গল্প:আড়াল | খুব কষ্টের ভালোবাসার গল্প

 খুব কষ্টের গল্প

খুব কষ্টের গল্প

আমার স্ত্রী যখন গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে তখন আমি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে পরে ছিলাম। আমাকে বেঁধে আমার সামনে ওকে ধর্ষন করা হয়েছে তাই বারবার চিৎকার করে নিষেধ করা সত্বেও সে আমার সামনে আত্মহত্যা করে। যদিও আমি জোরে চিৎকার করতে পারি নাই কারণ আমার মুখও বাঁধা। 


যেদিনের কথা বলছি সেদিন ছিল শুক্রবার। 

এই নদীতে শুক্রবার ছুটির দিনে মানুষের একটু চাপ বেশি থাকে, মাগরিবের অনেক পরে আমি বাড়িতে গেলাম। বউ আমার জন্য গরম ভাত নিয়ে  বসে ছিল, চুলোর উপর নিবু নিবু আগুনে তরকারি ছিল। বৈঠা রেখে টিউবওয়েল থেকে হাতমুখ ধুয়ে ঘরের মধ্যে গেলাম। বউ গামছা এনে আমার হাতে দিয়ে নিজে ভাত বাড়তে চলে গেল। একসঙ্গে খাবার শেষ করে যখন ঘুমাতে গেলাম তখন রাত এগারোটা। 


সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে বিছানায় শুয়ে একটু পরে ঘুমিয়ে গেলাম, কিন্তু মাঝরাতে বউয়ের ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। 


" বউ বললো, কে যেন তোমাকে ডাকে। "


আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম, তারপর সত্যি সত্যি যখন শুনলাম আমাকেই ডাকছে তখন আমি বিছানায় শুয়েই জিজ্ঞেস করলাম:- 


" কে আপনি? "


" নাবিল মাঝি দরজা খোল, তোমার সঙ্গে একটু জরুরি কথা আছে! "


" আমি বললাম, এতো রাতে কিসের কথা? কাল সকালে আসবেন তখন কথা হবে। "


" কালকে সকালে খুব ভোরবেলা তোমার নৌকা নিয়ে ঘুরতে চাই, বিদেশি কিছু মানুষ আছে তারা সূর্য ওঠার আগে নদীতে ঘুরতে চায়। আমরা তো তোমার কথা চিন্তা করে এসেছি, তোমার অনেক সুনাম আছে। "


এমন কথা শুনে আমি দরজা খুলতে গেলাম, যেহেতু তেরমুখ সেতুর এইখানে আমি নৌকায় করে মানুষকে ঘুরাই। তাই আমার কাছে মানুষ আসতেই পারে, তাছাড়া বিদেশিদের তো আবার সখের শেষ নেই। 


কিন্তু দরজা খুলে দেবার সঙ্গে সঙ্গে ৪/৫ জন মানুষ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো। তাদের সবার মুখে কালো মুখোশ পরা, আমি কিছু বলার আগেই ওরা আমাকে ঘিরে ধরে। তারপর ওদের সঙ্গে আনা রশি দিয়ে আমার হাত-পা বেঁধে ফেলে, মুখে শক্ত কাপড় দিয়ে বাঁধে যার জন্য কোন আওয়াজ করতে পারি নাই। এরপর আমার চোখের সামনে ওরা আমার স্ত্রীকে...


আমরা যেখানে থাকি এটা একটা বিলের মতো, অনেকটা আশেপাশে কোন বসতবাড়ি নেই। তাই টুকটাক সামান্য শব্দ কেউ শুনতে পেল না, আমি পাথর হয়ে পরে রইলাম। 


সবাই যখন চলে গেল তখন আমার স্ত্রী আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। পরনের কাপড় ঠিক করে কোনমতে বিছানা ছেড়ে উঠে আমার সামনে এসে বললো:- 


" গতকালই জানতে পেরেছি আমি মা হতে যাচ্ছি, ভেবেছিলাম কালকে সকালে বলবো। কিন্তু ওরা সবকিছু শেষ করে দিয়ে চলে গেছে, আমাকে ক্ষমা করে দিও। " 


এ কথা বলেই আমার স্ত্রী নিজের ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দিলো। আমি আমার চোখের ইশারায় আর গোঙানির শব্দে তাকে ফেরাতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। চোখের সামনে স্ত্রীর ঝুলন্ত লাশের দিকে তাকিয়ে সেই ভয়ঙ্কর রাতটা পার করতে কতটা কষ্ট হয়েছে বোঝাতে পারবো না। 


সকাল হলো, আমার সঙ্গে আরেকটা ছেলে নৌকা চালায় তার নাম ফিরোজ। ফিরোজ প্রতিদিন সকালে আমাকে সঙ্গে করে তারপর নদীতে যেত। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে দরজা খোলা দেখে ভিতরে প্রবেশ করলো। আর সঙ্গে সঙ্গে ঝুলন্ত লাশ ও আমার অবস্থা দেখে চিৎকার করে উঠলো। 


আমার ইশারা দেখে তাড়াতাড়ি আমার বাঁধন খুলে দিল, তারপর আমি শক্তিহীন শরীর নিয়ে দৌড়ে গিয়ে স্ত্রীর লাশ নামালাম। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম কিন্তু সেই কান্নার কোন ফল ছিল না। 


পুলিশ আসলো, 

রাতের সমস্যত ঘটনা আমি বললাম, অজ্ঞাত নামে মামলা হলো। আমার স্ত্রীর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে গেল, দুরের প্রতিবেশীদের উপস্থিতিতে নিরুপায় আমি বসে রইলাম মাটিতে। 


স্ত্রীর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সেদিন আর হাতে পেলাম না। পুলিশ বললো লাশ নাকি আগামীকাল সকালে পাবো, তাই রাতটা অপেক্ষা করতে হবে। 


মাগরিবের পরে নিস্তব্ধ বাড়ির মধ্যে আমার সঙ্গে ফিরোজ ও জামাল ছাড়া কেউ ছিল না। চোখের পানি ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে, একটু পর পর মনে হচ্ছে এখনই হয়তো কেউ একজন ভাতের জন্য ডাক দেবে। 


হঠাৎ করে চোখের সামনে স্ত্রীকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলাম। তার পরনে গতকাল রাতের সেই পোশাক, ঠিক যেন সেই লাশটা আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। 


- আমি বললাম, তুমি আসছো? 


- সে বললো, হ্যাঁ গো না এসে কি করবো? ওরা আমাকে একটা বন্ধ ঘরের মধ্যে একা একা ফেলে রেখেছে। আমার বড্ড ভয় লাগে, তোমাকে ছাড়া আমি তো থাকতে পারি না। 


- তাহলে চলো, ঘরে চলো। 


- না তার আগে কলপাড়ে গিয়ে গোসল করতে হবে, শয়তান গুলো আমাকে অপবিত্র করেছে। তুমি তো এখনো আমাকে গোসল করালে না, আমি কি কখনো এভাবে থেকেছি। 


- না তো। 


- তাহলে চলো। 


আমি ওর পিছনে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছি, সামনে অন্ধকার তবুও তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মনে হয়। কিন্তু আরেকটু সামনে গিয়ে আর খুঁজে পাচ্ছি না আমার স্ত্রী কে, চারিদিকে ঘন অন্ধকার। সামনে পিছনে চারিদিকে তাকিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি কিন্তু কোন কিছুর দেখা পেলাম না। হঠাৎ করে কিছু একটার সঙ্গে জোরে ধাক্কা লাগলো, আমি মাটিতে পরে গেলাম। 


তাকিয়ে দেখি আমি পরে আছি আমার থাকার স্থান থেকে অনেকটা দুরে বটগাছের কাছে। কিন্তু এতদূর কখন এলাম? আমি তো মাত্র কিছুটা পথ এসেই তাকে হারিয়ে ফেলেছি, তাহলে কি সেটা স্বপ্ন ছিল? আমি কি তাহলে স্বপ্ন দেখে তন্দ্রার মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে এসেছি? 


কারো বিকট বিভৎস হাসির শব্দে চমকে গেলাম, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি চারজন দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে। অন্ধকারে তাদের কারো মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে। 


হঠাৎ করে ওদের মধ্যে একজন বললো " এটাকে তাহলে এখনই মেরে ফেলি, নাহলে আবার নতুন কিছু ঝামেলা হতে পারে। "


 " আরেকজন বললো, স্ত্রী হারানোর বেদনায় খুব কষ্ট পাচ্ছে বেচারা, তারচেয়ে বরং তাকেও তার স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দাও। তাহলে বেচারা নিজেও শান্তি পাবে, আর আমরাও নিশ্চিত থাকবো৷ " 


" প্রথমজন বললো, গতকাল রাতেই ওকে মেরে আসা উচিত ছিল, তাহলে এখন আবার কষ্ট করে আসার দরকার ছিল না। "


" দ্বিতীয়জন বললো, তখন তো বুঝতে পারিনি যে এর স্ত্রী আত্মহত্যা করবে। ভেবেছিলাম গরীব তাই চুপচাপ সহ্য করতে পারবে, কিন্তু আত্মহত্যা করে জীবন দেবে ভাবিনি। "


" প্রথমজন বললো, আমাদের তিনজনের চেয়ে তুই একাই বেশি অত্যাচার করছো। মেয়েটা তো আত্মহত্যা না করে উপায় নেই। " 


চতুর্থ একজন হাত দিয়ে কিছু ইঙ্গিত দিল, আর প্রথমজন তার মুখের কাছে কান নিয়ে কি যেন শুনে চুপ হয়ে গেল। 


আমি মনে মনে ভাবলাম, বাকি দুজন কোনকিছু বলছে না। তারা কি আমার পরিচিত? 

সিদ্ধান্ত নিলাম যেভাবেই হোক সকাল বেলা স্ত্রীর লাশ দাফন করার আগে ওদেরও দাফনের জন্য উপযুক্ত করতে হবে। কিন্তু যেহেতু ওরা চারজন তাই কৌশলে সবকিছু করতে হবে, স্ত্রীর কান্নার তীব্র কষ্টগুলো কানের কাছে বাজছে। 


হাতের কাছে শক্ত কিছু অনুভব করছি, নিজের হাত দিয়ে অন্ধকারে সেটাকে আঘাত করে ইট বলে মনে হচ্ছে। সেটাকে হাতে নিলাম, ওদের মধ্যে দুজন একটু দুরে সরে গেছে আর বাকিরা দাঁড়িয়ে আছে। আমি আস্তে আস্তে দাঁড়ালাম, আর এক কদম করে এগিয়ে গিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে একজনের মাথায় আঘাত করলাম। এমন করে আঘাত করেছি যেন হাত দিয়ে ইট পরে না যায় কারণ নাহলে তো ওরা আমাকে মেরে ফেলবে আর আমি পারবো না ওদের সঙ্গে। 


আঘাত সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে পরে গেল মাটিতে, বাকি লোকটা হয়তো কি করবে সেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কিন্তু ততক্ষণে আমি তাকেও এক আঘাত করে বসলাম, যদিও দুজনেই আহত হয়ে গেছে কিন্তু মরেনি। বাকি যে দুজন ছিল ওরা একটু এগিয়ে এসে আবার পিছনে পালিয়ে গেল। 


এমন সময় প্রথম যাকে আঘাত করেছি সে আমার পিঠে গাছের ডাল দিয়ে আঘাত করলো। জানিনা কতটা লেগেছিল কিন্তু আমার মনের মধ্যে তখন শুধু ওদের হত্যা করার আকাঙ্খা। মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দেরি না করে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে শুরু করলাম দুজনকেই।


সকাল বেলা চারিদিকে ছড়িয়ে পরলো যে দুজন যুবক খুন হয়েছে বাগানের মধ্যে। আমি স্বাভাবিক ভাবেই বাড়িতে ছিলাম, সবাই ঠিকই বুঝতে পেরে গেল আমি খুন করেছি। আমার স্ত্রীর লাশ নিয়ে আসার আগেই আমাকে থানায় নিয়ে এলো। 


---


চোখের চশমা খুলে পানি মুছলেন দারোগা সাহেব। তার সামনে বসেই এতক্ষণ নিজের স্ত্রী ধর্ষন হয়ে আত্মহত্যা করার কাহিনি বলছিল নাবিল মাঝি। বৃদ্ধ দারোগা সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেল, এ সমাজ কত নোংরামি দিয়ে ভর্তি হয়ে গেছে। 


রাত বারোটা, দায়িত্বে নিয়োজিত প্রায় সকলেই নিবু নিবু চোখে ঢুলছে। দারোগা সাহেব জেলের তালা খুলে নাবিলকে বের করলেন। তারপর নিজে সঙ্গে করে নিয়ে বের হয়ে গেলেন অজানা উদ্দেশ্য নিয়ে। 


নাবিল যে বাড়িতে থাকতো সেই বাড়ি থেকে কিছু দুরে দারোগা সাহেব নাবিলকে নিয়ে উপস্থিত হলো। সেখানে দুজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে, তারা হয়তো জানে না নাবিল দারোগা সাহেবের সঙ্গে। কিন্তু নাবিল জানে ওরাই সেই বাকি দুজন, কারণ দারোগা সাহেব আগেই তাকে বলেছে। 


সেদিন সকালে যখন দুজনের লাশ পাওয়া গেছে তখন এরা দুজনেই প্রথম নাবিলের কথা বলে এক বাক্যে। কিন্তু আজ যখন নাবিল চারজনের কথা বলেছে, তখন দারোগা সাহেব স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে যে বাকি দুজন এঁরাই ছিল। তাই তো তিনি নাবিলের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্তি করার জন্য নিয়ে এসেছে। আর এদেরকে বলেছেন যে তোমরা থাকো, জরুরি কথা আছে। নাবিলের শাস্তির বিষয় বিভিন্ন কুপরামর্শ দিয়ে আসছিল এরা। 


নাবিলের হাতে আগেই বিশাল অস্ত্র দিয়েছেন দারোগা সাহেব, যেটা দিয়ে অনায়াসে এক কোপো ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করা যায়। 


---


পরদিন সকাল। 


গ্রামের মধ্যে হৈচৈ হচ্ছে, আরো দুজন খুন হয়েছে কিন্তু কে করলো খুন? নাবিল তো জেলের মধ্যে তাহলে এদের খুন করেছে কে? দারোগা সাহেব নিজেও সেই খুনের ঘটনাস্থলে গিয়ে জনগণের ভিড় থামানোর চেষ্টা করছেন। রক্তাক্ত জখম হয়ে খুন হওয়া লাশের দিকে তাকিয়ে সবাই আৎকে ওঠে, কেউ কেউ "ভালো হয়েছে" বলে চলে যায়। এরা এতদিন অনেক অত্যাচার করেছে, সবার সঙ্গে অসম্মান করতে তারা একরোখা ছিলো। 


লাশ দুটো ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে দারোগা সাহেব হাজতে আসলেন। নাবিলকে গতকাল রাতেই আবার হাজতের মধ্যে রাখা হয়েছে, নাবিল এখন আর মন খারাপ করে নেই। চোখ বন্ধ করে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সে। জীবনের কিছু গোপনীয় কথা থাকে, যেগুলো সবসময় সম্মুখে প্রবেশ করে না। কারণ জগতে অনেক কিছু থাকে সেই " কিছু কথা কাঁদে আড়ালে "। 

গল্প__আড়াল

     ,,,,,,,,,,,,, সমাপ্ত,,,,,,,


বাস্তব জীবনের গল্প ও ঘটনা পড়ুন।