বাবা ছেলের ফেসবুক স্ট্যাটাস
গলার টাই টা খুলতে খুলতে রুদ্র জিজ্ঞেস করল,
"বাবাকে দেখছি না যে? কোথায় বাবা?"
কিছুটা রাগী কণ্ঠে নীরা উত্তর দিলো,
"দেখো গিয়ে ভিক্ষে করছে। ছি: ছি:! ছেলের এত বড় বাড়ি, টাকা পয়সা থাকতেও উনাকে ভিক্ষা করতে হবে! লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়। উনাকে নিজের শ্বশুর বলে পরিচয় দিতেও লজ্জা লাগে। কথায় বলে না ভিখারিকে সোনার বাটি দিলেও সে সেটা দিয়ে ভিক্ষা করবে। তোমার বাবা সেরকম।"
বাঁকা হেসে রুদ্র বলল,
"তুমি এমনিতেও আমার বাবাকে নিজের শ্বশুর বলে পরিচয় দাও না। লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার কথা না তোমার।"
রুদ্রকে বের হতে দেখে নীরা বলল,
"আবার কোথায় বের হচ্ছো তুমি? মাত্রই অফিস থেকে ফিরলে।"
রুদ্র নীরার দিকে না তাকিয়েই বলল,
"বাবাকে আনতে যাচ্ছি।"
গাড়িতে উঠে বসতেই ড্রাইভার বলল,
"বাপেরে খুঁজতে বের হইবেন?"
রুদ্র কিছুক্ষণ কপালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল। তার খুব ক্লান্ত লাগছে। তার এত বড় হওয়ার পিছনে তার বাবার সেই ভিক্ষের টাকার অবদান আছে। আজ যখন সে এতসব কিছু উপার্জন করেছে সে চায় বাবা ভিক্ষে করা ছেড়ে দিক। কিন্তু সেট হচ্ছে না। ভিক্ষে করা নাকি তার রক্তে মিশে গেছে।
রুদ্র জানালা দিয়ে তাকাল। তার চোখ ছলছল করছে। কোনোমতে সে ড্রাইভারকে বলল,
"গাড়ি স্টার্ট করো।"
ছোট সাহেবকে অফিস থেকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তাকে আবার বের হতে হয় ছোট সাহেবের বাবাকে খুঁজতে৷ তাই সে এখন আর গাড়ি থেকে নামে না। গাড়িতেই বসে থাকে। এরপর করিম সাহেবকে খুঁজে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তবেই তার ছুটি হয়।
মোহন গাড়ি চালানো শুরু করল। রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে সে বলল,
"বড় সাহেবরে সকালে আপনের অফিসে বের হওয়ার আগেই বের হইয়া যাইতে দেখসিলাম। বললাম কই যান? হ্যায় কোনো উত্তর দিলো না।"
"বাবা যে বের হচ্ছে তুমি আমাকে বলোনি কেন?"
"উনি তো আপনারে কইতে মানা করসে।"
"তাহলে এখন বলছো কেন? মানা যেহেতু করেছে তাহলে একেবারেই কথাটা গোপন রাখা দরকার ছিল।"
রুদ্র কী তার সাথে মজা নিচ্ছে কিনা বুঝতে পারলো না মোহন। সে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে সামনে থাকা আয়নার দিকে তাকিয়ে তার সাহেবের মন বুঝার চেষ্টা করল।
"যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা কই?"
"বলো।"
"আপনার বাবারে একটা পাগলের ডাক্তার দেখান। উনার মাথার ঠিক নাই। নয়ত এত বড় বাড়ি, গাড়ি থাকতে কেউ ভিক্ষা করে?"
দাঁত কিড়মিড় করে রুদ্র বলল,
"তোমাকে এত কিছু ভাবতে হবে না। চুপ থাকো।"
"আমি আপনের কাছে কাম করি। আমি নাহয় চুপ ই থাকলাম৷ আপনে কয়জনের মুখ এমনে বন্ধ করবেন? সবাই হাসাহাসি করে।"
"ড্রাইভার, গাড়ি থামাও।"
সাথে সাথেই ব্রেক কষলো মোহন। আশে পাশে তাকিয়ে দেখল তার বড় সাহেব ফুটপাতে একটা থালা হাতে বসে আছে। রুদ্র গাড়ি থেকে নামলো। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল বাবার দিকে। সে দেখল এক লোক পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। তার সামনে হাত পাতলো তার বাবা। লোকটা পকেট থেকে দুই টাকার একটা ছেড়া নোট বের করে দিলো। দৃশ্যটা দেখতে কেমন যেন বুক ছিঁড়ে যাচ্ছিলো রুদ্রর। সে গিয়ে তার বাবার পাশে বসে পড়ল। তার এত দামি ড্রেসটায় ময়লা ভরছে সেদিকে খেয়াল নেই তার।
মৃদু স্বরে ডাকলো সে।
"বাবা..."
করিম সাহেব কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দিলেন,
"কে? রুদ্র তুই?"
চোখ মুছে রুদ্র গলা স্বাভাবিক রেখে বলল,
"হ্যাঁ, বাবা। বাড়ি চলো।"
এরপর করিম সাহেবকে ধরে রুদ্র গাড়ির সামনে নিয়ে গেল। যত্ন সহকারে গাড়িতে উঠালো। কিছুক্ষণ আগেই যাকে দুই টাকা ভিক্ষে দিয়েছে তাকে এত দামি গাড়িতে চড়তে দেখে হতবাক হয়ে যায় সেই পথচারীটি।
গাড়িতে বসার পর করিম সাহেবকে লজ্জা পেতে দেখা গেলো। রোজকার অভ্যাস মত তিনি আবারও ভিক্ষে করতে বেরিয়েছেন। অথচ তিনি কালকেও ছেলেকে কথা দিয়েছিলেন তিনি আর ভিক্ষে করবেন না। কথা রাখতে পারেননি তিনি। রুদ্র চুপ করে আছে। তিনি ভেবেছিলেন রুদ্র হয়ত তাকে কড়া ভাষায় কিছু বলবে। কিন্তু সে কিছুই বলছেন না।
লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে মাথা নিচু করে করিম সাহেব বললেন,
"আসলে অনেক দিনের অভ্যাস তো...তাই ছাড়তে... "
রুদ্র সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
"হ্যাঁ, জানি বাবা। ৪৫ বছরের অভ্যাস।"
করিম সাহেব কী বলবেন খুঁজে পাচ্ছেন না। রুদ্র বুঝতে পেরেছে সে হয়ত তার বাবাকে কখনোই ভিক্ষে করা থেকে আটকাতে পারবে না। তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো আচ্ছা, বাবা তোমাকে যদি একটা স্বর্ণের বাটি দেয়া হয় তুমি কী করবে? কিন্তু সে জিজ্ঞেস করলো না। নীরার কথাকে সঠিক প্রমাণ করে দিয়ে তার বাবা হয়ত বলতো, "আমার আগের বাটিটা তো ফুটো হয়ে গেছে। এটা দিয়ে ভিক্ষে করব।"
সে বাবাকে অন্য একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল,
"আজকে কত টাকা পেয়েছ বাবা?"
এই প্রশ্নে করিম সাহেবের চোখ যেন ঝলমল করে উঠল। খুশি গলায় বলল,
"আজকের আয় খুব ভালো হয়েছে জানিস। পুরো দেড় হাজার।"
রুদ্রও একটু হেসে বলল,
"ওহ আচ্ছা।"
গাড়ি পৌঁছে গেল বাসার সামনে। রুদ্র হাত বাড়িয়ে দিয়ে বাবাকে গাড়ি থেকে নামালো।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে রুদ্র জিজ্ঞেস করল,
"আচ্ছা বাবা, ভিক্ষে বেশি পাওয়ার জন্য তুমি যখন নিজের একটা চোখ নিজের হাতে নষ্ট করেছিলে তখন কী তোমার খুব কষ্ট হয়েছিল?"
প্রশ্নটায় থমকে গেলেন করিম সাহেব। তিনি জানতেন না যে তার অগোচরে আরো দুইটা চোখ এই ঘটনার সাক্ষী ছিল।
"তুই কীভাবে জানলি?"
রুদ্র এই প্রশ্নের উত্তর দিলো না। সে বলল,
"তুমি যখন এতকিছু থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেকদিনে ভিক্ষে করতে বেরিয়ে পড়ো আমার একই কষ্ট হয়।"
করিম সাহেব থরথর করে কাঁপতে থাকলেন। রুদ্র শক্ত করে তার বাবাকে ধরল। শান্ত স্বরে বলল,
"ঘরে চলো, বাবা।"
(সমাপ্ত)
ভিক্ষে
অরণী মেঘ