অবহেলার কষ্টের গল্প | কষ্টের গল্প

 চাপা কষ্টের স্ট্যাটাস

চাপা কষ্টের স্ট্যাটাস

আমার ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে তেরো বছর।কিন্তু,এখনো কোনো সন্তান-সন্ততি হয়নি।বিয়ের চার বছরের মাথায়-ই ওর বর দ্বিতীয় বিয়ে করে।সেদিন বোনটা আমায় টেলিফোন করে অনেক  কেঁদেছে।তার একটাই কথা তাকে যেনো আমি শ্বশুরবাড়ি নামক নরক থেকে বের করে নিয়ে যাই।


তখন আমি তাকে উল্টো ধমকেছি; বলেছি,

– “ তোর স্বামীর কি দোষ?চার বছর ঢের সময়।আর কত অপেক্ষা করবে?ওর-ও তো মন চায় বাবা হতে। ”


আমার এইসব কথা শুনে রিনঝিন ফোন নামিয়ে রেখেছিল।এরপর দ্বিতীয় বার আর ফোন করেনি।আমি কালে-ভদ্রে কখনো ফোন করলে ধরেছে এছাড়া নিজে কখনো কোনো সমস্যার কথা অভিযোগ করেনি আমার কাছে।হয়তো অভিমান করেছে;কিংবা বুঝে গেছে ওর ভাই-ও ওর মতোই সহায়হীন।


এরপর একবার ওদের বাড়িতে গেলাম। অফিসের এক কলিগের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা ধার করে দই-মিষ্টি নিয়ে।


আমাকে দেখে রিনঝিনের শ্বাশুড়ি মুখ কালো করে বললো,

– “ এইসব কমদামি মিষ্টি নাকি তারা খায় না।এসব যেন আমি যাওয়ার সময় ফেরত নিয়ে যাই। ”


এতো অপমানিত হয়েছি সেদিন।মন চাইছিল মাটির ভিতর ঢুকে যাই।তবুও,সব অপমান গা ঝাড়া দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,' – “ রিনঝিন কই? ”


আমার কথা শুনে রিনঝিনের শ্বাশুড়ি চেহারাখানা দ্বিগুণ অন্ধকার করে বললেন,

– “ রিনিজিনি আবার কি?এইসব ছোটলোক মার্কা নাম আমার সামনে নিবা না... এদের নাম-কাম কিছুরই ঠিক নাই। ”


আমি লজ্জিত গলায় বললাম,

– “ আসলে ছোট বেলায় ডাকতাম তো !! ”


আমার সাড়া শব্দ পেয়ে রিনঝিন নিজেই উঠানে এলো।ওকে দেখে আমার শরীর কেঁপে উঠলো।একি দশা হয়েছে আমার বোনটার! দুধে আলতা গায়ের রং ছিলো আর এখন কাঠ কয়লার মতো।খেতেও দেয় না হয়তো ঠিকঠাক মতো।


রিনঝিন বললো,

– “ এসো ভাইয়া ভিতরে আসো। ”


দরজার দিকে পা বাড়াতে যাবো ওমন সময় দেখি একটা মেয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে দরজার মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছে।তার ভাব-ভঙ্গী দেখেই বুঝলাম সে চাচ্ছে না আমি ভিতরে আসি।

বুঝতে পারলাম এটাই রিনঝিনের স্বামীর ২য় স্ত্রী।


রিনঝিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

– “ আমাকে দেখতে এসেছিলে...দেখা হয়েছে এবার চলে যাও। ”


আমার খুব ওকে সাথে করে নিয়ে যেতে মন চাচ্ছিল। কিন্তু,আমি অপারগ। শুধু যেটা পারি সেটা হলো মনে মনে দোয়া করতে যাতে কারো কপালে আমার মতো ভাই না জুটে।যে বোনকে আগুনে পরতে দেখতে পারে; কিন্তু সাহায্য করতে পারে না।


রিনঝিন আমাকে এগিয়ে দিতে এলো রাস্তা পর্যন্ত। দেখলাম ও বেচারি ভালো করে হাঁটতে পারছে না।পায়ের পাতার মধ্যে অনেক খানি কাটা দাগ।এখনো শুকায় নি। 


জিজ্ঞেস করলাম,

– “ পায়ে কি হয়েছে.?? ”


রিনঝিন হেসে উত্তর দিলো,

– “ আমার সতীন বটি দা ছুঁড়ে মেরেছিলো।ওর ছেলের দুধ জাল দিয়ে দেরি হয়েছে বলে। ”


আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। বললাম,

– “ তোর বর কিছু বললো না? ”


রিনঝিন আবার হাসলো।

– “ কে আমার বর?আমি হচ্ছি এ বাড়ির কাজের লোক।গরম পানি ছুঁড়ে মারা,গায়ে চা ঢেলে দেয়া,ঝাড়ু ছুঁড়ে মারা এগুলো নিত্যদিনের রুটিন। ”


আমি বহু কষ্টে চোখের পানি আড়াল করলাম।বললাম, 

– “ মিলেমিশে থাকিস।ঝগড়া করিস না। ”


রিনঝিন হঠাৎ ওড়নার কোনার গিঁট খুলে কয়েকটা জীর্ণ নোট আমার হাতে দিলো।বললো, 

– “ মিষ্টি টিষ্টি তো ধার করেই এনেছো আমি জানি।এখানে তিনশো টাকার মতো হবে। ”


আমি কিছু বলবো তার আগেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে গেলো ও।এটাই ছিলো শেষ দেখা।এরপর আর ছয়টা বৎসর দেখা হয়নি।ওদের বাড়ি যেতে সাহসে কুলাতো না।বোনকে এতো খারাপ অবস্থায় কোনো ভাই দেখতে পারে?


আমার স্ত্রী রোজিকে বললাম,

– “ একবার রিনঝিনকে আনি।কয়েক দিনের জন্য।বেচারা ওখানে অনেক কষ্ট পায়।খাওয়া-ও পায়না ঠিকমতো। ”


রোজি আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো।বললো,

– “ ও কষ্টে আছে ,খেতে পায় না।আর তুমি তো লাট সাহেব।টাকার অভাব নেই।মাসের শেষ কদিন কিভাবে সংসার চলবে তার হিসাব মিলাতে গিয়ে আমি ক্লান্ত।আর উনি এই সময় বাড়তি আরেকজনকে ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। ”


আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, 

– “ শুধু দুই দিনের জন্য আনি?আমার ভাগের খাবারটা নাহয় ও আর আমি ভাগ করে খাবো। ”


বলতে বলতে আমার চোখ ভিজে গেলো।কিন্তু,রোজি ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো,

– “ তুমি যদি দু পয়সা বেশি বেতনের চাকরি করতে তবে আমি তোমাকে মানা করতাম না।বোন কেন ,১৪ গুষ্টি এনে খাওয়াও। কিন্তু তুমি বেতন পাও ১০ হাজার তাই দিয়ে সারা মাস কি চলে?আমাদের চার ছেলে মেয়ের লেখাপড়া,বাড়ি ভাড়া, গ্যাস, কারেন্ট এর বিল আরো কতকি কোনটা আমি বলবো?আর মেয়েরা যে বড় হচ্ছে তাদেরও তো বিয়ে দিতে হবে সে জন্য তো একটা টাকাও আলাদা করে রাখতে পারো না।লজ্জাও করে না তোমার?আবার বলছো অর্ধেক করে খাবো। ”


রোজির উপর আমি কি ই বা বলবো।ও তো ভুলও বলেনি কিছু।রিনঝিনকে ফোন করতাম মাঝে মাঝে। খুব তাড়াতাড়ি কথা শেষ করতাম।ভয় হতো হঠাৎ যদি ও বলে,‘ভাইয়া আমাকে নিয়ে যাও।’আমি কই নিয়ে যাবো?


এভাবে কেটেছে অনেকগুলো বছর।একটা যে বোন আছে সে কথা মনেও আনতাম না।একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি বাসার‌ সবার মুখ থমথমে।আমার ছেলে এসে.এস.সি যে এপ্লাস পেয়েছে।এখন যে কলেজটায় ভর্তি হতে চাচ্ছে সেখানে ভর্তি হতে ১১ হাজার টাকা কমপক্ষে লাগবে।আর মাত্র দু'দিন সময়।অথচ আমি এক টাকাও যোগাড় করতে পারি নি।এর মধ্যে বাড়িওয়ালা সাত দিনের মধ্যে তিন মাসের বাড়ি ভাড়া শোধ করতে বলেছে না হয় তাড়িয়ে দিবে।

এতো টাকা আমি কই পাবো বুঝতে পারছিলাম না।


কার কাছে চাইবো? হঠাৎ মনে পড়লো বোনের কথা।যার কথা আমি মনে করি না কোনোদিন।

রিনঝিন কে ফোন করলাম। লজ্জিত হয়ে কিছু টাকা ধার চাইলাম। বললাম ভীষণ প্রয়োজন।ও রাজি হলো। বললো বড় রাস্তার কাছে যেতে, কিন্তু ওদের বাড়ি যেনো না যাই।এক দিক থেকে ভালোই হলো।না হয় মিষ্টি কিনতে আবার টাকা খরচ হতো।


আমার মতো গরিবের পক্ষে....  

তবু তো কিছু নেয়া লাগে।সস্তায় কি পাবো ...কি পাবো করে খুঁজতে গিয়ে ফুটপাতের ধারের একটা কাঁচ-মালার দোকান পেলাম।সেখানে মেয়েদের পায়ের নূপুর,ঘুঙুর এসবও বিক্রি হচ্ছে।ছোট বেলায় আমার বোনটা খুব সুন্দর নাচতো। নূপুর পরে।রিনঝিন রিনঝিন আওয়াজ হতো।সেই থেকে বাবা ওকে রিনঝিন ডাকতো।এখন বড় হয়েছে।এখন তো আর এসব পরবে না।তাও,আমি খুঁজে একজোড়া ঝুমকো ছাড়া নূপুর কিনলাম যেনো আওয়াজ না হয়; খুব সস্তায়।


সেদিন এই সামান্য উপহার দেখে ও এতো খুশি হয়েছিলো।আমি কল্পনাও করিনি।এরপর ও আমাকে বারো হাজার টাকা দেয়।আর জিজ্ঞেস করিনি,‘কই পেয়েছে এতো টাকা?’ খুব দরকার ছিল ব্যাশ নিয়ে নিলাম।


এর দুইদিন পর ওর স্বামী আমাকে ফোন করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করলো।বললো, ‘এক্ষুনি যেনো ওদের বাড়ি যাই।’


আমি ওখানে গিয়ে দেখি আমার বোনকে মেরে ও আর কিছু রাখেনি। 


সেদিন প্রচন্ড রেগে জিজ্ঞেস করলাম,

– “ আমার বোনকে তুই মারলি কোন সাহসে? ”


সে সাথে সাথে বললো,

– “ জীবনে বোনের খবর নেয় না।এক পয়সা দেয় না সে আবার আমার বাড়ির টাকা বোনকে দিয়ে চুরি করায়।তোর বোনের জন্য এতো মায়া হলে নিয়ে যা সাথে করে।এই চোর কে আমি আর পুষবো না। ”


মূহূর্তে আমার রাগ পানি হয়ে গেলো। অনেক বুঝালাম টাকা ফেরত দিবো কিন্তু লাভ হলো না।

হঠাৎ ,আজ নয় বছর পর রিনঝিন আবার বললো,

– “ আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও না তোমার সাথে। ”


আমি তবু বেহায়ার মতো ও বাড়িতে ওর থাকার ব্যবস্থা করার জন্য কেঁদেছি।হাতে ,পায়ে ধরেছি।

কিন্তু লাভ হয়নি।ওর স্বামী হুট করে তিনবার তালাক বলে দিলো। মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো।এখন আমি রিনঝিনকে নিয়েই পথচলা শুরু করলাম।


রোজিকে ফোন করে বললাম,

– “ কয়েকটা দিন যদি রিন...... ” আমার কথা শেষ না হতেই রোজি চেঁচিয়ে উঠলো।


ছেলেকে কলেজে ভর্তির চক্করে বাড়ি ভাড়া দিতে পারিনি।তাই সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।এখন রোজি ছেলে মেয়েদের নিয়ে ওর বাবার বাড়িতে উঠেছে।আমি নতুন বাড়ি খুঁজছি।আর রাতে পার্কের বেঞ্চে ঘুমাই।


রিনঝিন বললো,

– “ ভাইয়া আমি কি কোনো কাজ পাবো? পড়ালেখাও তো করতে পারলাম না বেশি।কি কাজ করতে পারি আমি? তুমি খুঁজে দিবা?আমি তো কিছু চিনিনা। ”


আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম,

– “ আমি নিজেই তো........... ”


এই শহরটা বড়ই প্রাণহীন।আমাদের গ্রাম ভালো ছিলো। যেখানে আমি আর রিনঝিন বড় হয়েছি।সবুজ রঙের সস্তার আইসক্রিম গুলোও ভাগ করে খেয়েছি।কেউ কিছু দিলে বাড়ি নিয়ে আসতাম।বোনকে ফেলে একটা খই-ও মুখে উঠতো না।সারাক্ষণ চিন্তা হতো।এরপর বড় হলাম।আলাদা আলাদা সংসার হলো।এতো দূরে সরলাম।যে ৫ বছরে একবার দেখাও হয় না।দেখা করি না‌।টাকার জন্যে.....


হাঁটতে হাঁটতে আমরা রেল ষ্টেশন চলে এলাম।রিনঝিন বললো,

– “ ওর নাকী খুব ক্ষিদা লেগেছে। ”


পকেটে হাতড়ে দেখি দশ টাকার একটা নোট কেবল।একটা পাউরুটি কিনলাম। অনেক দিন পর সেই ছোট্ট বেলার মতো ভাগাভাগি করে খেলাম।দুইজন রেলপাড় বসে রইলাম।আমি শুধু ভাবছি ওকে নিয়ে যাবো কই?


বসে থাকতে থাকতে রিনঝিন ঘুমিয়ে পরলো।কপালে হাত রেখে দেখি জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।

এমন সময় রোজি ফোন করে বললো,

– “ আমার ছোট মেয়েটার বাথরুমে পরে মাথা ফেটে গেছে।আমি যেন এক্ষুনি আসি। ”


আমি তাড়াহুড়ো করে চলে গেলাম।যাওয়ার আগে একটা কাগজে ছোট্ট করে লিখলাম,


❝ 'প্রিয়,রিনঝিন

রাগের মাথায় ডিভোর্স হয়না।তুই ফিরে যা।তোর স্বামী নিশ্চয়ই তোকে তাড়াতে পারবে না।আর পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস প্রিয় বোন রিনঝিন!! ❞


আমি চোখের পানি মুছে ফিরে গেলাম।মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করলাম।আবারো কতগুলো টাকা।কোথায় যে পাবো...


পরদিন ভোরে লোকজনকে বলাবলি করতে শুনলাম, রেললাইনে কাটা পরে নাকি একজন মহিলা মারা গেছে।চোখ,মুখ ,বডি পুরো থেঁতলে গেছে।তাই,চিনা যাচ্ছে না।


আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো।আমিও গেলাম সেখানে। ততক্ষণে পুলিশ চলে এসেছে।কেউ বলছে, সুই-সা-ইড।কেউ বলছে অন্যমনস্ক হয়ে রেললাইনে বসে ছিলো।কারো ধারনা কানে শুনতে পায়না।


আমি ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম।সত্যি চিনার জো নেই।পুরো শরীরের কি অবস্থা। শুধু পা দুখানা অক্ষত। উল্টোদিকে হয়ে বসে ছিলো হয়তো।আমি তখনো এটা ভেবে সান্ত্বনা পাচ্ছিলাম এটা রিনঝিন না।অন্য মেয়ে।রিনঝিন হয়তো ফিরে গেছে।


হঠাৎ, লাশের পা দুটোর দিকে তাকিয়ে দেখি একজোড়া নূপুর পরা।আমি কিনে দিয়েছিলাম রিনঝিন কে।দুদিনেই রং চটে গেছে।সস্তা বলে কথা।পুলিশ সবাইকে জিজ্ঞেস করছে, যারা ছিলো কেউকি বুঝতে পারছে এটা কে?


আমায় জিজ্ঞেস করায় আমি বললাম,

– “ একসময়ের খুব চেনা,কাছের মানুষ কিন্তু বর্তমানের খুব দূরের মানুষ।এতোই দূর যে তার খোঁজ নেয়ার সামর্থ্য -ও আমার ছিলো না। ”


আমার কথা শুনে পুলিশ রা ধমকি দিলো।পাগল বলে গালি দিলো।আমি হাসলাম।ভিড়ের মধ্যে বসে পরলাম।আসলেই পাগল হয়ে গেছি‌।নাহয় চোখের সামনে কেনো ছোট্ট রিনঝিনকে নাচতে দেখছি।চোখ বন্ধ করলাম।রিনঝিন ......রিনঝিন শব্দ তখনও হচ্ছে।

.

(সমাপ্ত)


ছোটগল্পঃ প্রিয়_রিনঝিন


এমন আরও বাস্তব জীবনের গল্প পড়ুন।