আপুর বিয়ে চোখে পানি চলে আসবে | বাস্তব গল্প

 বিয়ে নিয়ে স্ট্যাটাস

বিয়ে নিয়ে স্ট্যাটাস

ছোট আপার বিয়ের সময় আমি সবার আড়ালে ছিলাম। বিদায়ের সময় আপাকে দেখলাম এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজছে। বড়ো আপা ছোট আপার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,


"কিরে বিন্দু কাকে খুঁজছিস?"


"আপা সোহা কোথায়? ওকে দেখছি না যে।"


"তাই তো। সোহা কোথায় গেল?"


পাশ হতে কে যেন উত্তর দিলো,


"সোহা তো বিয়ের শুরু থেকেই নাই।"


আমি কিছুটা দূরেই উঠানের শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা কাঁঠাল গাছটার নিচে লুকিয়ে ছিলাম। ছোট আপা এদিকে তাকাতেই আমি তার চোখের আড়াল হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। ছোট আপা ভারি শাড়িটা পড়ে গটগট করে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধরে বললো,


"তুই এখানে কী করছিস হ্যা? আমাকে বিদায় দিবি না?"


আপা কথাটা স্বাভাবিকভাবে বললেও আমার চোখ ছলছল করছিল। কোনোরকমে কান্না আটকিয়ে আপার সাথে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।


"সোহা তুই আজ এতো চুপচাপ কেন? আজ তো তোর সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়া উচিত। আমাকে তো সবসময় বলতিস আমার বিয়ের সময় খুব মজা করবি। তাহলে এমন লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন রে?"


আমি কী বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।


"এই মেয়ে কী সমস্যা তোর? যাওয়ার সময় একটু কথা ও বলবি না আমার সাথে? আমাকে হাসিমুখে বিদায় দে। এই যে শশুর বাড়ি চলে যাচ্ছি। এখন থেকে আর কেউ তোর উপর চিল্লাচিল্লি করবে না। আর কেউ তোকে কাজ করার জন্য হুকুম করবে না। রাতের বেলা ঘুমানোর সময় বলবে না, পা টিপে দে। রাত দুইটা/তিনটার দিকে ঘুম ভাঙিয়ে বলবে না, পানি খাবো। পানি এনে দে তো একটু। তুই পড়তে না বসে ফোনে গেম খেললে, ইউটিউবে ভিডিয়ো দেখলে বকা দিবে না আর কেউ। তোর তিন আপুর মধ্যে সবচেয়ে অপছন্দের আপুটা আজ চলে যাচ্ছে এই বাড়ি ছেড়ে। এরপর যখন আসবো তখন তো দুই দিনের অতিথি হয়ে আসবো। আপ্যায়ন করবি তো? আবার রাগ করে চলে যেতে বলিস না যেন। এরপর আসলে আর তোকে জ্বালাবো না বুঝলি।"


আপার কথাগুলো শুনে আমি আপাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিলাম। সবাই যে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, সেদিকে আমার কোনো খেয়াল নেই। আমি নিজের মতো কেঁদেই যাচ্ছি। আপা হয়তো কিছুটা অবাক হয়েছে। আমার পিঠে আলতো করে হাত রেখে নিজের সাথে আরো কিছুটা জড়িয়ে নিলো। আমার কাঁধে তরল কিছু অনুভব করতেই বুঝলাম, আপাও কাঁদছে।


"এই কাঁদছিস কেন তুই? কষ্ট হচ্ছে? আমি চলে গেলে তো আর আমার সাথে ঝগড়া করতে পারবি না। বড়ো আপা আর মেজো আপার কাছে নালিশ করে বকা খাওয়াতে পারবি না। আম্মা অর্ধেক অর্ধেক করে ভাগ করে খাবার দিলে বেশিটুকু খাবার নিজে খেয়ে আম্মাকে বলতে পারবি না, তোমার আরেক মেয়েই বেশি খেয়ে আমাকে কম দিয়েছে। এজন্য মন খারাপ?"


আপার কথা শুনে আমার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল। ধরে যাওয়া গলায় বললাম,


"আপা, আমি তোর সব কথা শুনবো। তুই যখন যেটা করতে বলবি সেটাই করবো। আর তোর অবাধ্য হবো না। তোর পা টিপে দেওয়ার সময় চিমটি দিয়ে হাসবো না। তোর চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে দৌড়ে পালাবো না। বড়ো আপা আর মেজো আপাকে দিয়ে বকা খাওয়াবো না। তবুও তুই আমাকে ছেড়ে যাস না। তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না আপা। তুই শশুর বাড়ি যাস না প্লিজ।"


"ধুর পাগলি মেয়ে, আমি কী সারাজীবনের মতো চলে যাচ্ছি নাকি? মাঝে মাঝে আসবো তো। আর তোর যখন ইচ্ছা তখনই চলে আসবি আমার কাছে। এখন যেতে না করছিস কেন? এতদিন তো আমার কবে বিয়ে হবে? কবে চলে যাবো? এসব নিয়ে চিন্তা করতিস। আজ যখন চলে যাচ্ছি তখন এভাবে কাঁদছিস কেন?"


"ওসব তো আমি রাগ করে বলতাম। মন থেকে বলতাম না। আমার তোকে ছাড়া একটুও ভালো লাগে না রে আপা। তোকে ছাড়া আমার খুব একা একা লাগে। তুই চলে গেলে রাতে আমার সাথে কে ঘুমাবে? আমি না ভূতে ভয় পাই। মাঝরাতে কে আমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাবে? কে আমার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে ঠান্ডার মধ্যেও আইসক্রিম এনে খাওয়াবে আমাকে? আমার আবদারগুলো কে পূরণ করবে? তোকে ছাড়া আমাকে কেউ এতো ভালো বোঝে না।"


"আমার লক্ষ্যি বোন। আর কাঁদিস না। বিয়ের পর প্রতিটা মেয়েকেই তার বাপের বাড়ি ছেড়ে শশুর বাড়ি চলে যেতে হয়। এটাই নিয়ম। তোকেও একদিন শশুর বাড়ি যেতে হবে। আমি  প্রতিদিন ফোনে তোর খোঁজ খবর নিবো। তোর কোনোকিছু দরকার হলে আমাকে বলবি। লজ্জা পাওয়ার দরকার নেই। আর শোন নিজেকে এবার একটু গুছিয়ে নিস। সময়মতো গোসল করে খাবার খেয়ে নিবি৷ নামাজ পড়ার সময় বাহানা করবি না একদম। আম্মার কথা শুনবি। আর মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। দেখি এবার কান্না বন্ধ কর।"


কথাটা বলেই আপা আমার গালে হাত দিয়ে পানি মুছে দিলো। আপার চোখেও পানি টলমল করছে।


"তোকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু যেতে তো হবেই। মন খারাপ করিস না। একটু হাস তো। তোর হাসিমুখ দেখে যাই। এমন করে কান্না করলে তোকে পেত্নীর মতো লাগে।"


কথাটা বলেই আপা ফিক করে হেসে দিলো। আমি জানি এটা জোরপূর্বক হাসা। আপারও যে অনেক কষ্ট হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি আমি।


কিছুক্ষণ পর সবার থেকে বিদায় নিয়ে আপা গাড়িতে ওঠে। যাওয়ার সময় গাড়ির জানালা দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আপা খুব কাঁদছিল। আমি এসব সহ্য করতে না পেরে ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে বিছানার শুয়ে বালিশের উপর মুখ গুঁজে কাঁদছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, আমি খুব মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলেছি সেদিন।


এখন আর কেউ আমাকে শাসন করে না। কোনো কাজের জন্য হুকুম করে না। সারাক্ষণ ফোন নিয়ে পড়ে থাকলেও কেউ বকা দেয় না। আগে এসব বিরক্ত লাগলেও এখন এসবই প্রচন্ড রকম মিস করি আমি।


প্রতিটা মেয়েই হয়তো তার বোনের বিয়ের সময় বুঝতে পারে সে অনেক মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলছে। বড়ো বোনদের যখন বিয়ে হয়ে যায় তখনকার মতো বাজে অনুভূতি হয়তো আর কোনোকিছুতে নেই।


এসব ভেবেই ডুকরে কাঁদতে লাগলাম আমি।


"আপা তোকে আজ খুব মনে পড়ছে রে। তোকে হয়তো বলা হয়নি, তোকে খুব ভালোবাসি রে আপা। খুব ভালোবাসি।"


★সমাপ্ত★


এমন আরও গল্প পড়ুন।