সংসার জীবনের কষ্ট | সংসারের গল্প

 এই ঘর এই সংসার

এই ঘর এই সংসার

আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, ‘ নীলার সাথে বিবাহিত জীবন আমি আর টানতে চাচ্ছি না। ’ বেশ কিছুদিন ধরেই পরিকল্পনা করছিলাম,কিভাবে নীলাকে কথাটা বলবো।


সত্যি কথা বলতে কি, অনেক দিন থেকেই আমি বুঝতে পারছি,‘We are not made for each other.’ নীলা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে কিনা,জানি না। আমি চাই, আমাদের মিউচুয়াল ডিভোর্স হোক।কোন হৈ হুল্লোড় না,কোন ঝগড়া ফ্যাসাদ না।মানুষ যেন আমাদেরকে নিয়ে গল্প না ফাঁদে।কারণ আমার দেড় বছরের মেয়ের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এর উপর।আমি চাই, আমরা দুজনই হাসি হাসি মুখে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দেবো,


– ❝ আমরা শান্তিপূর্ণ বিচ্ছেদে যাচ্ছি।বাচ্চার দায়িত্ব আমরা দুজনেই সমানভাবে পালন করবো।আমাদের একজনের প্রতি আর একজনের সম্মান অটুট থাকবে আজীবন। ❞


কিন্তু নীলাকে সেই কথাটা কিভাবে বলবো,সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। 


নীলার সাথে আমার প্রেম ছিল পাঁচ বছরের।নীলা যখন ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়, আমি তখন থার্ড ইয়ারে পড়ি।আমি সন্ধানী করতাম আর দারুণ কবিতা আবৃত্তি করতাম। নীলা আমার কবিতা শুনে মুগ্ধ হতো।তাই যখন নীলাকে প্রেম নিবেদন করি, তখন সে 'না' বলেনি।নীলা খুব ইমোশনাল একটা মেয়ে ছিল।আমাকে অন্ধের মত ভালোবাসতো।মনে পড়ে, একবার আমার বন্ধু রিপন এক আড্ডায় হাসতে হাসতে বলেছিল, 


– " আমি ভাবতেই পারি না, নীলার মত সুন্দরী, মেধাবী, স্মার্ট মেয়ে তোর মত একটা ছেলের প্রেমে কিভাবে পড়ে ? " 


ওর কথা শুনে আমি হেসেছিলাম।কথা সত্যি, নীলা বড় লোক বাবার একমাত্র সন্তান, দারুণ সুন্দরী, দারুণ মেধাবী।সেই তুলনায় আমার সবকিছুই Below average.কাজেই রিপনের কথা শুনে আমি গর্বে হেসেছিলাম।


বলেছিলাম, 

– " ঠিক বলেছিস।সবার কপালে এমন রাজকন্যা জোটে না। " 


নীলা কিন্তু কথাটা শুনে খুব খেপেছিল। শুধুমাত্র এই কথার জন্যই নীলা পরবর্তীতে রিপনকে সহ্যই করতে পারতো না। আমাকেও নিষেধ করতো,ওর সাথে মিশতে।


বারবার বলতো, 

– " তোমার সম্পর্কে নিচু ধারণা পোষন করে, এমন একজনকে ফ্রেন্ড হিসাবে কেন রাখো ?" 


অথচ সেই নীলা ই বিয়ের পরে সম্পূর্ণ পালটে যায়।বিয়ের পরে যে নীলাকে আমি দেখি, সে সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন।সারাক্ষণ কান্নাকাটি, এ নালিশ, সে নালিশ। – " আজ আমার মা তাকে কি বলেছে ? কাল আমার বোন মিতু কি বলেছে?এতকাজ কাজের লোক দিয়ে করায় না কেন? সবকাজ তাকে একাই করতে হয় কেন?কেন মা বলেছে, মিতুর জন্য একটু নাস্তা বানিয়ে দাও? কেন মিতু বলেছে,রাষ্ট্রবিজ্ঞান কঠিন একটা সাবজেক্ট,ডাক্তারী পড়ার মত সহজ নয় ?" আমি শুনতে শুনতে ফেড আপ।


আচ্ছা, শ্বশুর বাড়িতে মেয়েদেরকে তো একটু এডজাস্ট করে চলতেই হবে, তাই না? আর আমার একটা মাত্র বোন, তার একটু সেবা যত্ন করলে সমস্যাটা কি ? মিতু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পড়ে। কিছু দিন পরেই তো শ্বশুর বাড়িতে চলে যাবে। কাজেই বাবার বাড়িতে একটু আদর যত্ন না পেলে কেমনে হবে ? কিন্তু কে বোঝে কার কথা? 


ভেবেছিলাম, বাচ্চা হওয়ার পরে এইসব সমস্যা আর থাকবে না।বিয়ের তিন বছর পরে বাচ্চা হলো। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পরে সমস্যা আরো বেড়ে গেছে। 


সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান , 

– " আমি একটু ঘুমাতে পারি না, শান্তি করে খেতে পারি না, গোছল করতে পারি না। কেউ আমার বাচ্চাটা একটু সামলায় না। বাথরুমে গেলেও মেয়ে কাঁদছে বলে দরজা ধাক্কায়। " আচ্ছা তোমার বাচ্চা, তোমাকেই তো সামলাতে হবে, তাই না? মা হয়েছো কেন ? আল্লাহ কি আর সাধে বলেছেন, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত? মাকে কষ্ট করতে হয় বলেই না বলেছে ? কিন্তু নীলাকে কে বোঝাবে সে কথা ? সব মায়েরা পারে, সে কেন পারবে না? সবাই বাচ্চা সামলেও কত টিপটপ থাকতে পারে। অথচ নীলাকে দেখলে এখন কাজের মেয়েদের মত লাগে। বলে খেতে সময় পায় না। অথচ মোটা হয়ে চেহারাটা এত পঁচা হয়েছে যে, আমার ওর সাথে এখন কোথাও যেতে লজ্জা ই লাগে। ভাগ্যিস রিপন এই অবস্থায় নীলাকে দেখেনি ।


আমি নীলাকে বললাম, 

– " নীলা, তোমার সাথে আমার কিছু সিরিয়াস কথা আছে। " 


নীলা শান্ত ভাবেই বললো, 

– " বলো। " 


আমি বলতে যাবো এমন সময় আমার মেয়ে নীলার জামা ধরে টানতে লাগলো আর বলতে লাগলো,

– " মাম্মা, বাইলে, বাইলে যাবো। " 


আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

–  " ওকে একটু কারো কাছে রেখে আসো।সিরিয়াস কথা এভাবে বলা যাবে না। " 


নীলা নির্লিপ্তভাবেই বললো, 

– " ওকে সামলানোর মত কেউ বাসায় নেই। তুমি বলো, আমি শুনছি। " 


নীলার এই স্বভাবটার কারণেই আমি ওকে দেখতে পারি না।কথায়, কথায় আমার বাড়ির বদনাম করবে।যেন বদনাম করার একটা সুযোগ খোঁজে সব সময়।আমি রাগের চোটে আমার মেয়ে অহনাকে নিয়ে গেলাম বাবা মায়ের ঘরে।দেখি বাবা ঘুমাচ্ছে।


মাকে বললাম, 

– " মা, অহনাকে নিয়ে একটু বাইরে ঘুরে আসো না।নীলার সাথে আমার একটু কাজ আছে। " 


মা বললো, 

– " আমি এখন ওকে নিয়ে বাইরে যাবো কিভাবে?তোর দোলা খালার জন্য একটা শাড়ি কিনতে যাবো।আমার সময় নেই। " 


আমি মিতুর রুমে যেয়ে বললাম, 

– " অহনাকে নিয়ে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আয়তো। "


মিতু বললো, 

– " আমার সামনে পরীক্ষা, আমার সময় আছে নাকি ?  "


– " সময় নেই, তাহলে গল্পের বই পড়ছিস কেন ? "


– " পড়ালেখার মাঝে মাঝে গল্পের বই পড়লে মাথাটা একটু ফ্রেশ হয়।কিছুটা রিলাক্স থাকা যায়। কিন্তু যদি পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে কাজ করতে হয়, তবে পড়ালেখা শিকেয় ওঠে। "


কথা সত্যি, কিন্তু আজ আমার নীলার সাথে কথা বলতেই হবে।তাই মিতুকে অনুনয়, বিনয় করে রাজি করালাম।মিতু অহনাকে নিয়ে বাইরে চলে গেলে আমি ঘরে এসে দরজা দিলাম। 


নীলা হেসে দিয়ে বললো,  

– " দারুণ সিরিয়াস কথা মনে হচ্ছে। " 


আমি নীলাকে সব বললাম। নীলা অবাক হয়ে আমার সব কথা শুনলো।ভেবেছিলাম প্রচুর ঝগড়া ঝাটি শুরু করে দেবে।


কিন্তু নীলা খুব শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করলো, 

– " তুমি কি অন্য কাউকে পছন্দ করো ? "


আমি বললাম, 

– " হুমম। আমার কলিগ ডা. অরিনকে আমার খুব ভালো লাগে।অল্প বয়সেই বি সি এস করে ফেলেছে, এফ সি পি এস পার্ট ওয়ান করে ফেলেছে। "


নীলা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো।নীলা অনেক মেধাবী ছিল।কিন্তু ফ্যামিলি পলিটিক্স করতে যেয়ে বিয়ের পরে বই খাতায় ধরলো না।সম্ভবত অরিনের কথা শুনে এজন্যই সে মন খারাপ করেছে। খুব মন খারাপ করে বললো, 


– " অরিনও কি তোমাকে পছন্দ করে? "


সম্ভবত। একদিন ঠাট্টা করে বলেছিলাম, 

– " তোমার মত বউ পেলে ধন্য হয়ে যেতাম। 


ও বলেছিল, 

– " ভাবিকে ডিভোর্স দেওয়ার সাহস আপনার আছে ? " 


– " তাতেই ধরে নিলে, সে তোমাকে পছন্দ করে? "


– " না, শুধু সেজন্য নয়। ও আমার ব্যাপারে খুব কেয়ারিং। "


নীলার মুখটা আবার কালো হয়ে গেল।হবেই তো।বাচ্চার দোহায় দিয়ে গত দেড়টা বছর আমার কোন খেয়াল রেখেছে ও ? অথচ অরিন প্রায় প্রায়ই আমার জন্য নিজ হাতে এটা সেটা বানিয়ে আনে। 


নীলা বললো, 

– " ঠিক আছে। তোমাকে মুক্তি দেবো। কিন্তু একটা শর্তে । "


– " কি শর্ত ? "


– " আগামী একমাস প্রতিদিন তুমি আমাকে একটা করে প্রেম পত্র দিবা।ঠিক যেমন বিয়ের আগে দিতে। প্রতিটা পত্র পড়েই যেন আমার মন ভালো হয়ে যায়। ঠিক একমাস পরেই আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো। "


আমার ঘাম দিয়ে জ্বর সারলো।এত সহজ শর্ত?!


আমি খুশিতে বললাম, 

– "  ঠিক আছে। "


বিয়ের আগে মোবাইলে কথা বললেও আমি নিয়মিত নীলাকে চিঠি লিখতাম।নীলা অবাক হতো, আবার ভীষণ খুশিও হতো।আমি পরের দিনই চিঠি লিখতে বসে গেলাম।মেয়েদেরকে খুশি করে চিঠি লিখতে গেলে তাদেরকে প্রশংসা করে চিঠি লিখতে হয়।এটা কোন ব্যাপারই নয়।পরের কিছু দিন আমার নেশা হয়ে গেল, নীলার ভিতরের পজিটিভ জিনিসগুলো খুজে বের করা এবং সেটা চিঠি আকারে লেখা। দিনের পর দিন যাচ্ছিলো আর আমি অবাক হচ্ছিলাম, " নীলার এত গুন ! " নীলার সবচেয়ে যে জিনিসটা আমাকে মুগ্ধ করে, তা হলো আমার প্রতি ওর ভালোবাসা।আমি আবার নীলার প্রেমে পড়ে গেলাম।


যেদিন ত্রিশ দিন পূর্ণ হলো, সেদিন ওকে চিঠিতে শুধু লিখলাম, 

– " আজ রাত একটায় শাড়ি পরে সাজুগুজু করে আমার রুমে এসো। " 


একটা অদ্ভুত নস্টালজিয়ায় ভুগছিলাম আমি।সাড়ে চার বছর আগের কথা।নীলার তখন ইন্টার্নী শেষের দিকে।আমার বি সি এস হয়ে গেছে, পোস্টিং এর অপেক্ষায় আছি।অনারারী মেডিকেল অফিসার হিসাবে তখনও ক্যাম্পাসেই ছিলাম আমি।একদিন নীলাকে রাত বারোটার সময় ম্যাসেজ দিলাম, – " রাত একটার সময় শাড়ি পরে বারান্দায় এসো। " নীলা রাত একটার সময় শাড়ি পরে সাজুগুজু করে ওদের হোস্টেলের দোতালার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।ওকে পরীর মত লাগছিল। ও সারারাত বারান্দার বড় টেবিলটাতে পা ঝুলিয়ে বসে ছিল।আর আমি গেটের বাইরে আম গাছটার নিচে বসে ছিলাম। টুকটাক ম্যাসেজ দিচ্ছিলাম দুজন দুজনকে।ভোর বেলায় ম্যাসেজ দিলাম, " Will you marry me? " নীলা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। ম্যাসেজ পাঠালো , " Yes ." তার পনেরো দিন পরেই আমাদের বিয়ে হয়ে যায়। 

.

.

শেষ চিঠিটা লেখার পর থেকেই অন্য রকম উত্তেজনায় ভুগছিলাম।ভেবে রেখেছিলাম, ' আজ আবার নীলাকে প্রপোজাল দেবো। একটা ছোটখাটো পার্টিও দেবো কাল। ' গত একবছর ধরে আমি আলাদা ঘরে থাকি।অহনার কান্নাকাটিতে ঘুম হয় না আমার, তাই। আমি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি নীলার জন্য।অবশেষে রাত একটার সময় সত্যি সত্যিই নীলা শাড়ি পরে সাজুগুজু করে আমার রুমে আসলো।ওকে পরীর মত লাগছিল।


ওকে কাছে যেয়ে বলতে গেলাম, – " খুব ভালোবাসি তোমাকে। " কিন্তু অনভ্যস্ততার কারণে বলতে পারলাম না। 


নীলা বললো, 

– " কি বলবে, তাড়াতাড়ি বলো। বাবু উঠে যাবে। "


আমি বললাম, 

– " নীলা, তোমাকে পেয়ে আমি ধন্য। কাল সন্ধ্যায় আমি একটা পার্টি রাখতে চাই।বিয়ের অনুষ্ঠানের মত ধুমধাম করবো। "


– " কাল তোমার পার্টিতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। "


– " কেন ?!! "


– " কাল সকালে বাবা আমাকে আর অহনাকে নেওয়ার জন্য গাড়ি পাঠাবে।আমি অলরেডি লাগেজ গুছিয়ে ফেলেছি।কাল একবারেই চলে যাবো। "


– " নীলা, আমি সরি।আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।আমিই আসলে তোমার যোগ্য নই। "


– " সেসব তো তুমি তোমার চিঠিতে লিখেছোই।তোমাকে ধন্যবাদ।গত সাড়ে চার বছরে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার ভিতরেও কোন কোয়ালিটি আছে।গত ত্রিশ দিন তুমি তোমার প্রতিটা চিঠিতে উল্লেখ করেছো, আমার কি কি গুন আছে।আমি তোমার চিঠিগুলো পড়তে পড়তে আবার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি।তোমার কাছে থেকে গেলে, কাল থেকে তুমি আবার ভুলে যাবা। কিন্তু আমি আর ভুলতে চাই না। এবার আমিও আমার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। নামকরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হতে চাই।শুধুমাত্র মেয়ে হওয়ার কারণে যে স্বপ্নগুলো দেখতে এতদিন সাহস করিনি, এখন সে স্বপ্ন দেখতে সাহস করছি। আমি চাই, আমার মেয়েও স্বপ্ন দেখুক, মানুষ হয়ে বাঁচার। "

------------------

-সমাপ্ত

-ছোটগল্প

-চিঠি

-সুমনা_তানু

-------------------


এমন আরও গল্প পড়ুন।