গল্প:তেতুল তলা | রহস্যময় ঘটনা

 রহস্যময় গল্প

রহস্যময় গল্প

তেতুল তলা...👹

পর্ব: ০১


পর পর তিনজন মধ্যবয়সী যুবক তেতুল তলায় আত্নহত্যা করার পর আমাদের এলাকা এখন থম থমে পরিবেশে রূপান্তরিত হয়েছে!

  বাসা থেকে বাবা মা আমাকে একদম বের হতে দেন না। যদিও সেই যুবকরা তিনজনই বিবাহিত ছিলেন!

   তিনজন যুবককেই ঠিক আলাদা দিন এ একই সময়ে তেতুল গাছের সাথে ফাঁসি লাগিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।

   পুলিশ ময়নাতদন্তের তথ্য থেকে জানতে পেরেছে তাদের আগে খুন করা হয়েছে আর পরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে!

   এলাকার মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকান গুলোতে এখন আর তেমন জন মানুষ বসে না, সবাই যে যার কাজ সেড়ে বাড়িতে চলে যাচ্ছে।

   দ্বিতীয় খুনের পর থেকে বেশ শক্ত পোক্ত অচেনা মানুষের সমাগম বেড়ে গেছে এলাকায়।

   রহিম চাচা বলেছেন ওনারা নাকি পুলিশ, খুনিকে ধরার জন্য সিভিল পোশাকে এসে চারদিক নজর রাখছেন।

   রহিম চাচা রিটায়ার্ড প্রাপ্ত আর্মি অফিসার, ঘরে তার দুই কন্যা আর স্ত্রী। দিন বিশেক আগেও রহিম চাচা বেশ হাসি খুশি থাকতেন আমাদের সাথে। প্রতিবেশী আর একসাথে খেলাধুলা করায় রমিম চাচার সাথে সখ্যতা বেড়ে একদম বন্ধুর মতো হয়ে গিয়েছি আমরা। রহিম চাচা তার মেয়েদের নিজেই স্কুল কলেজে আনা নেয়া করতেন এই বয়সেও। কিন্তু অনেকদিন হয়ে গেলো তিনি তার মেয়েদের নিয়ে বের হন না, মাঝে মধ্যে কলেজ পড়ুয়া বড় মেয়েটাকে দেখা গেলেও তার ছোট মেয়েটাকে অনেকদিন দেখিনি। অথচ তিনি বেশিরভাগ সময় ছোট মেয়েটাকে নিয়েই বের হতেন।


    পনির ভাইয়ের দোকানের সোজা ঠিক অপরপ্রান্তে একটা একটা পাগল দেখা যাচ্ছে দিন দশেক হলো। পাগলটা সারাদিন প্রলাপ বকতে থাকে আর মাঝ বয়সী যুবক ভাইদের গালাগালি করতে থাকে অকথ্য ভাষায়! তাই বেশ অল্প দিনেই পাগলের উপস্থিতি আর পরিচিতি লক্ষ্য করেছে সবাই। দিনরাত পাগলটা ওখানেই থাকে, কেউ কেউ শুকনো বোনরুটি ছুড়ে মারে কেউ বিস্কুট দেয় কিন্তু পাগলটা খেতে চায় না। একমনে তাকিয়ে থাকে তেতুল তলার পাণে!

    আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম যেদিন পাগলটাকে প্রথম দেখেছি, দেখতে অনেকটা সিমিনের মতো লাগে, ওর মতো টানা টানা চোখ মুখ নাক সব কিছুই প্রায় একই শুধু ঠোঁটের কোনে যেখানটায় সিমিনের একটা তিল আছে আর পাগলটার সেখানে কাটা দাগ!

    সিমিন হচ্ছে রহিম চাচার দশম শ্রেণিতে পড়া ছোট মেয়েটা, ওর বিষয়ে এতো জানার কারণ হচ্ছে অজানা কোনো কারণে সিমিনকে খুব ভালো লাগে আমার। রহিম চাচা ওরে নিয়ে যখন স্কুলে যেতো তখন খুব ভালো প্রতিবেশীর ভূমিকায় আমিও রহিম চাচার সাথে কথা বলতে বলতে তাদের সাথে আগাতাম। কেন জানিনা সিমিনের আশেপাশে থাকতে আমার বেশ ভালো লাগতো। সিমিনও মাঝে মধ্যে কেমন একটা অন্যরকম চাহনি নিক্ষেপ করতো আমার পাণে। তখন বুকের ভিতর এতো ভালো লাগতো যার তুলনা আমি অন্য কিছুতেই পাইনি।


   অনেকদিন ধরে সিমিনকে রহিম চাচার সাথে দেখছি না আর তাকে জিজ্ঞেসও করতে পারছি না যদি সে অন্য কিছু ভেবে বসে এই ভয়ে। কিন্তু হঠাৎ করে ওর মতো দেখতে পাগলটাকে দেখে আমার কেনো যেনো পুরো দুনিয়াটাই অন্ধকার হয়ে এসেছিল! যখন দেখলাম ঠোঁটের কোনে তিলের জায়গায়টা কাটা তখন থেকে মনের ভিতর অন্যরকম ভাবনা চলে এসেছে আমার। তড়িঘড়ি করে রহিম চাচাকে ডেকে এনে যখন দেখালাম,

     "দেখুন চাচা পাগলটাকে দেখতে একদম সিমিনের মতো মনে হয় না?"

     "কিহ! কক কক কই কই! ধুর কি যে বলো তুমি? সিমিন তো ঘুমাচ্ছে ও এখানে আসবে কি করে!"

     "কি বলেন চাচা? এই সন্ধ্যা বেলায় ঘুমাচ্ছে?"

     "ও তো এখন সব সময়ই ঘুমায় বাবা"(নিস্তেজ হয়ে)

     "মানে কি বলছেন?"

     "কি, কই না কিছু না। বলছি একটু অসুস্থ তো তাই বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে থাকে কিনা তাই।"

     "কি হয়েছে চাচা সিমিনের? ও ঠিক আছে তো! নাকি এমনিতে জ্বর হয়েছে?"

ওর অসুস্থতার কথা শুনে আমাকে বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করতে দেখে চাচা আমার দিকে আড়চোখে তাকালেন কিন্তু কিছু বললেন না।

    "তেমন কিছুনা সুস্থ হয়ে যাবে সমস্যা নেই।"

আমি বুঝলাম না পাগলটাকে আমি সিমিনের মতো বলায় চাচা ওমন ভাবে ঘাবড়ে গেলেন কেনো! আর সিমিন অসুস্থ এতোদিন আমাদের বললেন ও না। হবে হয়তো বলার প্রয়োজন মনে করেনি কিন্তু সিমিনের কি হয়েছে বুঝতে পারছি না।


   পুলিশ কাল রাত থেকে খুব কড়াকড়ি ভাবে এলাকার লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করে দিয়েছে। তিনটা খুন হলো পর পর তিনদিন বাদে নয়দিনের ভিতর অথচ খুনিকে এখনো ধরতে পারছে না তারা। সংবাদ মাধ্যমের লোকজন প্রায়ই এসে পুলিশের ব্যার্থতার কথা তুলে ধরছেন আর তারা এটাও বলছেন যে বারোদিনের মাথায় যদি তেতুল তলায় আরেকটা লাশ ঝুলতে দেখা যায় তাহলে পুলিশ কি করবে! এই নিয়ে এলাকার অবস্থা বেশ গরম। শুনলাম কাল রাত থেকে এখন দুপুর অবদি যাদের সাথে কথা বলে সন্দেহজনক মনে হয়েছে তার ভিতর থেকে জন পনেরো লোকজনকে থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ!

   বিকেলে বাসার জন্য ডিম কিনতে গিয়ে দেখি তেতুল তলার দিকে যাচ্ছে সবাই আর বলাবলি করছে মিন্টু ভাইকে কে জানি মেরে তেতুল তলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে!....


তেতুল তলা...👹

পর্ব: ০২


বিকেলে বাসার জন্য ডিম কিনতে গিয়ে দেখি তেতুল তলার দিকে যাচ্ছে সবাই আর বলাবলি করছে মিন্টু ভাইকে কে জানি মেরে তেতুল তলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে!....


   মিন্টু ভাই এলাকায় মোটামুটি পরিচিত একজন ব্যাক্তি, বছর তিনেক হয়েছে বিয়ে করেছেন তবে এখনো সন্তান হয়নি তার। মিন্টু ভাইয়েরা আমাদের এলাকায় স্থানীয় না তবে অনেক পুরনো ভাড়াটিয়া তারা, আমি ছোট থেকেই তাদের দেখে এসেছি।

   পুলিশ যাদের থানায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের আজ সবাইকে নিয়েও এসেছেন।

   কারণ তাদের ভিতর কেউ খুনি হলে আজ মিন্টু ভাইয়ের লাশ তেতুল গাছে ঝুলত না!

 

সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের বড় কর্মকর্তার গাড়ি এসে থামলো ঠিক রহিম চাচার বাসার সামনেই।

অফিসার গাড়ি থেকে নামার আগে তার গাড়ির দরজার সম্মুখে এস. আই কনস্টেবল এসে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন তার গাড়ি থেকে নামার অপেক্ষায়। বোঝাই যাচ্ছে খুব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তিনি, গাড়ি থেকে নেমেই সোজা চলে গেলেন রহিম চাচার বাসায়!

   আমরা নিস্তব্ধ হয়ে সবাই তাকিয়ে আছি রহিম চাচার বাসার দিকে, সবার মনে একটাই প্রশ্ন যে রহিম চাচার বাসায় পুলিশ কেনো! তাহলে কি তিনি খুন করেছেন এতোদিন! প্রশ্ন দিয়ে যে প্রশ্ন বাড়বে এটাও স্বাভাবিক। রহিম চাচা আর্মি অফিসার হয়ে এমন কাজ করলেন! কিন্তু কেনো করলেন!

    সবার চোখ রহিম চাচার বাড়ির দিকে আর আমি এখন তাকিয়ে আছি পাগলটার দিকে। পাগলটা ঘুমিয়ে আছে, গায়ে নোংরা কাপড়, রোদে পুড়ে যাওয়া লাল চুল যার যত্ন না নেয়ায় জট বেঁধে আছে।

    ঘুমিয়ে থাকায় পাগলটাকে কেমন যেনো মায়াবী মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে সিমিন থাকলেও ওরে ঠিক এমনই লাগবে!


 সিমিনের কথা মনে পরতেই বুক কেমন ধড়ফড় করে উঠছে আমার। তাহলে কি এটাই সিমিন! কিন্তু কি থেকে কি হচ্ছে এসব! সিমিনের এমন অবস্থা কেনো হবে! আর রহিম চাচার বাড়িতে এতো পুলিশ কেনো এলো!

   পুরো এলাকা এখন উৎসুক জনতা, সিমিনদের বাসার চারপাশে জমায়েত হয়ে তাকিয়ে আছে সবাই। দু'একজন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ রহিম চাচার বাসায় যেতে চাইলে পুলিশ তাদের বাধা দিচ্ছে। ভিড় জমানো মানুষ গুলোকেও দূরে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে কিন্তু কেউ দু'এক কদমের বেশি সরছে না কারণ সবাই মন ভর্তি প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে, যার উত্তর কেউ হয়তো এখন পাবে না কিন্তু চোখের অনুমান নিয়ে প্রশ্নের উত্তর মিলাবে বলে অপেক্ষায়...

  তেতুল তলা থেকে এখনো মিন্টু ভাইয়ের লাশ হাসপাতালে নেয়া হয়নি। এর আগের পাওয়া লাশ গুলো এতো সময় রাখা হয়নি।

    সবার মিনিট ত্রিশেক অপেক্ষার প্রহর বোধহয় শেষ হয়ে এলো, পুলিশ বের হয়ে আসছে সিমিনদের বাসা থেকে। ধীরে ধীরে রহিম চাচাকেও দেখা যাচ্ছে সেই বড় কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছেন তিনি। কিন্তু সবাই খুব আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে কারণ রহিম চাচা আর অফিসার বেশ হাস্যজ্বল ভাবে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছেন দুজন। যদিও হাসিটা অন্য দিনের মতো সাধারণ নয় কারণ এলাকায় লাগাতার মানুষ খুন হওয়ায় সবার মুখই ইদানীংকালে কিছুটা শুকনো।

    পুরো এলাকা রহিম চাচার হাসিতে যেনো স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো। কেউ জানে না তাঁর বাসায় পুলিশ কেনো আসলো, তবে সবই নিজেদের বুদ্ধি দিয়ে বলাবলি করছে যে রহিম চাচা রিটায়ার্ড প্রাপ্ত আর্মি অফিসার তাই তার সাথে পুলিশের বড় কর্মকর্তাদের ভালো পরিচয় থাকবে এটাই স্বাভাবিক।


  রহিম চাচাকে সাথে নিয়ে সব পুলিশ কর্মকর্তারা তেতুল তলায় পৌঁছেছেন। মিন্টু ভাইয়ের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে, দু'একজন পুলিশ বাদে ধীরে ধীরে অন্যসব পুলিশও চলে গেছেন।

   বাড়ির দিকে আসছেন রহিম চাচা,

   কিন্তু তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেছেন এলাকার বাচ্চা থেকে মুরব্বি সবাই। সবাই যে যা আন্দাজ করলেও মুখে এখন একটাই প্রশ্ন, "কি হয়েছিল!"

   রহিম চাচা দাঁড়িয়ে গেলেন তাদের সম্মুখে, সবাইকে বললেন তার সাথে ওই কর্মকর্তার ভালো বন্ধুত্ব রয়েছে। যার দরুন এলাকায় মানুষ খুন হওয়ায় তার সাথে কথা বলতে এসেছে কাউকে সন্দেহ হয় কিনা সে বিষয় জানতে।

   "তা আপনি কি বললেন? কেউ কি আছে যার উপর আপনার সন্দেহ হয়?" (মকবুল চাচা প্রশ্ন করলেন)

   "ভাই আমরা তো আইনের মানুষ আইন নিয়ে কাজ করেছি আমাদের চোখে সন্দেহের পাত্রের অভাব নেই। কিন্তু খুন দেখে বোঝা যাচ্ছে খুনী কিছু একটা বুঝাতে চাইছে তাই সন্দেহ করার আগে খুনীর বার্তাটা জানা জরুরী। শুনলাম ঢাকা থেকে নাকি স্পেশাল অফিসার এসেছেন যে ইতমধ্যে এলাকায় অবস্থান করছেন এবং সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। আপনারা কারো সাথে কোনো রকম ঝামেলায় জড়াবেন না আর অপরিচিত মানুষ দেখলে তাদের সাথে খারাপ আচরণ করবেন না।


   কথাগুলো বলে রহিম চাচা তার বাড়ির ভিতর চলে গেলো, ধীরে ধীরে লোকসমাগম কমতে শুরু করলো। আমিও বাসায় চলে এলাম, কেন জানিনা পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। রহিম চাচা যে খুনী নন তা কেউ বলতে পারবে না আর কে খুনী তাও কেউ বলতে পারবে না তবে সবাই একটু আগে তার বাসায় পুলিশ দেখে যা ভেবেছিল ওই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য এখন ভিন্নরকম পরিবেশ বিরাজমান হচ্ছে।

    রাত আনুমানিক দুটো বাজে,

    তেতুল তলার কাছ থেকে একটা মেয়ের চিৎকার শোনা যাচ্ছে!

    অন্য সময় হলে সবাই চিৎকারের শব্দ শুনে কোথা হতে শব্দ ভেসে আসছে তা নিয়ে বিচলিত হতো৷ কিন্তু কয়েকদিন ধরে সবাই তেতুল তলায় যাতায়াত আর ওদিকের ভাবনায় থাকার কারণে বুঝতে বেশি কষ্ট হয়নি যে চিৎকার তেতুল তলার দিক থেকেই ভেসে আসছে!....

    কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে কেউ বাসা থেকে নামছেন না! চিৎকারের শব্দ ধীরে ধীরে সব বাড়ির অন্ধকার ঘুচে লাইট জ্বলে আলোকিত হয়ে গিয়েছে। সবাই যে যার জানালায় অবস্থান করছেন, দরজাটা পর্যন্ত কেউ খুলছে না। একজন অন্যজনের সাথে ফোনে কথা বলে বিষয়টা ধীরে ধীরে যারা ঘুমিয়ে ছিলেন বা এলাকার বাহিরে আছেন তাদের কাছেও ছড়িয়ে গেছেন কিন্তু কেউ বাসা থেকে নামছে না!

    এক এক করে চারটি শক্তপোক্ত মাঝ বয়সী যুবক ছেলের খুন হয়েছে তেতুল তলায় যার কারণে ভয় এতোই গ্রাস করেছে যে কেউ সাহস করে যেতেই পারছে না চিৎকার করা মেয়েটি কে বা কেন চিৎকার করছে এটা দেখতে....

    

     দূর থেকে কে যেনো আসছে তেতুল তলার দিক থেকে, বেশ জোরে হাঁটতে হাঁটতে আসছেন। হাতে একটা টর্চ লাইট দেখা যাচ্ছে আর কাঁধে সাদা রঙের মোটা রশি! যে চারজন খুন হয়েছে তারা এরকম মোটা রশিতেই ঝুলছিল! লোকটার হাঁটার গতিবিধি দেখে অনেকটা পরিচিত মনে হচ্ছে।

     তাহলে কি!.....


তেতুল তলা...👹

পর্ব: ০৩ ও শেষ


দূর থেকে কে যেনো আসছে তেতুল তলার দিক থেকে, বেশ জোরে হাঁটতে হাঁটতে আসছেন। হাতে একটা টর্চ লাইট দেখা যাচ্ছে আর কাঁধে সাদা রঙের মোটা রশি! যে চারজন খুন হয়েছে তারা এরকম মোটা রশিতেই ঝুলছিল! লোকটার হাঁটার গতিবিধি দেখে অনেকটা পরিচিত মনে হচ্ছে।

     তাহলে কি!.....


মকবুল চাচা!

লোকটাকে দেখতে অনেকটা মকবুল চাচার মতো মনে হচ্ছে, মকবুল চাচা হাঁটার সময় মাঝে মধ্যেই কুজো হয়ে নুইয়ে পরেন আবার একটু পর পর সোজা হয়ে হাঁটেন! যার জন্য তার এইরকম হাঁটার গতিবিধি এলাকার সবাই চিনেন। মাঝে মাঝে এটা নিয়ে তাকে দু'একজন খোঁচা মেরে কথাও বলেন রাগিয়ে দেয়ার জন্য।

আর এই যে লোকটা তেতুল তলা থেকে হেঁটে আসছেন তিনিও ঠিক মকবুল চাচার মতোই হাঁটার মাঝে নুইয়ে পরছেন আবার নিজেকে সোজা করে হাঁটছেন!

   কিন্তু মকবুল চাচা এতো রাতে তেতুল তলায় কেনো! আর তেতুল তলা থেকে ভেসে আসা মেয়েটার চিৎকারও এখন আর শোনা যচ্ছে না! তবে কি মেয়েটাকে মেরে ফেললো!

   তবে মকবুল চাচার চেহারা দেখা যাচ্ছে না, শীতের পোশাক পরে বের হয়েছেন বোধহয়। হুডির টুপি দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছেন আর মাথা নিচু করে হাঁটছেন যার জন্য তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না....


  লোকটা হাঁটতে হাঁটতে ঠিক মকবুল চাচার বাসার সামনে এসে দাড়ালেন কিন্তু ভিতরে ঢুকলেন না। এলাকার মানুষজন নেমে তাকে ধরতে আসতেই পালিয়ে গেলেন রাতের অন্ধকারে...

  তৎক্ষণাত সবাই বলে উঠলো পুলিশের খবর দিতে, যেই ভাবা সেই কাজ। পুলিশ এলো, তাদেরকে সব খুলে বলার পরে তারা প্রথমে তেতুল তলার দিকে যেতে নিলেও সবাই গেলেন না। কিছু দিন সংখ্যক তেতুল তলায় আর কয়েকজন মকবুল চাচার বাসায়।

  পুলিশ না আসা অবদি কেউ মকবুল চাচার বাসার সামনে থেকে সরেনি, পুরো বাড়ির চারপাশে নিজেরাই পাহারা দিয়েছে।

  কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে মকবুল চাচার দরজায় কড়া নাড়ার পরে তিনি নিজেই বাসার দরজা খুলে বেরিয়েছেন!

  কে কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না কেউ।

  পুলিশ মকবুল চাচাকে বিভিন্নভাবে জেরা করেও কিছু সন্দেহজনক আন্দাজ করতে পারেনি। আবার কেউ মকবুল চাচার চেহারা দেখেনি শুধু হাঁটার গতিবিধি দেখে সন্দেহ করেছে তাই প্রমাণ না থাকায় তাকে সহ সবাই তেতুল তলায় চললেন এবং ইতমধ্যে ঘটে যাওয়া সব কিছু খুলে বললেন। প্রথমে মকবুল চাচা চেচিয়ে উঠলেন যে তার ওমন হাঁটার জন্যই হয়তো সবাই মজা নিচ্ছে! কিন্তু পুলিশ আর সকলের মুখে তাকিয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ, তিনি নিজেও ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেছেন তার মতো দেখতে খুনীর অবস্থা শুনে।

  

মেয়েটার চিৎকারের সন্ধানে যে দুজন পুলিশ আগে তেতুল তলায় গিয়েছেন তারা সেখানে কোনো মেয়েকে খুঁজে পায়নি।

       কোনো জনমানুষের চিহ্ন নেই তেতুল তলায়... অথচ পুরো এলাকা ওখান থেকে ভেসে আসা চিৎকারে জেগে উঠেছে। আশেপাশে ভালোভাবে দেখেও কোনো হদিস পাওয়া গেলো না কোনো মেয়ের, হয়তো কোথাও চলে গেছে মেয়েটা কিন্তু কি হয়েছিল এখানে! মকবুল চাচার মতো দেখতে লোকটা আসলে কে আর এখানে কোন মেয়ে ছিলো! কি হয়েছে মেয়েটার সাথে!

    মন ভর্তি উত্তরহীন প্রশ্ন নিয়েই সবাই যে যার গন্তব্যে চলে গেলেন কিন্তু কেউ জানতেন না তাদের জন্য সকালে কত বড় চমক ছিল....


    আমি সকাল ন'টা নাগাদ বের হয়েছি বাসার প্রয়োজনে দোকানে, একটু দূরে হওয়া স্বত্বেও পনির ভাইয়ের দোকানেই গেলাম কারণ ওখানে সিমিনের মতো দেখতে পাগলটা রয়েছে। কেন জানিনা ওরে দেখলে আমার সিমিন মনে হয় আর অনেকদিন সিমিনকে না দেখায় মনের ভিতর অনেক অজানা ভাবনা চিন্তা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। কিছু সময় দাঁড়িয়ে পণ্য নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হাঁটছি এমন সময় দেখলাম রহিম চাচা সিমিনকে নিয়ে বের হয়েছেন!

    আমি যেনো হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি ওরে সুস্থ স্বাভাবিক দেখে! মনের ভিতর কতো অজানা জল্পনা-কল্পনা ভেবে বসে ছিলাম আর সিমিন আমার সামনে, কি সুন্দর ভাবে হাসতে হাসতে বের হচ্ছে রহিম চাচার সাথে। আমি পিছে ফিরে দেখছি পাগলটা আছে তোহ! হ্যাঁ সেও বসে আছে পনির ভাইয়ের দোকানের সোজা অপরপ্রান্তে....


রহিম চাচা হয়তো কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছেন আমাকে দেখে, তাই নিজেই আসলেন আমার সাথে কথা বলতে আর সাথে সিমিন।

    চাচা কি চান বা ভেবেছেন জানিনা, সিমিনকে আমার সাথে কথা বলতে রেখে নিজেই রাস্তার ওপাশে গেলেন তার বয়সী মুরব্বিদের সাথে কথা বলতে!

    চাচার এমন অবস্থা দেখে যা কথা মনে জমে ছিল সব ভুলে বসেছি আমি। সামনে সিমিন থাকতেও আমি তাকিয়ে আছি তার দিকে যে কি চাচ্ছেন তিনি! নাকি আবার এমনিতেই বিশ্বাস করে ওরে আমার কাছে রেখে গেলেন! আশেপাশে থেকেও মানুষজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সিমিবের দিকে, হয়তো তারাও আমার মতো কিছু ভেবেছেন পাগলটাকে দেখে!

    যা হোক আমি সিমিনকে একের পর এক প্রশ্ন করা শুরু করে দিলেও ওর একটা উত্তরেই আমার সব উত্তর পাওয়া হয়ে গিয়েছে। জ্বর হয়েছিল সিমিনের যা খুব খারাপ পরিস্থিতির রূপ নিয়েছিল আর এখন ও সুস্থ। স্বস্থির নিশ্বাস ফেললাম আমি, সিমিনের সাথে কথা হচ্ছে এমন সময়


   হঠাৎ তিনটি গাড়ি ভর্তি পুলিশের গাড়ি এসে থামলো মকবুল চাচার বাসার সামনে। তড়িৎ গতিতে সব গুলো পুলিশ ঘেরাও দিয়ে দাড়িয়েছেন মকবুল চাচার বাড়ির পাশে লিখন ভাইয়ের বাসায়!

   ঘটনার আকস্মিক পরিস্থিতিতে সবাই আতংকিত হয়ে তাকিয়ে আছে এই বাড়ির দিকে। রহিম চাচা ছুটে এসে সিমিনকে বাড়ি পাঠিয়ে আমাকে দূরে সরে যেতে বললেন। 

   হঠাৎ পনির ভাইয়ের দোকানের অপরপ্রান্তে থাকা পাগলটা দৌঁড়ে আসতেই এলাকার মানুষ ওরে ধাওয়া দিতে যাচ্ছে এমন সময় পুলিশ এসে তাদের বাধা দিলেন এবং দাঁড়িয়ে থাকা সব পুলিশ কর্মকর্তা স্যালুট দিলেন পাগলটাকে! পাগলটা দেখলাম তার চেহারা ধরে টান দিচ্ছে নিজেই আর ওমনি কেমন যেনো সিমিনের চেহারা আর জমাট বাঁধা চুল গুলো তার হাতে চলে এলো! অবাক হয়ে দেখছে সবাই...

    সিভিল পোশাকে কয়েকজন বেশ শক্তপোক্ত ব্যক্তি এসে দাড়ালেন পাগলটার পিছনে, যাদের ভিতর কয়েকজন লুঙ্গিও পরা!

    পুলিশের গাড়ি থেকে বেশ উন্নত মানের অস্র নিয়ে পাগলটাসহ পাঁচজন সিভিল পোশাক পরা অফিসার চলে গেলেন লিখন ভাইয়ের বাসায়!


লিখন ভাই আমাদের এলাকায় এসেছেন বছর খানেক হয়েছে কিন্তু তা কেউ বলতে পারবে না, কারণ সবার সাথে সে এমন আন্তরিক ভাবে মিশেছেন যেনো কতকাল ধরে আছেন আমাদের সাথে।

   আনুমানিক প্রায় ঘন্টা খানেক পরে হাতে হ্যান্ডকাফ আর মুখে কালো কাপড় পরিয়ে বের করা হয়েছে লিখন ভাইকে! একে একে কয়েকজন পুলিশ পোশাক পরা অফিসার গেলেন বাসার ভিতর।

   নিয়ে এলেন সাদা রঙের কিছু দড়ি, ধারালো অস্র আরও কিছু সরঞ্জাম এবং সব শেষে একটা মেয়ের লাশ! আনুমানিক পনেরো ষোল বছর বয়স হবে মেয়েটার।


   সকলের কৌতুহলের যেনো শেষ নেই, এমন ঘটনা ঘটবে তা যেনো কল্পনায়ও আসেনি কারো! এতো আপন এতো আন্তরিক ছেলেটা এসব করতো কেউ ভাবতেও পারেনি।

   ধীরে ধীরে সবাই জানতে পেরেছে আসল ঘটনা,

   লিখন ভাই হচ্ছে সাইকো কিলার! পুলিশ জানিয়েছেন এর আগেও বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে লাগাতার মানুষ খুন করে রাতারাতি পালিয়ে আসতেন তিনি! অল্পদিনেই আন্তরিক হয়ে মানুষের সাথে মিশে এমন কাজ করাই তার ভালো লাগা! তার লক্ষ্য শুধু বিবাহিত যুবক কারণ তাদের মেরে ফেলার আগে তাদের শারীরিক নির্যাতনে জেনে নেন স্ত্রীদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য যা দিয়ে অল্প বয়সে বিধবা নারীদের একাকিত্বকে বশে এনে দৈহিক সম্পর্কে আনন্দিত হন লিখন!

   তাকে প্রমাণসহ ধরতেই এলাকায় পাগল সেজে এসেছেন সদ্য পুলিশে যোগদান করা এসপি ইমরাতুল জান্নাত।


.......সমাপ্ত........


লিখক: মারুফ ইসলাম


এমন আরও অনেক গল্প পড়ুন।