকে কে খাওয়ায় দিবে ?


-  আমি একা একা ই খাবো।


-  তুমি তো একা একা খেতে পারো না ।


সে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো, 


-  তাহলে নতুন একটা আম্মু আনবো।


-  নতুন একটা আম্মু আনলে তো আমি মারা যাবো।


সে খুব অভিমান করে বললো, 


-  যাও, মারা যাও।


-  সত্যি সত্যি মারা যাবো ?


সে আরো অভিমান করে বললো, 


-  হুমম।


আমি বললাম, " আচ্ছা, তাহলে সত্যি সত্যিই মারা যাচ্ছি । " এই বলে, আমি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলাম। সাথে সাথেই কাব্য কাছে দৌড়ে এসে বললো, "ওঠো আম্মু, ওঠো । " আমি চোখ বন্ধ করেই মিচমিচ করে হাসছি। আমার বোকা ছেলেটা তাও বুঝতে পারলো না, আমি অভিনয় করছি। সে ভাবলো আমি সত্যি সত্যিই মারা গেছি। হঠাৎ করেই কাব্য চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে, " ওঠো আম্মু, ওঠো। আমার নতুন আম্মু লাগবে না। " আমি চোখ বন্ধ করেই কাঁদছি। আমার পাগল ছেলেটা তাও বুঝতে পারছে না, আমি অভিনয় করছি । কাব্যর তখনকার কান্না এবং আবেগের বর্ণনা আমি দিতে পারবো না । সে বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা, খোদা আমাকে দেননি । শুধু বুঝতে পারছিলাম, আমার বুকটা দুমড়ে মুচরে যাচ্ছে । যখন কোন মা একটা বাচ্চা জন্ম দেয়, তখন তার কেমন কষ্ট হয়, আমার জানা নেই । সে আনন্দ মিশ্রিত কষ্ট যতটা গভীর হয়, কাব্যের আহাজারি শুনে আমি যে কষ্টটা পাচ্ছিলাম, সেটা ঠিক ততটাই মনে হলো আমার কাছে । মাত্র চার থেকে পাঁচ মিনিটের ব্যাপার । আমার মনে হলো, এই মুহূর্তে নতুন মা হিসাবে আমার জন্ম হলো । এতদিন কাব্য কে মানুষ করছি ঠিকই । কিন্তু সত্যিকারের মা হিসাবে এই মুহূর্তে আমার জন্ম হলো। আমি চোখ খুলে আমার ছেলে কে জরিয়ে ধরলাম । বললাম, " আমি তো অভিনয় করছিলাম বাবা। " কাব্য আশ্বস্ত হলেও কান্না থামাতে পারছিলো না । আমি ওকে আদর করতে করতে এবং নিজে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, " আম্মু, আর কোনদিন অভিনয় করবে না বাবা । "


আজ আমার ছেলের বাবার জন্য ও মনটা কেমন কেমন করছে । আমি আর কাব্য দুজনে মিলে বেলকনিটা সাজালাম। কাব্য বার বার জিজ্ঞাসা করছে, " আমরা এটাকে সাজাচ্ছি কেন আম্মু? এটা কি আমার আর তোমার নতুন খেলার ঘর ? " আমি বললাম, " হুমম, এটা বাবার জন্য একটা সারপ্রাইজ । এটা তোমার, আমার আর বাবার খেলাঘর। " কাব্য ওর বাবা কে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য প্রচুর এক্সাইটেড ছিল । কিন্তু শাহেদ আসতে একটু দেরি করে ফেললো। কাব্য ততক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে । আমি শাহেদের কিনে দেওয়া নীল রঙের শাড়িটা পরেছি। সাথে ম্যাচিং করা অর্নামেন্টস । একটু সাজগোজ করেছি, যা সাধারণত আমি করি না । শাহেদ খুব অবাক হলো, আমাকে দেখে । আমি বললাম, " বেলকনিতে যেয়ে বসো। আমি দুজনের জন্য কফি আনছি। "


আমি দুজনের জন্য কফি নিয়ে ঢুকলাম বেলকনিতে । শাহেদ অদ্ভুত সুন্দর ভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম । এত সুন্দর দৃষ্টি সহ্য করার ক্ষমতাও, খোদা আমাকে দেননি।


গল্প 

নতুন মা। 


সমাপ্ত..... 


এমন আরও বাস্তব জীবনের গল্প পড়ুন।