বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প | কষ্টের কিছু বাস্তব কথা

 বাস্তব জীবনের গল্প

বাস্তব জীবনের গল্প

আমার বউ টা যখন আমার একটা ডাকে ওর বাপ মা ছাইড়া চইলা আইলো তখন তার বয়স কত জানো মানিক ভাই? তার বয়স মাত্র পনেরো বছর তখন। আমার মায় কিন্তু আগের যুগের শাশুড়ী গো মতনই। আমার ছোডো বউ পালার মন তার আছিলো না। মায়ের কথা আছিলো বউ হইছে সংসার করবো গৃহস্থালি সব কাম করবো ছোডো, পারি না এইয়া আবার কি কথা? আমার বউডার কষ্ট হইতো। ছোডো থাইকা ঢাকায় বড়ো হইছে। বাপ মায়ের আদরের মাইয়া দুই টা ভাইর আদরের একটা বুইন  কোনোদিন মনে হয় না গ্যাস ধরাইয়া চা ও জ্বাল দিছে। অথচ আমার বাড়ি দুই চুলায় পাতা,গোবর দিয়া রান্ধা,গরু আছে, ধান, তিল, বাদাম, সরিষা। মায় দুই জন কামের মানুষ ছাড়াইয়া দিলো। বাড়িতে বউ আছে ফাও ফাও কামের মানুষরে পয়সা দিবে ক্যা? এইডাই ছিলো মায়ের যুক্তি। 

এর পর তো মায়ের খিটমিট। উনিশ বিশ হইলেই সারাদিন গা-লা-গা-লি তো ফ্রী আছিলো। একলা একলা বিয়া করছিলাম মায়ের মুখে মুখে কইতে ও পারতাম না কিছু। 

বউডা কেমন জানি বোবা হইয়া গেছিলো। তিনমাস যাইতে না যাইতে কেমন শুকাইয়া কালা হইয়া গেলো হলুদ পাখির মতন বউডা আমার। সারাদিন পর বাড়ি গেলে আধা রাইত ফুরাইতো ওর কান্দোন হুইন্না আর আধা রাইত ফুরাইতো কেমনে ওরে বাঁচান যায় এইডা চিন্তা কইরা। অমনে আর একটা মাস থাকলে ও ম*ইরা যাইতো। 

একদিন সকালে বউডারে ডাকতে ডাকতে খোঁজে গিয়া গরু ঘর দিয়া বাইর করলাম। জানো মানিক ভাই যাইয়া দেহি খালি মাথা আর চেহারায় গোবর লাগে নাই। সারা গায়ে গোবর। বুকটা চিপি মাইরা উঠলো। ও গোবরের গন্ধ সইতে পারতো না। মায়রে কইছিলাম যত কাম ই করাও গরু ঘরে পাডাইও না। শহরের মাইয়া আগে দেখুক একদিন আর পাডান লাগবে না, ওর অভ্যাস হউয়া যাবে তহন ও  নিজেই যাবে। 


ওই সময়ই হাত ধইর বাইর কইরা আনলাম। আর ঘরে ও ওডলাম না। বাহির হইয়া আইলাম। দোকান তো তহন নতুন। তবুও আল্লার নাম লইয়া একটা বাসা লইলাম। আল্লারে কইলাম যদি কাম ডা ভুল না করি তুমি ফালাইয়া দিও না। "


মানিক নামের লোকটা দাঁড়ানো থেকে বসেছে অনেকখন। দোকান বন্ধ করে এসেছিলো আরেক দোকানদার শাহআলম কে ডাকতে। আজকে হাটবারে তাদের ব্যবসা রমরমা ছিলো।  নিয়মিত না হলেও ব্যবসা ভালো হলেই মানিক বাইজি পারা ঘোরে। কোন নতুন কম বয়সী বাইজি তকমার নারী নেশায় ডুব দেওয়া তার যৌবন কালের অভ্যাস। সাথে থাকে লাল সাদা পানীয়।  বাড়িতে শুধু বললেই হয় আজকে দোকানে থাকবে। এভাবেই গত ত্রিশ বছর মাঝে মাঝে ই স্বাদ বদল করা তার গোপন চারিত্রিক বৈশিষ্ট। আজকে এসেছে শাহআলম কে ডাকতে। শাহআলমের মরুভূমির মতো জীবনের জন্য তার মায়া লাগে। বউডা চার বছর প্যারালাইজড। ওই বউ দিয়া শাহআলমের কোনো কাম যে হয় না তা মানিক ভাই নিশ্চিত। 

মানিকের দিকে তাকিয়ে শাহআলম মুচকি হাসলো। দাঁড়ানো থেকে সেই থেকে বসা অবস্থায় মানিক খুব মন দিয়ে শাহআলমের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শাহআলম আবারও বলে উঠলো,


" ওই হানে যদি কপাল পো*ড়া র সুখ হইতো তাইলে তো ভালোই ছিলো। বাসা লওয়ার একবছরের মাথায় ফয়সাল ওর মায়ের পেটে আইলো। কি খুশি যে হইছিলো মানিক ভাই! আমি বিয়ার দেড় বছরে ওরে ওইদিন চোক্ষে পানি নিয়া ও হাসতে দেখছি। আমার কেমন ব্যবসায় বরকত আইতে লাগলো। মুদির পাশাপাশি ওই বার ডাইল রাহি করলাম প্রথম। ফয়সাল যহন ছয় মাসের পেটে তহন আমি এক্সিডেন্ট করছি। হাঁটু গুঁড়া গুঁড়া হইয়া গেলো। প্রাণ ডা রইয়া গেলো। তিনমাস পঙ্গু হাসপাতালে ছিলাম। ও আমারে থুইয়া একটা দিন ও লরে নাই হাসপাতাল দিয়া৷ ওর যহন আটমাস শেষ প্রায় পা ফুইল্লা গেলো। এত কই তুমি তোমার বাপের বাড়ি যাও ও শোনে না। ততদিনে শ্বশুর বাড়ি তে মাইনা লইছে। আমার দোকান শালায় সামলায়। মায় ও নরম হইছে কিছুডা বাড়ি দিয়া যাওয়ার ছয়মাসের পরে হইতে। হাসপাতালে আমার বুইন থাকতে পারে মায় পারে। কিন্তু ও কয় থাকেন তবুও আমি ওরে থুইয়া যামু না। একদিন রাগ আর আটকাইতে পারি নাই কষাইয়া একটা থা*প্পড় দিছিলাম। এত কই বাসায় যাও বাসায় যাও হুনেই না। কত বড়ো বেহায়ায় তবুও যায় নাই। "


 শাহআলমের চিকচিক করা চোখের দিকে মানিক ভাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বোধ হারা হয়ে গিয়েছে। মস্তিষ্কে অতীত এসে দাঁড়িয়ে মগজের নালী গুলো চিনচিন করে উঠলো। বুকটা কেমন চিপে এলো। শাহাআলম নাক টানলো অথচ মুখে হাসি। চোখের পাপড়ি গুলো ভিজে গেছে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই শাহআলমের। কাঁধের গামছা দিয়ে পুরো মুখ মোছার সাথে বোধহয় চোখ ও মুছে নিলো। নাক টেনে আবারও বললো,

 " ফয়সাল হওয়ার অনেক দিন পরে ও আমি সুস্থ হইলাম না। পায়ে রড ঢুকানো। ভাজ করতে পারি না। ব্যাথা অসহনীয় থাকে প্রায় সময়। ডাক্তার কইছিলো পা ক-ই-টা ফেলানো লাগতে পারে নইলে পইচা ক্যান্সার হইয়া যাবে। 

একদিন কইলাম তানিয়া আমি যদি ম-ই-রা যাই..

সাথে সাথে আমার কলার চাইপা ধইরা আমার দিকে এমন ভাবে চাইয়া রইলো মনে হইছে আমারে চোখ দিয়া খাইয়া ফালাইবো। কতখন পরে নিজেই জরাইয়া ধইরা কাইন্দা দিছে। কইলাম এমন রাগ তো থা-প্প-র খাইয়া ও হও নাই। জানো মানিক ভাই বউডা সেই দিন ও ফয়সাল পেটে আসার মতন চোখে পানি নিয়া হইসা দিছিলো। কইছিলো, মা-র-ছো তো রাগে আর আমার ভালোর কথা চিন্তা কইরা। "

আমি অবাক হইয়া জিগাইলাম আচ্ছা কও তো ক্যান অমন জেদ কইরা ছিলা? কত রাগ লাগছিলো এউডা কি জানো? ও কইলো,

- আমি তো একদম অচল হইয়া গেছিলাম না তহন ও। যদি ও অনেক কষ্ট হইতো। তবুও তো চলতে পারতাম। আমি চলতে পারা অবস্থায় তোমার গোপন কাজ গুলা অন্য কেউ করবে এইডা আমি ভাবতেও পারতাম না। হউক সে তোমার মা বা বোন। "

জানেন যতদিন নিজের নিজের পায়খানা প্রসাব করতে না ও যাইতে পারছি আমি একটু সময় ও নাপাক থাকতাম না। ও আমারে একটু সময় ও নাপাক ফেলাইয়া রাখতো না। " 


এখন বলেন মানিক ভাই - যে নিজের বাচ্চার পায়খানা প্রসাব পরিষ্কার করার আগে মাসের পরে মাস আমার টা করছে তার দুর্দশা দুর্দিনে আমি যদি মুখ ফিরাইয়া থাকি তাইলে আয়না দেখমু কেমনে? "


মানিক ভাই নিরুত্তাপ ভাবে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। কি ভাবছে বোঝা যাচ্ছে না। তার মায়ের কথা মনে পরলো। যখন রাহেল কে বিয়ে করে আনলো রাহেল তখন তেরো বছর বয়সী।  আর মা পচন রোগী। মায়ের নিচের দিকের বিভিন্ন জায়গায় পচন ধরছিলো। জীবিত মানুষের গোশত পঁচা গন্ধে ঘরে টেকা দায় ছিলো যদি প্রতি বেলা পরিষ্কার না করা হইতো। মানিক বাজার দিয়ে ফিরে আগে খাইতো কাচারি ঘরে। অথচ তিনবেলা রাহেল ছোটো নরম হাতে পরিষ্কার করতো ক্ষত। লিকলিকে শরীরে রাহেলকে পান পাতার মতন লাগতো। মানিক তখন থেকেই বাইজি বাড়ি যায়। অথচ একদিন ও কেন বুঝলো না মায়ের পঁচা গন্ধে রাহেল দিনের পরে দিন অভুক্ত থাকতো!! নিজের মা তবুও মানিক বাড়ি যেতো না মাঝে মাঝে অথচ ছোটো রাহেল কি করে...  

বুকে মনে হয় একটা মোরচ দিলো। শক্ত করে চোখের পাতা বন্ধ করে ঝট করে উঠে দাড়ালো।  উল্টো দিকে পা বাড়ালে শাহআলম পিছু ডাকলো, 


" পথ কি ভুইলা গেলা?"

মানিক ভাই থামলো। ফিরে এসে একবার জরিয়ে ধরে বললো,

" ঠিক পথেই হাটছি শাহআলম ভাই। বড়ো বাজার বন্ধ হইয়া যাবে একটা শাড়ী কিনমু তোমার ভাবির লইগা। তুমি ধীরে সুস্থে বন্ধ কইরা আও"


শাহআলম বেশ কিছু সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন মানিক ভাইয়ের পথের দিকে। শুভ্র লুঙ্গি পড়া মাঝ বয়সী লোকটা চোখে আড়ালে গেলে ই আসমানে তাকালেন। আন্দাজ করতে পেরে মুচকি হাসি চলে আসছে অধর কোনে।

.


গতরাত থেকেই বকুল গাছটার নিচে কাঁদায় বসে আছে মানিক ভাই। বৃষ্টি হইছে যার জন্য কাঁদা আর পিচ্ছিল মাটি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। পাশেই পরে আছে লাল শাড়ীর ছেড়া ব্যাগটা।শাড়ি টা ও কাঁদার মধ্যে গড়াগড়ি করছে।  শাহআলম এসে কাঁধে হাত রেখে নরম কন্ঠে বললো,


--" মানিক ভাই এবার ঘরে লও। হায়াত মউতের উপর কি কেউর হাত আছে? রাহেল ভাবির হায়াত এডুকই ছিলো। এমন করলে মুর্দারের কষ্ট হয়। কাপড় পাল্টাইয়া জানাজায় লও৷ আর রাখা যাইবো না দাফন করতে হবে "


--" চাচা উনি যদি আম্মার জানাজায় না থাকে আমাদের সমস্যা নাই। ওনাকে বিরক্ত করবেন না। আমরা চার ছেলে বোনের জামাই এরাই খাটিয়া তুলে আম্মাকে নিয়ে যেতে পারবো। "


--" এভাবে কইও না বাবা... উনি তোমার বাপ। আর মানিক ভাই নিজেরে পাল্টাইয়া ফালাইছে"


--" আসলেই চাচা। উনি আমার বাবা। আমার মায়ের  ত্রিশ বছরের জীবনে একটা কালো জগৎ উনি। বড়ো সন্তান হিসেবে আমি আমার মায়ের সব চাপা আর্তনাদের সাক্ষী। উনি হয়তো-বা জানেন না বাইজি বাড়ি ঘোরাঘুরি করতে যে মিথ্যার আশ্রয় উনি নিতেন আমার মা সব জানতেন!! দোকানে থাকবে বলে উনি কোথায় থাকতেন তা-ও আমার মা জানতেন। পাপ কি চাপা থাকে চাচা? থাকেনা। উনি কালকে আমার মায়ের জন্য শাড়ি কেনার আগ মুহূর্তে একই দোকান থেকে আমি কাফন কিনেছি। বাড়িতে বলে গিয়েছিলো কাল রাতেও ফিরবে না। তাই আমি ও ওনাকে বিরক্ত করি নাই। নিজেই মায়ের কাফন কিনে এনেছি। 

আমার মা সব কিছু থেকে বাহিরে। আর কিছু আমার মা কে স্পর্শ করতে পারবে না। ওনাকে বলুন ওনার কেনা শাড়িটা নিয়ে বাইজি বাড়ি ফিরে যেতে। "


--" কইয়া লাভ কি? মায়ের লা*শ দাফন কর। ভাইজান কি জানতো তোর মায় মইরা গেছে?  না জাইনা ই শাড়ি লইয়া আইতেছিলো। ভাইজান বদলাইয়া গেছে "


--" ঠিক বলছো ফুফু তোমার ভাইজান বদলাইছে। না হয় আমার মায়ের জন্য শাড়ি কিনতে পারতো না। তবে জানো ফুফু সময় থাকতেই যদি উপলব্ধি  না ফিরে তাহলে না ফেরাই ভালো। কবরে গিয়ে তুমি যখন বুঝতে পারবে পৃথিবীতে যা করেছো সব ভুল ছিলো সেই উপলব্ধি আসবে আহারে কি করলাম অথচ কি করা উচিত ছিলো। তোমার ভাইয়ের বদলানোটা ও আমার মায়ের জন্য সেরকম "


রাহেল নেই তিনমাস। মানিক ভাই এখন নামাজের সময় নামাজ পড়ে। বাজারে আসতে যাইতে রাহেলের কবর জিয়ারত করে। মাথায় টুপি থাকে। ছেলেরা কেউ বাড়িতে থাকে না। মেয়েদুটো ও শ্বশুর বাড়ি। হোটেল ছাড়া ভাত খাওয়া হয় না। রাহেল থাকতে কখনো দোকান থেকে এসে দরজায় ঠকঠক করা লাগতো না। রাহেল দরজায় বসে থাকতো দরজা খুলে। অথচ আজ....!! চারদিকে ফাঁকা শুনশান নীরবতা.. ”


সমাপ্ত


উপলব্ধি

অনুগল্প

Nafesa Jannat


এমন আরও বাস্তব নতুন নতুন গল্প পড়ুন।