ব্যর্থ ভালোবাসার কষ্টের গল্প
৫ মাস পর সুস্থ হয়ে বিদেশ থেকে ফিরে স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলো শান।
আজকে দেশে ফিরবে সে কাউকে বলেনি। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফিরে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। কলিং বেল দিতে যাবে তখন ভাবছে কিছুক্ষন পর তাকে সুস্থ দেখে কিরকম রিয়াকশন দেবে সবাই! তখনই দেখলো তাদের বাড়ির রাস্তার মোরের পাশে একটি গাড়ি থামলো। গাড়ি থেকে নামলো পুতুল, শানের প্রিয়তমা স্ত্রী। কিন্তু নামার আগেই একজন হাত ধরে ফেললো গাড়ির ভিতর থেকেই। পুতুলের হাত ধরে চুমু খেয়ে বলল, আবার কালকে দেখা হবে। মিস করবো তোমায়।' পুতুল বিনিময়ে মুচকি হাসলো। শান যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। চোখের পাশ দিয়ে বের হল দুই ফোটা জল।
-------
সুখের সংসার ছিল শানের। বাবা মা, তার স্ত্রী পুতুলকে নিয়ে মধুবিত্ত একটি পরিবার ছিল তার। ছোট কোম্পানিতে একটি চাকুরি করত সে। তারপরও সুখের কোনো অভাব ছিলো না।
কিন্তু সব হারিয়ে গেলো এক কালো ঝড়ে। হঠাৎ অফিস থেকে আসার সময় একদিন এক্সিডেন্টে চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে বসে সে।
চেতনা ফিরে পেলে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করে শান। কিন্তু চারিদিকে তাকিয়ে সবকিছু অন্ধকার দেখতে পেলে তার পরিবার তাকে জানায় এক্সিডেন্টে মাথায় প্রচন্ড আঘাত লাগায় সে তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে।
সেদিন শানের পাশে বসে পুতুল অনেক কেদেছিল। তবুও শানকে এক মুহুর্ত ছেড়ে যায়নি।
বাবা মার পছন্দে পুতুলকে বিয়ে করেছিলো শান। বিয়ের পর হাসি কান্না আনন্দ অভিমানে ভালই চলছিলো পুতুলের সাথে তার জীবন। শান বারবার বুঝেছে বাবা মা তার জন্য সবচেয়ে ভাল কাউকেই বেছে এনেছে।
সেদিনও এক্সিডেন্টের পর সেটাই প্রমাণ হল। পুতুলের সেবা যত্নে মাথার চোট ধীরে ধীরে সারলো। কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা শানকে ঘিরে ধরল।
সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শান। এখন কিভাবে তাদের মধ্যবিত্ত পরিবার চলবে? শান কতদিন যে পুতুলকে বলেছে,
'পুতুল আমি বলি কি তুমি তোমার বাবার বাড়ি চলে যাও, ভালো থাকবে।'
'এই কথা দ্বিতীয় বার আর বলো না। আজ আমার যদি কিছু হত, তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে?'
'কি বলছো এসব?'
'যেতে না তো! তাহলে আমি কিভাবে যাই? তোমাকে এই অবস্থায় রেখে আমি একা ভালো থাকবো?'
'পুতুল তুমি তো জানো কি অবস্থা পরিবারের, টাকা পয়সা প্রায় শেষের পথে,,,'
'জানি আমি বলি কি, না হয় আমি একটা জব নেই।'
'কিন্তু...
'কোনো কিন্তু না, আমি কি আমার পরিবারের জন্য এটুকু করতে পারি না? তারপর তুমি সুস্থ হলে আমি না হয় আবার জব ছেড়ে দিলাম।'
'হাহা, আমি আবার সুস্থ!!!'
'দেখো তুমি আবার দেখতে পাবে, আমরা তো কালকেই ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। দেখি না কি বলে ডাক্তার।'
শান চুপ করে রইল।
পরের দিন হাসপাতালে ডাক্তার বলল শানের চিকিৎসা হতে হলে সিঙ্গাপুর নিয়ে যেতে হবে আর এটা খুব ব্যয়বহুল চিকিৎসা।
পুতুল আর শান দুজনের মুখই বিমর্ষ হয়ে রইল। শেষে পুতুল ডিসিশন নিল, এখন তো চিকিৎসার টাকাও নেই তাদের কাছে, তাই পুতুল চাকুরি করে টাকা জমিয়ে তারপর না হয় কয়দিন পর শানের চিকিৎসা করাবে।
শান সেদিন বুঝেছিল স্বামী স্ত্রী দুজন দুজনের পরিপূরক।
কয়দিন পর পুতুল একটা এনজিও তে চাকুরি নিল। প্রথম প্রথম বেশ ভালোই কাটছিল তাদের। অল্প বেতনের মাঝেও অনেক টাকা করে সেভ করছিল তারা শানের চিকিৎসার জন্য। পুতুক অফিস শেষে এসেই শানকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, তার খুব যত্ন করতো।
শান মাঝে মাঝে বলতো, 'আমি যদি অন্ধ হয়েও থাকি তাও আমার কোনো অভিযোগ নেই, কারণ এরকম আদর পাব, তোমার কাছে সারাটা জীবন।এই আদর ভালোবাসা দিয়েই আমি একটা জীবন কাটাতে পারব।'
বিনিময়ে পুতুলের মব মাতানো হাসির আওয়াজ শুনতো সে।
শানের মা কাথা সেলাই করে বিক্রি করতো কম দামে, এ টাকা দিয়েও কিছু সংসারের খরচ মিটতো।
কিন্তু হটাৎ কয়দিন পর পুতুল কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গেলো। রাতে ফিরতো, মাঝে মাঝে ১১ টা ১২ টাও বেজে যেত। শান কিছু বললে বলত অভারটাইম করছে সে। টাকাও জমাতে পারছিলো না আর অভার টাইম করেও। শানের বাবা মা বললে বলত ঃএত রাতে হেটে না এসে সি এন জি তে আসি, তাই একটু খরচ বেশি হয়। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই যখন ওভারটাইমের টাকা পাব তখন আর সমস্যা হবে না।'
কিন্তু পুতুলের আর সেই কিছুদিন আসলো না। শানের উপরও কেমন যেন পুতুলের যত্ন আদি কমে যাচ্ছিল। অফিস থেকে দেরি করে ফিরেই সে শানকে ক্লান্ততা দেখিয়ে শুয়ে পড়ত। কত রাত যে শান নিদ্রাহীন কাটিয়েছে তার ঠিক নেই। কিন্তু মনকে শান্তনা দিত পুতুল তো এসব তার জন্য তার পরিবারের জন্যই করছে।
শানের বাবা মা বৃদ্ধ হলেও বেশ বুঝেছিলো পুতুলের আশায় থাকলে ছেলের চিকিৎসা হবে না। একদিন তারা শানকে এসে বলল,
'বাবা আমরা কালকে তো ভিসা পাসপোর্ট করাতে যাব। সামনের মাসেই তুই যাবি চিকিৎসার জন্য।'
'কিন্তু বাবা এত টাকা তুমি কোথায় পেলে?'
'তোর নানু মারা যাওয়ার আগে তোর মায়ের নামে কিছু জমি লিখে দিয়েছিল। সেটাই আজ বিক্রি করে এসেছি।'
'কিন্তু মায়ের সম্পদ এভাবে,,,' বলার আগেই পাশ থেকে শানের মা বলল,
'আমার সম্পদ তো তুই। তোকে ছাড়া কিভাবে চলব আমরা?'
পুতুল বাসায় এলে তাকে জানালেও সে কিছু বললো না তেমন। শুধু বললো, 'বেশ ভালোই। তুমি জলদি যাও।'
'তোমাকে ছাড়া কিভাবে যাব আমি?'
'আরেহ আমি গেলে কেমন হবে? তাহলে চাকুরী করব কিভাবে আর পরিবারের খরচ মিটাব কিভাবে?'
'হ্যা ঠিকই বলেছো।'
বিদেশে আসলো শান। এয়ারপোর্ট অব্দি সে পুতুলের হাতখানা ধরে ছিলো। পুতুল সাহস জুগিয়েছিলো তাকে। বাবা মা সবার থেকে বিদায় নিয়ে সে বিদেশে এসেছিলো চিকিৎসা করাতে।
আজ পাচ মাস পর সে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরছে। ভিতরে কথা হয়েছে পুতুলের সাথে বাবা মার সাথে ফোনে কিন্তু শান বলেনি সে সুস্থ হয়ে গেছে। ভেবেছে সামনা সামনি সারপ্রাইজ দেবে৷ কিন্তু কে জানতো আজ নিজেই এত বড় কিছুর সম্মুখীন হবে।
এসব দেখে শান ভাবছে কেন সে ঠিক হল!অপারেশনের সময় সে মারা গেলো না কেনো? ভাবতে ভাবতেই পুতুল সামনে এসে দাড়িয়েছে।
'তুমি?'
একবার পুতুলের দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি সড়িয়েছে শান।
কি মনে করে পকেট থেকে ফোল্ডিং লাঠি টা বের করলো সে, আর সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে নিল।
লাঠি ঝাকাতে ঝাকাতে চারপাশে হাত আওড়াতে আওড়াতে বলল,
'পুতুল না? পুতুলের আওয়াজ মনে হল৷ পুতুল, কোথায় তুমি পুতুল??'
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
লেখিকা-আয়াশ_রহমান
(পর্ব_০১)
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_০২)
লেখক_আয়াশ_রহমান
নিজের স্ত্রীর শরীরে কেমন যেন পরপুরুষ এর ঘ্রাণ পাচ্ছে শান। এ বিষাক্ত অনুভূতির চেয়ে মৃত্যূও শ্রেয়।
কিছুসময় আগে শানকে দেখে পুতুল এগিয়ে আসলে শান তাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু তার কেন যেন মনে হচ্ছে এ সেই আগের পুতুল নয়। কেমন পাল্টে গেছে৷
'পুতুল।'
'শান তুমি কখন এলে? আর তোমার চোখে চশমা হাতে লাঠি! তার মানে কি?'
পুতুলকে ছেড়ে দিয়ে কেমন দুঃখী ভাব নিয়ে বলল, 'বলেছিলাম না পুতুল, ওরা পারলো না, পারলো না আমাকে ঠিক করতে।'
'মানে!!!'
'
আমি বোধহয় আর পারবই না দেখতে।'
শান চশমার আড়ালেই খেয়াল করলো কথাটি শুনে পুতুলের চোখে মুখে কষ্টের বদলে কেমন নিশ্চিন্ত হওয়ার আভাস। পদে পদে যেন নতুন কিছুর সম্মুখীন হচ্ছে সে। এই কি সেই পুতুল? তার পুতুল? যাকে শান জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসত?
হঠাৎ দরজা খুলে গেলো। শানের মা বাবা যেন কোথায় যাচ্ছিল। হাতে কাথার ব্যাগ দেখে বুঝলো মা বাবা হয়ত এগুলোর সাপ্লাই দিতেই যাচ্ছিল। শানকে দেখেই হাতের ব্যাগগুলো পড়ে গেল তাদের।
ছেলেকে এতদিন পর কাছে দেখতে পেয়ে কেদেই দিল তার মা। শানের বাবাও ছেলেকে দেখে খুব খুশি কিন্তু শানের চোখে চশমা দেখে অবাক হল সবাই। তার মানে সে কি সুস্থ হয়নি? এত সময় তো শানকে কিছু বলতে না দিয়েই তাকে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরে কাদছিলো তার মা।
'বাবা তোর চোখে চশমা, হাতে লাঠি?'
শান মাথা নিচু করে বলল, 'মা-বাবা, আমাকে সুস্থ করতে পারেনি তারা, বলেছে তিনমাস পরে আবার আসতে, তখন আরেকটা অপারেশনের পর আশানুরূপ ফলাফল আসতে পারে। ওখানে থাকার আর টাকা ছিল না তাই আমি চলে এসেছি।'
শানের মা ছেলেকে জড়িয়ে আরো জোড়ে কাদছে। শান তার মাকে জড়িয়ে স্বান্তনা দিচ্ছে। সে চাইলেও পারছে না তার মার চোখের জল মুছে বলতে যে মা আমি ভাল হয়ে গেছি। এই দেখো, তোমাকে বাবাকে দেখতে পাই। কিন্তু শান অপারগ তার যে অনেক কিছু জানার আছে। যে পুতুল কোনো পরপুরুষ এর দিকে তাকাতো না পর্যন্ত আজ সে পুতুলের হাত স্পর্শ করে এক বাইরের পুরুষ ওষ্ঠের ছোয়া দিয়ে গেছে, তারই সামনে।
এর কারণ শানকে বের করতেই হবে।
সেই চিরচেনা পুতুলকে আজ যেন কেমন অচেনা লাগছে শানের কাছে। ঘরে এসেছে প্রায় এক ঘন্টা মত আগে, শানকে বিছানায় বসিয়ে পুতুল নিজে ফ্রেশ হতে গেছে এখনো বেরোয়নি। কিন্তু একসময় শান অফিস শেষে বাসায় আসলে তার কাছেই ঘুরঘুর করতো পুতুল। আর আজ এতদিন পর এসেও পুতুলের এমন অনিহা। চোখের কোটর থেকে এক বিন্দু অবহেলা বেরিয়ে আসলো যেন। ওইভাবেই মুছে নিল শান। কিন্তু সে মনে মনে ভাবছে,
'আমাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে, নাহলে সব আমি কোনোভাবেই জানতে পারবো না। খুব ভালোভাবে আমার এই মিছে অন্ধত্বকে কাজে লাগিয়ে সত্য সামনে আনতে হবে। কেন আমার পুতুল এমন করছে? কেনো?'
এসব মনের মাঝেই বলতে বলতে পুতুল বের হয়ে
আসলো। তাকে এক পলক দেখে শান মাথা নিচু করলো। আগের অনুভুতি চেয়েও সে বাইরে আনতে পারছে না। পারছে না এই পুতুলকে ভালবেসে বুকে টেনে নিতে।
'চলো তোমাকে ওয়াশরুমে দিয়ে আসি। ফ্রেশ হও, তারপর একসাথে খাই।'
'না আমি যেতে পারব।'
'মানে?'
'আসলে একয়দিন তো একাই ছিলাম, সব কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আরো সেটা তো অচেনা জায়গা ছিল আর এটা আমার চিরচেনা ঘর। আমি নিজেই পারব।'
'অহ আচ্ছা।' বলে পুতুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছে। অন্য সময় হলে হয়ত শান পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতো তাকে। কিন্তু সেদিকে একবার দৃষ্টি দিয়েই লাঠি হাতাতে হাতাতে ওয়াশরুম যেতে ধরল শান।
খেতে বসেছে সবাই৷ শানের বাবা প্রশ্ন করলো,
'বাবা সব জমি জমা বিক্রি করেই তো তোকে বিদেশে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আবার কিভাবে যাবি?'
'কেন বউমা তো চাকুরি করে টাকা জমাচ্ছিল? সেই টাকা তো আমরা আগের বার নেইনি, আরো তিনমাস আছে সময়, একয়দিনে আরো জমবে, সবমিলে এবারের খরচ তো হয়ে যাওয়ারই কথা তাইনা মা?'
শানের মার কথা শুনে পুতুলের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। পরে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
'আ আসলে মা, আমার তো এখনো অভারটাইমের টাকা পাইনি, কি করবো বল, বেসরকারি এনজিও তো, এই কয়দিনে পেলেই তো কিছু একটা দেয়া যাবে।'
'সে কি বউমা! অভারটাইম ছাড়াও তো তোমার বেতনের যথেষ্ট টাকা থাকার কথা, কারন আমার কাথা সেলাই করে যেটাকা হয় সেটা দিয়েই তো আমি পরিবার চালাই, তুমি আর কয় টাকাই দাও?'
'মা আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি সংসারে টাকা দেই না?'
''দেখো বউমা,,,,'
'আচ্ছা মা থামো তোমরা, পুতুলের সমস্যা থাকতেই পারে চাকুরীতে। বেসরকারি জব তো। আমি তো আগেই বলেছিলাম আমার আর সুস্থ হওয়ার আশা নেই, মাঝখান থেকে তোমার মায়ের জমিটুকু বিক্রি করা লাগলো এমনি এমনি।'
'কি বলছিস এসব বাবা?'
'মা বাদ দাও, খাইয়ে দাও না, কতদিন তোমার হাতে খাইনি আমি।'
শানের কথায় তার মার চোখে পানি চলে আসলো৷ সে তরি হরি করে উঠে শানের পাশে গেলো শানকে খাইয়ে দিতে।
'আজ শুধু মা কেনো? আমার ছেলেকে আমিও খাইয়ে দিব।' বলে শানের বাবাও নিজের প্লেট নিয়ে শানের পাশে গেল।
খুব যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে শানকে তার বাবা মা। শান মাঝে মাঝে আড়চোখে খুব সতর্ক ভাবে পুতুলের কার্যকলাপ লক্ষ করছে। মন দিয়ে খেয়ে যাচ্ছে পুতুল, আশেপাশের কোনো চিন্তা নেই মনে হয় তার। আগের দিন হলে হয়ত পুতুল শানের বাবা মার কাছে নালিশ দিত যে আপনাদের ছেলেকেই খাওয়াবেন! মেয়ে কি দোষ করলো?
কিন্তু আগের পুতুল আর এখন সামনে বসে থাকা মানুষ কি আদৌ এক আছে? ভেবেই শান তাচ্ছিল্য হাসলো।
পুতুল নিজের খাওয়া শেষ করে রুমে চলে গেল কাউকে কিছু না বলে। 'দেখেছিস বাবা,বৌমার আচরণ? আগে তো বৌমা আমার সাথে ছাড়া খেতই না, আর আমার মুখে মুখে কথা বলছে এখন! তুই ছিলি না, তোর বাবার ঔষধ শেষ হয়ে গেছিলো, পুতুলকে বলায় সে যে কিরকম ব্যবহার করেছে আমাদের সাথে কি বলব তোকে। যে তারপর থেকে আমি বেশি করে কাথা সেলাই করি যেন এই বুড়ো বুড়ির কারো কাছে আর হাত পাতা না লাগে কিন্তু বাবা বৌমা,,,,'
শান আগেই মাকে চিন্তিত করতে চায় না। সে মাকে বুঝ দিল, 'মা চিন্তা করো না, হয়ত অফিসে কাজের চাপ বেশি তাই এমন করছে। দেখো ঠিক হয়ে যাবে দুইদিন পরে।'
লাঠি মেঝেতে ঠেকাতে ঠেকাতে নিজের ঘরে গেলো শান। পুতুল বিছানায় বসে মোবাইল টিপছিল। শানকে দেখা মাত্র মোবাইল রাখতে গেল কিন্তু কি মনে করে যেন মুচকি হেসে আবার মোবাইল চালানো শুরু করলো।
শান সেটা দেখে মুচকি হাসলো,' হয়ত ভাবছে এ তো অন্ধ দেখবে কিভাবে?'
শান বেডে গিয়ে বসল, পুতুলের হাতের মোবাইলের দিকে তাকানোর চেষ্টা করেও তেমন কিছু দেখতে পারলো না। বেশি দেখিতে গেলে পুতুলের কাছে ধরাও খেয়ে যেতে পারে। তাই পুতুলকে হঠাৎ প্রশ্ন করল,
'পুতুল?'
- - -
'পুতুল??'
'কি হয়েছে?' বিরক্তির সাথে বলল পুতুল।
'চলো আজ দুজন বেলকনিতে বসে গল্প করি।'
'দেখ আমি ভীষন ক্লান্ত। কালকে আবার সারাদিন অফিস আছে। আমি ঘুমাব।'
'অহ আচ্ছা। ঘুমাও লাইটটা নিভিয়ে দাও।' বলে শান পাশ ফিয়ে বিছানায় মাথা দিয়ে ভাবতে লাগলো আগের দিনের কথা।
------
'এই বউ কি হয়েছে? কথা বল না কেনো?'
- - - -
'রাগ করেই থাকবা?'
'নাহ আমি আবার রাগ করার কে?'
'কি হয়েছে বলো!'
'তুমি এখনো বুঝতে পারছোনা কি হয়েছে?'
'বুঝলে কি বলতাম?'
'থাক আর বুঝা লাগতো না আপনার।'
'আবার রাগ করলে?'
'আমার কথার কি কোন দাম আছে তোমার কাছে?'
'তোমার দাম না থাকলে কার দাম থাকবে বলো তো?'
'আমি যে বললাম চল আজ দুজনে একটু আকাশ দেখি, তুমি কি বললে? কাজ আছে তোমার কালকে রেস্ট নিতে হবে, তো এখন আবার আমাকে বলছো কেনো?'
'হাহাহা তো এই ব্যাপার!!' বলেই পুতুলকে কোলে তুলে বেলকনির দিকে এগুলো শান। পুতুলও রাগ অভিমান ভুলে শানের কাধ জড়িয়ে গালে একটা অধরের স্পর্শ দিয়ে দিল শানকে।
-------
আগের স্মৃতিগুলোর কথা ভেবে মুহুর্তেই চোখ ভিজে গেলো শানের। পাশে ফিরে দেখলো পুতুল লাইট বব্ধ করে এখনো চ্যাট করেই যাচ্ছে।
'পুতুল ঘুমিয়েছো?' পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল শান কথাটি।
পুতুল শানের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে একটু পর বলল,' আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছি কখন থেকে একটু চুপ করে ঘুমাতে দাও প্লিজ। কাল অনেক কাজ আছে।'
'আচ্ছা ঘুমাও।' বলে শান মুচকি হাসল আর পুতুল মোবাইলে চ্যাট করেই যাচ্ছে।
'আজকাল এত বড় মিথ্যা বলতেও একবার বাধে না পুতুল!!' মনে মনে বলল শান, দৃষ্টি এখনো পুতুলের দিকেই।
নিকনেমে কয়েকটা ফুলের স্টিকার দেয়া জন্য আইডির মালিকের নাম পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে না। শান কিছু একটা ভেবে শুয়ে পড়লো।
পুতুলকে হাত পা বেধে ফেলে রাখা হয়েছে একটা কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে। পুতুল হাত মুখ বাধা অবস্থায়ই শান শান বলে চিৎকার করছে আর বলছে,
'আমাকে বাচাও আমাকে নিয়ে যাও তুমি শান, শান।।।।।'
ধড়ফড়িয়ে উঠল শান, কি বাজে স্বপ্ন দেখলো সে!! পাশে তাকালো, পুতুল এখনো ঘুম। ভোরের আকাশে হালকা আলোর আভা দেখা দিয়েছে মাত্র৷
খুব সন্তর্পণে পুতুলের পাশে গিয়ে মোবাইল হাতে নিল শান। পাসওয়ার্ড দেয়া। শান নিজেই বসিয়েছিলো পুতুলের মোবাইলের পাসওয়ার্ড। নিজের নাম লিখলো সে, হলোনা, অবাক হল শান। পুতুল আর তার নাম একসাথে লিখলো তাও হচ্ছিল না। পুনরায় আবার তাদের বিয়ের ডেট লিখলো, এবারও ফলাফল শূন্য। প্রচন্ড রাগ হল শানের।তখনই পুতুল আড়মোড়া ছাড়ল। শান তড়িঘড়ি করে মোবাইল পুতুলের পাশে রেখে ক্রোধিত মনে বাথ্রুমে ফ্রেশ হতে গেলো।
সকালে ড্রয়িংরুমে বসে আছে শান, পুতুল আফিসে যাবে তাই শাড়ি আর বোরকা আয়রণ করছে ড্রয়িংরুমের টেবিলে আর পাশের সোফায় তার বাবা বসে কাথার কাপড় দেখছে। রান্না ঘরে মা রান্না করছিলো৷ শানের বাবার সাথে কথা বলতে এসেছে সে কাথার কাপড়ের বিষয়ে। হঠাৎ শানের রান্না ঘরের দিকে নজর গেলে দেখতে পেলো দুধ উপরে পড়ছে চুলা থেকে।
সে আনমনে বলে ফেললো, 'মা রান্নাঘরে যাও তোমার দুধ তো পুড়ে গেলো।'
সবাই শানের দিকে অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো। পুতুলের চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে। শানের মা বাবারও একি অবস্থা।।
শান ভালোই বুঝতে পারছে সে কি ভুল করে ফেললো অজান্তে।
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_০৩)
লেখক-আয়াশ_রহমান
'কি বললি?'
'ক কই কি বললাম মা?'
'দুধ পুড়ে যাচ্ছে তুই দেখলি কিভাবে?'
শান মুচকি হেসে উত্তর দিল। মা যাদের দৃষ্টিশক্তি নেই তাদের কিন্তু অন্য পাচটি ইন্দ্রিয়ের উপরই নির্ভরশীল হতে হয়। দুধ পোড়ার সেন্টেই তো বুঝা যাচ্ছে।'
শানের কথায় সবাই স্বাভাবিক হল। পুতুল মনে হল অনেক বড় ভীতি তে রক্ষা পেলো।
পুতুল অফিসে গেলেই পিছনে শান লাঠি হাতে চশমা পড়ে রওয়ানা দিল।
পেছন থেকে বাবা ডাক দিল,'কই যাচ্ছিস বাবা?'
'এইতো সামনেই একটু বাইরে গিয়ে কোথাও বসি।বাসায় ভালো লাগছে না।'
'ওহ। আমিও সাথে আসব?'
' না বাবা একাই পারব, বেশিদূর যাব না।'
তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ল শান। পুতুল অনেক দূরে চলে গিয়েছে হাটতে হাটতে। সামনে মোড় পাবে বলে। শান আরেকটু দূরে তাকিয়ে দেখলো একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, পুতুল গাড়ির সামনে গেলেই তার দরজা খুলে গেল। শান সেটা দেখে দৌড় দিল, লাঠি হাতে নিয়েই। কিন্তু কারো সাথে জোড়ে ধাক্কা খেলো। দুজনেই রাস্তায় পড়ে গেলো।
'এই চোখে দেখেন না নাকি?'
শান তাকিয়ে দেখলো বোরকা পড়া একটা মেয়ে, হাতে বাজারের ব্যাগ ছিল। কিন্তু সাথে থাকা ডিমগুলো রাস্তায় পড়ে থেতলে গিয়েছে।
'চোখে দেখতে পান না নাকি? আমার সব বাজার! আমার ডিমগুলো!! মামী আজ আমাকে কি করবে?' বলতে বলতে উঠে শানকে দেখে চমকে গেলো মেয়েটি।
'আপনি তো সত্যি মনে হয় দেখতে পান না, হাতে লাঠি, চোখে চশমা।'
শান মেয়েটিকে দেখছে, বয়স হয়ত খুব বেশি না ১৮ বা ১৯ হবে, টানা টানা চোখ দুইটা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মুখে মুখে কথা বলে।
'তাহলে দৌড়েছেন কেনো?' তারপর পিছনে কুকুর দেখে আবার একাই বলল,'কুকুর দেখে ভয় পেয়েছেন?'
শান শুনছে শুধু। পুতুলের গাড়ি চলে গেছে। কিন্তু শান দৌড়ের সময়ই নম্বরটা নিয়ে নিয়েছে।
'আমি পাশের বাসায় আজ দুইমাস মামা মামীর সাথে ভাড়া এসেছি, আপনাকে তো দেখিনি এই এলাকায়! কে আপনি?'
মেয়েটির ডাকে দৃষ্টি ফিরল শানের।
'আপনি কি বোবাও নাকি?'
শান অবাক হয়ে গেল। কি বলে মেয়েটা, ঠিক তখনই শানদের পাশের বাসার দুইতলা থেকে ডাক এলো।
'মিথু এই মিথু জলদি আয়, ওখানে দাড়িয়ে কি করিস?'
'হ্যা হ্যা মামী, আসছি। হায়রে আমার ডিম, এখন মামী আজ আবার আমাকে মারবে।' কেদেই ফেললো বলতে বলতে বেচারি।
'আজ আপনার জন্য আমার ভাগ্যে যে কি আছে আল্লাহই জানে।' বলে হন হন করে চলে গেলো মেয়েটি।
পুতুলের চিন্তায় আবার রাস্তা ধরে সামনের দিকেই এগোচ্ছে শান। এখন পরবর্তী পদক্ষেপ কি সেটাই ভাবার পালা। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ একজন বলল,'একি তুমি!!'
শান দেখলো তার পুরাতন অফিসের এক কলিগ রিয়াদ দাঁড়িয়ে আছে। তাই নিজেকে প্রস্তুত করলো সে,
'কে কে ভাই?'
'শান তোমার চোখ ঠিক হয়নি?'
'রিয়াদ ভাই নাকি? গলার আওয়াজে তো সেরকমই লাগে।'
'হ্যা আমি রিয়াদ। কিন্তু তোমার,,,,,'
পাশের একটা চায়ের দোকানে বসল তারা।
শানের কাছে সব শোনার পর রিয়াদ বলল,'তাহলে তো খুব বিপদে আছো তোমরা।'
সবই ভাগ্য ভাই।'
'আচ্ছা জব করবে?'
'আমার মত অন্ধকে চাকুরী কে দেবে ভাই?'
'আমার এক চাচা একটা প্রাইভেট মিডিয়া ফার্মে বড় পোস্টে আছে। সেখানে তুমি চাইলে রেডিও স্টেশনে কাজ করতে পার।'
'মানে?'
'অর্থাৎ তোমার দৃষ্টি লাগবে না, কথা দিয়েই কাজ চলে যাবে। আর এমনিতেও তোমার গলা তো খুব সুন্দর। মনে নেই অফিসে সবাই আমরা তোমার গলার গান শুনতে চাইতাম?'
'তাহলে তো খুবই উপকার হয় ভাই।' (শান ভাবলো 'ভালই হবে এই জব করলে, নিজের লুকানো কথা আরো বিশ্বাসপ্রবণ হবে আর আমিও বাবা মার জন্য কিছু করতে পারব।')
'চল আজকেই পরিচয় করিয়ে দিয়ে আসি তোমাকে।'
'আচ্ছা ভাই।'
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরল শান। পুতুল তখনো আসেনি। তার মা বাবা তাকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিল চাকুরী পেয়েছে সে রেডিও স্টেশনে। আর ডিউটি রাতে৷ ২ টায় শেষ অফিস৷
শানের বাবা মা চিন্তায় পড়ল। চোখে দেখতে পায় না তার উপর এই রাত বিরাতে কিভাবে যাবে ছেলেটি।
তবে শান তাদের আশ্বাস দিল সে পারবে৷ রিক্সায় যাবে আবার আসবে।
তখনই পুতুল আসল। কালকে ওই ব্যবহারের পর শানের মা পুতুলের সাথে কথা বলে না। তাই পুতুল বলল,' আমি ঘরে গেলাম, আজ খাব না, ভাল লাগছে না শরীর।'
শানের মা সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করলো না। শান বলল,'আমিও যাব।'
রুমে এসে বোরকা খোলার পর শান খেয়াল করলো পুতুল সকালে যে শাড়ি পড়ে গেছিলো সেটা আর এইটা এক না। চোখ কুচকে গেল তার। তাও কিছু বলল না। ফ্রেশ হয়ে আসল পুতুল।
বেলকনিতে ভেজা শাড়িটা নাড়তে দিতে গেল। শানও বেলকনিতে উলটো দিকে দাঁড়িয়ে আছে।
শান তার দিকে ফিরে হঠাৎ সদ্য নাড়তে দেয়া শাড়িটায় দাত দিল। তারপর পুতুলকে বলল,'এই শাড়ি কোথায় পেলে?সকালে তো এই শাড়ি পড়েছিলে না?'
পুতুলের মুখে ভয়ের আভা দেখা গেলো। চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। থতমত খেয়ে বলল,'তুমি কিভাবে জানলে?'
'সকালে ইস্ত্রি করার সময় আমি শাড়িটা ধরেছিলাম, সুতি কাপড়ের ছিল। এটা তো শিফনের শাড়ি মনে হচ্ছে যেরকম আমি তোমাকে গিফট করেছিলাম, তোমার খুব পছন্দের ছিল।
পুতুল হঠাৎ কি মনে করে বলল,'আরেহ এটা তো তোমার দেয়া শাড়িই। আলাদা করে ব্যাগে নিয়েছিলাম।'
কি জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা বলে দিল পুতুল। শান পুরো অবাক। তার অন্ধত্ব এর সুযোগ নিয়ে কি কি বলছে সে।
'কিন্তু এটা তুমি কেনো নিয়ছিলে?'
'আজকে অফিস ছুটি নিয়েছি আগেই। বান্ধবীর ছোট মেয়ের জন্মদিন ছিল। দাওয়াতে আমরা কয়জন বান্ধবীই ছিলাম। আসলে আমাদের আজকে থাকার প্ল্যানিং ছিল তার বাসায়। তার স্বামী বিদেশে তো, একা থাকে তাই। বুঝোই তো বাচ্চার জন্মদিন। কেক গায়ে মেখে একাকার করে দিয়েছে পিচ্চি মেয়েটা। তাই আমাকে শাড়িটা চেঞ্জ করতে হল। থাকতেই চেয়েছিলাম ওখানে কিন্তু তোমার কথা ভেবে চলে আসলাম।'
বাহ কি সুন্দর বানোয়াট কথা বলে দিল পুতুল। শুনেই হাসি আসলো শানের। তবুও কিছু বলল না এখন।
'আমিও বাইরে যাব। তুমি যেহেতু ঘাবে না ঘুমাও।'
'কোথায় যাবে এই রাতে?'
'সেটা নয় মায়ের কাছেই শুনে নিয়, যদি সময় হয়।' বলে শান চলে গেলো।
রেডিও স্টেশনে আরজের কাজ দেয়া হল শানকে। শান টেনশনে ছিল পারবে নাকি। কিন্তু রিয়াদ ভাইয়ের চাচা তাকে সাহস জুগালো। এখন মোটামুটি ইজি হয়ে গেল কাজটা। প্রথম দিনেই শানের ভয়েস সবার হৃদয় কেড়ে নিল।
রাত ২.৩০, মাত্র বাসায় পৌছেছে শান। তার মা তার জন্য অপেক্ষা করছিলই। ছেলে চোখে দেখেনা, এত রাতে যদি কিছু হয়। কিন্তু তারা তো আর জানে না কিছু। তবে আসার সময় একটা অদ্ভুত দৃশ্য খেয়াল করেছে শান। তাদের পাশের বাসার বেলকনি থেকে কারো ফুফানোর আওয়াজ আসছিল। ভাল করে খেয়াল করে দেখলো সকালের সেই মেয়েটা। বেলকনিতে দাড়িয়ে কেদে যাচ্ছে। শান কয়েক মুহুর্ত অবাক হয়ে তাকালেও বেশি কিছু ভাবেনি।
মাত্র রুমে ঢুকল সে। ঘুমাচ্ছে পুতুল, সেই মায়াবী মুখ যা দেখার জন্য অফিস থেকে প্রায় ছুটেই বাড়িতে ফিরত শান। মায়াবী গড়নের মুখটা দেখেই যেন সারাদিনের ক্লান্তি দূর করত সে। শরীরের পোশাক ঠিক নেই, ঘুমানোর সময় অবশ্য পুতুলের এটা আগেও হত। মুচকি হাসলো শান।
হঠাৎ ঘাড়ের দিকে নজর পরল শানের। মুহুর্তে চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। পুতুলের ঘাড়ের পাশে আরেকটু কাধের দিকে একটা তিল। যেটা শানকে বার বারই আকৃষ্ট করত। কত শত চুমু যে সেখানে দিয়েছে শান তার ঠিক নেই। আর আজ সে জায়গায়ই একটা দাগ। যেটাকে লাভ বাইট বলে। খুব তাজা দাগটা, মনে হয় আজকেই দেয়া হয়েছে।
চোখ লাল হয়ে উঠছে ক্রমশ শানের। মনে ইচ্ছা হচ্ছে এখনই এক ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিক। সব কিছুর কৈফিয়ত চাইবে, কিন্তু আবার মন বলছে তাহলে তো যেকোনো কারণ দেখিয়ে পুতুল বাচতে পারে, নিজের চোখে সব সত্য দেখতে চায় শান। খুব কষ্টে মনকে মানিয়ে নিল সে।
পরের দিন সকাল হতেই শান পুতুলের পিছু নিল। এবার আর কোনো ভুল নয়। শান গাড়িটার নম্বর থেকে কালকেই গাড়ির মালিকের ডিটেইলস জেনেছে। আশ্চর্য হলেও এটা পুতুলের অফিসের কারো নয়। সাব্বির নামের একটা ছেলের। সে নাকি কয়েকটা গ্যারেজের মালিক।
পুতুলকে আজকেও সেই গাড়ি তুলে নিল। আজ শান পেছনে একটা সি এন জি নিয়েছে। কিন্তু গাড়ি তো পুতুলের অফিসের দিকে যাচ্ছে না। অবাক হলেও পেছনে যেতে লাগলো শান। গাড়িটা দ্রুত চলছে৷ শান সি এন জি চালককে আরো দ্রুত চালাতে বলছে। কিন্তু হঠাৎ গাড়িটা ভিড়ের আড়ালে মিশে গেলো। একটা সি এন জি তো আর প্রাইভেট কারের গতির সাথে পারবে না! বিরক্ত হল আজকেও সে। অগত্যা সি এন জি কে পুতুলের অফিসের ঠিকানা দিল। অফিসের সামনে নেমে আবার অন্ধের অভিনয় শুরু হল তার।
অফিসের সামনেই রিসেপশন। সেখানে গিয়ে পুতুলের কথা জিজ্ঞেস করলে রিসেপশনিস্ট এমন ভাব করলো যেন চিনতেই পারলো না। পাশ দিয়ে আরেকটা মেয়ে যাচ্ছিল। রিসেপশনিস্ট তাকে জিজ্ঞেস করলো,
'ম্যাম ইনি পুতুল নামের কারো কথা জিজ্ঞেস করছে।'
'কিহ, পুতুল!!'
শান মেয়েটিকে দেখে বুঝলো মেয়েটি এই অফিসেই কাজ করে।
'মেয়েটি আবার বলল,'আপনি কে, আপনাকে তো চিনতে,,,'
'আমি পুতুলের এক আত্মীয়। চোখের ডাক্তার দেখাতে এসেছি ঢাকা। উনি কোথায় বলা যাবে?'
'কিন্তু পুতুল তো এ অফিসে থাকে না।'
'মানে?'
'মানে পুতুল তো ছয় সাত মাস হবে এই চাকুরী ছেড়ে দিয়েছে!!!'
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_০৪)
লেখক_আয়াশ
'কি বলছেন এসব? পুতুল চাকুরি ছেড়ে দিয়েছে?'
'হ্যা সেটা তো অনেক আগে।'
শান যেন আকাশ থেকে পড়ল। 'পুতুল এতদিন চাকুরির নাম করে বাড়ির বাইরে যাওয়া আসা করে। সেইজন্যই কি টাকার কথায় ওইরকম বিহেভ করে মায়ের সাথে!!!'
তখনই পাশ দিয়ে আরেকজন মেয়ে যাচ্ছিল। শান যার কাছে এসব শুনছিল তাকে জিজ্ঞেস করলো ওই মেয়েটি, 'কিরে লাবনী ইনি কে? তোর রিলেটিভ? আগে তো দেখিনি!!'
'আরেহ না, আমার রিলেটিভ হবে কেন? ইনি তো পুতুলকে খুজতে এসেছেন।'
'কিহ! পুতুল? এতদিন পর হঠাৎ?'
'ইনি নাকি জানতেন না যে এখন আর পুতুল এখানে জব করে না।'
মেয়েটি তাচ্ছিল্য হেসে বলল,'জব করবেই বা কেন? বড় মাছ আটকেছে না জালে!! এখন আর এসব ছোট খাট চাকুরি কি পুতুলের করা লাগে?'
মেয়েটির কথায় শান অবাক হয়ে চেয়ে রইল। বলল, 'কি বলছেন আপু? বুঝতে পারলাম না।'
মেয়েটি হেসে আবার বলল,'বুঝবেন কিভাবে। যদিও আপনার রিলেটিভ তারপরও বলছি, আমরা তো শুধু দেখতাম। আমাদের ম্যানেজার সাহেবের বন্ধু সাব্বিরের সাথে তার উঠা বসা বেশি হত পুতুলের। তার কিছুদিন পরই তো পুতুল জবটা ছেড়ে দিলো।'
'সাব্বির!!!'
বেলকনিতে বসে গোধূলির রক্তিম আকাশের পানে চেয়ে আছে শান। ভাবছে কিছুসময় আগে পুতুলের অফিস থেকে শুনে আসা কথা গুলো।
পুতুলের এনজিও তে একটা প্রোগ্রামে তার ম্যানেজারের বন্ধু সাব্বিরের সাথে পরিচয় হয় পুতুলের। সেখানেই সাব্বিরের নজর পুতুলের দিকে পড়ে যায়। তারপর নাকি অফিস শেষে প্রায়ই গাড়ি নিয়ে আসত সাব্বির, পুতুলের সাথে দেখা করতে। প্রথম প্রথম পুতুল সায় না দিলেও পরে নাকি তাদের প্রায়ই কথা বলতে দেখতো লাবনীরা অর্থাৎ পুতুলের কলিগরা।
এনজিওর ম্যানেজারের ব্যাপারটি দৃষ্টিকটু লাগলে একদিন নাকি তিনি সাব্বিরকে এই নিয়ে বলেন। তার কিছুদিন পরই পুতুল জব ছেড়ে দেয়।
শান শুনেছে সাব্বির একটা খারাপ ছেলে অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। এবার হয়ত পালা পুতুলের। কিন্তু পুতুল! এভাবে তার ভালোবাসাকে তুচ্ছ করলো!!
হায়রে ভালোবাসা! আজকালকার ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়! যাকে আপনি যতটা ভালোবাসার অধিকার দিবেন, সে ঠিক ততটা কষ্টই আপনাকে ফেরত দেয়ার ক্ষমতা পাবে। মনের গহীনে যতটা স্থান একজনের জন্য বরাদ্দ করা যায়, তার অনুপস্থিতি অবহেলা সেই স্থানটাই কষ্টে পরিপূর্ণ করতে পারে।
'তোমাকে এতটা বিশ্বাস এতটা ভালবাসার প্রতিদান এভাবে দিলে পুতুল!!'
এসব ভাবতে ভাবতে আঁখিদুটি অশ্রুসিক্ত হল শানের। কিন্তু মায়ের ডাকে তৎক্ষনাৎ সেটা আড়াল করে মুছে ফেললো সে।
'কিরে খেয়ে নে, আবার তো তোকে কাজে যেতে হবে।'
'মা আজ খেতে ইচ্ছা হচ্ছে না।'
'বাবা এরকম করলে তো শরীর খারাপ হবে।'
'অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে আমায়। অফিসেই খেয়ে নিব মা। তোমরা খেয়ে নিও।'
শানের মা মন খারাপ করে চলে গেলো। হাজার হোক মা তো৷ ছেলের মনবোঝে। সেও হয়ত বুঝেছে এই বদলে যাওয়া পুতুলের সাথে তার ছেলেটা ভালো নেই।
সন্ধ্যা হলেই শান বেরিয়ে পড়ল। রিয়াদ ভাই যে বিশ্বাসের সাথে তার চাচার কাছে তার কথা বলে জব দিয়েছে সেই বিশ্বাসের সম্মানটুকু তো দিতে হবে! কাজ সে মন দিয়ে করবে। এটা ভেবেই বের হল ঘর থেকে।
বাড়ির সদর দরজা পেরোনোর পরই একটা মেয়ের কন্ঠ আসলো তার কানে।
'আপনারা আমাকে ডিসটার্ব করছেন কেন? যান এখান থেকে।'
'এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছো, চলোনা আমাদের সাথে বসে আড্ডা দাও, আমাদেরও একটি মনোতৃপ্তি হোক।'
শান দেখলো কালকের সেই মেয়েটাকে কয়েকটা পাড়ার লাফাঙ্গা টাইপ ছেলেরা জ্বালাচ্ছে। সেই মেয়েটা ভয় পেয়েছে মনে হচ্ছে। এর মধ্যেই একটা ছেলে হঠাৎ মেয়েটার হাত ধরে ফেলল,
'হা...হাত ছাড়ুন বলছি! বেয়াদবি করলে লোক ডাকবো আমি।'
'আহা আমরা তো তোমার বন্ধুর মতই। চলো না আমাদের সাথে।'
'এই কি হচ্ছে এখানে?' শান জোড়ে বলে উঠল। ছেলেগুলো হঠাৎ হাত ছেড়ে দিয়ে তার দিকে তাকালো, সাথে মিথুও তাকালো।
'এলাকায় অসভ্যতা করিস মেয়েদের সাথে! দাড়া তোদের আমি....' বলে শান লাঠি উচু করে মারার জন্য আসলো।
ছেলেগুলোর বয়স খুব বেশি না, কলেজ পড়ুয়া। শানের হাতে লাঠি আর মারতে আসা দেখে তারা এক দৌড় দিল।
মিথু শানের দিকে দৌড়ে আসল।
'আপনি! আপনি কথা বলতে পারেন?'
'চুপ করো মেয়ে, তুমি এখানে কি করছো? সন্ধ্যায় বাড়ির বাইরে কেনো?'
'আ, আসলে,,'
'আসলে কি?'
'আচ্ছা আপনি লাঠি হাতে উচু করে আসলেন! কিছু না দেখে ওদের সাথে মারামারি করে পারতেন?'
শান মুচকি হেসে বলল, 'শরীরের শক্তির চেয়ে বুদ্ধির জোড় বেশি। ওরা কি বুঝেছে এটা অন্ধের লাঠি? ওরা তো ঠিকই মনে করেছে আমি লাঠি নিয়ে মারতে আসছি।'
'হুম, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আপনি না থাকলে আজ,,, '
'আমি কিন্তু আমার কথার জবাব পাইনি। তুমি বাড়ির বাইরে কি করছো?'
মেয়েটি মাথা নিচু করে ফেলল। চোখে ইতিমধ্যে জলের আভা প্রকট হয়েছে।
'অনাথ এতিমদের জীবনটাই কষ্টের।'
'মানে?'
'থাক অন্যদিন বলব।'
'তাহলে তো আমারও আজ না অন্যদিন তোমাকে সাহায্য করা উচিত ছিল।'
'আসলে,,'
'তুমি কি বলবে না কি?'
'মামী আর মামাতো বোন আমাকে রেগে বাড়ির বাইরে করে দিয়েছে। আজ নতুন না মাঝে মাঝেই দেয়। রাগ হলে অথবা আমার কাজে একটু ভুল হলেই বের করে দেয়। আজ যেমন খাবারে লবন একটু বেশি হয়ে গেছিলো। তার তরকারির প্লেট ফেলে দিয়ে আমাকে থাপ্পড় মেরে বের করে দিয়েছে।' বলতে বলতে কেদে দিল মেয়েটি।
শান এখন খেয়াল করল মেয়েটির গালে হাতের ছাপ বসে গেছে।
'কিন্তু তুমি এখন বাইরে দাঁড়িয়ে কি করছো?'
'মামা অফিস থেকে আসলে তার সাথে ঢুকবো। তাই অপেক্ষা করছিলাম। এর মাঝেই ওই ছেলেগুলো,,,,'
শানের মেয়েটির জন্য কষ্টই লাগলো। এখন একা দাড়ালে আবার কেউ এসে ডিসটার্ব করতে পারে। তাই সে মেয়েটির সাথেই দাঁড়িয়ে রইল।
দুজনই চুপচাপ। এক দুই মিনিট পরই মেয়েটি বলল,'আমার নাম মিথিলা, আপনি?'
'পিছনে যে বাড়িটা দেখছো ওটা আমাদের৷ আর আমার নাম,,,,,'
শান বলতে বলতে মেয়েটি আবার বলল,''ওই যে আমার মামা হেটে আসছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।'
'হুম।' বলে শান আবার লাঠি নিয়ে বিপরীতে এগোতে লাগলো।
'আপনি রাতে একা যেতে পারবেন?'
'হাহা অন্ধদের তো রাত আর দিন সবই এক।'
'আচ্ছা ভাল থাকবেন।'
'তুমিও সাবধানে থেকো।'
বলে শান অফিসের দিকে রওনা দিল।
অফিস থেকে এসে আজকেও পুতুলকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেলো শান। তার যেন পুতুলের দিকে তাকাতেও ইচ্ছা করছে না। বিশ্বাসঘাতক একটা।
খুব জলদি একটা কিছু করতে হবে আর এই অন্ধের নাটক করতেও ভালো লাগছে না তার।
পরের দিন সকালে আবারো ফলো করলো পুতুলকে শান। আজ আর কোনো ভুল নয়। সে দেখলো গাড়িটা পাশের এক পার্কের কাছে থামল। পুতুল আর সাব্বির নামের ছেলেটা হাত ধরাধরি করে নামলো।
শান পিছনে লুকিয়ে ফলো করছে তাদের। একটা বেঞ্চে বসছে দুজন। পুতুল সাব্বিরের কাধে মাথা রাখলো। শানের চোয়াল মুহুর্তেই রাগে শক্ত হয়ে গেলো।
সে নিজের মোবাইলে পিছন থেকে ভিডিও করতে লাগলো।
পুতুলের আওয়াজ ভেসে আসলো হঠাৎ।
'তুমি আজকেই চলে যাবে? এই পনেরো দিন আমি কিভাবে থাকবো?'
'আহা বেবি আমার বিদেশে কয়েকটা গাড়ির পার্টসের জন্য যেতে হবে। বুঝতেই তো পারছো। আর কয়েকটা দিন এমনিতেই চলে যাবে।'
'আমি আর ওই বাসায় থাকতে পারছি না। এতদিন তো তোমার অফিসে না হয় বাসায় বসিয়ে রাখো। আর একয়দিন কি করবো?'
'আরে চাকুরীর কথা না বললে কি তোমাকে তোমার শশুর শাশুড়ী বাইরে বেরোতে দিত?? আর আমি তো সারাদিন কাজের ফাকে তোমাকে নিয়েই ব্যস্থ থাকি।' একয়দিন বলবে ছুটি নিয়েছো অফিস থেকে। আর এই নাও কিছু টাকা। এই দিয়ে চলবা এই কয়দিন।'
'না থাক আগে যা দিয়েছো সেটাই তো আছে। আর দিচ্ছো কেনো?'
'আমার সব তো তোমারই।'
'শানের কি করা যায় কিছু ভেবেছো?'
'ওর কাছে তুমি বলতে না পারলে আমি কি করব। আচ্ছা এবার আমি বিদেশ থেকে এসে নেই তারপর দেখা যাবে। ওর তো কিছু একটা করাই লাগবে। তবে যাই বলো চোখ না ভালো হওয়ায় আমাদের জন্য ভালোই হয়েছে।'
'হুম।'
'কিন্তু তুমি কিন্তু শানের কাছেও আর ঘেষবে না।'
'আরেহ না, আমি ওর সাথে একটা ভাল করে কথাও বলি না। জানো আমি তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর বুঝেছি আসলে শানের প্রতি আমার মোহ ছিল। সেটা তোমার ভালোবাসায় কেটে গেছে। কিন্তু মাঝখানে বিয়েটা হয়ে আমার জীবন নষ্ট হয়ে গেলো।'
'চিন্তা করো না। আমি এসে নেই। তারপর শান সোজা ভাবে রাজি না হলে আমারও পথ জানা আছে।'
এই কথাটা শুনে শান আর এক সেকেন্ড দেরি করলো না। চলে আসলো সেখান থেকে। এই মেয়েকে সে ভালোবেসেছিলো? ছি!
সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো৷ আগে সাব্বিরকে শেষ করবে, তার সম্পদ, প্রোপার্টি সব ধ্বংস করে পথে বসাবে তাকে। তারপর পুতুলকে৷ আর সাব্বিরের একয়দিন বিদেশে থাকাও শানের জন্য কাজটা সহজ করে দিল।
পরের কয়দিন পুতুল বাড়িতেই থেকেছে। বলেছে ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে।
পুতুল কিন্তু প্রতিদিন মেসেজ করে শানের সামনেও। আর শান না দেখার ভান করে থাকে।
অফিসে ভালই কাজ চলছে শানের। রেডিও জকি হিসেবে সে আর তার কন্ঠ অনেক পরিচিত এই অল্প কয়দিনেই। সবাই এখন তাকে আর জে শান নামে চেনে। কিন্তু তাকে কেউ দেখেনি বা পরিচয়ও জানে না। কিন্তু অনেক মেয়েই তার গলার আওয়াজে পাগল। এর মধ্যে একটি নেয়ে প্রতিদিন তার শোয়ের সময় কল করে। শানের মুখের আওয়াজে নাকি তার দিনটা ভালো যায়। শান তার জন্য অনেক পছন্দের গান শোনায়।
এর মধ্যে সাব্বির বিদেশে থেকেই খবর পেয়েছে তার দুইটি গ্যারেজ পুলিশ সিল করেছে সেখানে নানা রকম মাদক দ্রব্য পাওয়ার জন্য। ইয়াবা,, ড্রাগস, ফেনসিডিলের কারবার করে এমন অভিযোগও এসেছে তার উপর৷
টিভিতেও এই খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেটাই অবাক হয়ে দেখছে পুতুল। শান অফিসে যাচ্ছিল। খবর দেখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠলো মুখে।
'মা অফিসে যাচ্ছি আমি।'
'সাবধানে যাস বাবা।'
পুতুল শানের কথায় পেছনে তাকালো, শান লাটজির সাহায্যে চলে যাচ্ছে দরজা দিয়ে। আজকাল শান তার সাথে সেরকম কথা বলেনা। তাহলে কি শান তাকে সন্দেহ করছে? পুতুলের মনে প্রশ্ন জাগে। সব কি জেনে গেছে কোনো ভাবে? কিন্তু সেটার তো উপায় নেই। একজন অন্ধের অপক্ষে কিভাবে সম্ভব জানা? পুতুল মাথা থেকে চিন্তা ঝাড়লো।
রাতে অফিস থেকে এসে ঘরে ঢোকার আগেই বুঝতে পারলো পুতুল ঘরে ভিডিও কলে কথা বলছে।
'আচ্ছা তোমার কে শত্রু আছে?'
'সেটা তো আমিও বুঝতেছি না। আমাকে কালকেই দেশে আসতে হচ্ছে। দুইটা গ্যারেজ অলরেডি শেষ আরেকটা আছে। এটা শেষ হতে দেয়া যাবে না, তাহলে তো পথে বসে যাব আমি।'
'আচ্ছা এসো আমিও তোমাকে ছাড়া ভাল নেই, আমরা মিলে কিছু একটা করব।'
'হুম। কে আমার পিছনে লেগেছে সেটা বের করতেই হবে। তাকে জানে মারব আমি।'
শান তাদের কথা শুনে মুচকি হাসলো। 'দেশে আয় সাব্বির। এখনো যে অনেক কিছু বাকি আছে তোর সাথে হওয়ার।'
কিন্তু কে জানত, শানের জীবনে সামনে এক ভয়াবহ ঝড় অপেক্ষা করছে!!!
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_০৫)
লেখক_আয়াশ
এতদিন সাব্বিরের প্রতিটা গ্যারেজে গ্যারেজে রাতের আধারে গিয়ে বিভিন্ন রকম নেশা দ্রব্য রেখে আসে যে, সে আর কেউ নয় শান নিজেই। তারপর নিজেই পুলিশের কাছে অচেনা নম্বর অথবা কোনো পি.সি.ও. থেকে ফোন দেয়। বিদেশ থেকে চিকিৎসাকালীন কিছু টাকা বেচে গেছিলো শানের। সেই টাকার প্রায় সবই শেষ এসব নেশা দ্রব্য ম্যানেজ করতে করতে।
আর একটাই কাজ বাকি আছে। সেটা সফল হলে
তারপরই সাব্বির রাস্তায় বসবে। কিন্তু শানের মাথায় অন্য বুদ্ধি।
এক ভয়ংকর পরিকল্পনা তার। সাব্বির দেশে আসলে সে গ্যারেজে থাকাকালীন পুলিশের রেইড হবে। হাতেনাতে ধরা পড়বে সাব্বির। আর শানের মোহরা হবে পুতুল। সাপও মরবে আবার লাঠিও ভাঙবে না।
অবশ্য এ পরিকল্পনা হয়েছে গতকাল রাতে। সে ঘরের বাইরে দাড়িয়ে ছিল। পুতুল ফোনে বলছিল আজ এতদিন পর সাব্বির আসবে। তাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে পুতুল। সেকথা শুনে শানের কষ্টের চেয়ে মুখে ক্রুর হাসিই বেশি দেখা দিল।
সাব্বির আজ দেশে এসেছে ভোরে। সকাল সকাল উঠে বেলকনিতে বসে বসে প্ল্যানের সব ছক মাথায় কষছিলো শান।
তখনই তার মা এসে কাধে হাত রাখল,'বাবা উঠে পড়েছিস?'
'হ্যা মা, মাত্র উঠলাম।'
'আসিস এত রাত করে আরেকটু ঘুমালেও তো পারতি।'
শান কথার জবাব না দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
'কিছু বলবে মা?'
'হ্যা বাবা, কিভাবে যে বলি, আসলে তোর মামা নাকি অসুস্থ। আজ আমি আর তোর বাবা সেখানেই তাকে দেখতে যেতে চাচ্ছি।'
'তো সমস্যা কি যাওনা। এক দুইদিন থেকে আসো।'
'আসলে আমার কাছে তো টাকা যা ছিল সব পরিবারের খরচে শেষ হয়ে গেছে। আবার বৌমার কাছে বললেও কি বলবে তাই,,,,'
শান হেসে বলল, 'যাবে কখন?'
'বিকেলে আমি আর তোর বাবা রওয়ানা দিতে চাচ্ছি।'
'অহ, আমি দুপুরে অফিসে গিয়ে বসের কাছে চেয়ে অগ্রিম কিছু এনে দেব মা। চিন্তা করো না।'
'তোর এমনিতেই এ অবস্থা। তার উপর তোকে আরো কষ্ট দিচ্ছি আমরা। তাইনারে!' মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল শানের মা।
'আমিই তো কুলাঙ্গার মা। তোমাদের দ্বায়িত্ব নিতে পারলাম না। এখনো তোমাদেরই পরিবার চালাতে হয়।'
'আমার ছেলে নিজে চোখে না দেখেও তার বয়ষ্ক বাবা মাকে দেখে রাখতে রাত নেই দিন নেই খেটে যাচ্ছে। আর সে কুলাঙ্গার!! এ কথা ভুলেও বলবি না আর।'
শান মাথায় রাখা তার মার হাতের উপর হাত রেখে হাসলো।'কবে আসবে মা?'
'এইত বাবা দুই একদিন মাত্র। কিন্তু এই এক দুইদিন থাকতে পারবি তো?'
'হ্যা মা। একা নাকি আমি পুতুল তো আছে, সে কোথায়?'
শানের মা কেমন খাপছাড়া গলায় তাচ্ছিল্য সহকারে বলল
'সে আজ সকালে উঠে বাজারে গেছে, অফিসের সবার জন্য নিজে রান্না করে নিয়ে যাবে। আর নিজের অসুস্থ স্বামীটার কোনো খোজ নেই। আগে থেকে জানলে তোর জীবনটা আমি এভাবে নষ্ট করতাম না বাবা।'
মুখ মলিন হয়ে উঠল মা ছেলের।
'আহ মা বাদ দাও তো। আজ যাবে এক জায়গায়। চিন্তা মুক্ত হয়ে যাও।' কথা কাটাতে শান বলল।
-----------
পুতুল সকাল থেকে নানা পদের রান্না করতে ব্যস্ত। অবশেষে দুপুরে রান্না শেষ হল। সব গুছিয়ে রওয়ানা দিবে এমন সময় শান বলল,'পুতুল আজ আমাকেও একটু নিয়ে যাবে সাথে?'
পুতুল চমকে উঠল,'মানে!!!! তুমি এখন কোথায় যাবে? কেনো?'
'আসলে আমার এখন একটু অফিসে যেতে হবে। নামিয়ে দিও না হয়। প্লিজ।'
শানের মা বাবা বসে আছে ড্রয়িং রুমে। পুতুল বেড়োবে ঠিক তখনই পিছন থেকে কথাটি বলল শান।
অনিচ্ছা হলেও রাজি হল পুতুল।
বাসায় বাইরে গিয়ে একটা সি এন জি ঠিক করলো পুতুল। হাতে এক গাদা খাবার। শানের কাছেও অফিসের ব্যাগ। গাড়িতে উঠে রওয়ানা দিল দুজন।
শান হঠাৎ বলল,'পুতুল একটা কাজ করে দেবে আমার?'
'কি?' কেমন বিরক্ত হয়ে বলল পুতুল।
'রেগে যাচ্ছ কেনো? আশে পাশে ওষুধের দোকানের পাশে রেখে একটা মাথা ব্যাথার ওষুধ কিনে দেবে? আমি যেটা খাই সেটা। চোখও জ্বালা করছে কেমন।'
সামনে ফার্মেসীর পাশে গাড়ি থামাতে বলে পুতুল ওষুধ আনতে নামলো। তখনই মুচকি হাসলো শান। নিজের ব্যাগ থেকে কিছু একটা তড়িঘড়ি বের করে পুতুলের নিয়ে যাওয়া খাবারের ব্যাগটির দিকে হাত বাড়ালো।
-------------
শানকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে পুতুল চলে গেল। অফিসে গিয়েই শান বসের কাছে কিছু টাকা চাইলো মায়ের কথা বলে। এমনিতেই অফিসের সবাই শানের কাজে আর ডেডিকেশনে মুগ্ধ। এক কথায় তাদের মিডিয়া চ্যানেল শানের গলার আওয়াজেই এখন এত পপুলার। শানের কথা শোনার আগেই বস তার হাতে টাকা গুজে দিল।
'এখানে দশ হাজার টাকা আছে। তোমার মাকে দিও ঠিক আছে? বাকি টাকা মাস শেষে নিও।'
'ধন্যবাদ স্যার। কি বলে যে আপনাকে,,,'
'আরেহ তুমি আমার চ্যানেলের গৌরব। আমারই তোমাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। এখন যাও রাতে এসো কেমন। গাড়িতে উঠিয়ে দিব?'
'না স্যার আমি পারব। আসি স্যার।'
---------
অফিস থেকে বেরিয়ে শান এক মুহুর্ত দেরি না করে পাশের কোনো পাবলিক ওয়াশরুমে গেলো। নিজের ব্যাগে আনা ফলস চুল দাড়ি পড়ে জামা পাল্টালো যেটা সে যা প্রতি রাতে করে। এবার লক্ষ্য সাব্বিরের গ্যারেজ। মুচকি হাসলো শান। যাওয়ার আগে পাশের একটা পি.সি.ও. থেকে পুলিশকে খবরটা জানাতে ভুললো না।
----------
গ্যারেজে মাত্র প্রবেশ করলো পুতুল। সাব্বির কথা বলছিল বাকিদের সাথে এসব নিয়েই। পুতুলকে আসা দেখে তাকে নিয়ে গ্যারেজের দুইতালায় গেলো।
শান একটু পরই পৌছাল। বৃদ্ধ লোকের বেশে এসেছে সে। নিচে গ্যারেজে অনেক লোক। গাড়ি রিপেয়ার করছে, তো কেউ পুরাতন গাড়ি কিনতে এসেছে। সবার চোখ ফাকি দিয়ে দুইতলায় গেল।
উপরের রুমের দরজা বন্ধ। কিন্তু পাশের জানালার ছিদ্র দিয়ে সবই প্রায় দেখা যাচ্ছে। শান সেখান দিয়েই খেয়াল করলো, পুতুলকে সাব্বির জড়িয়ে রেখেছে। পুতুলের গায়ে বোরকা নেই এখন আর। নিচে সুন্দর করে শাড়ি পড়ে সেজে এসেছে আজ। পাশে টেবিলের উপর পুতুলের নিয়ে যাওয়া খাবার। জড়িয়ে থাকা দৃশ্য দেখে শানের চোখ লাল হয়ে গেলো। এই বিশ্বাসঘাতককে সে কিনা ভালোবেসেছিলো!
'কি করছো ছাড়ো।' পুতুল ন্যাকামো করে বলল।
'এতদিন পর কাছে পেয়েছি। ছাড়তে ইচ্ছেই করছে না।' সাব্বিরের কেমন ঘোরের মধ্যে জবাব।
'আহা, আগে খাবার এনেছি তোমার জন্য সেটা তো খেয়ে নাও।'
'আমার খাবার তো আমি জড়িয়েই রেখেছি। সেটা আগে খেয়ে নেই। তারপর না হয় দেখা যাবে।' কথাটা বলেই পুতুলকে আর কোনো কথার সুযোগ না দিয়ে আরো গভীর হতে চাইলো।'
শান সেটা দেখেই জানালা থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তার চোখের সামনে তার একসময়ের ভালোবাসা অন্যের সাথে ভালোবাসার আদান প্রদানে ব্যস্ত।
ঠিক তখনই পুলিশের গাড়ির আওয়াজ শোনা গেলো। না চাইতেও জানালা দিয়ে আবার চাইলো শান। পুতুলের ঘাড়ে মুখ গুজে আচলে টান দিতেই সাব্বিরের কানে আসল পুলিশের গাড়ির আওয়াজ। সাথে সাথে ছিটকে গেলো দুজনই।
'পুলিশ হঠাৎ এসময়!!' সাব্বিরের ভয়ার্ত কন্ঠ।
'আমাকে তোমার সাথে এখানে দেখে ফেললে কি হবে? কি বলবে সবাই?' পুতুলও ভয়ে প্রায় কেদে দিয়েছে।
'আরে পিছনে একটা সিড়ি আছে। তুমি সেখান দিয়ে নেমে যাও।'
'তুমিও চলো।'
'আরে না, আমাকে তো এসব ফেস করতেই হবে। আর তাছাড়া আমি এসেছি এখন। এই গ্যারেজে তো কিছু পাবে না।'
'আচ্ছা আমি যাই।' পুতুল সাব্বিরকে হালকা জড়িয়ে ধরে বিদায় নিয়ে দ্রুত বেগে দৌড়ালো ওইভাবেই।
বোরকা পড়তে ভুলে গেছে তাড়াহুড়োয়। বোরকাটা নিচেই গড়াগড়ি খাচ্ছিল। দৌড়ের সময় পুতুলের পায়ের সাথে বেধে রুমের বাইরে পর্যন্ত চলে এসেছে। পুতুলের সেদিকে নজর নেই। সে দ্রুত এখান থেকে যেতে পারলেই বাচে।
শান সাথে সাথে আড়ালে এসেছে। যেন পুতুল দেখতে না পায়। পুতুল পিছনের গেট দিয়ে চলে যাওয়া মাত্রই পুলিশ উপরের তলায় চলে আসল।সাথে গ্যারেজের অনেকেই এসেছে, কর্মচারী, ক্রেতাসহ সবাই। শোরগোলে সবার দেখার ইচ্ছা কি হচ্ছে এখানে। শান বৃদ্ধ বেশে তাদের মাঝে মিশে গেছে।
পুলিশ সবাইকে বাইরে রেখে সাব্বিরের রুমে গেলো। শান আবার জানালায় চোখ রাখল।
'কি ব্যাপার আপনারা আমার গ্যারেজে?' সাব্বির প্রশ্ন করলো।
'আপনার গ্যারেজে নেশাদ্রব্য আছে আমরা খবর পেয়েছি।'
'হাসালেন। এতদিন আমি দেশে ছিলাম না। আমার গ্যারেজে কে না কে রেখে গেছিলো ওইসব। তার ভিত্তিতে আমার উপর মামলা করেছেন, সিল করেছেন সব। আর এখন তো আমি দেশে। এখানে কে রাখবে? আপনারা খুজে দেখতে পারেন।' সাব্বির বলে পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে বসল।
পুলিশ তন্ন তন্ন করে খোজা শুরু করলো। কিছুই না পেয়ে চলে যাবে তখনই হঠাৎ একজন অফিসার বলল,'এই টিফিন বাটিগুলোতে কি?'
'আমার লাঞ্চ।' সাব্বিরের আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব।
পুলিশ কি মনে করে বাটিগুলো খুলতেই তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। সাথে সাব্বিরের তো জান যায় যায় দশা।
সব গুলো বাটিতে মুখরোচক খাবার। কিন্তু তার উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন নেশাদ্রব্য-ইয়াবা ট্যাবলেট, ড্রাগস এর প্যাকেট!!!!!!।
'পুতুল!!! তাহলে তুমি??? তুমি আমার সব গ্যারেজে এরকমটা করেছো? আমি তোমাকে ছাড়ব না পুতুল। ছাড়বো না।' সাব্বির বসে পড়ে রাগে ক্ষোভে এসব বলছিল। তখনই হাতে হাতকড়া পড়ালো একজন। হাতে নাতে মাদকদ্রব্য ধরা পড়েছে। আজ আর রেহাই কোথায়!
বাইরে সবার ভিড়ে দাঁড়িয়ে ছদ্মবেশে এখনো দেখছে এসব শান। মুখে আজ তৃপ্তির হাসি। কিন্তু না আরেকজন তো বাকি আছে। এবার তার পালা। সবাইকে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি পেতে হবে। সবাইকে!!!!
কিন্তু এক প্রলয়ংকারী ঝড় যে তার জীবনে আসন্ন সেটা কি শান জানে??
তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_০৬)
লেখক_আয়াশ
সাব্বিরের ফোনে লাগাতার কল করেই যাচ্ছে পুতুল। কিন্তু ঢুকছে না। খুব টেনশনে আছে সে।
৫২ তম বারের সময়ও যখন কল ঢুকলো না তখন ফোনটা বিছানায় আছাড় দিল সে।
মাত্রই বাসায় ফিরেছে শান। ঘরে ঢুকতে যাবে এসময় এই দৃশ্য দেখে মনের অভ্যন্তরীণ খুশিটা যেন দ্বিগুন হয়ে গেল। এত ভালোবাসার পরও যে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে সেই কালনাগিনীকে জীবনে আর দ্বিতীয়বার সুযোগ দিতে চায় না শান।
কিন্তু খেলা তো শেষ নয়। এখন মানসিকভাবেও ভেঙে দিতে হবে পুতুলকে। তাকে যোগ্য শাস্তি দিয়ে তারপর ছেড়ে দেবে।
লাঠি ঠুকাতে ঠুকাতে ঘরে ঢোকার অভিনয় করতে লাগলো সে। তা দেখেই পুতুল সতর্ক হয়ে গেল। কিন্তু শানের সাথে কথা না বলে চুপচাপ রইল। শানও সেদিকে নজর দিল না।
----------
বিকেলে শান তার মা বাবা আর পুতুলের সাথে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। শানের মা বাবার ব্যাগ রেডি, যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। পুতুল সেখানে থাকলেও তার মন তো অন্য চিন্তায়।
'বাবা, মা এই নাও।'
শান হাতের টাকাটা সামনে এগিয়ে দিল। তার মা সেটা নিয়ে বলল,
'বাবা এত টাকা?'
'মা স্যার বলেছে এখানে ১০ হাজার আছে। আসলে মাসের অর্ধেক বাকি তো। বাকি টাকা......'
'না বাবা আমরা বলছি এত টাকা তো আমাদের লাগবেই না। এত টাকা দিচ্ছিস কেনো?' শানের মা বলল।
'মা নাও না। কখন কি দরকার লাগে।'
'নাও শানের মা, টাকা বেশি হলে না হয় তুমি ৫০০০ রাখো, বাকি টাকা আমাকে দাও, ছেলে দিয়েছে একটু হাত খরচ করবো না!!'
'তুমি এক টাকাও পাবে না। যা লাগবে আমার থেকে নেবে। বুড়ো বেটার আবার কিসের হাত খরচ!!'
'বাবা দেখলি! বুড়োকালেও আমার জেলখানা থেকে মুক্তি মিললো না।'
'কি বললে!!'
'ক কি কি? কোথায় বললাম?'
'হাহাহা, মা ঝগড়া না করে চলো যাই, এগিয়ে দেই তোমাদের।'
'বাবা নিজের খেয়াল রাখিস।'
'আরেহ মা পুতুল আছে না?'
'হু সেটা হলে তো নিশ্চিন্ত হয়েই যেতাম।' পুতুলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য সহকারে বলল শানের মা।
পুতুলের মেজাজ এমনিতেও খারাপ ছিল। শানের মার ত্যাড়া কথা শুনে বলল,'শান তুমি তাদের এগিয়ে দিয়ে এস। আমার মাথা ব্যাথা করছে। আমি রুমে যাই।' বলে এক সেকেন্ড দেরি না করে চলে গেলো।
'দেখলে শানের বাবা, কিরকম করলো?'
'আমরাই হয়ত এর জন্য দায়ী। জেনে বুঝে নিজের ছেলের জীবনটা শেষ করলাম।
'বাবা মা এখন বাদ দাও এসব। চলো তো। দেড়ি হয়ে যাবে।'
শানের নিষেধ স্বত্তেও তাকে দুই হাজার টাকা ফেরত দিল তার মা। তার হাত খরচ আর চলার জন্য। শান বাবা মাকে সামনের মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসবে এমন সময় কারো কান্নার আওয়াজ পেলো। সামনে তাকিয়ে দেখলো মিথু রাস্তার সাথের ম্যানহোলের পাশে হাটু গেড়ে বসে নিচে কি যেন দেখছে আর চোখের জল ফেলছে।
লাঠির সাহায্যে তার কাছে গিয়ে বলল,' এই কাঁদছে কে এখানে?কে?'
'আ আমি মিথিলা।' ফুফাতে ফুফাতেই বলল মেয়েটি।
'ওহ তুমি! কি হয়েছে তোমার? বলো আমাকে।'
'কিছুনা।'
'দেখো আমি আজ অন্ধ বলে হয়ত বলছোনা।'
'না নাহ এ কি বলছেন আপনি! সেদিন আপনি না থাকলে আমার কি হত!'
'তাহলে বলো।'
'আমাকে এই সামনের মুদি দোকানটা থেকে বাজার আনতে দিয়েছিলো মামী। টাকাটা হাতে নিয়েই আসছিলাম। হঠাৎ সামনে থেকে কুকুরের শব্দ পেয়ে চমকে উঠে হাতের টাকাটা নিচে ম্যানহোলের ছিদ্র দিয়ে পড়ে গেছে। এবার কি হবে? আগের দিন ভাঙা ডিম নিয়ে গেছিলাম জন্য মেরে রাতের খাবারও দেয়নি কিন্তু আজ কি হবে? কি বলব? মামী এসব বিশ্বাস করবে না। বলবে টাকা চুরি করেছি আমি।' বলে আবার ফোফাতে লাগলো মিথিলা।
শান তো এ কথা শুনে অবাক। কতটা নির্দয় হলে এই মেয়েটির উপর এরকম করতে পারে। সে বলল,
'আচ্ছা আমি তোমাকে হেল্প করতে চাইলে হেল নেবে তো?'
'মানে?'
'টাকাটা যদি আমি দেই?'
'কিন্তু আপনি কেনো দেবেন?'
'দেখো সেদিন কিন্তু আমার কারণেই ডিম ভেঙেছিলো। আজ না হয় বন্ধু হিসেবে তোমাকে হেল্প করলাম। কি নেবে না এই বন্ধুর হেল্প?'
'ক কিন্তু!!'
'না আর কোনো কথা নয়। কত টাকা দিয়েছিলো?'
'৫০০ টাকা।'
শান এবার মেয়েটিকে একটু পরীক্ষা করতে চাইলো। পকেটের দুইটা একহাজারের নোটের একটা দিয়ে বলল, 'নাও ৫০০ টাকা।'
'এটা তো এক হাজার টাকার নোট!'
শান মিথুর কথায় বুঝল মেয়েটি আসলেই সরল।
'আচ্ছা চলো।'
'কোথায়?'
'আজ একজনের জন্মদিন। তার জন্য কেক কিনতে হবে।'
'কে ভাবী নিশ্চয়ই!'
'না এক সর্বনাশিনী।'
'কিহ!!'
'আরে আমার কেউ নেই ভালোবাসার। অন্ধকে কে ভালোবাসবে?'
'ভালোবাসতে অন্ধ পঙ্গু না, লাগে মন। আর আপনার মত মনের মানুষকে কে না ভালোবাসবে!'
'আচ্ছা চলো।'
দুজনে খুশি মনে আগে মিথিলার মুদি বাজার করল তারপর শানের একটা কেক কিনে মিথিলার সাথেই বাসার উদ্দেশ্যে ফিরল।
মিথিলা বাসায় যাওয়ার আগে বলল,'আপনি আমাকে সাহায্য করেই যাচ্ছেন। আমি জীবনেও ভুলব না আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা।'
'আমরা তো বন্ধু। আমাদের মাঝে আবার কৃতজ্ঞতা কি?'
শানের কথায় মেয়েটির চোখে মুখে খুশির আভা দেখা দিল।
'আজ থেকে আপনি আমার সবচেয়ে প্রিয় দুইটি মানুষের মধ্যে একজন।'
'আরেকজন কে শুনি?' শান হেসে বলল।
'আর জে শান। নাম শুনেছেন? আমার মনে শুধুই সে।'
মিথিলার কথা শুনে শানের চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
'আচ্ছা আপনার নামটা তো জানা হল না?'
'হাহাহা, সেটা আরেকদিন বলব, আচ্ছা আসি। রাত হয়ে গেছে।'
'আচ্ছা।'
মিথিলার থেকে বিদায় নিল শান। সে এখন আর এসব নিয়ে ভাবতে চাচ্ছে না। তার সামনে বড় কাজ, অনেক বড়।
-------
বাসায় ঢুকে দেখলো পুতুল এখনো মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে। গাধাটার মাথায় এটুকুও বুদ্ধি আসেনি যে টিভি চালালেই সব জেনে যেত।
শান মুচকি হেসে রুমে ঢুকলো।
'পুতুল পুতুল?'
'কি হল চেচাচ্ছো কেনো?'
'আসো দেখো কি এনেছি।'
'পুতুল বলল,'পরে আমি বিজি আছি।'
'আরেহ দেখোই না।'
'উফফ, আচ্ছা দেখি।'
শানের হাত থেকে প্যাকেট খুলে দেখলো একটা ছোট কেক। উপরে হ্যাপি বার্থডে লেখা৷'
পুতুল অবাক হল। কারো মনে না থাকলেও শানের মনে আছে। আজ তার জন্মদিন বলেই সাব্বিরের জন্য এত কিছু রান্না করে নিয়ে গেছিল সে।
'তোমার মনে আছে?'
'তোমার জন্মদিন আমি ভুলতে পারি?'
'কিন্তু নাম কই কেকের উপরে?'
'আমার বউয়ের নাম অন্যকেউ লিখবে কেনো? তাই লিখতে দেইনি। এই নাও ক্রিম পেন। তুমিই লিখ।'
আগের পুতুল হলে হয়ত শানকে জড়িয়ে ধরতো। এই পুতুলের ফেস দেখে মনে হল শানের সব কাজ তার কাছে ঢং লাগছে।
দুজন কেক কেটে খাওয়া দাওয়া করে বিছানায় বসেছে। শান হঠাৎ বলল,
'তোমার একটা গিফটও আছে। দেখো একটা ব্যাগ রেখেছি অফিস থেকে এসে। ওইটায়।'
শানের কথা শুনে পুতুল শানের ব্যাগটা নিয়ে আসলো।
শান বলল,'খোলো এটার ভিতরে একটা প্যাকেটে আছে।
পুতুল ব্যাগের ভিতরে একটা প্যাকেট দেখলো। কিন্তু খুলে যা দেখলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তারই বোরকা যেটা পড়ে সাব্বিরের কাছে গেছিলো সে।
পুতুল অবাক হয়ে শানের দিকে তাকালো৷ শান শুয়ে উপরের সিলিংয়ের দিকে চেয়ে আছে।
'ত তু তুমি এ এটা!!'
'হাহাহা সাব্বিরের রুমেই ফেলে এসেছিলে তাই নিয়ে এসেছি।'
পুতুলের ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে তার সাথে! কি বলছে শান!!!
'তুমি কিভাবে জা জা জান ল লে?'
শান এবার হঠাৎ পাশের দেয়ালে লাগানো ঘড়ির দিকে ফিরল। বলল,'রাত ১১ টা ২৫ বেজে গেছে। শুয়ে পড়। কাল কথা হবে।'
পুতুল শানের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে দেখলো ঘড়িতে ঠিক ১১ টা ২৫ ই বাজে।
'তার মানে!!! তার মানে শান চ চোখে দেখতে পারে?' পুতুলের মনের মাঝে উথান পাথান শুরু হয়েছে। এক নিমিষে তার সব কিছু উলটা পালটা লাগছে।
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_০৭)
লেখক_আয়াশ
শানের মুখ থেকে বলা কথাগুলো মাথায় নিতে পারছে না পুতুল। সে এমন অপরাধ করেছে যার কোনো ক্ষমা হয় না। কি করবে সে এখন সেটাই ভাবছে। কিছু ভাবতে না পেরে হঠাৎ বেডে শুয়ে থাকা শানের পা জড়িয়ে ধরলো।
হঠাৎ পায়ে কারো স্পর্শ পেয়ে সেদিকে তাকালো শান। দেখলো পুতুল পা জড়িয়ে কাদছে৷
এক ধাক্কা দিয়ে পা সড়িয়ে নিল শান।
'এসব ন্যাকামির মানে কি?' কড়া গলায় বলল সে।
'আমি জানি তুমি খুব কষ্ট পেয়েছো আমার কাজে। আসলে আমার মাথা ঠিক ছিল না। তোমাকেও কাছে পাচ্ছিলাম না। কি যে হয়েছিল আমার! তাই,,,'
'তাই কি? নিজের স্বামীকে ভুলে অন্য পুরুষে মত্ত ছিলে? তাই কি? নিজের স্বামীর ভালোবাসা ভুলে অন্যের কাছে ভালোবাসা বিলিয়ে দিয়েছো অনায়াসে?'
'আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমার ভুল হয়ে গেছে।'
'কিছু কিছু ভুলের ক্ষমা হয় না পুতুল। সেটা কালকেই বুঝতে পারবে।'
'মানে?'
'আমার ক্লান্ত লাগছে, অফিসেও যাই নি তাই। সো নো মোর ওয়ার্ডস।'
পুতুলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শান পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল। আর পুতুল বেডের পাশে নিচে বসে চোখের জল ফেলছে৷ আজ শান তাকে জন্মদিনের উপহার দিয়েছে, হোক সেটা অভিনয়৷ সে সত্যি সত্যি সব ভালোবাসার প্রাপ্য ভাগীদার ছিল কিন্তু নিজের ভুলে হয়ত সব হারালো।
--------------
সকালে ঘুম থেকে উঠে পুতুলকে ওইভাবেই বসে থাকতে দেখলো শান। ভালো করে তাকাতে দেখলো পায়ের কাছে বেডে মাথা দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। শান বিছানা থেকে উঠতে নড়াচড়ায় পুতুলেরও ঘুম ভেঙে গেলো।
'আপনাকে নিয়ে এক জায়গায় যাব মিস পুতুল। তৈরি হয়ে নিন।'
শানের কথায় পুতুল চমকে উঠল।
'আমাকে আপনি করে বলছ হটাৎ!'
'আমি শুধু কাছের লোকদের তুমি বলি। আর আপনাকে আমি আমার জীবনে কোথায় জায়গা দিতে চাইনা আর।'
পুতুল কেদেই ফেললো। 'কি বলছো এসব!!'
'কথা না বাড়িয়ে রেডি হয়ে আসুন।'
বলেই শান চলে গেলো তার বাবা মায়ের ওয়াশরুমে রেডি হতে।
রেডি হয়ে রুমে এসেছে শান। দেখে পুতুল বোরকা পড়ছে।
'হাহাহা হাসালেন,এখনো বোরকা?'
পুতুল চোখ বড় বড় করে তাকালো।
'কেন, কি হয়েছে?'
'পরপুরুষের ঘরে পর্দাহীন হয়ে এখন আবার পর্দা করার ঢং করছেন?'
'তুমি!!'
'চলুন আমি রেডি।' বলে শান চশমা পড়ে আবার লাঠি হাতে নিলো।
শানের আবার অন্ধ সাজা দেখে পুতুল অবাক হল।
'এখনো এসব পড়ছো যে?'
'সেটা নিশ্চয়ই আপনাকে বলতে বাধ্য নই আমি? হ্যা আর একটা কথা, যদি কেউ আমার চোখ ভাল হওয়ার কথা জানতে পারে, আপনার জন্য বিষয়টি ভালো হবে না।' পুতুল শুধু নিরব দর্শকের মত শুনছে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা সি এন জি নিয়েছে দুইজন। লক্ষ্য থানা। সেটা শুনেই পুতুল বলল,',থানা কেনো?'
'সেটা না হয় গেলেই দেখবেন।'
পুতুল খানিক বাদে শানের একটা হাতের উপরে নিজের হাত রাখলো।
শানের মুখ চোখ শক্ত হয়ে উঠলো। হাত ঝাকি দয়ে ছাড়ালো সঙ্গে সঙ্গে।
'আচ্ছা আমরা কি আবার সব প্রথম থেকে শুরু করতে পারি না? আমি মানছি আমার অনেক বড় ভুল হয়েছে। আমি ক্ষমা চাচ্ছি হাত জোড় করে। আর জীবনেও এই ভুল করব না। একটা সুযোগ দাও।'
'মিস পুতুল ভুল না অপরাধ করেছেন আপনি। সেটা কি সহজে ভুলার?'
পুতুল কিছু বলবে তখনই ড্রাইভার বলল 'চলে এসেছি স্যার, নামেন।'
থানার ভিতরে যাচ্ছে দুজন। শান লাঠির সাহায্যে এগোচ্ছে। একটু পরই দুজন থানায় একটা লকাপের সামনে আসলো। ভিতরের মানুষটাকে দেখে তো পুতুলের চোখ কপালে।
'সাব্বির!!! ও এখানে কেনো?' পুতুল মনে মনে বলছে।
পুতুলকে দেখেই সাব্বির লকাপের সামনে চলে আসলো।
'তুই!!!'
'সাব্বির তুমি এখানে কিভাবে?'
'তুই জানিস না নষ্টা বেহায়া মেয়ে? নিজে সব করেছিস, আর এখন সাধু সাজছিস? ওই অন্ধকে সাথে করেও এনেছিস?'
শান পিছনে দাড়িয়ে না শোনার ভান করে আছে।পুতুল অবাক হয়ে চেয়ে আছে সাব্বিরের দিকে।
'কি বলছো এসব তুমি? আমার জন্য মানে?'
'খুশি হোস না রে বেশি। আজ হোক কাল হোক আমি জামিন নিয়ে নেব। তারপর তোকে কে বাচাবে সেটাও আমি দেখে নেব। আমার জীবন নষ্ট করে কি মনে করেছিস? আমি তোকে শান্তিতে থাকতে দেব?'
'আমি সত্যি কিছুই বুঝতে পারছি না।'
'চুপ কর কালনাগিনী। তোর সব অভিনয় আমার দেখা শেষ। টাকা হাতিয়েছিস আমার থেকে। এখন আমাকে আর দরকার হবে কেনো? তোকে সব কিছুর মাশুল দিতে হবে। দেখে নিস।'
পুতুল শানের উপস্থিতি ভুলেই সাব্বিরের সামনে গেল,'তুমি বিশ্বাস করো, আমি তো কিছুই করিনি।'
সাব্বির রেগে এবার পুতুলের গলা চেয়ে ধরল। পুতুল ছটফট করছে। শান পিছনে দাড়িয়ে মজা নিচ্ছে।
'তোকে আমি মেরেই ফেলব নষ্টা মেয়ে।'
'অফিসার, অফিসার আসুন এখানে, আমার ওয়াইফকে মেরে ফেললো।' পুতুলের গোঙানিতে শান ন্যাকামি করে লাঠি এদিক ওদিক করছে আর সাহায্য চাইছে।
পুলিশরা এসে অনেক কষ্টে পুতুলকে ছাড়ালো। সাব্বির ওরা যাওয়ার সময়ও পুতুলকে শাসিয়ে দিল। (আমি গল্পের লেখক আয়াশ বলছি, সকল আইডি নষ্ট হওয়ায় গল্প শুধু পেজে আপলোড করব, সাথে থাকুন সবাই)
'এসব এর মানে কি? কি বলল সাব্বির?' যাওয়ার পথে গাড়িতে বসে বলল পুতুল।
'হাহাহা।' সব একে একে বলল শান, সে কি কি করেছে।
'টিভিটা চালালে নিজেই বুঝে যেতেন। কিন্তু আপনার সাব্বিরের চিন্তায় সেটাও হয়ত মাথায় আসেনি আপনার। আচ্ছা মিস পুতুল অফিসে যাবেন না?'
পুতুল শানের প্রশ্নে থতমত খাচ্ছে।
'না মানে,,,'
'হাহাহাহা, জানি, সব জানি। কবে থেকে আমাকে ধোকা দিচ্ছেন সেটাও। মাত্র তো খেলা শুরু। আপনার নাগরকেই আপনার শত্রু বানিয়ে দিলাম।'
পুতুল পাশে বসে চোখের জল ফেলছে। কিন্তু তার একটাই আশা, শান হয়ত তাকে এখনো ভালোবাসে, নাহলে সাব্বিরের কাছে থেকে জেলে ওইভাবে বাচাতো না।
গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া চুকিয়ে হাটছে বাসার দিকে শান আর পিছনে পুতুল, হঠাৎ একজন এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল শানকে। পুতুল তো পুরোই অবাক।
'আপনি খুব খারাপ, কেনো বলেন নি আপনিই আমার আর যে শান?' শানকে জড়িয়ে ধরে মৃদ্যু কন্ঠে বলছে মেয়েটি। পুতুল রাগে ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু,,,,,,,,
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_০৮)
লেখক_আয়াশ
'এতদিন আমার সামনে থেকেও আমি বুঝিনি যে আপনিই আমার শান! কি পাগল আমি আপনার জন্য, আর আপনাকে চিনতেই পারলাম না!'
শানকে জড়িয়ে ধরে আছে মিথিলা আর উপরের কথাগুলো বলছে। পিছনে পুতুল রাগে ফেটে পড়ছে। কিন্তু চাইতেও কেন যেন শানের উপর অধিকার খাটাতে পারছে না পুতুল। অগত্যা রাগে সে তাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো বাড়ির দিকে।
শান সেটা দেখে মুচকি হেসে মিথিলা কে নিজের থেকে আলগা করলো,' মিথিলা? তুমি!'
'আপনি আগের দিন বলেন নি কেনো? আমি যে বললাম আমার কাছের মানুষ দুইজন আপনি আর শান। আপনি বলেন নি কেন? আমার সেই কাছের মানুষটা শুধু আপনি আর আপনি।'
'মিথিলা, কি বলছো তুমি বুঝতে পারছো?'
'জানেন আপনাকে প্রতিদিন কে কল দেয় রাতে? আমি। জানেন আপনার কথা শুনতে আমি মামার ফোনটাও প্রতি রাতে চুপিসারে নিজের কাছে আনি। কেন জানেন?'
শান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, কি বলছে মেয়েটি!
মিথিলা আবার বলল,'কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি। আগে তো দেখিও নি আপনাকে। কিন্তু কাল যখন রাতে জানলাম আপনিই সেই শান তখন আমার মাথা ঠিক ছিল না। আমি বুঝেছি আমি ভুল মানুষকে মন দেইনি। এতদিনের আপনার ব্যবহার, আমাকে নিস্বার্থ ভাবে সাহায্য করা, এসবে আমি বুঝেছি আমি ভুল মানু্ষকে পছন্দ করিনি।'
'হ্যা মিথিলা তুমি ভুল মানুষকেই পছন্দ করেছ। কি জানো তুমি আমার ব্যাপারে? কিছুই না। তাহলে?'
'আপনি কি বলছেন?'
'আগে বলো আমার পরিচয় কি করে পেলে?'
'গতকাল রাতে মামার সাথে তার এক বন্ধু আসে, সে নাকি আপনার স্টুডিওর একটা পোস্টে চাকরি করে৷ সেই বলেছে, আর জে শান চোখে দেখে না, আর আমাদের পাশের বাড়িই থাকে।'
শান হতবাক হয়ে মিথিলার দিকে চেয়ে আছে।
'শোনো মিথিলা, তুমি এখনো বুঝতে পারছো না। আমি তোমার জন্য ঠিক না।'
'কেনো? কেনো এমন বলছেন? আমি কি খুব খারাপ? সারাজীবন কষ্ট পেয়ে এসেছি, আবার এখন জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টটা দিয়েন না প্লিজ।'
'দেখো তুমি শুনিতে চাচ্ছো না আমার কথা। আমি অন্ধ আর তুমি,, '
'আমার সেটায় কিচ্ছু যায় আসে না। আপনি অন্ধ কেনো আল্লাহ না করুক বোবা, কানা হলেও আমার কিছু আসে যায় না।'
'ছেলেমানুষী করো না।'
'আচ্ছা আমি এতিম তাই বলে কি এমন করছেন?'
'মিথিলা!!' চিল্লিয়ে উঠল শান।
শানের ধমক খেয়ে মিথিলা বসে পড়েছে ওখানেই। একটু পর ফুফানোর আওয়াজ আসছে। শান ভাবলো, নাহ এই পিচ্চিকে আগে সামলাতে হবে।
'আচ্ছা দেখো, তুমি আমার সম্পর্কে কিছুই জানো না। আমি সব তোমাকে বলব। তুমি এখন বাসায় যাও।'
'কিন্তু,,,'
'কালকে বলব, যাও তুমি বাসায়।'
'আচ্ছা আপনার সাথে যে আসছিল সেই মহিলা কে? আর তিনি এভাবে চলে গেলো কেনো?'
'বললাম তো সব কালকে বলব।'
বলে মিথিলাকে বাসার সামনে দিয়ে এসে শান কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বাসায় গেলো।
শান আসলে পুতুলের ভাবগতি বুঝার চেষ্টা করছিল। ভেবেছিলো হয়ত পুতুলকে ঠিক একই যন্ত্রণা দেবে যা সে অন্যজনের কাছে গিয়ে শানকে দিয়েছে। তাই মিথিলা জড়িয়ে ধরার সঙ্গে সঙ্গেই ছাড়িয়ে নেয়নি। কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলো,'আচ্ছা ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো সাথে দেখলে না হয় রাগ হবে, আমি কি আদৌ পুতুলের ভালোবাসার মানুষ আছি!!'
বাসায় ঢুকতেই পুতুল ঠাট্টার ছলে বলল,'বাহ ভালোই তো চলছে।' ভ্রু কুচকে গেলো শানের।
'মানে?'
'বাইরে যে রঙ তামাশা দেখলাম। কচি মেয়ে পেয়েছো ভালই।'
'ছি একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সম্পর্কে কি বলছেন আপনি?'
'লজ্জা করে না এসব নষ্টামি করতে?'
শান সাথে সাথে পুতুলকে একটা জোড়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিল।
'বেয়াদব মেয়ে, কোন মুখে এসব কথা বলছিস তুই? তোর মুখ আছে এসব বলার? নিজে কি করেছিস দেখ। তারপর বল। আরেহ মেয়েটা তো জানেও না আমি দেখতে পাই। আমার গলার আওয়াজ ভাল লেগেছে বিধায় হয়ত এমন করল। তোর মত নষ্টামি করিনি আমি, শুনেছিস?'
'তোমার গলার আওয়াজ মানে? কি কাজ করো তুমি অফিসে?'
'হাহাহ সেটাও জানার ইচ্ছা হয়নি তোর এতদিন? তুই এতই ভাল স্ত্রী। কারন তুই মত্ত ছিলি সাব্বিরে।'
পুতুল মাথা নিচু করে আছে।
'ভেবে ছিলাম তোকে কষ্ট দিব, কিন্তু না তোর মত কালনাগিনীর সামনে থাকলে নিজেকেই কষ্ট দেয়া হবে। কালকে বাবা মা আসবে। আসলেই তোকে বিদায় করব।'
'বিদায় করবে মানে?'
'ডিভোর্স।'
'কিহ?'
শান কোনো উত্তর দিল না। রুমের দিকে এগোলো।
'শুনে যাও। কি বললে তুমি!'
পুতুল শানের পিছনের শার্ট ধরে ফেললো৷
'ছাড় আমাকে, তোর ওই নোংরা শরীর দিয়ে আমাকে অপবিত্র করার চেষ্টাও করবি না।'
পুতুলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে শান। পুতুল ওখানে বসেই কাদছে।
রাতে শান তাড়াতাড়িই অফিসে গেছে। পুতুলের সাথে একটা কথাও বলেনি। কিন্তু বাসার বাইরে বেড়িয়েই আড়চোখে পাশের মিথিলাদের বাড়ির দিকে চেয়েছে।
হ্যা, যা ভেবেছে তাই। মিথিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার বাসার দিকেই তাকিয়ে আছে। শান লাঠির সাহায্যে যাওয়ার ভান করল। মহান বিপদে সে🇧, না চাইতেও এই বাচ্চা মেয়েটার মনে কি৷ তবে জায়গা করে নিল?
শান অফিসে যাওয়ার আধা ঘন্টার ভিতরে কলিং বেল বাজলো৷ পুতুল ভাবলো হয়ত শান আবার এসেছে, কিন্তু দরজা খুললেই তার সামনে দাড়িয়ে ছিল সাব্বির।
পুতুল খানিকটা আতংকিত হল।
'একি তুমি?'
'কি ভেবেছিস জেলে ভরে রাখবি? আর তোরা মজা করবি?'
'কি বলছো,,'
আর কিছু বলতে না দিয়ে পুতুলের চুলের মুঠি ধরে ভিতরে নিয়ে আসলো সাব্বির।
এক প্রকার জোড়পূর্বক বিছানায় ফেলে দিল পুতুলকে।
'আজ আমার সকল ক্ষোভ তোর উপর বের করবো ডাইনি। তোর স্বামী তো অন্ধ আরো বাসায় নেই। এখন তোকে কে বাচাবে? তোকে আজ মেরেই ফেলব আমি।'
'বিশ্বাস কর, আমি কিছু করিনি। সব করেছে,,'
আর কিছু বলার আগেই পুতুলের উপর ঝাপিয়ে পড়ল সাব্বির।
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_০৯)
লেখক_আয়াশ
বিছানায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে রয়েছে পুতুল। জীবনের হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ আগে কি হল সেই নির্মমতার স্মৃতি মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। এসবের জন্য তো সেই দায়ী।
হঠাৎ কি মনে করে মুচকি হাসলো পুতুল।
আর কোনো ভুল করবে না সে। খুব ভেবে চিন্তে জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নেবে। যা ভুল হবার তা তো হয়ে গেছে, সেটা তো পালটানো যাবে না। কিন্তু এই সুযোগ আর দেবে না। শানের গিফট করা শিফন শাড়ি টা নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো সে, উদ্দেশ্য শরীরে লেগে থাকা পাপের স্পর্শগুলো ধুয়ে আসা।
রাতে শো করার সময় হঠাৎ কান্নারত মেয়ের ফোন আসলো শানের কাছে।
'হেলো, আরজে শান হেয়ার,, বলুন কি গান শুনাতে পারি আপনাকে!!'
মেয়েটির হালকা ফুফানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
'হেলো মিস, ক্যান ইউ হেয়ার মি?'
'হ্যা শুনছি।'
'কিভাবে আপনার মন ভালো করতে পারি? কি গান শোনাব? বলুন।'
'আমার কিছু প্রশ্ন আছে আপনার কাছে।'
'আমার কাছে!!!'
'হ্যা, শুধুই আপনি দিতে পারবেন এর উত্তর।'
শান একটু চিন্তায় পড়ে গেলো। কি বলছে মেয়েটি!! গলাটা চেনা চেনা লাগছে।
'হ্যা হ্যালো।।'
'বলুন মিস, আমি আপনি সহ সবাই শুনছে আপনাকে, আমরা সবাই আপনার প্রশ্নের উত্তর খুজবো।'
'আচ্ছা কাউকে ভালোবাসা কি অপরাধ?'
'না অবশ্যই নয়। ভালোবাসা পবিত্র ঠিক ততসময় যত সময় না আমরা সেটাকে অপবিত্র করি।'
'তাহলে আমার ভালোবাসা মেনে নিচ্ছেন না কেনো?'
'এক্সকিউজ মি! আমাকে বলছেন!!'
রেডিওতে সবাই শুনছে। শানের কলিগরাও কান দিয়ে শুনছে সবকিছু। সবাইতো অবাক। এভাবে লাইভে এসে প্রপোজ করছে কেউ??
'হ্যা আজ সবার সামনে বলছি আপনাকে। জানেন প্রথমে আপনার গলার মোহে পড়েছিলাম। কিন্তু জানতাম এটা তো শুধু আবেগ। আপনি তো মানুষ অন্যরকমও হতে পারেন। তারপর একজনের সাথে আমার দেখা হতে লাগলো প্রতিনিয়ত। তার ব্যবহার, আমার প্রতি কেয়ার সবকিছুতে আমি আবিষ্ট হয়ে গেছিলাম। একটা মেয়ে ঠিক এরকম একটা কেয়ারিং লোকই চায়। কিন্তু পরে জানলাম আমার সেই দুজন পছন্দের লোক একজনই, আপনি। তারপর কিভাবে আমি আপনাকে ভুলব? বলুন!'
শান বুঝে গেছে মিথিলা ছাড়া এটা কেউ নয়। কিন্তু তার পরিচয় তো এভাবে আনা যাবেনা সামনে। তাই সে বলল,
'যদি সত্যি কাউকে ভালোবাসেন তাহলে সে একদিন না একদিন আপনার হবেই। কিন্তু তারপরও যদি না হয় তবে বুঝবেন তার কোনো কমতি আছে। তাই বলে জীবনকে থামাবেন না। এগিয়ে যাবেন।'
'তাহলে আজ থেকে আমি অপেক্ষায় থাকলাম সে আমার হলে আমি একদিন তাকে পাবই।'
বলেই ফোনটা কেটে গেলো সাথে সাথে।
স্টুডিওর সবাই অবাক। শোয়ের পর অনেকে প্রশ্ন করছে এই বিষয়ে। শান অতি কষ্টে সেসব সামাল দিয়েছে।
রাতে বাসায় ফিরে শান টেবিলে হরেক রকমের রান্না দেখছে। সে বাসায় ফিরলে প্রথম প্রথম তার মা জেগে থাকতো। কিন্তু শান নিষেধ করায় এখন আর কেউ থাকে না জেগে। তাহলে আজ হঠাৎ!! তার মা বাবাও তো বাসায় নেই৷
হঠাৎ রান্নাঘর থেকে পুতুল বেরিয়ে আসলো। পড়নে তার দেয়া শাড়ি। তাকে দেখেই তার কাছে আসলো।
'আজ তোমার জন্য রান্না করেছি নিজ হাতে। চলো খাবে।'
'হাহাহা, আজ এত ঢং কেন হঠাৎ?'
'আজ না এতদিন ছিল ঢং, সেই ভুল গুলো শুধরে নিয়েছি।'
পুতুলের দিকে ভালো করে খেয়াল করলো শান। গলায় আচড়ের দাগ। চোখ আবার লাল হয়ে উঠলো শানের। খবর পেয়েছে একদুই দিনের জন্য সাব্বির জামিন পেয়েছে। তাহলে কি আবার এসেছিল?
'সাব্বির এসেছিল জন্যই বোধহয় এরকম আয়োজন?'
'তুমি কিভাবে জানলে?'
'গলায় তার আসার ইঙ্গিত ছেড়ে গেছে যে তোমার প্রেমিক। জানবো না?'
'আসলে আসলে,,,'
'থাক তোমাদের প্রাইভেট ব্যাপার এসব। আমার থেকে ডিভোর্স নিয়ে তো তার সাথেই থাকবে৷ যদি সে জেল থেকে ছাড়া পায়। হাহাহাহা।'
'দেখো আমার কথা শোনো। সাব্বির এসেছিল। আমার সাথে জোড় জবরদস্তি করার চেষ্টা করতেই তাকে একটা থাপ্পর দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছি আমি। লোক ডাকার ভয় দেখিয়ে। আমি আর ভুল করতে চাই না। বিশ্বাস করো।'
'তোমাকে আবার বিশ্বাস? সেটাও আমি?'
'আমাকে একটা সুযোগ দাও। আমি আর জীবনে ভুল করব না।'
'আমিও তোমাকে সুযোগ দিয়ে জীবনে আর ভুল করতে চাই না।'
পুতুল কেদেই ফেললো। 'আচ্ছা মাফ করবে না কি পরে দেখা যাবে। আমি তোমার জন্য এত রান্না করেছি সেই খাবারটা খাও অন্তত। খাবারের অসম্মান করলে তো আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবে।'
শান ভেবে দেখলো খাবার খেলে কি সমস্যা! তার পর তার খিদেও পেয়েছে। সময় হয়নি রাতে খাওয়ার। তার হাত মুখ ধুয়ে এসে খেয়ে নিল সে। পুতুল বেড়ে দিতে চাইলে সে নিজেই অল্প অল্প করে বেড়ে খেয়ে নিল। খাওয়ার সময় পুতুল একদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে।
খাওয়া শেষ হলে শান রুমে চলে গেলো। পুতুলও একটু পর রুমে আসলো। দেখে শান বেলকনিতে দাড়িয়ে। চুপি চুপি পিছনে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল পুতুল।
সেকেন্ডে ছাড়িয়ে পুতুলকে ধাক্কা দিল শান।
'তোমার হাতের খাবার খেয়েছি বলে ভেবো না তোমাকে মেনে নিয়েছি আর না কোনোদিন নেব। এই অপবিত্র হাত দিয়ে আমাকে ছোয়ার দুঃসাহস দেখাবেনা। খবরদার।'
'তুমি এভাবে বলতে পারলে?'
'আমার চোখে সামনে থেকে দূর হও।'
বলে পুতুলকে রুমের ভেতরে দিয়ে বেলকনির দরজা লাগিয়ে দিল। পুতুল দরজা ধাক্কাচ্ছে কিন্তু শান খুলছে না। পুতুল দরজার অপাশ থেকে বলছে,
'একদিন আমাকে মিস করবে তুমি, এই অপবিত্র স্পর্শ কেই মিস করবে। দেখে নিও।'
শান কোনো তোয়াক্কা করলো না ওর কথার। আজ বেলকনিতেই থাকবে সে। শরীর কেমন দুর্বল লাগছে। বেলকনিতে থাকা চেয়ারে বসতেই চোখে ঘুম আসলো শানের। চোখ যেন খুলতেই কষ্ট হচ্ছে এমন।
-----------
সকালে অনেক লোকের শোরগোলে ঘুম ভাঙলো শানের। অনেক বেলা হয়েছে ঘুম থেকে উঠতে। দুইতালায় বেলকনি তাদের। নিচে তাকিয়ে দেখে অনেকজন তার দিকে তাকিয়ে আগুন আগুন করে চিল্লাচ্ছে।
মিথিলাও তাদের মধ্যে তাকিয়ে আছে অসহায় ভয়ার্ত মুখ নিয়ে। সেও চিৎকার করছে বাইরে আসার জন্য। 'শান শান, কি হয়েছে? আগুন লেগেছে আপনি বাইরে আসুন। তাড়াতাড়ি আসুন। দরজা ভিতর থেকে লক করা। শুনতে পাচ্ছেন? এই যে আমি নিচে। শান??'
'আসছি আসছি।।'
চেয়ার থেকে উঠে সাথে সাথে অন্ধের অভিনয় শুরু করলো সে। নিচে চোখ না দিয়ে উপরে তাকিয়েই হাত নাড়াতে লাগলো । কিন্তু কেমন পোড়া পোড়া আগুনের বিশ্রি গন্ধ ঘর থেকে আসছে।
সেজন্যই কি এরা এরকম করছে!! শান নিজেও ভয় পেল। আগুন আসবে কিভাবে?
বেলকনির দরজা খুলে রুমে গেলো শান। কিন্তু একি? কি দেখছে শান? ফ্লোরে পড়ে থাকা একটা মানুষের টুকরো টুকরো করা দেহে আগুন জ্বলছে। টুকরোর মাঝে মাঝে একটা কাপড়ের ছোট ছোট টুকরোও আছে৷ সেই শিফনের কাপড় যা পুতুল গতকাল পড়েছিল।
শান কি দেখছে নিজেই বুঝতে পারছে না। আগুন প্রায় শেষের দিকে। অনেক আগেই আগুন লাগানো হয়েছে, তাই এখন পোড়া ধোয়াই বেশি।
একটু পাশে খেয়াল করতে দেখলো কাটা দেহের এক টুকরো একটু দূরে পড়েছে বিধায় আগুন লাগেনি।
টুকরোটা একটা মেয়ের হাতের।
শান কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। কিভাবে কি হল?
সে কাটা হাতটির দিকে এগিয়ে গেলো।
ধোয়ায় রুমে শ্বাস নেয়ায় দুস্কর। এর ভিতরেও খেয়াল করে দেখল হাতটি অতি চেনা পরিচিত। হাতটির অনামিকা আঙুলে জ্বলজ্বল করছে কিছু একটা,,,,
একটা আংটি!!
সেই আংটিটা শানের খুব পরিচিত। এটা সেই আংটি যা পুতুলকে বিয়ের সময় পড়িয়ে দিয়েছিল শান।।।।।
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_১০)
লেখক_আয়াশ
এমন নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছে যে লাশ চেনা পর্যন্ত যাচ্ছে না। তবে যে হাতের টুকরা ছিল সেটার ডি এন এ টেস্টে এটা নিশ্চিত করা হয়েছে যে এটাই পুতুল।
শান পুলিশ স্টেশনে বসে আছে। তার ঠিক পাশেই তার দিকে তাকিয়ে আছে দুইজোড়া রক্তলাল চোখ, পুতুলের বাবা মায়ের। যে শশুর শাশুড়ী শানকে মাথায় তুলে রাখতো। বলত তাদের গরিব ঘরে রাজপুত্র জামাই হয়ে এসেছে, সেই দুইজন লোকই আজ খবর পেয়ে এসে শানকে জোড়ে থাপ্পড় দিয়েছে। অন্ধত্ব এর অভিনয় করা শানের চুপ চাপ সব সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
কিছু সময় আগের কথাঃ
সকালে পুতুলের লাশের এমন বিভৎস অবস্থা দেখে শানের মাথা যেন কাজ করছিল না। কি থেকে কি হয়ে গেল। আর সে কিচ্ছু ঠিক পেল না? ঘরেই তো এসব হয়েছে? শানের ঘুম খুব পাতলা। তবে আজ সে কেন কিছুই ঠিক পেল না সেটা নিয়ে বিস্ময় তার মনে। ঘরের ভিতরেই তো পুতুলকে এমনভাবে জবাই করা হয়েছে আর সে কিনা বেলকনিতে থেকেও কিছু করতে পারলো না?
নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে শানের। হাজার হোক বিশ্বাসঘাতক কিন্তু তার স্ত্রী ছিল, একসময় তাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছিল শান। কিন্তু আজ তার কাছে থেকেও সে তাকে রক্ষা করতে পারলো না। শানের মনে হচ্ছিল রাতে পুতুলের বলা শেষ কথা, একদিন সে পুতুলকে মিস করবে, সেই অসতী স্পর্শ মিস করবে। কিন্তু ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি হবে সেটা ভাবতে পারেনি শান।
দরজা খুলে দেয়ার সাথে সাথে পুলিশ প্রবেশ করলো আগে। পিছনে মিথিলা। তার চোখে মুখে ভয়, কষ্ট। পুলিশ ভিতরে সবকিছু যাচাই করার পর শানকে ধরে এনেছে। মিথিলাও এসেছে শানের সাথে। সে সকাল থেকেই মাঝে মাঝে ফুফাচ্ছে। মিথিলা তো আর জানতো না শান বিবাহিত, তার স্ত্রীও আছে। তবে এরকম পরিস্থিতিতে জানবে সেটা কল্পনা করতে পারেনি। যে মিথিলা মামীর ভয়ে বাইরে বেড়োতেই
পুতুলের বাবা মাকে খবর দিলে তারা এসে থানায় পৌছেছে। এসেই শানকে মেয়ের খুনি বলে থাপ্পড়ও মেরেছে। সবাই ধারণা করছে সেই খুনি।
শান মাথা নিচু করে বসে আছে। সে কোনো হিসাবই মেলাতে পারছে না। মিথিলাও একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সে আজ যেন খুব অসহায়। শানের মা বাবাকেও খবর দেয়া হয়েছে।
তখনই থানায় আসলো শানের অফিসের বস। তাকে অনেকেই চিনেন। তাকে দেখে অনেক পুলিশ অফিসাররাই এগিয়ে আসলো। সে এসেই শানের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
'শানকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে?'
'স্যার তার স্ত্রীর লাশ কাটা অবস্থায় তার সাথে বাসায় পাওয়া গেছে। তাই তাকেই প্রাথমিক পর্যায়ে সন্দেহের আওতায় আনা হয়েছে।'
'আচ্ছা অফিসার, আপনি জানেন শান অন্ধ, আর অন্ধ মানুষকি এভাবে সূক্ষ্ম ভাবে লাশ কাটতে পারে? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন সে লাশ কেটে আগুন লাগিয়ে নিজেই বসে থাকবে কেনো? লাশ গায়েব করতো অথবা নিজে পালিয়ে যেত।'
'স্যার আপনার কথায় যুক্তি আছে কিন্তু তিনি তো চুপ আছেন।'
'শান বলো কাল রাত থেকে কি কি হয়েছে।'
শান তার বসের কথা শুনে এবার বলা শুরু করলো কাল অফিস থেকে আসার পর কি কি হয়েছে সেই কাহিনী প্রসঙ্গে।
সব শুনে অফিসার বলল,'আপনার জবানবন্দি রাখলাম আমরা তবে আপনাকে ছাড়া যাচ্ছে না এখনি।'
শানের স্যার বলল,' আচ্ছা তোমার কি কারো উপর সন্দেহ হয়?'
শান সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলল,'হ্যা আছে সন্দেহ আমার।'
মিথিলা এসব শুনছিল। এতক্ষনে সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। 'তাহলে শান তার স্ত্রীর খুনিকে চেনে?'
'কে সে শান?'
'তার নাম সাব্বির। আমি তার কথা পুতুলের অফিসে গিয়ে জেনেছি। পুতুলের অফিসের এক কলিগ তাকেই জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমি বিদেশে থাকাকালে তার সাথে পুতুলের সম্পর্ক হয়। দুইদিন আগে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য চোরাচালানের অভিযোগে৷ আমি শুনেছি তার সাথে আমার স্ত্রীর ঝগড়া কিন্তু অন্ধ মানুষ হয়ে কি করার আছে আমার নিরূপায় হয়ে থাকা ছাড়া?'
পুতুলের মা বাবা ঐদিকে আরো রেগে গেলো৷ 'আমার মেয়েকে মেরে এখন আবার তার নামে বদনাম দিচ্ছিস?'
এর মধ্যে শানের মা বাবাও হন্ত দন্ত হয়ে প্রবেশ করলো। শানের মা শানকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো।
পুলিশ তাদের থামালো।
সবাইকে বাইরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হল। শানের মা বাবাকে শান অভয় দিয়ে বাসায় পাঠালো৷ মিথিলা না চাইতেও চলে গেল। শানের বসের অনুরোধে কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য তখনই পুতুলের সাবেক অফিস ও সাব্বিরকে নিয়ে আসতে যাওয়া হল।
পুতুলের অফিসের সেই কলিগ এসে শানকে চিনতে পেরে বলল ইনি এসেছিলেন। আর পুতুলের সাথে সাব্বিরের কথাও বলল।
এবার সাব্বিরের আসার অপেক্ষা। পুলিশ তাকে খুজতে বেরিয়েছে। তখনই থানায় ডিআইজি সাহেব আসলেন। তিনিও শানের বসকে চিনতেন। তারা কথা বলা কালেই শানের বস তাকে পরিচয় করিয়ে দিল ডিআইজি সাহেবের সাথে।
'কিহ তুমি সেই আরজে শান?'
ডিআইজি সাহেব শানের পরিচয় শুনে বললেন।
'তুমি জানো আমার পুরো পরিবার তোমার শো দেখে, কিন্তু এসব কি হল বাবা?'
সব শোনার পর তিনি বললেন,'হুম, কিন্তু তুমি সেসময় ঘরে উপস্থিত ছিলে আর একজন মানুষকে এতটা যন্ত্রণা দিয়ে মারলে চিৎকার তো করবে, সেটাও তুমি শোনোনি?'
শান বলল সে ঘুমিয়ে ছিল আর আশ্চর্যজনক ভাবে তার একটু ঘুমও ভাঙেনি যদিও তার ঘুম পাতলা।
এরই মধ্যে পুলিশ এসে জানিয়েছে সাব্বিরকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না আর তার মোবাইলও বন্ধ। সাব্বির গত কালই জামিন নিয়েছে আর জামিনের শর্ত মোতাবেক তার সব সময় শহরের মধ্যে এবং যোগাযোগ এর আওতায় থাকার কথা ছিল। সে সেটা ভঙ্গ করেছে। আবার পুলিশ এটাও বের করলো যে সাব্বিরকে যেদিন হাতে নাতে ধরা হয়েছিল সেদিন সিসিটিভি ক্যামেরায় পুতুলকে তার কাছে যেতে দেখা গেছে এবং তার হাতে সেই ব্যাগ ছিল যেটায় ড্রাগস পাওয়া গেছে। সাব্বিরের পুতুলকে মারার কারনও পরিষ্কার হয়ে গেল।
সবার কাছে সব কিছু শোনার পর শানের উপর থেকে অনেকটাই সন্দেহ সরে সাব্বিরের উপর পড়েছে।
শানের বস বলল শানকে কি জামিন দেয়া যাবে এখনই। ডিআইজি সাহেব প্রথমেই শানের অন্ধত্ব দেখেই ভেবে নিয়েছিল শানের মত একজন চোখে না দেখতে পাওয়া লোকের এরকমভাবে মারতে পারার কথা নয়। তারপরও ফরমালিটি পূরণ করে
জামিনের ব্যবস্থা করা হল শানের।
বাড়িতে পৌছতে অনেক সময় লেগে গেলো শানের। আসার সময় পুতুলের মা বাবাকে থানায় বসে থাকতেই দেখেছে সে।
শানের বস শানকে বাড়ি দিয়ে গেল। রাত প্রায় দশটা বেজে গেছে। বসকে বিদায় দিয়ে লাঠির সাহায্যে সদর দরজার কাছে গিয়ে খুলতেই ভিতরে যা দেখলো তাতে শানের চোখ ছানাবড়া। এ কি দেখছে সে???
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_১১)
লেখক_আয়াশ
বাসার দরজা খুলে দেখে শানের মাকে মিথিলা
দুই হাতে আগলে নিয়ে বসেছে। শানের বাবা পাশে থেকে বাতাস করছে। (প্রশ্নপর্বে মাত্র তিনজন সঠিক উত্তর দিয়েছেন। বাকি সবাইকেও ধন্যবাদ এত ক্রিয়েটিভ চিন্তা ভাবনা করার জন্য)
মনে হয় ছেলের খবর শুনে অতিরিক্ত প্রেশারে এমন হয়েছে। শান দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মা বলে উঠল।
সাথে সাথে মিথিলা সহ সবাই শানের দিকে তাকালো। শান বুঝল ব্যাপারটা৷ সে লাঠি নিয়ে বলল,
'মা বাবা কই তোমরা? দেখ আমি এসেছি।'
শানের মা ছেলের আওয়াজ শুনে ছুটে এসে শানকে জড়িয়ে ধরল৷
'বাবা, তুই এসেছিল, আমি তো মনে করেছিলাম,
'মা শান্ত হও, আমার কিছু হবেনা। বাবা কোথায় তুমি? মা এমন করছে কেনো?'
'আর বলিস না, তোর জন্য কেদে কেটে একাকার মাথা ঘুরে পড়েই গেছিল।' এই মেয়েটি না থাকলে কি যে হত!!'
শান মিথিলা কে দেখেও না দেখার ভান করে বলল,'কোন মেয়েটি?'
'মিথিলা, পাশের বাসায় থাকে। তোর সব কথা বললাম, পুতুলের তোর উপর আমাদের উপর করা ব্যবহারের কথাও।'
শান এতসময় মাকে জড়িয়ে ধরে ভাবছে, মিথিলা সব জেনেও তার বাসায় আছে? সে বিবাহিত জানার পরও!!
শানের মাকে সে সোফায় বসালে তার মা জিজ্ঞেস করল, 'বাবা তোকে ছাড়ল কিভাবে?'
শান তখন সব কথাই বলল৷ সে সাব্বিরের কথা বলেছে, পুতুল কতদিন থেকে অফিস যায়না সব।
সাব্বিরের সাথে তার মেলামেশা।
সব শুনে শানের মার চোখ লাল হয়ে গেছে।। 'বাবা আনি আগেই সন্দেহ করেছিলাম। এই কালনাগিনীকে৷ এতদিন আমাদের মিথ্যা বলেছে অফিসে যাওয়া নিয়ে!!'
'শানের মা ওর ব্যাপারে আর বলো না। সব তো বুঝাই যাচ্ছে যে ওই সাব্বির ওকে মেরে পালিয়েছে।'
'হুম।'
মিথিলা এক নাগাড়ে তাকিয়ে আছে শানের দিকে৷ হয়ত তার ভালোবাসার মানু্ষটা কত কষ্টে আছে সেটাই দেখছে।
'মা একটু বসো আমি রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসি।'
'বাবা রুমে তো সিল করে দিয়ে গেছে পু'লিশরা।ওইখানে ঢুকা যাবে না। আমাদের রুমে যা।'
'অহ।'
'চল তোকে দেখিয়ে দেই। আমাদের রুম তো চিনবি না না দেখলে।'
'না আন্টি আমি নিয়ে যাচ্ছি।' মিথিলা উঠে বলল।
শানের মা বাবার মিথিলাকে খুব পছন্দ হয়েছে। পিচ্চি মেয়ে একটা কিন্তু চোখে মুখে কি মায়া। শানের মায়ের বারবার মনে হচ্ছে ইসস যদি পুতুলের আগে এই মেয়েটি পেতাম!!
শান কি করবে? সে তো বলতেও পারছে না যে সে দেখতে পায়!
অগত্যা মিথিলা শানকে ধরে নিয়ে গেল। রুমে নিয়ে গেলেই শান জিজ্ঞেস করল,'তুমি এখানে কেনো মিথিলা?'
'যাকে ভালবাসি তার অসময়ে এগিয়ে আসব না?'
'এরপরও বলছো ভালোবাসো? এত কিছু হওয়ার পরও? আমি বিবাহিত মিথিলা, এজন্যই তোমাকে মেনে নেইনি।'
'আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমি আপনাকে ভালোবাসি, যদি আপনি আপনার বউকে ভালবাসতেন আমি নিজে সরে যেতাম। কিন্তু এখন তো সে নেই। আর তার প্রতিও আপনার ভালবাসা থাকার কথা নয় কারন দিনের পর দিন সে আপনাকে ঠকিয়েছে।'
'তোমার কি একটুও সন্দেহ হচ্ছে না? যদি আমি নিজেই খু'ন করি?'
মিথিলা শানের কথায় একটু চমকে উঠল। শান জবাবে মুচকি হাসল।
মিথিলা আরো কিছু বলবে তখনই শানের বাটনওয়ালা ছোট মোবাইল ফোন টা বেজে উঠল। শান ফোন ধরে কানের কাছে নিল,
'হ্যালো'
-----
'হ্যা বলুন অফিসার।'
----
'কিহ!!'
-----
'আরেকজনের লা'শ পাওয়া গেছে?'
----.
'কার!!'
জবাবে কি বলল অপাশ থেকে শোনা গেল না কিন্তু শানের হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো। মিথিলাও পাশে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে।
আবার তখনই রুমে যারা প্রবেশ করলো তাদের দেখে শান মিথিলা দুজনই চমকে উঠল।
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_১২)
লেখক_আয়াশ
'বেহায়া মেয়ে, বাড়িঘর ছেড়ে এখানে পড়ে আছিস?' মিথিলার মামীর কর্কশ আওয়াজে ঘর কেপে উঠল, সাথে মিথিলাও। শান দেখলেও কিছু বলতে পারছে না।
'মা মা মামী!'
'চুপ কর হতচ্ছাড়ি। তোর বাপ মাকে খেয়েছিস এবার আমাদের মান সম্মান ডুবাতেও উঠে পড়ে লেগেছিস?'
'আহা, শান্ত হও, বাসায় যাই তারপর না হয় বলব।' মিথিলার মামা একটু শান্ত করার জন্য কথাটা বলল তার মামীকে।
'তুমি চুপ থাক। তোমার আস্কারাতেই আজ এই অবস্থা।'
শানের মা বাবাও ততসময় চলে এসেছে।
'দেখুন আপনারা ভুল ভাবছেন। আজ কি হল সেটা তো শুনেছেনই। শানের মা রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই মিথিলা বাসায় এসেছে।'
শানের বাবা মিথিলার মামীকে বুঝাতে চেষ্টা করল। কিন্তু মনে হয় না কাজ হল তেমন একটা। মিথিলার মামী মিথিলার হাত ধরে জোড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আর বলছে' চল তোর সব পাখনা আজ কেটে দিব আমি।' মিথিলা চোখের জল ফেলছে, যাওয়ার সময় একবার শানের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে চলে গেলো।
শানের মনে একটু খারাপ লাগলো। মেয়েটা তার জন্যই এত কিছু করল আর বিনিময়ে সে তাকে কিছুই দিতে পারলো না, তার হয়ে একটা কথাও বলতে পারলো না।
কিন্তু এখন শানের মাথায় অন্যকিছু চলছে। নিচের দিকে তাকিয়ে পড়ে থাকা ফোনটা দেখতেই সেটা আবার মাথায় আসলো।
পুলিশ স্টেশনে বসে আছে শান। তার পাশে তার বসও আছে আর পুলিশ অফিসাররা। তাদের সামনে একটা লাশ শোয়ানো আছে। সেদিকেই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে শান।
কিছুক্ষন আগে পুলিশ তাকে ফোন করে একটা লাশ পাওয়ার কথা বলেছিল। লাশটা আর কারো নয়, সাব্বিরের!!! তাকে মাথায় অনেক ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে মারা হয়েছে।
খবরটা শুনে শানের মাথায় ৪৪০ ভোল্টের শক লেগেছিল।
'সাব্বিরকে কে মারবে?'
শানের বসের কথায় শানসহ সব পুলিশ অফিসার তার দিকে তাকালো।
'না মানে আমি বলছি যে এত সময় তো আমরা সন্দেহ করছিলাম সাব্বিরই পুতুলকে মেরে পালিয়েছে তাহলে?'
শান অন্ধের ভাব করে মাথা নিচু করে আছে। এখন মনে হয় সন্দেহ আবার তার দিকেই গেল। কি থেকে কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতেছে না।
ডিআইজি সাহেব বলল,'শান তুমি টেনশন করো না। আগে লাশের পোস্ট মর্টাম হোক, তারপর না হয় দেখা যাবে।'
'হুম।' এই ছোট্ট শব্দটি ছাড়া কিচ্ছু বেড়লো না শানের মুখ দিয়ে।
সেইদিন রাতটা অনেক কষ্টে পার হয়েছে শানের। তার মা বাবা তাকে স্বান্তনা দিয়েছে যে নির্দোষদের উপরওয়ালা কোনো ক্ষতি হতে দিবেন না আর পুতুল নামক কালনাগিনী গিয়েছে তো ভালই হয়েছে।
শান স্টুডিওতে কাজটা রাতের বদলে দিনে নিয়েছে। এখন তার লাইভ শো সকালের শুরুতেই টেলিকাস্ট হবে। গতকাল রাতেই তার সাথে এ নিয়ে বসের কথা হয়েছে। সবাই শুধু আর যে শানকে চায়। তাই সকাল বেলাই সে স্টুডিওর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। কাজ থামাবে না শান সে যাই হয়ে যাক না কেনো। কিন্তু যাওয়ার পথে ডিআইজি সাহেবের নির্দেশে পুলিশ স্টেশনে গেল। লাশের পোস্ট মর্টাম নাকি ইতিমধ্যে হয়েছে। আর সাব্বিরকে গতকাল দুপুরের দিকে মারা হয়েছে। একটু আশার আলো দেখলো শান। কারণ তখন তো সে পুলিশ স্টেশনে ছিল। যদিও পুতুলের খুন নিয়ে এখনো মামলা তার উপরই আছে তবুও উটকো একটা ঝামেলা থেকে তো বাচলো।
আরো একটা ইনফরমেশন পেলো শান। আততায়ী বামহাতী ছিল। সেই মোটা ভারী বস্তু দিয়ে বামহাতে সাব্বিরকে প্রহার করা হয়েছে।
শান ভাবতে লাগলো তার চেনাজানা কেউ বামহাতী আছে নাকি। কিন্তু সে নিযে বাদে কাউকেই খুজে পেলো না। যদিও এখন তার ওই অভ্যাস নেই, তবে আগে সে সামান্য কাজেই ঝুলের ভিতর বাম হাত দিয়ে ফেলত। এই নিয়ে পুতুলের সাথে অনেক ঝগড়াও হয়েছে৷ পুতুল তার বামহাত ব্যবহারের স্বভাব বাদ দিয়ে তবে ছেড়েছে।
মাথায় আবারও সেই পুতুলের কথা আসছে! ভাবতেই গা রিরি করে উঠলো শানের৷ না আর সে তার কথা ভাববে না, যে শানকে ঠকিয়ে এসেছে প্রতিনিয়ত।
কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করছে শান। পুতুলের মা বাবাকে আর দেখা যায়নি থানায়। মনে কৌতুহল জাগতেও সেটা কাউকে জিজ্ঞেস করেনি। কিভাবেই করবে! সে তো দুনিয়ার কাছে অন্ধ।
স্টুডিওর কাজ শেষে দুপুরে বাসায় ফিরবে তখনই বাড়ি ঢোকার ঠিক আগ মুহুর্তে মিথিলার মামা ছুটে আসলো।
'বাবা, আমার ভাগ্নীটাকে বাচাও বাবা। আমার মিথিলাকে বাচাও।'
'কেন কি হয়েছে মিথিলার আঙ্কেল!! এমন করছেন কেন?'
'বাবা শান,, মিথিলা,,,,,,,'
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_১৩)
লেখক_আয়াশ
'কি হয়েছে আঙ্কেল? কি হয়েছে মিথিলার?'
'কাল এখান থেকে যাওয়ার পর ওর মামী ওকে মেরেছে, আমি কি অপারগ মামা! শত চাইতেও ঠেকাতে পারিনি। আজ সকাল থেকে মিথিলার জ্বর, তার মামী মানে আমার স্ত্রী তার দুঃসম্পর্কের এক ভাইয়ের ছেলেকে মিথিলার সাথে বিয়ে দেবে বলে আজ বিকেলেই আসতে বলেছে। আর মিথিলাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছে। হয়ত কিছু সময় পর চলেও আসবে সেই ছেলে। কিন্তু ছেলেটা ভাল না বাবা, অনেক খারাপ।'
'আংকেল তো এক্ষেত্রে আমি কি করতে পারি? এটা কি আপনাদের পারিবারিক ব্যাপার না?'
'মিথিলা তার মনের সব কথা আমাকে বলে। দেখো বাবা মেয়েটি বাচ্চা, বুঝে না এখনো অনেক কিছু।
তোমাকে নিজের মনে বসিয়ে ফেলেছে বাবা। আমাকে অনেক আগেই বলেছিল। কিন্তু,,,,'
'কিন্তু আপনি তো জানেন আংকেল আমার কি অবস্থা। মিথিলার সামনে এখনো পুরো জীবন পড়ে আছে।'
'কিন্তু বাবা তুমি কিছু না বললে আজকেই ওর জীবন অন্ধকার হয়ে যাবে। তুমি কিছু একটা করো। মিথিলা সকাল থেকে তোমার কথাই বলছে জ্বর নিয়ে।'
'আংকেল মিথিলা বাচ্চা মেয়ে আর আমি বিবাহিত! অন্ধ! তারপরও!"
তখনই মিথিলার মামার ফোনে একটা কল আসলো।
ফোন পকেটে রেখেই সে বলল,'বাবা ছেলেটা নাকি চলে এসেছে। তুমি কিছু একটা কর। আমি ততসময় সামলাই ওদিকে।'
শান পড়ল মহাবিপদে৷ যে মেয়েটা তার পরিবারের জন্য তার জন্য এত কিছু করল, তাকে কিভাবে ক্ষতি হতে দেবে!!! কিছু একটা ভেবে ফোন ভের করল শান।
------------
শাড়ি পড়িয়ে সোফায় বসিয়ে রাখা হয়েছে মিথিলাকে, শরীরে জ্বর, হালকা কাপছে মেয়েটি। কিন্তু মামীর ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না। গালে কালসিটে দাগ হয়ে আছে। কপালেও রক্ত জমাট হয়ে আছে। কালকে মারার সময় তাকে ধাক্কা দিয়ে
ফেলে দেয়ায় কপাল দেয়ালে লেগেছিল।
এই অবস্থায়ও সে বুঝতে পারছে সামনে বসে থাকা ছেলেটি তাকে লালসার নজরে দেখছে। আগেও এই ছেলেটিকে দেখেছে সে। তার মামীর আত্মীয়। আগেও এসে মিথিলাকে বাজে নজরে দেখেছে। শরীর রিরি করে উঠছে মিথিলার। সে ভেবেই নিয়েছে তার মামা কিছু না করলে বিয়ে হওয়ার আগেই সে কিছু একটা ঘটিয়ে দেবে। হয়ত এ জীবনে আর ভালোবাসা পাওয়া হবে না তার।
কাজীকেও ডেকে আনা হয়েছে। ওই বখাটে ছেলেটি সামনে বসে পাংশুটে হাসি দিচ্ছে।
'কাজী সাহেব কাজ শুরু করুন।' মামীর কড়া নির্দেশ।
কাজী বিয়ের কাজ শুরু করার জন্য ছেলেকে মিথিলার পাশে বসতে বলল। ওই বখাটেটা মিথিলার পাশে বসতে যাবে ঠিক তখনই শান তার অফিসের বস ও ডি আই জি স্যারকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। ডি আই জি স্যারের পিছনে আরো দুই তিনজন পুলিশ।
তারা ঢোকা মাত্রই রুমের সবাই উঠে পড়ল।
'আপনারা!! এখানে?' মিথিলার মামী বিরক্ত সহকারে বলল।
ডি আই জি সাহেব কড়া গলায় বললেন,'শান জানিয়েছে এখানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে!'
এতসময় মাথা নিচু করে থাকলেও শানের আসার কথা শুনে মিথিলা উপরে তাকালো। মনে এক সেকেন্ডেই অনেক সাহস সঞ্চার হয়ে গেল যেন তার। চোখে মুখে আশার আলো ফুটে উঠেছে।
'কি বলছেন আপনারা?' শানের দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে মিথিলার মামী বলল।
'সেটা যাচাই করতেই আসা আমাদের। এই ছেলে তোমার নাম কি? কি কর তুমি?' ডি আই জি সাহেব বখাটে টা কে জিজ্ঞেস করল।
'জি রাতুল।'
'কি কর?'
'জি জি,,,,, ' ভাতিজার তোতলানো দেখে মিথিলার মামী বলল,
'এ আমার ভাইয়ের ছেলে। কেন কি হয়েছে?'
'কিছুনা। তবে আপনার ভাগ্নীকে যে এই ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছেন, মেয়ের অনুমতি আছে কি?'
'আছে, থাকবেনা কেন?'
'আচ্ছা দেখি।'
ডি আই জি সাহেব মিথিলার কাছে গেল,
'মা বলো তুমি। তুমি এ বিয়ে করতে চাও?'
মিথিলা উপরের দিকে চাইলো তার মামী চোখ লাল চোখে তার দিকে তাকিয়ে ইশারা করছে হ্যা বলতে। কিন্তু পাশে শানের দিকে তাকালে দেখলো শান নিচে তাকিয়ে আছে। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে মিথিলার মনে সাহস জাগলো।
'হ্যা স্যার। এই বখাটেটার সাথে আমাকে জোড় করে বিয়ে দিচ্ছে। এর জন্য মেরেছেও আমাকে।'
উপরের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সময় শাড়ি পরিহিতা মিথিলার ঘোমটার আড়ালে মুখে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন দেখে ডিআইজি স্যার সহ সবাই চমকে উঠলেন। শান সব দেখেও কিছু বলতে পারছে না। আজ নাটক করার জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজে রুখে দাড়াতে পারছে না বলে নিজেরই রাগ হল। ভাল থাকলে আজ মিথিলার সাথে বিয়ে হওয়া ছেলেটাকে দিত দুই ঘা।
ডিআইজি সাহেব সাথে সাথে অর্ডার দিলেন,'নারী নির্যাতনের অপরাধে এর মামা মামীকে গ্রেফতার কর। এই ছেলেটিকেও এর মামীর সাথে থানায় নাও।'
ভাগ্যিস মিথিলার মামাতো বোন তার নানার বাড়িতে গেছিলো নাহলে সেও আজ আটক হত।
হ্যান্ডকাফ পড়াতে যাবে তখনই শান তখন বলে উঠল,'স্যার এনার মামার কোনো দোষ নেই, বরং এনার মামাই আমাকে দিয়ে আপনাকে বলিয়েছে।'
মিথিলার মামী রাগী চোখে নিজের স্বামীর দিকে তাকালো। যেন চোখ দিয়েই ভষ্ম করে দেবে। কিন্তু মিথিলার মামার আজ একটুও দুঃখ নেই। সে নিজে সাহস জোগাতে না পারলেও আজ সে মৃত বোনের মেয়েটির সাথে অন্যায় হতে দেয়নি।
'পোড়ামুখী এতদিন আমাদের খেয়ে পড়ে আমাদের পিঠেই ছুড়ি ঢুকালি? বিয়ে ভেঙেছে না তোর? দেখ আর কখনো তোর কপালে সুখ আসবে না।' মিথিলার মামী নিজের রাগ সামলাতে না পেরে বলছে।
'ও তোমার খায়নি পড়েনি, আমার ভাগ্নী আমার খেয়েছে, আমার পড়েছে। আর বিয়ের কথা বললে, সেটা এখনি হবে।'
মিথিলার মামার কথায় সবাই অবাকের চরম পর্যায়ে।
''হ্যা আজই ওর বিয়ে হবে সেটাও শানের সাথে।'
মিথিলার গাল লাল হয়ে আসছে। সে আবার মাথা নিচু করে নিয়েছে।
'কি বলছেন আংকেল, আপনার কথায় আমি এখানে বিয়ে ঠেকাতে এসেছি, কিন্তু বিয়ে এটা করা কিভাবে সম্ভব?'
'কেন সম্ভব নয় বাবা?' পিছন থেকে শানের মা বলে উঠল। তার পাশে তার বাবাও রয়েছে।
'মা, তুমি?' শান মায়ের আওয়াজ শুনে বুঝেছে এমন ভাব করে বলল৷
'হ্যা আমি আর তোর বাবাও এসেছে। মিথিলার মামা আমাদের আজকেই জানিয়েছে। বাবা মেয়েটা তোকে খুব ভালবাসে। আমরাও বুঝেছি। তুই জীবনটাকে আরেকটা সুযোগ দে।'
'কিন্তু মা আমি অন্ধ, বিবাহিত ছেলে। তাছাড়াও আমার নামে এখনো মামলা আছে থানায়। এ অবস্থায়!! স্যার আপনিই বলুন।'
ডি আইজি স্যার বলল,'আমি আর কি বলব, যদিও মামলা চলচজে তোমার নামে, তবে তুমি নির্দোষ প্রমান হওয়ার আগেই যদি সে তোমাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে আমাদের কি করার। এখন কনে রাজি হলেই হয়। নাকি বলিস বন্ধু?'
'শান, তুমি চিন্তা করো না। আমরা তোমাদের কিচ্ছু হতে দেব না। আমাদের বিশ্বাস তুমি নির্দোষ। আর আমি কি আমার চ্যানেলের স্টারকে সহজে ছাড়বো নাকি? তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। এখন শুভ কাজে দেরি করো না তো।' শানের বস এতসময় চুপ থাকলেও এখন মুখ খুলল।
'তুমি আমার মেয়ের বয়সী তাই বলছি, মা তুমি রাজি তো শানকে বিয়ে করতে?' ডি আইজি সাহেব মিথিলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল।
মিথিলা লজ্জায় মাথা নিচে নামিয়েছে। তার লজ্জা পাওয়া দেখে সবাই বুঝে গেছে।
শানের মা বাবা শানকে জোড় করে বসালো। মিথিলার পাশে। মিথিলার মামী আর ওই ছেলেকে থানায় যাওয়ার আগে বিয়ের দর্শক হতে হল না চাইতেও। আর কাজী! পড়াতে এসেছিল একজনের সাথে বিয়ে পড়ালো আরেকজনের সাথে। তবে মামার বাড়ি ছাড়ার সময় মিথিলা ডি আইজি সাহেবকে বলল তার মামীকে ছেড়ে দিতে। সে তার নতুন জীবন কারো অভিশাপের সাথে শুরু করতে চায় না।
--------
শানের মা বাবার পাশের ঘরটায়ই তাদের থাকার জায়গা করা হয়েছে। পাশাপাশি বসে রয়েছে শান আর মিথিলা। দুজনেই চুপ। কেউ বুঝতে পারছেনা কি করবে, কি বলে শুরু করবে। শানই বলল
'মিথিলা, আমি সত্যিই আমার এ জীবনের সাথে তোমাকে জড়াতে চাইনি। আমার কোনো নিশ্চয়তা নেই।'
মিথিলা হঠাৎ শানের হাতের উপর নিজের হাত রাখলো।
'আমি জানি আপনি কি পরিস্থিতিতে আছেন। আমি শুধু এই বিপদে আপনার পাশে দাড়াতে চাই। তাছাড়া নিজে থেকে কোনোদিন আপনার সামনে কিছুর আবদার করব না আমি।'
শান চশমার আড়ালেই তার নববশূর দিকে তাকালো। মুখে মারের কালসিটে দাগ, কপালে লাল রক্তজমাট বাধা, তারপরও যেন কি মায়াবী লাগছে মেয়েটিকে।
'তুমি এত ভাল কেন? একজন স্ত্রী হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত আসামীকে এতটা বিশ্বাস করছো এখনো?'
'আমার আপনার উপর নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস। আপনি কারো খুন করতে পারেন না।'
'তারপরও আমার মত বিবাহিত ছেলেকে বিয়ে করলে? তুমি আরো অনেক ভালো কিছু ডিজার্ভ করতে মিথিলা।'
'আর যাই হোক আমার চার বছরের ভালোবাসাকে কিভাবে হারাতাম!!' বিরবির করে বলল মিথিলা।
'কি বললে?'
'কই কই কিছু না তো । বলছি মিথিলা মিথিলা কি? মিথু বলবেন। শুধুই মিথু। আজ থেকে আমি আপনার বউ। ভুলবেন না।'
'কি আর বলব তোমাকে। তোমার আমার মা বাবার জেদের সামনে আজ পরাস্ত হলাম। যাই হোক আমার কিছু সময় দরকার৷ কিন্তু কথা দিচ্ছি আমি৷ তোমার সাথে কখনো খারাপ কিছু হতে দিব না। তোমার পাশেই থাকব। দোয়া করো যেন তোমার বিশ্বাস রাখতে পারি।'
'আপনার উপর বিশ্বাস না থাকলেও আমার ভালোবাসার উপর বিশ্বাস আছে।'
'মিথিলা, সরি মানে মিথু আমি একটু বাইরে খোলা বাতাসে যাচ্ছি। একটু পরেই আসব। তুমি ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে যেও কেমন? তুমি অসুস্থ, জ্বর এখনও যায়নি, রাত জাগা ঠিক হবে না।'
'কেন বাইরে কেন আবার!!'
'একটু মাথা ধরে আছে। তাই খোলা বাতাসে যাচ্ছি। দূরে নয় বাড়ির বাইরেই, এই যাব আর আসবো।'
'আচ্ছা, তাড়াতাড়ি আসবেন।'
---------
বন্ধ সিল মারা ঘরের মধ্যেই চুপিসারে প্রবেশ করলো শান। রুমটি অন্ধকার। এক দুমট গন্ধ বেড়চ্ছে এখনো রুম দিয়ে।
আস্তে আস্তে অন্ধকার রুমেই প্রবেশ করলো শান।
পুলিশরা এ ঘরে ঢুকতে নিষেধ করেছে। তবুও আজ নতুন কারো সাথে জীবন শুরু করার আগে এ রুমে তো তার আসতেই হল।
রুমের জানালা দিয়ে চাদের আলো পড়েছে রুমটিতে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে শান।
কত স্মৃতি পুতুলের সাথে এ রুমে। ভালোবেসে কত সময় পাড় করেছে। কিন্তু কে জানত এক বিশ্বাসঘাতক সে। নিজের বদলা নেয়ার আগেও চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে। এক্ষেত্রেও বিশ্বাসঘাতকতা।
আয়নায় নিজেকে দেখে তাচ্ছিল্য হাসছে শান। আজ সে সুস্থ হতেও অন্ধের নাটক করতে হচ্ছে। আজ দুনিয়ার সবার সামনে সে এরকম শুধুমাত্র সেই ছলনাময়ীর জন্য। আজ আবার তার কাধে আরেকটা নিষ্পাপ মেয়ের ভার এসে পড়ল। কি থেকে কি করবে সে!!
নিজের বিষণ্ণ জীবনের কথা চিন্তা করতে করতে আয়নার সামনে হাটুগেরে বসে পড়ল শান। চোখ থেকে দুফোটা লোনাজল বেড়িয়ে পড়ল।
হঠাৎ পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে সামনে আয়নায় তাকালো শান।
'এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে গেলে?? হাহাহা'
গলার আওয়াজ পেয়ে প্রচন্ড মাত্রায় চমকে উঠল সে।
এ কি দেখছে চোখের সামনে!!! এ তো পুতুল!!!!!
পুতুল এখানে কিভাবে?? সে তো মরে গেছে! তার দিকে তাকিয়েই বিশ্রিভাবে হাসছে পুতুল। শানের চোখ কি ভুল কিছু দেখছে? না এটা তো পুতুলই। কিন্তু কিভাবে?
'আমার থেকে ছুটকারা পাবে না তুমি, যতই চাও, হাহাহা।'
বিশ্রি হাসি ছড়িয়ে পড়ছে ঘরের চারিদিকে।
কাধে রাখা পুতুলের হাতটির উপর কাপা কাপা হাতে নিজের হাত রাখলো শান।
হাতের স্পর্শ পেতেই অবাকের আরো চরম মাত্রায় উঠল।
পাশে চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখলো এটা তো হাত নয়!!! কঙ্কাল!!
মানুষের রক্ত মাংসের কোনো চিহ্ন নেই। শুধু কঙ্কালের হাত। পুতুল তখনো তার দিকে তাকিয়ে হেসেই যাচ্ছে।
প্রচন্ড ভয় হতে লাগলো শানের। সে কোনোদিনও এসব ভুত প্রেতে বিশ্বাসী নয়। কিন্তু নিজের সামনে এত কাছে এই দৃশ্য!!
সামনের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ হাত দিয়ে চুলকালো ভাল করে শান। এবার আবার পিছনে তাকালো। কিন্তু নাহ, এবার তো কেউ নেই!! আশে পাশে ফাকা। একদম চুপচাপ। কেউ নেই আশে পাশে।
তাহলে কি ভুল দেখলো? কিন্তু মাত্রই তো সামনে ছিল পুতুল? এত তাড়াতাড়ি কোথায় গেল? হেলুসিনেশন হচ্ছে নাকি তার!!!
কিচ্ছু ভাবতে পারছে না সে। তার সাথে কি হচ্ছে? আশে পাশে সব জায়গায় দেখলো, চাদের আলোতে সব ভালই দেখা যাচ্ছে। এবার গিয়ে সাহস করে ঘরের লাইটটাও জ্বালালো। না কিচ্ছু নেই। রুমের সব কিছু ঠিক ঠাক। কালকে যেমন ছিল ঠিক তেমনই আছে। তার মানে কল্পনাতেই দেখেছে এসব। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব!! রুমের লাইট জ্বলার কথা মনে পড়তেই সাথে সাথে আবার বন্ধ করলো কারণ কেউ তাকে এ ঘরে দেখলে সন্দেহ করবে, ভাববে সেই খুনী।
নিজের কল্পনা ভেবেই উপরের রুম থেকে নিচে আসলো শান।
নিজের রুমে এসে দেখলো মিথিলা ঘুমিয়ে পড়েছে ওইভাবেই। পরণের শাড়ি এলোমেলো। দেখে শান মুচকি হাসলো। মেয়েটা বোধহয় শাড়ি সামলাতেই পারে না। নিজেই তার শাড়ির আচল দিয়ে তাকে ঢেকে দিল। মুখের উপর ডিম লাইটের আলো পড়েছে। আঘাত গুলোর উপর হালকা হাত ছুয়ে দিল শান। কতটা কষ্টই না পেয়েছে বেচারি তার জন্য।
না আর এই মেয়েটিকে কষ্ট পেতে দেয়া যাবে না। খুব শীঘ্রই তার সব সত্য সামনে তুলে ধরবে, মিথিলাকে সব জানাবে সে। এসব ভাবতে ভাবতেই মিথিলার পাশে শুয়ে তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো ধীরে ধীরে।
সকালের আলো চোখে লাগতেই ঘুম ভাঙলো মিথিলার। দেখলো পাশে শান তার মাথায় হাত দিয়ে তার মুখোমুখি শুয়ে ঘুমিয়ে আছে।
সে দৃশ্য দেখেই মিথিলার ঠোটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।
'আপনাকে অনেক ভালোবাসি আমি। আপনার চেয়েও আপনাকে আমি বেশি চিনি। আপনি যতটা না নিজের ব্যাপারে জানেন তার থেকেও আমি বেশি জানি। ঠিক এতটাই ভালোবাসি আপনাকে।কখনো ছাড়বো না আপনাকে। কখনো না।
যে তাসের ঘরে আমি আপনি বন্দী হয়েছি সে ঘরটা আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে আজীবন আগলে রাখব প্রিয়।'
কথাগুলো মনে মনে বলে শানের খুব কাছে এসে তার কপালে ওষ্ঠ ছুইয়ে দিল মিথিলা, প্রথম চুমু তার ভালোবাসাতে।
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_১৪)
লেখক_আয়াশ
মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখছে শান।
শানকে হাত পা বেধে রাখা হয়েছে এক বন্ধ ঘরে। চাইলেও নড়তে পারছে না। প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়েছে বেচারার।
হঠাৎ বদ্ধ ঘরের দরজাটা খুলে গেলো। শান ভাল করে খেয়াল করে দেখলো এটা কেউ না পুতুল!!!
পুতুল তার গলায় হাত দিয়ে চেপে ধরলো আচমকা। শানের হাত পা বাধা থাকায় সে কিছুই করতে পারছে না। সে দেখলো পুতুল তার হাতটা শানের দিকে এগোচ্ছে। আর হাতটায় মাংস চামড়া কিছু নেই। শুধু কঙ্কালের মত হাড়।
মুহুর্তেই হাতটি শানের গলা জোড়ে চেপে ধরল। হাতে যেন অ'সুরের শক্তি! শ্বাসকষ্ট শুরু হল শানের।
'ছাড়ো আমাকে, ছাড় বলছি।'
'হাহাহাহা আমার মৃ'ত্যু বিফলে যাবে কেন? তুই কি ভেবেছিস? তাকে আমি ছেড়ে দিব? আমি মরেছি তোকেও মা"রবো। হাহাহাহাহ'' সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ওই কঙ্কালের মত হাত দিয়ে চেপে ধরল শানের গ'লা। এখনি মরে যাবে শান এমন মনে হচ্ছে।
'না না নায়ায়ায়ায়াহহহহ!!!'
রাত শেষের দিকে,আযান ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।। বিছানা থেকে ধরফরিয়ে উঠল শান। কি ভয়ানক স্বপ্ন!! তখনই পাশে থেকে মিথিলা সাথে সাথে শানের হাত আগলে ধরল তার কোমল হাত দুটি দিয়ে।
'কি কি হয়েছে আপনার?'
'হ্যা? না না কিছু না।'
'খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন? তাই না?'
'আসলে আসলে খুব খুব বাজে।'
'একটু বসুন, ' বলেই মিথিলা ঘরের পামি রাগা জগ থেকে পানি গ্লাসে নিয়ে আসলো।
'পানি খেয়ে নিন, ভালো লাগবে।' শানের হাতে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিয়েছে মিথিলা।
'শান এক ঢোকে পুরো গ্লাস ফাকা করলো৷। মিথিলা পাশে বসে তার পিঠে হাত বুলাচ্ছে। শান শুধুই অবাক হচ্ছে।
'নিজে অসুস্থ তারপরও উলটা আমারই সেবা করছে মেয়েটি? মাত্র কিছুদিনের দেখা, তারপরও এত ভালোবেসে ফেললে আমায় মিথিলা? কিভাবে এর ঋণ শোধ করব আমি?'
'কি হল কি ভাবছেন? শুয়ে থাকুন আরেকটু। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। ভাল লাগবে।'
'না না থাক, তুমি ঘুমাও। আমি ঠিক আছি।'
'আপনি যে ঠিক নেই সেটা আপনি দেখতে না পারলেও আমি পারছি। কেন এত দুশ্চিন্তা করেন? শুয়ে পড়ুন।'
শান বাধ্য স্বামীর মত শুয়ে পড়ল মিথিলার পাশে। মিথিলা তার মাথায় হাত বুলাচ্ছে।
'শান্ত হয়ে ঘুমান, এমনিতেই অনেক ধকল যাচ্ছে আপনার উপর।'
শান চোখ বন্ধ করে শুনছে আর ভাবছে 'যদি মিথিলা জানতে পারে সে দেখতে পায় তাহলে? মিথিলা কি তাকে অবিশ্বাস করবে?'
কিছু সময় পর হঠাৎ মিথিলার আওয়াজ আসলো।
'আপনাকে আমি কিচ্ছু হতে দিব না। এত বছরের পর অর্জিত ভালোবাসাকে আমি মোটেও হারাতে চাই না।।
তখনই শান চোখ খুলে তাকালো। মিথিলার দিকে তাকালো। কিন্তু দেখলো তার পাশে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই ঘিয়ে পড়েছে মিথিলা। আর বিড়বিড় করে কি বলছে। ঘুমের ঘোরে কি বলছে মেয়েটি!! শান সেদিকে বেশি ভ্রুক্ষেপ না করে ঘুমানোতে মনোযোগ দিল। আসলেই মেয়েটির হাতে জাদু আছে। দুস্বপ্ন দেখে শানের মনে যে খারাপ লাগাটা সৃষ্টি হয়েছিল সেটা নিমষেই ভুলিয়ে দিল।
শান ভাবলো ওই ছলনাময়ী পুতুলের কথা কম ভাববে সে। রাতে ওই কল্পনা আবার এখন এরকম স্বপ্ন!! এভাবে চলতে দেয়া যাবে না। এসব ভেবে ঘুমিয়ে পড়ল শান।
সকালে নাস্তার টেবিলে বসেছে সবাই। শানের মার মুখে মিথিলাকে নিয়ে প্রসংশার ফুলঝুরি উড়ছে।
'বাবা কি পাগলি মেয়ে এনেছিস আমার জন্য? দেখ আমাকে কিছু করতেই দিচ্ছে না! সকালে উঠে সকল নাস্তা নিজে নিজে করেছে। পরোটা, আলু ভাজি, ডিমের মামলেট, সুজির পায়েশ, আলুর দম আরো কত কি!! কিচ্ছু করতে দিচ্ছে না এখন থেকেই।'
শানের মা শানের পাশে বসে হাসতে হাসতে বলল।
পাশে শানের বাবাকে নাস্তা তুলে দিচ্ছিল মিথিলা। শানের মার কথা শুনে সে বলল,'মা এখন থেকে আমি এসে গেছি না? আমি সব সামলাবো।'
'সেটা সামলাও কিন্তু নিজের দিকেও তো খেয়াল রাখতে হবে মা! কালকে তোমার অসুখ ছিল না? জ্বর ছিল, আর মুখে ক্রিম দাও একটু, এখনো লাল হয়ে আছে।'
মিথিলার মন একটু খারাপ হয়ে গেল। মা জ্বর কমে গেছে আমার। আর মুখের দাগের কথা বলছেন? মা বাবা যাওয়ার পর থেকে এসব দাগ মুখে পড়ার অভ্যাস হয়ে গেছে।'
'দেখো কি বলে! মা বাবা গেছে তো আমরা কারা? শানের বাবা বলল।
'হুম ঠিক বলেছো তুমি, আমরাই এখন থেকে তোমার মা বাবা। বুঝেছো?'
মিথিলা জড়িয়ে ধরল শানের মাকে। আর শানের মা তার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। শান চশমার আড়ালে আড়চোখে দেখছে সেই দৃশ্য। এই দুইদিন আগেই তার বাড়ির কি অবস্থা ছিল! আর মিথিলা এসেই
বাড়িটাকে হাসি খুশিতে ভরে দিয়েছে মনে হয়।
'কিরে বসে আছিস কেন তুই? খাওয়া শুরু কর।'
শানের মা তাকে বলল। মিথিলাও সেদিকে চাইলো।
'হ্যা হ্যা খাচ্ছি।'
'হুম আর মিথিলা মা তুমি বসো। খেয়ে ওষুধ খেতে হবে।'
'হুম।।'
'যাই বলো আজকে রান্নাটা ফাটাফাটি হয়েছে।' শানের বাবা বলল।
'হুম তাইতো, আমার মেয়ের হাতের রান্না। কিরে তুই কিছু বলছিস না?' শানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল তার মা।'
'আমাকে বলছো?'
'হ্যা তো কাকে বলব, বল বউমার রান্না কেমন হয়েছে?'
মিথিলা কৌতুহলী চোখে শানের দিকে তাকিয়ে আছে। শান রুটির এক লোকমা মুখে দিয়ে বলল,'মা ভাল হয়েছে অনেক।'
শানের এইটুকু কথাই মিথিলার মনে আকাশ সমান আনন্দ দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
মিথিলা লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিল। শানের মা সেটা লক্ষ করে হাসি মুখে মিথিলার মুখ উচু করলো। 'আমার পিচ্চি মা টা আবার লজ্জাও পায়!' এক হাতে জড়িয়ে নিল তাকে। মিথিলা লজ্জায় আরো লাল হয়ে গেলো।
'আচ্ছা মিথিলা তোমরা আগে কোথায় থাকতে?' শানের বাবা প্রশ্ন করলো।
'জি নবাবগঞ্জ।'
'কি বলো!! শানের আগের অফিসও তো নবাবগঞ্জেই ছিল। আমরা ওখানে কতদিন থেকেছি।'
শান ওদের কথাগুলো শুনছে।
'ইশশ যদি নবাবগঞ্জেই আমার এই মা টাকে পেতাম
তাহলে ভিতরে এত কিছু ঘটত না আমার ছেলের জীবনে।' শানের মার আফসোসের গলা।
মিথিলা সে কথা শুনে মুচকি হাসলো। হাসিটার পেছনের মানে কেউ বুঝলো না। কেউ সেদিকে খেয়ালই করেনি হয়ত।
'আচ্ছা বাবা, কালকে রাতে পানি খাওয়ার সময় মনে হল উপরের রুম থেকে কেউ হাসছে।'
শানের বাবার কথা শুনে শানের মুখে খাবার আটকে গেলো।
মিথিলা শানের মায়ের হাত আরো জোড়ে জড়িয়ে ধরলো।
'কি বলছো তুমি? উপরের রুমে তো সিল মারা। ওখান থেকে হাসি মানে?এসব আজগুবি কথা বলে মেয়েটাকে ভয় দেখাচ্ছো শুধু শুধু।'
'হ্যা গো মনে হল একটা মেয়ের হাসির আওয়াজ উপর থেকে। কিন্তু আমার ভুলও হতে পারে তাই আর দেখতে যাইনি।'।
'হুম তাই বলো বয়স হয়েছে, কি না কি শুনেছো
কোথা থেকে, মনে করেছো উপর থেকে আসছে।'
'হয়ত, সেটাও হতে পারে।'
শানের মাথায় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। গতকাল রাতে সে যেটাকে কল্পনা ভাবছিল সেটা কি তাহলে??? না এটা কিভাবে সম্ভব?
কিন্তু তার বাবা সে হাসির শব্দ শুনলো! কারণ উপরে তো পুতুল তার সামনে হেসেছিল। কল্পনা হলে সেটা বাবা কিভাবে দেখবে?
না আজ রাতে আবার যেতে হবে শানকে। কিছুতেই এটা হেলাখেলা করা যাবে না।
অফিসে গেলো শান। সারাদিন ওই চিন্তাতেই সময় গেল। ভিতরে মিথিলা দুপুরে ফোনও করেছিল খেয়েছে নাকি জানতে। বিকেল হতেই শান বাসায় এসেছে।
রাত প্রায় একটা, সবাই ঘুম। ধীরে ধীরে উপরের রুমের দিকে এগোচ্ছে শান। আজ সব জানতে হবে তাকে। শরীরে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে, এটা ভয় না কৌতূহল জানে না সে। উপরের রুমের দরজার
সামনে পৌঁছালো সে। কাপা কাপা হাতে ধীরে ধীরে দরজা আলতো করে ধাক্কা দিল।
দরজা খুলেই শান যা দেখলো তাতে.......
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_১৫)
লেখক_আয়াশ
রুমের দরজা খুলেই যা দেখলো তাতে শানের মাথা ঘুরে গেলো। সে দেখলো রুমের ফ্লোরে তার বাবা পড়ে আছে আর তার মাথা দিয়ে রক্ত পড়ে রুমের ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে।
'বাবা!!!!' বলে শান চিৎকার দিয়ে উঠল। ছুটে গেল বাবার কাছে। বাবার মাথা কোলে নিল।
ততক্ষন নিচে থেকে মিথিলা আর শানের মা চলে এসেছে। তারাও শানের বাবার অবস্থা দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। শান তাদের দেখে নিজেকে একটু সামলে নিল।
হস্পিটালে বসে আছে শানের মা আর মিথিলা। শানও পাশেই বসে। সে যেন শোকে অয়াথর হয়ে গেছে। ডাক্তাররা বলেছেন তার বাবার মাথা থেকে অনেক রক্তক্ষরণ হওয়ায় অবস্থা ক্রিটিকাল। রক্ত লাগবে এমারজেন্সি। একটু পর এসেই রক্তের গ্রুপ বলবে।
শানের মা জিজ্ঞেস করলো,'বাবা তুই উপরে কি করছিলি? আর তোর বাবা যে পড়ে ছিল সেটা দেখলি কিভাবে?'
'আমি পানি খেতে গিয়ে উপরের রুম থেকে কিছুর আওয়াজ পাই। উপরে গিয়ে রুমের ভিতরে গেলেই পায়ে কারো স্পর্শ অনুভব করি। নিচে বসে হাত হাত দিলে টের পাই আমার বাবা শুয়ে রয়েছে। অনেক ডাকার পরও আমার ডাকে সাড়া না দিলে আর মাথায় হাত দিলে ভেজা ভেজা লাগায় বুঝতে পারলাম এটা রক্ত। তখনই তোমরা চিৎকারের আওয়াজ শুনেছো।'
'কি হচ্ছে এসব বাবা? আমাদের উপর কে বদলা নিচ্ছে?'
'জানি না মা, আমিও কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।'
'তোর বাবার আবার কিছু হবে না তো?'
'মা এসব কথা বলো না। দেখো বাবা ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে।'
শান আর শানের এতসময় কথা বললেও মিথিলা শানের বাবা যে রুমে আছে সেদিকে চেয়ে আছে। চোখে মুখে অস্থিরতা।' শান আড়চোখে চশমার আড়ালে সেটা দেখেছে।
হঠাৎ মিথিলা তাদের দিকে তাকিয়ে কেদে উঠলো। শানের মা মিথিলাকে জড়িয়ে ধরল।
'মা দেখেছো আমি অপয়া, নিজের বাবা মাকে হারালাম। আজ যে বাবা মাথায় হাত দিয়ে বলল সে আজ থেকে আমার বাবা, দিন না পেড়োতেই এত বড় বিপদ আসল। আমি আসলেই অলক্ষী!!'
'না মা এমন বলতে নেই। কিচ্ছু হবে না তোর বাবার।'
তখনই ডাক্তার বের হল,'তাড়াতাড়ি এ পজিটিভ রক্তের ব্যবস্থা করুন দুই ব্যাগ। ইটস এমারজেন্সি। দেরি হলে পেশেন্টের অবস্থা আরো গুরুতর হবে।'
মিথিলা সাথে সাথে উঠে দাড়াল,'আমার রক্ত এ পজিটিভ। আমার থেকে নিন।'
'আচ্ছা আসুন। কিন্তু দুই ব্যাগ লাগবে যে!!'
'আমিই দিব। সমস্যা নেই।'
শানের মা বলে উঠল,' না মা দুই ব্যাগ দিলে তুই নিজেই আরো অসুস্থ হয়ে পড়বি। এমনিতেই মাত্র জ্বর থেকে উঠলি। আমরা দেখছি। কি করা যায়।'
মিথিলাকে ডক্টর ভিতরে নিয়ে গেল রক্ত নিতে শানের মাও সাথে গেলো।
শান রিয়াদ ভাই আর তার বসের কাছে ফোন দিল রক্ত ম্যানেজ করার জন্য।
কিছু সময়ের ভিতরেই রিয়াদ ভাই আর তার বস চলে আসলো। সব শুনে সবাই অবাক হল। কিন্তু আশার খবর হল রিয়াদ ভাইয়েরও রক্ত এ পজিটিভ। তাই শানকে আর টেনশন করতে হল না।
এদিকে খবর পেয়ে পুলিশ এসেছে শানের বাসায়। শানকেও ফোন করে নিয়ে আসা হয়েছে।
ডিআইজি সাহেব বললেন,'এটা কি হল শান! আজ আবার রি ইনভেস্টিগেশন হওয়ার কথা ছিল রুমে আরো কোনো তথ্য পাওয়া যায় নাকি খুজতে আর তার আগেই এরকম টা হয়ে গেলো?
শান চুপ করে আছে। সেও কিছু বুঝতে পারছে না।
'স্যার আমার পরিবারের উপর কার নজর লেগেছে, কেন করছে এসব সে কিছুই তো বুঝতে পারছি না!!'
'তোমার বাবা উপরের রুমে কেন এসেছিল?'
'সেটা তো আমিও জানি না স্যার।'
'হুম, তার জ্ঞান ফিরলেই আমরা বুঝতে পারব হয়ত।'
শান অন্য ঘরে বসে বসে সব কিছু আবার মিলাচ্ছে, ওইদিকে তার রুমে ফরেন্সিক বিভাগ এসেছে আবার সকল কিছু খতিয়ে দেখতে।
শানের মাথায় একটাই কথা বারবার আসছে। যদি তার বাবাকে মাথায় আঘাত করা হবে তাহলে তখন তার বাবা ব্যাথায় চিৎকার করলো না কেনো? এই কথাটা সে বারবার ভাবছে। তাহলে কি পরিচিত কেউ?
এসবের উত্তর হয়ত তার বাবা সুস্থ হলেই পাওয়া যাবে।
রুমের সকল জিনিস আবার খুটিয়ে খুটিয়ে দেখা হল। অবশেষে দুইটা অবাক করা জিনিস পাওয়া গেল।
ফ্লোর থেকে পাওয়া গেল কিসের যেন একটা ছোট টুকরা। মনে হচ্ছে মানুষের হাতের যে হাড় থেকে তার আগার অংশ। সেই অংশ দেখে তো সবাই অবাক। কারন পুতুলের পিছ করা লাশ খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়েছিল। আর সেটা থাকলেও তো পোড়া অবস্থায় থাকবে, কিন্তু এটা তো একটু ভাঙা অংশ মনে হচ্ছে।
ফরেনসিক ডাক্তাররা ছিল সেখানে, তারা বলল এটা ফলস হাড়। অর্থাৎ মানুষের অরিজিনাল
হাড় নয়। বাজারে অনেক সৌখিন জিনিস পাওয়া যায় এমন৷ যেমন- কঙ্কালের হাত, মাথা; এটা সেরকমই একটা জিনিস।
আর দ্বিতীয় জিনিসটা আরো চাঞ্চল্যকর। কাপড়ের ছোট্ট একটা ছেড়া অংশ। অংশটা শাড়ির হবে হয়ত। ঘরের দরজার কোনায় ধারালো কিছু একটা অংশের সাথে লেগে ছিল।
শানকে সামনে বসিয়ে এসব জিনিসের নাম বলা হচ্ছে সে অন্ধ বলে। কিন্তু শান দুটোই চোখে দেখতে পাচ্ছে।
প্রথম কঙ্কালের হাড়ের টুকরা দেখে শান সিওর হল যে সেদিন সে সত্যি পুতুলকেই দেখেছিল। সেটা তার কোনো কল্পনা ছিল না। কিন্তু আসলেই পুতুল নাকি পুতুলের বেশ ধরে অন্য কেউ! সকল চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তার৷
'পুতুল হলে পালাবে কেনো? না সেটা পুতুল রুপী আর কেউ যে পুতুলের মৃত্যুর সুযোগ উঠাচ্ছে।' এটাই ভাবতে বাধ্য হল শান।
দ্বিতীয় কাপড়ের টুকরাটা দেখা মাত্রই তার যেন শরীরে আগুন জ্বলে উঠল। কারণ এটা অন্য কারো নয়। মিথিলার শাড়ির!!!!
সেদিন এই একই রঙের শাড়ি পরিহিতা নববধূকেই শান বিয়ে করে এনেছিল। শানের বুঝতে বাকি রইলোনা মিথিলা সেদিন যে শাড়িটি পড়ে ছিল এই কাপড়ের টুকরা সেম সেই শাড়িটারই।
ডিআ'ইজি স্যারকে বলে সে হাসপাতালে ছুটল। তার আজ অনেক কিছু জানার আছে। কাকে রেখে কার উপর ভরসা করবে শান? সে কি জীবনে দ্বিতীয়বারের মত বি'শ্বাসঘাতকতার স্বীকার হল!!! এবারও একটা মেয়েকে বিশ্বাস করবে এই আশাটা যখনই মনে মনে ঠিক করেছিল, তার আগেই ভেঙে গেলো!!!!
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_১৬)
লেখক_আয়াশ
হাসপাতালে পৌছে দেখলো বাবার রুমের বাইরে এখনো মাথা নিচু করে বসে আছে তার মা।
শানের বাবাকে এখন নরমাল বেডে শিফট করা হয়েছে, তার রক্ত দেয়া কমপ্লিট কিন্তু এখনো জ্ঞান ফেরেনি।
হস্পিটালে আসার সময় রিয়াদ শানের কাছে ফীন করে এসব বলেছে।
মায়ের কাছে যাওয়ার সময় হাতের লাঠির আওয়াজেই হয়ত শানের মা টের পেল তার ছেলে এসেছে।
ছেলেকে দেখতেই তার কাছে ছুটে গেল সে।
'বাবা, ডাক্তাররা তো এখনো কেউ কিছু বলছে না। তোর বাবার কি অবস্থা কেউ বলছে না বাবা, আর মিথিলা,,,'
'কি হয়েছে মা মিথিলার?ওকে দেখছি না কেনো?'
'তোর বাবার রক্ত দিতে গিয়ে মেয়েটা আমার অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এমনিতেই জ্বর ছিল গায়ে, রক্ত দিয়ে বারবার মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল বাবা। পাশের রুমে ওকে স্যালাইন দেয়া হয়েছে।'
শানের কথাটা শুনে যেখানে মিথিলার জন্য টেনশন হওয়ার কথা ছিল সেখানে বোধহয় আশাহত বেশি হল।
মায়ের সাথে পাশের রুমে গিয়ে দেখলো মিথিলা শুয়ে আছে, হাতে স্যালাইন লাগানো। হয়ত ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু মিথিলার থেকে তো অনেক কিছু জানার ছিল শানের। এ অবস্থায় শান কিছু বলতেও পারছে না।
নিরাশ হল শান। মা পাশে থেকে বলল, 'বাবা সামনের বেডে মিথিলা শুয়ে আছে। তুই আয় বস এখানে।'
'না মা চলো বাইরে যাই, দেখি ডাক্তাররা কি বলে, বাবার জ্ঞান কখন ফিরবে।'
'আচ্ছা চল।'
রুম থেকে বেড়োতে যাবে তখনই ডাক্তার সাহেব তাদের সামনে আসলো।
'আপনাদের পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। আপনারা দেখা করতে পারেন। তবে খুব সতর্ক, একদম প্রেশারাইজ করবেন না।'
'আচ্ছা ঠিক আছে।'
শানের বাবাকে বেডে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ধীরে ধীরে চোখে মেলে শান ও তার মাকে দেখে সে হাত দিয়ে তার মাকে কাছে আসতে ঈশারা করল।
শানের মা এক সেকেন্ড বিলম্ব না করে শানের বাবার কাছে গেল, পাশের চেয়ারে বসলো। শান পিছনে পিছনে এসে তার মার পাশেই দাড়ালো।
'এখন কেমন লাগছে তোমার? ঠিক আছো তো?'
'হ হুম।'
'কি থেকে কি হয়ে গেলো!'
শানের বাবা তখন শানকে হাত বাড়িয়ে আসতে বলল।
শানের মা শানের হাত ধরে কাছে নিল তার বাবার।
'বাবা শান, মা, মা, মাথায়'
'বাবা কিচ্ছু হবে না তোমার। তুমি চিন্তা করো না।'
'না বাবা শোন আ, মা,,র ক.. কথা।'
'তুমি চুপ করো এখন বলতে হবে না। পরে বলবা।'
'বাবা একটু রেস্ট নাও। আমরা না হয় পরেই শুনব।'
শানের মা তার বাবাকে চুপ করিয়ে দিল। শানও কিছু বলল না। কারণ এমনিতেই তার বাবা অসুস্থ।
শানের মাথা স্থির হচ্ছে না। কি বলতে চাইছে তার বাবা!!!!
রাতটা তাদের এভাবেই কাটল। মিথিলার তখনো জ্ঞান ফেরেনি। শান সারারাত মিথিলার রুমেই ছিল। ঘুমন্ত মিথিলাকে কতবার পরখ করে দেখেছে শান তা সে নিজেও জানে। এই নিষ্পাপ মেয়েটির মনেও কি এরকম কিছু থাকতে পারে? শান সেটাই বুঝতে পারছে না। শুধু অপেক্ষা কখন মিথিলার জ্ঞান ফিরবে আর কখন তার বাবার কাছে থেকে শুনতে পারবে কি হয়েছিল।
পরদিন খুব সকালে শান তার বাবার রুমে গেল। তার মা উঠেছে, শানের বাবার হাত ধরে আছে।
'বাবা।'
'শান, বাবা এসেছিস। বস তোর বাবার কাছে আয়।'
মায়ের কথায় শান গিয়ে বসল ওর বাবার কাছে।
বাবা, এখন কেমন লাগছে?'
''''ভালো বাবা। তোর মা আমাকে কিছু বলতেই দিচ্ছে না। তোকে সব জানানো দরকার বাবা।'
'বাবা তোমার কষ্ট হবে বলতে'
'না বাবা শোন। আমি আস্তে আস্তে বলছি।
কালকে আবার পরশুদিনের মত উপরের রুম থেকে আওয়াজ আসছিল। ভালকরে খেয়াল করে দেখি হ্যা উপরের রুমেই কেউ একজন আছে, কিছু একটা করছে। শুনসান ঘরে না হলে এরকম শব্দ আসার কথা নয়। আমি চুপিসারে গেলাম। গিয়ে রুমের দরজা ধাক্কানোর সাথে সাথে কে যেন তড়িৎবেগে বেলকনিতে চলে গেল। আমার সন্দেহ স্পষ্ট হল। অন্ধকারে সে মনে করেছে আমি দেখতে পাইনি তাকে।'
একথা শুনে শানের তখন নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। সেদিন সে লাইট জ্বালিয়ে পরো রুমটা দেখলেও বেলকনিটা কেনো দেখলোনা!!! সেদিনই সব সত্যি সামনে আসতো তাহলে!!'
'তারপর!!' শানের মা ভীতস্বরে বলল।
'আস্তে আস্তে বেলকনিতে আগালে অন্ধকারে দেখি একটা নারীমূর্তি পিছন মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে শাড়ি পড়া। দেখতে যাব সে কে কিন্তু,,'
'কিন্তু কি হল!!'
'তার কাছে যাওয়ার আগেই সে অন্ধকারে ঘুরে আমার মুখে কি যেন স্প্রে করল তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। তার চেহারাটা দেখতে পাইনি আমি কারণ হঠাৎ চোখ ঝাপসা হয়ে গেছিলো সেটা মারার পর। মুহূর্তেই আমার বোধশক্তি কেমন যেন লোপ পায়। তারপর চোখ খুলে নিজেকে এখানে দেখি।'
'বাবা আসছি আমি।'
শান সাথে সাথে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। শানের বাবা শাড়ি পড়া মেয়েকে দেখেছে। আর মিথিলার শাড়ির টুকরাও পাওয়া গেছে রুমে। এখন তো কোনো সন্দেহই থাকে না। রাগে শরীর জ্বলে যাচভহে শানের। তাহলে কি মিথিলা সব জানে? তার চোখের কথাও? না আগেই ধরা দেয়া যাবে না ওর কাছে।
শান দ্রুত পায়ে মিথিলার রুমে গেলো।
মিথিলার রুমে গিয়ে দেখল মিথিলা মাত্র চোখ আধো আধো খুলছে। শান এক মিনিট বিলম্ব না করর লাঠির সাহায্যে মিথিলার কাছে গেল।
মিথিলা চোখ পিটপিট করে আশে পাশে তাকিয়ে শানকে আসতে দেখলো। মুখের কোনে হাসি ফুটে উঠল তার।
'আপনি এসেছেন?'
শান মিথিলার বেডের পাশে গেল। মিথিলা হাত বাড়িয়ে শানের হাত ধরল। শান মিথিলার বেডে তার পাশেই বসল।
'আমি গেলামই কখন? সারারাত তো এখানেই ছিলাম।'
মিথিলার মুখ যেন লজ্জায় লাল বর্ণ ধারণ করল। কিন্তু সেটা দেখে শানের আরো রাগ বেশি হচ্ছে। মনে তো হচ্ছে গলা টিপে মেরে ফেলতে। কিন্তু একটা কথা সে বুঝতে পারছে না।
যদি মিথিলাই তার বাবাকে মারবে তাহলে আবার নিজেই অসুস্থ শরীর নিয়ে রক্ত দিতে গেলো কেনো? কি রহস্য এর!!
'বাবা কেমন আছে?'
'ভাল।'
'আমাকে ওইখানে নিয়ে চলুন বাবার কাছে।'
'মিথিলা তোমাকে কিছু কথা বলব, তুমি কি ঠিক ঠিক উত্তর দেবে?'
'হঠাৎ কি কথা?'
'তুমি কি উপরের রুমে গেছিলে?'
প্রশ্নটা শুনে মিথিলার মুখে ভয় ডানা দিল। চশমার আড়ালে শান সব দেখছে।
'মা মা মানে!!'
'আমার কথার উত্তর দাও মিথিলা, তুমি কি উপরের রুমে গেছিলে?'
মিথিলার ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,'হ্যা।'
'কি বললে?'
মিথিলা চুপ করে আছে।
'এই মেয়ে কি বললে তুমি?'
'আপনি ক..কি ভাবে জানলেন?' চোখে মুখে ভয় মিথিলার,
শান কিছু বলবে এর মাঝেই আবার ফোন আসল,
'হ্যালো শান'
ফোনটা ডি আইজি স্যারের।
'জি স্যার।'
'রুমে পাওয়া সেই হাড়ের টুকরো সম্পর্কে কিছু তথ্য এসেছে হাতে। তুমি এখনি এসো **** এই ঠিকানায়। একটুও দেরি করো না।'
'আচ্ছা স্যার আসছি আমি।'
এই মুহুর্তে কিচ্ছু করার নেই শানের। না গেলে তার উপর সন্দেহ এসে পড়বে। যেতেই হবে।
'আমার অনেক কিছু জানার আছে মিথিলা। তুমি আমাকে অনেক কিছু বলোনি। তুমি যদি কিছু করে থাকো তার শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।
মিথিলা উপরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছিল। শানের কথা শুনে মুচকি হাসলো মিথিলা।
'আপনার যা মন চায় সেই শাস্তিই দিবেন না হয়।'
রুম থেকে লাঠির সাহায্যে উঠে বের হয়ে গেলো শান। মিথিলা তার দিকে তাকিয়ে আছে একভাবে।
শান হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে ডিআইজি স্যারের বলে দেয়া ঠিকানায় যেতে একটা রিক্সায় উঠলো।
ব্যস্ততম শহর ঢাকা। এর মাঝেই এক সিগনালে শানের রিক্সা থেমে আছে। এমনিতেই এত চিন্তা, এই ট্রাফিক য্যাম যেন সেটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ঠিক এমন সময় রাস্তার পাশে একজনকে দেখে চোখ আটকে গেল শানের। এ কাকে দেখছে সে!!!
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_১৭)
লেখক_আয়াশ
শান রিকশা থেকেই দেখলো পুতুলের বাবা রাস্তার পাশের বাস কাউন্টার থেকে বের হচ্ছে। শানের মাথায় প্রথম থেকেই কথাটা ঘুরছিল যে প্রথমদিন পুলিশ খবর দেয়ার পর থেকে তো পুতুলের বাবা মাকে আর দেখা যায়নি পুলিশ স্টেশনে!!
পুতুলের বাবাকে দেখে শানের খটকা লাগলো।
কিরকম লুকিয়ে লুকিয়ে যাচ্ছে পুতুলের বাবা। সবার অগোচরে, কেউ যেন তাকে লক্ষ্য না করে ওইভাবেই।
শান তড়িঘড়ি রিক্সা থেকে নামলো পুতুলের বাবার পিছনে ধাওয়া করার জন্য। দ্রুত হাটছে লোকটি। শানও তার পিছন পিছন হাটছে। ডাক তো দেয়া যাবে না, তাহলে শানের চোখের ভাল হওয়ার খবর জেনে গেলে তো আরো বেশি সন্দেহ করবে তার উপর। মনে করেই নেবে যে তাদের মেয়ে পুতুলকে শানই মেরেছে। কোথায় যায় দেখার জন্য শান তার পিছু নিতেই থাকলো।
ঠিক তখনই একটা লোকের সাথে ধাক্কা লাগলো শানের। দোষটা পুরোপুরি লোকটির দেয়া যায় না। কারণ শান তো পুতুলের বাবার দিকে তাকিয়েই দ্রুত হাটছিল।
'কি ভাই চোখ কি বাসায় রেখে রাস্তায় হাটেন?' সামনে দাঁড়ানো মধ্যবয়সী লোকটির তেজী স্বরে শান থেমে তাকালো৷
'সরি ভাই।' বলে শান আবার যখন লোকটিকে পাশ কাটিয়ে পুতুলের বাবাকে ফলো করবে তখনই দেখলো পুতুলের বাবা নেই।
এক সেকেন্ডে কোথায় গেল লোকটা!! শান চারপাশে তাকালো, দ্রুত হেটে ফ্লাইওভারে উঠলো চারিদিকে দেখার জন্য কিন্তু কোথাও নেই।
নিজের ব্যর্থতায় মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল তার। হয়ত কিছু জানাও যেত!!
মোবাইল অনবরত বেজে চলেছে। ডিআইজি স্যারের ফোন হয়ত। হ্যা ঠিক তাই। সে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বলল।
-------
পুলিশের সাথে একটি শপে দাঁড়িয়ে আছে শান। এই শপে নাকি এরকম আর্টিফিশিয়াল কংকালের হাত, খুলি সহ বিভিন্ন জিনিস পাওয়া যায়।
পুলিশ আগেই শপের মালিককে জিজ্ঞেস করেছে টুকরাটা দেখিয়ে এবং সেটা তার দোকানে থাকা আরেকটা হাতের সাথে হুবহু মিলেও গেছে।
পুলিশ শানকে ডাকার কারণ হচ্ছে দোকানের মেমোতে কংকালের হাতটি যার নামে ক্রয় করা হয়েছে সেখানে শানের নাম লেখা আছে।
শান তো দেখে অবাক। সে সাথে সাথে ডিআইজি স্যারকে বলল,
'স্যার আমি তো এখানে আসিই নি আগে কোনদিন।'
'হুম। তবে তোমার নামে কেনা কেন?'
'আমিও সেটাই ভাবছি স্যার।'
'এটাই যদি হয় তবে কেউ তোমাকে ফাসাতে চাচ্ছে শান।'
সেই শপের মালিককে জিজ্ঞেস করা হলঃ
'আচ্ছা আপনি কি এনাকে হাতটা বিক্রি করেছেন?'
'না স্যার, আসলে তখন দোকানে আমার কর্মচারী ছিল।'
'তো তাকে ডাকুন।'
'জি স্যার।'
অই দোকানের মালিক হাত বিক্রির সময় যে সেলসম্যান ছিল তাকে খবর পাঠিয়েছে, সে বাড়িতে ছিল তখন। সবাই তার আসার অপেক্ষাই করছে। ত্রিশ মিনিট পর সে আসলো৷
তার কাছে আরো চাঞ্চল্যকর খবর পাওয়া গেল।
হাতটি নাকি দুইজন বোরকা পড়া মহিলা কিনতে এসেছিল। এসে শানের নামে রিসিপ্ট করেছে বিল দেয়ার সময়।
শানের মাথায় আরো জট পেকে গেল সাথে পুলিশের সবারও। সবাই ভাবছে কি থেকে কি হচ্ছে এগুলো!! আবার দুইজন মেয়ে?? কোনো কুলকিনারা তো হচ্ছেই না কেসের বরং দিন দিন আরো জটলা পাকাচ্ছে।
ডিআইজি স্যার শানকে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করে তাকে আবার হসপিটালে যেতে বলল। শানও সেদিকেই গেল। কারণ মিথিলার কাছে তো আরো অনেক কিছু জানার আছে তার।
রিক্সা ঠিক করে আবার হাসপাতালের দিকে আসছে তখন হঠাৎ শানের মাথায় একটা কথা মনে পড়ল।
'আচ্ছা, পুতুলের বাবাকে তো আমি একটা বাসের কাউন্টার থেকে যেতে দেখেছিলাম। ইসস জিনিসটা এত সময় পর কেন মাথায় আসলো!!! আসলে আমার মাথাটাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে এত চিন্তায় চিন্তায়। সেখানে গেলেই হয়ত কিছু জানা যাবে।'
কিছু সময় পর শান আবার সেই বাসের টিকিট কাউন্টারে পৌছালো।
গিয়ে সেখানকার রিসেপশনিস্টকে বলল,'আমার পরিচিত একজন, এই নাম (পুতুলের বাবার), একটু দেখেন তো এই নামে টিকিট বুক করা হয়েছে নাকি।'
'সরি স্যার আমরা পারসোনাল ইনফরমেশন কাউকে দেই না।'
'আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে। আমি তার কলিগ। সে আমাকে বলেছে তার আর তার স্ত্রীর দুইটা টিকেট বুক হয়েছে কিনা দেখতে। আর না হলে নতুন করে আমাকে কিনে নিয়ে যেতে বলেছে।'
'অহ আচ্ছা। স্যার নামটা কি বললেন? আর কোথাকারা টিকেট?'
শান পুতুলের বাবার নাম ও তাদের ঠিকানা অর্থাৎ যে জেলায় থাকে সেখানকার নাম বলল।
কিন্তু বিনিময়ে রিসিপশনিস্ট যা বলল তাতে শানের মাথা ঘুরে গেল।
'স্যার এই নামে কিছু সময় আগেই টিকেট বুক করা হয়েছে। কিন্তু,,,'
'কিন্তু কি?'
'কিন্তু সে তো যশোরের বেনাপোলের টিকিট কেটেছে।'
'মানে!!'
শান কি বলবে বুঝতে পারছে না। পুতুলের বাবার বাড়ি ময়মনসিংহ। তারা যশোরের বেনাপোলে যাবে কেন!
'আরো একটা কথা স্যার।'
'জি!'
'আপনি বললেন তিনি আর তার স্ত্রী। কিন্তু এখানে তো তার নামে তিনটা টিকেট আছে। রাত নয়টায় বাস।'
শেষের কথাটা শুনে শান যেন নিজের ভেতরেই নেই।
'তিনটা টিকেট!! মানে!!! আরেকজন কে!!'
'আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে আমার আর কেনা লাগলো না। থ্যাংক ইউ।'
'অয়েলকাম স্যার।'
শান বাস কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে হতবাক হয়ে রাস্তার পাশেই বসে পড়ল। পুতুলের মা বাবার সাথের সঙ্গীটা কে সেটা নিয়েই সে চিন্তা করছে অনবরত। তাহলে তারা একা না? তাদের সাথে আরো কেউ আছে?
কে সেই তৃতীয় ব্যক্তি!! এখান থেকে নড়া যাভে না। রাত নয়টার সময়ই সব খোলাসা হবে তার।
তখনই তার ফোনে তার মায়ের ফোন আসলো।
'হ্যালো, বাবা!'
'মা কি হয়েছে! গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? বাবা ঠিক আছে তো!!'
'বাবা মিথিলাকে তো কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।'
'মানে!!!'
গল্প:তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
(পর্ব_১৮ (শেষ পর্ব)
লেখক_আয়াশ
'তুমি এতদিন আমাদের ধোকা দিয়ে আসছ!! দেখতে পেয়েও নিজেকে অন্ধ বানিয়ে আসছ আমাদের আছে?'
শানের সামনে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তিনজন ব্যক্তি। তার মধ্য থেকে শানের বস এই কথাটা বলল। বাকি দুজন রিয়াদ ভাই ও ডিআইজি স্যারও অবাক হয়ে চেয়ে আছে।
শান একটু আগে তাদের সেই বাস কাউন্টারের ঠিকানা দিয়ে আসতে বলেছে। সেখানে আসলেই শান তাদের অবাক করে দিয়ে লাঠি চশমা ফেলে এগিয়ে যায় সামনে। আর এখন তারা সামনের একটি চা দোকানে বসে আছে মুখোমুখি হয়ে।
'আমি জানি আপনারা আমাকে অবিশ্বাস করবেন। কিন্তু আমি নিরূপায় ছিলাম।আর ডিআইজি স্যার, আপনি হয়ত আমাকে এখন খু'নি ভাববেন। কিন্তু আমি নির্দোষ, বিশ্বাস করুন। উপরওয়ালা চাইলে আর কিছু সময় পরই আমার সত্যতা প্রমাণ হবে ।'
'মানে কি বলতে চাইছো তুমি!!'
শান ওদের প্রথম থেকে বলা শুরু করলো। তার বিদেশ থেকে আসা হতে এখন পর্যন্ত কি কি হয়েছে। তার অন্ধ হওয়ার কারণ সব। আর আজ একটু পর বাসের অপেক্ষা কেন করা হচ্ছে, কেন তাদের এখানে ডেকে আনা হল সব খুলে বলল।
'আসলে স্যার আমি জানি আজ হয়ত আ'ইনি সাহায্য না নিলে তাদের ধরেও কিছু করতে পারবো না। তাই আপনাকে ডাকা।'
'হুম বুঝেছি তোমার কথা। যদিও আইন আমাকে এমন করার অনুমতি দেয়না, তবুও তোমার সততা দেখে আমরা সবাই তোমার সাহায্য করব।'
'অনেক ধন্যবাদ স্যার। আর রিয়াদ ভাই, বস, আপনারাও আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। আসলে পুতুলকে সাব্বিরের সাথে হাতে নাতে ধরতেই আমার এসব করা।'
রিয়াদ ভাই শানকে জড়িয়ে ধরল। 'জানি আমি ভাই কতটা কষ্ট সহ্য করলে মানুষ এমন করতে পারে। আমরা আপনার পাশে আছি।'
শানের বস বলল,'কিন্তু মিথিলা কোথায় গেলো শান? সেটা কি খোজ খবর করা উচিত নয়?'
'হ্যা স্যার। কিন্তু এখন আর মাত্র এক ঘন্টা আছে। এখান থেকে গেলে এই সুযোগ আর পরে আসবে না।'
'ঠিক বলেছো।'
----------
গাড়ি ছাড়তে আর মাত্র ১০ মিনিট দেড়ি। বাস থেমে আছে, যাত্রী প্রায় সবাই উঠে পড়েছে কিন্তু পুতুলের মা বাবার কোন দেখা নেই।
শান সহ বাকি তিনজন রাস্তার অপর পাশে সামনের একটা দোকানে ঘুপটি মেরে আছে। দৃষ্টি বাস কাউন্টার টির দিকে।
হঠাৎ শান দেখলো পুতুলের বাবা একটি ব্যাগ হাতে আসছে। আর পিছনে,,,
পিছনে বোরকা পড়া দুই মহিলা। বাস কাউন্টারে আসা মাত্রই শানরা সবাই আচমকা তাদের ঘিরে ধরল।
শানকে দেখেই পুতুলের বাবা ভয় পেয়ে গেল। স্থির হয়ে দাড়িয়েছে সে।
তবে শানের লক্ষ্য পিছনের মহিলা। সে পুতুলের বাবাকে পাশ কাটাতেই আরেকটা বোরকা পড়া মহিলা তার পথ আটকালো।
'তুমি! এখানে কি চাই??' গলার কন্ঠে বুঝলো এটা পুতুলের মা। শান সে কথায় পাত্তা না গিয়ে পিছনের মেয়ের দিকে এগোচ্ছে। মেয়েটি কেমন অস্থির আচরণ করছে।
শান যতই যাচ্ছে মেয়েটি পিছনে যাচ্ছে ততই৷ শান হট করে মেয়েটির মোজা পড়া হাত ধরে ফেলল। কিন্তু একি!!
এটা তো মানুষের হাত না, কি শক্ত, লোহার মত আর কি ভারী!!
শান হাত ধরা মাত্রই মেয়েটি দৌড় দিল। এক সেকেন্ডের মাঝে যেন শান সম্বিত হারালো। সে দেখলো হাতটি তার হাতে খুলে রয়ে গেছে। আর বেরিয়ে পড়েছে সেই হাড় যা সকালে এন্টিক দোকানটিতে দেখেছিলো তারা।
কিন্তু এখন বিলম্ব করার সময় নয়। এক ছুটে গিয়ে সে পিছনে দৌড়াতে থাকা মেয়েটিকে ধরে ফেলল৷ অবশ্য বেশিদূর যেতে পারতো না সে। কারণ সামনে রিয়াদ ভাই ছিল।
মেয়েটির বাম হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে শান। এবার সামনের পর্দা খুলে তার পরিচয় জানার পালা। মুখ বের করতেই যাকে দেখতে পেল তাকে দেখে শান সহ বাকি তিনজনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।
'তুমি!!!'
-----------
পুলিশ স্টেশনে বসে আছে শান সহ বাকি সবাই। বাইরে বাকি পুলিশরাও ভেতরের দৃশ্য দেখছে অবাক চোখে। পুতুলের মা বাবা মাথা নিচু করে বসে আছে
ক্রুদ্ধ চোখে সামনের ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল শান,
'কেন আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করলে পুতুল!!!!!'
হ্যা, সামনে বসে থাকা বোরকা পড়া মেয়েটি আর কেউ নয়, সেই পুতুলই। চুপ করে আছে সে। কিছুই বলছে না।
'এখন লুকিয়েও কোনো লাভ নেই পুতুল। যা বলার সত্যি বলে দাও। কেন এরকমটা করলে!!!'
এতসময় পর পুতুল বলা শুরু করলো,
'সেদিন বিকেলে সাব্বির এসে আমাকে দোষী ভেবে আমার উপর প্রতিশোধ নিতে চায়। সে তার সকল ক্ষতির লোকশান চায়, বলে আমাকেই দিতে হবে নাহলে আমার আর তার ভিডিও সে ভাইরাল করে দেবে। তার কথায় এটাও জানতে পারি যে সে আসলেই মাদকের ব্যবসায় জড়িত ছিল।
আমি ভয় পেয়ে যাই। সাব্বির যাওয়ার পর কি করব চিন্তাই করছিলাম তখনই বাসার কলিংবেল বাজে। দেখি বাবা মা এসেছে আমার, কিন্তু একা না, সাথে এসেছে আরেকটা মেয়ে, নাম সপ্না। সপ্নাকে বাবা মা নিয়ে এসেছিল আমাদের বাসায় কাজ করার জন্য। তারা জানত, তুমি অন্ধ আর আমিও অফিসে যাই তাই কাজের লোক দরকার হবে হয়ত।
বাবা মাকে দেখে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। তাদের সব বলি। তারপর তিনজন মিলে অনেক ভাবার পর এই ভয়ানক প্ল্যান বানাই।
সেদিন রাতে খাবারে ঘুমের মেডিসিন দিয়ে আগে সপ্নাকে খাওয়াই। সে ঘুমিয়ে পড়লে তাকে বাবা মা উঠিয়ে তোমার বাবা মার রুমে লুকিয়ে রাখে, সাথে তারাও লুকিয়ে থাকে।
তুমি আসলে তোমাকে ওষুধ খাইয়ে তোমার কাছে ভাল সাজি যেন তুমি আমার উপর সন্দেহ না করো পরে।
তুমি বেলকনিতে ঘুমানোর পর বাবা মা সপ্নাকে নিয়ে রুমে আসে, ওর দেহ কেটে পিছ পিছ করে আগুন জালিয়ে দেই, সাথে আমার পড়া শাড়িটাও। যেন তুমি বুঝো সেটা আমি। আরো প্রমান রাখতে খুব কষ্টের একটা কাজ করতে হয় আমাকে। নিজের হাতও কাটতে হয়। অবশ্য এর ভিতরে বাবা বাইরে দিয়ে অবশ করার ইনজেকশন এসেছিল। সেই হাতটা কেটে পাশে দেখে দেয় বাবা। আমি রক্ত আর কাটা হাত দেখে জ্ঞান হারাই।
তাই বাবা মা আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় বাসা থেকে। এর পর সকালে কি হয় সেটা তো তুমি জানো।
কিন্তু একটা ভুল হয়ে যায়, আমাকে ধরে রুম থেকে নেয়ার সময় আমার বাবার হাতের আংটিটা
খুলে পড়ে যেটা আমরা পরের দিন বুঝি।
পরের দিন সাব্বিরের সাথে দেখা করতে চাই আমি। সাব্বির আসলে তাকে কথার ছলে ভুলিয়ে সে অন্যমনস্ক হলে মাথায় মেরে হত্যা করি। আমার ডান হাত কাটা বিধায় বাম হাত দিয়ে মারতে হয়েছিল। সাথে আমার বাবাও ছিল। সেদিনই আমি আর মা বোরকা পড়ে গিয়ে এই নকল হাতটা
কিনে আনি তোমার নামে মেমো করে।
রাতে বাবার সেই আংটি খুজতে লুকিয়ে বাসায় যাই, কারণ বাসার এক্সট্রা চাবি তো আমার কাছে ছিলই। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ তুমি চলে আসো। তবে আমাকে নিজের কল্পনা মনে করতে থাক, সেসময় আমি বেলকনিতে লুকাই। ভাগ্য ভাল আমার সেদিন তুমি বেলকনিতে দেখোনি। সেদিন আমার আরো প্ল্যান ছিল। তোমার নতুন বউকে মারা। কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে সেদিন আর তোমার রুমে যাইনি। কারন তুমি সজাগ ছিলে। বাবার আংটিটা না পেয়েই চলে আসি আমি।
পরদিন রাতে আবার যাই। আংটিটা খুজেও পাইনি, খুজবো কিন্তু তোমার বাবা দেখে ফেলে, তাকে ক্লোরোফম দিয়ে অজ্ঞান করে মাথায় আমার এই হাড়ের হাত দিয়েই জোড়ে প্রহার করি। কিন্তু সেটাই বোকামি হয়েছে। আমার হাতটা একটু ভেঙে পড়ে। অবশেষে প্রমাণ পাওয়া যাবে এই ভয়ে সব কিছু ছেড়ে দেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করি আমরা।
সাব্বিরকে মারার সময় তার এটিএম কার্ড সহ সবকিছু নিয়ে আসি। প্ল্যান ছিল যশোরের বেনাপোল গিয়ে সেখান থেকে টাকা তুলে দেশ ত্যাগ করবো বর্ডার পাড় হয়ে,, কিন্তু......'''''
'কিন্তু কি পুতুল!! পারলেনা তো? পারতেও না। আমার ভালোবাসাকে ধোকা দিয়েছো। এর ফল তো তোমাকে ভোগ করতেই হত। আমার ভালোবাসাকে খুন করে সাধ মেটেনি! মানুষ খুন করতেও পিছপা হলে না!! আমার বাবা যে তোমাকে মেয়ের আদর দিয়েছে তাকেও মারতে চেয়েছো? ছি!!'
ডি আই জি স্যার শানকে থামিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। পুতুলের পরিবারের ফাসিই হবে। দুইটা মানু্ষ হ'ত্যা ও একজনকে এটেম্প টু মার্ডারের চেষ্টা করেছে। বাচার কোনো পথ নেই আর বাচানোর কোনো লোকও নেই।
'স্যার আমিও তো দায়ী।'
'কেন শান!'
'আমি তো সাব্বিরকে ফাসাতে চেষ্টা,,,,'
'চুপ করো, আমাকে বলেছো, আর কাউকে বলোনা। তাছাড়া তুমি শুনলেনা? সাব্বির তো আগে থেকেই মাদক ব্যবসায়ী ছিল। আর তার মরে যাওয়ার পর তো সেই কেস ক্লোজও হয়ে গেছে। যাও পরিবারের কাছে যাও।'
'স্যার আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।'
'তুমি আমার ছেলের মত শান। যাও এবার বৌমাকে খুজো গিয়ে। সমস্যা করে আমাকে ফোন করবে।'
'জি স্যার।' শানের মিথিলার কথা মনেই ছিল না।
আর মিথিলা যে এসবে জড়িত নয় এটা জেনে শানের খুব খুশি হল। কিন্তু মিথিলার থেকে অনেক কথা জানার বাকি আছে শানের। কারন মিথিলার শাড়ি পাওয়া গেছে।
--------
রিয়াদ ভাই আর বসকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে গেল শান। আজ আর লাঠি চশমা পড়ে নয়। স্বাভাবিক হয়ে।
'বাবা তুই দেখতে পারছিস?' শানকে দেখা মাত্রই তার মা ছুটে আসলো তার কাছে। তার বাবাও পিছনে থেকে অবাক চোখে তাকিয়ে।
'মা আমি তো বিদেশ থেকে ফেরা হতেই দেখতে পাই।'
'মানে!!'
'সব কিছুর সমাধান হয়েছে মা।' বলে সব কিছু খুলে বলল শান তার মা বাবাকে।
সকল কাহিনী শুনে তার মা বাবাও আশ্চর্য।
'এতো কিছু করেছে ওই মেয়ে!!!' শানের বাবা বলল।
'হ্যা বাবা।'
'তুই চোখে দেখতে পাস, এর থেকে ভাল খবর আর কিছুই হতে পারে না আমাদের জন্য। কিন্তু বাবা আমাদের তো বলতে পারতি তোর একথা। আমরা কি বলতাম নাকি কাউকে?' শানের মা শানকে জড়িয়ে রেখেছে। শানের বাবাও ছেলের চোখে দেখতে পাওয়ার খবরে খুব খুশি।
'মা বাদ দাও পুরাতন কথা। মিথিলা কোথায় গেল মা? ও আসেনি কেনো?'
'হ্যা বাবা আমিও সেটাই ভাবছি। মেয়েটা কোথায় গেল।'
----
মিথিলাকে খুজার জন্য হাসপাতাল থেকে বেড়বে তখনই দেখে মিথিলা একটা রিক্সা থেকে নেমে এলোমেলো ভাবে হেটে হাসপাতালের দিকেই আসছে। হয়ত অতিরিক্ত দুর্বল শরীর তাই।
পড়ে যাবে ওমনিই শান ধরে ফেলল মিথিলাকে।
মিথিলা চোখ বন্ধ করে ছিল ভয়ে।
'মিথু!!!'
শানের আওয়াজ শুনে মিথিলা চোখ খুললো। শানকে দেখেই কেদে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
কিন্তু হঠাৎ যেন অভিমান ডানা বাধলো তার। শানের কাধ থেকে হাত ছাড়িয়ে গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল সে।
শান অবাক হচ্ছে যে, মিথিলা সে চোখে দেখতে পারছে জেনেও আশ্চর্য হচ্ছে না কেনো?'
শান বিলম্ব না করে তাকে কোলে তুলে নিল। হাসপাতালের কেবিনে এনে তারপর শুইয়ে রাখলো। সবাই রুমে জড়ো হয়েছে তখন।
'কোথায় গেছিলে মিথু?'
মিথিলা চুপ।
শানের মা এসে এবার তার পাশে বসল। শানের বাবাও মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে এসেছে বেডের পাশে। রিয়াদ আর শানের বসও পেছনে।
'মা চুপ কেন? বলো কোথায় গেছিলে?'
মিথিলা কান্না কান্না স্বরে বলল,'বাবা মা আপনাদের ছেলে আমাকে সন্দেহ করেছে।'
শানের বাবা মা রেগে শানের দিকে তাকালো।
শান চুপ করে আছে।
'আচ্ছা মিথু, তুমি জানতে যে আমি দেখতে পাই?' শানের প্রশ্নে সবাই অবাক হল।
'আমার প্রথম থেকে বলতে হবে সব। শুনবেন?'
'হ্যা মিথিলা বলো।'
'আমি আপনাকে ৪ বছর ধরে চিনি, ভালোবাসি।'
'মানে!!!'
মিথিলা তার সাথে নিয়ে আসা ছোট্ট ব্যাগটা খুলে একটা শার্ট বের করল।
'দেখুন তো চিনতে পারেন নাকি?'
শার্টটা দেখে শান অবাক। অনেক পুরাতন হলেও শার্টটা তার নিজের। কিন্তু কোথায় এটা রেখেছিল, শার্টটা কোথায় গেল মনে করতে পারছে না।
'এটা তো আমার,,,,'
'৪ বছর আগে নবাবগঞ্জ থাকার সময় এক সন্ধ্যায় আপনি কিছু বখাটে ছেলের হাত থেকে একটা মেয়ের ইজ্জত বাচিয়েছিলেন মনে আছে? তার বোরকার হাতার দিকটা ছিড়ে গেছিলো বলে আপনি নিজের শার্ট খুলে পড়িয়ে দিয়েছিলেন?''
'হ্যা, মনে পড়ছে।'
'আমিই সেই মেয়ে।'
'কি!!'
'আমার তো তখন বয়স আরো কম, ১৫ কি ১৬ হবে। হয়ত ভালোবাসা বুঝতাম না, কিন্তু আমার আবেগ সেদিন থেকে আপনি। আমাকে কেউ ভালোবাসতো না, বখাটেগুলো থেকে বাচিয়ে আপনি যখন আমাকে বুকে জড়ালেন ভয় পেয়েছি বলে, তখন জীবনে প্রথম মনে হয়েছিল আমার একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল আছে। সেদিন হয়ত আমার চেহারা আপনি দেখেননি কিন্তু আপনার চেহারা আমার এই মনে গেথে গেছিলো।
আমার বান্ধবীরা এসে যাওয়ায় আপনি তাদের কাছে দিয়ে আমাকে রেখে যান। তারপর প্রায় প্রতিদিন সেই স্কুল থেকে আসার সময় যাওয়ার সময় রাস্তায় আপনাকে খুজতাম। কিন্তু পাইনি, দিনশেষে মামীর হাজারো অত্যাচারের পর এই শার্টটাই ছিল একমাত্র আশ্রয়স্থল। এই শার্ট বুকে নিতেই মনে হত আপনি আমার কাছে আছেন।
একদিন হঠাৎ আপনাকে রাস্তায় দেখে স্কুল কামাই দিয়ে আপনাকে ফলো করি। আপনার অফিসের ঠিকানা পাই। এরপর থেকে প্রতিদিনই দূর থেকে দেখতাম আপনাকে। কিন্তু কাছে যাইনি, মনে করতাম আমি যে অনাথ, আর অনাথকে কি কেউ ভালোবাসবে? মেনে নেবে তার পরিবার? মামী বলত এই অনাথকে বিয়ে করবে কে? কি আছে এর। এরকম দূর থেকে দেখতাম প্রতিদিন। চলতেই থাকলো এই দেখা।
তারপর একদিন আপনি অফিসে আসেন না। পরদিনও না। এভাবে দশদিন আপনাকে না পেয়ে অফিসে যাই। আপনার নামও তো জানতাম না। চেহারার বর্ণনা দিতেই বলে আপনার বদলি হয়েছে। জীবন আমাকে বাচার উৎস দিয়েও কেড়ে নিল এভাবে। আবার আমি মনমরা হয়ে গেছিলাম।
অবশেষে আমার মামারও বদলি হল ঢাকায়। কিন্তু ভয় হত, আপনি তো অন্য কাউকে বেছে নিতেও পারেন এই জীবনে। কে জানত আমার ভাবনাই সত্যি হবে।
কিন্তু কি ভাগ্য দেখুন, আপনার ঠিক পাশের বাসায় ভাড়া নেয়া হল আমাদের। হঠাৎ একদিন বেলকনি থেকে আপনাকে দেখলাম। আপনি সেদিন হয়ত বিদেশ থেকে আসছিলেন। আপনাকে দেখে নিচে নেমে আপনার কাছে যাব, তখনই দেখি আপনি লাঠি বের করে চশমা পড়ে অন্ধের অভিনয় করলেন। আমি অবাক। এই এক সেকেন্ড আগেও তো ভাল ছিলেন আপনি। তাহলে!! তার কিছু মুহুর্ত পরই একটা মেয়ে আপনাকে এসে জড়িয়ে ধরে। আমার যেন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল তখন। সব পেয়েও হারালাম আমি। জানতে পারি আপনি বিবাহিত।
কিন্তু আপনার এই অন্ধের নাটকে আমার খটকা লাগে। তার পরদিন ইচ্ছা করে আপনার সাথে ধাক্কা লাগাই৷ এর পর থেকে তো জানেন, কখনো চাইতে, কখনো না চাইতেও আমার আপনার সাথে দেখা হয়। প্রতিরাতে বেলকনি থেকে দেখতাম আপনি ভাল সেজে অফিস থেকে বাড়িতে ঢোকার আগ মুহুর্তে আবার অন্ধের অভিনয় করতেন। আপনার সাথে মিশে কারণ জানার চেষ্টা করি কিন্তু আপনি কিছুই বলতেন না।
তারপর হঠাৎ এক রাতে দেখি আপনার স্ত্রীর সাথে কিছু কথা হচ্ছে বেলকনিতে। আপনি তাকে দরজার অপাশে রেখে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়লেন চেয়ারে। সারারাত আপনাকে আমি দেখেছি নিজে না ঘুমিয়ে। কিন্তু ভোরের দিকে দেখি রুমের জানালা দিয়ে ধোয়া বেরোচ্ছে। ছুটে যাই আমি। আমার দেখা দেখি অন্যরাও আসে। তখনো আপনি ঘুমিয়েই ছিলেন। তারপর সব জানার পর আমার সন্দেহ আরো প্রবল হয়। কেউ আপনাকে ফাসাতে চাচ্ছে। কারণ
আপনি তো আমার সামনেই ঘুমিয়ে ছিলেন সারারাত।
আপনাকে এভাবে রেখে একা কেমন করে আসব? সারাদিন সাথেই ছিলাম আপনার। মামী আমাকে বিয়ে দিতে চাইলে আমার সব আশা যেন ভেঙে গেল। কিন্তু যখন মামাকে সব বলার পর আপনি আসলেন আর বিয়ে হল আমাদের, বিশ্বাস করুন,এই জীবনে ওতটা খুশি আমি আগে কখনো হইনি।
সেদিন রাতে আমিও অই ঘরে গেছিলাম নিজের মত খুজতে। একটা আংটি খুজেও পাই। আপনাকে সেদিন রাতে বলব বলব করে বলা হয়নি তার আগেই বাবার এই অবস্থা।'
মিথিলা ব্যাগ থেকে আংটিটাও বের করল।
'অহ সেই জন্য হয়ত তোমার শাড়ির একটা অংশ লেগে গেছিলো আসার সময়।'
'জানিনা, হয়ত খেয়াল করিনি।'
শানের কাছে এবার সব ক্লিয়ার। রিয়াদ ভাইকে আংটিটা দিল পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার জন্য।
শান উপরওয়ালাকে হাজারো ধন্যবাদ দিচ্ছে এরকম একজনকে তার জীবনে আনার জন্য। তার মা বাবা তো মিথিলার কথা শুনে তাকে এখন পর্যন্ত জড়িয়ে ধরে রেখেছে। এত ভালোবাসতেও
কেউ পারে??
------
মিথিলা এখনো মুখ ফুলিয়ে আছে। শান অইভাবেই খাইয়ে দিচ্ছে তাকে নিজের হাতে। ঘরে তারা দুইজনই আছে। সবাই চলে গেছে। শানের মা বাবা পাশের রুমে, শানের বাবাকে যে রুমে শিফট করা হয়েছিল সেই রুমে।
'অভিমান পরেও করতে পারবে, আমার উপর রাগ
সারাজীবন দেখাতে পারবে। আগে খেয়ে দেয়ে সুস্থ তো হয়ে নাও।'
মিথিলা একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার অন্যদিকে ফিরল।
'আচ্ছা এরকম করলে আরজে শানের মেয়ে ফ্যানের অভাব নেই।'
কথা শোনা মাত্রই শানকে এক খামছি দিল মিথিলা৷ খামচি দিয়ে ধরেই আছে। শান ব্যাথা পেলেও মুচকি হাসছে।
'আমাকে এক টুকরো শাড়ির জন্য অবিশ্বাস করতে পারলেন আপনি!!'
'সরি বউ। তাছাড়া তুমিও তো বলোনি আমাকে যে তুমি জানো আমি দেখতে পাই!!'
'এক টুকরো কাপড়েই এরকম আর সেটা বললে তো ফাসি দিয়ে দিতেন।'
'বউ ব্যাথা লাগছে কিন্তু!!'
মিথিলা সাথে সাথে ছেড়ে দিল শানকে। নখের দাগ বসে আছে। নিজেই হাতটা নিয়ে ফু দিতে লাগলো।
'মেরে আবার আসছে এখন।'
মিথিলা কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,'আর অবিশ্বাস করবেন?'
'না না কোনোদিন না। আগে খেয়ে নাও,'' আরো এক লোকমা মিথিলার মুখে তুলে দিল শান।
খাওয়ানো শেষ করে নিজেও সামান্য খেয়ে মিথিলার পাশে বেডে বসেছে শান। মিথিলা তার মাথা শানের কাধে রাখলো।
'উপরওয়ালা সবার ভাগ্যে একজনকেই ঠিক করে রাখে। তাইতো সব কিছুর পরও আমি তোমাকে পেলাম মিথু।'
'আমিও ভাবিনি আপনাকে পাবো আমার জীবনে।'
মিথিলার হাত নিজের হাতের ভাজে নিল শান। মিথিলাকে নিজের আরো কাছে আগলে ধরল৷ মিথিলাও পরম আবেশে শানের বুকে মাথা রাখলো। মিথিলার মাথায় অধর ছুইয়ে শান বলল,
'মিথু, হয়ত আমাদের এ জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু এই ছোট্ট জীবনে যে সংসার নামক তাসের_ঘরে_তুমি_আমি বন্দী হয়েছি, সেটা দীর্ঘস্থায়ী করার দায়িত্ব শুধু আমাদের, আমাদের ভালোবাসার।'
মিথিলা বিনিময়ে তার ভালোবাসার মানুষটির দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি দিল।
সমাপ্ত