বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প | বাস্তব জীবনের গল্প ২০২৪

 অনেক কষ্টের গল্প

অনেক কষ্টের গল্প

রুমের মধ্যে বাতি বন্ধ করে শুয়ে আছি। একটু পরে বড় ভাইয়া আমার রুমে এসে বললো, 


- কি করিস মিরাজ? 


- কিছু করি না ভাইয়া, কিছু বলবা? 


- তোর চাকরির কি অবস্থা? যেখানে ইন্টারভিউ দিলি সেখান থেকে কিছু জানায়নি? 


- না ভাইয়া। 


- তোকে একটা কথা বলার জন্য এসেছি। 


- বলো। 


- আমার শাশুড়ী গ্রাম থেকে শহরে আসবেন কিছু দিনের জন্য বেড়াতে। সঙ্গে হয়তো আমার শশুড় ও আসতে পারে। 


- আচ্ছা। 


- তুই জানিস আমাদের এই একটা মাত্র ফ্ল্যাট। থাকার যে কি ব্যবস্থা করবো সেটা নিয়ে গতকাল রাত থেকে টেনশনে আছি। 


- হুম, টেনশন করারই কথা। 


- আমি একটা উপায় বের করতে পেরেছি। 


- কি? 


- তোর তো চাকরি হচ্ছে না। তাই বলছিলাম যে তুই যদি মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে কিছুদিন ঘুরে আসিস তাহলে দুটো রুম ফাঁকা হয়ে যাবে। 


আমি ভাইয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে হয়তো পুরোপুরি চাইছে মাকে নিয়ে আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। এর আগে ভাবির সঙ্গে এসব নিয়ে অনেক ঝগড়া করতে শুনেছি। 


আমি বললাম, 

- মা যদি রাজি হয় তাহলে আমার আপত্তি নেই। 


- সেখানে তো সমস্যা, মা তো রাজি হচ্ছে না। সে গ্রামের বাড়িতে যেতে চায় না, বলে তার শরীর নাকি খুব অসুস্থ। 


- হ্যাঁ এটা ঠিক, আমাকেও প্রতিদিন বলে তার শরীর ভালো নেই। বাবাকে নাকি প্রতি রাতে স্বপ্নে দেখেন, বারবার মৃত্যুর কথা বলে। 


- অসুস্থ হলে এরকম সবারই হয়। মৃত্যু যদি আসে সেটা তো শহর গ্রাম সবজায়গা আসবে তাই না? তাছাড়া শহরের দূষিত খাদ্য আর আবহাওয়ার চেয়ে গ্রামে গেলে শরীর ভালো হতে পারে। 


আমি কিছু বললাম না। কারণ আমি বুঝতে পারছি ভাইয়া যেভাবেই হোক মাকে বাসা থেকে গ্রামের বাড়িতে পাঠাবেই। আর সেই কাজটা সে আমাকে দিয়ে করতে চাইছে। কিন্তু মায়ের কথা মনে পড়লে আমারই খারাপ লাগে। দিন দিন মা বেশ অসুস্থ হয়ে গেছে, বিছানা থেকে এখন শুধু নামাজ পড়তে আর বাথরুমে যাবার জন্য ওঠে। 


- বললাম, তুমি চিন্তা করো না। মাকে বুঝিয়ে বলে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবার দায়িত্ব আমার। 


- ধন্যবাদ ভাই, টাকাপয়সা যা লাগে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবি সমস্যা নেই। আর সেখানে গিয়ে টাকার দরকার হলে কল দিলেই হবে। মাত্র তো কয়েকটা দিন, তারপর আবার ফিরে আসবি। 


- ঠিক আছে সমস্যা নেই। 


ভাইয়া উঠে দরজা পর্যন্ত গেল। আমি পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললাম, 


- আমার কি মনে হয় জানো? 


- ভাইয়া পিছনে ফিরে তাকিয়ে বললো, কি? 


- আমার মনে হয় মাকে আর কোনদিন তোমাকে এই বাসাতে আসতে হবে না। এটাই হয়তো শহর থেকে তার শেষ বিদায়। 


- তুই ও মায়ের মতো কথা বলিস কেন? 


- আচ্ছা যাও তুমি। 


|

|


মা বিছানায় শুয়ে আছে। আমি তার কাছে গিয়ে বিছানার পাশে বসলাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মা বললো, 


- কিরে মন খারাপ নাকি? 


- না মা, একটা কথা বলতে এসেছি। 


- কি কথা? 


- ভাইয়া তোমাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছে জানো? 


- হ্যাঁ আমাকেও বলেছিল। কিন্তু আজকাল শুধু মনে হয় যেকোনো সময় মারা যাবো। তাই মৃত্যুর সময় নিজের বড় সন্তান বৌমা নাতি নাতনী কেউ কাছে থাকবে না এটা হয় নাকি? সেজন্য আমি রাজি হইনি। 


- কিন্তু ভাইয়া তো আমাকে গিয়ে অনুরোধ করেছে তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য। 


- তুই বলিসনি কিছু? 


- হ্যাঁ বলেছি যে আমি তোমাকে নিয়ে আজই গ্রামের বাড়িতে চলে যাবো। 


- কেন বলেছিস? 


- মা তুমি বোঝার চেষ্টা করো, ভাইয়া তোমাকে কিছুতেই রাখতে চাইছে না। হয়তো ভাবির সঙ্গে এ নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে তার। তোমার জন্য তোমার সন্তানের পরিবারে ঝামেলা হচ্ছে। তারা তোমাকে তাদের সংসারে বোঝা মনে করে। 


- একটা কথা বলি মিরাজ? 


- বলো মা। 


- তোর ভাইয়া যখন বিয়ে করে তখন তো বললো বৌমা নাকি খুব ভালো মেয়ে। কিন্তু এখন সেই মেয়ে আমাকে সহ্য করতে পারে না কেন? আমার ছেলের বাসায় থাকি তাহলে সেখান থেকে আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে কেন? 


- এসব নিয়ে কষ্ট পেও না মা। তুমি যদি এখানে থাকো তাহলে এদের ঝামেলা দিন দিন বাড়বে। ভাবি তার উদ্দেশ্যে সফল হতে না পেরে আরও ঝামেলা বাড়াবে৷ তখন তুমিও কষ্ট পাবে। তারচেয়ে বরং তুমি আমার সঙ্গে চলো, আমি তো আছি মা। গ্রামের বাড়িতে বাবার কতো স্মৃতি। সেখানে গেলে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে। বাবা একা একা আমাদের গ্রামের বাড়িতে কবরে ঘুমিয়ে আছে। তার কবরটা দেখতে পাবো। 


- আমাকে কবে নিয়ে যাবি মিরাজ? 


- আজকে বিকেলেই রওনা দেবো। 


- ঠিক আছে তুই ব্যবস্থা কর। 


|

|


গ্রামের বাড়িতে এসেছি বেশ কিছুদিন হলো। কিন্তু মায়ের অসুস্থতা দিন দিন বাড়ছে। প্রথম প্রথম সপ্তাহ খানিক ভালো ছিল কিন্তু তারপর হঠাৎ করে একদিন জ্বর হলো। সেই থেকে মা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। 

আজকে সকালে আমাকে ডেকে বললেন, 


- আমি মনে হয় খুব শীঘ্রই মারা যাবো বাবা। 


- চুপ করো তো মা, সবসময় এরকম করো কেন? 


- তোর ভাইকে একটু খবর দে না। মৃত্যুর আগে সবাইকে একসঙ্গে দেখতাম, ওরা সবাই যেন গ্রামে আসে। বলে দেখ না। 


মায়ের বলার আগেই আমি গতকাল ভাইয়ার কাছে কল দিয়েছিলাম। কারণ মায়ের শরীর সত্যি খুব খারাপ। কিন্তু ভাইয়া বললেন তার অফিসে কাজ আছে অনেক। তাছাড়া সামনের সপ্তাহে নাকি তাদের বিবাহবার্ষিকী। তাই এরকম সময় ভাবি নাকি কিছুতেই রাজী হবে না। 

কিন্তু এসব কথা মায়ের কাছে বলার কোনো মানে হয় না। অসুস্থ মানুষ মন খারাপ করে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যাবে। 


- বললাম, ঠিক আছে মা আমি ভাইয়ার কাছে আজই কল দিয়ে জানাবো। 


- ঠিক আছে, আর আমার সঙ্গে একটু মোবাইলে কথা বলিয়ে দিস তো। 


আমি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। ভাইয়ার কাছে আবারও কল দিলাম। বারবার রিং বাজার পরও রিসিভ করছে না। আমি আবারও কল দিলাম, 


- রিসিভ করে বিরক্ত গলায় বললো, বারবার কল দিচ্ছিস কেন? ব্যস্ত আছি তো।। 


- ভাইয়া মায়ের অবস্থা ভালো না। 


- হাসপাতালে নিয়ে যা, টাকা লাগলে সন্ধ্যা বেলা কল করিস৷ 


- মা হাসপাতালে যাবে না। তিনি তোমাকে সবাই কে বাড়িতে আসতে বলছেন। 


- আমি গিয়ে কি করবো? আমি কি ডাক্তার? 


- তুমি বড় সন্তান ভাইয়া, তোমার প্রতি মায়ের অনেক ভালোবাসা আছে। তোমাকে দেখে একটু শান্তি পেতে চায়। 


- ঠিক আছে সময় নিয়ে আসবো, এখন রাখি। 


আমি কল কেটে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। ভাইয়া আর আসবে বলে মনে হয় না। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম যে আর কোনদিন ভাইয়াকে কল দিয়ে বিরক্ত করবো না। 


|

|


১৫ দিন পর। 

ভাইয়া কাজ করেছে, আমি তার অফিসে এসে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলাম। আমাকে দেখে তিনি বললেন, 


- গ্রাম থেকে কবে আসলি? 


- আজই এসেছি। 


- মা কোথায়? 


- গ্রামের বাড়িতে। 


- অসুস্থ মাকে রেখে চলে এলি? তোর তো দায়িত্ব বলতে কিছু নেই মনে হচ্ছে। 


- হাহাহা, তুমি আমাকে মায়ের দায়িত্বের কথা বলছো ভাইয়া? তুমি কতটুকু পালন করছো? 


- তো কি? আমি পালন করিনি? তার খাবার টাকা কাপড়ের টাকা সব আমি দেইনি? 


- এগুলো দিলেই দায়িত্ব শেষ? 


- একটু পরে আমার একটা মিটিং আছে। তোর সাথে বাসায় গিয়ে কথা বলবো। 


- আমি থাকতে আসিনি, একটু পরেই ট্রেনে করে চলে যাবো গ্রামের বাড়িতে। 


- ওহ্ আচ্ছা। 


আমি আমার পকেট থেকে দুটো সোনার চুড়ি বের করে বললাম, 


- মৃত্যুর সময় মা এগুলো তোমার জন্য দিয়ে গেছে ভাইয়া। তোমার মেয়ের জন্য মায়ের উপহার। 


ভাইয়া আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মা মারা গেছে এই কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না। 


- কি বললি? মা মারা গেছে? 


- হ্যাঁ মারা গেছে, তোমাকে শেষ যেদিন আমি কল দিলাম তার চারদিন পরে মা মারা গেছে। কিন্তু তুমি এমনই দায়িত্বশীল সন্তান, মায়ের অসুস্থতার কথা শুনেও আর খবর নিলে না। 


- আসলে এতো ব্যস্ততা যাচ্ছে যে। 


- মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের ব্যস্ততা থাকে ভাই। আমরা দুনিয়ার পিছনে ছুটতে ছুটতে মৃত্যুর দার প্রান্তে গিয়ে উপস্থিত হই। তবুও আমাদের ব্যস্ততা কমে না, কিন্তু জীবন ফুরিয়ে যায়। 


ভাইয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, 


- গ্রামের বাড়িতে পাশের গ্রামের একটা স্কুলে ছোট্ট একটা চাকরি পেয়েছি। বাড়িতেই থাকবো আর সেখানে চাকরিটা করবো। অন্তত প্রতিদিন সকালে ফজরের নামাজ পড়ে মা-বাবার কবর জিয়ারত করতে পারবো। 


ভাইয়া বসে আছে, আমি বের হবার জন্য পা বাড়ালাম। তারপর আব পিছনে ফিরে বললাম, 


- তুমি কোনদিন গ্রামের বাড়িতে যেও না ভাই। গ্রামের বাড়িতে তোমার ভাগের যতটুকু জমি আছে সেই জমির দাম অনুযায়ী টাকা আমি তোমাকে দিয়ে দেবো। তবুও কোনদিন আমার মা-বাবার বাড়িতে যাবে না। কারণ তোমাকে যদি ওই গ্রামের মধ্যে দেখি তাহলে সেদিন হয় তুমি মরবে নাহয় আমি মরবো। 


এ কথা বলে আমি বেরিয়ে গেলাম। রাস্তায় নেমে হাঁটতে লাগলাম। আমাকে এখনই গ্রামের বাড়িতে ফিরতে হবে। মা-বাবার কাছে। 

পৃথিবীতে আল্লাহ রাসূলের পরে মা-বাবার স্থান। ছোট্ট জীবনে আমরা নিজেদের সম্মানিত করতে গিয়ে মা-বাবাকে লাঞ্ছিত করি। অথচ একবারও চিন্তা করি না যে এই মা-বাবা একদিন আমাকে সম্মানিত করার জন্য নিজেদের সকল সুখ নষ্ট করেছেন। 


----- সমাপ্ত -----


গল্পঃ-সময়ের_কথা। 

কলমেঃ Sorif Islsm শরীফヅ 


এমন আরও বাস্তব জীবনের গল্প ও ঘটনা পড়ুন।