স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা | স্বামী স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক

 স্বামী স্ত্রীর মিলন

স্বামী স্ত্রীর মিলন

-তোমরা কেমন আছো বউমা?

-জি?

-মানে, তুমি আর সাজিদ, তোমাদের সম্পর্ক কেমন যাচ্ছে? ঠিকঠাক আছে সব?

-জি মা, ঠিক আছেতো, কিছু কি হয়েছে মা? হঠাৎ এমন প্রশ্ন করছেন?

-না! সাজিদ আজকাল অনেক দেরি করে ফিরে, ছুটির দিনেও বিভিন্ন কাজের ছূতোয় বাইরে কাটিয়েই দেয়। তুমিওতো ঘুরতে টুরতে যাওনা ওকে নিয়ে। 

-ওহ! এই কথা? আসলে মা, আমরাতো দুজনই অনেক ব্যস্ত। ঘুরতে যাওয়ার সময় হয়ে উঠেনা। আর একই কারণে, ও দেরি করে বাড়ি ফিরে।


-না বউমা, আমার কেন যেন সব ঠিক মনে হচ্ছেনা, কোথাও যেন কি ছন্দপতন! সাজিদ ইদানিং অফিসেই সময় কাটায় বেশি, অফিস কলিগদের নিয়ে বেশ আউটিংয়েও যায়। সেই তুলনায় তোমাকে সময় দেয় কম।শোন, সময় থাকতে লাগাম টেনে ধর, নইলে কিন্তু বড় বিপদ হয়ে যেতে পারে। ছেলে মানুষকে একদম ছেড়ে দেয়াও ঠিকনা। তাদের ছলে-বলে-কৌশলে বশ করতে হয়।


-কি যে বলেন মা! ওসব কিছুইনা। তারপরও আপনি যখন বলছেন আমি খেয়াল রাখব।


মুখে শাশুড়ীর কথায় সায় দিলেও মৌসূমী মোটেও সন্দেহবাতিক মেয়ে নয়। বরের ব্যক্তিগত বিষয়ে অহেতুক হস্তক্ষেপ করা তার পছন্দ নয়। ছলে-বলে কাউকে বশ করারতো প্রশ্নই আসেনা। কারো মনে যদি সহজাত ভালোবাসা না থাকে তাকে দিয়ে জোর করে ভালোবাসানো যায়না। আর কেনইবা সে জোর করে ভালোবাসা আদায় করতে যাবে? আত্মসম্মান বলেওতো একটা কথা আছে। সেই সম্মান আর বিশ্বাস যদি কেউ অটুট না রাখতে পারে তবে তার সাথে সম্পর্ক দীর্ঘায়িত না করাই শ্রেয়। 


অফিস শেষে বাড়ির পথে "পার্সোনা"র পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় অনেকদিন পর দেখা হয়ে গেল কলেজ-জীবনের বান্ধবী তিথির সাথেঃ


-ও আল্লাহ! মৌসূমী, তুই এদিকে? কেমন আছিস? আল্লাহ! কতদিন পর দেখা!কি হয়েছিস বলতো তুই? একদম যোগাযোগ রাখিসনা। কোন গেইট টুগেদারেও এটেন্ড করিসনা!


-আমার অফিস পাশেইরে। ভাল আছি, তোর কেমন চলছে! আসলে, অফিস-সংসার সব মিলিয়ে সময় হয়ে উঠেনা।


- আরে সময় করে নিতে হয়। তুইতো সংসারকন্না কর‍তে গিয়ে নিজের শখ আহ্লাদ সব খুইয়েছিস! গত ভাল গান করতি তুই! হলফ করে বলতে পারি, এখন আর প্র‍্যাক্টিস ট্রাক্টিস করিসনা। চেহারাটাকেও কি বানিয়ছিস বলতো! মিনিমাম যত্নটুকুও করিসনা। চল আমার সাথে, আমি পার্লারে যাচ্ছিলাম, চল একসাথে যাই। গল্পও হবে, রিলাক্সও করা হবে।

-নারে, তুই যা! আমার প্রিপারেরশান নাই, তাছাড়া সাজিদ চলে আসবে বাসায়, ওকে চা-নাস্তা দেয়া....

-আরে! পার্লারের যাবি এখানে প্রিপারেশানের কি আছে? একদিন তোর শাশুড়ী চা বানিয়ে খাওয়াতে পারবেনা সাজিদ ভাইকে!?

-না! না! তা হবে কেন? আমার শাশুড়ী অনেক উদারমনা! উনি কিছু মনে করবেননা! আসলে আমারই আন-ইজি লাগে! ১০টা-৬টা অফিস! সারাদিন ঘরের বাইরে- এমনিতেই  গিল্টি ফিল হয়! তার উপর আবার সন্ধ্যায় পার্লারে যাওয়া! বাড়াবাড়ি হয়ে যাবেনা? 


-আরে আজব? বাড়াবাড়ি হবে কেন? মাসে এক কি দুই দিন তুই একটু নিজের যত্ন নিলে সংসার চুলায় যাবেনা। তাছাড়া শোন, সংসারের সবার ভালোর জন্যই তোর নিজের শরীর ও মনের যত্ন নেয়া উচিৎ। শরীর-মন খারাপ থাকলে মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়, তখন কারো সাথে ভাল ব্যবহার করা যায়? তুই বল?


এত কথার পরও মৌসুমীর ইতস্ততভাব না যাওয়ায় এক প্রকার জোর করেই তাকে পার্লারে নিয়ে গেল তিথি। 


ফেসিয়াল,পেডিকিউর-মেনিকিউর, ভ্রু-প্লাক, হেয়ার-কাট সব মিলিয়ে দুইঘন্টা পার হয়ে গেল। মনে মনে তিথিকে অভিসম্পাত দিতে দিতে বের হলেও আয়নায় নিজেকে দেখে অবাক হয়ে গেল সে, মুগ্ধতায় ছুঁয়ে গেল মন। আত্মবিশ্বাসটাও যেন এক লাফে দ্বিগুন হয়ে গেল। বাসায় ফেরার পর শাশুড়ীও বেশ খুশি। 


-বাহ! তোমাকেতো খুব ভাল লাগছে, দেখি দেখি! মা শা আল্লাহ! যাওনা কেন সবসময়?


শাশুড়ীর আস্কারায় মন ফুরফুরা হয়ে গেল, গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বেডরুমে গেল সে। সাজিদ ততক্ষণে মায়ের কল্যানে চা-নাস্তা সেরে মোবাইলে চ্যাট করায় ব্যস্ত।


-কি ব্যাপার ম্যাডাম! আজতো দেখি বেশ ফুরফুরা! কি ব্যাপার বলেনতো!?বলেই চোখ তুলেই মৌসূমীকে দেখে থতমত খেয়ে গেল সে। 


-পার্লারে গিয়েছিলে নাকি? মৌসূমীর ভ্রু নাচানো দেখে দায়সারাভাবে জিজ্ঞেস করল সাজিদ। অনেকদিন পর মৌসূমীকে আবার আগের মত অপ্সরীর মত লাগছিল তার, মুখে কিন্তু তা স্বীকার করলনা। 


মনে মনে তিথির প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করল মৌসূমী। বাকবাকুম মনে সে ঠিক করল এখন থেকে নিজের জন্য আলাদা সময় বের করে নিবে, শরীর-মনের যত্ন নিবে নিয়মিত।


যেই কথা সেই কাজ, অফিসের অন্য সবার সাথে আজকাল মৌসূমীও পার্টিতে যায়, প্রায় প্রতি বৃহস্পতিবার খেতে যায় কোন না কোন রেস্টুরেন্টে। বেশ খোশমেজাজে থাকে সে আজকাল। তার শাশুড়ীও বেশ খুশি বউমার সতঃস্ফুর্ততায়! হবেইনা বা কেন? ইদানিং বউমার প্রাণশক্তি যেন বেড়ে গিয়েছে বহুগুণে, এত ব্যস্ততার মাঝেও পরিপাটি করে রাখে সংসারের সব দিক, তার সাথে নিয়ম করে গল্প করে প্রতিদিন।বউ-শাশুড়ী দু'জনেরই একমত, জীবনতো একটাই, যতক্ষণ প্রাণ আছে উপভোগ করা উচিৎ। দায়িত্ব-কর্তব্য সবারই থাকে, এর মধ্যেই সময় বের করে নিতে হয়।


সাজিদেরও বেশ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে ইদানিং। মোবাইলে চ্যাট আর ফোনে কথাবলার চেয়ে এখন যেন মৌসূমীর নজরদারির প্রতি উৎসাহ বেড়ে গিয়েছে। আগের মত আর রাত করে বাড়ি ফিরেনা, ছুটির দিনেও অফিস গেট-টুগেদারের নাম করে বেড়িয়ে যায়না। প্রতিদিনই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চায় মৌসূমী কোথায় যায়, কি করে,সাথে কে থাকে ইত্যাদি, ইত্যাদি।আর ইদানিং যেন একটু বেশিই ঘনিষ্ট হতে চায় সে! বাড়িতে যতক্ষণ থাকে তার পেছন পেছন ঘুরঘুর করতে থাকে, ঘরের মধ্যে গা-ঘেঁষে থাকতে চায়। 


-তুমি বেশ বদলে গিয়েছো মৌ!

-তাই? কেন বলছো এ'কথা?

-তুমি ইদানিং বেশ দেরি করে বাড়ি ফের, অনেক বেশি বেশি ঘুরতে যাওয়া হয়, সাজগোজও কর অনেক বেশি!

-হুম, ঘুরতে যাই, সাজগোজ করি এ'কথা ঠিক, কিন্তু দেরি করেতো বাড়ি ফিরিনা? আমি আগের সময়েই বাড়ি ফিরি। তবে থার্সডে একটু দেরি হয়, ডিনার থাকে তাই। 

-একটু না মৌসূমী, বেশ দেরি হয়! আর সুমনের সাথে এত মেলামেশা কেন? কি চলছে বলতো? চিবিয়ে চিবিয়ে বলল সে।

-সাজিদ! বিহেইভ ইউরসেল্ফ! কি বলছ এসব? মাথা ঠিক আছে? কি ইংগিত দিত চাইছো?

-ইংগিত হবে কেন? ঘটনাতো স্পষ্ট!প্রতিদিন সুমনের সাথেই বাড়ি ফিরতে হব কেন আপনার? কি এমন স্পেশাল্টি তার? 

-সাজিদ! সুমন আমার জুনিয়র, অনেক রেসপেক্ট করে আমাকে। ওকে জড়িয়ে অন্তত বাজে কথা বলোনা!ওর বাসা আমাদের বাসার কাছেই, তাই আমি ওকে নিয়ে আসি সাথে করে, বেচারার কনভেন্স বেঁচে যায় তাহলে, আর সন্ধ্যা-রাতে আমিও সিকিউরড ফিল করি সাথে কেউ থাকলে। ও মেয়ে হলে এভাবে বলতে পারতে? তাছাড়া তুমি নিজেই কি ধোয়া তুলসীপাতা? আমি কিছু বলিনা বলে? কয়দিন আগেওতো সারারাত ধরে চ্যাট করতা তোমার বসের পি-এস এর সাথে। তাকে নিয়ে এখানে সেখানে আউটিংএও গিয়েছো, সবই আমার কানে এসেছে, কই আমিতো তোমাকে কিছু বলিনি! কখনো কখনো খারাপ লেগেছে এই ভেবে যে তুমি আমাকে ডিপ্রাইভ করে রাত-বিরেতে চ্যাট করতে ওর সাথে।কিন্তু, কই কখনোতো নোংরা কোন কথা বলিনি? এখন খুব গা-ঘেষা স্বভাব হয়েছে, এতদিন কোথায় ছিলে তুমি? যাইহোক, এসব ফালতু আলোচনা করতে রুচিতে বাঁধছে আমার,আমাকে আর ভালো না লাগলে সরাসরি বলবে, কিন্তু প্লিজ, নোংরামি করবেনা। 


সেদিন মৌসূমীর আত্ম-বিশ্বাস দেখে তাকে আর ঘাটাতে সাহস পেলনা সাজিদ। বরং রাতে ঘনিষ্ঠ হল জোর করে আর বারবার স্যরি বলল দুর্ব্যবহারের জন্য আর মিলার সাথে একটু বেশিই মেলামেশা করে ফেলেছে বলে কনফেসও করল।


রাতে সাজিদ ঘুমিয়ে যাওয়ার অনেক্ক্ষণ  পরও ঘুমাতে পারলনা মৌসূমী। ভাবছে, সম্পর্কগুলো কি এমনই? মেশিন-আসবাবের  মত নিয়মিত ঘষামাজা করতে হয়! নইলে এতদিন ধরে প্রেম করে বিয়ে করার পরও কেন মরিচা পরে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে? একছাদের নীচে দিনের পর দিন থাকার পরও কেন নতুন করে অচেনা মনে হয় পার্টনারের গতি-বিধি? তৃতীয় ব্যক্তি এসে কিভাবে ঢুকে পড়ে আলগোছে! তবে কি বিশ্বাস আর ভালোবাসার কোন মূল্যই নেই? নাকি সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ'দুটোই যথেষ্ট নয়,প্রয়োজন পড়ে নিয়মিত চর্চার, নতুনরুপে, নতুনভাবে? 


-অনুবন্ধ_পরিশীলন 

-সৈয়দা_আঞ্জুমান_আরা_শারমিন


এমন আরও স্বামী স্ত্রীর গল্প পড়ুন।