বিয়ে নিয়ে স্ট্যাটাস
আমার বিয়ের বয়স হয়েছে। কিন্তু একটার পর একটা বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। এমন নয় যে আমি দেখতে অসুন্দরী বা গায়ের রং ময়লা।
আমি দেখতে মোটামুটি সুন্দরী। গায়ের রং কাঁচা হলুদের মতো। মাথা ভর্তি রেশম কালো চুল হাঁটু ছুঁই ছুঁই করছে।
আমার জন্য খুব ভালো ভালো প্রপোজাল আসে। পছন্দ ও হয় তাদের। তারপর যৌতুক দাবি করে বসে।
আর আমার বাবার এক কথা। আমার মেয়ে তো ফেলনা নয় যে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিব। শুধু মাত্র যৌতুকের কারণে একটার পর একটা বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে আমার!
সংসারে আমার মায়ের কথার কোন মূল্য নেই। একদম ছোট থেকেই দেখেছি, মা কোন মতামত প্রকাশ করতে পারে না সংসারের কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে। বাবা মা দুজনেই চাকরি করতো একসময়। কিন্তু বেতন পেয়ে সব টাকা বাবার হাতে তুলে দিতে হতো মাকে।
একটা টাকা বাবার পারমিশন ছাড়া খরচ করতে পারতো না। আমার খালা, মামাদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো। তারা সবসময় আমাদের বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করতো। বিশেষ করে ঈদ আসলেই নতুন পোশাক পাঠাতো।
কিন্তু আমার মা কখনো তার ভাই বোনদের বাচ্চাদের জন্য কিছু করতে পারতো না। এটা নিয়ে মায়ের মনে খুব আফসোস কাজ করতো সবসময়।
মাঝে মধ্যে ওভার টাইম করে সেই টাকা লুকিয়ে ফেলতো। বাবাকে না জানিয়ে আমার খালাতো ভাই বোন দের ঈদের আগে খুব সামান্য কিছু টাকা পাঠায় আবার বলে দিতো ঐশ্বর্যের বাবা যেন না জানে!
আমার খুব কষ্ট হয় মায়ের জন্য। নিজের ইনকামের টাকা চুরি করে দিতে হবে কেন! কেন মা মুখ বুজে সহ্য করে এসব! এটা কেমন সম্পর্ক!
খালাদের কাছে গল্প শুনেছি আমার বাবা বিয়ের সময় ক্যাশ টাকা যৌতুক তো নিয়েছিলই। আমার নানাভাই গোল্ডের পাশাপাশি সংসারে যা লাগে, সুঁই সুতা থেকে শুরু করে বদনাটা পর্যন্ত দিয়েছিলেন। ট্রাক ভরে সবকিছু দেওয়ার পরেও কিছু হলেই কথায় কথায় মায়ের গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করতেন না আমার বাবা।
বিয়ের পর থেকে আমার মা নানু বাড়িতেই থাকতেন বেশি। নানা ইন্জিনিয়ার ছিলেন। তার আদরের কন্যার জন্য দুহাতে খরচ করতেন।
আমার ভাইয়া যখন জন্ম নিলো, তখন আমার বাবা নাকি বলেছিলেন আমার লাখ টাকার সম্পত্তি!
এটাই ছিল ভাইয়া কে দেখে তার প্রথম কথা।
কাজ কর্ম সেভাবে করতেন না। কিন্তু জুয়া খেলে টাকা উড়াতেন। ভাইয়া যে প্রথম সন্তান। কিন্তু সেই সন্তানের প্রতি তার কোন দায়িত্ববোধ ছিল না। ভাইয়ার দুধ থেকে শুরু করে পোশাক আশাক সবকিছু নানা ভাই দিতো। অবশ্য তাদের এমনিতেও তেমন খরচ ছিল না। কারণ নানু বাড়িতেই থাকতেন তারা।
ভাইয়ার পাঁচ বছর পর আমার জন্ম। আমি ও বড়ো হয়েছি নানু বাড়িতেই।
নানা ভাই রিটায়ার্ড করার পর আমার বাবা মা নিজের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন পাকাপাকি ভাবে।
এই যে ছেলে নিয়ে আমার বাবার এতো অহংকার। সেই অহংকার ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে আমার ভাইয়া।
পড়ালেখা করে না। ভবঘুরে হয়ে খায় আর ঘুরে বেড়ায়। বিয়ের বয়স হয়েছে তবুও বিয়ে করতে পারছে না। কাজ কর্ম না করলে কে দিবে তার কাছে মেয়ে?
শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই জন্য ভালো চাকরি ও পায় না। আবার বাবার আর্থিক অবস্থা ও এমন নয় যে, ছেলেকে বিজনেস পারপাসে টাকা দিবে।
আমার মা খালারা পাঁচ বোন এক ভাই।
আমার নানু তার পাঁচ মেয়ের জন্য ঢাকায় একটা জায়গা লিখে দিয়েছেন। আমার বাবা আল্লাহর ত্রিশ দিন মায়ের সাথে ঝামেলা করে। জায়গাটা বিক্রি করে টাকা নিয়ে আসতে বলে।
আমার মায়ের কথা হলো জায়গাটা তো দিন দিন দাম বাড়ছে। থাকুক না। বিক্রি করলেই তো টাকা খরচ হয়ে যাবে।
বাবা তখন মাথা গরম করে মুখে যা আসে তাই বলতে থাকেন। মেয়ে মানুষের মাথায় ঘিলু আছে নাকি।
ভালো করে শুনে রাখো বোকা মহিলা। এই টাকা খরচ করা হবে না। এখন আমরা দুজনেই ঘরে বসে আছি। জায়গা জমি থেকে যা আসে, তাতে কোন রকম দিন চলে যায়। কিন্তু ভালো ভাবে বেঁচে থাকতে ক্যাশ টাকা তো লাগে নাকি?
এই টাকা এক সমিতিতে রাখব। তিন বছর পর ডাবল হবে। আর মাসে মাসে যে ইন্টারেস্ট পাব তাই দিয়ে আমাদের সংসার চলে যাবে রাজার হালে।
এখন দুজনেরই বয়স হয়েছে। নানা রকম রোগ শরীরে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে তারা এখন গৃহস্থালি করছে।
আমাদের নিজেদের ও অনেক জমিজমা আছে। সেখান থেকে ভালো ফসল আসে। কিন্তু বাবার নজর মায়ের নামে সেই জমিতে।
আমার খালারা মাকে অনেক বুঝিয়েছে জায়গাটা বিক্রি না করতে। কিন্তু আমার বাবার রোজ রোজ অশান্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে আমার মা ডিসিশন নিতে বাধ্য হলেন জমিটা বিক্রি কর দিতে।
আর জমি বিক্রি হওয়ার সাথে সাথে পুরো টাকাটা বাবা নিজের দখলে নিতে এক সেকেন্ড ও সময় নিলেন না।
সেই টাকা সমিতিতে খাটালেন। আমার খালারা অনেক বুঝালো এইসব সমিতি সব ধান্দাবাজ। যে কোন সময় টাকা পয়সা নিয়ে পালাবে। কিন্তু আমার বাবা কারো কথা শুনতেই নারাজ। তিনি যেটা ভালো বুঝেন, সেটাই ফাইনাল।
তো যেটা বলছিলাম। প্রকৃতি ছাড় দেয়, ছেড়ে দেয় না।
বাবা নিজে যৌতুক নিয়ে বিয়ে করলেও মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সময় যৌতুকের ঘোর বিরোধী।
আমি নিজে ও যৌতুকের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমার বিয়ে গুলো একের পর এক ভেঙে যাওয়াতে আমার মনের মধ্যে বদ্ধমূল একটা ধারণা জন্মে গেল যে বাবার কারণেই আমার আজ এই অবস্থা। এটা আল্লাহর তরফ থেকে বাবার ওপরে আল্লার এক ধরনের প্রতিশোধ। দোষ করেন বাবা মা। ফল ভোগ করতে হয় সন্তান দের!
এদিকে মা চাইছে জমি বিক্রির কিছু টাকা ভাইয়া কে দিতে। ভাইয়া যেন কিছু একটা শুরু করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।
কিন্তু ঐ যে বললাম, এ সংসারে আমার মায়ের কথার কোন দাম নেই। তার নিজের টাকা। অথচ সে ছুঁয়েও দেখতে পারবেনা।
বেশ কয়েক মাস বাবা সমিতি থেকে ইন্টারেস্টের চকচকে টাকার নোট নিয়ে এসে ভালো মন্দ বাজার করতে শুরু করলো। তার চেহারায় একটা আনন্দ ঝলমলে ভাব। তার ধারণা সে সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেন।
ছয় মাস পর একদিন বাবা মুখ অন্ধকার করে ঘরে ফিরলেন। তার যে মেজাজ গরম আমরা সবাই বুঝতে পারছি। কিছু ববলার আগেই চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়িঘর মাথায় তুলছে।
পরের দিন ভাইয়া খবর আনলো যে, যে সমিতিতে টাকা রাখা হয়েছিলো। রাতের অন্ধকারে কোটি টাকা নিয়ে গায়েব হয়ে গেছে তারা। অফিসে বড়ো একটা তালা ঝুলছে। গ্রামের মানুষের মাথায় হাত। গ্রামের সহজ-সরল মানুষ গুলো নিজেদের জমিজমা বিক্রি করে টাকা রেখেছিল বেশি লাভের আশায়। এখন তারা সবাই সর্বশান্ত!
আমি রাত জেগে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে পানাহ চাই। আমার বাবার ভুল গুলো ক্ষমা করে তিনি যেন আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকান। নিজের বিয়ের জন্য আল্লাহর কাছে চাইতে অনেক লজ্জা লাগে। তারপরও মাঝ রাতে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে একজন উত্তম চরিত্রের জীবন সঙ্গী চাই।
একদিন আল্লাহ আমার ডাকে সত্যি সত্যি সাড়া দিলেন।
আমার জন্য খুব ভালো একটা প্রপোজাল আসলো। ছেলে ইন্জিনিয়ার। ঢাকায় চাকরি করে। আমাকে কলেজে যাওয়ার সময় দেখে তার খুব ভালো লেগেছে।
কোন দেনা পাওনা ছাড়াই বেশ আয়োজন করে আমার বিয়ে হয়ে গেল। বাবা তার সাধ্যমত খরচ করলেন আমার জন্য।
ছেলে দেখতেও রাজ কুমারের মতোই সুন্দর।
বাসর রাতে আমি খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে, প্রতিষ্ঠিত সুন্দর একটা ছেলে ডিমান্ড ছাড়া আমার মতো এমন নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে কেন বিয়ে করবে? নিশ্চয় কোন কিন্তু আছে।
কিন্তু ওর ছোট্ট একটা কথায় আমার সব ভুল ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
মুখ দেখে আমার হাতে আংটি পরিয়ে দিয়ে বললো, ঐশ্বর্য আজ থেকে তোমার সব দায় দায়িত্ব আমার। আমরা দুজন এখন থেকে খুব ভালো বন্ধু হয়ে থাকব।
সবাই বিয়ের আগে প্রেম করে। আমরা না হয় বিয়ের পর প্রেম করলাম। আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো তোমাকে ভালো রাখতে।
তবে একটা অনুরোধ আছে।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম চোখ তুলে।
সে বললো, একসাথে থাকতে গেলে মান অভিমান হবেই। কিন্তু আমাদের সমস্যা আমরা নিজেরাই মিটাব। কখনো আমার বা তোমার পরিবারের কাছে কোন কিছু জানাবে না। আমি চাই না আমাদের মধ্যে কোনো তৃতীয় পক্ষ আসুক।
এসো এখন অজু করে নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করি।
আমি ওর সাথে নামাজে দাঁড়িয়েছি। অন্য রকম এক ভালো লাগায় ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার মন।
আমি স্বপ্নেও ভাবিনি এতো ভালো একজন মানুষকে আমি আমার জীবন সঙ্গী হিসেবে পাব।
মোনাজাতে চোখের পানি আটকাতে পারলাম না।
মোনাজাত শেষ করে দেখি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও আমার দিকে।
খুব আলতো করে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু খেলো।
আর আমার পুরো শরীর শিরশির করে কেঁপে উঠলো স্বর্গীয় ভালোলাগায়।
বি: দ্র: গল্প নয়, সত্যি।
-ঐশ্বর্য
কলমে - রোকেয়া পপি।